শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 10
এ বছর বৃষ্টি হয়নি তেমন। আষাঢ়ে বৃষ্টি হয়েছে নিয়মরক্ষা। শ্রাবণের বৃষ্টি গ্রামের দিকে যত ঝরেছে, শহরে তত ঝরেনি। এক এক দিন মেঘের পরে মেঘ জমে। ঘন শ্রাবণ মেঘ। মাটির ওপর মেঘের ছায়া। তারপর হঠাৎ হু-হু করে হাওয়া দেয়। কিছুক্ষণ পরেই আকাশ ফর্সা। যেন কলির বিয়েতে অসুবিধে হবে বলেই শ্রাবণের গোড়ায় ঝিরঝিরে মতো নামমাত্র হয়ে বৃষ্টি থেমে গেল। আজ সকাল থেকেই মেঘের গুরু গুরু ডাক, কালি-ঢালা আকাশ, তারপর মুষলধার। স্কুলবাস থেকে নেমেই হাঁটু জল। নাতিকে কোলে করে নামালেন দাদু। সে জলে নামবার জন্য ছটফট করছে। দোরগোড়া থেকে ঠাকুমা ধমকাচ্ছেন। বারান্দায় উৎকণ্ঠিত মা আধঘোমটা দিয়ে দেখছে। একটা মস্ত ছাতা দরজার সামনে এসে থামল। ওপরে ছাতা, তলায় জল। মাঝখানে ঢোলা প্যান্ট পরা কোমর, আর তার ওপর ফুলে ওঠা শার্টের অংশ। নাতি-দাদুর দিক থেকে এই দৃশ্যের দিকে চোখ পড়ে গেল। আর কিছু দেখতে হল না। বুকের মধ্যে গুরগুর শুরু হয়েছে। এক দৌড়ে বন্দনা ঘরের মধ্যে চলে গেল। কাকা। দীর্ঘ চার বছরেরও পর।
ক্রমশ ক্রমশ প্যান্ট-গোটানো, ভেরিকোজ-ভেন-অলা শক্ত শক্ত মজবুত কাঠের গুঁড়ির মতো পা দু-খানা দৃশ্য হল। ঠাকুমা মাথায় ঘোমটা টেনে বললেন—‘অ মা, বে-ই মশাই!’ সামান্য লজ্জা পেয়ে ভেতরে যেতে যেতে বললেন—‘আসুন, আসুন। দেখুন দিকি নাতি আমাকে টেনে একেবারে রাস্তায় বার করে ফেলেছে।’
কথা শুনে দাদু পেছন ফিরে তাকালেন—‘আরে আরে সোমনাথবাবু? পথ ভুলে?’ কাশীনাথবাবুর মুখে উল্লাস, বিস্ময়!
—‘দেখ দাদাভাই আজ কে এল!’
বন্দনা ছুটেছে বাথরুমে। চোখ মুখ ভেসে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে একটা বিস্ফোরণের মতো কিছু। তার অশ্রু কি শোকের, না আনন্দের, না অভিমানের? বন্দনা জানে না। সে শুধু দেখছে অনেক দিনের খরার পর বৃষ্টি নামছে। ততক্ষণে ছেলে বাইরে থেকে ডাকাডাকি করছে—‘ও মা। দেখ না আমি কেমন ভিজেছি।’ শাশুড়ি ডাকাডাকি করছেন, ‘অ বউমা, দেখে যাও কে এসেছেন, তোমার আবার অসময়ে বাথরুম কেন গো?’
চোখ মুখ ধুয়ে বহু কষ্টে আত্মসংবরণ করে বেরিয়ে এল বন্দনা, একতলায় বৈঠকখানা ঘরে যখন পৌঁছল তখন চোখে জল নেই, কিন্তু চোখ ফোলা, লালচে, বুকের সামনের কাপড় ভিজে।
কাকার গলার স্বর গমগম করছে। কোথা থেকে এলেন। কিভাবে হঠাৎ ঠিক করলেন, টিকিট পেতে কি কষ্ট! বন্দনা ঢুকে প্রণাম করতে আর্তনাদ করে উঠলেন—‘এ কি চেহারা করেছিস রে বুড়ি?’
বন্দনা প্রাণপণে নিজেকে সামলায়, ঠোঁট কামড়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছে। শাশুড়ি বসেছিলেন, নীরস কণ্ঠে বললেন—‘আর কি চেহারাই বা আশা করেন বে-ই মশাই। সব সাধ-আহ্লাদ তো ঘুচেই গেল এই বয়সে। খায় না, দায় না।’
কাকা মাথা নেড়ে বললেন—‘সে কি? এটা তো ঠিক নয়! এ হতে দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়।’
কাশীনাথবাবু বললেন—‘কি ঠিক নয় সোমনাথবাবু?’
—‘এইভাবে জীবনটাকে অপচয় হতে দেওয়া কি ঠিক?’ সখেদে বললেন সোমনাথ। কাশীনাথবাবু বললেন—‘জীবন তো তার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। আর জীবন!’ নিঃশ্বাস পড়ল তাঁর।
কাকা বললেন—‘এ কি কথা বলছেন? বিধাতার দান জীবন! অমূল্য জীবন, সে কি নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক?’
শাশুড়ি বললেন—‘বউমা, কাকাকে ঘরে নিয়ে যাও মা। শুকনো কাপড় চোপড় দাও। একেবারে কাক-ভেজা ভিজেছেন।’
বন্দনার পেছন পেছন ওপরে উঠলেন কাকা। মুখে কথা নেই। ঘরের মধ্যে রূপ রঙ-তুলি নিয়ে মেঝেতে বসে গেছে। তাকে দেখে কাকার মুখে হাসি ফুটল। খপ করে কোলে তুলে বললেন—‘আমি কে বলো তো?’
রূপ বলল—‘আঃ ছাড়ো না, জানি না!’
—‘আগে বলো আমি কে, তবে ছাড়ব।’
এঁকে বেঁকে মানুষটির খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসাবার চেষ্টা করতে করতে রূপ বলল—‘তোমার নাম আমি জানি। বে-ই মশাই। বিচ্ছিরি নাম। এরম নাম আবার হয় নাকি?’
কাকা হাসতে হাসতে বললেন ‘ঠিক বলেছ নাতিবাবু। নামটা বিচ্ছিরি, বুড়ি আমি তোর কে হই ওকে বলে দে তো!’
বন্দনা শুকনো গলায় বলল—‘সত্যিই কি তুমি আমার কেউ হও? কেউ নয় তুমি আমার।’
—‘যাক, এতক্ষণে তোর গলার আওয়াজ পেলুম’। কাকা একইরকম হাসি-হাসি মুখে বললেন ‘যাক একটা ধুতি-টুতি কিছু দিবি তো? যতই ঠাণ্ডা অভ্যাস থাক, তোদের এই সমতলের বৃষ্টি গায়ে লাগলেই যত বুড়োটে রোগ চেপে ধরবে।’
বন্দনা বলল—‘তুমি তাহলে পাকাপাকি ভাবেই পাহাড়ি হয়ে গেলে?’
—‘পাকাপাকি আমি কিছুই হচ্ছি না, তা যদি বলিস। কাঁচাকাঁচি বললে না হয় মেনে নিতে পারি।’
বন্দনা আলমারি খুলে অভিমন্যুর ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি বার করে দিল। কাকাকে বাথরুমে নিয়ে গেল।
সোমনাথবাবু স্টেশনে নেমে সেখানে লাগেজ রেখে আগে বুড়ির বাড়ি এসেছেন। এতদিনে এই একবারই মাত্র মনে হয়েছে বড় অন্যায় হয়ে গেছে। বুড়িকে দেখে আসা উচিত ছিল। আসলে সোমনাথবাবুর মনোভাব বড় বিচিত্র। বুড়িকে কোলে-কাঁখে করে মানুষ করেছেন, তার বিয়ে দিয়েছেন উপযুক্ত পাত্র দেখে। তারপর দাদা মারা গেলেন, দাদা ছিলেন তাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। তাঁরও বালকবয়সে বাবা মা মৃত। মস্ত বড় একান্নবর্তী পরিবারে এই দাদাই তাঁকে পক্ষীমাতার মতো সব ঝড়-ঝঞ্ঝা আড়াল করে মানুষ করেছেন। সংসার করেছেন, বেশি বয়সে। বউদি মারা গেলে মনে হয়েছিল দ্বিতীয়বার মাতৃহীন হলেন। দাদা বা দাদার মেয়ের চেয়ে তাঁর নিজের কষ্ট কিছুমাত্র কম হয়নি। বিয়ে তো করলেনই না। মনের মধ্যে নিজের অজ্ঞাতেই কিরকম একটা বৈরাগ্য তৈরি হয়ে গেল। ক্রমশই যেন গিঁট খুলছে। দাদা চলে যেতে শূন্য বাড়িতে মনে হয়েছিল জীবনরজ্জুর সব গ্রন্থিগুলো খুলতে খুলতে জীবন- ব্যাপারটা এবার খুব সোজা সরল দাঁড়িয়ে গেল। আর কোথাও আটকে থাকবার দরকার নেই। মেয়ে ভালো ঘরে-বরে পড়েছে। তার কোনও অভাব-অভিযোগ নেই। সে এতই ব্যস্ত যে কাকার কাছে আর দু-দিন কাটিয়ে যাবারও সময় পায় না। ভালোই তো! যে যার নিজের মতো করে সুখী হোক। সুখে থাকলেই হলো। সুখটাই বড় কথা। ব্যস। তাহলে তো কোনও দায় নেই। পরিণত যৌবনে কেদার বেড়াতে গিয়ে হিমালয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন সোমনাথবাবু। মাঝে মাঝেই ট্রেকিং-এ যেতেন। এবার যেন পাকাপাকিভাবেই পায়ে স্পাইক দেওয়া শু, হাতে লাঠি আর পিঠে রুকস্যাক উঠল। উলিকটের গেঞ্জির ওপর গরম কাপড়ের শার্ট, তার ওপর সোয়েটার, কোট, কম্বল চাপিয়ে সোমনাথবাবু চলেছেন এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে। কেদার-বদরি হল তো গঙ্গোত্রী-গোমুখ, সেটা হল তো যমুনোত্রী, সেটা শেষ হলে অমরনাথ, রূপকুণ্ড, সন্দকফু, ফালুট। আবার নেপাল হয়ে এভারেস্টের পাদমূলে। যতটা যাওয়া যায় একটার পর একটা। সারা বছর অফিস করেন, তারপর মাসখানেকের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। চাকরিটা বড্ডই বাধাস্বরূপ মনে হওয়াতে একটু সকাল-সকাল অবসর নিয়ে নিলেন। ব্যাস তারপর থেকে বাধাবন্ধনহীন হিমালয়যাত্রী। আলমোড়ায় বসে খবর পেলেন অভিমন্যুর মৃত্যুর। পিঠের কাছে তখন গোটা হিমালয়ান রেঞ্জ, চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ, ত্রিশূল কোলে কোলে রোদ এসে পড়েছে। অপূর্ব শোভা। কুয়াশা কেটে ক্রমশ ঝকঝক করছে সব। সবই যেন মানুষের কামনা-বাসনা, আনন্দ-বিষাদের ঊর্ধ্বে। মনে হল, না না অভিমন্যু মোটেই হারায়নি, আছে এই পৃথিবীতেই, এই বায়ুমণ্ডলে, শরীরের বাধা মুক্ত হয়ে সে পরমানন্দে ভ্রমণ করছে। সে-ও বুঝি এবার তাঁর মতো পরিব্রাজক-ভূমিকা বেছে নিল। সব মানুষই শেষ পর্যন্ত তাই নেয়। বুড়ির কিছুদিন খুব কষ্ট হবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলে আর কষ্ট নেই। কিছুদিন, মাত্র কিছুদিন মেয়েটা অপেক্ষা করুক। জীবনের সত্য-রূপ বুঝতে মাত্র ক’টা দিন আর। নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে কনখল হয়ে কাশীতে পৌঁছলেন সোমনাথবাবু। কাশীতে থাকাকালীন, দশাশ্বমেধ ঘাটে তাঁর একদিন একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়।
লাক্সার রোডের ধর্মশালা থেকে রোজই দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে আসতেন তিনি। একদিন ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, দেখলেন সাদা থান পরা এক অশীতিপর বৃদ্ধা গঙ্গাস্নান করে জড়-পুঁটলি হয়ে বহু কষ্টে উঠে আসছেন। উঠতে উঠতে হঠাৎ বসে পড়লেন, সোমনাথবাবু তাড়াতাড়ি তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়ে দেখেন তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ঘাটের সিঁড়ির ওপর সোমনাথবাবুর কোলে মাথা রেখে, সোমনাথবাবুর হাতের গঙ্গাজল মুখে নিয়ে বৃদ্ধা মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে মনে হল বিড়বিড় করে কি বলছেন।
—‘কিছু বলবেন, মা?’ সোমনাথবাবু তাঁর মুখের কাছে কান নিয়ে গেলেন। ‘কিছু চাই?’
—‘নারায়ণ, নারায়ণ,’ অতি কষ্টে বললেন বৃদ্ধা।
—‘বলুন, কি ইচ্ছে আপনার!’
—অজ্ঞাত পরিচয় প্রৌঢ়ের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা বললেন, ‘বিশ্বনাথ, পরজন্মে যেন আর বিধবা করো না।’
সোমনাথবাবু একটা ধাক্কা খেলেন। মানুষের কত রকমের আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রার্থনার বস্তু আছে জীবনে। রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশো দেহি, দেহি মে। অথচ আশি বছর অতিক্রান্ত এই বৃদ্ধার মুখ দিয়ে এতো অকিঞ্চিৎকর প্রার্থনা উচ্চারিত হল! আর কিছু চাওয়ার কথা মনে পড়ল না? ঐশ্বর্য, বুদ্ধি, যশ, জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঈশ্বর-প্রেম কিছু না। শুদ্ধ নির্বৈধব্য?
মুখ তুলতে নানা বয়সের আরও কয়েকটি মুখ দেখতে পেলেন সোমনাথ। বেশির ভাগই শীর্ণ। নানা অভিজ্ঞতার রেখা আঁকা, হাতে গঙ্গাজলের ঘটি, গায়ে নামাবলী, সব মুখেই যেন এক মুখ।
হঠাৎ সোমনাথবাবু সোজা হয়ে বসলেন—মৃত বৃদ্ধাকে অনেকক্ষণ থেকে চেনা-চেনা লাগছিল। কেন তিনি বুঝতে পেরেছেন। তাঁর মুখে যেন বুড়ির আদল।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বললেন—‘দিদিমা মুক্তি পেলেন। আহা বোধহয় গত পঞ্চাশ বছর ধরে মানুষটা একা একা এই কাশীতে পড়েছিল গা! কী দুঃখুটাই পেয়েছে।’
আর এক জন কপালে জোড় হাত ঠেকিয়ে বললেন—‘গঙ্গার কোলের ওপর গেলেন। মাসিমার ডাক নিশ্চয়ই শুনবেন বাবা, পরের বারে দেখ। যাবে ভাগ্যিমানি জাজ্বল্য এয়োতি হয়ে পাকা মাথায় সিঁদুর পরে। বিশ্বনাথ, বিশ্বনাথ!’
ব্রাহ্মণ সন্তান, শেষ সময়ে মুখে জল দিয়েছেন, অপরিচিতা বৃদ্ধার মুখাগ্নি সোমনাথবাবুই করলেন। সারা দিনের পর স্নানটান সেরে ধর্মশালার টানা বারান্দায় বসলেন। পাহাড় থেকে সমতলে নামলে কিছুদিনের জন্য শরীরটা বেজুত হয়ে থাকে। হরিদ্বারে মাত্র একদিন কাটিয়ে কাশীতে এসেছেন। কেমন একটা অবসাদ। আগে এমন হলে মনে হত, সমতলের হাওয়া তাঁর সহ্য হচ্ছে না, আরও উঁচুতে থাকা দরকার। চলে যাওয়া দরকার, আবার। আজ মনে হল—না। গ্রন্থিমোচন হয়নি। হয়নি বলেই এই অবসাদ। জীবনের পাকে যে গিঁট পড়েছে, তিনি তাকে খোলবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে চলে গেছেন, যতক্ষণ না খুলছেন যতক্ষণ না ফিরছেন, হিমালয় বৈরাগ্য, আনন্দ সব মায়া। সব মিথ্যা। তিনি একেবারেই মূর্খের স্বর্গে বাস করছিলেন। বুড়িমাকে এক্ষুনি একবার দেখে আসা দরকার।
কাশীনাথবাবু এবং তাঁর স্ত্রী কিছুতেই সোমনাথবাবুকে যেতে দেবেন না।
কাশীনাথ এবং তাঁর ভাই বন্দনার খুড়শ্বশুর দুজনেই বললেন—‘লাগেজটা আপনি স্টেশনে রেখে এলেন কেন, বুঝিয়ে বলুন আগে।’
—‘আরে প্রায় বছরখানেক পরে বাড়ি ফিরছি। বাড়ি তো একটা জঞ্জালের আণ্ডিল হয়ে আছে কি না। তাই ভাবলুম ওদিকে গিয়ে কাজ নেই। দেরি হয়ে যাবে, আগে বুড়িকে দেখে…’
—‘তা বেশ তো, হাতের সুটকেস, বেডিংটা নিয়ে আসতে কি হয়েছিল? বুড়ির বাড়িতে কি আপনার উঠতে নেই?’
বেয়ান হেসে বললেন—‘তা সুটকেসের জিনিসও বুড়ির বাড়ি আছে, আর শয্যের অভাবও ভগবানের ইচ্ছেয় এখনও হয়নি। তোমরা ওঁকে সুটকেস-বেডিং-এর জন্যে অত হয়রান করছ কেন?’
সোমনাথবাবু উকিলি জেরার মুখে খুবই অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন। কিছুতেই তিনি মুখ ফুটে বলতে পারছেন না, কুটুমবাড়িতে ও রকম না বলে-কয়ে হুট করে ওঠা যায় না। অন্তত তিনি পারেন না।
বেয়ান বললেন—‘বেশ তো, যা করেছেন করেছেন। এখন মেয়ের বাড়ি দু-দিন জিরিয়ে তবে জঞ্জালের আণ্ডিলে যাওয়া হবেখন।’
বন্দনা চা দিয়ে গেল কুটুমদের জন্য তুলে রাখা, দামী বোন চায়নার কাপে। সঙ্গে মুড়ি, বেগুনি, ফুলুরি। ইলিশমাছ ভাজা। বেলা চারটে প্রায় বেজে গেছে। সোমনাথবাবু তাঁর নিয়ম ভঙ্গ করে ভাতে কিছুতেই আর বসবেন না। শেষ বেলায় গড়িয়ে নেবার অভ্যাসও সোমনাথবাবুর নেই।
বেয়াই-বেয়ানদের সঙ্গে গল্পগাছা সেরে বন্দনার আয়ত্তের মধ্যে আসতে সোমনাথের সন্ধে প্রায় উতরে গেল।
বন্দনা বলল—‘কাশীতে আমার মতো দেখতে কাকে দেখলে তাইতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল বুড়ি বলে একটা মানুষ আছে, নইলে কাশীর পর কোথায় যেতে?’
কাশীর দৃশ্যটা মনে পড়ে সোমনাথের মুখের ওপর ছায়া নেমে এসেছে। কার মুখে কখন তিনি বন্দনার আদল দেখেছিলেন সে সব খুঁটিনাটি তিনি বলেননি। মনে করতেও চান না আর। তবু তো মন থেকে মোছা যায় না কিছুতেই! অশীতিপর এক মৃত্যুপথযাত্রিণীর মুখে এক যুবতীর মুখের আদল কেউ দেখে? তবু তো দেখেছিলেন! মুখের গাম্ভীর্যটাকে মুহূর্তের মধ্যে মুছে ফেলে সোমনাথ বললেন—‘কোথায় আর যেতুম রে বুড়ি। তোর কাছে যে আমার কান বাঁধা। তবে হ্যাঁ, তোকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব। জানি পুঁচকেটাকে নিয়ে পারবি না, তাই উচ্চবাচ্য করিনি। কিন্তু তোর যে খুব অসুখ গেছে। বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছিস মাসের পর মাস—এ সব কথা তো আমি জানতুম না মা!’
বন্দনার চোখে জল এসে যায়! কাকা বলছেন কি! তিনি কি সত্যিই এ পৃথিবীর নন? নির্মম, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন? এমন করছেন, এমন ভাবে কথা বলছেন যেন বন্দনার কিছুই হয়নি, কোনও পরিবর্তনই হয়নি তার জীবনে, মাসের পর মাস বিছানায় শুয়ে থাকার কোনও কারণ যেন তার ঘটেনি। একবারও অভিমন্যুর নাম মুখে আনলেন না। যেন তিনি জানেন না যে সে নেই। ধরেই নিয়েছেন আপাতত সে কোথাও গেছে, সময় হলেই এসে পড়বে। কিম্বা অভিমন্যু ভট্টাচার্য বলে বন্দনার জীবনে, কাকার জীবনে কেউ কখনও ছিল না। তার শোক দুঃখ ক্ষতির কোনও গুরুত্বই তিনি দিলেন না। নিজের কথাতেই ভরপুর। অমরনাথের পথে কোথায় কবে পিছলে বরফের ফাটলে পড়ে যাচ্ছিলেন। মানস সরোবরে সন্ন্যাসীরা কি রকম অবলীলাক্রমে চান করে অথচ জলে হাত দিলে মনে হয় হাত খসে গেল। এভারেস্টের পথে শেরপারা তাঁকে ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখিয়েছিল। এমনভাবে বলছেন যে এক একটা সময়ে রূপের সঙ্গে সঙ্গে বন্দনাকেও হেসে ফেলতে হচ্ছে।
—‘বুঝলে নাতিবাবু, আমি চলেছি আর কুয়াশা চলেছে। আমি যদি চলি তিন পা তো কুয়াশাটা চলে ছয় পা। শেরপা ব্যাটাও চলেছে, কিন্তু চলছে কি না বুঝতে পারছি না তো। এমন ঘন কুয়াশা যে মনে হচ্ছে সামনে একটা খাড়া সাদা দেয়াল, নিশ্চয়ই মাথা ঠুকে যাবে। এমন সময়ে সেই বিচ্ছিরি কুয়াশার মধ্যে থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত ডাক। কোনও মানুষ কিম্বা পশুর গলারও অমন আওয়াজ কেউ কখনো শোনেনি হলপ করে বলতে পারি। জানিস, আগের দিনই আবার শেরপাটা ইয়েতির টাটকা পায়ের ছাপ দেখিয়েছে। এক হাত লম্বা, তিনটে মর্তমান কলার মতন আঙুল। আমি তো ভাবলুম এই আমার হয়ে গেল। আলভারেজের শেষ হয়েছিল বুনিপের হাতে, আর সোমনাথ বাঁড়ুজ্জেকে শেষ করবে ইয়েতি। ইয়েতিই আমার নিয়তি। প্রাণপণে কুয়াশার সাদা দেয়াল ফুঁড়ে যেদিক থেকে ডাকটা আসছিল তার উল্টো দিকে দৌড় লাগিয়েছি। আর কোথায় যায়! সোজা ইয়েতির খাসখপ্পরে। বিচ্ছিরি-গন্ধঅলা বুক। একেবারে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর শুনলুম ইয়েতিটা ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলছে—‘এ সাব। আপ কঁহা দৌড়কে দৌড়কে যাতা, পহলে বোলা না হুঁয়াপর খাদ হ্যায়। হুঁয়া মৎ যানা!’
ধড়ে প্রাণ এল, শেরপা দ্রিমিং। বললুম—‘দ্রিমিং, ইয়েতির ডাক শুনতে পেয়েছ?’
দ্রিমিং বললে—‘ইয়েতিকা আওয়াজ! হায় রাম, আপ কিধরসে সুনা। কহানী সুনকর আপকো দিমাগ বিলকুল খারাপ হো গয়া। ডরো মৎ সাব।’
আমি বললুম—‘এই তো দু মিনিট আগে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ। শুনতে পাওনি?’
দ্রিমিং বললে—‘হায় রাম, সাব উও তো হম খাঁসতা থা—বোঝো নাতিবাবু কোথায় ইয়েতির হাসি আর কোথায় দ্রিমিং-এর কাশি।’
রূপ খুব মজা পায়। হেসে লুটিয়ে পড়ে। বন্দনাও হাসতে থাকে, বলে—‘তুমি পারোও বাবা, সেই একরকম রয়ে গেলে। কোত্থেকে গল্পগুলো বানাচ্ছো বলো তো!’
কাকা বলেন—‘তোর মার কথা শুনেছিস? আচ্ছা, এর মধ্যে গপ্প বানাবার আছেটা কি? তবু যদি বলতুম সত্যি ইয়েতি দেখেছি। হিমালয়ে কত মজা, কত রোমাঞ্চ তা তো আর জানিস না। গল্পের চেয়েও অনেক গুণ আশ্চর্য।’
রূপ এখন আস্তে আস্তে দাদুর কোলে উঠে বসেছে। বিরক্তি নেই। আবদার নেই। দুধ খেয়ে নিল দাদুর কোলে বসেই। বন্দনা বলল—‘কতক্ষণ তুই দাদুর কোলে বসে থাকবি রূপু, পা ব্যথা করবে যে!’
কাকা বললেন—‘আরে এখনই দেখছিস কি? এ তো সবে কোলে চড়িয়েছি, এরপর কাঁধে চড়াব, বলো দাদা? তারপর?’
—‘তাপ্পর হিমালয়!’ রূপ হাততালি দিয়ে বলে উঠল।
—‘ওই দ্যাখ বুড়ি, এরই মধ্যে ওকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছি। দিয়েছি তো?’
রাত্রে সোমনাথবাবু জিদ ধরলেন বুড়ির সঙ্গে খাবেন। মেজ দেওর আজকাল বোম্বাইতে বদলি হয়েছে। কলির বিয়েতেও সে আসতে পারেনি। ছোট দেওর আর মিলি আগে খেয়ে নিয়েছে। এবার বাড়ির কর্তাদের পালা। আজকাল খাওয়ার টেবিলে বসবার লোক কমে যাওয়ায় কর্তারা ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই বসেন। কিন্তু আজ বড় বেয়াই এসেছেন। তিনজনে একত্রে বসবেন। সেইমতোই টেবিল সাজানো হয়েছিল। সোমনাথবাবুর জিদ শুনে দুই গিন্নিই আপত্তি করে উঠলেন। গাঁই গুঁই। অসুবিধে আছে। তাছাড়া, বউমার অভ্যাস নেই, ও লজ্জা পাবে। সোমনাথবাবু হেসে বললেন—‘বুড়ি আমার সঙ্গে খেতে লজ্জা পাবে, এ একটা নতুন কথা শোনালেন বটে, বেয়ান। মা অল্প বয়সে চলে গেল। বুড়ির স্কুলে যাবার সময়ে আমাকেই বউদির মতো গরস পাকিয়ে পাকিয়ে খাইয়ে দিতে শিখতে হয়েছিল। প্রথম-প্রথম এমন থাবা ভরে দিতুম যে ওর সাজ নষ্ট হয়ে যেত। জানেন তো। তবু আমি না খাওয়ালে ওর স্কুলে যাওয়াই হত না। আপনাদের বাড়ির বউমা হতে পারে, কিন্তু আমার যে মেয়েও বটে, মা-ও বটে।’
খাবার টেবিল ডান দিকে। শাশুড়িরা দুজনে মিলে সারাটা সন্ধে ধরে অনেকরকম রান্না করেছেন। রুপোর থালায় সাদা বলের মতো লুচি। লালচে মাছের কালিয়া, পোলাও, দই-ইলিশ, মাংস, ভাপা দই, চাটনি। বাঁ দিকে দেয়াল ঘেঁষে বন্দনার কম্বলের আসন পড়েছে। সামনে পাথরের সেট। ফল, মিষ্টি, গ্লাসে দুধ।
সোমনাথবাবু ঘরে ঢুকেই বললেন—‘ওকি ওটা কি বুড়ির জায়গা? নিচে কেন?’
দুই শাশুড়ি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। খুড়িমা ঢোঁক গিলে বললেন—‘কাষ্ঠাসনে দোষ নেই অবশ্য। তবু মাছ-মাংস ছিষ্টি আঁশ, ছোঁয়া ন্যাপা।’
কাশীনাথবাবু কাষ্ঠ হেসে বললেন—‘বেয়াইমশাই সত্যি-সত্যিই কাশী থেকে এলেন তো? আমার কিন্তু মনে হচ্ছে খোদ বিলেত থেকে এসেছেন।’
সোমনাথবাবু সে কথা ভালো করে শুনলেনও না, বললেন—‘এত্তো সব দিয়েছেন আমাদের। বুড়ি-মার যে কিচ্ছু নেই!’
খুড়শাশুড়ি বললেন—‘সকালে একবার ময়দা খেয়েছে, রাত্তিরে আবার খেলে ওর অম্বল হয় কি না!’
—‘তো ভাত দিলেন না কেন? এতো বড় রাতটা ওর কাটবে কি করে? ওই শশা, কলা আর খরমুজা যে পেটের মধ্যে তলিয়ে যাবে? বুঝেছি, ওইজন্যেই ওরকম পেত্নীর মতো চেহারা হয়েছে।’
শাশুড়ি ছেলে ভোলাবার মতো করে একটু কর্তৃত্বভরা কণ্ঠে বললেন—‘নিন নিন আরম্ভ করুন বেইমশাই। মেয়েদের খাওয়ার দিকে নজর দিতে নেই। মেয়েমানুষের গতর লোহার গতর, দুটো খুদ খুঁটে খেলেও গতর ফেটে পড়ে। আজ যে আবার একাদশী!’
সোমনাথবাবু বুঝতে-পারা গলায় স্বস্তির নিঃশ্বাসফেলে বললেন—‘তাই বলুন, আজ আপনাদের সব একাদশী। তাই ফল মূল মিষ্টি। সকড়ি জিনিস খাবেন না কেউ।’
কাশীনাথবাবু তীব্রকণ্ঠে বলে উঠলেন—‘আপনি বলছেন কি সোমনাথবাবু! চাঁদ থেকে এসেছেন না কি? আপনার কথার অর্থ জানেন? আপনার বেয়ানরা এয়োস্ত্রী মানুষ, ওঁরা একাদশী করবেন? ছি ছি ছি!’
সোমনাথ ধরা গলায় বললেন—‘শুধু আমার ওই একফোঁটা মা-টাই তাহলে এইভাবে নিশিপালন করতে পারবে, বলছেন? দাদা চাঁদ থেকেও আসিনি, বিলেত থেকেও আসিনি। কিন্তু এ আমি বাস্তবিকই বুঝতে পারলুম না। শিক্ষিত বাড়ি আপনাদের! আমাকে মাপ করবেন। এ সব আর আমার গলা দিয়ে নামবে না।’
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন কাশীনাথবাবু—‘এ তো আপনি আমাদের অপমান করছেন? কুটুম্ব হয়ে বাড়ি বয়ে এসে অপমান। আপনার মেয়ে আমার বাড়িতে বসে অনাচার করছে, তা জানেন? ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা হয়ে পেড়ে শাড়ি, গহনা পরে বিবি সেজে বেড়াচ্ছে, তবু স্নেহের বশে কিচ্ছু বলিনি।’
উত্তপ্ত আবহাওয়ায় কথার পিঠে কঠিন কথা আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে। শাশুড়ি যোগ করলেন—‘অলুক্ষুণে বউ। সংসারের অলক্ষণ? আমার অমন ইন্দ্রের মতো ছেলেটাকে পেটে পুরেছে। তারও পর অনাচার? এই তো চারদিকে এতো বাড়ি আছে। এতো সংসার আছে। কোথায় এমন বিয়ের ছ-সাত বছর যেতে-না-যেতে এমন ইন্দ্রপাত হয়। আর কোথায়ই বা সোমত্ত বিধবা মেয়েমানুষ হাতে চুড়ি ঝমঝমিয়ে, রঙিন শাড়ি দলমলিয়ে বেড়াচ্ছে? আমরা দুই জা তো সদাসর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকি। কোত্থেকে কি সব্বোনাশ হয়ে যায়।’
ক্রোধ-কম্পিত দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার মুখ দিয়ে আজ অনেকদিন পর জমা রাগ, ক্ষোভ, দ্বেষ সব গলগল করে বেরিয়ে এল। তাঁদের দিকে শান্ত চোখে চেয়ে, ততোধিক শান্ত গলায় সোমনাথ বললেন—‘আজই বরঞ্চ আমি বুড়িমাকে নিয়ে যাই। ওকে রেডি হতে বলুন।’
দরজার পিঠে ঠেস দিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বন্দনা। শাশুড়ির শেষ কথাগুলো কানে ঢুকতে তার হঠাৎ কি রকম তীব্র গা-বমি করে উঠল। টলতে টলতে সে কোনমতে ওপরে গিয়ে ছেলের পাশে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত, কালিমাখা চোখে আর জল নেই। জল আসে না। রাগও নেই। সহসাই যেন তার বোধশক্তি চলে গেছে।
কিছুক্ষণ পরে এসে কাকা যখন মাথায় হাত রেখে, কোমল গলায় বললেন—‘বুড়ি, রাগ করেছিস?’ সে উত্তর দিতে পারল না।
কাকা পাশে বসে পড়লেন। বললেন—‘এদিকে ফের বুড়ি, আমার দিকে তাকা! আমার সঙ্গে যাবি না?’
সে একটু কেঁপে উঠল। ক্ষীণ স্বরে বলল—‘আমি বড় দুর্বহ। তুমি কি বইতে পারবে?’
সোমনাথবাবু বললেন—‘বুড়ি, আমি তোকে বইব না তুই আমাকে বইবি, সে-সব পরে ঠিক হবে রে। আগে তো তুই এই আবহাওয়া থেকে বার হ।’
কাশীনাথবাবুর গলা খাঁকারির আওয়াজ পাওয়া গেল বাইরে।
—‘বেয়াইমশাই!’
—‘বলুন দাদা’। সোমনাথবাবু বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ালেন।
—‘রাগের মাথায় কি বলতে কি বলেছি, দোষ ধরবেন না। হাত জোড় করছি। আপনি না খেলে এরকমভাবে চলে গেলে গেরস্থের অকল্যাণ হয়, মাথা ঠাণ্ডা করে এবার চলুন।’
সোমনাথবাবু বললেন—‘মাথা গরম তো আমি করিনি দাদা! আপনি আমার বড় দাদার মতন। আপনার ওপর কি আমার রাগ করা সাজে? তাছাড়াও, এই মুমূর্ষু মেয়েটাকে আর ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে এতরাতে পথে বার করা বোধহয় ঠিকও হবে না। বৃষ্টিও পড়ছে বেশ। আমরা কাল সকালেই যাব এখন।’
—‘দু চার দিনের জন্যে বউমা আপনার কাছে কাটিয়ে আসবেন এ আর বেশি কথা কি? কিন্তু এইভাবে যদি নিয়ে যান মনে রাখবেন বরাবরের জন্যেই নিয়ে যেতে হবে। খোরপোষের জন্যেও আমি কিছু দিতে পারব না। খোকা তার সব টাকা তার মাকে উইল করে দিয়ে গেছে। সে আমার বড় ছেলে। অনেক যত্ন করে, খরচ করে তাকে আমি মানুষ করেছি। অত খরচ অন্য কোনও সন্তানের জন্য আর করতে পারিনি। তাদের একরকম বঞ্চিতই করেছি বড়র জন্যে। তার সঞ্চয়ের ওপর আমার ন্যায্য দাবি আছে। বউমা এখানে থাকলে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু এখান থেকে তাঁকে নিয়ে গেলে স্বপ্নেও আশা করবেন না যে তাঁর খোর-পোষের জন্য আমার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারবেন।’
সোমনাথবাবু মৃদু স্বরে বললেন—‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন দাদা। অভিমন্যু যদি তার স্ত্রীর ব্যবস্থা করে গিয়ে না থাকে আমার কোনও খরচ দাবি করবার প্রশ্ন উঠছে না। আমি আমার নিজের সাধ্য অনুযায়ী ওদের দেখাশোনা করব। কতদূর কি করতে পারব জানি না, কিন্তু এমন তিল তিল করে মরতে ওকে দেব না। এটা নিশ্চিত।’
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জবাব এল —‘বেশ।’ রাগত খড়মের আওয়াজ দালানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বাজতে লাগল।
পরদিন বেলা নটা নাগাদ বন্দনা রূপের হাত ধরে কাকার সঙ্গে ট্যাকসিতে গিয়ে উঠল। সঙ্গে দুটি ট্রাঙ্ক, একটি সুটকেস, একটি হোল্ডল। শ্বশুরবাড়ির দেওয়া গয়না বিশেষ ছিল না। কঙ্কনজোড়াই সবচেয়ে ভালো, সেগুলো কলিকে দিয়েছে। হার, আংটি, কানের ফুল কিছু একটা প্যাকেটে করে কাশীনাথবাবুর টেবিলে নামিয়ে রাখলেন সোমনাথবাবু। বললেন—‘ছেলেতে যা ইনভেস্ট করেছিলেন, সবই লস গেল। আমার বুড়ি-মা যতটুকু পারছে ফিরিয়ে দিচ্ছে।’
ক্ষিপ্তের মতো গয়নার ঠোঙাটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললেন কাশীনাথবাবু। সোমনাথ বললেন—‘আসি। অভিরূপকে আমার যথাসাধ্য মানুষ করার চেষ্টা করব। আপনি ভাববেন না।’
তীব্রস্বরে কাশীনাথ বললেন—‘নাতিকে ফিরিয়ে আনবার জন্যে দরকার হলে আমি কোর্টঘর করব। এখন যাচ্ছেন যান।’
সোমনাথ ক্রমশই বিরূপ হয়ে উঠছিলেন। জিভ কেটে বললেন—‘নিজে আইনজীবী হয়ে এটা কি বললেন দাদা। কোর্টে গেলে অবধারিতভাবে বেরিয়ে পড়বে অভিমন্যুর লাইফ-ইনসিওরেন্সের টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বুড়ির গয়না… সবই আপনারা…’
খ্যাঁশখেঁশে গলায় কাশীনাথবাবু বললেন—‘যান, যান, আর কথা বাড়াবেন না। অলক্ষণ যত শিগগিরই দূর হয়ে যায় ততই ভালো।’
বন্দনা গাড়ির মধ্যে বসে শিউরে উঠে কানে আঙুল দিল। আসার সময়ে সে শাশুড়িদের প্রণাম করে আসতে পারেনি। তাঁদের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শ্বশুরমশাই পা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, খুড়শ্বশুর বাজার করার ছুতোয় বেরিয়ে গেছেন, তাঁরও সঙ্গে দেখা হয়নি। শুধু খুড়তুত ছোট ননদ মিলি ঘটনা-পরম্পরার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। বন্দনা দোতলা থেকে একতলায় নামছে, সিঁড়ির মুখে মিলি কাঁদতে কাঁদতে তার আঁচল চেপে ধরেছিল।—‘বউমণি তুমি যেও না, তুমি আর খোকামণি চলে গেলে আমি কি করে থাকব। কে আমার বোনা দেখিয়ে দেবে!’ বন্দনা ফিসফিস করে বলেছিল—‘কলেজ-ফেরত যাস না আমার কাছে, ঠিকানা তো জানিস!’
শ্রাবণের আকাশ সজল, গম্ভীর কিন্তু ক্ষান্তবর্ষণ। এতটুকু হাওয়া নেই। পথের পাশে পাশে অ্যাসফাল্টের যেখানে একটু ফাটল পেয়েছে গজিয়ে উঠেছে ঘাস, ঘাসফুল। গাছগুলোর পাতা চিকন সবুজ, বৃষ্টির জলে নেয়ে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকালেই সানাইয়ে পূরবীর আলাপ শুনতে পাওয়া যায়। লাল বেনারসী, দুহাতে শাঁখা, বালা, হাতভর্তি সোনার চুড়ি। পথে যে এখনও জল জমে আছে। কালকের বৃষ্টির বাসি জল। তার মধ্যে অনেকদিন আগেকার কোন বধূর ছায়া পড়েছে। মাথায় মৃতমায়ের সোনার সিঁথিপাটি, দুধে-আলতা ভরা পাথরের থালা, আলপনা, হাতের মধ্যে ছটফটে মাছ। উৎসুক মুখগুলো ওড়না ফাঁক করে দেখছে, খুড়শাশুড়ি বললেন—‘ঘর-আলো-করা বউ হয়েছে দিদি। বরণ আরম্ভ করো, দুধ তো উথলে গেল বলে।’ হাসি-ভরা গলার আওয়াজ। দুধে-আলতায় পা ডুবিয়ে পা দু-টি গোলাপি। ভট্চায্যি বাড়ির প্রথম বউ, কৃতী ছেলের জন্যে অনেক খুঁজে পেতে সংগ্রহ করে আনা রূপসী বধূর বধূবরণ হচ্ছে।