শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 24
সুদীপ্ত বললেন—‘আমার একটা উপহার তামাদি হয়ে গেছে যদিও, তবু বড় আনন্দ আর পছন্দ করে কেনা ছিল জিনিসটা। সেটা এখন নিলে আমি খুব খুশি হতাম।’
সন্ধে ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসছে। শাঁখ বাজার শব্দ বাতাসে মিশে আছে। তিনটে ঘরেই ধূপ জ্বালিয়ে দিয়েছে বন্দনা, চন্দন গন্ধে এখন বাড়ি ম ম। সে বলল—‘ঠিক আছে নিই তবে।’
সাইড-ব্যাগ থেকে একটা সযত্নে প্যাক করা বাক্স বেরোল। অর্ধেকটা খুললেন সুদীপ্ত—নীলাম্বরী শাড়ি।
‘মনে পড়ছে?’ সুদীপ্ত বললেন।
—‘সেই থেকে জমিয়ে রেখে দিয়েছেন?’
—‘ইয়েস।’
‘কেন?’
—‘এর আবার কোনও উত্তর হয় নাকি? প্রথমত যাঁকে মনে করে উপহারটা কেনা তিনি যতক্ষণ না গ্রহণ করছেন ততক্ষণ তো আমি জিনিসটার জিম্মেদার। তাছাড়া’… সুদীপ্ত একটু থেমে বললেন—‘উপহারটা দেবার দিন আসবে এ আশা ছিল।’
—‘এত আত্মবিশ্বাস?’
—‘ও ইয়েস। ভালোবাসার আরেক নামই যে আত্মবিশ্বাস!’
—‘এসব ইললিগ্যাল মনোভাব কবে থেকে?’
—‘বলব না।’
—‘কেন?’
—‘ইললিগ্যাল’, শব্দটা তুলে নিতে হবে।
—‘নিলাম।’
—‘প্রথম দিন প্রথম ক্ষণ থেকে বলতে পারলে কবিদের ফাইন্ডিংস্-এর সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু তা নয়। সেই সিরিজ আঁকবার সময় থেকে…’
—‘মডেল হওয়া ব্যাপারটা তো বিপজ্জনক তাহলে?’
—‘আঁকতে গিয়ে যদি মানুষকে আবিষ্কার করা যায়, যদি ভাবে ভাব মেশে তাহলে এক অর্থে বিপজ্জনক, বেদনাদায়ক ঠিকই!’
—‘এরকম হয় নাকি? হয়েছে আগে আর?’
সুদীপ্ত হেসে ফেললেন—‘দুঃখের বিষয়, না।’
—‘আবিষ্কার-টার কি বললেন ভালো বুঝলাম না।’
—‘দেখলাম এক নিষ্পাপ কৈশোর প্রার্থনাময় যৌবনে পৌঁছল, জীবন তার প্রতিশ্রুতি রাখল না। কৈশোরের বিস্ময় ভরা চাহনিতে আস্তে আস্তে গভীর অবসাদযোগ, বিষাদযোগ। অথচ সেই বিষাদযোগের অন্তরালে পরিপূর্ণ বাঁচবার ইচ্ছা, বিপুল কর্মশক্তি, তার চেয়েও বড় ভালোবাসবার শক্তি বাঁধ দেওয়া জোয়ারের জলের মতো আটকে আছে। বাঁধ কেটে দিলে পুষ্পিত প্রান্তরের রূপ কেমন হতে পারে মনশ্চক্ষে তাও দেখতে পেলাম। মনে মনে আঁকলাম।’
বন্দনা ভাবল—‘পুষ্পিত হওয়া অতি সহজ!’ মুখে বলল—‘ঠিক যেমনটি এঁকেছিলেন, বাস্তবের ছবিটা যদি তেমন না হয়!’
—‘হবে না-ই তো!’ সুদীপ্ত জোর দিয়ে বললেন, ‘আমার চেয়ে লক্ষগুণ বড় শিল্পী ছবি আঁকছেন, তাঁর ঝুলি থেকে কি রঙ, কি রেখা বার হয়—দেখবার অপেক্ষায় আছি।’
জীবনশিল্পী তাই তার ঝুলি থেকে প্রথম রঙ বার করেছে। ঘোর নীল, রাত্রির আকাশের মতো। অভিসারের রঙ। নীলাম্বরী পরে বন্দনা অফিস গেছে। সরু পাড়, জমকালো আঁচল, তাইতে রাধাকৃষ্ণর রাসলীলা। কত গোপী মুখ, বাঁশি, বৃক্ষ, লতা, ফিকে গোলাপি রঙের রেশমী সুতো দিয়ে অসাধারণ একটি ছবি তৈরি করেছে বিষ্ণুপুরের বালুচরী শিল্পী। ঘোষাল সাহেব পর্যন্ত চমকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। রোগমুক্তির পর এই প্রথম বন্দনা কাজে যোগ দিল। ঘোষালের মুখে আনন্দের হাসি। স্যারা বলল—‘ফ্যানটাসটিক।’ সোম কাজে এসেছিল ঘোষালের কাছে, ফেরার সময় এক দণ্ড দাঁড়াল, আড়চোখে স্যারার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল—‘কংগ্র্যাচুলেশনস্।’
চমকে উঠল বন্দনা—‘হঠাৎ?’
—‘স্বভাবতই সেরে উঠেছেন বলে। তাছাড়া আপনাকে খুব সুন্দর, খুব জীবন্ত লাগছে। আমি শুধুমাত্র দর্শক। তবু এ দৃশ্যে বড় খুশি লাগছে। কংগ্র্যাচুলেশন এগেইন।’
পেছন ফিরে চলে গেল সোম। ও কি কিছু জানে? জানা তো সম্ভব নয়! কোনক্রমেই নয়। আজই প্রথম সে সুদীপ্তর সঙ্গে একা বেড়াতে যেতে রাজি হয়েছে। রূপ আজ কলেজ-ফেরত বন্ধুর বাড়ি যাবে, ফিরবে না বলে গেছে। বন্দনাও বলেছে—সে-ও আজ একটু বেরোবে। অফিস-বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ফেরার তাড়া নেই। সুদীপ্ত সিনেমায় যেতে ভালোবাসেন না, নাটক ভালোবাসেন, গ্রুপ থিয়েটার। এখন তো তেমন কিছু হচ্ছে না। কোথায় নিয়ে যাবেন কে জানে। বন্দনা কিছু জিজ্ঞেস করেনি। যা করবে ভালো বুঝে করবে। বহুদিনের পর নিজেকে কিছু ভাবতে হবে না, এই ভেবেই সে খুশি।
ছুটির পর অফিসের গাড়িকে সে বলল পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে ছেড়ে দিতে। সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি, নিয়ে আকাশবাণী ভবন। সুদীপ্ত বললেন—‘ট্যাক্সিটা ছাড়বার দরকার নেই।’ আবার মুখ ঘুরিয়ে থিয়েটার রোড, লর্ড সিনহা রোড। বিরাট কলেজ হলে গানের আসর বসেছে। পুরিয়ার সিদ্ধ শিল্পী। দেড়ঘণ্টা ধরে পুরিয়ায় ভ্রমণ করে হঠাৎ শুদ্ধ কল্যাণের বিপুল অতিজাগতিক গাম্ভীর্যে পৌঁছলেন। সুরের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে বন্দনা। যতবার তীব্র মধ্যমে পৌঁছচ্ছে সুর ততবার তার শরীরের মধ্যে বালিকা-কালের পাথুরিয়াঘাটার কনফারেন্সের পুরো আবহ সুরবিস্তার করছে। হ্যারিংটন স্ট্রিটের মোড়ে একটা বিরাট ফাঁকা জায়গা ছিল অনেক দিন। সেই জায়গাটা ঘিরে সদারঙ্গ মিউজিক কনফারেন্স বসত। বড়ে গোলাম আলি, আমীর খাঁ, বাহাদুর খাঁ এদের ওখানেই শুনেছে। হীরাবাঈ এবং সরস্বতীরানেকে পাথুরিয়াঘাটায়। সে সব ছিল বড় আনন্দের, রঙ বাহারের দিন। শূন্যে কে যেন রঙ ছড়াতো, রঙ আর সুগন্ধ। মউলের বাস তখন হাওয়া দিলেই বইত হু হু করে। ঘুম-ভাঙানিয়া সে সব রাত। রাতের আকাশ বেয়ে সুরের প্রপাত নেমে আসছে। কখনও সগর্জনে ফৈয়জ খাঁয়ের গলায়, কখনও গম্ভীর মন্দ্র চালে আমীর খাঁয়ের গলায়, কখনও নৃত্যপর ঝরনাধারায় হীরাবাঈ বরোদেকার। বাগেশ্রীতে তারানা ধরেছেন শিল্পী। কীরকম এক গম্ভীর বিষন্ন প্রার্থনা মুক্তি পাচ্ছে, অনন্ত হরিনারায়ণম, যেন তুম তরানা নুম-এর মধ্যে থেকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। আজকের এ আসর স্মৃতিজাগানিয়া, দুখজাগানিয়া, যে স্মৃতি, যে দুঃখ আসলে একরকম নিবিড় সুখ। অনুভূতির খুব গভীর স্তরে তার দুঃখ আজ সুখের সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে টের পেল বন্দনা। কেন এত বিবাদ বিতর্ক, কেন ভাবনা, কেন এতো অবসাদ? অনুভূতির তৃতীয় স্তরে সবই এক অখণ্ড সামুদ্রিক বিশালতায় বিরাজ করছে। ভৈরবী ঠুংরি ধরেছেন পণ্ডিতজী। ঠুংরির পরতে পরতে যেন ভজনের দৈবী মূৰ্ছনা মিশিয়ে দিচ্ছেন, চোখের পাতার পেছনে থমকে থাকা জল যেন আর থাকতে চায় না, ওই আকৃতি ওই মোচড়কে অভিষিক্ত করতে চায়। সেই সুরসাগরে, রূপসাগরে, সুগন্ধসায়রে ডুব দিতে দিতে বন্দনার প্রথম ডুবে অপরূপ রূপ-যৌবন সব যেন ফিরে এল এক দিব্য উপহারের মতো, রোমে রোমে আবার সেই হারানো রোমাঞ্চ-তরঙ্গ, ঠোঁট মধুর প্রত্যাশায় কাঁপছে, তার হাত পা সব যেন নরম-ননীর তৈরি, যে কোনও সময়ে এই সুরের উত্তাপে গলে যাবে। দ্বিতীয় ডুবে বন্দনা অলঙ্কার নিয়ে উঠল,বহু-মূল্য আভরণ। অলঙ্কার হল বাহুল্য, সজ্জা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত। যে জীবনে শুধু প্রয়োজনের দায় মেটাবার ব্যবস্থা সেখানে বাঁচবার অনেক উপকরণ সত্ত্বেও একটা কঠিনতা, একটা ফাঁকি থেকে যায়। প্রয়োজন মিটিয়ে যখন অতিরিক্তের প্রকাশ হয়, নানা রূপবন্ধে, নানা ছন্দে, সেই জীবন অলঙ্কারময়, তার আনন্দের উৎস বিচিত্র। বন্দনার চোখে আজ অকারণ অশ্রুর সুখ, বুকের মধ্যে আবেগের জোয়ার যেখানে সে ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত নেই, কণ্ঠ বুঝি যে কোনও মুহূর্তে ওই সুরে সুর যোজনা করতে আছড়ে পড়বে। ছন্দোময় পায়ের পাতা, অদৃশ্য মুদ্রা হাতে, কটিতে ভাঁজ। গান শুনতে শুনতে বন্দনা মনে মনে উঠে দাঁড়ায়, রাশি রাশি ফুল আকাশে ছুঁড়ে দেয়, মুঠো মুঠো আবির ফাগ, তার দু-হাতের মুঠো থেকে ঝরে ঝরে পড়ে পৃথিবী রঙিন করতে থাকে।
ভৈরবী ঠুংরির পর আসর শেষ। রাত বারোটা বেজে গেছে। নির্জন অথচ আলোকময় পথ। ওপরে তারাভরা মধ্যযাম। এত সুন্দর কলকাতা বন্দনা কখনও দেখেনি। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যালের বিশাল সিলুয়েৎ দেখা যাচ্ছে কোনও রহস্যময়, অপার্থিব উপস্থিতির মতো।
সুদীপ্ত বললেন—‘এটুকু তো হেঁটে যেতেই হবে। এখন গাড়ি পাওয়া যাবে না। খুব কষ্ট হবে?’ সুদীপ্তর গলা তখনও সুরে ভারি হয়ে আছে।
বন্দনার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ভেতরটা এতো ভরাট। পা ফেলতে অস্বস্তি পাছে তাল কেটে যায়। দু-পাশের পরিচিত সব সৌধরা আজ এক মায়ানগরীর মায়াপ্রাসাদ। জ্যোৎস্নাময় পথ মাড়িয়ে মাড়িয়ে চলতে চলতে তার মনে হল—হয়ত মায়া। সত্যিই মায়া। জীবন কখনও কখনও এমন মায়াময় বলেই প্রতিদিনকার তিল তিল খুঁটে খুঁটে বাঁচার উঞ্ছবৃত্তি সত্ত্বেও মানুষ বাঁচবার প্রবল ইচ্ছে নিয়েই বাঁচে। লোয়ার সার্কুলার রোড, হেস্টিংস রোড, হসপিট্যাল রোড সব ছায়া-বৃক্ষে মোড়া। সদর দরজার তালা খুলে বন্দনা ভেতরে ঢুকে গেলে সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। দু’জনে দু’পাশে। একজন দরজার ভেতরে, একজন বাইরে রাস্তায়। ভেতরে ভেতরে দু’জনেই মন্দ্রিত মথিত, কিন্তু বাইরে নিস্পন্দ, নির্বাক। কিছুক্ষণ পরে সুদীপ্ত বললেন—‘আজ তবে চলি!’
বন্দনা কিছু বলল না। শুধু দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। একটু পরে দরজা বন্ধ করল। দোতলায় উঠে ক্যোলাপসিবলের তালা খুলল। শূন্য পুরী। আজ যেন শূন্য নয়। সঙ্গে করে যে গান, যে সুর, যে তালের অলঙ্কার সে আজ দেহমন ভরে নিয়ে এসেছে সেই সব তার অঙ্গে থেকেও কি এক মন্ত্রে ঘরময় দালানময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এ এমন এক অলঙ্কার যা দিয়ে দিলেও ফুরিয়ে যায় না। শুতে গিয়ে বন্দনার মনে হল সে অকূল সুরপাথারে ডুবে যাচ্ছে। এ সমুদ্রে ডুবে গেলেও দম বন্ধ হয় না।