টেনিসের শেষে লীলার সঙ্গে
টেনিসের শেষে লীলার সঙ্গে সমর এসে দূরের বেঞ্চটায় বসল বিশ্রামের জন্যে। পরিশ্রমে তখনও তাদের মুখে রক্তাভা, নিশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত। চোখে অপরাহ্নের আলোয় দেখা যাচ্ছিল বিচিত্র এক মদিরতা।
সমর ভাবছিল আর চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। লীলার কাছে সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব করবে সে। কিন্তু সুযোগ মিলল না। তার আগেই একজন ভৃত্য এসে জানাল, আপনার টেলিফোন ডাক্তারবাবু। আমি ভদ্রমহিলাকে ধরে রাখতে বলেছি।
নিতান্ত অনিচ্ছাভরেই সমরকে উঠে দাঁড়াতে হয়। লীলা ভ্রূভঙ্গি করে বলল, তোমার নার্সটিই করছেন বোধহয়। তার মানেই তোমায় এখনি ছুটতে হবে। আমি ভেবেছিলুম কোথায় ব্রিজ নিয়ে বসা যাবে!
সে-লোভ সমরের নিজেরও বড় কম ছিল না; তবু যেতেই হয়। রিসিভারটা তুলে নিয়ে অপ্রসন্ন কণ্ঠেই ডাকল, হ্যালো!
ওপার থেকে ভেসে এল মায়ার সঙ্কুচিত কণ্ঠ, আমি মায়া বলছি। অজয়বাবু এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। কি একটা জরুরী কথা আছে। অবশ্য আপনার যদি কোন ক্ষতি না হয়—
যাচ্ছি। ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলুন। রিসিভারটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে আবার যখন সমর লীলার কাছে ফিরে এল, মুখখানা তখন তার অপ্রসন্নতায় থমথম করছে। ক্ষুব্ধকণ্ঠে সে বলল, আমাকে ক্লিনিকে একবার যেতেই হবে। এক বন্ধু সেখানে
বাধা দিয়ে লীলা বলে উঠল, শুনে সত্যিই খারাপ লাগছে। আবার ফিরে আসবে তো? তোমায় ছেড়ে দিতে একেবারে ইচ্ছে করছে না।
সমরের বুকের ভেতর রক্তস্রোত উত্তাল হয়ে উঠল। কি উত্তর দেবে চট করে ভেবে পেল না।
লীলা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, কি, জবাব দিচ্ছ না কেন?
ততক্ষণে একটা পথ সমর আবিষ্কার করে ফেলেছে। সেটাই আন্তরিক কন্ঠে ব্যক্ত করল, চেষ্টা করব—নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। সঙ্গে যদি বন্ধুটি আসতে চান, অসুবিধে হবে কি?
ছি ছি। কি বলছ তুমি? নিশ্চয় নিয়ে আসবে।
অনেকখানি নিশ্চিন্ত হল সমর।
তার সঙ্গে যেতে যেতে লীলা প্রশ্ন করল, তোমার বন্ধুটিও কি ডাক্তার?
না। সেন এ্যান্ড সন বিজনেস ফার্মের নাম হয়তো শুনে থাকবে। অজয় হচ্ছে সেই সেন অ্যান্ড সনের সন।
খিলখিল করে হেসে উঠল লীলা। সমরের মনে হল বেলোয়ারি ঝাড়ে অকস্মাৎই ঝড়ের দোলা লাগল। বুকের ভেতরেও সেই ঝড়ের মাতন। সংক্ষেপে বিদায় নিয়ে সে দ্রুত পা চালাল।
চেম্বারে অজয় অপেক্ষা করছিল ঠিকই; কিন্তু সমরকে ফিরিয়ে আনার তাগিদ সে সত্যিই দেয়নি। সমর বেরিয়ে গেছে শুনে স্বাভাবিক কৌতূহলেই মায়াকে জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় গেল এমন অসময়ে? পেশাদার কলে?
ইতস্তত করে মায়া জবাব দিয়েছিল, আমি ঠিক জানি না, মিস্টার সেন—তবে—তবে মনে হয় না
তার ভঙ্গি দেখে অবাক হয়েছিল অজয়। বিস্ময়ের সুরে বলে উঠেছিল, তবে? আজকাল কি ও সামাজিক জীব হয়ে গেল নাকি?
কোথায় যেন পার্টিতে নিমন্ত্রণ ছিল—
খবরটা শুনেও অজয় যেন বিশ্বাস করতে পারেনি। কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলেছিল, আচ্ছা চলি। তাকে বলবেন, সুবিধে মত আবার একদিন আসবখন।
ফিরে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই মায়া ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠেছিল, না, না, যাবেন না, মিস্টার সেন। আমি জানি তিনি কোথায় গেছেন। এক্ষুনি তাঁকে ফোন করে দিচ্ছি।
বাধা দেবারও অবসরও পায়নি অজয়। এমন কোন জরুরী কাজ নেই এটুকু বলবার সুযোগও মায়া তাকে দেয়নি। ছুটে গিয়ে সমরের দিয়ে যাওয়া নম্বরটা ডায়াল করতে শুরু করে দিয়েছিল।
সমর এসে পৌঁছল। তার কর্তব্য পালন যেন শেষ হয়েছে, এমনই ভঙ্গিতে মায়া নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে গেল।
অজয় ক্ষমা ভিক্ষার সুরে বলল, বিশ্বাস কর ভাই, আমি ঠিক টেনে আনতে তোকে চাইনি। জানি তো, তোদের মত জহ্লাদের ভাগ্যে আমোদ আহ্লাদের শিকে কদাচিৎই ছেঁড়ে।
বিশেষজ্ঞর চোখ দিয়ে সমর তখন অজয়ের সর্বাঙ্গ যেন লেহন করছিল। বন্ধুকে ঠিক সুস্থ বলে মনে হল না তার। চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোর বল তো। চেহারা এমন ভেঙে গেল কেন? লিভার?
অজয় হেসেই উড়িয়ে দিতে চাইল। বলল, না, না, লিভার আমার ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিনের মতই চলছে। একটু ক্লান্ত লাগে, এই পর্যন্ত। হয়তো খাটাখাটুনিটা বেশি হচ্ছে বলেই
বাধা দিয়ে সমর জিজ্ঞেস করল, সত্যি বলছিস তো? ওমর খৈয়ামের মত দাও পেয়ালা পূর্ণ করে চালাচ্ছিস না?
না হে ডাক্তার, না। সে প্রবৃত্তিও নেই, সময়ও নেই। যে জোয়াল বাবা কাঁধে চাপিয়েছেন।
আচ্ছা, জামাটা খুলে ফেল তো। একবার পরীক্ষাটা করে নিই।
আপত্তির সুরে অজয় বললে, তোকে বলছি কিচ্ছু না। বরং একটা সর্বরোগহর জাতীয় টনিক দে, তাতেই
সমর প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠল, কি করতে হবে, আমি জানি। তুই খোল জামা। অগত্যা অজয়কে সোফার ওপরেই শুয়ে পড়তে হল। সমর গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পরীক্ষা করে চলল তাকে। ফাঁকে ফাঁকে অজয় বর্ণনা করে গেল তার দুঃখের কাহিনী, জানিস, বাবা নিজেকে হঠাৎই গুটিয়ে নিয়েছেন—সব কিছু ভার চাপিয়ে দিয়েছেন আমার কাঁধে। এখন ভদ্রলোক বারান্দায় বসে বসে চুরুট টানেন, আর আমি ছ্যাকড়া গাড়ির ঘোড়ার মত যখন বাড়ি ফিরি, তখন তাকিয়ে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। ভাবটা এই, বোঝ বাছাধন কত ধানে কত চাল।
হাতের কাজ বন্ধ না রেখে সমর জিজ্ঞেস করল, বাড়ি ফিরে কি করিস?
করি? করিটা কখন? ফিরতে ফিরতে তো কোনদিন রাত এগারোটা বারোটা, কোনদিন বা রাত কাবার।
বিস্ময়ভরে সমর একবার না তাকিয়ে পারল না।
হা হা করে হেসে উঠল অজয়। বলল, অবাক হচ্ছিস? ভাগ্য ভাল যে বিয়েটা করিনি। তাহলেই উদ্বাহ বন্ধনটা উদ্বন্ধনে দাঁড়াত রে! নিত্য বিরহের এই জ্বালা দুনিয়ার কোন সতী-সাধ্বীই বোধ হয় সইতেন না।
বন্ধুকে পাশ ফিরে শোবার ইঙ্গিত করে সমর নিরুত্তাপ গলাতেই প্রশ্ন করল, কিন্তু তুইই বা এত বাড়াবাড়ি করিস কেন?
অজয় অকস্মাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। সুর পালটে বলল, করি নিছক বাহাদুরি দেখাবার জন্যে নয়, সমর। বিরাট একটা কিছু গড়ে তোলার মধ্যে, চালানোর মধ্যে যেন একটা মোহ আছে। সুন্দরী মেয়ের তীব্র আকর্ষণও বলতে পারিস।
সমর ভূকুঞ্চিত করল। পাশ ফিরে ছিল বলে অজয় সেটা লক্ষ্য করতে পারল না। নিজের খেয়ালেই বলে চলল, এই তো সবে মইয়ের প্রথম ধাপে পা দিয়েছি। অদুর ভবিষ্যতে মনে হয় একেবারে শেষ ধাপে উঠে যেতে পারব। ভদ্রলোককে তখন দেখাব মুচকি হাসতে আমিও পারি।
সমর পরীক্ষা শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, শেষেরও তো শেষ থাকে শুনেছি।
হ্যাঁ, সেটা প্রস্থান; তবে মহাপ্রস্থান কিনা ঠিক বলতে পারব না।
হাত ধুতে সমর বাথরুমে গিয়ে ঢুকতেই অজয় উঠে বসে তার ছেড়ে রাখা জামাটা গায়ে গলিয়ে নিল। সমর তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসতেই সে হালকা সুরে প্রশ্ন করল, শরীর-যন্ত্রের কোথাও কি বৈকল্য ঘটেছে বন্ধু?
সমর তার পেশাসুলভ গম্ভীর ভাবে জবাব দিল, এখনও নয়। তবে সারারাত ধরে কাজের মোহ তোকে ছাড়তে হবে। মানুষের স্নায়ুরও তো সহ্য করবার একটা সীমা আছে। মাথা থেকে বর্তমানে তোকে রাজমুকুটটি খুলে ফেলতে হবে। দুর্ভাবনা দুশ্চিন্তাগুলো দূরে ঠেলে, খেলাধুলো আর খুশিমত ঘুরে বেড়ানো—এইতেই কিছুদিন মেতে থাকতে হবে।
বিষ হাসি হাসল অজয়। বলল, ডানা দুটো ছেঁটে দেওয়া হয়েছে রে, কাজেই ওসব আর পারব না। তুই বরং একটা টনিক-ফনিক কিছু দে।
তাই দোব। এক বোতল চলতি-হাওয়ার-পন্থী নরনারীর সাহচর্য। উচ্ছল প্রাণের ধারায় ছুটে চলেছে, এমন একদল তরুণ-তরুণী। আয়।
বন্ধুর মুখে এমন কাব্যিক কথাবার্তা শোনবার আশা অজয় কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি। কতক্ষণ বিমূঢ়ের মত তাকিয়ে থেকে বলল, তুই কি কোথাও নিয়ে যেতে চাস?
সমর উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলল, হাঁ, স্বাস্থ্যনিবাসে। উঠে পড়, আর দেরি করিসনি।
তার ভাবভঙ্গি দেখে অজয় বেশ খানিকটা কৌতূহলী হয়ে উঠল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়ল বন্ধুর সঙ্গে।
লীলার সঙ্গে আলাপ সেই দিন থেকে।
প্রথম পরিচয়েই বিচিত্র এক প্রতিক্রিয়া দেখা দিল দুজনের মনেই। অজয়ের মনে হল জীবন-নদীতে অতি অকস্মাৎ একটা নতুন প্রাণশক্তির জোয়ার দেখা দিয়েছে। আর লীলার বুকের ভেতর রক্তস্রোতটা উত্তাল হয়ে উঠে শ্বাসরোধ করে আনল তার। কেমন যেন থিতিয়ে গেল সে।
গভীর রাতে দত্তবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে সমর যখন নিজের চেম্বারে ফিরে এল, তখন তার মনে প্রচ্ছন্ন একটা অস্বস্তি। মাথার ভেতর এলোমেলো চিন্তা। নিত্যকার মত আন্তরিক আপ্যায়ন সে পায়নি। সে অবহেলিত, সে অনাদৃত।
সন্ধ্যার প্রতিশ্রুতি রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
.
পরদিন থেকে সমর কাজের চাপে নিশ্বাস নেবার ফুরসতটুকুও পেল না। নতুন নতুন রোগীর আনাগোনা তো ছিলই, সেই সঙ্গে ছিল শক্ত শক্ত গোটাকয়েক অস্ত্রোপচার।
হপ্তাখানেক পরে কাজের চাপ যখন একটু হালকা হল, তখন প্রথমেই তার মনে হল অজয় আর লীলার কথা। এতদিনের ভেতর কেউ তো আসেইনি, বা তার খবরটুকুও নেয়নি। টেলিফোনটা তুলে নিয়ে সে প্রথমেই অজয়কে ডাকল; কিন্তু শুনল সে বেরিয়ে গেছে।
এর পর সে লীলাকে ফোনে ডাকল। অনুরোধের সুরে বলল, হপ্তাখানক পরে আজ একটু ছুটি মিলেছে। কোথাও ঘুরে আসবে?
লীলা কিছুটা নিরুত্তাপ গলাতেই জবাব দিল, না, আজ বেরোতে পারব না।
মনঃক্ষুণ্ণ কিছুটা হলেও সমর সহজ কণ্ঠেই বলল, বেশ, তাহলে আমিই একটু পরে যাচ্ছি।
ঠিক সন্ধ্যার মুখেই সমর দত্তবাড়ি গিয়ে হাজির হল এবং প্রথমে যে লোকটির ওপর তার দৃষ্টি পড়ল সে হচ্ছে অজয়। বাড়িতে আর কোন অতিথি ছিল না; সুতরাং
ব্যথা পেল সমর। বুকের ভেতরটা মনে হল কে যেন সাঁড়াশি দিয়ে টানছে। তবু মুখের হাসি তাকে বজায় রাখতে হল। অজয়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখে আনন্দ প্রকাশও করতে হল।
বন্ধুর সঙ্গে লীলার সম্বন্ধটা জানত না বলেই অজয় সত্যকার খুশিতে একেবারে উপচে উঠল। তার পিঠে গোটাকয়েক চাপড় কষিয়ে বলল, এর সব কৃতিত্বই তোর। বিনা ওষুধে এমন প্রেসক্রিপশন করতে আর কোন ডাক্তারই বোধহয় পারতেন না।
সমর স্নানভাবে একটু হেসে একধারে বসে পড়ল। চোখ দুটো তার ঘুরে বেড়াতে লাগল লীলার চলাফেরার সঙ্গে। তার হাসি, কথা বলার ভঙ্গি ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখতে লাগল। বদলে গেছে, তার সম্বন্ধে লীলা অনেকখানি বদলে গেছে। যতবারই তার চোখে চোখ পড়ল, লীলা ফিরিয়ে নিল মুখখানা। দৃষ্টি তার অপরাধ কুণ্ঠিত। অথচ অজয়ের ওপর চোখ পড়তেই তার চোখে বিচিত্র এক আলো ঝলসে উঠছিল। মুখে নেমে আসছিল অপরূপ কমনীয়তা। বিমুগ্ধা কুরঙ্গিণীর ভঙ্গি তার কথা বলায়, হাসিতে।
বিক্ষুব্ধ মন নিয়েই সমর তাড়াতাড়ি ফিরে এল নিজের ক্লিনিকে। অকারণে রূঢ় হয়ে উঠল মায়ার ওপর। পরক্ষণে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে, একরকম জোর করেই তাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিল।
অবশ্য প্রতিবাদ করেনি মায়া। শুধু নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে সারারাত চোখের জল ফেলল।
এর পরও বহুবারই সমর দত্তবাড়িতে গেল। নিমজ্জমান ব্যক্তি যেন বাঁচবার দুস্তর চেষ্টায় হাত-পা ছুঁড়ছে। তাতে জলেই ঢেউ উঠেছে, আবর্তের সৃষ্টি হয়েছে, বাঁচবার মত মাটি মেলেনি পা রাখার।
প্রতিবারই তার দেখা হয়েছে অজয়ের সঙ্গে।
.
সেদিন রাত এগারোটা বেজে যেতে সমর রোগীদের হাত থেকে বিশ্রামের অবসর পেল। ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিল আরামকেদারাটার ওপর। চুরুট একটা ধরাল বটে, কিন্তু টানতে পারল না। কি এক গভীর অস্বস্তি যেন রক্তকোষের ভেতরে ভেতরে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। রগের শিরাদুটো দপদপ করছে। চোখ দুটোয় আগুনের হলকা।
মায়া তার হোস্টেলে ফিরতে গিয়েও পারল না। থেকে থেকেই উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে উঁকি দেয়।
বিরক্ত হল সমর। পুরুষকণ্ঠে বলল, কাজ হয়ে গেলেই আপনাকে তো কত দিন বাড়ি চলে যেতে বলেছি, মিস দে।
মায়ার মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল। কি একটা বলতে গিয়েও পারল না।
বোধ করি অকারণেই রূঢ় হয়ে উঠল সমর, আপনার এই বাড়াবাড়িতে আমার সুনামটা যে নষ্ট হতে পারে, সেটা ভাবেন না কেন?
মায়া চমকে উঠল। মনে হল কে যেন তার পিঠে কশাঘাত করেছে। চোখের জল চাপতে চাপতে ছুটেই সে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।
একটু পরেই অজয় এসে হাজির হল। সেদিন লীলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর আজই প্রথম এল।
সমর বেশ খানিকটা অবাকই হল। দেওয়াল ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, এই রাত দুপুরে? দত্তবাড়ি থেকে নাকি?
অজয় সংক্ষেপে জবাব দিল, হ্যাঁ। তারপরই নিজের জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ারখানায় বসে পড়ল।
সমর চুরুটের বাক্সটা তার দিকে এগিয়ে দিল।
কতক্ষণ চুপ করে বসে রইল অজয়। কোন কিছুতেই যেন তার উৎসাহ নেই। এক সময় সোজাসুজি বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল, লীলাকে তুই ভালবাসিস, সমর?
বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধতার ভেতর দিয়ে কাটল। তারপর একসময় নীরস কণ্ঠে সমর জবাব দিল, হ্যাঁ বাসি। তাতে আপত্তির কোন কারণ আছে?
অজয় একটা চুরুট বেছে নিয়ে ধরাচ্ছিল; অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, আমরা দুই যুযুধান শত্রু নই, সমর। বন্ধুর মতই আলোচনা করতে চাই। কারণ আমিও তাকে ভালবেসেছি।
আমায় কি করতে বলিস? সরে দাঁড়াই?
না। তবে বন্ধু হিসেবে আমার কর্তব্য, কথাটা তোকে খুলে বলা।
ধন্যবাদ। কিন্তু তার কোন দরকার ছিল কি?
আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। অজয় একসময় ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বলল, এমন একটা জিনিস যে আমাদের মধ্যে ঘটবে, কোনদিন কল্পনাও করিনি। তোর কিন্তু আগে থাকতেই আমাকে একটু আভাস দেওয়া উচিত ছিল, সমর।
সমর মুখ তুলে তাকাল। ঈষৎ বিদ্রূপের সুরে বলল, কেন? এ তো কারও ইজারা করা সম্পত্তি নয়। লীলাকে ভালবাসার অধিকার আর সবায়ের মত তোরও আছে।
মুখ সে একথা বললেও তার মন বলল, এটা বিশ্বাসঘাতকতা।
অজয় ক্লান্ত সুরে বলল, এখন ও নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। তবে জেনে রাখ, বরমাল্য যার গলাতেই দুলুক আমার তাতে কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই।
ক্ষতিবৃদ্ধি বলতে কিসের ইঙ্গিত করছিস?
আমাদের বন্ধুত্বের।
সমর তিক্ত হাসি হেসে উঠল। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, কথাটা অতিনাটকীয় হয়ে যাচ্ছে না?
না। অজয় আবেগ ভরা কণ্ঠে বলে উঠল, আমি চাই তুই-ই আগে লীলার কাছে বিয়ের প্রস্তাব কর। কারণ দাবিটা তোরই প্রথম।
সমরের দৃষ্টিতে ফুটে উঠল ইস্পাত কঠিনতা। শুষ্ককণ্ঠে সে বলল, তাতে লাভ হবে কিছু? বেশ, তুই যখন বলছিস, তখন আমিই যাব। গিয়ে প্রস্তাব করব তার কাছে।
ভগবান তোর মনস্কামনা পূর্ণ করুন।
অপরিচিত দুই ব্যক্তির মত সেদিন রাত্রে দুই বন্ধু পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল।
পরদিন সত্যিই সমর দত্তবাড়ি গিয়ে হাজির হল। তার ভাগ্য ভাল, তাই লীলাকে একাই পেল। সমস্ত রকম ভূমিকা পরিহার করে সে সোজাসুজি প্রস্তাব করল লীলার কাছে।
লীলা প্রথমটা অবাক হল। তারপরই তার মুখে দেখা দিল ক্রোধের রক্তিমা। রূঢ়কণ্ঠেই সে বলল, তুমি আমাকে পেয়েছ কি? তোমার ক্লিনিকের নার্স, না বাড়ির দাসীবাদী?
সমর ভ্রুক্ষেপই করল না তার বিরূপ মন্তব্যে। বক্তব্যটা আবার বলল, বিয়ে করতে আমায় রাজী আছ, লীলা? তুমি তো জানো, আমি তোমায় ভালবাসি।
তুমি অভদ্র, বর্বর। তোমাকে কোনদিনই বিয়ে করতে পারব না আমি।
ওটা ছাড়া, অন্য কোন কারণ আছে?
লীলা বিদ্রূপের সুরে বলল, শুনলে যদি খুশি হও তাহলে বলতে আমার বাধা নেই। তোমার চেয়ে যোগ্য পাত্র আমি পেয়েছি। কথাটা বলে ফেলেই সে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। এতখানি রূঢ় না হলেও সে পারত।
সমর কিন্তু স্থিরদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, যোগ্যতর পাত্রটি কি অজয়?
হ্যাঁ। অস্ফুট কণ্ঠে লীলা জবাব দিল।
সমরের মুখখানা কঠিন হয়ে উঠল। চোখে দেখা দিল শাণিত দৃষ্টি। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, সত্যভাষণের জন্য ধন্যবাদ। তবে অসভ্য বর্বর বলে পরিহাসটা না করলেই পারতে।
লম্বা লম্বা পা ফেলে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
অতএব অজয় আর লীলার বিবাহের দিন ধার্য হয়ে গেল। নির্দিষ্ট তারিখের আগের রাত্রে অজয় এল সমরের ক্লিনিকে। চেম্বারে পা দিয়েই সে রাগতকণ্ঠে বলে উঠল, তুই আমাকে ভুল বুঝছিস, সমর। তোর সামনে লীলা যা-ই বলে থাকুক, আসলে সে
বাধা দিল সমর, আমি কৈফিয়ৎ চাইনি, অজয়
তুই না চাইলেও, আমাকে তো
রক্ষে কর ভাই, আমার অনেক কাজ।
হতাশ হয়ে পড়ল অজয়। অভিমানহত কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে। একদিন না একদিন সব বুঝবি তুই। আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি চিরকাল থাকতে পারে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। তাছাড়া শুধু এইটুকু বলতেই আমি তোর কাছে আসিনি।
সমর স্থিরদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে বিয়ে বাড়ি যেতে হবে—এই তো?
হাঁ, যাওয়া চাই-ই।
কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। চোখে তার এক বিচিত্র আলো ঝলসে উঠল। হেসে বলল, ঠিক আছে, যাব আমি। বিদায়টা জমবে ভাল।