শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 13
চেহারাটি শান্ত, গভীর অথচ মধুর। যেন অনেক অভিজ্ঞতা পরিপাক করে তবে এই মাধুর্যে পৌঁছতে পেরেছে। পরিপাটি বেশবাস, বেশকে ছাড়িয়ে মানুষটিকেই চোখে পড়ে আগে। কথাবার্তা মৃদু, দৃঢ়, মার্জিত, অথচ সপ্রতিভ। স্কুল-বোর্ডের প্রত্যেকের পছন্দ হয়ে গেল। সরকারি অনুদান এঁরা নেন না। ট্রাস্টের টাকাতেই স্কুল চলে। বহু ধনী লোকের দান রয়েছে। সব সরকারি নিয়মকানুন মেনে চলবার দরকার হয় না তাই। এঁরা মনে করেন শিক্ষয়িত্রীদের সবচেয়ে বড় গুণপনা তাঁদের চরিত্র, এবং সেই চরিত্রকে বাইরে রূপ দেবার উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব। চরিত্র বলতে অবশ্য এঁরা মোটের ওপর আভিজাত্য, ভদ্রতা, নৈতিক পবিত্রতা এই সবই বোঝেন। পোশাকে, কথাবার্তায়, হাব-ভাবে এই জাতীয় চরিত্র প্রকাশ পেলেই এঁরা খুশি। চরিত্র বলতে যদি খুব বেশি আত্মস্বাতন্ত্র্য, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকবার ক্ষমতা, এই সব বোঝায় তাহলে এঁরা হয়ত একটু অসোয়াস্তি বোধ করবেন। আপাতত প্রার্থিনীর চেহারাটি পলকা, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে স্বভাবটি হালকা নয়। সুতরাং বন্দনার চাকরি প্রায় এককথায় হয়ে গেল।
মিসেস খাসনবিশ সেক্রেটারি। বললেন—‘শী নীড্স ইট ভেরি মাচ, বাট ডাজন্ট মেক এ শো অফ দ্যাট।’ অতুল মুখার্জি চেয়ারম্যান, বললেন—‘একজ্যাক্টলি। এটা আমার মতে ভদ্রমহিলার সবচেয়ে বড় কোয়ালিফিকেশন। আর তাছাড়াও, মেয়েদের প্রোভাইড করবার জন্যেই তো একদিন এ স্কুলের পত্তন হয়েছিল। এই ধরনের মেয়েদের। এডুকেশন দিয়ে ছেড়ে দিলেই তো হবে না, প্রয়োজনে তার অ্যাপ্লিকেশনের ভদ্র ক্ষেত্রও তো দিতে হবে।’
—‘বছরখানেক যাক, বি. এডটা আমরাই করিয়ে নেবো’, আরেকজন সদস্য বললেন।
সংসারের অর্ধেক কাজ করে দ্যান সোমনাথবাবু। তাঁর অবসর রয়েছে, স্বাস্থ্য ভালো, উৎসাহ প্রচুর। বন্দনা আর রূপকে পেয়ে তিনি যেন নতুন জীবন পেয়েছেন। এমন উদ্যমের সঙ্গে নাতির জুতো পালিশ করেন, কেড্সে রঙ লাগান, যে কোনদিন তিনি এগার হাজার থেকে ষোল হাজার ফিটের মধ্যে ট্রেকিং করে বেড়াতেন, কিংবা চার হাজার ফিটের তলায় নামলে অস্বস্তি বোধ করতেন এ কথা কেউ বললেও বিশ্বাস করবে না। ভীষণ সংসারী এক দাদু-মানুষ। বন্দনার হাতের কাজ অভ্যেস হয়ে যেতে বছরখানেকের বেশি লাগল না। এখন কাজগুলো যান্ত্রিকভাবে হয়ে যায়, সুতরাং মন তার নিজের কাজ আরম্ভ করে দেয়, কি করি, কি করি করে অস্থির তো করে দেয়ই তারপর সোমনাথবাবু দেখেন, স্টোভে ভাত চাপিয়ে বন্দনা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আনাজ কুটতে- কুটতে আগে কাকাকে যে কারণে বকত এখন নিজেই তাই করছে। অর্থাৎ কুটছে তো কুটছেই।
সোমনাথ বললেন—‘বুড়ি, তুই এম এ-তে ভর্তি হয়ে যা।’
বন্দনা বলল—‘তার চেয়ে আমি একটা চাকরি করি না, কাকা। টাকাকড়িও কিছুটা সুবিধে হয়।’
—‘তোর যা ইচ্ছে, যেমন ইচ্ছে, যাতে তুই ভালো থাকিস তাই কর।’
বাড়ি থেকে স্কুল সামান্য দূরত্ব। হেঁটেই চলে আসতে পারে বন্দনা। পথটুকু যেন মুক্তির আপন পথ। সুখী হবার জন্য পথে বার হওয়া যে তার এতো জরুরি ছিল, সে আগে কখনও বোঝেনি। ঘরের মধ্যে যেন অনেকগুলো আয়না ফিট করা থাকে। প্রত্যেকটি দেয়াল থেকে একটি করে আত্মমুখ চেয়ে থাকে, যেদিকে তাকাও খালি আমি, আমি, আমি। সেই আমির ভাবনা, আমির দুঃখ, আমির দুশ্চিন্তা, মন-খারাপ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দিবাস্বপ্ন দিয়ে ক্রমে ক্রমে বাড়িটার কোণগুলো পর্যন্ত ভর্তি হয়ে যায়। দমবন্ধ হয়ে আসে। কাঁধে নতুন চামড়ার ব্যাগ, পরনে ফিকে সবুজ চিকনের কাজ করা শাড়ি, বন্দনা চলেছে, দুধার দিয়ে বয়ে চলেছে জনস্রোত। বহমান বলে প্রতি মুহূর্তে যেন নতুন হয়ে উঠছে। ব্যস্ত সমস্ত, কর্মস্থলে চলেছে, স্টপে স্টপে অফিসযাত্রী মানুষের উত্তেজিত অপেক্ষা। তারই মধ্যে অপেক্ষাকৃত মন্থরগতিতে প্লাস্টিকের ঝুড়ি হাতে দুলিয়ে বাজার করতে চলেছে কোনও সুখী গৃহিণী। বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে কোনও মা। বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরবে। গাঁজা পার্কে এই কর্মব্যস্ত সকালেও বেশ কিছু লোক এসে গেছে। এরা কি বেকার? না অবসরপ্রাপ্ত? কি সূত্রে এদের এখন এ-পার্কে আসা, এ হেন অসময়ে, তা বোঝা সম্ভব নয়। কোন কোনদিন রিকশায় উঠে পড়ে বন্দনা। এমনিতে তার বেরোনোর সময়ের হেরফের হয় না। কিন্তু এক-এক দিন রূপ স্কুলে চলে যাবার পর কাকা বাড়ি ফিরে খুব গাঁই-গুঁই করতে থাকেন।
—‘তুই চাকরিটা নিলি, আর এখন দ্যাখ আমাকে একা-একা খেতে হবে।’
বন্দনা অপরাধী-অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখলে, কাকা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘যাঃ, তোর দেরি করিয়ে দিলুম। শিগ্গিরি বেরিয়ে পড়। আমার একা খেতে কোনই অসুবিধে হবে না।’
সামান্য মনখারাপ নিয়ে একটু দেরি করে বাড়ি থেকে বেরোয় বন্দনা। হাঁটতে ভালো লাগে না, ফুটপাতে খুব ভিড় মনে হয়। যদিও সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিতে থাকে যুবকরা। মানুষ। মানুষ দেখতে-দেখতে আস্তে-আস্তে তার চিত্ত ভরে যায়। হাসি-খুশি, রাগী-রাগী, বিরক্ত, তৃপ্ত দেখতে, অসুখী খিটখিটে দেখতে, ব্যস্ত, ঢিলেঢালা, কত রকমের মানুষ। মানুষের মুখশ্রী এ ক’দিনেই ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলেছে বন্দনা। তার বুকের মধ্যে কে যেন সদাসর্বদা গুনগুন করতে থাকে—আমি তোমাদের সবার একজন। তোমাদের মধ্যে তোমাদেরই মতো কাজ করব, ঘুরব, ফিরব, দোহাই তোমাদের আমাকে আলাদা করে রেখ না। ঘর সে যত পবিত্র, যত পরিচ্ছন্ন, যত সজ্জিতই হোক না কেন, তার চেয়ে এই ছায়াচ্ছন্ন বীথিকাপথ, কিংবা ঢং-ঢং ঘণ্টিবাজাননা ট্রামলাইন পাতা, তীব্রগতিতে ভারি দোতলা বাস চলা, বহু মানুষের অবিরাম চলাফেরায় অক্লান্ত রাজপথ অনেক, অনেক গুণে ভালো। অথচ অফ পিরিয়ডে সহকর্মিণীদের সঙ্গে গল্প করতে-করতে একেক সময়ে বন্দনার কাকার জন্যে ভীষণ মন কেমন করে ওঠে। সে সমস্ত রান্না সেরে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে, টেবিলের ওপর কাকার খাবার বাটিতে-বাটিতে বেড়ে থালা চাপা দিয়ে রেখে আসে। কাকা রূপকে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে গড়িমসি করে ব্যায়াম করেন, তেল মাখেন, চান করেন, গীতা পড়েন, যে অধ্যায় বন্দনাকে পড়াবেন মনে করেন সেটা দাগ দিয়ে দিয়ে ভালো করে পড়ে রাখেন। তারপর ঠাণ্ডা খাবার খেয়ে সব নামিয়ে দেন। স্টোভে একটু গরম করে নেওয়া কিছুই না, বন্দনা যখন বাড়ি থাকত তখন সোমনাথবাবু আগ বাড়িয়েই কাজটা করতেন, বলতেন—‘সারা সকাল রেঁধেছিস আর উনুনের ধারে যাসনি।’ কিন্তু এখন যেহেতু তাঁকে একা খেতে হয়, সেহেতু গরম করার হাঙ্গামায় তিনি আর যেতে চান না। বন্দনা বকাবকি করলে হাসেন, বলেন—‘যে মানুষের ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে, একটু গরম-ঠাণ্ডায় তার কি এসে যায় বল তো?’
বাসনমাজার লোক এলে দরজা খুলে দেওয়া, রূপ ফিরলে তাকে মোড়ের মাথা থেকে নিয়ে আসা, খেতে দেওয়া, সমস্ত সামলান কাকা। বন্দনা যখন ফেরে, তখন পরিষ্কার তকতকে বাড়িতে শেষ বেলার আলো, ছেলের ঘুমন্ত মুখে সেই আলো ছড়িয়ে থাকে। পাশে আর্মচেয়ারের হাতল থেকে পা দুটো নামিয়ে নিয়ে কাকা বলেন—‘তুই এখানে একটু শো বুড়ি। আমি চা-টা করি।’
বন্দনা বলে—‘আচ্ছা, তুমি কি বলো তো? সারা দুপুর তো একবার ওপর একবার নিচ করেছো। একটু ঘুমিয়ে ছিলে তো?’
—‘ঘুমোবো কি রে? পাগল হলি নাকি? জীবনের আর ক ঘণ্টা মোটে বাকি বল দিকিনি? ঘুমিয়ে সে সময় কেউ নষ্ট করে? শোন, লুচির ময়দা মেখে রেখেছি, আলু কুটে জলে ভিজিয়ে রেখেছি, চল তোকে গরম-গরম ভেজে দিই।’
—‘আচ্ছা কাকা, তোমাকে আমি সত্যি ভীষণ বকবো। কে তোমাকে বলেছে লুচির ময়দা মাখতে। তুমি খাবে?’
—‘আরে আমি তো খেয়েছি তখন প্রায় দুটো। এখন কি আর খেতে পারি? চা ছাড়া কিচ্ছু না।’
—‘তাহলে রূপু খাবে?’
—‘উঁহুঃ, ওকে কিচ্ছু দিসনি। পেট পুরে ভাত খেয়েছে, মাংসটা গরম করে দিলুম। ব্যাটা গপাগপ এক থালা খেয়ে নিল। এখন পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আর কিচ্ছু দোব না।’
—‘তাহলে কার জন্যে লুচিটা হবে?’
—‘কেন বুড়ি, তুই কি মানুষ না? তুই কি সকাল নটায় সামান্য দুটো খেয়ে সারা দুপুর গলাবাজি করে, এই চারটের সময় এক মাইল পথ হেঁটে বাড়ি ফিরলি না? তোদের খেতে নেই, খিদে পেতে নেই, না? তোদের জন্যে আলাদা করে কিছু করে দেওয়াটা এতই হাস্যকর? আচ্ছা তৈরি হয়েছিস। গরুর জাত নাকি? সকালে যা খেয়েছিলি, চাট্টি গলার কাছে রেখে দিয়েছিস? জাবর কাটবি। এখন?’
কাকার রাগ দেখে বন্দনা অবাক। বলে—‘কি আশ্চর্য, তুমি এতো রাগ করছ কেন? খাবার তো কত রকম জিনিসই আছে। খাব না কেন? লুচিটা হাঙ্গামা নয়?’
—‘খাবার অনেক জিনিস আছে? তোর ভাঁড়ারের খবর আমি রাখি না। কি আছে শুনি? পাঁউরুটি? পাঁউরুটি চিবোতে ভালোবাসিস তুই? সত্যি করে বল।’
—‘ন্না।’
—‘মুড়ি? মুড়ি চিবোতে ভালো লাগবে সারাদিনের পর?’
—‘খেলেও হয়। অসুবিধে কি! চায়ের সঙ্গে একবাটি মুড়ি নিয়ে নিতুম।’
—‘মুড়ি মাখবার কি রেখেছিস? চানাচুর? বাদাম ভাজা? নারকোল?’
—‘উহুঃ।’
—‘তাহলে কি ভাবে খাবি? শুকনো মুড়ি একগাল আর এক চুমুক করে চা!’
—‘ঠিক ধরেছে। আমার খুব ভালো লাগে।’
—‘ভালো লাগাচ্ছি তোকে। আমি এখনও বেঁচে আছি; বুঝলি? তোকে তো আর করতে হচ্ছে না। আমি সারাদিন শুয়ে বসে আছি; আমি তোকে ভেজে খাওয়াব। লুচিগুলো সব হয়ত গোল হবে না। কোনটা কোনটা আফ্রিকার ম্যাপের মতো, অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপের মতো হয়ে যাবে।’ বলতে বলতে কাকা হেসে ফেলেন।
অগত্যা বন্দনা রান্নাঘরে গিয়ে লুচি বেলে দেবে। কাকার কি গোঁ; সেই লুচি ভেজে, আলু ছেঁচকি করে তাকে খাইয়ে তবে ছাড়বেন।
সত্যি কথা, চাকরিটা নিয়ে বন্দনা বেঁচে গেছে। মেয়েদের পড়ানোটা বন্দনার কাছে যত না পড়ানো, তার চেয়ে বেশি পড়া। ওদের ছেলেমানুষি কথাবার্তা, আগ্রহ, কৌতুক, সব মিলিয়ে তরুণ জীবন্ত মনগুলোকে সারা ক্লাস পড়ানোর নাম করে ও শুধু উপভোগ করে। সেভন থেকে এইট, এইট-এ থেকে এইট-বি। তার এই খুশিটা স্টাফরুমের সবার কাছে বেশ প্রকাশ হয়ে পড়ে। তৃপ্তিদি একদিন বললেন—‘আরে ওই দুষ্টুর শিরোমণি এইট-বির ক্লাস করে তোর এতো খুশি কিসের? অ্যাঁ?’ চিন্তাদি বললেন—‘প্রথম প্রথম তো। দু দিন যেতে দাও না, তারপরই ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশবে।’ কিন্তু বন্দনা জানে সে ক্লান্ত হবে না। আসলে আর্থিক স্বাধীনতার ব্যাপার নয়। কাকার কাছে আসবার পর থেকে টাকাকড়ির ব্যাপারে তার আর নিজেকে পরনির্ভরশীল মনে হয় না। কিন্তু মানসিক নির্ভরতা? সেটা থেকেই গেছে। এখন তার একটা নিজস্ব জীবন হয়েছে যেটা কাকা-নির্ভর নয়, রূপ-নির্ভরও নয়। এতে যে তার চারপাশের গণ্ডিটা কিভাবে দূরে হটতে-হটতে মিলিয়ে গেছে এবং মিলিয়ে গিয়ে কি পরিমাণে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তা একমাত্র সে-ই জানে। কিন্তু কাকা? কাকার জীবনের গণ্ডিটাকে সে কেটে ছেঁটে ছোট করে দিল না তো? তাদের জন্যই তিনি ভ্রমণের নেশা ছাড়লেন। অমন পর্যটক মানুষটা হাতা-খুন্তি বেড়ি-ঝাঁটা- বালতি ধরলেন, তাঁর কর্তব্যবোধে তিনি করছেন, কিন্তু তাঁকে সঙ্গ দিয়ে, তাঁর যত্ন করে, ক্ষতিপূরণ করে দেওয়াটা কি তার উচিত ছিল না? কাকাকে সে একটা আনন্দহীন খাটুনির জীবনের চক্রে বেঁধে দিল না তো!
যেদিন এরকম মনে হয় সেদিন বন্দনা ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ক্লাসে যেতে দেরি করে, কখন ছুটি হবে সে-জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। ফেরবার সময়ে তার প্রিয় জ্যাকারান্ডা কি করবী গাছের ফুলের থোকার দিকে তাকায় না। ধূলিমলিন যে রাস্তা হাঁটতে সে রোজ রোজ বেঁচে থাকার আনন্দস্বাদ পায় আজ তা পায় না, কোনক্রমে ব্যস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে দরজার কড়াটা এমনভাবে নাড়ে যেন ভয় পাছে কেউ দরজা না খোলে। কাকা এসে দরজা খুলে দিয়ে এক মুখ হাসেন। সেই প্রিয় প্রৌঢ় মুখখানাকে দেখে তবে শান্তি। বন্দনার সে সময়ে ইচ্ছে করে ছোটবেলার মতো কাকাকে জড়িয়ে ধরে গালে খুব কষে হামি খায়। কিন্তু সে অভ্যেস চলে গেছে। এখন জিনিসটা পাগলামি বা ন্যাকামি বলে মনে হবে। বিশেষ করে তাদের দু-জনের স্বভাবই খুব সংযত, উচ্ছ্বাসহীন বলে। সে খুব করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে—‘কাকা তুমি ভালো আছো তো? ভালো ছিলে?’ —বলতে বলতে চোখ ছলছল করতে থাকে।
সোমনাথবাবু বলেন—‘হঠাৎ—? ভালো থাকব না কেন? ও কি কাঁদছিস নাকি?’
—‘তোমার জন্যে আজ সারাদিন মন কেমন করছিল স্কুলে।’
—‘আচ্ছা পাগল মেয়ে তো। আমি কি তোদের ফেলে কোথাও গেছি?’
বন্দনা মনে মনে বলে—‘তুমি যাওনি কাকা, বরং ফিরে এসেছ, মুক্তজীবন থেকে স্বেচ্ছায় এসে জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছ, তুমি মহানুভব। আসলে আমিই চলে গেছি। তোমায় ফেলে চলে গেছি।’
সারা সন্ধে কাজকর্ম করতে-করতে ঘুরে-ঘুরে বন্দনা কাকার কাছে চলে আসে। বাচ্চা মেয়ের মতো। রূপ খেলার মাঠ থেকে ফিরে একটু মাকে চায়, রাত্রে কোনদিন মার কাছে, কোনদিন কাকার কাছে শোয়। বন্দনা ছেলের সঙ্গে গল্প করে। কিন্তু মন পড়ে থাকে কাকার কোলের কাছটিতে। প্রাণপণে সে খালি বোঝবার চেষ্টা করে কাকার প্রাপ্তির ঝুলিতে কিছু কম হয়ে যাচ্ছে কি না।