শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 27
পঁচিশ বছরের জন্মদিন পালনটা রূপের একদম পছন্দ নয়। একে তো একটা ধেড়ে ছেলে, তার ওপরে বেকার। তার আবার জন্মদিন। পনের বছরের জন্মদিনটা খুব ঘটা করে পালন করা হয়েছিল। প্রত্যেক বছরই পিসিরা আসে, সে বছর আরও কেউ কেউ এসেছিলেন। পিকনিক, সিনেমা, গান, কিন্তু সেসব দিনের কথা রূপ মনে আনতে চায় না। জন্মদিন আবার কি! করতেই যদি হয়, তো পায়েস-ফায়েস করে খাইয়ে দিলেই তো হয়। লোককজন ডাকা আবার কি। কিন্তু বন্দনা কিছুতেই শুনবে না। আসলে তাদের জীবনে উৎসবের সুযোগই নেই। অথচ মাঝে মাঝে পাঁচজন অতিথি এসে হই-হল্লা করলে ভালো লাগে। শেষে রূপ বলল,—‘ঠিক আছে আমার কয়েকজন বন্ধুকে বলব, কিন্তু তাদের তুমি বলতে পারবে না অকেশনটা কি।’
বন্দনা বলল—‘তোর বন্ধুরা অনুপ, কিশোর, সন্দীপ, সুমন সবাই জানে।’
রূপ চুপ করে গেল। আসলে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে তার আজকাল আর যোগাযোগ নেই। এই সুযোগে সে অঞ্জু অংশুদের গ্রুপটাকে বাড়িতে আনবার কথা ভাবছে।
কথা ঘোরাবার জন্য সে বলল—‘আমার পঁচিশ বছর বয়স হয়ে গেল? ইসস মা।’
বন্দনা হেসে বলল—‘বয়স তো বেড়ে যাবেই রে। দুঃখ কেন?’
—‘দূর এতো চেষ্টা করছি, এখনও পর্যন্ত একটা চাকরি জোগাড় করতে পারছি না।’
—‘চাকরির বাজার ক্রমশই খারাপ হচ্ছে রে রূপু। টেকনিক্যাল কোয়ালিফিকেশন না থাকলে খুব মুশকিল। যাই হোক, এম-এটা তো করে ফেলেছিস। একটা ঠিকই পেয়ে যাবি।’
—‘মা, তোমাদের ওখানে হয় না, না?’ রূপ সাহস করে বলেই ফেলল। বন্দনা বলল—‘আমাদের ওখানে ইউনিয়ন এতো স্ট্রং, তাদের বায়নাক্কাও ভীষণ। সেরকম কোনও ওপনিং হলে আমি চেষ্টা করব। তবে সে সম্ভাবনা কম।’
অনুপম সোম এখন পার্সোনেল ম্যানেজার। কোনক্রমেই বন্দনা তাকে। জানাতে পারবে না সে এখানে ছেলের চাকরির চেষ্টা করছে।
—‘মা, পিসেকে একবার বলে দেখবে?’
বন্দনা বিষন্ন হয়ে গেল। বলল—‘দেখ রূপু অন্য লোকেদের যা-যা থাকে আমাদের তার অনেক কিছুই নেই। শুধু সম্মানটা আছে। তোর পিসি পিসে সত্যিকারের ভালো লোক, আমাদের হিতৈষীও। সেবার তুই ইনটারভিউটাতে গিয়ে পৌঁছতে পারলি না, সঞ্জয়কে খুব অপদস্থ হতে হয়েছিল। ও অবশ্য আমায় কিছু বলেনি। কিন্তু এখন যদি চাকরির জন্য ওকে ধরি, ওর সম্মান নষ্ট হবে। আমারও নষ্ট হবে।’
অসন্তুষ্ট মুখে রূপ বলল—‘তোমরা যে কি বলো মা। কোনকালে কি ঘটনা ঘটেছিল, সঞ্জয় পিসের অফিস-অলারা কি সব মনে করে রেখেছে?’
বন্দনা বলল ‘এক কাজ কর না। তুই নিজেই পিসেকে গিয়ে বল না। তাহলে তোর আগ্রহটাও বুঝবে।’
কথাটা রূপের মনে লাগল। সঞ্জয় পিসে খুব মাই-ডিয়ার লোক। সেবার সে কৈফিয়ত দিয়ে এসেছিল পায়ের ব্যাণ্ডেজ দেখিয়ে। পিসেমশাইয়ের মুখ থাকেনি অফিসে, কিন্তু তাকে তেমন কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন—‘আরে তুমি একটা ইয়ংম্যান, পায়ে ব্যাণ্ডেজ নিয়েই আসতে। কি ক্ষতি ছিল? আর জ্যাম-ট্যাম থাকলে সেরেফ হেঁটে মেরে দেবে, তোমার পা-গাড়ি তো আর কেউ কেড়ে নিচ্ছে না। জীবনে উন্নতি করতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হবে মাস্টার।’
সঞ্জয়-পিসের কাছে একবার বোধহয় যাওয়া যায়। বাড়িতে না। অফিসে। যেতে হবে পার্ক সাকাস। এসপ্লানেড থেকে বাস বদল করতে হবে। প্রোসেশন বেরিয়েছে দেখে রূপ বাস থেকে নেমে পড়ল, হ্যারিংটনে ঢুকে পড়ল, চৌরঙ্গি রোডে এখন গাড়ি বহুক্ষণ থেমে থাকবে। হঠাৎ ডান দিকের বিল্ডিংটায় ওর চোখ আটকে গেল, এই বাড়িটার তিন তলায় ‘পেগাসাস অ্যাডভার্টাইজিং’এর অফিস। রূপ ঢুকে পড়ল। তিনতলায় উঠেই চিনতে পারল জায়গাটা। যদিও আরও অনেক সাজ-সজ্জা হয়েছে, চতুর্দিক কাচে মোড়া, দেয়ালে দেয়ালে মুর্যাল। ঠাণ্ডা ঝলক চতুর্দিক থেকে। বদলেছে, তবু চেনা যায়, নির্দিষ্ট ঘরের সামনে গিয়ে পিওনকে চিরকূট দিল। লিখবে নিজের নাম? যদি দেখা না করেন? নাঃ, লিখে ফেলা যাক, যা হয় হবে।
চিরকূট পাঠাবার পর মুহূর্তেই পিওন এসে বলল—‘যান, ডাকছেন।’ ভেতরে ঢুকতে রূপের পা বেধে যাচ্ছে। খানিকটা মোটা কার্পেটের কারণে, খানিকটা অন্য কারণে। টেবিলের ওধারে দেয়াল ভর্তি নানান সাইজের, নানান প্রকারের বিজ্ঞাপনী ছবির পটভূমিকায় সুদীপ্তকাকুর সাদার ছোঁয়া লাগা কালো চুল। ভারি চশমা। সিগারেটের ধোঁয়ায় কালচে ঠোঁট, আঙুল। সেই মুখ সামান্য ভারি।
—‘কি ব্যাপার? বসো।’
রূপ সসঙ্কোচে বলল—“আপনি ভালো আছেন, মাস্টারমশাই।’
—‘কেন তোমার কি সন্দেহ আছে তাতে?’ সুদীপ্ত হেসে বললেন, —‘তারপর কি করছ? আঁকাটা একেবারেই ছেড়ে দিলে?’
—‘আবার ধরব ভাবছি, কিছু কিছু অলরেডি এঁকেছিও। দু-একটা। ধরুন বইয়ের প্রচ্ছদ। কিছু কিছু অ্যাড-এর লে-আউট। জাস্ট ফর ফান…’ রূপ একটু ইতস্তত করে থেমে গেল।
সুদীপ্ত খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন—‘তুমি কি চাকরি খুঁজছ রূপু?’
রূপ চুপচাপ মুখ নিচু করে বসে। কিচ্ছু বলতে পারছে না।
সুদীপ্ত বললেন—‘তুমি পরদিন তোমার কাজগুলো নিয়ে এস, ধরো কাল কি পরশুর মধ্যে। আর এই অ্যালবামটা দিচ্ছি দেখ একটু বসে।’ সুদীপ্ত ড্রয়ারের মধ্যে থেকে একটা বিরাট অ্যালবাম বার করলেন। রূপ দেখতে লাগল। সুদীপ্ত রূপকে দেখতে লাগলেন। একবারও তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন না।
আজ রূপ মাকে চমকের পর চমক দিচ্ছে। ‘মা, এই হল অংশুমান আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু। এ অঞ্জু, এই প্রদীপ’, মার মুখে সামান্য বিস্ময়। অনুপ, সন্দীপদের যে সে বলেনি একথা রূপ মাকে জানায়নি। বন্ধুদের সঙ্গে বান্ধবীদের সংযোজনের কথাও না।
জলি বলে উঠল ‘মাসিমা, আপনাকে কি সুন্দর কি ইয়ং দেখতে। অভিরূপের দিদি বলে মনে হয়।’
বন্দনা অবাক হয়ে তাকাল। এরকম কথা যে তার মেয়ের বয়সী একটি মেয়ে এভাবে বলতে পারে সেটাই তার কাছে আশ্চর্য। সে কথা ঘোরাবার জন্য বলল—‘তোমাদের কাউকেই আমি আগে দেখিনি। রূপ আগে এদের সঙ্গে পরিচয় করাসনি তো।’
—‘টাইম নিচ্ছিল’ অঞ্জু দাঁতে নখ কাটতে কাটতে জবাব দিল, তারপর বলল—‘অভিরূপ তোমার বাবার সঙ্গে আলাপ করাবে না?’
প্রদীপ বলল—‘এই অঞ্জু, কি বলছিস? জানিস না।’
জলি বলল—‘এ মা!’
বন্দনা একটু দাঁড়িয়ে থেকে বলল—‘তোমরা গল্প করো আমি আসছি। সে চলে যাবার পর সবাই অঞ্জুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রদীপ বলল—‘কি রে অঞ্জু জানতিস না অভিরূপের বাবা নেই?’
অঞ্জু একইভাবে দাঁতে নখ কাটতে কাটতে বলল—‘না বুঝতে পারলে কি করব?’
রূপ আশ্চর্য হয়ে ভাবল—সবাই জানে, অঞ্জু জানে না? হতে পারে? তাছাড়া অঞ্জুকে যেন সে নিজে একবার বলেছে। কবে কোথায় মনে করতে পারছে না, কিন্তু নিশ্চয়ই বলেছে।
সারা সন্ধে ঝমঝমে বাজনা বাজল রেকর্ডে, সমস্বরে গান তার সঙ্গে অন্যান্যবারের মতো টেবিলে খেতে দেওয়া গেল না। রূপ এক ফাঁকে মাকে এসে বলল—‘মা তুমি আমায় একটা একটা করে প্লেট দিয়ে দাও, আমি নিয়ে যাচ্ছি। ওরা গানে গল্পে এতো মেতে আছে যে টেবিলে এসে খেতে চাইছে না।’
টেবিল ফুল দিয়ে সাজিয়েছে বন্দনা, খাবারগুলো সব বুফের জন্য আলাদা আলাদা প্লেটে রাখা, বলল—‘ঠিক আছে নিয়ে যা।’ ছটা প্লেটই রূপ একে একে বয়ে নিয়ে গেল, দ্বিতীয়বার আরও কিছু নিতে এল রূপ। তৃতীয়বার এল জলি।
—‘মাসিমা রান্না দারুণ হয়েছে। চাটনি আর কাটলেটটা আর একটু দিন না।’ বন্দনা বলল—‘চলো না আমি যাচ্ছি, দিয়ে দিচ্ছি।’
জলি হেসে বলল—‘ওখানে আপনি যেতেই পারবেন না। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় অন্ধকার, সাদা কাঠি পেছনে লুকোলেও টের পাবেন।’
বন্দনার নির্দেশমতো হাতটা ধুয়ে নিয়ে জলি কাটলেট আর চাটনি নিয়ে গেল। ছেলের জন্মদিনের আমোদ আহ্লাদ রূপের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রইল, পরিশ্রমের ভাগটুকু মায়ের। রান্নাঘর আর দালানের মধ্যে কয়েকবার ঘোরাঘুরি করে বন্দনা তার সেই তৃতীয় ঘরের একলা জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আজকেও তার জানলার তলায় অন্ধকারের বৃত্ত। অথচ চার পাশে আলো জ্বলছে। এই বাড়ির সামনের আলোটাই বার বার খারাপ হয়ে যায়। রাস্তার আলো মুখে পড়ে না বলে একরকম স্বস্তিও হয়। রূপের বন্ধুবান্ধবীরা হই হই করে চলে গেল। সদর দরজার কাছে হল্লার শব্দ। ‘ফির মিলেঙ্গে’, ‘রূপচাঁদ চলি।’ ‘অভিরূপ মাসিমাকে বলে দিস ফার্স্টক্লাস খেলাম।’
পাঁচটি ছায়ার পেছন পেছন ষষ্ঠ ছায়া রূপও ওদের এগিয়ে দিতে গেছে। রাত এখন সাড়ে দশটা। মেয়ে দু-টি কোথায় থাকে, কিভাবে পৌঁছবে। বন্দনার একটু ভাবনা হল, এরা নিশ্চয়ই সে ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু কিরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন সৌজন্যহীন ধরন এদের। মেয়ে দু-টিও ছেলেদের সঙ্গে সমানে তাল দিচ্ছে। এরকম ধরনের মেয়ে বন্দনা কোনদিন দেখেওনি, কল্পনাও করেনি।
নিচে খিল তোলার শব্দ হল। দু তিনটে সিঁড়ি টপকে টপকে রূপ ওপরে আসছে। এত খুশি তাকে যেন বহুদিন দেখেনি বন্দনা।
—‘মা, মা।’
—‘কি রে?’ রূপ ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
রূপ ঝলমলে মুখে বলল—‘ওঃ মা যা রেঁধেছিলে আজ। তুলনা হয় না। ওরা সবাই বলল ফাটাফাটি।’
বন্দনার মুখে পাতলা হাসি ভেসে উঠেছে, বলল, ‘তুই খুশি হয়েছিস?’
জবাব না দিয়ে রূপ মাকে জড়িয়ে ধরল। রূপের ঠোঁটের ওপর একটুকরো গোঁফ ছিল ক’দিন আগেও। কামিয়ে ফেলেছে। মুখটা একটু অপরিচিত লাগে। মাথায় ওর অনেক নরম চুল, বোধহয় খুব নেচেছে কুঁদেছে। তাই এলোমেলো হয়ে আছে। রূপের মুখ ওর ঠাকুমার মতো, একটু গোলগাল, দাঁতগুলো হাসলে দেখা যায়। ঠোঁট দুটো টুকটুকে লাল ছিল আগে, এখন বোধহয় সিগারেটের গুণে একটু মেরুন-বেগুনি রং ধরেছে। রূপ তার বাবার মতো লম্বা নয়, মাঝারি দোহারা চেহারা, একটু অসাবধান হলেই থলথলে হয়ে যাবে। বন্দনার মনে হল, রূপ বড় হয়নি। বড় হবেও না কোনদিন। যদিও ও নিজেকে খুব বড়ই মনে করে।
বন্দনার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে রূপ ধপাস করে খাটে বসে পড়ল—‘ওরা কেউ অকেশনটা বুঝতে পারেনি মা, পারলে এইসা প্যাঁক দিত।’
—‘প্যাঁক? সে আবার কি?’
রূপ বলল—‘পেছনে লাগা আর কি। আজকালকার এই ভাষাগুলো তোমাদের হয়ত বাজে মনে হবে, কিন্তু দারুণ এক্সপ্রেসিভ। মা ওদের কেমন লাগল তোমার?’
—‘কিছু লাগবার মতো আলাপ আর করালি কই।’
—‘ওরা আসলে তোমাকে একটু সমীহ করছিল। প্রথম দিন তো। জলি আর অঞ্জু আবার আসবে।’
আবার আসবে? বন্দনা চুপ করে রইল। তারপর তাক থেকে একটা বই পেড়ে বলল—‘রূপু তোর জন্মদিনের উপহার। রাসেলের অটোবায়োগ্রাফি। রূপ মোড়ক খুলে দেখল। বন্দনা বলল—‘একটু একটু করে পড়বি। ফিরে ফিরে পড়বি।’
রূপ বলল—‘তা তো বটেই। আচ্ছা মা ওদের মানে জলি আর অঞ্জুকে কেমন লাগল?’
—‘কোনজন জলি? কোনজন অঞ্জু?’
—‘ওই যে ভায়োলেট শাড়ি পরা ওইটে অঞ্জু।’
বন্দনা বুঝতে পেরেছিল, তবু জিজ্ঞেস করল। মেয়েটি চোলি পরেছিল চুমকি দেওয়া। গোছা গোছা বেগুনি কাচের চুড়ি।
মেয়েটি অভিরূপের বাবার সঙ্গে পরিচিত হতে চেয়েছিল। সে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল—‘ও জানে না তোমার বাবা অনেকদিন চলে গেছেন!’
রূপ অপ্রস্তুত মুখে বলল—‘খুব বেশিদিনের আলাপ তো না, হয়ত বলিনি।’
—‘অনুপদের সঙ্গে কি আজকাল তোমার সম্পর্ক নেই?’
—‘তা থাকবে না কেন? কিন্তু এরা একটা আলাদা গ্রুপ, হয়ত মিশ খাবে না, তাই বলিনি।’
—‘ওদের সঙ্গে মিশ খাবে না, তোর সঙ্গে খেল কি করে?’
রূপ মাথা চুলকে বলল—‘তোমার ওদের পছন্দ হয়নি, না?’
বন্দনা একটু হেসে বলল—‘পছন্দ হবার মতো নয়, সেটা তুই নিজেই বুঝতে পারছিস তাহলে।’
—‘অঞ্জুকেও তোমার ভালো লাগেনি, না?’
বন্দনার ভেতরে এবার ইলেকট্রিক শক। তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
—‘মা কথা বলছ না কেন?’ রূপ ঝুঁকে পড়ে বলল—‘ভালো অবশ্য না-ও লাগতে পারে, বাইরে থেকে ওকে দেখলে একটু উদ্ধত মনে হয়।’
—‘ভেতরটা উদ্ধত নয় বলছিস?’
রূপ আর পারল না—‘মা শী ইমপ্রুভস্ অন অ্যাকোয়েন্ট্যান্স। ওকে যদি বিয়ে করতে চাই?’
—‘এই তো বলছ বেশিদিনের আলাপ নয়, ভালো করে না বুঝে সুজে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিও না রূপ!’
রূপ ঢোক গিলল। বলল—‘না, এক্ষুনি করছি না। চাকরি টাকরি পাই! মা, ওকে অনেকেই বিয়ে করতে চায়, আমি বেশি দেরি করলে…ও রাজি হয়েছে।’
—‘তোর কি বিয়ের কথা ওকে বলা হয়ে গেছে?’
—‘হ্যাঁ, না, মানে একরকম—হয়েই গেছে।’
বন্দনা গম্ভীর গলায় বলল—‘এতো তাড়াতাড়ি কিছু ঠিক করো না রূপ। অনেকে ওকে বিয়ে করতে চায় বলছ, তুমি একটু দেরি করলেও ও যদি তোমার প্রতি অনুগত থাকে তাহলেই বুঝবে…’
—‘মা প্লীজ, ওকে না হলে আমি বাঁচব না। আমাকে তাড়াতাড়ি করতেই হবে।’
বন্দনার একবার মনে হল বলে—কাউকে না হলে কারুর বাঁচা আটকায় না। সাময়িক ভাবাবেগ, উচ্ছ্বাস এসব রূঢ় বাস্তবের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। কিন্তু এসব বলে কোনও লাভ নেই। একদিন ছেলেকে সে প্রায় এইভাবেই মিনতি করেছিল। ছেলে সেখানে রুদ্র প্রলয়ঙ্করের ভূমিকা নিয়েছিল। বন্দনার মনের গহনে সেই ভালোবাসা এখন চোরা নদীর মতো আটকে পড়ে আছে। তাতে স্রোত বয় না। একটা কর্দমাক্ত দহ। কিন্তু চলছে তো জীবন! প্রথম প্রথম যে দারুণ কষ্ট হত, মনে হত সব ছেড়ে-ছুড়ে পাগলিনীর মতো দরজা-জানলা হাট করে খুলে রেখে সে বরাবরের মতো কোথাও বেরিয়ে যায়। এখানে, এই ঘর-কন্নায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে সময়ে দীর্ঘদিন রূপকে দেখলে তার ঘৃণা হত। নিজের মনোভাবে সে নিজেই ভয় পেয়েছে, কষ্ট পেয়েছে। সুদীপ্তকে দেখলে তাকে কুটি-কুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হত। বিরাট একটা প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হত। এসব কি ভয়ের কথা নয়! বন্দনা সেই সব বিভীষিকার দিন দাঁতে দাঁত চেপে পার হয়ে এসেছে। কাউকে জানতে দেয়নি। কলিকে পর্যন্ত না। জানতে দিতে প্রচণ্ড লজ্জা। বন্দনা নিজের দুঃখের কথা কাউকে জানাতে লজ্জা পায়। আত্মমর্যাদার মানটা এত উঁচুতে তুলে ফেলেছে যে কারুর কাছে দুর্বল হতে পারে না। সুদীপ্ত অনেক দূরে সরে গেছে। আসে না, কিন্তু দুতিন মাস অন্তর অন্তর একটা করে চিঠি দেয়। সে চিঠি রূপের হাতে পড়লেও কোনও অসুবিধে নেই।
রূপ বলল—‘মা, একটা কথা বলব? রাগ করবে না?’
—‘আমার রাগের কত তোয়াক্কা তুই করিস।’
—‘না আমি সীরিয়াসলি বলছি। আমি অঞ্জুকে বিয়ে করি, তারপর তুমি…’
—‘তারপর আমি কি রে? চলে যাব এখান থেকে? না মরে যাব?’
—‘কি যে বলো! তারপর তুমি সুদীপ্তকাকুকে…’
বন্দনা চমকে উঠল। একটু পরে আস্তে আস্তে বলল—‘এখন আর তা হয় না।’
—‘কেন হয় না?’
—‘অনুভূতির জগতে যা ভেঙে যায়, তাকে সারিয়ে-সুরিয়ে নিয়ে আর কাজ চলে না।’
—‘কেন, সুদীপ্তকাকু তো এখনও তোমায় চিঠি দেন। মা আই অ্যাম সরি।’
—‘চিঠি দেন হিতৈষী বন্ধু হিসেবে। কিন্তু রূপ সব কথা তোমাকে বোঝাতে পারব না। তোমার এতদিনে সময় হল বলেই আমার সময় হবে না। আমার আর সে মন নেই। আমি বুড়ো হয়ে গেছি।’
রূপ হেসে বলল—‘আমার বন্ধুরা বলছিল, তোমাকে আমার বড় দিদির মতো দেখতে লাগে, অনায়াসেই বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যায়।’
—‘রূপ, তোমার আগের বন্ধুরা স্বপ্নেও মায়ের সম্বন্ধে এ ধরনের কথা বলা ভাবতে পারত না।’
—‘এরা একটু ঠোঁট কাটা। কিন্তু মনে মুখে এক হওয়াও তো একরকমের ভালো।’
—‘সব কথার, সব ব্যবহারের স্থান-অস্থান, পাত্রপাত্র ভেদ আছে রূপ, সেগুলো অস্বীকার করলে সভ্যতার শর্তগুলোই অস্বীকার করা হয়।’
—‘অঞ্জু উইল চেঞ্জ মা, দেখ।’
—‘না বদলালেই কি তুই আমার কথা শুনবি?’ বন্দনা হাল-ছাড়া গলায় বলল, ‘যা বলি তোর ভালোর কথা ভেবেই বলি, তুই তোর রুচি মতো চলবি, শুধু রুচিটা নষ্ট না হয়ে যায় এটাই ভাবি।’
রূপ বলল—‘ও মাই সুইট মাদার, রুচি যুগে যুগে পাল্টায়। আমাদের যুগটা তোমাদের থেকে এক্কেবারে আলাদা…’
—‘তাহলে আমার মতো সেকেলে রুচির সঙ্গে আর থাকতে পারবি না বলেই কি আমায় বিদায় করতে চাইছিলি?’
রূপ বলল—‘উঃ, তুমি যে কী বলো! আমি তোমার সুখের কথা ভেবেই বলেছি। তুমি যেমন আছ, তেমনি থাকবে। আফটার অল দিস ইজ ইয়োর ফাদার্স হাউজ।’
বন্দনা চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। ছেলেও একই ভাবে তার কোলের ওপর থুতনি দিয়ে। রুচির অমিলটা এখনই স্পষ্ট করে ধরা পড়েছে। বন্দনার বাবার বাড়িতে রূপের বউ যদি থাকতে না পারে, তাহলে কি রূপই চলে যাবে?
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে বলল—‘রূপু, তোর ছেলেবেলাকার দিনগুলো র কথা মনে পড়ে? স্কুল থেকে এসে মাকে না দেখলে কেমন করতিস?’
—‘মনে পড়ে মানে? ফীলিংগুলো শুদ্ধ মনে আছে।’
—‘দিন কত বদলে যায়!’
—‘মা ডোন্ট বি সিলি। এখনও যদি ওইরকম নেই-আঁকড়েগিরি করি তোমার কি ভালো লাগবে? আই অ্যাম এ গ্রোন আপ ম্যান নাউ।’ বন্দনা হেসে বলল—‘সত্যি! তুই গ্রোন-আপ ম্যান আর আমি গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি।’
রূপ বলল—‘ইউ আর এ গ্র্যান্ড অ্যান্ড লাভলি মাদার। আমার প্রস্তাবটার কথা ভেবে দেখলে পারো। আমি সুদীপ্তকাকুর কাছে গিয়েছিলাম। হী ইজ আনচেঞ্জড্।’
বন্দনা চমকে, বলল—‘গিয়েছিলি? এই বলতে?’
—‘না, তা নয়। চাকরির জন্য।’
—‘চাকরির জন্য? ওঁর কাছে? রূপ!’
—‘কেন, কি হয়েছে তাতে?’ রূপ কাঁধ নাচাল। জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মায়ের দিকে, পেছন ফিরে। ‘উনি আমাকে চাকরি দিচ্ছেন। হী ইজ এ গুড গাই। নিশ্চয়ই আমার জন্যে দিচ্ছেন না। মা’—রূপ ফিরে দাঁড়াল, —‘আই ফীল ওবলাইজ্ড্ টু হিম। তুমি রাজি হয়ে যাও। নইলে আই’ল ফীল ভেরি ব্যাড অ্যাবাউট ইট।’
—‘সে ক্ষেত্রে চাকরিটা নিও না।’ ঠাণ্ডা গলায় বলে বন্দনা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
হঠাৎ ভীষণ ভয় লাগল বন্দনার। যাকে খুব আপন জন বলে জানি, আদ্যোপান্ত চেনা, হঠাৎ যদি দেখা যায় সে প্রতারক, যাকে ভাই বলে জানি, সে ভাই নয় ভাই সেজে এসে এতদিন ঠকিয়েছে, ছেলে আসলে ছেলে নয়, কোনও অচেনা মানুষ একরকম চেহারার সুযোগ নিয়ে ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে গেছে, তাহলে যেরকম আতঙ্ক হয়, এ সেই ভয়ানক আতঙ্ক। যে রূপ মা বিয়ে করতে যাচ্ছে শুনে ঘৃণায় বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল তাকে সে তবু খানিকটা চেনে। কিন্তু আজ যে নিজের স্বার্থের জন্য মাকে বিয়ে করতে বলছে সেই রূপকে তার একদম অপরিচিত লাগল। তার বুকের ভেতরটা হু হু করছে। খাঁ খাঁ করছে। না না, রূপ নিশ্চয়ই এভাবে বলেনি। এ ভেবে করেনি কাজটা। হয়ত ও সত্যিই এখন অনেক পরিণত হয়েছে। মায়ের সুখের কথা ভেবেই প্রস্তাবটা দিতে পেরেছে। মাস্টারমশাইয়ের ওপর পুরনো শ্রদ্ধা, আস্থা ফিরে এসেছে বলেই তাঁর কাছে চাকরি চাইতে যেতে পেরেছে। নিশ্চয়ই ব্যাপারটা কতটা নির্লজ্জতা হবে ও বুঝতে পারেনি।