Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

তখন দ্বিপ্রহরের সময়, যেসব মেঘ বাতাসের দৌরাত্ম্যে ছিন্নভিন্ন হইয়া পলাইয়া গিয়াছিল, তাহারা সন্ধ্যার পরেই একটির পর একটি করিয়া মহাসমারোহে বাজনা-বাদ্য বাজাইয়া আবার আকাশের গায়ে জোট বাঁধিতে লাগিল। সকলেই স্থির করিল আজ রাত্রে বৃষ্টি না হইয়া যায় না। গরম কমিবে—প্রাণ বাঁচিবে। এ বৃষ্টি সকলের মঙ্গলের জন্য, শুধু শুভদা মনে করিল তাহারই কপালদোষে আজ এই দুর্যোগের সূত্রপাত হইয়া আসিল। একে ত হলুদপুরের পথঘাট বনজঙ্গলের মধ্য দিয়া, তাহাতে গাঢ় মেঘ করিয়াছে, তথাপি শুভদা বালা দু’ গাছি অঞ্চলে বাঁধিয়া, কাপড়খানি বেশ করিয়া গুছাইয়া পরিয়া, একটা বিছানার চাদরে সমস্ত অঙ্গ বেশ করিয়া আবৃত করিয়া বাটী হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। সে পূর্বে আর কখন বামুনপাড়ায় যায় নাই, শুধু শুনিয়াছিল মাত্র যে, উত্তরমুখ ধরিয়া চলিলে আধক্রোশ দূরে পাকারাস্তা পাওয়া যায় এবং আর একটু অগ্রসর হইলেই বামুনপাড়া। সেখানে পৌঁছতে পারিলে জমিদারবাড়ি চিনিয়া লইতে বিলম্ব হইবে না। কারণ নন্দীদের প্রকাণ্ড অট্টালিকা গ্রামে প্রবেশ করিলেই দেখিতে পাওয়া যায় সে শুনিয়াছিল। হলুদপুরের অন্ধকার পথ ছাড়াইয়া পাকারাস্তা পাওয়াই তাহার বিপদের কথা হইয়া দাঁড়াইল। ক্রমে অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া একফোঁটা দুইফোঁটা জল পড়িতে লাগিল; একফোঁটা দুইফোঁটা পরিশেষে মুষলধারায় পরিণত হইল দেখিয়া শুভদা বৃক্ষতলে আশ্রয় গ্রহণ করিল।

পথ চলা আর অসম্ভব; অন্ধকারে একহস্ত দূরের পদার্থও আর দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। প্রবল বৃষ্টি ও তৎসঙ্গে বিদ্যুৎ ও বজ্রের শব্দে শুভদার ভিতর পর্যন্ত কাঁপিতে লাগিল। সে দেখিল, চতুর্দিক হইতে বন্য জীবজন্তু ছুটিয়া আসিয়া সেই বৃক্ষতলে আশ্রয় লইতে আসিতেছে, আবার তৎক্ষণাৎ মনুষ্যমূর্তি দেখিয়া সভয়ে চিৎকার ছাড়িয়া পলাইয়া যাইতেছে। শুভদার সহসা মনে হইল, যদি চোর ডাকাইত কেহ আশ্রয় লইতে এইখানেই আসিয়া পড়ে? তাহা হইলে? তাহার প্রাণের ভয় হইল না, কিন্তু তদপেক্ষা মূল্যবান বালা দু গাছির জন্য ভয় হইল। স্বামীর নিষ্কৃতির কারণ, নিজের আশা-ভরসা সমস্তই এই বালা দু গাছি।
সত্রাসে শুভদা বৃক্ষতল ছাড়িয়া পলায়ন করিল। সমস্ত শরীর কর্দমসিক্ত হইয়াছে, গাছপালার আঁচড়ে ও কণ্টকে সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে, তথাপি শুভদা পথ বাহিয়া চলিতে লাগিল। এক নিমিষের তরে বৃষ্টির উপশম নাই। এক মুহূর্তের জন্য মেঘের শব্দের বিশ্রাম নাই, কোন্‌ মুখে কোথায় চলিয়াছে তাহারও স্থিরতা নাই, তথাপি বনবাদাড় সরাইতে সরাইতে অগ্রসর হইতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে বোধ হইল যেন অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত পথ সম্মুখে দেখা যাইতেছে। দ্বিগুন উৎসাহে হাঁটিয়া আসিয়া শুভদা দেখিল যথার্থই পাকাপথ পাইয়াছে। এখন কিন্তু অন্য কথা। যখন পথ পায় নাই তখন কেবল পথের ভাবনাই ভাবিয়াছিল, এখন কাজের কথা মনে হইতে লাগিল। এত রাত্রে কি করিয়া দেখা হইবে, দেখা হইলেই কি কার্যসিদ্ধি হইবে? সিদ্ধ হউক আর না হউক, এ দুর্যোগে বাটীই বা কেমন করিয়া ফিরিয়া যাইবে? ক্রমে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিল; কিছুদূর আসিয়াই প্রকাণ্ড অট্টালিকা ও চতুর্দিক-সংলগ্ন রেলিং দেওয়া বাগান দেখিয়া বুঝিতে পারিল ইহাই নন্দীদের বাটী; কিন্তু কেমন করিয়া প্রবেশ করিবে? আর প্রবেশ করিলেই বা তাঁহার সহিত এত রাত্রে কি করিয়া সাক্ষাৎ করিবে ! শুভদার কান্না আসিল; এখন কি হইবে? কি করিয়া বাড়ি যাইবে? পরিশ্রমে, অনাহারে, দুর্ভাবনায় সে মৃতপ্রায় হইয়া পড়িয়াছিল, নন্দীদের বাটির সম্মুখে যে শিবমন্দির ছিল তাহারই বারান্দার উপর আসিয়া একেবারে শুইয়া পড়িল। তখন বৃষ্টি সম্পূর্ণ ছাড়ে নাই, তবে কমিয়া আসিয়াছিল। বৈশাখের মেঘ যেমন একমুহূর্তে গগন আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, তেমনিই একমুহূর্তে গগন ছাড়িয়া কোথায় চলিয়া যায়। এ মেঘও দেখিতে দেখিতে আকাশের প্রান্তদেশে মিলাইয়া যাইতে লাগিল, আবার চাঁদের আলোকে জগৎ অনেক শুভ্রশ্রী ধারণ করিল। শুভদা মনে করিল এইবার ফিরিয়া যাইবার সময় হইয়াছে। সিক্তবস্ত্র একটু গুছাইয়া লইবার সময় দেখিতে পাইল একজন বৃদ্ধ ভৃত্য হস্তে প্রদীপ লইয়া জমিদারবাটীর ফটক খুলিয়া মন্দিরের দিকে অগ্রসর হইতেছে। ইহার নিকট যদি কোন সন্ধান পাওয়া যায় এইরূপ একটা ক্ষীণ আশায় ভর করিয়া শুভদা প্রস্থান না করিয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিল। বৃদ্ধ মন্দিরের দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দেখিল একজন স্ত্রীলোক অবগুন্ঠনে মুখ আবৃত করিয়া দাঁড়াইয়া আছে; কিন্তু কোন কথা না কহিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।
বহুক্ষণ পরে বাহিরে আসিয়া দেখিল স্ত্রীলোকটি এখনও সেইভাবে দাঁড়াইয়া আছে, বৃদ্ধ প্রথমে অবগুন্ঠন দেখিয়া অনুমান করিয়াছিল, কোন ভদ্রঘরের স্ত্রী জলের ভয়ে এখানে আশ্রয় লইয়াছিল, এইবার চলিয়া যাইবে, কিন্তু এখনো সেইভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে গা?
স্ত্রীলোকটি কোন কথা কহিল না। কোথায় যাবে বাছা?
শুভদার কথা বলিতে লজ্জা করিতেছিল; কিন্তু এখন মৃদুকণ্ঠে কহিল, জমিদারবাবুদের বাড়িতে।
জমিদারদের বাড়ি ত এই সামনেই; তবে সেখানে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
শুভদা কোন উত্তর দিতে পারিল না।
বৃদ্ধ পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, জমিদারদের বাড়িতে কার কাছে যাবে?
বাবুর কাছে।
কোন্‌ বাবুর কাছে?
ভগবানবাবুর কাছে।
বৃদ্ধ বিস্মিত হইয়া বলিল, ভগবানবাবুর কাছে?
হাঁ।
তবে আমার সঙ্গে এস। বৃদ্ধ অগ্রে অগ্রে চলিতে লাগিল। শুভদা জ্যোৎস্নালোকে বৃদ্ধের পলিতকেশ সৌম্যমূর্তি দেখিয়া অসঙ্কোচে পশ্চাতে চলিতে লাগিল। ক্রমে ফটক পার হইয়া, বাগান পার হইয়া, একটা কক্ষের দ্বার খুলিয়া বৃদ্ধ ডাকিল, এই ঘরে এস।
শুভদা কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিল, চমৎকার সুসজ্জিত কক্ষ, সমস্ত মেঝের উপর মূল্যবান কার্পেট বিছানো; সম্মুখে মসলন্দ পাতা, তাকিয়া দেওয়া বসিবার স্থান। বৃদ্ধ তাহার উপর উপবেশন করিয়া শুভদার আপাদমস্তক দীপালোকে, অবগুন্ঠনের ঈষৎ ফাঁক দিয়া যতদূর দেখা যায় নিরীক্ষণ করিল। শুভদা সময়ে রূপবতী ছিল। বয়সে ও দুঃখ-কষ্টে পূর্বের সে জ্যোতি এখন আর নাই, তথাপি হীনপ্রভ লাবণ্যের যতটুকু অবশিষ্ট আছে, বৃদ্ধ তাহাতেই মোহিত হইল। অনেকক্ষণ দেখিয়া দেখিয়া কহিল, বাছা, তোমার ভুল হইয়াছে, বিনোদবাবুর সঙ্গে বোধ হয় তুমি দেখা করিতে চাও।

বিনোদবাবু কে?
বিনোদবাবু ভগবানবাবুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।
শুভদা কহিল, তাঁহার সহিত দেখা করিতে চাহি না।
তবে কি ভগবানবাবুর নিকটই প্রয়োজন আছে?
হাঁ
ভগবান নন্দী আমারই নাম; কিন্তু আমি তোমাকে কখন দেখিয়াছি বলে ত মনে হয় না।
শুভদা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।
তবে আমার নিকট কি প্রয়োজন থাকিতে পারে?
শুভদা কথা কহিল না।
ভগবানবাবু আবার বলিলেন, আমি ভাবিয়াছিলাম রাত্রে স্ত্রীলোকের প্রয়োজন বিনোদের নিকটই থাকিতে পারে; এত রাত্রে আমার নিকট যে তোমার কি প্রয়োজন আছে আমি বুঝিয়া উঠিতে পারছি না।
তথাপি শুভদা কোনও উত্তর দিল না।
তোমার বাড়ি কোথায়?
হলুদপুরে।
হলুদপুরে? আমার নিকট প্রয়োজন? তুমি কি হারাণের স্ত্রী?
শুভদা অবগুন্ঠনের ভিতর হইতে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।
তবে বল কি প্রয়োজন?
শুভদা অঞ্চল হইতে বালা দু গাছি খুলিয়া ধীরে ধীরে ভগবানবাবুর পায়ের নিকট রাখিয়া গদগদকণ্ঠে বলিল, তাঁকে ছাড়িয়া দিন।

বৃদ্ধ সমস্ত বুঝিতে পারিলেন। বালা দু গাছি হাতে লইয়া বেশ পরীক্ষা করিয়া অবশেষে কহিলেন, তবুও সুখী হইলাম যে সে তোমাকে ইহাও দিয়েছিল। তাহার পর বালা দুটি নীচে রাখিয়া বলিলেন, তুমি ইহা ফিরাইয়া লইয়া যাও। আমি ব্রাহ্মণের মেয়ের হাতের বালা লইতে চাহি না। ছাড়িয়া দিতে হয় অমনিই দেব; বিশেষ সে আমার যাহা লইয়াছে তাহাতে এ অলঙ্কার লইয়া ছাড়িয়া দেওয়াও যা, না লইয়া ছাড়িয়া দেওয়াও তা।
শুভদা চক্ষু মুছিয়া বলিল, তাঁকে ছাড়িয়া দিবেন ত?
ইচ্ছা ছিল না ! সে যেরকম দুশ্চরিত্র তাহাতে তাহার শাস্তি পাওয়াই উচিত ছিল, তবুও তোমার জন্য ছাড়িয়া দেব।
শুভদার চক্ষু ফাটিয়া জল পড়িতে লাগিল। পলিতকেশ বৃদ্ধকে সে ব্রাহ্মণকন্যা হইলেও মুখ ফুটিয়া আশীর্বাদ করিতে সাহস করিল না; মনে মনে তাঁহাকে শত ধন্যবাদ দিয়া ঈশ্বরের চরণে তাঁহার সহস্র মঙ্গল কামনা করিয়া যাইবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইল। ভগবানবাবু মুখ তুলিয়া বলিলেন, আজই বাড়ি যাবে?

শুভদা ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, আজই যাইবে।
তোমার সঙ্গে আর কেহ লোক আছে?
কেহ না।
কেহ না? তবে এত রাত্রে একাকী যাইও না। একজন লোক লইয়া যাও।
শুভদা তাহাও অস্বীকার করিয়া একাকী সেই বনের ভিতর দিয়া বাটী ফিরিল।
যখন বাটীতে প্রবেশ করিল তখন ভোর হইয়াছে। ললনা ইতিপূর্বে উঠিয়া সংসারের কাজকর্ম করিবার চেষ্টা করিতেছিল। সিক্তবস্ত্রে জননীকে দেখিয়া কহিল, মা, এত ভোরে স্নান করে এলে?
হাঁ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *