শিশু-সাহিত্যের বিস্ময় যোগীন্দ্রনাথ সরকার
যোগীন্দ্রনাথ সরকার ২৮শে অক্টোবর, ১৮৬৬ সালে (১২ই কার্তিক ১২৭৩ বঙ্গাব্দে) দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নেতড়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস ছিল যশোহর। তাঁর পিতার নাম নন্দলাল সরকার । নন্দলাল সরকার ছিলেন যশোরের একটি দরিদ্র কায়স্থ পরিবারের মানুষ।
তিনি পরবর্তী কালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে থাকতে আরম্ভ করেন। বিখ্যাত চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ নীলরতন সরকার যোগীন্দ্রনাথ সরকারের দাদা। যোগীন্দ্রনাথ সরকার ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। দেওঘর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষায় তাঁর কোন আগ্রহ না থাকায় তিনি কলেজ জীবন শেষ করতে পারেন নি।
এরপর তিনি সিটি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করতে আরম্ভ করেন মাত্র পনের টাকা বেতনে। এ সময় থেকেই তিনি শিশু সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন এবং শিশুসাহিত্য রচনা শুরু করেন। আজগুবী ছড়া রচনায় তাঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। তাঁর সঙ্কলিত বই ‘হাসি ও খেলা’ ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় । তিনি সখা, সখী, মুকুল, বালকবন্ধু, বালক, সন্দেশ প্রভৃতি ছোটদের পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। তিনি ‘মুকুল’ পত্রিকাটি সম্পাদনাও করেছিলেন।
তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা বাঙালি শিশুসাহিত্যিক। ছোটোদের অক্ষর পরিচয় থেকে সাহিত্যরস পরিবেশনের এক আকর্ষণীয় ও অভিনব কৌশল অবলম্বন করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যে পথিকৃতের সম্মান লাভ করেন। তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছড়াকার বলে সম্মানিত হন ।
ছবির সাহায্য অক্ষর চেনাতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার কবিতাগুলির সাথে সুন্দর সুন্দর ছবি থাকত। যা ছোটদের মনে এক কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করত। ছোটদের জন্য লেখা বিদেশী উদ্ভট ছন্দ ও ছড়ার অনুসরণে তিনি ‘হাসি রাশি’ নামে একটি সচিত্র বই প্রকাশ করেন। এর সাথে সাথেই ১৮৯৯ সালে তার সংগৃহীত ‘খুকুমনির ছড়া’ প্রকাশিত হয়। তার রচিত হাসিখুসি (১৮৯৭ সালে প্রকাশিত) বইটিই খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তার রচিত এবং সঙ্কলিত ত্রিশটি ছোটদের গল্প ও ছড়ার বইয়ের মধ্যে ‘ছড়া ও ছবি’, ‘রাঙাছবি’, ‘হাসির গল্প’, ‘পশুপক্ষী’, ‘বনে জঙ্গলে’, ‘গল্পসঞ্চয়’, ‘শিশু চয়নিকা’, ‘হিজিবিজি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার সম্বন্ধে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “বাংলার মাটিতে এমন একজন মানুষ অন্ততঃ জন্মেছেন, যিনি একান্তভাবে ছোটদের লেখক, সেই সব ছোটদের, যারা কেঁদে কেঁদে পড়তে শিখে, পরে হেসে হেসে বই পড়ে।”
ছোটদের উপযোগী একুশটি পৌরানিক বই এইসময় তিনি রচনা করেছিলেন। সেগুলি হল, ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৯০৯), ‘শকুন্তলা’, ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘সীতা’ (১৯১০), ‘ধ্রুব’ (১৯১৫), ‘ছোটদের রামায়ণ’ (১৯১৮), ‘ছোটদের মহাভারত’ (১৯১৯), ‘দৈত্য ও দানব’ (১৯২০) প্রভৃতি। এছাড়াও জ্ঞানমুকুল, সাহিত্য, চারুপাঠ, শিক্ষাসঞ্চয় প্রভৃতি এবং তেরো-চোদ্দটি স্কুলপাঠ্য বই তিনি রচনা করেছিলেন। ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯০৫ সালে বন্দেমাতরম্ বলে একটি জাতীয় সঙ্গীত সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
১৮৯৬ সালে যোগীন্দ্রনাথ ‘সিটি বুক সোসাইটি’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন। এই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়েছিল। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর শিশুদের বই ‘টুকটুকে রামায়ণ’ এবং কুলদারঞ্জন রায়ের লেখা ‘ইলিয়াড’ এই পাবলিকেশন থেকেই প্রকাশিত হয়।
প্রবল কাজের চাপের ফলে ১৯২৩ সালে উচ্চরক্তচাপজনিত কারণে মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে জ্ঞান হারান তিনি। বহু চিকিৎসার পর প্রাণরক্ষা পেলেও শরীরের ডান ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়। কিন্তু অসুস্থতার মধ্যেও তিনি তাঁর রচনা ও প্রকাশনার কাজ চালিয়ে যান। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৩৬ সালে তাঁর শেষ সংকলন ‘গল্প সঞ্চয়’ প্রকাশিত হয়। তার রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৭৮টি।
যোগীন্দ্রনাথ সরকারের পাঁটটি ছড়া এখানে দেওয়া হল –
————————————————–
১).
মজার মুল্লুক (দেশ)
—————————-
” এক যে আছে মজার দেশ,
সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ,
দিনে চাঁদের আলো !
আকাশ সেথা সবুজবরণ
গাছের পাতা নীল;
ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা
জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়,
নেংটি-ইঁদুর দেখে;
ছেলেরা খায় ‘ক্যাস্টর-অয়েল’
রসগোল্লা রেখে !
মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা,
ওষুধ লাগে ভালো;
অন্ধকারটা সাদা দেখায়,
সাদা জিনিস কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে
বই নে বসে পড়ে;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া
লোকের পিঠে চড়ে !
ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই,
উড়তে থাকে ছেলে;
বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে,
মাছেরা ছিপ্ ফেলে !
জিলিপি সে তেড়ে এসে,
কামড় দিতে চায়;
কচুরি আর রসগোল্লা
ছেলে ধরে খায় !
পায়ে ছাতি দিয়ে লোকে
হাতে হেঁটে চলে !
ডাঙ্গায় ভাসে নৌকা-জাহাজ,
গাড়ি ছোটে জলে !
মজার দেশের মজার কথা
বলবো কত আর;
চোখ খুললে যায় না দেখা
মুদলে পরিষ্কার !”
২).
হারাধনের দশটি ছেলে
————————————————
“হারাধনের দশটি ছেলে
ঘোরে পাড়াময়,
একটি কোথা হারিয়ে গেল
রইল বাকি নয়।
হারাধনের নয়টি ছেলে
কাটতে গেল কাঠ,
একটি কেটে দু’খান হল
রইল বাকি আট।
হারাধনের আটটি ছেলে
বসলো খেতে ভাত,
একটির পেট ফেটে গেল
রইল বাকি সাত।
হারাধনের সাতটি ছেলে
গেল জলাশয়,
একটি সেথা ডুবে ম’ল
রইল বাকি ছয়।
হারাধনের ছয়টি ছেলে
চ’ড়তে গেল গাছ,
একটি ম’ল পিছলে পড়ে
রইল বাকি পাঁচ।
হারাধনের পাঁচটি ছেলে
গেল বনের ধার,
একটি গেল বাঘের পেটে
রইল বাকি চার।
হারাধনের চারটি ছেলে
নাচে ধিন ধিন,
একটি ম’ল আছাড় খেয়ে
রইল বাকি তিন।
হারাধনের তিনটি ছেলে
ধরতে গেল রুই,
একটি খেলো বোয়াল মাছে
রইল বাকি দুই।
হারাধনের দুইটি ছেলে
মারতে গেল ভেক,
একটি ম’ল সাপের বিষে
রইল বাকি এক।
হারাধনের একটি ছেলে
কাঁদে ভেউ ভেউ,
মনের দুঃখে বনে গেল
রইল না আর কেউ।”
৩).
কাজের ছেলে
————————
” দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল,চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;
ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়,”
” ছিঁড়ে দেবে চুল।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
বাহবা বাহবা – ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ!
দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।
ওই তো ওখানে ঘুরি ধরে টানে, ঘোষদের ননী;
আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি!
দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ,
সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!
এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যত কিছু পাই;
মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!
দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,
চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।”
৪).
কাকাতুয়া
——————
“কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুমণি,
সোনার ঘড়ি কি বলিছে, বল দেখি শুনি ?
বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্,
যা কিছু করিতে আছে, করে ফেল ঠিক।
সময় চলিয়া যায়-
নদীর স্রোতের প্রায়,
যে জন না বুঝে, তারে ধিক্ শত ধিক।”
বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্।”
কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুধন,
অন্য কোন কথা ঘড়ি বলে কি কখন ?
মাঝে মাঝে বল ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্,
মানুষ হইয়ে যেন হয়ো না ক সঙ।
ফিটফিটে বাবু হলে,
ভেবেছ কি লবে কোলে ?
পলাশে কে ভালবাসে দেখে রাঙা রঙ্।”
মাঝে মাঝে বলে ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্।”
৫).
প্রার্থনা সঙ্গীত
———————–
“ছোটো শিশু মোরা তোমার করুণা হৃদয়ে মাগিয়া লব
জগতের কাজে জগতের মাঝে আপনা ভুলিয়া রব।
ছোটো তারা হাসে আকাশের গায়ে ছোটো ফুল ফুটে গাছে;
ছোটো বটে তবু তোমার জগতে আমাদেরো কাজ আছে।
দাও তবে প্রভু হেন শুভমতি প্রাণে দাও নব আশা;
জগত মাঝারে যেন সবাকারে দিতে পারি ভালবাসা।
সুখে দুখে শোকে অপরের লাগি যেন এ জীবন ধরি;
অশ্রু মুছায়ে বেদনা ঘুচায়ে জীবন সফল করি।।”
তাঁর কিছু গ্রন্থের তালিকা –
১). হাসি ও খেলা (১৮৯১ সালে)
২). রাঙাছবি (১৮৯৬ সালে)
৩). হাসিখুসি প্রথম ভাগ (১৮৯৭ সালে)
৪). হাসিখুসি দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯৭ সালে)
৫). ছড়া ও ছবি (১৮৯৭ সালে),
৬). খেলার সাথী প্রথম ভাগ (১৮৯৮ সালে)
৭). খুকুমণির ছড়া (১৮৯৯ সালে)
৮). খেলার সাথী দ্বিতীয় ভাগ (১৯০৪ সালে)
৯). হাসির গল্প (১৯২০ সালে)
১০). পশুপক্ষী (১৯১১ সালে)
১১). বনে জঙ্গলে (১৯২১ সালে)
১২). হিজিবিজি (১৯১৬ সালে)
১৪). জ্ঞানমুকুল
১৫). চারুপাঠ
১৬). শিক্ষাসঞ্চয়
১৭). ছোটদের মহাভারত (১৯১৯ সালে)
১৮). ছোটদের রামায়ণ (১৯১৮ সালে)
১৯). কুরুক্ষেত্র (১৯০৯ সালে)
২০). সীতা (২৯১০ সালে)
২১). ধ্রুব (১৯১৫ সালে)
২২). দৈত্য ও দানব (১৯২০ সালে)
১৯৩৭ সালের ২৭শে জুন (মতান্তরে ২৬শে জুন) ৭১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের।
—————————————————————-
তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া।
১). “শিশুসাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার”। banglanews24.com। (সংগ্রহের তারিখ – ২৬/০৯/২০২০.)
২). সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬ পৃষ্ঠা ৬০৮ আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
৩). সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান – প্রথম খণ্ড – সাহিত্য সংসদ আইএসবিএন ৮১-৮৫৬২৬-৬৫-০
৪). বাংলাপিডিয়ায় যোগীন্দ্রনাথ সরকার
“প্রবন্ধ:: ১৫০ বছরে শিশুসাহিত্যের প্রাণপুরুষ: ৫). যোগীন্দ্রনাথ সরকার – সমুদ্র বসু” (ইংরেজি ভাষায়)। (সংগ্রহের তারিখ – ২৬/০৯/২০২০.)
৬). মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়-এর সমস্ত লেখার সূচী”>ফাল্গুনী। “যোগীন্দ্রনাথ সরকারঃ ১৫০ তম জন্মবর্ষে ফিরে দেখা”।
৭). Ichchhamoti (ইংরেজি ভাষায়)। (সংগ্রহের তারিখ – ২৬/০৯/২০২০.)