Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 2

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

—‘মা!’ দেশ থেকে-আসা রাশীকৃত তেঁতুল কুটে কুটে জড়ো করছিলেন দুই জায়। কিছু হবে ছড়া-তেঁতুল, কিছু হবে তেঁতুলের কাই-আচার। তাছাড়াও অম্বলে, রান্নায়, বাসন-মাজার…সারা বছরের ব্যবস্থা। ডাক শুনে চমকে মুখ তুলে তাকালেন।—‘ওকি বউমা, তুমি! কি দরকার? ডাকলে না কেন? নিচে নামলে কি করে? কি সর্বনাশ, যদি পড়ে যেতে।’ শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালেন শাশুড়ি। আঁচল খসে পড়ল চাবিশুদ্ধ ঝনাৎ করে।

—‘পড়ে যাব কেন? রূপু বলছে খিদে পেয়েছে।’ কেমন শূন্য চোখে তাকাল বন্দনা,—‘এখন ও কি খায়?’

সব ভুলে গেছে ও। ছেলে কখন খায়, কি খায় কিচ্ছু মনে নেই। দুজনে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন, শেষে কাকিমা বললেন,—‘এই তো মা, এক্ষুনি চান করেই ভাত খাবে। এখন তো আর কিছু খায় না। বায়নাদেরে হয়েছে তো খুব। দাঁড়াও আমি দেখছি।’ কাকিমা বঁটি কাত করে রাখলেন।

বন্দনা তাড়াতাড়ি বলে উঠল—‘না, না, বায়না করেনি, খিদে পেয়েছে ওর। আমি চান করিয়ে দিচ্ছি কাকিমা। তার আগে খাওয়ার মতো কিছু নেই?’

কাকিমা তাকালেন বড় জায়ের দিকে, চিন্তিত মুখ। শাশুড়ি বললেন—‘আচ্ছা একটা কমলালেবু দিচ্ছি, এইটে খেতে বল ততক্ষণ। অন্য কিছু খেলে খিদে নষ্ট হয়ে যাবে।’

লেবুটা হাতে করে সিঁড়ির দিকে এগোল বন্দনা। সে যেন নতুন করে হাঁটতে শিখছে। তার ননদ কলি নেমে আসছে দোতলা থেকে। তরতর করে। দুদিকে দুবেণী। কাঁধে ব্যাগ, কলেজ যাচ্ছে নিশ্চয়ই। সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়াল—‘বউমণি, তুমি যে নিচে নেমেছ? কখন উঠলে? কখনই বা নামলে? খোকামণি কোথায়?

বন্দনা লেবুটা তুলে ধরে কৈফিয়তের সুরে বলল—‘এই যে, খোকার জন্যে লেবু নিয়ে যাচ্ছি। ওর খিদে পেয়েছে।’ কিরকম যেন বাচ্চা, ভীতু বালিকার মতো কথাগুলো। অসংলগ্ন।

কলি বলল—‘এস বউমণি, আমি তোমায় ওপরে পৌঁছে দিই।’

—‘তোমার কলেজের দেরি হয়ে যাবে না?’ রেলিং ধরে ধরে আস্তে আস্তে উঠতে উঠতে বন্দনা বলল—‘আমি ঠিক উঠতে পারব।’

কলি একবার ওপরে তাকাল, একবার নিচে। আর দেরি করলে সত্যিই ফার্স্ট পিরিয়ডটা মিস হয়ে যাবে। লেকচারের মাঝখানে ক্লাসে ঢোকা একদম পছন্দ করেন না এ কে বি। সে দু তিনটে সিঁড়ি টপকে এক লাফে নিচে নামল, আবার পেছন ফিরে তাকাল—‘বউমণি ধরে ধরে যাও। মাথা ঘুরে গেলে মুশকিল হবে। আমি আসছি তাহলে।’

বউমণিকে দেখলেই আজকাল কেন কে জানে বড়দার বিয়ের দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়। বাসি বিয়ের দিন সন্ধেবেলায় রান্নাঘর থই-থই করছে অন্ন-ব্যঞ্জনে। বিশাল একটা রুপোর থালায় সব কিছু-কিছু উঠেছে, রুপোর বড় মেজ, সেজ, রাঙা, ফুল, ছোট বাটিতে হরেক ব্যঞ্জন। বড় রুই মাছের মুড়ো ল্যাজা। বাটি থেকে উঁচিয়ে রয়েছে। পায়েসের সুগন্ধে রান্নাঘর ম’ম। রান্নাঘরে বামুন ঠাকুর, মা, কাকিমা। চাঁদের আলো রঙের শাড়ি, লাল ব্লাউজ, এক গা গয়না পরে নতমুখে বউমণি এসে দাঁড়াল। মা বললেন—‘দ্যাখো বউমা, চোখ চেয়ে দ্যাখো ভালো করে, এই সব তোমার। তোমার রসুইঘর। তোমার অন্ন। তোমার ব্যঞ্জন। তোমার কল্যাণে এইরকম রোজ রোজ হবার সামর্থ্য হোক আমার খোকার।’ কাকিমা হেসে বললেন—‘মনে মনে “উইশ’’ করো।’ মা ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল—‘উইশ-ফুইশ আবার কি রে ছোট গিন্নি? একটি বর আমরা ওকে দিয়েছি, আর দুটি বর ও দেব্‌তাদের কাছ থেকে আমাদের জন্যে মেঙে নিক।’

—‘তা ও পারবে, যা লক্ষ্মীমন্ত বউ তোমার,’ কাকিমা বন্দনার থুতনিতে আদর করে বলেছিলেন। পেছনে কখন বড়দা এসে দাঁড়িয়েছে। বরেরা তো বাসিবিয়ের দিনেই বউয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি ঘুরঘুর করে! তা বড়দা বলল—‘আর বর চেয়ে আমাকে ফ্যাসাদে ফেলে কাজ নেই। এই সমস্ত রান্না যদি রোজ হয় তাহলে ফার্স্ট থিং তো মা আর কাকিমাকে সারাক্ষণ হেঁশেলেই কাটাতে হবে, আর এই সব খেয়ে কলিটার এইসান পেট ছাড়বে…’

কলি প্রচণ্ড প্রতিবাদ করে উঠেছিল—‘আহা, খালি আমারই, না? আর সবার বুঝি সোনায় গড়া পেট?’

বড়দি বলল—‘তুই আর সরু গলায় চেঁচাসনি। একেই তো সানাইয়ের প্যাঁপোঁয় কাজ-কর্ম করা দায় হয়ে উঠেছে। কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছি না। এই দাদা, তুই এখন এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন রে? কালরাত্রির দিন বউয়ের মুখ দেখলে কি হয় জানিস?’

—‘কি হয় বল না রে খুকি! তুই একটা অথরিটি লোক। আমাদের একটু শেখা-টেখা!’

—‘খবর্দার ঠাট্টা করবি না। কি হয় মুখে উচ্চারণ করতে নেই, তা জানিস? যা যা ভাগ এখান থেকে, ভাগ বলছি।’

কাকিমা এই সময়ে বললেন—‘না, না, জন্মের ভাত-কাপড়টা ওকে দিয়ে দিইয়ে দাও, নিয়ে-টিয়ে বন্দনা বউ একেবারে ঘরে যাক।’

ফুলকাটা পেতলের ট্রেতে করে সুতরাং কাপড় এল, সেটা দু আঙুলে তুলে দাদা বলল—‘জন্মের ভাত কাপড়? বাব্বাঃ বাঁচা গেল। এই নাও বাবা, জন্মের মতো দিয়ে দিলাম। এরপর একদম ফ্রি।’

বউমণি মুখ নিচু করে মিটিমিটি হাসছে। বড়দি ঝঙ্কার দিয়ে উঠল—‘ফিচলেমি হচ্ছে, না? এটা সিম্বলিক তা জানিস। সারা জীবন যত অন্ন বস্ত্র লাগে সবই দিতে হবে। এক্সট্রাও অনেক দিতে হবে। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, আরও নানান খানান আছে, সে সব এখনই ফাঁস করছি না। কি বল, বন্দনা?’

দাদা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলেছিল—‘যাক তোদের সিম্বলে যখন শাড়ি দিয়েছিস, শাড়ির ওপর দিয়েই যাবে শুধু, তারপরই ফ্রি।’—‘কিসের অত ফিরি ফিরি করছিস রে মুখপোড়া?’ পিসিমা এসে পড়েছেন। পিসিমা এসে না দাঁড়ালে যজ্ঞিবাড়ি ঠিক জমে না। বললেন—‘তুই আর ফ্রি নেই। আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা-ছাঁদা হয়ে গেছিস, বুঝলি?’

কলি রাস্তা পার হয়ে বাস স্টপে এসে দাঁড়াল। অনেক দিন সে ভালো করে বউমণিকে দেখেনি। নিজের ঘরে শুয়ে বসে থাকে, বাইরে বেরোয় না, বউমণির এই অসুখ, এই বিষাদকে কলি ভয় পায়। খোকামণি তার কাছে একবার, খুড়তুত বোন মিলির কাছে একবার খায়, মায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়ে, কাকাদের ছায়ায় ছায়ায় ঘোরে। ওকে স্কুলে দেবার কথা হচ্ছে। কিছুটা সময়ও অন্তত সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে ভুলে থাকবে। কিন্তু বাড়িশুদ্ধ সবাই যেন আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছে বউমণি বলে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ এখানে আছে। সে কি ছিল, আর কি হয়েছে! আজ সিঁড়ি দিয়ে তাকে টলতে টলতে উঠতে দেখাটা কলির কাছে একটা মস্ত ধাক্কা। ও যে এমন হয়ে গেছে, এত রোগা শ্রীহীন, একটা রঙচটা কাঁচকড়ার পুতুলের মতো তা কলি আগে খেয়াল করেনি।

কনডাকটর বলল—‘টিকিট দিদি টিকিট।’

নামবার সময় হয়ে এসেছে, কলি তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে পয়সা বার করে দিল। একদম অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল।

‘কলি, তুমি শাড়ি পরতে ভালোবাস?’ নতুন বউদি সামনে একগাদা সিল্কের শাড়ি মেলে বলছে। চোদ্দ বছরের কলি সবে শাড়ি ধরেছে, বাইরে শাড়ি, বাড়িতে ফ্রক, এখনও সামলাতে পারে না, কিন্তু শাড়ি তার প্রাণ, ঘাড় নেড়ে বলছে—হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ।

—‘এইগুলোর থেকে যেটা ইচ্ছে বেছে নাও।’

সবচেয়ে সুন্দরটা, লাল-নীল-হলুদ ফুল ফুল ঝকঝকে জমকালোটা কলি বেছে নিচ্ছে। মেজদা বসে বসে বউদির সঙ্গে গল্প করছিল। নতুন বউয়ের সঙ্গে গল্প করতে সবারই ভালো লাগে। সে বউ যদি আবার এমনি শিক্ষিত, এমনি হাসি-খুশি, রসিক, এমনি মিষ্টি হয়। মেজদা বলল—‘এ হে হে হে, কলি, টিকেয় আগুন হয়ে যাবে যে রে শেষটায়।’ বউমণি বলে উঠল—‘এ কি কথা মেজদা! কলি তো একদমই কালো না। তাছাড়াও চাপা রঙে লাল খুব সুন্দর খোলো।’

কলি মুখ গোঁজ করে বসে আছে। নেবে না ওই শাড়ি, কিছুতেই না। মেজদা বললে—‘পাচ্ছিস নিয়েই নে। সেই কবে তোর বর দেবে তার জন্যে হত্যে দিয়ে বসে থাকাটা কি ঠিক?’

—‘কেন দাদারা বুঝি দিতে পারে না?’ বউমণির চোখে ছদ্ম তিরস্কার।

—‘আরে সেই কথাই তো বলছি।’

—‘আরে সেই কথাই তো বলছি। আমার কাছে লবডঙ্কা। আমার বউ এলেও আগে থেকে বলে দেবো, এ বাড়ির বড়বউ একটা শাড়িছত্রের গোলমেলে প্রিসিডেন্ট ক্রিয়েট করে গেছেন, তুমি যেন সেইমতো চলো না, নৈব নৈব চ।’ মেজদা হাসতে হাসতে বলছে কিন্তু কলির গায়ে যেন হুল ফুটছে। সে কি ভিখারি? চাইতে এসেছে? বউমণি ভালোবেসে দিচ্ছে তাই। সে-ও বউমণিকে দেবে। বউমণি রেগে গেছে—‘মেয়েদের ব্যাপারে কেন নাক গলাতে আসেন বলুন তো? আপনি এখন যান। আমরা দুজনে এখন সব গুছিয়ে তুলব। হয় যান, নয় বসে বসে দেখুন। একটাও কমেন্ট নয়। আর আপনার বউ আপনার হাতে পড়বার আগে আমাদের হাতে পড়বে, তখনই তাকে যা শেখাবার শিখিয়ে দেবো। কি বল কলি?’

চার দাদার কোলের বোন। বড়দার পরে অবশ্য বড়দি। একেবারে পিঠোপিঠি। কিন্তু কলির প্রায় শৈশব অবস্থায় বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে। চার দাদার যত আদর, যত ঠাট্টা-ফাজলামি সব কলিকে নিয়ে। এমন পেছনে লাগত যে কাঁদিয়ে ছেড়ে দিত। মেজদাকে বার করে দিয়ে বউমণি দরজায় খিল তুলে দিল, বলল—‘নাও, এবার নাও।’

—‘নেওয়ার কি আছে বউমণি, থাক না তোমার আলমারিতে। যখন দরকার হবে তখন পরব,’ কলির অভিমান এখনও যায়নি।

—‘সে তো পরবেই। আলমারির সব শাড়িই যখন দরকার হবে পরবে। একটা তোমার নিজস্ব করে নাও। নাও কলি, লক্ষ্মীটি, না হলে আমি ভীষণ দুঃখ পাব।’

—‘তাহলে তুমি বেছে দাও। আমি তো বুঝতে পারি না। কোনটা আমাকে মানাবে দেখে দাও।’

‘ঠিক? আমিই বেছে দিই তাহলে?’ বউমণি শাড়ির স্তূপের মধ্যে থেকে সেই লাল-হলুদ-নীল ফুল ফুল মিষ্টি শাড়িটাই তুলল। বলল—‘এইটাই সবচেয়ে মানাবে তোকে কলি। এমন চকচকে আয়নার মতো রং, পরে একেবারে লাল হয়ে উঠবি।’

তারপর খুড়তুত বোন মিলি এল। মিলি শাড়ি পছন্দ করল। তিনজনে মিলে বউমণির ঢাউস দুটো আলমারি গোছানো হল।

সেই কাশ্মীরি সিল্ক পরে বড়দার মৃত্যুর পরও বন্ধুর বিয়েতে গেছে কলি। সবাই বলেছে, ‘কি সুন্দর, কি অপূর্ব দেখাচ্ছে তোকে, কোথাকার সিল্ক রে? কোথা থেকে কিনেছিস? ও কি তোর চোখে জল কেন রে কলি? দাদা দিয়েছিলেন, না? বড়দা!’ কলি মাথা নাড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে মেক-আপ নষ্ট হচ্ছে, অস্ফুট গলায় বলছে—‘বউদি, আমার বউমণি দিয়েছিল রে।’

বন্ধুরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। দাদার স্মৃতি হলে কান্নার মানে বোঝা যায়, বউদি তো আর মরে যায়নি রে বাবা! চন্দনা বলে—‘নে, নে, বর দেখবি চল। মোছ চোখের জল। ইস কাজল বাঁচিয়ে। বর যা হয়েছে না? দেখে আমিই এইসান একসাইটেড হয়ে গেছি যে আমারই টপ করে বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

কলির ভালো লাগে না। বউমণি মরে যায়নি। কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকারও তো কোনও মানে হয় না। শুষ্ক প্রেতিনীর মত, একাম্বরা, রুক্ষ চুল, হাঁটতে পারছে না, হাঁপাচ্ছে, ওষুধ খেয়ে খেয়ে চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। সেই উজ্জ্বল, হাসিখুশি, নিতান্ত সরল, আমুদে বউমণি যে তাদের সবাইকে বিশেষ করে তাদের দুই বোনকে এতো ভালোবাসত!শনিবার ম্যাটিনি শো-এ সিনেমা যাওয়া মানেই সে, মিলি আর বউমণি, লুকিয়ে লুকিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ‘শ্রী’তে যাবার নাম করে এক এক দিন মেট্রো, কি লাইটহাউজে চলে যাওয়া, তারপর ট্যাক্সি করে হুশ, শ্রী সিনেমার কাছে এসেই তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি। বউমণি বলবে—‘এখানেই ছেড়ে দিই। কি বল?’

ট্যাকসিটা চলে গেলে রাস্তার ওপর তিনজনের কি ধুম হাসি।

—‘এই শ্রী-তে কি হচ্ছে ভালো করে দেখে রাখ। এই মিলি তুই ঠিক উল্টো-পাল্টা করবি।’

—‘আমি না, আমি না, দিদি, কলি।’

বাড়ি ঢুকতেই চায়ের গন্ধ। সাড়া পেয়ে কাকিমা বলছেন—‘বাঃ খুব তাড়াতাড়ি এসে গেছ তো বন্দনা বউ! যা রে কাপড় বদলে আয় সব, চা হয়ে গেছে।’

তিনজনে মিলে দুদ্দাড় ওপরে, মাঝে বউমণির ঘর। বড়দা আসতে এখনও দেরি আছে। ঢুকে তিনজনে বিছানায় গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে বন্দনা বলছে—‘ট্যাকসির কথাটা জানলে কাকিমা কি বলবেন?’

কলি বলছে—‘তিন মেয়েতে মিলে একলা একলা নীরাতে ঢুকে খেয়ে আসার কথাটা?’ আবার হাসি।

—‘ইটালিয়ান ক্যাসার্টটা কি দুর্দান্ত, না?’

—‘সাঙ্ঘাতিক। বউমণি ওই পাতলা বিস্কুট তো আমি ডেকোরেশন বলে ফেলেই দিচ্ছিলুম।’

—ওকে ওয়েফার বলে। ডেকোরেশন তো বটেই। কিন্তু সব ডেকোরেশনই শেষ পর্যন্ত পেট্টায় নমো করবার। কেকেও তো চেরি থাকে, আইসিং থাকে, সেগুলো ভেঙে ভেঙে খাস না?’

—‘আইসিং কি গো?’

—ওই যে রে সাদা সাদা নকশাগুলো।

—‘হ্যাঁ খাই তো। আমাদের দোলের মঠের বিলিতি সংস্করণ বলো?’

—বউমণি, আবার কবে বেরোবো।’

খোকামণিকে বেড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরছে রতন। ভালোমানুষের মত মুখ করে বন্দনা বলছে—‘কোথায় রে? শ্রী না চিত্রা?’ যেন কিছু বুঝতে পারছে না দুই ননদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে।

—‘না, না,’ মিলিটা অধৈর্য হয়ে উঠেছে—‘না, না বউমণি, এসপ্লানেড, এসপ্লানেড। মেট্রো, নিউ এম্পায়ার, লাইটহাউজ, গ্লোব।’

—‘বাস রে বাস। কি লম্বা লিস্টি দিচ্ছিস!’

—‘ইঃ রে আমার! ইংরেজি ছবি বুঝতে পারিস?’ কলি বলছে।

—‘সব কথা বোঝবার দরকার হয় নাকি? তুই বুঝেছিস? কি অপূর্ব ছবিটা বলতো আঃ ‘গন উইথ দা উইন্ড,’ ওঃ বউমণি রেট বাটলারকে যদি হাতের কাছে। পেতুম!’

—‘কি করতিস?’ বউমণি হাসছে।

—‘উঃ কি যে করতুম!’ হাত মুখ সব মিলিয়ে মিলি একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করে।

—‘তুই কলি?’

—‘স্কার্লেটটার মতো বোকামি অন্তত করতুম না!’

আবার তিনজনের হু হু হাসি।

—‘বউমণি তোমাকেও বলতে হবে। ওসব চলবে না।’

—‘এই খবর্দার, বন্দনার চোখে-মুখে চাপা হাসি, ‘আমার রেট বাটলার এসে গেছে।’

হাসতে হাসতে দরজার খিল খোলা হচ্ছে, বড়দার মাথার চুল এলোমেলো, ভারি ব্যাগটাকে টেবিলে রাখতে রাখতে বলছে—‘এতো হাসি কিসের, অ্যাঁ? অ্যাত্তো হাসি? এই মিলিয়া, কলিয়া, আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র করছিস রে তোরা!’

বেশি দিনের কথা নয়, মাত্রই বছরখানেক। অথচ মনে হয়, কতদিন, কতদূর, কোন গতজন্মে কিংবা স্বপ্নে এসব ঘটেছিল বোধহয়। এখন কলি মায়ের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এসপ্লানেড পাড়ায় যায়, মাঝে মাঝে। কিন্তু তেমন জমে না। বন্ধুদের হই-হুল্লোড়ের মাঝখানেও হঠাৎ-হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। বউমণির শাড়ির গন্ধ, চুলের গন্ধ, মোড়ের দোকান থেকে তবক দেওয়া পান কিনে তিনজনে খাওয়া আর হাসা। তিন ননদ-ভাজে। তিন অসম বয়সী বন্ধু মিলে। ‘গন উইথ দা উইন্ড’, ‘গ্যাস লাইট’, ‘জোয়ান অফ আর্ক …।’

—‘এই কলি, কলি তোর রোল কল করছেন।’

—‘হানড্রেড অ্যান্ড ফাইভ। কলিকা ভট্টাচার্য,’ স্যারের চোখ সোজা কলির মুখের ওপর। মুখ চেনেন, নামও জানেন। বসে রয়েছে ক্লাসে, অথচ জবাব দিচ্ছে না। এম. এ ক্লাসে ক’টাই বা মেয়ে, সবাইকার বায়ো-ডাটা স্যারেদের নখদর্পণে। স্যারের মুখে বিরক্তি, বিদ্রূপ। —‘হ্যাললো শকুন্তলা, আর য়ু থিংকিং অফ ইয়োর দুষ্মন্ত?’ ক্লাসশুদ্ধ ছেলে-মেয়ে অসভ্যের মতো হাসছে। হো-হো করে। কলির মুখ লজ্জায় নিচু। লজ্জায়, অপমানে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে আর কোনদিন এ. কে. বির ক্লাস করবে না। কোনদিন না। তখন বুঝবেন একঘর ছেলের মাঝখানে এরকম নিষ্ঠুর নির্লজ্জ ঠাট্টা করবার ফল কি। সবাই হাসছে কলি বুঝতে পারছে। একমাত্র তার মুখোমুখি বেঞ্চে ছেলেটি নির্বিকার। মুখ সামান্য বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। পরিমল। অনুরাধা পাশ থেকে কনুইয়ের গুঁতো দিচ্ছে। —‘এই কলি, এই, দ্যাখ পরিমল রেগে গেছে। তোর হয়ে। অন ইয়োর বিহাফ। য়ু শুড বি গ্রেটফুল। হি, হি।’ অনুরাধা ইংলিশ মিডিয়াম থেকে এসেছে, কথায় কথায় ইংরেজি বলে, ছেলেদের সঙ্গে মেশেও খানিকটা, নানারকম খবরাখবর সংগ্রহ করে আনে। কারুর কোনও ভাবান্তর ওর চোখ এড়ায় না।

ক্লাস শেষ হতে সে কলিকে ঠেলতে ঠেলতে পরিমলের পাশ দিয়ে বার করে।

—পরিমল বলছে—‘আমি দুঃখিত। ক্ষমা চাইছি।’

কলির মুখ লাল। কিছু বুঝতেও পারছে না, বলতেও না।

অনুরাধা হাসছে—‘কিসের ক্ষমা? কেন ক্ষমা?’

—‘এ. কে. বির হয়ে। ওঁর রুচিবিরুদ্ধ উক্তির জন্যে। আই অ্যাম অ্যাশেমড অফ হিম।’ কলি পালাতে পারলে বাঁচে। পরিমলের সামনে থেকে। অনুরাধার পাশ থেকে।

পরিমল ধুতি শার্ট পরা, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। খুব গম্ভীর। হাসলে দাঁত দেখা যায় না। খুব দায়িত্বশীল, ভদ্র এবং পরিচ্ছন্ন। সিগারেট টানে না। মাঝে মাঝে খুব গভীর দৃষ্টিতে কলির দিকে চেয়ে থাকে। এটা অনুরাধার আবিষ্কার। প্রথমে অনুরাধা ভেবেছিল, সে-ই এই জরিপের লক্ষ্য। তাই একদিন অন্য বেঞ্চে বসল। সেদিনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। পরিমল মুখুজ্জের নিরীক্ষণের বিষয় স্মার্ট, চোখে-মুখে কথা বলা, তুখোড় মেয়ে অনুরাধা নয়, শ্যামলা, লাজুক, মুখচোরা কলিকা ভট্টাচার্য। অনুরাধা বলে—‘ডাক্তারি পড়তে পড়তে ছেড়ে দিয়েছে। এসে এখন আর্টস-ক্লাসে জুটেছে রে কলি, তুই কি মাটিয়া কলেজের সামনে দিয়ে রোজ যাতায়াত করতিস না কি?’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress