Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শতধারায় বয়ে যায় || Prafulla Roy » Page 9

শতধারায় বয়ে যায় || Prafulla Roy

৪১.

অফিস থেকে বেরিয়ে বাস স্টপেজের দিকে যেতে যেতে বিনয়ের চোখে পড়ল, হিমঋতুর বিকেল ফুরিয়ে আসছে। পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় স্থির চিত্রের মতো শেষ বেলার সূর্যটা দাঁড়িয়ে আছে। তার লাল রং ফিকে হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পর ওটা আর থাকবে না। ঝুপ করে বড় বড় ইমারতের আড়ালে নেমে যাবে।

এর মধ্যেই মিহি কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। আকাশে হুল্লোড় বাধিয়ে নানা রঙের বিভ্রম তৈরি করে উড়ে চলেছে অজস্র পাখি। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর দুধারের ফুটপাথে কত যে মাথা-উঁচু, ঝাড়ালো গাছ। শীতের বাতাস সেগুলোর ঝুটি ধরে নাড়া দিতে দিতে বয়ে চলেছে।

দুপুরবেলার আলস্য ঝেড়ে শহর এখন সরগরম। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। প্রচুর যানবাহন।

বিনয়ের মাথায় অবিরল ঝিনুকের ভাবনাটা চলছিল। কীভাবে মেয়েটাকে খুঁজে বার করবে, ঠিক করে উঠতে পারছিল না। আচমকা একটা রাস্তার নিশানা যেন পেয়ে যায় সে। কাজের দিনগুলোতে সময় পাওয়া যাবে না; অফিসের ডিউটি থাকবে। কিন্তু ছুটির দিনগুলো পুরোপুরি তার নিজস্ব। সেই সব দিনে শিয়ালদায় গিয়ে নর্থ কি মেন লাইনের লোকাল ট্রেন ধরে কোনও একটা স্টেশনে নেমে পড়বে সে। স্থানীয় মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে করে জেনে নেবে ওখানে কোনও রিফিউজি কলোনি বা ক্যাম্প আছে কি না। যদি থাকে, সেখানে চলে যাবে। এভাবে কাজের কাজ কিছু হবে কি না তার জানা নেই। তবু চেষ্টা তো করতে হবে।

মনের গতিবিধি বোঝা ভার। কখন যে সোজা সরল পথে চলতে চলতে হঠাৎ সেটা মোড় ঘুরে কোন দিকে ছুটবে আগেভাগে তার হদিস মেলে না। ঝিনুকের ভাবনাটা সরে গিয়ে হঠাৎই ছায়া-মায়াদের মুখগুলি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিনয় কথা দিয়েছিল, খুব শিগগিরই তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। হাজার ঝঞ্ঝাটে এমন জড়িয়ে গিয়েছিল, যে যাওয়া হয়নি। কথা দিয়েছিল, রামরতন গাঙ্গুলির দুই মেয়ের কাজের জন্য আনন্দ আর হিরণকে বলবে। বলা হয়নি। অথচ পদে পদে লাঞ্ছিত চার রমণী তারই জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। তাদের অফুরান আশা, সে একটা কিছু করে দেবে যাতে এই শহরে তারা সসম্মানে বেঁচে থাকতে পারে। তাছাড়া, ওরা কিছু বলেনি, বিনয় নিজের থেকেই নিত্য দাসকে দিয়ে নাসের আলির কাছে খবর পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিল, রামরতন গাঙ্গুলির পাকিস্তানের বিষয় আশয়ের কোনও ব্যবস্থা তিনি করতে পেরেছেন কি না। কলকাতায় ছায়া-মায়ার কাজকর্ম যদি কিছু না জোটে, দেশের জমিবাড়ি বিক্রির টাকাটা ছিল ওদের শেষ ভরসা। কিন্তু সেখানেও চরম বিপত্তি ঘটে গেছে। প্রাক্তন মাস্টার মশায়ের সম্পত্তি বেচতে গিয়ে সৎ, সাহসী, দায়িত্ববান নাসের আলি খুন হয়ে গেছেন। এই দুঃসংবাদটা ছায়া-মায়াদের জানিয়ে আসা উচিত ছিল। অলীক দুরাশা নিয়ে আজীবন তারা অপেক্ষা করবে, তা তো হয় না।

বিনয়ের মনে হল, সে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক। নিজের সমস্যা আর সংকট নিয়েই সর্বক্ষণ মগ্ন থাকে। এই মুহূর্তে তীব্র অপরাধবোধে সে কুঁকড়ে যায়। নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে ঠিক করে ফেলে, প্রসাদ লাহিড়ি যখন আজ অনেক আগে আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছেন, এখনই টালিগঞ্জে যাবে না। সোজা রামরতন গাঙ্গুলির স্ত্রী এবং মেয়েদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করবে।

সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর বাস স্টপেজে দাঁড়াল না বিনয়। ফুটপাথ ধরে আরও খানিকটা এগিয়ে ডান পাশের বাঁক ঘুরে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের ক্রসিংয়ে চলে এল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শ্যামবাজার রুটের ট্রাম এসে গেল।

চিত্রা সিনেমার কাছে নেমে রাস্তা পেরিয়ে ওধারে মদন বড়াল লেনে ঢুকে পড়ে বিনয়। মিনিট দুই হাঁটার পর বিমল গাঙ্গুলিদের সেকেলে তেতলা ভাড়াটে বাড়িটার সামনে চলে আসে। সদর দরজা হাট করে খোলা। ভেতরের মস্ত চাতালে নানা বয়সের মেয়েলোক আর বাচ্চাকাচ্চাদের জটলা। প্রায় সবাই কথা বলছে। ফলে গোটা চাতাল জুড়ে চলছে কলরোল।

বিনয় জানে, বিমল গাঙ্গুলি এখন অফিসে রয়েছে। তবু তারই নাম ধরে ডাকতে লাগল, বিমলবাবু–বিমলবাবু ছায়া কি মায়াকেও ডাকতে পারত কিন্তু যুবতী মেয়েদের ডাকতে কেমন যেন সংকোচ হল।

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয় না। গেটের মুখে ছায়া বা মায়া নয়, তাদের বিধবা দিদি বাসন্তী এসে দাঁড়ায়। বিনয়কে দেখে তার চোখেমুখে আলোর ছটা খেলে যায়। ব্যগ্র গলায় বলে, আপনে আসছেন। আসেন–আসেন–

গেট পেরিয়ে বিনয় ভেতরে ঢুকল।

তিরিশ নম্বর মদন বড়াল লেনের এই বাড়িতে এর আগে মাত্র একবারই এসেছিল বিনয়।

সে কোনও দিকে তাকাল না। চাতাল পেরিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, বিমলবাবু কি বাসায় আছেন?

বাসন্তী বলল, না। অফিসে

এসময় বিমলের অফিসে থাকারই কথা। কিন্তু কোনও কারণে যদি না গিয়ে থাকে, সেই জন্যই জানতে চাওয়া। বিনয় স্বস্তি বোধ করে। বিমল যদিও ভালমানুষ, জীবনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য মৃত রামরতন গাঙ্গুলি এবং তার পরিবারের সবার প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, তবু তার সামনে রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েদের পক্ষে নিজেদের ক্ষোভ, কষ্ট এবং অসম্মানের কথা খোলাখুলি জানানো সম্ভব নয়।

আচমকা কিছু মনে পড়ায় চকিত হয়ে ওঠে বিনয়, আগের বার যখন আসি বিমলবাবুর স্ত্রী ছিলেন না। তিনি কি কথাটা শেষ করে না সে।

ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিল বাসন্তী। চাপা গলায়, হয়তো একটু বিব্রতভাবে বলল, না, হেই যে বাপের বাড়ি গেছিল, অহনও ফিরে নাই।

বিনয়ের মনে পড়ে, সেবার এসে বিমলের স্ত্রীর বাপের বাড়ি যাবার কথা শুনে গিয়েছিল। এতদিন নিজের ঘর-সংসার ফেলে মা-বাবার কাছে থাকার কারণ কী? সেটা যাই হোক, স্বস্তিটা সহস্র গুণ বেড়ে যায় বিনয়ের। প্রথম দিন এসে সে জেনে গেছে, বিমলের স্ত্রী দীপ্তিই রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। স্বার্থপর, ঝগড়াটে, রণচণ্ডী ধরনের মহিলাটি চায় না এক দণ্ডও জেঠ-শশুরের পরিবারটি তাদের ঘাড়ে চেপে থাকুক। কবে, কোন জন্মে বিমলকে রামরতন কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছেন, কলকাতায় পাঠিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, সেজন্য তার স্ত্রী এবং মেয়েদের বোঝা বইতে হবে, তার কোনও মানে নেই। কলকাতা শহরে রেশনের চাল চিনি আটা, খোলা বাজারের মাছ আনাজ তেল ডাল মশলার দাম চড় চড় করে বেড়ে চলেছে। হাল যখন দ্রুত খারাপ হচ্ছে, চারটে মানুষের দায় নেওয়া কি মুখের কথা? পাঁচ-দশ দিন, কি দুচার মাস হলে না হয় কৃষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে নেওয়া যেত, কিন্তু অবস্থা যা তাতে আজীবন তাদের টানতে হবে। তার ওপর দুটো মেয়ের ভরা যৌবন। দুই পূর্ণ যুবতাঁকে তো চিরকাল গলায় ঝুলিয়ে বসে থাকা যাবে না। লোকে ছি ছি করবে। কিন্তু দুম্বো মেয়ে দুটোকে পার করা মুখের কথা নয়। ঘরে তো টাকার পাহাড় জমানো নেই। নেই কাড়ি কাড়ি সোনাদানা। বিয়ে দিতে হলে ধারে দেনায় মাথার তালু অবধি ডুবতে হবে। তারপর? নিজেদের ভবিষ্যৎ আছে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা আছে। অসুখবিসুখের খরচ আছে। মেয়ের বিয়ে আছে। কাজেই ঘাড় থেকে আপদ নামানো দরকার। আর সেজন্যই দীপ্তি সারাক্ষণ অগ্নিমূর্তি হয়ে থাকে। প্রতিটি ভাতের দলা মুখে তোলার সঙ্গে সঙ্গে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েরা টের পায়, বিমলের সংসারে বেঁচে থাকাটা কতখানি গ্লানিকর, কতটা দুঃসহ।

বিমলকে বিনয় যতটুকু দেখেছে তাতে মনে হয়েছে, সে খুবই ভদ্র, শান্ত এবং কর্তব্যপরায়ণও। শত কষ্ট আর টানাটানির মধ্যেও সে ছায়া-মায়াদের দায়িত্ব নিতে চায়। কিন্তু আগুনখাকী স্ত্রীর ভয়ে তা নেবার মতো শিরদাঁড়ার জোর তার নেই।

দীপ্তিকে দেখেনি বিনয়। তবে তার সম্বন্ধে যে ধারণাটুকু হয়েছে তা আদৌ সুখকর নয়। দীপ্তি আজ এখানে থাকলে হয়তো এমন ঘোর অশান্তির সৃষ্টি করত, গনগনে রাগে এমন বিষ ঢেলে দিত যে অস্বস্তির সীমা-পরিসীমা থাকত না বিনয়ের। হাজার হোক, সে বাইরের লোক। অনাত্মীয়।

চাতাল পেরিয়ে ডানদিকের বারান্দায় উঠতে উঠতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাসন্তী। কণ্ঠস্বর উঁচুতে তুলে এক নিঃশ্বাসে ডাকতে থাকে, ছায়া মায়া মা, তরাতরি বাইরে আসো। দ্যাখো কে আইছে।

বাসন্তীর ডাকে এত আকুলতা আর উত্তেজনা মেশানো ছিল যে বিনয় অবাক হয়ে যায়। ওদিকে সামনের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসেছেন রামরতনের স্ত্রী। বাঁ ধারের রান্নাঘরের দিক থেকে ছুটে আসে ছায়া আর মায়া।

রামরতনের স্ত্রী কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিনয়ের একটা হাত ধরে ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসান। প্রথম দিনও এই ঘরেই তাকে বসানো হয়েছিল।

ঘরের এক পাশে একফালি তক্তপোশ আধময়লা চাদরে ঢাকা। সেখানে বসলেন রামরতনের স্ত্রী। বললেন, হেই দিন কইয়া গেছিলা শিগগির আইবা। এতকাল পর আমাগো কথা মনে পড়ল? চিন্তা হইতে আছিল আমাগো বুঝিন ভুইলাই গ্যাছে।

বিনয় অপ্রস্তুত। দুর্বল, মিনমিনে গলায় একটা কৈফিয়ৎ অবশ্য দিল। রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের সে কি ভুলতে পারে? সারাক্ষণ তাঁদের চিন্তা তার মাথায় রয়েছে। কিন্তু নানা পাকে এমন জড়িয়ে গেছে যে সে-সব থেকে বেরুতে পারে না। তার ওপরে নতুন চাকরি। প্রচণ্ড কাজের চাপ। ইত্যাদি ইত্যাদি। বিনয় যা বলল তার একটি বর্ণও বানানো নয়। তবু সামান্য একটু খিচ থেকেই যাচ্ছে। এরই মধ্যে একটু সময় বার করে সে কি দু-এক ঘণ্টার জন্য মদন বড়াল লেনে আসতে পারত না?

বাসন্তী মায়ের পাশে নিঃশব্দে বসে পড়েছিল। মৃদু গলায় বলল, আপনের অবস্থান আমরা বুঝি। কিন্তুক আপনে ছাড়া কইলকাতায় আমাগো আর কুনো ভরসা নাই।

বাসন্তী তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কিন্তু আপনি করে বলে। এতে অস্বস্তি হয় বিনয়ের। সে ভাবল, বাসন্তীকে তুমি করে বলতে বলবে। কিন্তু তার আগেই রামরতনের স্ত্রী শুরু করলেন, অ্যাদ্দিন পর আইছ। মনে যে কী বল পাইতে আছি, বুঝাইয়া কইতে পারুম না। জানি, আমাগো লেইগা কিছু একটা ব্যাবোস্তা না কইরা তুমি আসো নাই।

বিনয় চমকে ওঠে। কাছাকাছি বসে আছেন রামরতনের স্ত্রী এবং বাসন্তী। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছায়া আর মায়া। ধীরে ধীরে সবাইকে একবার দেখে নিল বিনয়। সারি সারি মুখগুলি অনন্ত প্রত্যাশায় জ্বল জ্বল করছে। সেই সঙ্গে খানিক উৎকণ্ঠাও মেশানো। সবাই দমবন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে, পলকহীন।

হঠাৎ তীব্র শীত লাগার মতো কাপুনি ধরে যায় বিনয়ের। সেটা হৃৎপিণ্ডের, না কি মস্তিষ্কের কোনও গোপন কেন্দ্র থেকে উঠে এসে ডালপালার মতো ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে? সে তো ঝুলি বোঝাই করে অনেকগুলো পারিনি নিয়ে এসেছে। ছায়া-মায়ার চাকরি? জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। এমনকি আনন্দ বা হিরণের সঙ্গে কথাও বলে উঠতে পারেনি। এ-সব জানাতেই এসেছিল। তার ওপর রামরতনের জামতলির জমিজমা বেচতে গিয়ে নাসের আলি খুন হয়ে গেছেন–সেই দুঃসংবাদটা দিতেও। কিন্তু চারটি অসহায় রমণী এই শহরে তাকেই শেষ অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে। কিন্তু বিনয় কীভাবে একের পর এক এতগুলো খারাপ খবর মুখ থেকে বার করবে, ভেবে পেল না।

রামরতনের স্ত্রী করুণ বিলাপের সুরে একনাগাড়ে বলতে লাগলেন, বিমলের বউ হেই যে তার বাপের বাড়ি গ্যাছে, আমরা যদ্দিন আছি, হে আর ফিরব না। এই বাড়ির ভাত গলা দিয়ে আর নামতে চায় না বিনয়। অহন কও, আমাগো লেইগা কী করছ? ছায়া মায়ার কাম কাইজ কিছু হইল?

উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেল বিনয়। তার মস্তিষ্কে আচমকা বিদ্যুত্তরঙ্গ ঝলসে ওঠে। আশ্চর্য ভোজবাজিতে স্মৃতির ঝাপি খুলে যায়। তাদের প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িটা বেচে অবনীমোহন তার যাবতীয় ঋণশোধ করে গুরুর আশ্রমে চলে গেছেন। পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দেবার পরও তেত্রিশ হাজার টাকা বেঁচেছে। সুনীতি সুধা আর তার নামে ব্যাঙ্কে সেটা জমা করা আছে। এর তিন ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ এগারো হাজার তার প্রাপ্য। সেই টাকাটা, এমনকি পুরো তেত্রিশ হাজারও যদি সে নেয়, দুই দিদি এতটুকু আপত্তি করবে না। বিনয় ঠিক করে ফেলল, নিজের অংশের টাকাটা আপাতত রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের দিয়ে দেবে।

এগারো হাজার বেশ মোটা অঙ্কের টাকা। সস্তাগণ্ডার দিন, সুখের সময় কবেই শেষ হয়ে গেছে। জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য। তবু ওই টাকায় ভদ্র-পাড়ায় ঘর ভাড়া নিয়ে ওরা দু-তিনটে বছর নিশ্চিন্তে, মোটামুটি সচ্ছলভাবে কাটিয়ে দিতে পারবে। তার ভেতর ছায়া মায়ার কাজ কি আর জুটবে না? নিশ্চয়ই জুটবে।

বিনয়ের চিন্তাপ্রবাহ এক জায়গায় স্থির থাকছে না। ভাবনার প্রক্রিয়াটা নানাভাবে চলছে। সে এর মধ্যেই ভেবে নিল, টাকাটা একবারে রামরতনের স্ত্রীর হাতে তুলে দেবে না। শহরে চোর-ঘেঁচোড় ফেরেববাজ থিকথিক করছে। চারটি নিপাট সরল সাদাসিধে রমণী কলকাতায় এই প্রথম পা ফেলেছে। এখানকার ফন্দিবাজদের সম্বন্ধে তাদের কোনও ধারণাই নেই। তারা জানে না, টিকে থাকতে হলে কতরকম কৌশলের দরকার। হয়তো ফস করে টাকার কথা সবার সামনেই বলে ফেলল। তারপর সেটা খোয়া যেতে কতক্ষণ? তাই টাকাটা খেপে খেপে দেবে বিনয়। বলবে, সীমান্তের ওপার থেকে যেমন যেমন আসছে, তেমন তেমন দিয়ে যাচ্ছে।

রামরতনের স্ত্রী ফের বললেন, কিছু কইলা না তো বাবা?

নিজের ভাবনার মধ্যে তলিয়ে ছিল বিনয়। চমকে উঠে দেখতে পায়, তার সামনে সারি সারি সেই মুখচ্ছবি। বিপুল উৎসাহে ছায়া মায়ারা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখগুলো থির থির কাঁপছে। ওদের দৃঢ় বিশ্বাস, পরামাশ্চর্য কোনও জাদুকরের মতো আকাশের পরপর থেকে এই মুহূর্তে বিনয় তাদের জন্য অলৌকিক জিয়নকাঠি নামিয়ে আনবে।

বিনয় একদমে বলে যায়, ছায়া-মায়ার চাকরি হতে একটু সময় লাগবে। তবে অন্য একটা ব্যবস্থা। আমি করেছি। তাতে আপনাদের অনেকখানি সুবিধা হবে।

অসীম আগ্রহে রামরতনের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, আমাগো লেইগা কী করছ বাবা?

আমার জানালোনা, খুব বিশ্বাসী একটি লোককে দিয়ে পাকিস্তানে মাস্টামশাইয়ের ছাত্র নাসের আলির কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম। তিনি

বিনয় শেষ করতে পারে না। তার আগেই উত্তেজিত, অধীর স্বরে রামরতনের স্ত্রী বলে ওঠেন, এই কথা আমাগো জানাও নাই তো!

বিনয় বলে, কী করে জানাবো! এর মধ্যে তো আমি আপনাদের এখানে আসতে পারিনি। হঠাৎ লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার সঙ্গে পাকিস্তানের নানা মানুষের যোগাযোগ আছে। সুযোগ পেয়ে সেটা কাজে লাগিয়ে দিলাম।

রামরতনের স্ত্রী স্থির বসে থাকতে পারছিলেন না। সামনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে জানতে চাইলেন, নাসের কি কিছু করতে পারছে?

কোনও দিনই মিথ্যে বলার অভ্যাস নেই বিনয়ের। পাছে ধরা পড়ে যায় তাই কারও দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না। মুখ নামিয়ে নেয় সে। যদি গলার স্বর কেঁপে যায় তাই প্রাণপণে সেটা স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে। প্রায় মরিয়া হয়ে বলে, পেরেছে বলেই কী ভেবে, নিজের অজান্তে চোখ তুলতেই লক্ষ করল, ছায়া মায়া বাসন্তী এবং রামতনের স্ত্রীর মুখ লহমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

রামরতনের স্ত্রী শরীরের সবটুকু শক্তি জড়ো করে আর-একবার বিনয়ের হাত জড়িয়ে ধরেন। থর থর, ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করেন, কী করছে কও

বিনয় বলল, আপনাদের জামতলির চাষের জমি আর বাড়ির খদ্দের পেয়ে গেছেন। বিক্রির সময় মাস্টারমশায়ের দেশে গিয়ে রেজিষ্ট্রি করে দেবার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তো নেই। নাসের আলি কী একটা বন্দোবস্ত করেছেন। তাতে বিক্রিতে অসুবিধা হবে না। দু-এক সপ্তাহের মধ্যে বেচে টাকা পাঠিয়ে দেবেন।

বালিকার মতো হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন রামরতনের স্ত্রী, তুমি আমাগো বাঁচাইলা বাবা। ভগবান তোমার মঙ্গল করব। আমার মাথায় যত চুল আছে তত বছর তোমার পরমায়ু হউক। প্রচুর মঙ্গলকামনা এবং আশীর্বাদের পর বললেন, তোমার লোকেরে দিয়া নাসেরেরে জানাইয়া দিও, ভগবান তারও ভাল করব। হে আমার পোলার কাম করছে।

অকপট, ছলচাতুরিহীন চারটি রমণীর সঙ্গে মিথ্যাচার করতে তীব্র অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছিল বিনয়। নিজের কাছেই ভীষণ ছোট হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে নিজের কালিমাখা মুখ দেখতে পাবে। একটার পর একটা ফাঁসে জড়িয়ে পড়ছে সে। তবে সবচেয়ে যেটা তার বিবেকে শেল বিধিয়ে চলেছে তা হল মৃত নাসের আলির নামে মিথ্যে বলা। এজন্য অনুশোচনার শেষ নেই তার। পরক্ষণে নিজের মনেই সান্ত্বনা খোঁজে, নাসের আলি কোনও দিনই ফিরে আসবেন না। তাঁর নামে মিথ্যে বললে চারটি মানুষ যদি বেঁচে যায় তাতে খুব একটা অন্যায় কি হয়েছে? নাসেরের আত্মার প্রতি হাজার বার ক্ষমা চেয়ে নেয় বিনয়। তারপর জড়ানো স্বরে বলে, আপনার কথাগুলো জানিয়ে দেব।

আমাগো লেইগা এত করতে আছ। আর-একখান কাম কইরো বাবা

বলুন কী কাজ?

নাসের টাকাটা পাঠাইলে ভাল জাগায় ঘর ভাড়া কইরা দিবা।

বিনয় আস্তে মাথা নাড়ে, দেব।

শীতের সন্ধে ঝপ করে নেমে আসে। তারই তোড়জোড় চলছে। ঘরের ভেতরটা আবছা অন্ধকারে ভরে গেছে। বাসন্তী উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল।

বিনয় বলল, আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। আজ উঠি।

শশব্যস্ত রামরতনের স্ত্রী বললেন, ওই দ্যাখো, নিজেগো চিন্তা নিয়াই দিনরাইত ডুইবা থাকি। কহন আইছ। কিছুটুক তো দেই নাই। ছায়া-মায়া অক্ষণই চা কইরা নিয়া আয়। আর দ্যাখ, মিঠাই টিঠাই কী আছে–

ছায়া-মায়া রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাদের থামিয়ে উঠে দাঁড়ায় বিনয়, আজ থাক। সেই সকালে বেরিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে আসছি। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।

রামরতনের স্ত্রীও উঠে পড়েছিলেন। বললেন, চা বানাইতে কতক্ষণ আর লাগব। এট্ট বইসা যাও বাবা, বইসা যাও। নিজেগো কথা কইতে কইতে মাথার ঠিক আছিল না। কী অন্যায় যে হইয়া গ্যাল! যে যুবকটি তাদের জন্যে এমন এক সুসংবাদ বয়ে এনেছে, যা ছিল স্বপ্নেরও বাইরে, অকল্পনীয়, তাকে সামান্য একটু খাতিরযত্নও করা হয়নি। এর জন্য আক্ষেপের শেষ নেই বৃদ্ধার।

বিনয় ম্লান হাসে, কোনও অন্যায় হয়নি। কদিন পরে তো টাকা নিয়ে আসছি। তখন চা-মিষ্টি যা দেবেন, খেয়ে যাব। বেরুবার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে সে, দেখুন একটা কথা বলতে সংকোচ হচ্ছে। তবু না বললেই নয়।

আমাগো কাছে তোমার কীসের সংকোচ। মন খুইলা কও

টাকার কথাটা আপনারা চারজনই শুধু জানবেন। অন্য কারওকে বলবেন না।

নিষ্পলক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন রামরতনের স্ত্রী। সংকেতটা তিনি ধরতে পেরেছেন। ধীরে ধীরে বললেন, বুঝছি। বিমলগো কইতে নিষেধ করতে আছ।

শুধু বিমলবাবুরা কেন, আর কেউ যেন না জানে।

ঠিক আছে।

শত মিনতি সত্ত্বেও বিনয় বসল না। রামরতনের স্ত্রী আর তার তিন মেয়ে সদর দরজা অবধি তার সঙ্গে সঙ্গে এল। রাস্তায় বেরিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকায় বিনয়। দরজার ফ্রেমে এক বৃদ্ধা, এক মধ্যবয়সিনী এবং দুটি তরুণীর উজ্জ্বল, কৃতজ্ঞ মুখ স্থির হয়ে আছে।

এক মুহূর্ত চার রমণীকে দেখেই সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে বিনয়। আর তখনই নতুন করে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তোলপাড় করে ঝিনুকের চিন্তাটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে খুঁজে বার করতে হবে। করতেই হবে।

৪২.

মদন বড়াল লেনের আদ্যিকালের ঘিঞ্জি বাড়িঘর আর দোকানগুলোতে আলো জ্বলে উঠেছে। সবই অল্প পাওয়ারের মিটমিটে বাম্ব।

কর্পোরেশনের লোকেরা কখন যেন রাস্তার সারি সারি গ্যাস বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। বিকেল থেকে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। সেই কুয়াশা ক্রমশ গাঢ় হয়ে আলোগুলোকে ঠেসে ধরছে।

কদিন হল, এই শহরে শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। উত্তুরে হাওয়ায় ছুরির ধার। গায়ে লাগলে কেটে কেটে বসে যায়। ভিড়ের ভেতর দিয়ে বড় রাস্তার দিকে যেতে যেতে বিনয় গায়ের গরম চাদরটা দিয়ে কান-মাথা ঢেকে ঘন করে সারা শরীর জড়িয়ে নিল। আজ দুপুরে ভাত খাওয়া হয়নি। সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি থেকে অফিসে এসে চার পিস পাতলা পাতলা টোস্ট, একটা ডিম সেদ্ধ আর চা খেয়েছিল। এখন পেটে খাণ্ডবদাহন হবার কথা। কিন্তু খিদে তেষ্টার বোধটাই তেমন নেই বিনয়ের। ঝিনুকের চিন্তা অন্য সব অনুভূতিকে প্রায় ভোঁতা করে দিয়েছে। অনবরত সেটা তার মস্তিষ্কে ঘূর্ণিপাক সৃষ্টি করে চলেছে।

কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে সবে সে পৌঁছেছে, শ্যামবাজারের দিক থেকে একটা দুনম্বর রুটের দোতলা বাস দাপিয়ে ঝাঁপিয়ে এসে হাজির। বিনয় উঠে পড়ল।

এই বাসটা রাসবিহারী অ্যাভেনিউর মোড় ঘুরে বালিগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত যাবে। মোড়ের মাথায় নেমে টালিগঞ্জের বাস বা ট্রাম যা আগে পায় সেটাই ধরবে বিনয়।

হিমঋতুর এই সন্ধেবেলায়, শীতে শহর যখন হিহি কাঁপছে, কার প্রাণে এত শখ যে হাওয়া খেতে বেরোয়। বাসটা প্রায় ফাঁকাই। বিনয় পাশের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একটা জানালার ধার ঘেঁষে বসল। জানালাটা অবশ্য বন্ধ। শুধু সেটাই না, সবগুলোই।

জানালাগুলোর পাল্লার ওপর এবং নিচের দিকটা কাঠের, মাঝখানে আট দশ ইঞ্চির মতো কাঁচ। সেই কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরের নানা দৃশ্য চোখে পড়ে।

বিনয় বাইরে তাকিয়ে ছিল ঠিকই, কিন্তু কিছুই যেন দেখছিল না। সেখানকার যাবতীয় দৃশ্য তার দৃষ্টি ছুঁয়ে ছুঁয়ে সরে সরে যাচ্ছে। রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েদের মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপাতত দু-তিন বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। তার মধ্যে পাকাপাকি কিছু একটা করে ফেলা সম্ভব হবে। কিন্তু ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া যাবে কীভাবে? কোন পদ্ধতিতে? অধর ভুইমালী শিয়ালদা স্টেশনে ঝিনুককে একটি মাঝবয়সী লোকের সঙ্গে ট্রেনে উঠতে দেখেছে। এই পলকা সুতোটুকু ধরে কতটা এগুনো সম্ভব?

দোতলা বাসটা রাস্তায় ঝড় তুলে আধ ঘণ্টার ভেতর রাসবিহারীর মোড়ে এসে গেল। সেখান থেকে ট্রাম ধরে জাফর শা রোডে বিনয় যখন পৌঁছল, আটটা বাজতে তখনও ঢের দেরি। কিন্তু এর মধ্যেই রাস্তাঘাট নিঝুম। বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে।

বারকয়েক ডাকাডাকি করতে উমা নিচে নেমে দরজা খুলে দিল। দোতলায় উঠে আসতেই দেখা গেল, বাইরের ঘরে দ্বারিক দত্ত, হিরণ আর সুধা শালটাল জড়িয়ে গল্প করছে। বিনয় যতক্ষণ না অফিস থেকে ফেরে, ওরা এখানে অপেক্ষা করতে থাকে। তাকে দেখামাত্র ত্বরিত পায়ে উঠে দাঁড়ায় সুধা। ব্যস্তভাবে বলে, আয়, আয়—

দ্বারিক দত্ত বললেন, এমন জব্বর শীত। তার ওপর এত রাত্তিরে বাড়ি ফেরা। আনন্দ তোকে একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছে বটে!

বিনয় বলতে পারত, পুরো ডিউটি দিলে তার ফিরতে ফিরতে সাড়ে দশটা, এগারোটা বেজে যেত। খবরের কাগজের কাজ অন্য সব অফিসের মতো দশটা-পাঁচটার বাঁধাধরা চাকরি নয়। কিন্তু দ্বারিক দপ্তর কথাগুলো তার কানেই প্রায় ঢুকল না। ভীষণ উত্তেজিত সুরে বিনয় বলল, ছোটদি, আজ কি হয়েছে জানিস?

হিরণ আর দ্বারিক দত্ত উৎসুক হয়ে ওঠেন। হিরণ বলে, কী হয়েছে?

খবরের কাগজে ঢোকার পর অফিসে কে কী করেছে, কে কী বলেছে, নতুন নতুন কাদের সঙ্গে আলাপ হল–বাড়ি ফিরেই সব খুঁটিনাটি হিরণদের জানায় বিনয়। এমনকি দিল্লি বোম্বের পুরোনো পত্রপত্রিকা ঘেঁটে পশ্চিম পাকিস্তানের নানা চমকপ্রদ ঘটনার কথাও শুনিয়েছে সে। যেমন লাহোরের ধর্ষিতা জাঠ তরুণী নীলমের কাহিনি।

সুধা আঁচ করে নিল, অফিসের সহকর্মী বা নীলমদের মতো কারও কথা বলবে বিনয়। তবে ভাইকে কিছু বলতে দিল না সে। কেননা এই মুহূর্তে সে-সব খুব একটা জরুরি নয়। সেই কোন সকালে ছেলেটা বেরিয়ে গিয়েছিল। ফিরল এই রাত্রিবেলায়। হা-ক্লান্ত। চুল উষ্কখুষ্ক, চোখ বসে গেছে। দেখামাত্র টের পাওয়া যায়, তার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে।

সুধা হিরণদের বলল, এখন নয়। বিনু একটু জিরিয়ে নিক। হাত মুখ ধুয়ে বাইরের নোংরা জামাকাপড় পালটাক। তারপর খেতে খেতে ধীরেসুস্থে সব বলবে।

বিনয় দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে সঙ্গে করে ভেতর দিকে চলে গেল সুধা। ভাইকে তার ঘরে পাঠিয়ে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে স্টোভ ধরিয়ে বড় এক ডেকচি জল বসিয়ে দিল। যা শীত, গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢাললে কী চোখেমুখে ছিটোলে চামড়া অসাড় হয়ে যাবে। আর-একটা স্টোভ ধরিয়ে উমাকে চটপট খাবার গরম করতে বলল সে।

বিনয় নিজের ঘরে গিয়ে খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে আধশোওয়া মতো হয়ে থাকে। রাজ্যের অবসাদ এখন তার ওপর ভর করেছে। চোখের পাতা খুলে রাখা যাচ্ছে না। শরীর এলিয়ে আসছে।

একসময় দরজার কাছে সুধার গলা শোনা গেল, বিনু–এই বিনু, ঘুমিয়ে পড়লি না কি?

ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে বিনয়, না না

সুধা বলে, বাথরুমে গরম জল দিয়ে এসেছি। যা বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

বিনয় গামছা এবং ঘরে পরার পাজামা-শার্ট নিয়ে চানঘরে গিয়ে ঢোকে। শীতের এই রাত্তিরে ফুটন্ত জলে হাত-পা ধুতে যে কী আরাম! পলকে সারাদিনের ক্লান্তির অনেকটাই কেটে যায়।

বাথরুম থেকে বেরুতে না বেরুতেই খাওয়ার ডাক পড়ে।

পাশাপাশি হিরণ, বিনয় এবং দ্বারিক দত্ত খেতে বসেছেন। দ্বারিক দত্ত রাত্তিরে দুধ খই আর একটা সন্দেশ কিংবা ছানার অন্য কোনও মিষ্টি খান। খইয়ের বদলে কোনও কোনও দিন সুজির রুটি। তবে মিষ্টিটা চাই-ই। রাত্তিরে গুরুপাক খাবার তার হজম হয় না।

সুধা কাছেই বসে আছে। দরকারমতো ভাত ডাল মাছ তরকারি হিরণ আর বিনয়ের পাতে তুলে তুলে দিচ্ছে।

সুধা বিনয়ের দিকে তাকিয়ে মনে করিয়ে দিল, তখন কী যেন বলছিলি—

বিনয় বলল, আজ একজন ঝিনুকের কথা বলল। সে কলকাতার আশেপাশেই আছে।

রান্নাঘরে তড়িৎপ্রবাহ বয়ে যায়। সুধা উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কার কাছে শুনলি?

বিনয় অধর ভুইমালীর কথা বলল।

দ্বারিক দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, লোকটা কে? তাকে আজ তুই কোথায় পেলি?

সকালে জবরদখল কলোনি সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে যাওয়া, সেখানে হঠাৎই অধরের সঙ্গে দেখা হওয়া, কোথায় কীভাবে ঝিনুককে সে দেখেছে তার সবিস্তার বিবরণ শোনা–এক নিঃশ্বাসে সমস্ত জানিয়ে দেয় বিনয়। তারপর অনন্ত আক্ষেপের সুরে বলে, অধর ভুইমালী যদি খেয়াল করে ঝিনুককে জিজ্ঞেস করত সে কোথায় যাচ্ছে, তাকে খুঁজে বার করা যেত। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। খবর পেয়েও বোধহয় লাভ হল না। জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে সে।

হতাশ, বিপর্যস্ত, হতোদ্যম বিনয়কে দেখতে দেখতে এক ধরনের আকুলতা বোধ করে হিরণ। গলায় জোর দিয়ে বলে, কেন পাওয়া যাবে না? শিয়ালদা মেন লাইন থেকে যখন ঝিনুক লোকাল ট্রেনে উঠেছে তখন ওধারে কাছাকাছি কোথাও আছে। অফিসের দিনে তো হবে না। ফি রবিবার ওই লাইনের একটা করে স্টেশনে নেমে সেখানকার রিফিউজি ক্যাম্প, কলোনি আর গ্রামগুলোতে যাওয়া দরকার। কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি এক স্টেশনে নামব, তুমি আর-এক স্টেশনে। এতে নিশ্চয়ই কাজ হবে।

বিনয় বলল, আপনি যাবেন তা না ভাবলেও, স্টেশনে স্টেশনে নেমে আমি নিজে গিয়ে খোঁজ করার কথা চিন্তা করেছি। সেই সঙ্গে তার সংশয়ের কথাটাও জানিয়ে দেয়। বিনয়ের ধারণা, এতে তেমন কিছু হবার সম্ভাবনা খুবই কম। অনেকটা ঘন অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াবার মতো। শিয়ালদা মেন লাইন থেকে কত দিকে কত ট্রেন যায়। স্টেশনের পর স্টেশন। সেইসব স্টেশনের দুধারে বহু দূর অবধি কত যে গ্রাম, কত যে ক্যাম্প আর কলোনি, কত যে ছোটখাটো শহর, তার কি লেখাজোখা আছে। সব জায়গায় ঘোরাঘুরি করা দুজন কেন, দশ বিশ জনের পক্ষেও এক জীবনে সম্ভব নয়। তাছাড়া মেন লাইনের ট্রেনে চড়েছে বলেই ঝিনুক চিরকাল ওই দিকে থাকবে, জোর দিয়ে তা কি বলা যায়?

হিরণ দমে যায়। এত সব খুঁটিয়ে ভাবেনি সে। কী উত্তর দেবে, ঠিক করে উঠতে পারল না।

সুধা অসীম আগ্রহে সবার কথা শুনছিল। এবার বলে ওঠে, আমি একটা উপায় বলতে পারি।

কী উপায়?

সুধা বলল, ওভাবে অন্ধের মতো ছোটাছুটি না করে বিনু বরং একবার থানায় যাক। ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর থানায় জানানো হয়েছিল। শিয়ালদা মেন লাইনের কথা বললে হয়তো কিছু একটা হতে পারে।

কদিন আগে এই সুধাই যে ঝুমার সঙ্গে বিনয়ের বিয়ের ব্যাপারে শিশির সুনীতি আনন্দের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল, এখন যেন তা ভাবাই যায় না। আসলে সে ধরেই নিয়েছিল, ঝিনুককে আর পাওয়া যাবে না। নিয়ের সামনে অনন্ত ভবিষ্যৎ। একা একা কীভাবে কাটবে তার? ঝিনুক তার জীবনের যে দিকটা ফাঁকা করে দিয়েছে তা পূরণ হবে কোন উপায়ে? এই সব ভেবে চিন্তে শিশিরদের কথায় সায় দিয়েছে সে। কিন্তু যেইমাত্র জানা গেল ঝিনুক কলকাতার আশেপাশেই আছে, তার খোঁজ পাওয়া যেতেও পারে, সঙ্গে সঙ্গে ঝুমা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। চিরদুঃখী, লাঞ্ছিত মেয়েটার জন্য সে ব্যগ্র হয়ে উঠেছে।

অধরের কাছে ঝিনুকের কথা শোনার পর থেকে বিনয় এমনই বিচলিত, এমনই ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল যে থানার চিন্তা তার মাথাতেই আসেনি। অথচ পুলিশের বিপুল ক্ষমতা। তাদের কর্মকাণ্ডের জাল সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ছড়ানো। পাঁচ সাত মাইল পর পর একটা করে থানা।

পুলিশ এতদিন যে কিছু করতে পারেনি, কারণ তারা সঠিকভাবে জানত না, কোথায় ঝিনুককে খুঁজতে হবে। আন্দাজে আন্দাজে এলোপাতাড়ি এখানে ওখানে হাতড়াচ্ছিল। এখন ক্ষীণ হলেও একটা সূত্র পাওয়া গেছে। ওসি দিবাকর পালিতকে খবরটা দিলে তিনি নিশ্চয়ই ওই অঞ্চলের ওপর জোর দেবেন। বিনয়রা দশ বছর ছোটাছুটি করেও যা পারবে না, ওঁরা দশ দিনে তা করে ফেলবেন।

আশায়, উদ্দীপনায় চোখ মুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে বিনয়ের। খাওয়া দাওয়া ফেলে এখনই থানায় ছোটার জন্যে উঠে পড়েছিল। দ্বারিক দত্ত হিরণ সুধা তিনজনেই বলল, এত রাতে যেতে হবে না। কাল সকালেই বরং বিনয় দিবাকর পালিতের সঙ্গে গিয়ে দেখা করুক।

একটু চুপচাপ।

হিরণ খেতে খেতে কী ভাবছিল। হঠাৎ বলে ওঠে, আরও একটা কাজ করতে হবে বিনু

বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী কাজ?

যুগল কদিন হল, আমাদের বাসায় আসছে না। তুমি দু-চারদিনের মধ্যে সময় করে একবার মুকুন্দপুর কলোনিতে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা কোরো।

বিনয় অবাক হল, কেন বলুন তো?

হিরণ উদ্দেশ্যটা বুঝিয়ে দিল। যুগল মেন লাইনের আগরপাড়া থেকে প্রায়ই কলকাতায় যাতায়াত করে। শুধু সে একাই নয়, কলোনির আরও অনেকে। তারা ঝিনুককে চেনে। যুগলরা যদি ট্রেনে তাদের যাওয়া-আসার সময় লক্ষ রাখে, হয়তো ঝিনুকের দেখা পেয়ে যাবে।

থানার মতো যুগলদের কথাও ভাবেনি বিনয়। বলল, যাব। নিশ্চয়ই যাব। মনে মনে ঠিক করে ফেলে, কাল আর কোনও কলোনি বা ক্যাম্পে যাবে না। ঝিনুকের সন্ধানটা তার কাছে সবচেয়ে জরুরি। সবার আগে যেতে হবে থানায়। সেখান থেকে ফিরে চান-খাওয়া সেরে অফিসে।

পরদিন সকালে চা খেয়ে বিনয় যখন বাড়ি থেকে বেরুল, কুয়াশা কেটে সবে রোদ দেখা দিয়েছে।

শীতের এই সকালবেলায় কলকাতার ঘুম ভাঙলেও তার সর্বাঙ্গে ঘোর আলস্য জড়ানো। চারদিক ফাঁকা ফাঁকা, রাস্তায় লোকজন খুবই কম। দু-চারটে দোকান খুলেছে। বেশির ভাগই বন্ধ। সাইকেল পিওনরা গাড়ি চালাতে চালাতেই আশ্চর্য কৌশলে দড়ি-বাঁধা খবরের কাগজ দোতলা তেতলা বাড়িগুলোর সামনের দিকের উঁচু উঁচু বারান্দায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে।

বড় রাস্তায় আসতেই এসপ্ল্যানেডের ট্রাম পেয়ে গেল সে। মিনিট পনেরোর ভেতর সেটা তাকে ভবানীপুর থানার সামনে পৌঁছে দিল।

ওসি দিবাকর পালিত তখনও কোয়ার্টার থেকে তাঁর চেম্বারে নামেননি। ঘন্টাখানেক পর তিনি এলেন। নিজের গদি-মোড়া নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন, কখন এসেছ?

বিনয় বলল।

দিবাকর বললেন, এটা তাহলে তো অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়েছে। খুব আর্জেন্ট কিছু না থাকলে এত তাড়াতাড়ি আমি নামি না।

বিনয় সংকোচের সুরে বলল, জানতাম না। অনেক আগেই এসে পড়েছি।

দিবাকর বললেন, দু-আড়াই উইক পরে তোমাকে দেখলাম। কেমন আছ বল– খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিনয়ের সব খবর নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অবনীবাবুর চিঠিপত্তর পেয়েছ?

আশ্চর্য, সেই যে বাবা তার গুরুর আশ্রমে হরিদ্বার না উত্তরকাশী চলে গেছেন তারপর থেকে তার সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ নেই। নিজেকে নিয়ে সারাক্ষণ বিনয় এমনই ব্যতিব্যস্ত, হাজার সমস্যায় এতই জড়িয়ে গেছে যে অবনীমোহনের কথা সেভাবে মনেই পড়েনি। নিজের জন্মদাতা মানুষটি বহু দূরের অচেনা, অস্পষ্ট কোনও নক্ষত্রের মতো কি বিলীন হয়ে যাচ্ছেন?

বিনয় আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, না, পাইনি।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর বিনয় জিজ্ঞেস করল, ঝিনুকের খোঁজ কি পেয়েছেন?

দিবাকরের মাথা ডাইনে থেকে বাঁয়ে এবং বাঁয়ে থেকে ডাইনে বার তিনেক ঘুরে যায়। বিমর্ষ মুখে বলেন, না। পেলে তো তোমাকে জানিয়েই দিতাম। তবে আমরা হাল ছাড়িনি, সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বিনয় বলল, আমি ওর সম্বন্ধে কিছু খবর দিতে এসেছি।

দিবাকর সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, কী খবর? তার চোখে মুখে গভীর ঔৎসুক্য।

অধর ভুইমালী যা যা বলেছিল, সব জানিয়ে দিল বিনয়।

দিবাকরের শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়। বললেন, আমাদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। তুমি যে বললে সেই কু ধরে এগুবো। শিয়ালদা মেইন লাইনের ওধারে যত থানা আছে সব জায়গায় আজই ফোন করে বলব, তারা যেন তাদের এলাকায় তন্ন তন্ন করে ঝিনুকের খোঁজ করে।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে উঠে পড়ে বিনয়।

জাফর শা রোডে ফিরে বাইরে থেকে ডাকাডাকি করতে উমা এসে দরজা খুলে দিল। দোতলায় উঠতে উঠতে নিত্য দাসের গলা শুনতে পেল বিনয়। কতদিন বাদে লোকটা এ-বাড়িতে এল, মনে করতে পারল না সে। শুধু টের পেল, বুকের ভেতরটা তোলপাড় হতে শুরু করেছে। নিত্য কি হেমনাথের চিঠি নিয়ে এসেছে? রুদ্ধশ্বসে একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি টপকাতে লাগল সে।

৪৩.

দোতলায় উঠে আসতে দেখা গেল, বাইরের ঘরে দ্বারিক দত্ত আর নিত্য দাস বসে আছে। দুজনে কথা বলছিল। এছাড়া অন্য কেউ নেই। দশটা বাজতে চলেছে। এসময় হিরণের বাড়িতে থাকার কথা নয়। সে এতক্ষণে নিশ্চয়ই অফিসে চলে গেছে। সুধাকেও দেখা গেল না। সে হয়তো ভেতরে সংসারের নানা কাজকর্মে ব্যস্ত। স্বামীকে অফিসে পাঠিয়ে দিলেই সুধার সব কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। তারপরও কত কাজ থাকে। অথর্ব সরস্বতীকে চান করানো, খাওয়ানো। সরস্বতীর তেত্রিশ কোটি দেবতা আছে। বুড়ো মানুষটির পক্ষে বোজ তাদের সামনে বসে ধূপদীপ জ্বালিয়ে ঠায় দেড় দুঘন্টা বসে পুজো টুজো করা সম্ভব নয়। সেই দায়িত্বটা প্রায়ই নিতে হয় সুধাকে। তাছাড়া দ্বারিক দত্তর সেবাযত্ন আছে। সাড়ে বারোটা, একটা পর্যন্ত দম ফেলার ফুরসত নেই তার। ভাবাই যায় না, বেলা দশটায় সুধা বাইরের ঘরে বসে নিত্য দাস আর দ্বারিক দত্তর সঙ্গে গল্প করবে।

বিনয়কে দেখে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ায় নিত্য দাস। বিনয় বলল, বসুন, বসুন।

ফের বসতে বসতে নিত্য বলে, হেই সাড়ে আটটা থিকা আপনের লেইগা বইসা আছি ছুটোবাবু। ঠিকই করছিলাম, যতক্ষণ না ফিরেন, উইম না।

হেমনাথের খবরের জন্য সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী ব্যগ্র হয়ে উঠেছে বিনয়ের। সে জিজ্ঞেস করে, দাদুর চিঠিপত্র কি এসেছে?

আইছে। কাইল রাইতে আমার লোক বডার থিকা আইয়া দিয়া গ্যাছে। তখন সাড়ে দশটা বাজে। অত রাইতে গারিঘুরা মিলে না। হের লেইগা আইতে পারি নাই। জামার পকেট থেকে পুরু লম্বা একটা খাম বার করে বিনয়কে দিতে দিতে নিত্য দাস বলল, চিঠিখান দ্বারিক কত্তারে দিয়া চইলা যাইতে পারতাম। কিন্তুক আপনের লগে ম্যালা (অনেক) দিন দ্যাহা হয় নাই। ভাবলাম, আইছি যহন। দ্যাহাখান কইরাই যাই। হ্যামকত্তার চিঠি পইড়া আমারে যদিন আপনের কিছু কওনের থাকে হুইনা যামু।

বিনয় উত্তর দিল না। উত্তেজনা, বুকের থরথরানি, শঙ্কা–কত কী-ই যে চলছে তার ভেতরে। কী লিখেছেন হেমনাথ? ক্ষিপ্র হাতে খামের মুখ ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে উঁচু গলায় ডাকতে লাগল, ছোটদি–ছোটদি তার গলা ভীষণ কাঁপছিল।

সুধা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘরোয়া ধরনে পরা তাতের আধময়লা শাড়ি। খোঁপা ভেঙে গেছে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। দেখামাত্র টের পাওয়া যায়, কোনও কাজ করতে করতে চলে এসেছে।

সুধা বলল, কি রে, কখন ফিরলি?

এই সবে। দুমিনিটও হয়নি।

থানায় কী বলল?

পরে শুনিস। এখন বোস্

এখন কি বসবার সময়? রাজ্যের কাজ পড়ে আছে।

ততক্ষণে খামের ভেতর থেকে চিঠি বার করে ফেলেছে বিনয়। বলল, দাসমশাই দাদুর চিঠি নিয়ে এসেছে। শুনবি না?

সুধা ঘরে ঢুকে পড়ে। যে-কাজটি ফেলে সে চলে এসেছে সেটা পরে করলেও চলবে। তার চেয়ে হেমনাথের চিঠি শোনাটা এখন শত গুণ জরুরি। এই চিঠির জন্য তারা কী উৎকণ্ঠা নিয়ে যে অপেক্ষা করে আছে! বিনয়ের কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসতে বসতে সুধা বলল, পড়–

বিনয় চিঠি খুলে পড়তে শুরু করল।

কল্যাণবরেষু
বিনু, বেশ কিছুকাল আগে তোমার পত্র পাইয়াছিলাম কিন্তু উত্তর যে দিব, তাহার উপায় ছিল না। কারণ নিত্য দাসের যে লোকটি পাকিস্তানের চিঠি ইন্ডিয়ায় এবং ইন্ডিয়ার চিঠি পাকিস্তানে পৌঁছাইয়া দেয় সেই জয়নাল বহু দিন রাজদিয়ায় আসে নাই। তোমাদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করিব, চিন্তা করিয়া কূলকিনারা পাইতাম না। কী দুশ্চিন্তায় যে দিন কাটাইয়াছি, শুধু আমিই জানি। আর জানে তোমার দুই দিদা। সারা রাত্রি আমরা চোখের পাতা এক করিতে পারিতাম না।

আমি জানি, নিত্যদিন ইন্ডিয়ার কাগজে পাকিস্তানের ভীতিকর সব খবর পড়িয়া তোমরা আমাদের সম্বন্ধে প্রচণ্ড উদ্বেগের মধ্যে রহিয়াছ। কিন্তু কী করিব, ভাবিয়া ভাবিয়া যখন শেষ আশাটুকুও ছাড়িয়া দিতে বসিয়াছি সেইসময় জয়নাল আসিয়া হাজির। মনে হইল, দেবদূতের দর্শন পাইলাম।

জয়নাল জানাইল, মধ্যিখানে টাইফয়েডে পনেরো দিনেরও বেশি সে শয্যাশায়ী হইয়া ছিল। শরীর ভয়ানক দুর্বল। সেই কারণে আমার সহিত দেখা করিতে পারে নাই। এজন্য বার বার ক্ষমা চাহিল। লোকটি ভাল। বিনয়ী। দেশভাগের পর বহু হিন্দু পরিবারের একাংশ ইন্ডিয়ায় চলিয়া গিয়াছে। বাকি অংশ দেশের ভিটা আঁকড়াইয়া পড়িয়া আছে। এপারের প্রিয়জনদের জন্য ওপারের আত্মীয়-পরিজনদের। যে কী অনন্ত দুর্ভাবনা, জয়নাল তাহা বোঝে। পার্টিশানে ক্ষতিগ্রস্ত, সর্বস্বান্ত মানুষগুলির জন্য তাহার গভীর সহানুভূতি লক্ষ করিয়াছি।

যাহা হউক, এইবার আমাদের কথা জানাই। আমি শারীরিক দিক হইতে মোটামুটি আছি। সামান্য জ্বরজারি হইয়াছিল, তাহা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তোমার দিদা এবং শিবানীদিদি ভাল নাই। শিবানী কয়েকদিন ম্যালেরিয়ায় ভুগিয়া উঠিল। তোমার দিদার বাতের পুরাতন ব্যথাটা নতুন করিয়া চাগাইয়া উঠিয়াছে। চলিতে ফিরিতে কষ্ট হয়।

রাজদিয়ার একমাত্র এল এম এফ ডাক্তার অশ্বিনী ঘোষ গত মাসে দেশের বিষয় সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করিয়া রাতারাতি কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছে। গোপনে গোপনে সে যে বাড়িঘর বিনিময়ের চেষ্টা করিতেছে, আগে তাহা কাহাকেও জানায় নাই। সমস্ত কাজ নিঃশব্দে সমাধা করিয়া যাইবার আগে আমার সঙ্গে অবশ্য দেখা করিয়াছিল। আর ছিল ননী কবিরাজ। সে আমার মতো পূর্বপুরুষের ভিটা কামড়াইয়া পড়িয়া ছিল। তাহার স্ত্রী এবং ছেলেরা আগেই আগরতলায় গিয়া থিতু হইয়া বসিয়াছে। ননী রাজদিয়ায় থাকুক, ছেলেরা চাহিত না। ননীও দেশ ছাড়িবে না। কিন্তু তাহার বয়স হইয়াছে। শরীরে ভাঙন ধরিয়াছে। এই অবস্থায় স্ত্রী-পুত্র পরিবার ছাড়িয়া পাকিস্তানে একা একা পড়িয়া থাকা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিতেছিল। শেষ পর্যন্ত ননীর ছেলেরা আসিয়া এক প্রকার জোর করিয়া তাহাকে আগরতলায় লইয়া গিয়াছে।

অশ্বিনী ডাক্তার আর ননী কবিরাজ ভারতে চলিয়া যাইবার পর রাজদিয়ার লোকজন চিকিৎসার ব্যাপারে ভীষণ সংকটে পড়িয়া গিয়াছে। নৌকা পাঠাইয়া পনেরো মাইল দূরের কমলাপুর হইতে উমাপতি ডাক্তারকে আনাইয়া তোমার দুই দিদার চিকিৎসা করাইতে হইয়াছে।

এদিকে রাজদিয়া এবং তাহার চারিপাশের গ্রামগুলির অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটিবার লক্ষণ নাই। রাজাকার এবং লিগের লোকেরা সমানে দাপাইয়া বেড়াইতেছে। ফলে চোদ্দ পুরুষের ভিটামাটি ফেলিয়া দেশত্যাগের ঘটনা আরও বাড়িয়া গিয়াছে।

তোমাকে আগের চিঠিতে জানাইয়াছিলাম কিনা স্মরণে নাই। ইদানীং কিছুদিন যাবৎ দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার জন্য বেনামি পত্ৰ পাইতেছি। আমি গ্রাহ্য করি না। তবে মন ভীষণ খারাপ হইয়া গিয়াছে। পূর্ববঙ্গের এই ছোট শহরে কতকাল পুরুষানুক্রমে আমরা বাস করিয়া আসিতেছি। ইহা আমার জন্মভূমি। আমি সজ্ঞানে সারা জীবনে কোনও অপরাধ করি নাই। বরং মানুষের উপকার করিবারই চেষ্টা করিয়াছি। তবে কেন আমাকে আপন দেশ হইতে চলিয়া যাইতে হইবে? কায়েদে আজম জিন্না বলিয়াছিলেন, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানির অধিকার সমান। তাহারা নিরাপদে, নির্বিঘ্নে এই দেশে বসবাস করিতে পারিবে। তাহাদের জীবন, তাহাদের ধনসম্পত্তি সমস্ত কিছুই এখানে সুরক্ষিত। কিন্তু যত দিন যাইতেছে তাহার উলটাটাই চোখে পড়িতেছে। স্বাধীনতার কারণে হাজার হাজার মানুষ যে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করিয়াছে, ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়াছে তাহা কি দেশভাগের জন্য? তাহা কি পিতৃপুরুষের ভিটা হইতে উৎখাত হইয়া স্ত্রী-ছেলেমেয়ের হাত ধরিয়া চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ভাসিয়া পড়িবার জন্য?

ইতিমধ্যে দুইটি ঘটনা ঘটিয়াছে যাহা আমার মনোবল অনেকখানি ভাঙিয়া দিয়াছে।

প্রথম ঘটনাটি এই প্রকার। তুমি গিরিগঞ্জের আসাদুল মিয়াকে নিশ্চয়ই চেন। আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসিত। আমাকে নিজের বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করিত।

আসাদুল বড় ধানী গৃহস্থ। প্রায় দেড় শ কানি জমির মালিক। গিরিগঞ্জের বাজারে নদীর ধার ঘেঁষিয়া তাহার ধান এবং পাটের বড় বড় আড়ত। ভূসম্পত্তি ছাড়াও তাহার পঞ্চাশখানা নানা ধরনের নৌকাও আছে–এক মাল্লাই, দোমাল্লাই, চারমাল্লাই, কোষ আর এক শ মণী দুই শমণী ভড়।

সেই আসাদুল গত সপ্তাহে আমাদের বাড়ি আসিয়া হাজির। এমনিতে খুব ভদ্র এবং বিনয়ী। সে আমাকে আগের মতোই প্রণাম করিল। তারপর মিঠাই খাইতে খাইতে একথা সে-কথার পর সসংকোচে বলিল, একহান কথা কমু যদিন কিছু মনে না করেন বড়ভাই।

বিনু, তোমার কি মনে আছে, আসাদুল আমাকে বড়ভাই বলিয়া ডাকে? তাহার হাবভাব এবং ভণিতা লক্ষ করিয়া আমি ভিতরে ভিতরে সতর্ক হইলাম। নিশ্চয়ই কোনও গূঢ় উদ্দেশ্য লইয়া সে আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে। আমার মনোভাব তাহাকে বুঝিতে না দিয়া বলিলাম, মনে করব কেন? যা বলবি বল

কিছুক্ষণ ইতস্তত করিয়া আসাদুল বলিল, দ্যাশের গতিক নিজের চৌখেই দ্যাখতে আছেন। দিনকে দিন খারাপের দিকে যাইতে আছে। ভালা যে হইব তার কুনো লক্ষণ নাই। আমি একহান মোন্দ খবর পাইছি

কী খবর রে?

কিছু শয়তান লোক তলে তলে আপনের বিষয় সোম্পত্তি দখল করনের লেইগা মতলব করতে আছে।

আসাদুলের কথা শুনিয়া চমকাইয়া উঠিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, তুই জানলি কী করে?

আসাদুল জানাইল, শুনাশুন কানে আইছে।

এই লোকগুলো কারা?

মাপ করেন, হেইটা আমি কইতে পারুম না বড়ভাই।

কী করে দখল করবে? আমি তো এখনও দেশেই আছি। তা হলে কি আমাকে মেরে ধরে কেড়ে নেবে, নাকি খুন করবে?

জানো বিনু, আমার প্রশ্নটার উত্তর না দিয়া আসাদুল বলিল, এক কাম করেন বড়ভাই, আপনের জমিন বাঁচাইতে হইলে আমারে দিয়া দ্যান। এমুনভাবে লিখাপড়ি হইব যে চাষ এবং দেখাশুনার লেইগা আমারে দিতে আছেন। চাষের বেবাক খরচপাতি আমার। আপনে ফসলের আধাআধি ভাগ পাইবেন।

বিনু, বুঝিতে পারিলাম, এতদিন যে হুমকি দেওয়া চিঠি পাইয়াছি সেগুলি আসাদুলই পাঠাইয়াছে। তাহা ছাড়া কেউ আমাকে খুন করিয়া জমিজমা কাড়িয়া লইতে চায় না। কাল্পনিক হত্যাকারীর ভয় দেখাইয়া আসাদুলই কৌশলে উহা গ্রাস করিতে চায়। একবার লিখিয়া পড়িয়া চাষের অনুমতি দিলে আসাদুলকে ইহজন্মে আর হটানো যাইবে না। সে জানে, তোমরা কেউ আর রাজদিয়ায় ফিরিয়া আসিবে না। আমি বৃদ্ধ হইয়াছি। আমার মৃত্যুর পর আমাদের জমির উপর তাহার স্বত্ব পুরাপুরি কায়েম হইবে। আসাদুল অবশ্য বলিয়াছে, এখনই লেখাপড়া করিতে হইবে না। এই বিষয়ে চিন্তা করিবার জন্য সে আমাকে তিন-চার মাস সময় দিয়াছে।

এই সেদিন পাকিস্তানের জন্ম হইল। ইহারই মধ্যে মানুষ কত বদলাইয়া গিয়াছে। কেউ গায়ের জোরে অসহায় মানুষের বিষয় আশয় ছিনাইয়া লইতেছে। আবার আসাদুলের মতো কেউ ফন্দি আঁটিয়া কাজ শুছাইয়া লইতেছে।

সেই যে আসাদুল আসিয়াছিল, তারপর তাহার সম্বন্ধে অনেক কথাই কানে আসিতেছে। ভালমানুষ সাজিয়া সে আমাকে যা প্রস্তাব দিয়াছিল, ঠিক সেই উপায়েই রাজদিয়ার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির অনেকেরই জমি মুঠায় পুরিয়াছে। এই লোকটিকে তাহার বাল্যকাল হইতে দেখিয়া আসিতেছি। যে-আসাদুলকে চিনিতাম, সে আর তেমনটি নাই। এখন সে কূট, চতুর, অতীব ধুরন্ধর। মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণা দ্রুত পালটাইয়া যাইতেছে।

বিনু, এবার তোমাকে দ্বিতীয় ঘটনাটির কথা জানাইতেছি। ইহা আরও মারাত্মক।

রাজদিয়ার দক্ষিণ দিকে সোনাখালি গ্রামের ধনা আর মনা বারুই-এর কথা মনে আছে কি? এই দুই ভাই সুজনগঞ্জের হাটে গিয়া পান বেচিত। হতদরিদ্র, সাদাসিধা মানুষ। ধনারা সম্প্রতি ভয়ে কিংবা চাপে মুসলমান হইয়াছে। খবরটা শুনিবার পর তোমাদের প্রাক্তন হেড মাস্টার মোতাহার হোসেন তাহার কয়েকজন পুরানো ছাত্রকে সঙ্গে লইয়া এই ঘটনার প্রতিবাদ করিতে সোনাখালি গিয়াছিল। মোতাহার মনে করে, মানুষ যদি স্বেচ্ছায় পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করিয়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, কিছু বলিবার নাই। কিন্তু ত্রাস বা জুলুমের কারণে করিলে তাহা কোনওভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।

সোনাখালি গিয়া মোতাহারেরা রাজাকার আর পশ্চিমাদের হাতে প্রচণ্ড মার খাইয়া আসিয়াছে। মোতাহারের মুখ মাথা ফাটিয়া গিয়াছে। একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। হাঁটু এবং ডান হাতের হাড় ভাঙিয়াছে। হাতে-পায়ে প্লাস্টার আর মুখে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় বর্তমানে সে শয্যাশায়ী। রোজই তাহাকে দেখিতে যাই। শারীরিক আঘাত সে যতটা পাইয়াছে, তাহার সহস্র গুণ আঘাত পাইয়াছে মানসিক দিক হইতে। ইদানীং সর্বক্ষণ মোতাহার মুহ্যমান হইয়া থাকে।

এদিকে তোমার দুই দিদা চারিদিকের হাল দেখিয়া অস্থির হইয়া উঠিয়াছে। তাহারা আর দেশে থাকিতে চাহিতেছে না। স্বীকার করিতে দ্বিধা নাই, আমার আত্মবিশ্বাস কিছুটা হইলেও টলিয়া গিয়াছে।

তোমাকে আগের পত্রে জানাইয়াছিলাম, বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হইয়াছে। সেই আন্দোলন দ্রুত নানা জিলা এবং মহকুমার শহরে শহরে ছড়াইয়া পড়িতেছে। এমনকি আমাদের এই ক্ষুদ্র রাজদিয়ায়ও বাদ যায় নাই।

তোমাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা জানাইয়াছিলাম। আমার এখনও আশা, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতেই কাল হউক, পরশু হউক, কী দুই-দশ বছর পরেই হউক, ইহার উদ্ভব ঘটিবে।

একদিকে গভীর অন্ধকার, অন্যদিকে কিঞ্চিৎ আলোর রেখা। ইহার মধ্যিখানে দাঁড়াইয়া কোনও প্রকার সিদ্ধান্ত লইতে পারিতেছি না। নৈরাশ্য যখন প্রবলভাবে গ্রাস করে তখন ভাবি, ইন্ডিয়ায় চলিয়া যাইব। পরক্ষণে চিন্তা করি, ভাষা আন্দোলনের হাত ধরিয়া সুদিন আসিবার ক্ষীণ একটু সম্ভাবনা তো দেখা দিয়াছে। তবে কেন পলাইয়া যাইব? মনের এক বিভ্রান্ত অবস্থায় দিন কাটাইতেছি। জন্মভূমি হইতে শিকড় উপড়াইয়া লইয়া অন্য দেশে চলিয়া যাওয়া কি সহজ কাজ? যাওয়ার কথা মনে হইলেই বত্রিশ নাড়িতে টান পড়ে।

আমি আর কিছুদিন অপেক্ষা করিয়া দেখিতে চাই। তারপর সকলের পরামর্শ লইয়া যাহা সঙ্গ ত মনে হয় তাহাই করিব। জয়নাল বলিয়াছে, সে সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া উঠিয়াছে। এখন নিয়মিত আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিতে পারিবে। ভরসা দিয়াছে, তুমি পত্র লিখিলে এক সপ্তাহের মধ্যে আমার জবাব তোমার কাছে পৌঁছাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিবে। আমি লিখিলে ওই সময়ের মধ্যেই তোমার উত্তর রাজদিয়ায় লইয়া আসিবে।

আশা করি, কুশলে আছ। তোমরা আমাদের আশীর্বাদ লইও। ইতি–দাদু।

চিঠি পড়া শেষ হলে সারা ঘর জুড়ে অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে আসে।

একসময় হতাশার সুরে দ্বারিক দত্ত বলে ওঠেন, পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ! টু নেশন থিওরির ওপর দেশটা ভাগ হল, তা কি হেমের মাথায় নেই! ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, সারাক্ষণ ওর খালি বাঙালি আর বাঙালি। যেন স্বপ্নের ঘোরে থাকে। আরে বাপু, লিয়াকত আলিরা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে, এখন আর বাঙালি টাঙালি না। স্রেফ হিন্দু আর মুসলমান। একটু থেমে ফের বললেন, এত বয়েস হয়েছে, পাকিস্তানে মহাবিপদের মধ্যে রয়েছে, তবু বাস্তববোধটা হল না হেমের।

দ্বারিক দত্তর কথাগুলো খানিক বুঝল নিত্য দাস। বেশিটাই মাথায় ঢুকল না। তবে বাস্তববোধ শব্দটা বেশ মনে ধরেছে। সে আক্ষেপ করতে থাকে, ঠিকই কইছেন। হ্যামকায় এমুন পণ্ডিত মানুষ, কত লিখাপড়া করছেন কিন্তুক আসল বুদ্ধিসুদ্ধিই নাই। কই শাজাহান সাহেবের অত ভালা জমিন আর বাড়িঘরের লগে নিজেগো সোম্পত্তি এঞ্জে কইরা চইলা আইবেন, ইন্ডিয়ায় আইয়া শান্তি মতো থাকবেন, তা না। মাটি কামড়াইয়া পইড়া রইলেন পাকিস্থানে! এমুন সোনার সুযুগ কেও ছাড়ে।

দ্বারিক দত্ত সায় দিলেন, হেমের মতিগতি কিছুই বুঝি না। বদ্ধ পাগল না হলে কেউ এখন। পাকিস্তানে পড়ে থাকে! আরে বাপু, তোমার নাতি-নাতনি, আত্মীয়-বন্ধু সব এপারে চলে এসেছে। শেষ জীবনটা তাদের কাছে আনন্দ করে কাটাও। প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করে আসবে। তোমাকে তো কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না।

একটু চুপচাপ।

তারপর দ্বারিক দত্ত আবার শুরু করলেন। বিনয়কে বললেন, একটা কথা ভেবে দেখেছিস?

হেমনাথ সম্পর্কে আগে থেকেই প্রবল দুশ্চিন্তায় ছিল বিনয়। চিঠিটা পড়ার পর সেটা সহস্র গুণ বেড়ে গেছে। দ্বারিক দত্তর দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, কী ভাবব?

হেমনাথের হঠাৎ যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়, বউঠাকরুন আর শিবানীর কী হবে? কে তাদের দেখবে?

কী ইঙ্গিত দিলেন দ্বারিক দত্ত? জমি চাষের অধিকার চেয়েছে আসাদুল। খুবই বিনীতভাবে, সম্ভ্রমের সুরে। কিন্তু তিন-চার মাস বাদে হেমনাথ যখন তাকে ফিরিয়ে দেবেন, কোনও মতেই ভাগচাষে রাজি হবেন না, তখন কী মূর্তি ধারণ করবে আসাদুল মিয়া? জনবল, অর্থবল তার বিপুল। পাকিস্তানের আবহাওয়া যখন বিষবাষ্পে-ভরা, রাতের অন্ধকারে লহমায় অঘটন ঘটে যেতে পারে। হঠাৎ হেমনাথের। অপমৃত্যু হলে একটা প্রাচীন মহাবৃক্ষের পতন ঘটবে। তার প্রতিক্রিয়া হবে নানাদিক থেকে। রাজদিয়া এবং তার চারপাশের বিশ তিরিশটা গ্রামের হতদরিদ্র সব মানুষ–হিন্দু আর মুসলমান–যাদের সুখে দুঃখে আজীবন তিনি জড়িয়ে আছেন, যাদের বিপদের দিনে, সংকটের মুহূর্তে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তারা শোকে একেবারে ভেঙে পড়বে। হেমনাথের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ওই অঞ্চল জুড়ে হা-হুতাশ চলবে দীর্ঘকাল। তা ছাড়া যে হিন্দুরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে এখনও ওখানে পড়ে আছে, তারা আর এক দণ্ডও থাকবে না। ভিটেমাটি ফেলে বউ ছেলেমেয়ের হাত ধরে তারপাশা কি মুন্সিগঞ্জে গিয়ে গোয়ালন্দের স্টিমার ধরবে। গোয়ালন্দ থেকে রিফিউজি স্পেশাল-এ সোজা কলকাতায়। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক ক্ষতি হবে শিবানী আর স্নেহলতার। নির্বান্ধব রাজদিয়ায় তাদের বাকি জীবন কাটবে কীভাবে?

হঠাৎ বিনয়ের মাথায় দুশ্চিন্তার বদলে তীব্র ক্ষোভ আর রাগ জমা হতে থাকে। হেমনাথকে মনে হয় চরম অপরিণামদর্শী। এত বয়স হল, এক জীবনে কত কিছু দেখলেন–বহুকাল আগের সেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রথম এবং দ্বিতীয় দুই মহাযুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশভাগ, পূর্ববাংলা ছেড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ইন্ডিয়ায় চলে আসা–তবু আকাশকুসুম অলীক এক স্বপ্নের ঘোরেই রয়েছেন। সেই স্বপ্নটিকে লালন করা ছাড়া অন্য কোনও দিকে তার নজর নেই।

নিত্য দাস বলে উঠল, শাজাহান সাহেবের লগে পরশু দেখা হইছিল। জবর তাগিদ দিতে আছেন। অন্য গাহেক তেনারে ছাইকা ধরছে। আমি তেনার হাতে-পায়ে ধইরা চৈদ্দ পনরো দিন সোময় চাইয়া লইছি। এই শ্যাষ। এইর মইদ্যে যদিন হ্যামকত্তা কিছু না করেন, শাজাহান সাহেব অন্যের লগে সোম্পত্তি এচ্চেঞ্জ কইরা পাকিস্থানে চইলা যাইবেন। এত বড় গাহেক আমার হাতে আর এউইক্কাও (একটাও) নাই। তেনি এইবার ছুঁইটা গালে হাত কামড়ান ছাড়া কিছু করনের থাকব না।

দ্বারিক দত্ত জোরে জোরে মাথা নাড়েন, ঠিকই বলেছিস।

নিত্য দাস বলে, এমুন গাও-এলাইনা (গা-এলানো) ভাব করলে চলে! পাকিস্থানে দিনকে দিন। অবোস্থা খারাপের থিকাও খারাপ হইয়া যাইতে আছে। শুনাশুন কানে আইছে, যে কুনোদিন এচ্চেঞ্জ বন্ধ হইয়া যাইব।

সুধা অসীম উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে ছিল। বলল, এখন উপায়?

নিত্য দাস বলল, উপায় একহানই। (একখানাই)। আপনেরা কেও একজন পাকিস্থানে গিয়া জোর কইরা হ্যামকস্তারে রাজি করান। সুস্সু মখি (সামনা সামনি) বইয়া কথা কইলে আমার মনে লয় কাম হইব।

কিন্তু এই মুহূর্তে কে যাবে পাকিস্তানে? সুধারা চুলচেরা আলোচনা করে দেখল, হিরণের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। বাকি থাকে দুজন। আনন্দ আর বিনয়। আনন্দ মাত্র দুবারই রাজদিয়ায় গেছে। পথঘাট, লোকজন কারওকেই চেনে না। যখন সে গিয়েছিল তখন দিনকাল ছিল একরকম। এখন আমূল সমস্ত কিছু পালটে গেছে। এই প্রচণ্ড দুঃসময়ে জলেস্থলে যখন ঘাতকবাহিনী শিকারের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আনন্দ ঝুঁকি নিয়ে যাবে না। হেমনলিনীও তাকে কোনওভাবেই যেতে দেবেন না। বাকি থাকে বিনয়। তার নতুন চাকরি। তাদের কাগজ নূতন ভারত বেরুবার মুখে। এ অবস্থায় সেও যেতে পারবে না।

সব শোনার পর নিত্য দাস বলল, আপনেরা যা কইলেন, বেবাক ঠিক। কেও যাইতে পারলে ভালা অইত। তা যহন সোম্ভব না তহন এক কাম করেন।

কী কাজ? সবাই উন্মুখ হল।

আপনেরা হলে (সকলে), একহান কইরা চিঠি ল্যাখেন। ছোটবাবু, সুধা বইন, সুনীতি বইন, দুই জামাইবাবু, দ্বারিককত্তা–কেও য্যান বাদ না যায়। এমুনভাবে জোর দিয়া ল্যাখবেন যাতে হ্যামকত্তার হুশ হয়। দ্যাশ দ্যাশ কইরা এতকাল তো নাচানাচি করলেন। কী পাইলেন শ্যাষ তরি (অবধি)! পাকিস্থানে আর কিছুদিন থাকলে পরানে বাঁচতে অইব না। পত্রগুলি লিখা অইলে এক লগে খামে ভইরা রাইখেন। আমি দিন দুই পরে আইয়া লইয়া যামু ।

নিত্য দাস লেখাপড়া খুব একটা শেখেনি। তবে তার জাগতিক বুদ্ধি খুবই তীক্ষ্ণ। তার যুক্তিতে ধার আছে। বিনয় একা চিঠি লিখলে যতটা কাজ হবে, একসঙ্গে সবাই মিলে লিখলে তার বহুগুণ। ফল পাওয়া যাবে। এতজনের সমবেত চাপে হেমনাথ অটল থাকতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত সম্পত্তি বিনিময়ে রাজি হয়ে যাবেন।

দ্বারিক দত্ত বললেন, খুব ভাল বলেছিস নিত্য। আমরা সবাই লিখব।

নিত্য দাস আর বসল না। সে যখন উঠে পড়েছে, হঠাৎ অধর ভুইমালীর কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। সে ব্যস্তভাবে নিত্যকে বলল, দাস মশাই, একজন রিফিউজি তার পাকিস্তানের সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করতে চায়। দেশ থেকে আসার সময় বুদ্ধি করে দলিলপত্র নিয়ে এসেছে। আপনি কি তাকে সাহায্য করতে পারবেন?

নিত্য দাসের চোখেমুখে ঝিলিক খেলে যায়। ব্যগ্র স্বরে সে বলে, নিয্যস (নিশ্চয়ই) পারুম। এই কইরা কইরা হাড়ি পাকাইয়া ফালাইতে আছি। কই থাকে লোকটা? তেনির নাম-ঠিকানা দ্যান

অধর ভুইমালীর নামটা জানিয়ে দিল বিনয়। তারপর সে যেখানে থাকে সেই সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পশ্লিতে কীভাবে যেতে হবে, বিশদভাবে বুঝিয়ে দিল।

নিত্য দাস বলল, কাইল বিহানে (সকালে) গিয়াই অধর ভুইমালীর লগে দেখা করুম। মাস খানেকও লাগব না, তেনিরে কইলকাতার ধারে কাছে জমিজিরাতের ভালা বোন্দবস্ত কইরা দিমু একটু থেমে আক্ষেপের সুরে বলে, এইরকম বুদ্ধি যদিন হ্যামকার থাকত!

নিত্য দাস যখন গেল, প্রায় বারোটা বাজে। অফিসের সময় হয়ে এসেছে। বিনয় স্নান করে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ল।

৪৪.

কাল সকালে দিবাকর পালিতের সঙ্গে দেখা করতে থানায় গিয়েছিল বিনয়। তাই কোনও রিফিউজি কলোনি বা ক্যাম্পে যাওয়া হয়নি। আজও গেল না। ঝিনুকের চিন্তাটা তাকে এমনই উতলা করে রেখেছে যে সকালে উঠেই চা আর জলখাবার খেয়ে সে মুকুন্দপুরে ছুটল। সুধাকে বলল, দুপুরে খেতে আসবে না। অফিস করে ফিরবে সেই রাত্তিরে।

দিবাকর পালিত কাল বলেছেন, শিয়ালদা মেন লাইনে যত থানা রয়েছে, সব জায়গায় খবর পাঠাবেন। এই বিশাল এলাকার প্রতিটি থানার ওসি যাতে তাদের আওতায় সমস্ত কলোনি আর গ্রামগঞ্জ তোলপাড় করে ঝিনুককে খুঁজে বার করার ব্যবস্থা করেন তা বিশেষভাবে বলে দেবেন।

দিবাকরকে যতটুকু বিনয় দেখেছে, মনে হয়েছে মানুষটি যথেষ্ট আন্তরিক। হৃদয়বান। ঝিনুকের হদিস যে এতকাল পাননি সেজন্য তার সংকোচ আর আক্ষেপের শেষ নেই। লোকদেখানো ব্যাপার নয়। সত্যি সত্যিই ঝিনুকের জন্য তিনি বিচলিত।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রাম, বাস পালটে পালটে শিয়ালদা চলে এল বিনয়। বেশ কয়েকবার যাতায়াতের ফলে এদিকের রাস্তাটাস্তা সড়গড় হয়ে গেছে তার।

স্টেশন চত্বরটা অবিকল আগের মতোই। বরং ওপার থেকে আসা মানুষের ভিড় আরও বেড়েছে। যেদিকেই তাকানো যাক, সারি সারি শীর্ণ, শঙ্কাতুর, মলিন মুখ। জলের কলগুলোর সামনে লম্বা লাইন। লাইন অল্প কটি পায়খানার সামনেও। চারদিকে ধুলো ময়লা আবর্জনার ভঁই। রয়েছে থুতু, দলা দলা কফ, পোড়া বিড়ির অগুনতি টুকরো। এধারে ওধারে কত যে বাচ্চা মুক্ত আকাশের তলায় পায়খানা করছে, পেচ্ছাপে ভাসিয়ে দিচ্ছে। গু, মুত আর পচা জঞ্জালের দুর্গন্ধ এখানকার বাতাসে অনড় হয়ে আছে। যখনই বিনয় শিয়ালদায় আসে এই চিরস্থায়ী কদর্য গন্ধটা নাক দিয়ে ঢুকে ভেতরে যায়। পেটের নাড়িগুলো পাক দিয়ে ওঠে। আজও তাই হল।

নাকে কোঁচার খুট ঠেসে ধরে ভিড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগল বিনয়।

এখানে ভোরে চোখ মেলার সঙ্গে সঙ্গে কারণে অকারণে শুরু হয়ে যায় ঝগড়া। কুৎসিত গালিগালাজ। খিস্তিখেউড়। বেলা যত বাড়তে থাকে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেয়োখেয়ির মাত্রাও চড়ে যায়। সমস্ত দিন হইচই, গলা-ফাটানো চিৎকার, তীব্র উত্তেজনা। রাত্তিরে যতক্ষণ না দু-চোখ জুড়ে আসছে অবিরল হট্টগোলে চতুর্দিক উচ্চকিত হয়ে থাকে। যতক্ষণ শরীরে শেষ এনার্জিটুকু অবশিষ্ট থাকে, সেটা চলতেই থাকে। যতক্ষণ ঘুমোয় সেই সময়টুকুই যা শান্তি।

পরস্পর কামড়াকামড়ি চুলোচুলি করে মনুষ্যজাতির যে অংশটা পাকিস্তানে সর্বস্ব খুইয়ে এসে এই স্টেশনে দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ কী? কী করবে তারা? কোথায় যাবে? এদের মানুষের মতো বেঁচে থাকার ব্যবস্থা কি সরকার করে দেবে? না কি এই চত্বরেই তারা বিলীন হয়ে যাবে?

শিয়ালদা স্টেশনে এলে এইসব চিন্তা নানা অদৃশ্য সুড়ঙ্গ দিয়ে বিনয়ের মাথায় ঢুকে পড়ে। যতবার আসে, তার মন বিষাদে ভরে যায়। সেই রেশ থাকে অনেকক্ষণ। আজও মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্য। তার পুরো ভাবনা জুড়ে রয়েছে ঝিনুক। গাদাগাদি করে পড়ে থাকা এই উদ্বাস্তুদের নিয়ে দুশ্চিন্তাটা উড়ো মেঘের মতো দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।

স্টেশন বিল্ডিংয়ে ঢুকে আগরপাড়ার টিকেট কাটল বিনয়। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। ডাউনের দিকের গাড়িগুলোতে এ-সময় ভিড় থাকে না। প্রায় কঁকা একটা কামরায় উঠে বসে পড়ল সে। কয়েক মিনিট বাদেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

জানালার চৌকো ফ্রেমে বাইরের পরিচিত চলমান সব দৃশ্য বিনয়ের চোখের সামনে দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। ডোবা, খাল, মাঝে মাঝে লোকালয়, কঁকা মাঠ ইত্যাদি। আনমনা তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ খেয়াল হল, আগে না জানিয়ে হঠাৎ চলে এল। যুগলকে রুজি রোজগারের ধান্দায় বেরিয়ে যেতে হয়। বিলের মাছ মেরে বেলঘরিয়ায় বেচতে গেলে তাড়াতাড়িই সে ঘরে ফিরতে পারে। কিন্তু রোজ তো আর জাল কি পলোতে মাছ পড়ে না। তখন সস্তা মালপত্র ফেরি করতে বেয়োয়। এ তো ঘড়ি-ধরা কাজ নয় যে অমুক সময়ে বেরিয়ে অমুক সময়ে চলে এলাম। ফেরি করতে বেরুলে কখন ফিরবে তার ঠিক থাকে না। কলোনিতে গিয়ে যদি যুগলকে পাওয়া না যায়?

বিনয় ভাবল, তাকে দুটোয় অফিসে হাজিরা দিতে হবে। যুগলের সঙ্গে দেখা না হলে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। অগত্যা পাখিকে বলে আসবে, যুগলকে যেন দুচার দিনের ভেতর কলকাতায় সুধাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

আগরপাড়া স্টেশনে নেমে ফসলকাটা, শূন্য মাঠের ভেতর দিয়ে বিনয় যখন মুকুন্দপুর কলোনিতে পৌঁছল, দিনের তাপাঙ্ক অনেকটাই বেড়েছে। যদিও ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া বইছে তবু তপ্ত রোদ শরীরে আরাম ছড়িয়ে দিচ্ছিল। এতটা পথ যে সে হেঁটে এল, একটুও ক্লান্তি লাগছে না।

মুকুন্দপুরে বেশ কয়েকবার এসেছে বিনয়। এখানকার নাড়িনক্ষত্র তার জানা।

কলোনির মাঝখানের লম্বা ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে যুগলদের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিনয়ের চোখে পড়ল, দুপাশের প্রতিটি বাড়িতেই মেয়েরা গেরস্থালির কাজে ভীষণ ব্যস্ত। রান্নাবান্না, ঘর নিকানো, ঝটপাট ইত্যাদি। বেশ কিছু থুড়থুড়ে বুড়োবুড়ি খোলা আকাশের তলায় জলচৌকি কি চটের আসনে বসে সারা শরীরে রোদের তাপ শুষে নিচ্ছে। এধারে ওধারে থোকায় থোকায় কিছু সদ্যযুবতী আর কিশোরকিশোরী কলকল করে সমানে গল্প করছে।

বিনয় যখনই মুকুন্দপুরে আসে, চোখে পড়ে কলোনির বাচ্চাগুলো খোলা জায়গাটায় হুল্লোড় করছে। কিন্তু আজ তাদের একজনেরও দেখা নেই। একটু অবাক হল সে। চকিতের জন্য মনে হল কোথায় যেতে পারে তারা?

যুগলদের বাড়ির কাছাকাছি যখন এসে পড়েছে, সেইসময় কোনও মেয়েমানুষের উঁচু গলা কানে এল, ছুটোবাবু না?

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিনয়। বাঁদিকের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে যুগলের পিসতুতো বোন টুনি। চোখেমুখে অপার বিস্ময়।

টুনি বলল, আপনে যে আইজ আইবেন, যুগল তো আমাগো কয় নাই!

বিনয় বলে, আমি হঠাৎ চলে এসেছি। যুগলকে আগে কিছু জানাইনি। জিজ্ঞেস করে, যুগল কি বাড়িতে আছে?

আছে। হ্যায় আইজ কামে বাইরায় নাই।

যাক, সারা রাস্তা যে চিন্তাটা বিনয়ের মাথায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল সেটা এখন উধাও। যুগলের সঙ্গে দেখা হচ্ছেই।

এদিকে টুনি আনন্দে, উত্তেজনায় কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমনিতে নিচু গলায় সে কথা বলতে পারে না। এই মুহূর্তে কণ্ঠস্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে কলোনির লোকজনদের ডাকাডাকি করতে লাগল, তরা হগলে দেইখা যা। আমাগো ছুটোবাবু আইছে রে, ছুটোবাবু আইছে–

ঘরের কাজকর্ম ফেলে চারপাশের বাড়িঘর থেকে নানা বয়সের বউ-ঝিরা বেরিয়ে আসে। এই সময়টা শক্তসমর্থ পুরুষরা কলোনিতে থাকে না। ঘরে পড়ে থাকলে পেটের ভাত জুটবে কোত্থেকে? অথর্ব বুড়োবুড়ি, মেয়েমানুষ আর বাচ্চারা ছাড়া অন্য কারওকে এখন পাওয়া যায় না।

রাজদিয়ার হেমকর্তার নাতিকে মুকুন্দপুরবাসীদের ভীষণ পছন্দ। বিন্দুমাত্র অহমিকা বা নাকউঁচু ভাব নেই। বড় বংশের ছেলে কিন্তু সবার সঙ্গে এমনভাবে মেশে যেন সে তাদেরই একজন।

বিনয়কে ঘিরে কলকলানি চলছেই। আপনে আইছেন ছুটোবাবু, কী ভালা যে লাগতে আছে কইয়া বুঝাইতে পারুম না। ইত্যাদি।

এদিকে হইচই শুনে যুগল আর পাখি তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। অন্য সবার মতোই তারাও অবাক। খুশিতে চোখ চিক চিক করছে।

যুগল বলল, আপনে যে আত (হঠাৎ) কুলোনিতে আইবেন, হপনেও ভাবি নাই।

বিনয় বলল, তোমার সঙ্গে দরকারি কথা আছে। তাই আসতে হল।

খুব জরুরি ব্যাপার না থাকলে এভাবে কেউ আসে না। কী একটু ভাবল যুগল। তারপর কলোনির মেয়েদের বলল, তুমরা অহন ঘরে যাও। পরে ছুটোবাবুর লগে কথা কইও বিনয়কে বলল, আহেন–

পাখি আর যুগল বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে তাদের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

কলোনির মেয়েরা বেশ নিরাশ হল। তাদের হয়তো বিনয়ের সঙ্গে একটু আধটু গল্প করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সে সুযোগটা যুগল দিল না। অগত্যা সবাই ধীরে ধীরে যে যার ঘরের দিকে ফিরে যেতে লাগল।

বিনয় সামান্য অস্বস্তি বোধ করে। পরক্ষণে খেয়াল হয়, এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনাবশ্যক কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। যে কারণে মুকুন্দপুর কলোনিতে ছুটে আসা, সেটা সেরেই তাকে কলকাতায় ফিরতে হবে।

সেবার এসে বিলের লাগোয়া যে ঘরটায় বিনয় এক রাত কাটিয়ে গিয়েছিল, যুগল তাকে সেখানে নিয়ে আসে। তক্তপোশে বিছানার ওপর পরিষ্কার একখানা চাদর পরিপাটি করে পাতা। বলল, বহেন ছুটোবাবু, বহেন। পাখিও তাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। তাকে বলল, তরাতরি চা কইরা লইয়া আয়–

পাখি দৌড়ে উঠোনের কোণে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

বিনয়কে বিছানায় বসিয়ে একটা জলচৌকি টেনে এনে পায়ের কাছে বসে পড়ে যুগল।

বিনয় জিজ্ঞেস করল, আজ বাড়ি থেকে বেরোওনি যে?

শরীলে জুইত নাই ছুটোবাবু-যুগল জানায়, টালকি (ঠাণ্ডা) লাইগা জ্বরে পড়ছিলাম। কাইল রাইতে জ্বরটা ছাড়ছে কিন্তুক শরীল জবর কাহিল। কাইক (পা) ফালাইতে কষ্ট হয়। হেই লেইগা ঘরেই আটকা আছি। কাইল থিকা আবার বাইর হমু–

আগে সেভাবে লক্ষ করেনি বিনয়। এবার তার চোখে পড়ল, যুগলের চেহারায় অসুস্থতার ছাপটা খুব স্পষ্ট। ফ্যাকাসে মুখ, চোখ দুটো ঘোলাটে। ভাঙা গালে খাড়া খাড়া দাড়ি। ভীষণ রোগা দেখাচ্ছে। বলল, আরও দু-চার দিন বিশ্রাম নিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বেরিয়ে।

আমাগো লাহান মাইনষের কি বইয়া থাকলে চলে ছুটোবাবু? দিন আনি, দিন খাই। ঘরে জামাইনা : ট্যাকা-পহার (জমানো টাকাপয়সার) পাহাড় নাই যে নিচ্চিন্তে পায়ের উপুর পাও তুইলা থাকুম। জ্বরে পইড়া তিনদিন বাইর অইতে পারি নাই। কতখানি ক্ষতি যে হইয়া গ্যাছে!

কথাটা ষোল আনা ঠিক। বিনয় উত্তর দিল না।

যুগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুধাদের খবর নিতে লাগল।

পাখি পরিষ্কার কাঁচের গেলাসে চা নিয়ে আসে। সঙ্গে প্লেটে সস্তা বেকারির কড়কড়ে এস (বড় হরফের এস-এর মতো দেখতে) বিস্কুট। বিনয় মাঝে মাঝে কলোনিতে আসবে, এই আশায় একজোড়া কাঁচের গেলাস কিনে এনে যত্ন করে রেখে দিয়েছে যুগলরা।

যুগল পাখিকে বলে, ছুটোবাবু খাইয়া যাইব। রান্ধন বহাইয়া দে। ঘরে মাছ নি আছে?

মুখখানা মলিন হয়ে যায় পাখির। বিব্রত ভাবে সে মাথা নাড়ে, নাই

প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় যুগল। মাছ ছাড়া কেওরে কি ভাত দ্যাওন (দেওয়া) যায়! যাই বিলে গিয়া জালের খ্যাও (খেপ) দিয়া দেহি কী মিলে—

ঘরের কোণে একটা ঝাঁকি-জাল টাঙানো রয়েছে। যুগল সেদিকে পা বাড়াতে যাবে, বিনয় তাকে থামিয়ে দেয়। বলে, না না, এখন তোমাদের ব্যস্ত হতে হবে না। আমি খেয়ে এসেছি। ডাহা মিথ্যেই বলল সে। এছাড়া যুগলকে ঠেকানোর অন্য কোনও উপায় নেই।

স্থির চোখে কিছুক্ষণ বিনয়কে লক্ষ করে যুগল। তারপর বলে, সাচা (সত্যি) নি কন ছুটোবাবু? দুগা মাছ-ভাত কইরা দিতে পাখির কিন্তুক কুনো কষ্ট হইব না।

মিথ্যে বলার অভ্যাস নেই বিনয়ের। অস্বস্তি বোধ করলেও মুখচোখ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে সে বলল, বিশ্বাস কর, সত্যি বলছি।

যুগল বিশ্বাস করল। সে জানে, বিনয়ের মুখ থেকে কখনও মিথ্যে বেরোয় না। তবে তার ছুটোবাবুকে না খাওয়াতে পারার জন্য দুঃখ থেকেই গেল। বলল, এই দুফার বেইলে বেলায়) দুই গরাস ভাত খাইয়া না গ্যালে।

বিনয় বলল, আর-এক দিন এসে খাব–

একটু নীরবতা।

তারপর যুগল গলা নামিয়ে বিমর্ষ মুখে শুধোয়, ঝিনুক বইনের কুনো খবর বাতরা (বার্তা) নি পাইলেন?

বিনয় বলল, সামান্য একটা খবর পেয়েছি। সেই জন্যেই আজ তোমার কাছে আসা। জানি না কোনও কাজ হবে কি না

যুগলের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। নিষ্প্রভ চোখ দুটো ঝলকে ওঠে। সে প্রায় চেঁচিয়ে বলে, চেঁচিয়ে কী খবর পাইছেন কন ছুটোবাবু, কন- তার স্বর তীব্র উত্তেজনায় কাঁপছে।

অধর ভুঁইমালীর সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে থানায় গিয়ে দিবাকর পালিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা অবধি সব জানিয়ে বিনয় বলে, পুলিশ এই লাইনের কলোনি আর ক্যাম্প ট্যাম্পগুলোতে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। ওরা ওদের মতো খুঁজুক। তুমি তো এদিকের ট্রেনে যাতায়াত কর। লক্ষ রেখো যদি ঝিনুককে দেখতে পাও। আর কলোনির লোকজনদেরও বলে দিও তারাও যেন নজর রাখে–

যুগল বলে, না, কুলোনির কেওরে অহন জানামু না। ঝিনুক বইন যে নিখোঁজ হইয়া গ্যাছে হেইটা এহানকার কেও জানে না। হগলের মন তত এক না। বেশির ভাগই ভালা। দুই চাইর জন । কুচুইটা (কুচুটে) আছে। আবডালে এ নিয়া গুজগুজানি করতে থাকব। যা করনের আমিই করুম। টেরেনে নজর তো রাখুমই, আশপাশের ইস্টিশানের ধারে ধারে যেই হগল কুলোনি বইছে, হেই হেই জাগাতেও যামু-বলতে বলতে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায় তার, আরে আরে, মাস দ্যাড়েক হইল আগরপারা ইস্টিশানের উই ধারে একহান নয়া কুলোনি বইছে। লন যাই ছুটোবাবু, অহনই বাইর হইয়া পড়ি। মা কালী যদিন মুখ তুইলা চায়, হেইহানে ঝিনুক বইনেরে পাইয়াও যাইতে পারি।

বিনয় অবাক। সংকোচের সুরে বলল, সবে তোমার জ্বর ছেড়েছে। শরীর দুর্বল। এই অবস্থায়

যুগল ততক্ষণে দরজার কাছাকাছি চলে গেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, এই হগল কাম ফালাইয়া রাখতে নাই। আপনে এটু বহেন, আমি জামা কাপর বদলাইয়া আইতে আছি। সে ডানপাশের ঘরে চলে যায়।

কিছুক্ষণ বাদে দুজনে বেরিয়ে পড়ে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে যুগলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে যায় বিনয়ের। সেই কত বছর আগে হেমনাথের বাড়িতে কামলা খাটত। তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিল। এতকাল বাদে কোথায় হেমনাথ পড়ে আছেন, আর সীমান্ত পেরিয়ে ভাসতে ভাসতে কোথায় এসে সে ঠেকেছে, তবু হেমনাথের তো বটেই, তার নাতি নাতনি থেকে শুরু করে সকলের ওপর তার কী যে আশ্চর্য টান! বিশেষ করে বিনয়ের ওপর তার অপার মায়া। ঝিনুকের জন্য বিনয়ের যত ব্যাকুলতা, রক্তের সম্পর্কহীন এই নিরক্ষর অনাত্মীয় মানুষটার তার চেয়ে লেশমাত্র কম নেই। লক্ষ পাকে যুগল বিনয়দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

ঝিনুকের চিন্তা মাথায় নিয়ে বিনয় মুকুন্দপুর কলোনিতে ছুটে এসেছিল। অন্য কোনও দিকে খেয়াল ছিল না। আচমকা আশু দত্তকে মনে পড়ে যায়। কিছুদিন আগে যুগল আর সে কলোনির স্কুলের সরকারি গ্রান্টের জন্য কোন এক বড় অফিসারের কাছে দরবার করতে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়েছিল। তারপর ওঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই।

বিনয় জিজ্ঞেস করে, আশু স্যার কি এখানেই আছেন?

যুগল ঘাড় কাত করল, হ। কুলোনিতে তেনার মন বইয়া গ্যাছে। নিশিকান্ত আচায্যিগো একহান বাড়তি ঘর আছে। অহন হেহানেই থাকেন। তেনার লেইগা নয়া ঘর তুলতে আছি। পনেরো বিশ দিনের ভিতরে হইয়া যাইব।

তোমাদের স্কুলের কী হল?

কলোনির শেষ প্রান্তে, কিছুদিন আগে যে জায়গাটা ছিল ঘন ঝোপঝাঁপ আর উঁচু উঁচু প্রাচীন সব বৃক্ষে ঢাকা, সেখানে আর জঙ্গলের চিহ্ন নেই। একটাই মাত্র টালির চাল আর কাঁচা বাঁশের বেড়ার লম্বা ঘর উঠেছে। সেটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে যুগল বলল, উই তো আমাগো ইস্কুল। মাস্টর মশয় কুলোনির পোলাপানগো পড়াইতে আছে। হুনতে আছেন কলরবলর?

এখানে পা রাখার পর অন্য কোনও দিকেই কান ছিল না বিনয়ের। ঝিনুকেই আচ্ছন্ন হয়ে ছিল সে। এবার দূর থেকে অগুনতি কচি কচি গলার কলরোল শুনতে পেল। ধারাপাত মুখস্থ করার আওয়াজ, নাকি ক খ গ ঘ? আজ এখানে আসার পর কেন যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে কলোনির খোলা জায়গায় হুটোপাটি করতে দেখা যায়নি, এবার বোঝা গেল।

কলরবমুখর স্কুল-ঘরটার দিকে কয়েক পলক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে বিনয়। কী অদম্য জেদ আশু দত্তর, কী বিপুল উদ্যম, কী অফুরান সৃজনীশক্তি। ষাট পেরিয়েছেন কবেই। এই বয়সে বিলের ধারে বিজন বনভূমির গায়ে উদ্বাস্তুদের কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে গড়ে তুলেছেন আশ্চর্য এক পাঠশালা। যাঁর প্রতাপে একদা রাজদিয়া হাইস্কুল তটস্থ থাকত সর্বক্ষণ, আয়ুর শেষ প্রান্তে পৌঁছে তিনি ফেলে-আসা জীবনটাকে নতুন করে শুরু করেছেন।

যুগল বলে ওঠে, অ্যাদূর যহন আইছেন, মাস্টর মশয়ের লগে দেখা কইরা যাইবেন?

বিনয় বলল, না, আজ আর সময় হবে না। তুমি আশু স্যারকে বলে দিও, পরে যেদিন আসব তার সঙ্গে দেখা করব। চল মুখ ফিরিয়ে সে হাঁটতে শুরু করল।

মনের ভাবগতিক বুঝে ওঠা ভার। কখন কোন পথে সেটা যে ধেয়ে যাবে আগে থেকে তার হদিস মেলে না। বিনয় ছুটে এসেছিল ঝিনুকের জন্য। এখন তার সমস্ত ভাবনা জুড়ে শুধু আশু দত্ত। আর কী আশ্চর্য, আশু দত্তর কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আর-একজন প্রাক্তন মাস্টার মশাইয়ের মুখ-জামতলির রামরতন গাঙ্গুলি। বিক্রমপুরের দুই এলাকায় দুজনে তো একই কাজ করেছেন। অশিক্ষার কুশিক্ষার ক্লেদে হাজার বছর ডুবে-থাকা গ্রামগুলোতে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়া। সীমান্তের এপারে এসে সেটা নতুন করে শুরু করতে পেরেছেন আশু দত্ত। কিন্তু রামরতন তো ইণ্ডিয়ায় পৌঁছতেই পারলেন না।

রামরতনের কথা মনে হলেই ছায়া-মায়ারা হুড়মুড় করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। সব যেন অদৃশ্য কোনও সুতোয় বাঁধা।

রামরতনের স্ত্রী বড় আশা করে আছেন, বিনয় তার দুই মেয়ের চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। করা হয়নি। ভেবেছিল সুধা-সুনীতিদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাঙ্ক থেকে তার ভাগের টাকাটা তুলে রামরতনের স্ত্রীকে দিয়ে আসবে। দেওয়া হয়নি। অধর ভূঁইমালী ঝিনুকের খবরটা দেবার পর সব সংকল্প ভুলে গিয়েছিল।

রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের ব্যাপারে ক্রমশ নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাচ্ছে বিনয়। অপরাধবোধের মধ্যেই আলোর একটা সংকেত আচমকা মাথায় ঝলকে ওঠে। টাকা হাতে পেলে রামরতনের পরিবারকে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে। আগলে রাখার মতো কোনও পুরুষ অভিভাবক নেই। এদিকে ঘাড়ের ওপর দুই পূর্ণ যুবতী মেয়ে। কলকাতা শহর তো স্বর্গরাজ্য নয়। বদমাশ লম্পট এবং মেয়ের দালালে থিক থিক করছে। বিশেষ করে দেশভাগের পর এদের সংখ্যা কত গুণ যে বেড়ে গেছে! ছায়া-মায়ার মতো সরল নিষ্পাপ দুই তরুণী কখন যে কার পাল্লায় পড়বে, ভুজুং ভাজুং দিয়ে কোন নরকের রাস্তায় তারা ওদের পৌঁছে দেবে–এমন বিপদ তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার চেয়ে রামরতনের স্ত্রী যদি মেয়েদের নিয়ে মুকুন্দপুরে এসে থাকেন, দুর্ভাবনার কারণ নেই। এখানে আশু দত্ত আছেন, যুগল আছে, পতিতপাবনেরা আছে। কারও ঘাড়ে এমন মাথা নেই যে এখানে এসে বজ্জাতি করতে পারে। ছায়া-মায়ারা এই কলোনিতে পুরোপুরি নিরাপদ।

বিনয় বলল, আচ্ছা যুগল, তোমাদের কলোনির পুবদিকের জঙ্গল সাফ করে যেখানে স্কুল বসেছে ওখানকার সব জমি কি বিলি হয়ে গেছে?

যুগল বলল, না। ক্যান কন তো?

ওখানে একটা রিফিউজি ফ্যামিলিকে কাঠা চারেক জায়গা দিতে পারবে?

আপনে যহন কইছেন চাইর কাঠা ক্যান, যতনি চাই দিমু।

বিনয় খুশি। বলল, খুব ভাল হল। একটা ফ্যামিলি বেঁচে যাবে।

যুগল জিজ্ঞেস করে, যাগো লেইগা জমিনের কথা কইলেন হেরা কারা?

বিনয় বিশদভাবে এখন কিছু জানাতে চাইল না। শুধু বলল, পরে শুনো

আর কোনও কৌতূহল দেখায় না যুগল।

ছুটোবাবু যখন মুখ ফুটে চেয়েছেন তখন কাদের জন্য এই জমি, তারা মানুষ কেমন, এ নিয়ে লেশমাত্র মাথাব্যথা নেই যুগলের। ছুটোবাবুর ইচ্ছা মানে তার কাছে হুকুম। সেই হুকুম তাকে পালন করতে হবে। পুবদিকের জঙ্গল সাফ করার পর যে জমি বেরিয়েছে তার অনেকটাই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কোথায় কোথায় ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে, মনে মনে তার খোঁজ করতে লাগল সে।

বিনয়ও আর কিছু বলল না। নীরবে মেঠো পথের ওপর দিয়ে হেঁটে চলল। আশু দত্ত, রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েরা দ্রুত ফিকে হতে হতে মিলিয়ে গেল। সমস্ত ভাবনা জুড়ে ফিরে এল ঝিনুক।

৪৫.

আগরপাড়া স্টেশনে এসে লাইন পেরিয়ে পশ্চিম দিকে মিনিট সাতেক হাঁটার পর ডানপাশে একটা গ্রাম পড়ল। ফুটিফাটা জং-ধরা পুরোনো টিন, ভাঙা টালি, কি খড়ের চালের অগুনতি বাড়িঘর গা-জড়াজড়ি করে রয়েছে। দরজা জানালা খোলা, হা হা করছে। লোকজন চোখে পড়ে না। চারপাশ নিঝুম। দেখেই বোঝা যায়, একসময় এগুলো ছিল হতদরিদ্র মানুষদের বাসস্থান।

বিনয় অবাক। পরিত্যক্ত গ্রামটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ওখানে কারওকে দেখছি না তো? সব গেল কোথায়?

এই অঞ্চলটা ভাল করেই জানে যুগল। হাতের তালুর মতো সব তার পরিচিত। বলল, এইটা আছিল মুসলমানগো গেরাম। দ্যাশভাগের পর এহানকার বেবাকটি (সকলে) পাকিস্থানে চইলা গ্যাছে।

চকিতে বিনয়ের মনে পড়ল, ইন্ডিয়া থেকে ওপারে গিয়ে বহু লোক হিন্দুদের ফাঁকা বাড়িঘর দখল করে নিচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা মুসলমানেরা। কিন্তু এখন অবধি সে যেটুকু দেখেছে, পুর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা কোনও মুসলমানের ফাঁকা জমি জায়গায় জোর করে বসে পড়েনি। অবশ্য সে কতটাই বা দেখেছে। পশ্চিমবঙ্গ তো একটুখানি জায়গা নয়। কোথায় কী হচ্ছে, সবটা তার জানা নেই।

জনশূন্য গ্রামটা পেছনে ফেলে আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর নতুন উদ্বাস্তু কলোনিটায় চলে এল বিনয়রা। এখানে মুকুন্দপুরের মতো বিল বা জঙ্গল নেই। আন্দাজ করা যায় এলাকাটা ছিল পোড়ো অনাবাদী ডাঙা + তার খানিকটা চৌরস করে বেশ কিছু ঘর তোলা হয়েছে। টিন, টালি আর কাঁচা বাঁশের একএকটা খাঁচা। আর দশটা জবরদখল কলোনির সঙ্গে কোনও তফাত নেই। সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লির সামনে বাঁশের খুঁটিতে টিনের ফলকে কলোনির নাম লেখা ছিল। এখানে তেমন কিছু নেই। আসতে আসতে যুগল যা বলেছিল তাই। একেবারে নতুন কলোনি। সবে পত্তন হয়েছে। বোধহয় নামকরণ হয়নি।

বিনয়দের দেখে একটা বয়স্ক লোক–পরনে ময়লা ফতুয়া, ময়লা খাটো ধুতি, গালে বড় কালো জডুল-কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এল। বিনয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবু, আপনেরা?

নিজেদের পরিচয় দিয়ে এখানে আসার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দেয় বিনয়। ঝিনুকের নাম, বয়স এবং চেহারার বর্ণনাই শুধু না, অধর ছুঁইমালীর দেখা ঝিনুকের সঙ্গী অজানা আধবুড়ো লোকটার কথাও জানালো। তারপর বলল, এরা কি এই কলোনিতে থাকে?

জডুলওলা বেশ জোর দিয়ে বলল, না বাবু, অ্যামন কেও এহানে নাই। আমরা সবসুদ্ধ চাল্লিশ ঘর রিফুজ। হগলে হগলেরে চিনে। যাগো কথা কইলেন ত্যামন কেও থাকলে ঠিক জানতে পারতাম।

খানিক চিন্তা করে বিনয় জিজ্ঞেস করে, এমনও তো হতে পারে, ওরা এখানে কারও কাছে এসেছিল।

জডুলওলা তক্ষুনি জবাব দিল না। কয়েক পলক চুপ করে থেকে বলল, আপনেরা এটু খাড়ন। আমি বেবাকটিরে ডাইকা আনি– সে কলোনির ভেতর দিকে চলে গেল। মিনিট তিন চারেক বাদে যখন ফিরল, সঙ্গে বড় সড় একটা দঙ্গল। রিফিউজিরা যেমন হয়, এরাও অবিকল তেমনই। শীর্ণ, ক্ষয়াটে চেহারা। ভাঙা গালে পাঁচ সাত দিনের দাড়ি। চুলে বহুকাল তেল পড়ে না। গর্তে বসা চোখের তলায় কালি। সারাক্ষণ ত্রস্ত, সারাক্ষণ উৎকণ্ঠিত।

সামনের দিকে রয়েছে পুরুষেরা। পেছনে খানিক দূরে কিশোরী, যুবতী, নানা বয়সের ঘোমটা-টানা সধবা মেয়েমানুষ আর বাচ্চারা। সবার চোখে অনন্ত কৌতূহল।

বয়স্ক জডুলওলা লোকটা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। তবু বিনয় কলোনির পুরুষগুলোকে আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু সবারই এক উত্তর। ঝিনুকের হদিস কেউ দিতে পারল না। সে হতাশ হয় ঠিকই, তবে মুষড়ে পড়ে না। এর মধ্যেই সে বুঝে নিয়েছে, এত সহজে ঝিনুককে পাওয়া। যাবে না।

একসময় নতুন কলোনির বাসিন্দাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিনয়রা ফিরতে থাকে।

নীরবে হাঁটছিল তারা। বিনয়ের ম্রিয়মাণ মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে যুগলের। খুব নরম গলায় সে বলে, ভাইবেন না ছুটোবাবু, ঝিনুক বইনেরে ঠিক পাওয়া যাইব।

বিনয় কতটা সান্ত্বনা বা ভরসা পেল, কে জানে। সে উত্তর দেয় না।

আগরপাড়া স্টেশনে এসে শিয়ালদার ট্রেন ধরল বিনয় আর যুগল ধীরে ধীরে, ক্লান্ত পা ফেলে মুকুন্দপুরের দিকে হাঁটতে লাগল।

শিয়ালদায় পৌঁছে প্ল্যাটফর্মের থিকথিকে ভিড় ঠেলে ঠেলে বাইরের চত্বরে চলে এল বিনয়। এখানে সারাক্ষণই হট্টগোল। কানে যেন তালা ধরে যায়। এখন এ-সব ভাল লাগছিল না। জোরে জোরে পা ফেলে বাস রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। সামনের সার্কুলার রোড থেকে বাস বা ট্রাম ধরে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ-হ্যারিসন রোডের ক্রসিংয়ে গিয়ে বাকি পথটুকু হেঁটে অফিসে যাবে, এমনটাই ভেবে রেখেছে।

বিশাল চত্বরের সিকিভাগ সবে পেরিয়েছে, হঠাৎ স্টেশনের সমস্ত হইচই ছাপিয়ে স্লোগান ভেসে এল।

আমরা কারা?
বাস্তুহারা।
আমাদের দাবি
মানতে হবে।
কলোনিবাসীদের ক্যাশডোল—
দিতে হবে, দিতে হবে–
ইনকিলাব
জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।

চমকে বাঁদিকে তাকায় বিনয়। শিয়ালদা সাউথ স্টেশন থেকে উদ্বাস্তুদের মিছিল বেরিয়ে আসছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

একটা নয়, পর পর পাঁচটা মিছিল। প্রথম যে মিছিলটা বেরুলো তার সামনে সাদা কাপড়ের বিরাট ফেস্টুন। সেটায় বড় বড় লাল হরফে লেখা ও বাস্তুহারা সংগ্রাম কমিটি। দুটি যুবক ফেস্টুনটা দুধারে ধরে নিয়ে আসছে। তাদের মতো আরও কজন যুবক-যুবতীও আছে। এরা কেউ কেউ ফেস্টুনের আগে আগে হাঁটছে। বাদবাকি মিছিলগুলোর পাশে রয়েছে। সামনের দিকে যারা আছে পালা করে স্লোগানের প্রথম অংশটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে। মিছিলের ছিন্নমূল জনতা স্লোগানের শেষটা গলা মিলিয়ে বলে যাচ্ছে।

যে তরুণ-তরুণীরা মিছিলগুলোকে নিয়ে চলেছে, পোশাকে আশাকে এবং চেহারা দেখে আদৌ মনে হয় না, এরা বাস্তুহারা। চকিতে সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পশ্লির ত্রিদিব সেন আর জয়ন্তী বসুর। কথা মনে পড়ে যায় বিনয়ের। অধর বলেছিল, ওরা পার্টির লোক। কমিনিস। ত্রিদিবদের মতো আজ যারা মিছিলগুলোকে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ে চলেছে তারাও নিশ্চয়ই কোনও পার্টির লোক।

একটার পর একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। প্রতিটি মিছিলের সামনে যারা আছে তাদের একজনের হাতে ছোট একটা ফেস্টুন। তাতে লেখা : দেশবন্ধু পল্লি গড়িয়া বা মহামান্য তিলক কলোনি– যাদবপুর, বা রবীন্দ্রনগর কলোনি–ঢাকুরিয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ যে যে অঞ্চলের কলোনি থেকে তারা আসছে তার নাম টাম জানা গেল। প্রতিটি মিছিলের উদ্বাস্তুদের হাতে রয়েছে অগুনতি প্ল্যাকার্ড। চাটাইয়ের চৌকো চৌকো টুকরো কেটে তার ওপর খবরের কাগজ সেঁটে লাল কালিতে যে-সব স্লোগান এখন দেওয়া হচ্ছে তাই লিখে আনা হয়েছে।

মিছিলগুলো একে একে চলে গেল। আচমকা বিনয়ের মনে হয়, উদ্বাস্তুদের নিয়ে খুব শিগগিরই পশ্চিমবঙ্গে তুমুল আন্দোলন শুরু হবে। অন্যমনস্কর মতো সে স্টেশনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সার্কুলার রোড পেরিয়ে হ্যারিসন রোডে এসে পড়ল। একটু পরেই একটা মোটামুটি ফাঁকা ট্রাম পেয়ে উঠে পড়ল। জানালার ধারে জায়গা পেয়ে সে বসে পড়ে।

সেই মিছিলগুলো হ্যারিসন রোডের একটা ধার ঘেঁষে স্লোগান দিতে দিতে চলেছে। বাস ট্রাম বা অন্য যানবাহন মিছিলের কারণে খুব স্পিড তুলতে না পারলেও ধীরে ধীরে চলতে পারছে।

খুব কৌতূহল হচ্ছিল বিনয়ের। মিছিলগুলোর গন্তব্যস্থল কোথায়? তাদের উদ্দেশ্য কী? ট্রাম মিছিলগুলোর কাছে এসে গিয়েছিল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করল, কোথায় চলেছেন আপনারা?

একজন রাজনৈতিক কর্মী স্লোগান দিতে যাচ্ছিল, মুখ ফিরিয়ে বলল, বিধান রায়ের বাড়ির সামনে, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে।

সেখানে আজ কী আছে?

যুবকটি জবাব দিল না। এখন অত সময় তার নেই। ব্যস্তভাবে স্লোগান দিতে দিতে সে এগিয়ে গেল।

বিনয় যখন অফিসের কাছাকাছি এসে পৌঁছুল শীতের বেলা ঢলে পড়তে শুরু করেছে। ফুটপাথ ধরে জোরে জোরে পা ফেলছিল সে। কিন্তু অফিসে ঢুকবার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। চোখে পড়ল, ডানদিক থেকে এগিয়ে আসছে ঝুমা।

বুকের ভেতর এলোপাতাড়ি হাতুড়ি পেটার আওয়াজ শুনতে পেল বিনয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress