Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শরৎচন্দ্রের বড় গল্প “বড়দিদি” প্রসঙ্গে দু-চার কথা || Purabi Dutta

শরৎচন্দ্রের বড় গল্প “বড়দিদি” প্রসঙ্গে দু-চার কথা || Purabi Dutta

শরৎচন্দ্রের বড় গল্প “বড়দিদি” প্রসঙ্গে দু-চার কথা

উপরোক্ত শিরোনাম বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু বক্তব্য ও পর্যালোচনার প্রয়াস—

১৮৫৬ সালে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু “বিধবা বিবাহ ” আইন তৎকালীন বৃটিশ সরকারের সহায়তায় প্রণয়ন করেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বৎসর।

শাস্ত্রজ্ঞ প্রামান্য স্বরূপ দাখিল করেছিলেন পরাশর সংহিতা থেকে, উদ্ধৃতি।

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।”
পরাশর সংহিতা।

অর্থাৎ পাঁচটি কারণে স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করতে পারেন—- স্বামী নিরুদ্দিষ্ট হলে, মারা গেলে, সন্ন্যাসী হলে, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে বা সমাজে পতিত হলে। প্রথা পাল্টানো যায়, আইন করে, কিন্ত সংস্কার যায় না। বাঁধা এলো সমাজে প্রচণ্ড, নারীদের থেকেও।

সংস্কার সহজে কি যায়? তার জন্য চাই– সময়, উদারতা, সহনশীলতা , কুসংস্কারযুক্ত অন্ধত্ব দুরীকরণ ও সর্বোপরি শিক্ষা , বিশেষ নারীশিক্ষা।

পরবর্তী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা প্রসারে। সে কথা থাক্……

শুধু বলি এগিয়ে আসেন নি তখন কোন বুদ্ধিজীবী মনিষী বা লেখক অনেকদিন— এই আইনের সপক্ষে কোন নজির রাখতে !!!

শরৎচন্দ্রও কি পেরেছিলেন, তাঁর কোন রচনায় বিধবার বিবাহ দিয়ে কাহিনীর যবনিকা টানতে? না, পারেন নি, তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭৬ সালে, আরও ধরে নিলাম পরিণত বয়স ও লেখক হতে ২০ বছর, ১৮৫৬ সালের পর চল্লিশ বছর কেটে গিয়েও, সমাজের ঐ আগুনে ঘৃত নিক্ষেপ করে কেউ সাহস দেখালেন না? শরৎচন্দ্র পরকীয়া প্রেম দেখিয়েছেন, বিধবার প্রেম দেখিয়েছেন, লিখেছেন বাইজির সাথেও প্রেম, কিন্ত কোথাও বিবাহ পরিণতি পায় নি।

এর কারণ, শরৎচন্দ্র জানতেন, সমাজ কখনও মেনে নেবে না। তাদের কাছে, এ নায়িকা কাহিনী যে কিঞ্চিত অছুৎ ব্যাপার। ঘৃণায়, ছিছিক্কারে, পুস্তক পাঠ পর্যন্ত বন্ধ রাখবে সুশীল সমাজ। আর কিছু আদিরসাত্বক আবালবৃদ্ধদের যোগাবে টাটকা রস ভাণ্ডার। নিঃসন্দেহে মুখ থুবরে হোঁচট খেতো পুস্তক ও সংশ্লিষ্ট সকলেরা। বর্তমান মিডিয়াতে একটা কথা প্রচলিত, পাবলিক “খাবে” কিনা বা কতটা “খাচ্ছে” , সেই বুঝে প্রোডাকসন, নয়ত খাবে মার। শরৎচন্দ্রের লেখনী ছিল যে কিছুটা, তার ব্রেড অ্যান্ড বাটার। কিন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিনি সমর্থন করতেন, বিধবাদের পুনর্বিবাহের সমীকরণ।

অত্যন্ত সন্তর্পনের সাথে তিনি এগোতেন, বিধবাদের প্রেম বিষয়ক স্পর্শকাতর জায়গাগুলিতে তার দক্ষ কলম দণ্ড নিয়ে।

লিখে ফেলেছিলেন এক সতেরো বছরের বিধবা তরুণীর প্রেম কাহিনী। সেজন্য সুচতুরভাবে , সৃষ্টি করলেন তাঁর প্রেমিককে এমন এক চরিত্রের যিনি চূড়ান্ত পর্যায়ের মেধাসম্পন্ন অথচ অতিরিক্ত মেধাজনিত বাস্তববুদ্ধি রহিত । এমনটা মনুষ্যজগতে অঘটন কিছু নয়, প্রচুর উদাহরণ আছে পৃথিবীভর। ইচ্ছে করেই যেন শরৎচন্দ্র পাঠককুলের নজর ঘুরিয়ে রাখলেন নায়কের প্রতি। গল্পের নামও দিলেন নায়ক কেন্দ্রিক করে — “শিশু” খাতা বন্দি থাকল সে কাহিনী অনেকদিন।

তারপর, “শরৎ পরিচয়” পুস্তকে সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন,–
ভাগলপুরে, হাকিম শ্রীজ্ঞানেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে , “সাহিত্য সঙ্ঘ” এর সভায় মাসে একদিন করে শরৎচন্দ্রের রচনা যা সুরেন্দ্রনাথের জিম্মায় ছিল, তা পাঠ হতো।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ উৎসাহিত হলেন ঐ শিশু গল্পটি শুনে, ও ছাপাবার জন্য গল্পটি আলাদা করে লিখতে। সুরেন্দ্রনাথ দুটো খাতায় গল্পটি আলাদা করে লেখা শেষ করার পরই জ্ঞানেন্দ্রনাথ পুজোর ছুটিতে দেশে গেলেন আর ফিরলেন না, অন্যত্র বদলি হলেন। লেখাটি দুটি খাতায় বন্দি হয়ে নানা হাত বদল হয়। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তার “শরৎচন্দ্রের জীবন-রহস্য” পুস্তকে লিখেছেন সেই শিশু বা বড়দিদি গল্পের পাণ্ডুলিপি তার হাতে এলে, তিনি তা ভারতী পত্রিকার সম্পাদিকা সরলা দেবীর কাছে দেন। সরলা দেবী পড়ে চমৎকৃত হন ও বলেন প্রথম দুই কিস্তিতে লেখকের নাম দেবে না
——যাকে বলে commercial stunt লোকে ভাববে রবীন্দ্রনাথের লেখা। নানা হাত বদলের ফলে লেখার শেষ অংশ লুপ্ত হয়। শরৎচন্দ্রের কাছে চিঠি যায়, শেষ করবার জন্য শরৎচন্দ্র লেখেন—- ও কাহিনী না ছাপালেই ভালো হতো, বাল্যকালের রচনা। তারপর তিনি শেষাংশ লিখে দেন।

অর্থাত শরৎচন্দ্রের সংশয় ছিল, এ গল্প সমাজ গ্রহণ করবে কিনা।

“বড়দিদি”তে মাধবী ভালবেসেছিল ঐ শিশু মনের সুরেন্দ্রনাথকে, প্রেম ত এক বিরাট আধার—সেখানে বিরাজ করে নানা অনুভূতি– স্নেহ, প্রীতি,কাম, শ্রদ্ধা, সম্মান, আস্থা, বিশ্বাস।

মাধবী ধরা পড়ল নিজের কাছেই,শিউরে উঠেছে নিজে বিধবা বলে, দ্বিতীয়বার ধরা পড়ল সখী মনোরমার কাছে , সেও চমকে সতর্কতার বাণী আওড়ায় , মাধবী যে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ও বিধবা বধূ, এ তো ঘোর অনাচার। মাধবী ধরা পড়ে, পিতার কাছেও, তিনি ব্যথা অনুভব করেন।

শরৎচন্দ্র এতসব প্রতিবন্ধকতার মাঝেও, অতি সুচতুরভাবে শেষ দিকে মাধবীর সংলাপে জানিয়ে দেন এক বিধবার স্বীকারোক্তি । কেমন সে কথা। আগে সুরেন্দ্রনাথের অনুভূতি বলে নি। বিমাতার পরে এমন এক দ্বিতীয় নারীর যত্ন সে পায়, যাকে সে মনে করে, সে নারীর সত্ত্বা তার নিজের ভেতরেই রয়েছে, তাকে ছাড়া তার নিজের কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না, সে নারী অবশ্যই মাতৃস্থানে নয়,সে দেবীও নয় , সে স্ত্রী বা প্রেমিকা কিনা ক্ষমতা নেই বুঝবার, অথচ, তাকে এক মুহূর্ত মন থেকে দূরে রাখতে পারছেন না। নিজ সত্ত্বার সাথে মিশে আছে “বড়দিদি” নাম্নী এক নারী ।

শেষ দিকে অসুস্থ সুরেন্দ্র যখন মাধবীকে দেখে ও পরিচয় জেনে প্রশ্ন করে “তুমি বড়দিদি?” মাধবীর উত্তর ,মাথা নেড়ে,হ্যাঁ নয়, সে পরিষ্কার উত্তর দেয় “আমি, মাধবী”

এই “আমি মাধবী” দুটি শব্দ গল্পে মাধবীর প্রেম সার্থক ও পূর্ণমাত্রা পায়। সে সুরেন্দ্রর কাছে, মাধবী হয়েই থাকতে চায় বড়দিদি নয়, বিধবা বলে অপরাধবোধ কোন রেখাপাত করে না। সুনিপুনভাবে শরৎচন্দ্র এক বিধবা নারীর প্রেম কাহিনীর গল্প লেখেন। সুরেন্দ্রনাথের চরিত্র ইচ্ছাকৃতভাবেই ওমনটি করে চিত্রিত করেছেন, সাধারণ কোন শিক্ষিত যুবক হলে পাঠকরা হয়ত এক ধাক্কা খেতো। যদিও বিবাহই সবসময় পরিণতি বোঝায় না , কিন্ত “বড়দিদি” শরৎচন্দ্রের সমস্ত রচনার মধ্যে একমাত্র মিলনান্তক এক বিধবার প্রেম কাহিনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress