শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 26
প্রদীপ বলল—‘আমি প্রস্তাব করছি, অভিরূপ আজ আমাদের সব্বাইকে পার্ক হোটেলে ডিনার খাওয়াবে।’
—‘আমি এই সাধু প্রস্তাব সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি,’ অংশু বলল। অঞ্জু একটা ঝটকা দিয়ে বলল—‘এটা তোমাদের খুব অন্যায়। এটা হতে পারে না। অভিরূপ এখন গার্জেনের হোটেলে খায়।’
অংশু বলল—‘কড়া ডোজ দিইছিস অঞ্জু, অভিরূপের জন্যে তোর প্রাণ কেঁদে উঠছে সেটাও অ্যাপ্রিশিয়েট করছি। কিন্তু বললে তো হবে না। অভিরূপ সাঁসালো পার্টি। একমাত্তর নয়নের মণি তার ওপর।’
অঞ্জু বলল—‘ঠিক আছে, আমি সংশোধনী প্রস্তাব আনছি অভিরূপ খাওয়াবে, তবে পার্ক হোটেল নয়, বসন্ত কেবিনে।’
হাত উল্টে প্রদীপ বললে—‘যা শালা। পার্ক হোটেল থেকে বসন্ত কেবিন। ইম্যাজিনেশন আছে অঞ্জুটার। হবে ওর। জীবনে কিছু পারবে।’ প্রস্তাব পাস হয়ে গেল।
অভিরূপ এতক্ষণে বলল—‘লে ল্লেঃ, পার্ক হোটেল! দেখেছিস কখনও ভেতরটা? কি ড্রেস পরে যেতিস যদি সংশোধনী ছাড়া প্রস্তাব পাস হয়ে যেত। আমি না হয় বাড়ি থেকে এনে টাকা ফেলে দিতাম।’
প্রদীপ বললে—‘কি ড্রেস দেখাচ্ছিস তুই বে! জানিস অদূর ভবিষ্যতে এসব হোটেল ফোটেল জনগণের হয়ে যাবে! তুই কি ব্রিটিশ আমল থেকে এলি নাকি? শালা কলোনিয়াল। এই অঞ্জু ওর কান মুলে দে তো!’
জলি বলল—‘এই তোমরা ব্যাকরণে ভুল করবে না একদম। অঞ্জু কি ওর শালী যে কান মুলে দেবে? কানমলার হক বউয়েদের থাকে না, শালীদেরই একমাত্র থাকে। দিই, অভিরূপ দিই!’
অভিরূপ একটু লাল হয়ে জলির বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে বলল —‘খবর্দার পকেট নিয়ে টানাটানি করছ কর। কান ফানে হাত দিতে এলে লাশ পড়ে যাবে।’
লাশ পড়ার কথায় সকলেই খুব হাসল। একে তো অভিরূপ এদের চোখে লালটুস, ক্যাবলা, তার ওপর ওদের ভাষা ভালো রপ্ত হয়নি, অথচ বলতে যায়। প্রয়োগে থেকে থেকেই নানারকম ভুল হয়।
আজকে ওদের সবারই আনন্দ মাত্রাছাড়া। কারণ অনেক দিন ঘোরাঘুরি করে অভিরূপ আজ অঞ্জুর ফাইন্যাল মত পেয়েছে। য়ুনিভার্সিটির আলাপ গড়াতে গড়াতে দু-তিন বছর হয়ে গেল, এখনও পুরো দলটার কফি-হাউজ অধিবেশন বন্ধ করার কোনও কারণ ঘটেনি। অংশুর প্রাইভেট টুইশন, প্রদীপ বাড়ির বাজার সরকার, বাজারের কমিশন থেকে খরচ চলে। অঞ্জু-জলি কিভাবে নিজেদের বাড়ি থেকে হাত-খরচ আদায় করে সেটা টপ সিক্রেট, ওরাই জানে।
বসন্ত কেবিনে কবিরাজি এবং ফাউল কারি দিয়ে উৎসব পালন করার পর অংশুরা নেহাত দয়া করে অভিরূপ আর অঞ্জুকে ছেড়ে দিল, বলল—‘যা যা, তোরা একটু ঘুরে ঘেরে আয়।’
অঞ্জুর পরনে কড়া কমলালেবু রঙের ছাপা শাড়ি। সেই একই রঙের লিপস্টিক, টিপ। প্রায় মাঝ-পিঠ অবধি চুল হর্সটেল করে বাঁধা—অঞ্জুর চোয়াল সামান্য উঁচু। নাকবসা। এবং ছড়ানো পৃথুল ঠোঁট। চোখ দুটি প্রতিমার চোখের মতো একটু ওপর দিকে বাঁকানো। চলনে বলনে, ভাষায় ভঙ্গিতে বেপরোয়া বিজয়িনীর প্রত্যয়। লম্বায় অভিরূপ তার থেকে ইঞ্চিখানেকের বেশি নয়। একেবারে গোলগাল, নধর, এক টুকরো কুচকুচে গোঁফ আর চশমায় হঠাৎ দেখলে গাম্ভীর্যটুকু ধরা পড়ে। ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, সে যেন ধরা পড়েই আছে।
বাইরে বেরিয়ে সে বলল—‘এই অঞ্জু, উট্রামে যাবে?’
—‘আউটরাম? ধুস! দিলুটা রোজ আমায় আউটরামে নিয়ে যেত। পকেট গড়ের মাঠ! ওসব গঙ্গা-ফঙ্গা আমার ভাল লাগে না।’ দিলু অভিরূপের পূর্বসূরী। সেই আণ্ডার-গ্র্যাজুয়েটের দিনগুলো থেকে দিলুর সঙ্গে অঞ্জুর প্রণয় পর্ব চলছিল। দিলু ওকে একটা আংটিও পরিয়ে দিয়েছিল। নানারকম মনকষাকষির পর অঞ্জু আংটিটা খুলে দিয়েছিল। দিলু বলেছিল—‘ফেরত দিচ্ছ। দাও। আমিও মরে যাচ্ছি না। তুমিও না। দিলুও দেখবে কত ধান থেকে তুমি কতো চাল বের করতে পার।’
দিলুর ব্যাপারটা অভিরূপ জানে। দিলুর পূর্বে যে একটি নওলকিশোর ছিল সে-কথাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিলুর নাম সে সহ্য করতে পারে না। বলল—‘দিলেটা একেন্নম্বরের বজ্জাত। ওর সঙ্গে তোমার কি?’
অঞ্জু সোজাসুজি বললে—‘আহা ন্যাকা! জানে না যেন।’
অভিরূপ হার মেনে বললে—‘ঠিক আছে, কোথায় যাবে বল।’
—‘সিনেমা! আবার কোথায়।’
—‘এখন? এখন তো ইভনিং শো আরম্ভ হয়ে গেছে! ঘণ্টা কাবার হতে চলল।’
—‘তাতে কি? আমাদের তো এয়ার কণ্ডিশনে বসা নিয়ে কথা! হলে বসে অঞ্জু বলল—‘তুমি ওদের মতো ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন আমার মাথায় আসে না। তোমার মাকে বলো যোগীন্দরে ঢুকিয়ে দেবে!’
কথাটা যে অভিরূপের মনে হয়নি তা নয়। কিন্তু সে জানে মাকে বলা বৃথা। নিজের কর্মক্ষেত্রে মা ভীষণ ডাঁট নিয়ে থাকে। ছেলের জন্যে উমেদারি করতে মায়ের মাথা-কাটা যাবে। বলল—‘ছাড়ো তো! সীরিয়াসলি লেগেছি যখন, ঠিকই পেয়ে যাব একটা।’
—‘দূর’ অঞ্জু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বছরের পর বছর ওয়েটিং রুমে বসে থাকতে আমার ভাল লাগে না। দিদির বিয়ে হয়ে গেল, বোনের বিয়ে হয়ে গেল, আমার বেলাই খালি যত বেকার রাঙা মুলো জোটে।’
অভিরূপ আহত হয়ে বলল—‘অঞ্জু প্লীজ, তুমি আর একটু ভদ্রভাবে কথা বলা অভ্যেস করো, নইলে তোমাকে আমি মায়ের কাছে নিয়ে যাব কি করে?’
অঞ্জু অম্লানবদনে বলল—‘যা বলেছ! অংশু-ফংশুর সঙ্গে মিশে আমার একটা পার্মানেন্ট ল্যাঙ্গোয়েজ প্রবলেম হয়ে গেল। কি যে করি। তোমার মা আবার যা, দেখলে ভয় লাগে।’
—‘ভয়? কিসের ভয়!’
—‘কী গম্ভীর। তার ওপরে সিলভার-টনিকে লাল হয়ে আছে। ডাঁটিয়াল। যাই বলো বাবা।’
অভিরূপ বলল—‘অঞ্জু, তুমি একটা ইমপসিবল, মা খুব ভালো লোক। একটু গম্ভীর বরাবরই। কিন্তু সেটা হাই-ব্ৰাণ্ড বলে নয়। অনেক শোক দুঃখ পেয়েছে তো। দেখ তুমি গিয়ে যদি হাসি ফোটাতে পারো।’
অঞ্জু ঘুরে বসে বলল—‘দেখ অভিরূপ, তুমি যদি ভেবে থাক, আমি তোমাকে বিয়ে করব, তোমার মায়ের মুখে হাসি ফোটাবার মিশন নিয়ে, তবে কাটো। এক্ষুনি কাটো।’
হল মোটামুটি ফাঁকা। ওদের সিট রীয়ার স্টলে। তবু অঞ্জুর শেষ কথাটার তীক্ষ্ণতায় দু চার সারি সামনে বসা কয়েকজন ভদ্রলোক ফিরে তাকালেন। চাপা গলায় বললেন—‘চুপ করবেন?’
অভিরূপ বলল—‘দেখলে তো? সত্যিই কিন্তু তোমার কথাবার্তার ধরন চেঞ্জ করতে হবে আমাদের বাড়ি যেতে হলে।’
অঞ্জু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল—‘দেখা যাবে।’
এই দলটার সঙ্গে অভিরূপের আলাপ-পরিচয় হয়েছে ইউনিভার্সিটি থেকে। ওর স্কুলের সঙ্গীসাথীরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকেনি। দু একজন বিদেশে চলে গেছে। কলেজের যে সবচেয়ে বন্ধু, সে-ও কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে এখন ট্রেনিং-এ আছে। অভিরূপের মুশকিল হল সে কিছুতেই একটাতে লেগে থাকতে পারে না। নইলে তার বুদ্ধি-শুদ্ধি একেবারেই খারাপ না। কমপিটিটিভ পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে গিয়ে অনার্সটা ভালো হল না, অনার্সটা করতে গিয়ে কমপিটিটিভ পরীক্ষাটাও না। তাছাড়া অনার্সের ফল খারাপ হয়ে যাওয়ায় সে এমনি দমে গেল, আর সর্বভারতীয় পরীক্ষার পড়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতেই পারল না। ইউনিভার্সিটিতে অনেক কষ্টে সুযোগ পাওয়া গেল পলিটিক্যাল সায়েন্সে। তার কলেজের সহপাঠীরা বরানগরে চলে গেল ইকনমিক্স পড়তে। অভিরূপ একদম একা পড়ে গেল। মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কে আজকাল কেমন একটা আড়ষ্টতা এসে গেছে। খারাপ রেজাল্ট দেখে মা খুব মুষড়ে পড়েছিল। ‘ইসস্, এতো খারাপ হল কেন রে, রূপ? তুই বড্ড দুটো তিনটে জিনিস একসঙ্গে করতে যাস। একূল-ওকূল দুকূল যায়।’
—‘গেছে গেছে, সবাই যদি এখন রঞ্জনলাল মুখার্জি না হতে পারে।’
কলির ছেলে রঞ্জন কলকাতার এক নাম করা স্কুলের নাম করা ভালো ছেলে। মা বলল—‘কারুর সঙ্গে তুলনা করবার দরকার কি?’
—‘তুলনা আমি করিনি, তুমি করছ।’
—‘আমি আবার কখন তুলনা করলুম?’
—‘মনে মনে করেছ। করা অবশ্য স্বাভাবিক। তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। আমার লাকটা তো গোড়া থেকেই খারাপ। একদম গোড়া থেকে।’
মা একটু চুপ করে থেকে বলল—‘রূপ, পরীক্ষায় ভালো মন্দ থাকবেই। আমি কথার কথা বলেছি। ও নিয়ে বেশি মন খারাপ করবার দরকার নেই। তুই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যা।’
‘—না।’ রূপ তীব্রস্বরে চিৎকার করে উঠল।
মা আস্তে আস্তে সরে গেল সেখান থেকে।
রাত্রে খেতে বসে নরম গলায় রূপ বলল—‘মা দেখ, এম-এতে আমি ভালো করবই।’
মা ভয়ে ভয়ে বলল—‘ইকনমিক্স পাবি তো?’
—‘এই মার্কসে ইকনমিক্স হবে না। আমাকে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়তে হবে। তবে আমার কথা লিখে রাখো যে যুগটা আসছে সেটা পল সায়েন্সের যুগ। তাছাড়া আই এ এসের জন্য তো আবার বসছিই।’
মা উদ্বিগ্নস্বরে বলল—‘এম-এটা করে নে না। তারপর আই এ এস-এর কথা ভাবিস।’
—‘এই জন্যেই তোমার সঙ্গে পরামর্শ করা চলে না। তুমি এতো ওল্ড ফ্যাশনড। এখন আর একেক্কে এক দুয়েক্কে দুই-এর দিন নেই। এখন একসঙ্গে সব করতে হবে। খেলাধুলো, পড়াশোনা, রাজনীতি, স—ব।’
মা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—‘রূপু, তুই সত্যিই এখনও বড় ছেলেমানুষ। একটু আমার কথা মেনেই দেখ না কি হয়। নিজের মতে চলে তো একটা রেজাল্ট…’
রূপ মাংসের বাটিটা ঠেলে দিল, বলল—‘দূর, খাব না, ভাল লাগে না।’
মা বলল—‘না, না তুই খেয়ে নে। আমি আর কিছু বলব না।’
রূপ দেখল পরের দিনই পিসি এল, পিসিতে মায়েতে কিসব গুঞ্জন হল, পিসি যাবার সময়ে বলে গেল—‘রূপু, তোকে তোর পিসে ডেকেছে, কাল পরশুর মধ্যে একবার যাস।’
যাবে না যাবে না করেও অভিরূপ গিয়েছিল। পিসে সে সময়ে একটা খুব লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিল। ওদের অফিসে সেলস-ট্রেনি নেওয়া হচ্ছে, রূপ যদি দরখাস্ত করে পিসে চেষ্টা করবে। রূপ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল—‘মার্কেন্টাইল ফার্মের চাকরিতে কি সিকিওরিটি আছে পিসে? সম্মানই বা কি? চাকরি হল সরকারি চাকরি। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস।’
পিসে হেসে বলেছিল—‘আমার কাছে তো এই চাকরিটাও বেশ সিকিওর আর বেশ প্রেসটিজিয়াসই মনে হচ্ছে রে। এসব চাকরিতে উন্নতির সুযোগ অনেক। ভেবে দেখ, এ সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না। এম-এ পাস করতে করতে বয়স বেড়ে যাবে।’
—‘ভেবে দেখি।’
বাড়িতে ফিরে মায়ের সঙ্গে একচোট হয়ে গেল।
মা বলল—‘সঞ্জয় কি বলল রে?’
—‘জানোই তো সব।’
—‘সত্যি জানি না।’
—‘কেন পিসিতে তোমাতে চুপিচুপি কি যে সব চক্রান্ত করলে আমার বিরুদ্ধে।’
মা গম্ভীর হয়ে বলল—‘পিসে তোমাকে কিছু যুক্তি পরামর্শ দেবে, তাই শুনেছি। বলতে ইচ্ছে হয় বলো, নইলে থাক।’
অভিরূপ বলল—‘আচ্ছা মা, আমাকে বইতে কি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ইউনিভার্সিটির মাইনে আর বইপত্রের টাকাটা কি খুব বেশি।’
—‘এ কথা কেন?’
—‘কই রঞ্জনলাল মুখুজ্জেকে তো কেউ চাকরির অফার করছে না। সে তো যত খুশি পড়ার চান্স পেয়ে যাচ্ছে। সে কি তার বাবা আছে বলে।’
মা বলল—‘রঞ্জন এখনও স্কুলের গণ্ডিই পেরোয়নি। তবে হ্যাঁ তাকে ডাক্তারি পড়াবার জন্যে তৈরি করা হচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু রূপ তোমার যে বাবা নেই, তোমাকে যে যত শিগগির সম্ভব নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, মায়ের পাশে, এটা তোমার জায়গায় অন্য যে কোনও ছেলে নিজেই বুঝে নিত। নিজেই ভাবত। আমার অবস্থাও যেমন অন্য পাঁচজন মায়ের মতো নয়, তোমার অবস্থাও তেমন কখনই অন্য পাঁচজন ছেলের মতো নয়। তোমার বাবা নেই। ইট রিয়্যালি মেক্স ভেরি ভেরি বিগ ডিফারেন্স।’
রূপের কাছে মায়ের উত্তরটা অপ্রত্যাশিত। বাবা না থাকার প্রসঙ্গটা বরাবর মাকে খুব দুর্বল কাঁদো-কাঁদো করে দেয়, সচেতনে না হলেও এটাকে অস্ত্র হিসেবে বহুবার ব্যবহার করে ফল পেয়েছে সে। হঠাৎ সে কিছু জবাব দিতে পারল না। ভুরু কুঁচকে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
অনেক রাত অবধি ঘুম আসছিল না। মায়ের হাত কপালের ওপর। —‘রূপ।’
রূপ পাশ ফিরে শুল।
মা কোমল গলায় বলল—‘তুই চাকরির কথায় ওরকম ভেঙে পড়ছিস কেন? আমি সঞ্জয়কে ফোন করেছিলুম। চাকরিটা খুব ভালো, তুই ঘুরতে ভালোবাসিস, ঘুরতে পারবি। স্কুটার কিনবি একটা। আর চাকরি করতে করতেও তুই আই এ এস-এর জন্যে তৈরি হতে পারবি। সবাইকার ক্ষমতা কি এক ধরনের হয়। রঞ্জুর একদিকে মাথা খোলে তোর অন্যদিকে মাথা খেলবে। আমার ধারণা হাতে কলমে কাজ করে শিখতে তোর ভালো লাগবে রে রূপ।’
—‘তুমি তাহলে চাও আমি, চাকরিই করি?’
—‘চাই, কিন্তু পড়াশোনায় ইতি করে নয়। রোজগারের ধান্দার জন্যও না। তোর একটা চেঞ্জ দরকার। একঘেয়ে মুখস্থবিদ্যার আবহাওয়ায় তুই ফুটতে পাচ্ছিস না। চাকরি করলে তুই ছোট হয়ে যাবি না। কিছুদিনের মধ্যেই দেখবি আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবি।’
—‘ঠিক আছে তুমি যদি তাই চাও, তাই হবে।’
—‘আমি চাই বলে কিছু করিসনি। নিজে ভেবে-চিন্তে ভালো মনে করতে হয় তো কর। নইলে থাক।’
অনেক রাত পর্যন্ত মা রূপের কপালে হাত বুলিয়ে দিল। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল রূপ।
বন্দনা জানলার ধারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে রাতটা কাটিয়ে দিল। সে এতদিনে নিশ্চিত হয়ে গেছে যে রূপের আর পড়াশোনা হবার নয়। ও সব সময়ে নিরাপত্তাবোধের অভাবে ভুগছে। এক জিনিস থেকে আরেক জিনিসে ওর আগ্রহ বদলে যাচ্ছে। মতি স্থির থাকছে না। সঞ্জয় ঠিকই বুঝেছে। চাকরিটা পেলে, চাকরি করলে, ওর আত্মবিশ্বাস আসবে, ও স্থির হবে, ব্যবস্থিত হবে। হে ঈশ্বর চাকরিটা যেন ও করে।
সকালবেলায় রূপ খুশি মেজাজে বলল, ‘য়ুনিভার্সিটিতে ভর্তিটা তো হয়ে থাকি। চাকরিটা যদি না-ই হয়।’
সঞ্জয় যেভাবে কথা বলেছিল তাতে বন্দনার সন্দেহ ছিল না যে চাকরিটা ওর হবেই, তবু বলল—‘সে তো ঠিকই, ভর্তি হয়ে থাকতে আপত্তি কি?’
ফর্ম জমা দেবার লাইনে রূপের ঠিক সামনে দাঁড়িয়েছিল অংশু। ওর কলেজেই পড়ত, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ওকে দেখে বলল—‘এই যে রূপচাঁদ, এসে গেছিস? সব মাল এক ধার থেকে পল সায়েন্সে। ওই দ্যাখ তিনু, আমাদের তিনকড়ি রে, ওই প্রদীপ।’
এই সময়ে অংশু আর রূপের মাঝখানে দুটি মেয়ে এসে ঠেলেঠুলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
অংশু বলল—‘যাশ শালা, এ আবার কি? এই, এই ম্যাডাম কি হচ্ছে, এটা একটা কিউ।’
একটি মেয়ে ঠোঁটের অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলল—‘কিউ? তাই বুঝি। এই জলি, এরা বলছে এটা কিউ। কিউ কি রে? শুনেছিস কখনও?’
জলি নামধারিণী হাত নেড়ে বললে—‘ছেলেমানুষ বলছে, ওদের বলতে দে।’ এরকম অদ্ভুত সংলাপ অভিরূপ তো দূরের কথা অংশু পর্যন্ত কখনও শোনেনি। অংশুকে দেখে মনে হল সে হার স্বীকার করে নিয়েছে। বলল—‘কোন কলেজ ম্যাডাম? ’
মেয়েটি বোঁ করে পেছন ফিরে গেল, তারপর আবার সামনে ফিরে বলল—‘হল?’
—‘কি হবে?’
—‘ওই যে কলেজের নাম জিজ্ঞেস করলেন। গায়ে লেখা আছে, দেখলেন?’
অংশু বলল—‘যাঃ শালা।’
জলি হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল—‘ব্যাকরণে ভুল করে ফেললেন দাদা, না ভাই, আচ্ছা দাদাভাই, আ-কারের জায়গায় ঈ-কার হবে।’
দু’জনেই হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
অংশু বলল—‘আপনাদের নাম কি?’
জলি বলল—‘মাইরি।’
—‘মাইরি নাম? ধুর।’
—‘নাম কেন হবে। আপনার বাক্যটার পাদপূরণ করে দিলাম।’ অংশু বোকার মত হাসল।
জলি বলল—‘আমার নামটা অলরেডি আউট হয়ে গেছে। জলি, শুধু জলি, পদবী, উপাধি ইত্যাদি ফালতু ব্যাপারে বিশ্বাস করি না। আর উনি হচ্ছেন মিস অঞ্জু সরদার। পুরো নাম অঞ্জলি। কিন্তু অমন আদ্যিকেলে নাম ওকে মানায় না বলে ছেঁটে কেটে ছোট করে নিয়েছি। ফিল্মে চান্স পেয়েছে। যে সে না।’
অভিরূপ এতক্ষণ চুপ করেছিল, লোভ সামলাতে না পেরে বলল—‘একসট্রা না কি?’
জলি বলল—‘একসট্রা? তুমি হও গে ভাই গণেশদাদা। অঞ্জু ভ্যাম্প-এর রোল ছাড়া নেয় না। গড়িয়ে গড়িয়ে নাচতে হয়। চোখ নাচবে, কোমর নাচবে, সব নাচবে, পারবেন? কি গণেশদাদা পারবেন?’
অঞ্জু বললে—‘বাদ দে। বাদ দে।’
ওদের দু’জনকে অনায়াসে টপকে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে অঞ্জু বলতে লাগল—‘লেডিজ ফার্স্ট, লেডিজ ফার্স্ট ।’ সবার আগে ফর্ম জমা দিয়ে রিসিট চোখের ওপর নাচাতে নাচাতে বেরিয়ে গেল।
অংশু বললে—‘বোওল্ড। ক্লীন বোওল্ড। এক্কেবারে তুখোড় ইয়র্কার রে! ব্যাটের তলা দিয়ে গলে গেল।’ তারপর গলা নিচু করে বলল—‘চাবুকের মতো ফিগার, দেখেছিস অভিরূপ?’
এই নতুন ইয়ারদের হুল্লোড়ের জগতে এমন নেশাড়ের মতো জমে গেল রূপ যে ইনটারভিউয়ের দিন সে যখন আড়াই ঘণ্টা লেট করে সঞ্জয় পিসের বিখ্যাত আপিসে পৌঁছল তখন সেটা কতটা ট্র্যাফিক-জ্যামে আটকে পড়া বা রাস্তার আধলা ইঁটে হোঁচট খেয়ে পা কেটে যাওয়ার জন্য আর কতটা ভেতরের অনিচ্ছা থেকে, বলা শক্ত।
এখন সেই চাকরিটার কথা ভেবে তার হাত পা কামড়াতে ইচ্ছে হয়।