Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 25

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

ম্যারেজ রেজিস্টারের কাছে গিয়ে সইসাবুদ করে আসা হবে। কোনও অনুষ্ঠান নয়, হোটেলে খাওয়া হবে, তারপরে সুদীপ্ত বন্দনাকে নিয়ে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাবেন। সপ্তাহখানেক। সে ক’দিন কলি রঞ্জুকে নিয়ে রূপের কাছে থাকবে। তারপর ফিরে এসে সুদীপ্তর ইচ্ছে তাঁর বাড়িতে বন্দনা-রূপ চলে যাবে। বন্দনার ইচ্ছে সুদীপ্তই এসে তাঁদের সঙ্গে থাকবেন। এ ব্যাপারটার এখনও মীমাংসা হয়নি। আর বাকি রূপকে বলা। সুদীপ্ত আজকাল মস্ত অ্যাড-এজেন্সিতে বড় চাকরি পেয়েছেন, তিনি বলছিলেন রূপকে নিয়ে একদিন নতুন অফিস দেখাবেন,দু’জনে একটু ঘুরবেন, তারপরে জানাবেন কথাটা। নতুন অফিস দেখা হল, ঘোরা হল, খাওয়া হল, কিন্তু কথাটা বলা হল না। সুদীপ্ত বললেন—‘সামহাউ আই কুড্‌ন্‌ট্‌। আমাদের অন্য উপায় ভাবতে হবে। দু’জনেরই যখন বলতে এত দ্বিধা লাগছে।’

শনিবার রাত্রে কলি ফোন করল—‘রবিবার রঞ্জুর জন্মদিন, রূপু যেন সকাল থেকে যায়।’

রবিবার সারাটা সকাল ফাঁকা। বন্দনা তিনখানা ঘর ভালো করে ঝেড়ে ঝুড়ে গুছোল। পর্দাগুলো কাচতে দিয়েছিল, সব পরালো। পাখা পরিষ্কার করল। গায়ে মাথায়, শাড়িতে ঝুল ময়লা। বেশ করে মাথা ঘষলো। একটা দেড়টার সময়ে বেরিয়ে মনে হল শরীরটা চমৎকার হালকা লাগছে, ভাত-টাত খেয়ে আর এই হালকা অবস্থাটাকে পাল্টে কাজ নেই। একটু দুধ আর পাউরুটি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল একটা বই নিয়ে। কখন আস্তে আস্তে ঘুম এসে গেছে, দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে বাজতে চটকা ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে বন্দনা দেখল রূপের ঘরে পাখা চলছে। রূপ বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে, জামা-কাপড় পরা।

—‘কি রে কখন এলি? কে খুলে দিল?’

—‘নিচের জেঠিমা।’

—‘কি খাওয়ালো পিসি?’

—‘খাওয়ালো!’

—‘চা খাবি তো এখন! আর কিছু?’

—‘নাঃ শোনো মা, একটু তাড়াতাড়ি করো, আমি একবার এক্ষুনি বেরোব।’

—‘বেরোবি কি? এই তো এলি?’

—‘বেরোতে হবে, একবার অনুপের কাছে যাব।’

—‘এখনই? কেন রে?’

—‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা হস্টেলের ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে।’

বন্দনা অবাক হয়ে বলল— —‘কেন? কার জন্য?’

—‘ন্যাচার‍্যালি আমারই জন্য। আমার পক্ষে এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। তোমরা আমাকে তাড়িয়ে ছাড়লে!’

—‘রূপ তুই কি বলছিস? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’

—‘তুমি পিসি আর দ্যাট ম্যান মিলে যা ব্যবস্থা করেছ, তাতে আমার আর এখানে থাকা চলে না। তোমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখা পর্যন্ত চলে না। আই হেট দ্যাট ম্যান।’ —রূপ গলা চড়াল।

—‘রূপ’—বন্দনা কঠিন গলায় বলল—‘কবে থেকে এই মনোভাব তোমার ওঁর সম্বন্ধে?’

—‘আজ থেকে। এই মুহূর্ত থেকে। যখন থেকে তোমাদের ঘৃণ্য চক্রান্তের কথা শুনেছি তখন থেকে।’

—‘তার আগে তুমি ওঁকে পছন্দ করতে?’

—‘করতাম। ভুল করতাম।’

—‘কমেন্ট না করে, সোজা কথার সোজা উত্তর দাও রূপ। চক্রান্ত কাকে বলছ? আমার পক্ষে এরকম একা-একা থাকা ভীষণ কষ্টকর ভয়াবহ হয়ে উঠছে দিনকে দিন। সুদীপ্তকাকুর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক খুব ভালো বলেই এ কথা আমি ভাবতে পেরেছি।’

রূপের মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—‘এতদিন তো তুমি আর আমিই ছিলাম, কোনও অসুবিধে তো হয়নি!’

—‘এখন আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। আমার ভয় করে।’

—‘এখন তো আমিও বড় হয়ে গেছি। আর কিছুদিন পর তোমার ভার পুরোপুরি নিতে পারব। এখন তোমার এ সব মনে হচ্ছে কেন! আর আর…বয়স বেড়ে গেলে কি কেউ বিয়ে করে?’ বিয়ে কথাটা অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টায় উচ্চারণ করল রূপ।

বন্দনা মৃদু গলায় বলল—‘তাহলেই বোঝো, এ কেমন বিয়ে।’

—‘মা প্লীজ, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি..তুমি এটা করতে পারবে না। করলে আমি চলে যাব। কোথায় যাব জানি না, আমার কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই, উঃ বাবা, বাবাগো, তুমি আমাকে আমার বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এলে কেন? এখানে আমার কেউ নেই, কিছু নেই…’ রূপ সর্বহারার মতো দু’হাতে চুল ছিঁড়তে লাগল।

বন্দনা বলল—‘রূপু শান্ত হও। শোনো, ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছিল শুধু আমার জন্য নয়, তোমার জন্যেও বটে। তুমি একজন অভিভাবক পেতে, অভিজ্ঞ বন্ধু পেতে। তুমি যদি না চাও এরকম কষ্ট পাও তো হবে না…’ বলতে বলতে তার গলা বুজে এল।

রূপ বলল ‘উনিশ পার হয়ে কুড়ি বছর বয়স হতে চলল, আমার অভিভাবক? তোমার পায়ে পড়ি মা, আমাকে অন্তত নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও।’

—‘তোমার কি মনে হচ্ছে উনি এলে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না? উনি বাধার সৃষ্টি করবেন?’

—‘উঃ মা, আই ডোন্ট নো। আই ডোন্ট কেয়ার, আই জাস্ট হেট দ্যাট ম্যান নাউ, ওঃ আমি পাগল হয়ে যাব!’

—‘আমি তো বলছি তোমার এরকম মনে হলে ঘটনাটা ঘটবে না।’

—‘মা ইউ আর সো কাইন্ড, ইউ আর আ নাইস নাইস গার্ল!’ রূপ অনেকদিন পর মাকে জড়িয়ে ধরল।

—‘ছাড়ো রূপ।’

—‘তুমি কষ্ট পাচ্ছ তাহলে? রাগ করে আছ। ওই লোকটা তোমাকে আমার কাছ থেকে টোট্যালি কেড়ে নিয়েছে?’

—‘কষ্ট পাচ্ছি! রাগ করছি, কারণ তুমি ছেলেমানুষের মতো উল্টোপাল্টা চিন্তা করছ। আমি তোমার মা, আমাকে কেউ তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে? এখন? কিন্তু আমারও তো একটা জীবন আছে। তুমি তোমার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছ, আমি একলা-একলা কিভাবে দিন কাটাই, তুমি জানো? জানবার চেষ্টা কর?’

—‘কেন মা, আমার জীবনটা কি তোমার জীবন নয়? আমি কেরিয়ারটা নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে আছি। একবার করে নিতে দাও না। তারপর দেখবে আমি আর তুমি কিরকম মজাসে থাকি; রূপের গলায় কাকুতি মিনতি।’

—‘সে তো ঘটনাটা ঘটলেও করা যায়। তুমি ঠিকভাবে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে রূপ। প্রথমটা হয়ত একটু আপসেট হয়ে যাচ্ছিস।’

—‘না, না,—’ রূপ চিৎকার করে উঠল।—‘আমি বন্ধু-বান্ধবের কাছে মুখ দেখাব কি করে? বাড়িতেই বা আমি কি করে টিঁকব? দোহাই তোমার মা যা চাও তাই করব, খালি বন্ধ কর বন্ধ কর ব্যাপারটা।’

বন্দনা ধীরে ধীরে অস্ফুট গলায় বলল—‘তাই হবে। ওঁর আসার কথা কিছুক্ষণ পরেই। তোমার সামনেই আমি ওঁকে বলব। তুমিও তোমার যা মনে হয়, যুক্তিটুক্তি সব বলতে পারো।’

রূপ ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল। ভয় ঘৃণা দুই-ই তার চোখে। বলল—‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হ্যাভ টু ফেস দ্যাট ম্যান। মা তুমিই ওকে যা বলার বলে দিও। আমি চললাম। পরে আসব।’ ঝড়ের মতো পায়ে চটি গলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল রূপ।

সুদীপ্ত এলেন ঘণ্টাখানেক পরে। ওপরে এসে দেখলেন, বন্দনা দালানের চেয়ারে বসে আছে, গালে হাত। বললেন—‘কি ব্যাপার? নিচের দরজা খোলা। আবহাওয়ায় যেন ঝড়ের পূর্বাভাস।’

—‘পূর্বাভাস নয়। ঝড়টা হয়ে গেছে’—বন্দনা ধীরে ধীরে বলল।

—‘ঝড়? কিসের ঝড়?’

—‘রূপকে ওর পিসি আজ খেতে ডেকেছিল, জানিয়েছে, তারই প্রতিক্রিয়ায় ঝড়।’

—‘ও কি মানতে পারছে না?’—সুদীপ্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন।

—‘না। এখন ও তোমাকে হেট করে। আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে গেছে—এ বিয়ে হবে না। ও লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। ওর কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। আর ও তো বড় হয়েই গেছে। মার দেখাশোনার ভার আর কিছুদিন পর থেকে ও-ই তো নিতে পারে।’

—‘তুমি কথা দিলে?’

—‘দিয়েছি। নইলে বলছিল হস্টেলে চলে যাবে। ওর কেউ নেই। আমি ওকে ওর নিজের বাড়ি থেকে উৎপাটিত করে এনেছি, ভুল করেছি। আজ অনেক দিন পর ও বাবাকে ডেকে কাঁদল।’

—সুদীপ্ত বললেন—‘উনিশ কুড়ি বছরের ছেলে। ছেলেমানুষ তো নয়। একেই একটা জটিল মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে কথাটা ওকে বলা ঠিক হয়নি। আমাকে জিজ্ঞাসা করলে পারতে।’

—‘তুমি কি করতে?’

—‘আমি তো ভাবছিলাম। ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত ওকে জানাবারই পক্ষপাতী ছিলাম না। আগে রেজিস্ট্রেশনটা হয়ে যেত। তারপর সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যেতাম। ইনক্লুডিং রূপ। ইনক্লুডিং রঞ্জু, কলি, সঞ্জয়। তিনটে ঘর নেওয়া হত। সেই সময়ে আস্তে আস্তে ভাঙা হত খবরটা।’

—‘পাগল হয়েছ? সমুদ্রে গেলে ও জলে ঝাঁপ দিত। পাহাড়ে গেলে খাদে। তুমি ওর রকম সকম দেখনি তাই বলছ।’

—‘শোনো বন্দনা, ও যা-ই বলুক, যা-ই মনে করুক, মনে রেখ এটা ওর প্রথম প্রতিক্রিয়া। আইডিয়াটা নিজের মনে যত নাড়াচাড়া করতে থাকবে, পরিচিত হতে থাকবে, ততই আস্তে আস্তে মেনে নিতে সুবিধে হবে। প্রথমটা রেজিস্ট্রেশনের পর আমরা না হয় আলাদাই থাকলাম। তুমি এ বাড়িতে আমি আমার বাড়িতে। তুমি এভাবে ওকে কথা-টথা দিয়ো না।’

—‘দিয়েছি তো। দিয়ে দিয়েছি।’

—‘ও কিছু নয়। রেজিস্ট্রেশনটা হয়ে যাক। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকি। মাঝে মাঝে তুমি ওকে বোঝাবে। মাঝে মাঝে আমি। বুঝে যাবেই। বুঝে যাবার পর খবরটা বলব।’

—‘আর তা সম্ভব নয়। ও আমার কাছ থেকে কথা নিয়ে গেছে। আমি যদি সে কথার মর্যাদা রাখতে না পারি ওর কাছে আমার একটুও মান থাকবে না। ও একদম নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকেও শেষ করে দেবে— এ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।’

—‘তুমি এতো ভেঙে পড়ছ কেন বন্দনা!’ সুদীপ্ত বন্দনার ঠাণ্ডা হাতের ওপর হাত রাখলেন—‘আমি বলছি এই বয়সের প্রতিক্রিয়াগুলো, এই রাগ, ঘৃণা অসহায়তা বোধ এ সমস্তই সাময়িক। সময় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

বন্দনা হাসল, বলল—‘আমার ছেলেকে কি তুমি বেশি চেনো! এখনও সময় আছে। এখনও যদি ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি, ওকে বাঁচাতে পারব, নইলে ও একেবারে বিপথে চলে যাবে।’

ঘড়ির টিকটিক আর পাখা চলার মৃদু আওয়াজ ছাড়া পরবর্তী মিনিটগুলোয় প্রায় আর কোনও শব্দই রইল না। সুদীপ্ত সিগারেট ধরাতে ভুলে গেছেন। বন্দনা সেই একই রকম অনড় ভঙ্গিতে বসে। ঢং ঢং করে সাতটার ঘণ্টা বাজলে সুদীপ্ত বললেন—‘আমি তাহলে চলি, বন্দনা!’

বন্দনা উঠে দাঁড়াল, ব্যাকুল গলায় বলল—‘চলে যাবে? এখুনি? আবার কবে আসবে? কখন?’

সুদীপ্ত একটু সময় নিলেন, বন্দনার রুক্ষ মাথার ওপর আলতো করে একবার হাত রাখলেন, ক্লান্ত সুরে বললেন—‘আসব। কিন্তু কি লাভ?’

—‘লাভের কথা ভেবেই কি চিরদিন সব কাজ করেছ?’

—‘না, তা করিনি। কিন্তু এটা যে আলাদা বন্দনা…’ সুদীপ্তর গলা ভেঙে যাচ্ছে… ‘আমিও যে একজন তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ, আমার এভাবে চলতে খুব খুব কষ্ট হবে…তাছাড়াও তোমার ছেলের আমাকে ঘৃণা করাটাই যদি শেষ কথা হয়, তুমি যদি সেটাকেই মেনে নাও, ভয় পাও, তাহলে আমি এলে জটিলতা ক্রমাগত বেড়ে যেতে থাকবে। তুমি যা ভয় করছ তাই-ই হবে তখন। রাগে, ঘৃণায় ও বিপথে চলে যাবে।’

বন্দনা দাঁড়িয়ে রইল। সুদীপ্ত হাতটা একবার তার দিকে বাড়ালেন, তারপর আবার গুটিয়ে নিলেন, খুব মৃদুস্বরে বললেন—‘ভয় পেয়ো না বন্দনা। আসব, আমি আসব।’

সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন সুদীপ্ত। যে সিঁড়ি দিয়ে কয়েকঘণ্টা আগে নেমে গেছে রূপ। দু’জনেই বলে গেল আসব। কিন্তু শূন্য দালানের ওপর একা-একা দাঁড়িয়ে বন্দনার মনে হল ভুল, মিথ্যে। ওরা কেউ আর আসবে না। যতই সে মনকে চোখ ঠারুক, রূপ তাকে অনেকদিন ছেড়ে চলে গেছে। দু’জনের মধ্যে কোনও সখ্য, কোনও সাধারণ আগ্রহ, সাধারণ মূল্যবোধের ভিত্তি নেই। স্বভাবও সম্পূর্ণ বিপরীত। রূপ বহির্মুখী। সে ভীষণই অন্তর্মুখী। রূপ তার আগ্রহের জগৎ, আনন্দের জগৎ খুঁজে নিচ্ছে। মা তার একটা অভ্যাস, একটা সংস্কার, সেটাকে এখনও সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই পর্যন্ত। মায়ের একটা প্রতিমা তার মনের মধ্যে গড়া আছে, প্রাণহীন প্রতিমা, যার মুখ চোখের ভাব চিরকালের জন্য স্থির। সে প্রতিমার ঘরে নিত্য পূজা হল কিনা, সেবা হল কিনা, তা নিয়ে রূপের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ওই ধূলিমলিন প্রতিমাটিকে সে বিসর্জন দিতেও পারছে না। আজকের ঘটনা ওর মনে স্থায়ী রেখা এঁকে দিল। ওর প্রতিমায় চিড় খেয়েছে।

সেই খুঁত-যুক্ত প্রতিমা এবার হয়ত ও কোনদিন বিসর্জনই দিয়ে দেবে। সুদীপ্তর পক্ষে এই বেলাশেষের সম্পর্কের কূল থেকে ফেরা খুব মুশকিল। তাঁকে বন্দনা অথই জলে ভাসিয়ে দিল। তার তবু নেই-নেই করেও ছেলে আছে। সুদীপ্তর কেউ নেই। কার কাছে ফিরে যাবেন? যাকে স্ত্রী বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন অনেক দিন থেকে, তাকে কি আর পরিচিত বন্ধুর মতো দেখা সম্ভব? হয়ত তিনি মাঝে মাঝে আসবেন। ক্লান্ত পা টেনে টেনে। নিজের মনকে জোর করে বুঝিয়ে। সেই আসার মধ্যে অভিমান পুঞ্জ হবে, অভিমান থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে উদাসীনতা, আস্তে আস্তে আনন্দটা কর্তব্য, তারপর কর্তব্যটা ভার মনে হবে। খুব গুরুভার। সুদীপ্ত তখন আর আসবেন না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress