Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » লোহার গরাদের ছায়া || Ashapurna Devi » Page 3

লোহার গরাদের ছায়া || Ashapurna Devi

এতক্ষণকার জনসমুদ্রের ঢেউয়ে যে গ্লানিটা ধুয়ে গেছে মনে হচ্ছিল, সেটা আবার কোথা থেকে এসে চেপে ধরল।

সকালবেলা চান করে আর সাজ করে এ ঘর থেকে চলে গিয়েছিল, আর আসবার অবকাশ হয়নি। চন্দ্রা যখন আলমারি খুলে ধরে বলেছিল, কী পরবে বলো? ধুতি পাঞ্জাবি? বুশ শার্ট ট্রাউজার? তাড়াতাড়ি ঠিক করো।

তখন এই পালঙ্কের একটা কোণে একটু বসেছিল যেন সুনীল আলতো হয়ে।

একটু হেসে বলেছিল, তোমার বরকে যে সাজে সাজাতে চাও সাজাও।

সব কিছুই তো গায়ে বড় হয়ে গেছে বলেই চমকে উঠেছিল চন্দ্রা, এ কী তুমি শেভ করোনি?… সামনেই তো রেখে দিয়েছিলাম নতুন শেভিং সেট। দেখতে পাওনি?

সুনীল গালে একটু হাত ঘষে কুণ্ঠিত হাসি হেসে বলেছিল, দেখেছি। সাহস হল না।

সাহস হল না?

হল না। অনেকদিনের অনভ্যাস তো! মানে নাপিতে কামিয়ে দিত তো?

নাপিতে।

চন্দ্রা একটুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল, সেই একশো লোকের দাড়ি কামানো জঘন্য ক্ষুরে?

সুনীল একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, একশো লোকের ক্ষুরে!… কত শত বদমাইশ আসামির খাওয়া থালায় খেতে হত না? প্রথম প্রথম তো উপোসেই

চন্দ্র দুহাতে মুখ ঢেকে বলে, থাক থাক, বলো না বলো না।

হ্যাঁ এই কথাই বলল চন্দ্রা।

সুনীলের প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তের দুঃখের বেদনায় যন্ত্রণার অপমানের জ্বালার শরিক কেউ হবে না। এরা সবাই কানে হাত ঢেকে বলবে, থাক থাক বোলো না।

সাজ নিয়ে আর কথা হল না। অনেকদিন আগের ছোট হয়ে যাওয়া একটা চিকনের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে, দাড়ি খচখচ মুখ নিয়ে নীচে নেমে গেল সুনীল। নিজের ঘরে একটু বসবে কী? তখন ওর বড়মামা আসেননি? তিনি হাঁক পাড়েননি–কই হে সুনীলবাবু কোথায়?

খাবারই সময় জোটে না প্রায়।

আজকের দিনে সুনীল কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। নিজেরও নয়। সুনীল আজ পাবলিকের। চন্দ্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিল সুনীল ওই অসংস্কৃত মুখটা নিয়ে অনায়াসে লোকের সামনে বেরোতে গেল! সুনীল সম্পর্কে এটা ভাবা যেত?

কিন্তু এখন, এই প্রায় মধ্যরাতে সুনীল তো আর পাবলিকের সম্পত্তি নয়? নিতান্তই ব্যক্তিগত। এখন তো সুনীলের উচিত ছিল সেই রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিটির উপযুক্ত হয়ে আসা? নাপিতই যদি দরকার হয়, মেটানো কি অসম্ভব হত?

চন্দ্রার রুচিকে পীড়িত না করে, চন্দ্রার ভাল লাগার মতো হয়ে চন্দ্রার কাছে আসতে পারত সুনীল!

আর এসে-সকালের সেই অসমাপ্ত নাটকটা পুনরভিনয়ে শুধরে নিতে পারত। পুনরভিনয়ে আর নতুন সংলাপের পুনর্যোজনায়।

অবতারণা করতে পারত নতুন দৃশ্য, নতুন ভঙ্গি। অভিনয়ের উৎকর্ষে নাটককে উতরে নিয়ে যেতে পারত, পৌঁছতে পারত মঞ্চ থেকে চিত্তলোকে।

যে নাটক ঝুলে পড়েছিল, সেটা আবার দাঁড়িয়ে পড়তে পারত।

কিন্তু হল না।

আবারও ভেস্তে ফেলল এরা।

বুদ্ধিহীন নায়ক নায়িকার হাতে পড়লে নাটকের যা দশা হয়, তাই হল।

সুনীল সকালের মতোই কিছুক্ষণ ওই দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

নীল আলো জ্বালা ঘরের সব কিছুই যেন অলৌকিক লাবণ্যে মণ্ডিত।…

সুনীল শব্দ না করে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে আস্তে পাশ কাটিয়ে সোফাটায় গিয়ে বসল। শুয়ে পড়ার জন্যে শরীরের সমস্ত তন্ত্ৰীগুলো যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খুলে পড়ে যাচ্ছে।

সংসারে সর্ববিধ ক্লান্তিকর কাজের মধ্যে বোধ করি সব থেকে কঠিন ক্লান্তিকর হচ্ছে, অনিচ্ছুক চিত্ত নিয়ে অবান্তর অবাঞ্ছিত অপ্রীতিকর অতিথিকে স্বাগত সম্ভাষণ জানানো, সঙ্গ দেওয়া!

সুনীল সেই সবচেয়ে ক্লান্তিকরের গভীর গহ্বর থেকে উদ্ধার হয়ে এলেও, ক্লান্তির গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।…

সুনীলের ভয় হচ্ছে শুলেই ঘুমিয়ে পড়বে।

কিন্তু চন্দ্রার সে ভয় করেনি কেন?

চন্দ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে কেন?

ঠিক এই সময় ওপাশের ঘরে রমলা তার বরের কাছ ঘেঁষে শুয়ে বলছিল, চন্দ্রার ব্যবহারটা দেখলে তো? সারাদিন মাথাধরার ছল করে শুয়ে পড়ে থাকল। আশ্চর্য মেয়েমানুষ। আমার মনে হচ্ছে, জেলখাটা আসামি বলে ও ঠাকুরপোকে ঘেন্না করছে।

এ সন্দেহ কি সুনীলের মনেও সঞ্চারিত হচ্ছিল একটা ছাত বারান্দা ডিঙিয়ে?

সুনীল আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে উঠছিল।

সুনীল ঠিক করছিল ওই সোফাটাতেই শুয়ে পড়বে, সে সময় চন্দ্রার মৃদু তীক্ষ্ণ তীব্র জিজ্ঞাসা ঘরের নিথর পরিস্থিতিটাকে বিদীর্ণ করে দিল।

এক্ষুনি চলে এলে যে? আরও কেউ আসতে পারে এখনও, যারা তোমায় খুব ভালবাসে।

এ ভঙ্গি চন্দ্রা স্বভাবগত।

কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে এই লগ্নে, চন্দ্রার কি সেই স্বভাবটাকেই প্রকাশ করা উচিত ছিল?

অথবা হয়তো উচিত অনুচিতের বোধ হারিয়ে ফেলেছিল চন্দ্রা তীব্র প্রতীক্ষার মুহূর্ত গুনতে গুনতে।

তাছাড়া

নীলাভ মৃদু আলোর ছায়ায় ঘুমের ভান করে পড়ে থাকা চন্দ্রা কি প্রত্যাশা করছিল না একটা ঝড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ুক তার উপর? সেই ঝড়ে, যা কিছু উলটোপালটা ঘটেছে এ যাবৎ, তা ভেঙেচুরে সমান হয়ে যাক।

কিন্তু চন্দ্রাকে সেই ভানের ঘুম থেকে জেগে উঠতে হল। চন্দ্রা অবাক হতেও ভুলে গেল সুনীলের অদ্ভুত ব্যবহারে। তাই চন্দ্রা, সুনীলকে এখানে শুলে কেন?বলে প্রশ্ন করল না নিজের জায়গায় শোবে এসো বলে ডাকতে গেল না, সেই দুধ ধবধবে লেসের ঝালর দেওয়া বালিশে মাথা রেখেই তীব্র প্রশ্ন করে উঠল, সুনীল এখুনি চলে এল কেন?

অথচ চন্দ্রা আজ তাদের ফুলশয্যার বিছানার সেটটা বার করে পেতেছিল সাধ করে। চাদর মশারি ওয়াড়।

সুনীল সেটা বুঝতেও পারল না, শুধু ওই রাজকীয় শয্যায় শায়িতা কন্যাকে স্পর্শ করতে সাহস করল না, দুরে থেকে ঈর্ষার চোখে দেখতে লাগল বসে বসে।

ঈর্ষাই বোধহয়।

সুনীলকে নিয়ে সারাদিন সবাই ডাংগুলি খেলছে, আর চন্দ্রা নিরুদ্বেগে রাজশয্যায় শুয়ে আছে। সহ্য করা কঠিন।

এ এক অদ্ভুত হৃদয়রহস্য।

যে চন্দ্রাকে সুখ আরাম আয়েস আর বিলাস বিভবে ডুবিয়ে রাখবার সাধনাই ছিল সুনীলের ধ্রুব লক্ষ্য, সেই চন্দ্রার সুখ দেখে ওর হিংসে হচ্ছে, আরাম দেখে রাগ ধরছে।

চন্দ্রার ভাষার মধ্যে ব্যঙ্গ নিহিত ছিল, তাতে উৎক্ষিপ্ত হল সুনীল।

সুনীল তাই ব্যঙ্গেই জবাব দিল, তাই দেখছি! না চলে এলেই হত। মহারানির কাঁচা ঘুমটা ভাঙানোর পাপে পাপী হতাম না।

অনেকের সঙ্গে অনেক কথা কয়ে সুনীল কি তার স্বাভাবিক ধারালো কথার ভঙ্গিটা ফিরে পেল? দীর্ঘদিনের অব্যবহারে যেটা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল।

চন্দ্রা একটু চুপ করে থেকে আস্তে বিছানায় উঠে বসল, শান্ত গলায় বলল, আর ওখানে কেন? রাত যথেষ্ট হয়েছে, ঘুমনো দরকার।

সুনীল বলল, এখানেই বেশ চমৎকার ঘুমুতে পারি।

পারতে পারো। তোমার পক্ষে এখন কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু অকারণ কৃচ্ছসাধনে দরকারটাই বা কী? এখানে তো পরস্ত্রী নেই।

সুনীলের ভিতরে উত্তাল ঝড়, তবু সুনীল কথার পিঠে সহজ কথা বলল।

বলল, নেই কি আছে, তাই বিচার করছি এতক্ষণ।

বিচার শেষ হয়েছে?

ঠিক বুঝতে পারছি না।

আচ্ছা ওটা সকালের জন্যে থাক, এখন তো ঘুমে ঢুলছ। এসে শুয়ে পড়ো।

সুনীল উঠে এল।

সুনীলের মুখে এল, একটা কয়েদিকে পাশে নিয়ে শুতে ঘেন্না করবে না তো?

কিন্তু সেটা না বলে, একেবারে অদ্ভুত অবান্তর একটা কথা বলে বসল।

অতএব বলতেই হবে এই আড়াই বছরে বুদ্ধিহীন আর ভোঁতা হয়ে গেছে সুনীল।…ওই মুখে আসা কথাটা বলে ফেললে হয়তো বদলে যেত পরিস্থিতি, আসত ঢেউ, আসত জোয়ার, ভাসিয়ে নিয়ে যেত সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব।

কিন্তু সুনীল ভোঁতা হয়ে গেছে।

তাই বলে বসল, তখন মাকে দিয়ে ডেকে পাঠালাম তবুও গেলে না, খুব খারাপ দেখাল।

চন্দ্রার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা বিদ্যুতের শিহরন খেলে গেল।

চন্দ্রা তবু শান্ত ভাবে বলল, কখন?

কখন? বাঃ। মনে করতে পারছ না? চ্যাটার্জি বউ নিয়ে এসেছিল। খুব বিশ্রি দেখাল।

চন্দ্রা তীব্র হল।

চন্দ্রা বলে উঠল, ওতেই খুব বিশ্রি দেখাল? তা হলে তো না গিয়ে ভালই করেছি। গেলে আরও বিশ্রি ব্যাপার ঘটত। আমি গেলে তো ওদের দরজা দেখিয়ে দিতাম।

দরজা দেখিয়ে দিতে?

হয়তো শুধু তাও নয়, দরজার বাইরে পার করে দিয়ে কপাট বন্ধ করে দিতাম।

চন্দ্রা ঝুপ করে শুয়ে পড়ে।

বালিশে মুখ ডুবিয়ে বলে, ছি! ছি! আমি তো ভাবতেই পারছিলাম না, কী করে তুমি ওই শয়তানটার সঙ্গে হাসি গল্প করছিলে।

ভদ্রতা বলে একটা বস্তু তো থাকবেই!

সকলের সঙ্গে নয়।

সকলের সঙ্গেই। বাবাও ওর সঙ্গে কথা বলছেন, মা মিষ্টি খাইয়েছেন

তা হলে বুঝতে হবে তোমরা সবাই মহৎ, আমি তোমাদের মতো উচ্চ শ্রেণীর জীব নয়।

চন্দ্রা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

সুনীল সেই দিকে অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় চলে আসে।

.

মনের সুক্ষ্ম তন্ত্রগুলি ঠিক সুরে বাজল না, দেহের শিরায় শোণিতে তীব্র বাজনা বেজে উঠতে চাইছে। বহুদিনের বঞ্চিতের ক্ষুধা! চুলোয় যাক কোমলতা সৌকুমার্য সব কিছু। চন্দ্রা অস্ফুটে বলে ওঠে, ছোট আলোটা খোকার জন্যে সারারাত জ্বলে–

সেই অস্ফুট কথা কানে যায় না সদাজাগ্রত কুম্ভকর্ণের।

সেই কুম্ভকর্ণ বলতে থাকে কীসের জন্যে অনধিকারীর ভূমিকায় থাকছিলাম আমি? অধিকার আছে, পুরোমাত্রায় আছে। এই ঘর, এই শয্যা, এই শয্যাশায়িনী, সব আমার। আমি পূর্ণমাত্রায় ভোগ করব। যথেচ্ছ ভাবে।

যে এই দীর্ঘদিন বর্বরদের আবহাওয়ায় বাস করে বর্বর হয়ে গেছে সে অধিকারের ওপর হিংস্র থাবা বসাবে, সূক্ষ্মতার ধার ধারবে না।

আরতির ঘণ্টা বাজতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল, বাজল যুদ্ধের উদ্দাম বাজনা।

কে জানে, এর জন্যে দায়ী কে!

.

সকালে রমলা ছোট জায়ের মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, তবু ভাল, ঠাকুরপোর রাতটা ভালই কেটেছে। সারাদিন যেভাবে মাথা ধরে পড়ে রইলি–

চন্দ্রা স্থির দৃষ্টিতে একটু তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, দিদি, তুমি বোধহয় সম্পর্কে আমার গুরুজন।

রমলা বোধ করি এ রকম কথার জন্যে প্রস্তুত ছিল না, একটু থমমত খেল। তবু সে হচ্ছে বাঁচাল মেয়ে। তাই ঠোঁট উলটে বলে, অত গুরুজন গোরুজন বুঝি না বাবা, আয়দের ঘটনা ঘটলে আমি আহ্লাদ করবই।

সকাল থেকে বাড়িতে পুজোর আয়োজন চলছিল। অনেক রকম মানত আছে অপর্ণার, মঙ্গলচণ্ডী, সঙ্কটা, সত্যনারায়ণ।

পুজাকালে সুনীলকে এসে বসতে হবে এই নির্দেশ দিতে তাকে ডাকলেন অপর্ণা। শুনে সুনীল পুরনো ভঙ্গিতে কৌতুকের হাসি হাসতে চেষ্টা করল। বলল, তোমার এইসব পরম শক্তিমান দেবদেবীরা তো কেউই তোমার ছেলের কয়েদটা রদ করতে পারেননি বাবা, তবে আবার এত নৈবেদ্য দিতে বসছ কেন?

এই রকম বলত সুনীল আগে।

মায়ের পুজো-পাঠ মানতটানত নিয়ে খুব ঠাট্টা তামাশা চালাত। কিন্তু ওর সেই কৌতুকের ভাষায় আর হাসিতে যেন আলোর ফুলঝুরি ঝরত। অপর্ণা ছেলের লাবণ্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে বলতেন, তবে আর কি, তুই আমার গোপাল ঠাকুর আছিস, তোরই পুজো চড়াই।

আজ আর কথায় সেই নির্মল আহ্লাদের সুর ধ্বনিত হল না, হাসিতে সে লাবণ্য ঝরল না।

চেষ্টাকৃতের চেষ্টাটা ধরা পড়ল।

আর অপর্ণাও কেন জানি যে হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে উঠলেন। বললেন, এই তো দোষ তোদের। ঠাকুর দেবতা মানিস না, পুজোআচ্চা নিয়ে ঠাট্টা করিস, তার ফলও তো দেখছিস বাবা! এখন থেকে একটু নত হতে চেষ্টা কর।

সুর কেটে গেল।

কী থেকে কী হল।

সুনীল এক মুহূর্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু অন্য ধরনের হাসি হেসে বলে চলে গেল, সেটার জন্যে আর চেষ্টা করতে হবে না মা।

.

বাইরের দিকে নিজের ছোট্ট বসবার ঘরটায় বসেছিলেন ভবানীবাবু, সুনীল অকারণেই ঘরটায় এসে ঢুকল। কী ভেবে সেলফের বইগুলো দেখতে লাগল। মনে হল অনেকগুলো নতুন বই দেখল।

তার মানে কারুরই জীবনধারা ব্যাহত হয়নি। পৃথিবী যেমন চলছিল, তেমনই চলে এসেছে।

শুধু সুনীলের জীবনের চাকাটাই লম্বা একটা সময়ের জন্যে একেবারে থেমে থেকেছে।

কিন্তু সেই কাদায় বসে যাওয়া রথের চাকা কি ফের চলবে?না মহাভারতের কর্ণর মতোই পরিণতি হবে তার?

আচ্ছা, সুনীলের নিজের যে সেই বিরাট গ্রন্থসংগ্রহ ছিল?

দোতলার দক্ষিণ কোণের ঘরটায় দেয়ালজোড়া আলমারিতে সাজানো থাকত! সুনীল কিছু কিছু ত্রিবেণীতে নিয়ে যেত, আবার রেখে যেত।

কী হল সেই বইগুলোর?

সেই ভাবেই আছে?

না কি কেউ সেগুলো অবান্তর বলে বাড়ির কোনও একখানে ঠেলে রেখে দিয়ে ঘরটা কাজে লাগাচ্ছে?

আশ্চর্য, এমন অদ্ভুত কথাটা সত্যিই মনে এল সুনীলের। সুনীল কি তা হলে এ সংসারের ভালবাসার প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছে? না হলে এ কথাটা ভাবল কেমন করে?

এখনও বাড়িটা সমস্ত ঘুরে দেখা হয়নি সুনীলের, তাই বইগুলো সম্পর্কে এই সন্দেহ পোষণ করতে পারল।

আচ্ছা, সুনীলের সেই কোয়ার্টার্সে যেসব জিনিসগুলো ছিল, সেগুলোর কী গতি হল? কিছু কিছু অবশ্য কোম্পানিরই ছিল, যেমন ডিনার টেবিল, স্ট্যান্ডের আলো, সিলিং ফ্যান, ফ্রিজ।…গাড়ি তো বটেই।

বাকি যা কিছু তো সুনীলেরই। সুনীল আর চন্দ্রা দুজনের সুখস্বপ্ন দিয়ে গড়া সেই সুখস্বর্গ।

সে সমস্তই কি কোম্পানি ক্রোক করে নিয়েছে? না কি পুলিশে নিয়ে নিয়েছে?

লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করতেও পারছে না কাউকে।

সুনীল মনে মনে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠল। নিজের প্রতি নিজের সেই ব্যঙ্গ ভাষায় মুখর হয়ে উঠলে এইসব শুনতে পাওয়া যেত।

দূর শালা, বেকুব! তুই কি ভাবছিস তুই আবার তোর সেই হারানো স্বর্গ ফিরে পাবি? আর সেই ভাঙাচোরা টুকরো খেলনাগুলো খুঁজেপেতে জড়ো করে নিয়ে আবার খেলাঘর পাতবি? বুদ্ গাড়ল, তোর জীবনের সব কিছুর বারোটা বেজে গেছে, বুঝলি?

শালা শব্দটা সুনীলের যে এমন রপ্ত হয়ে যাবে কে কবে ধারণা করেছে?

অবিশ্যি ওটা কিছুই নয়, এখন অনেক গালিগালাজ এবং অশ্লীল শব্দ মুখস্থ হয়ে গেছে সুনীলের। কথা বলতে বলতে ব্যবহার করে বসা বিচিত্র নয়। এই কালই তো বাবার সঙ্গে কথা বলতে বসে মুখ ফসকে কী একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল।

ভবানীবাবু আশা করেছিলেন নতুন বইগুলো নিয়ে কিছু বলবে তাঁর ছোট ছেলে। বই দেখলেই তো উচ্ছ্বসিত হওয়া অভ্যাস ছিল ওর। কখনও নির্বাচনের প্রশংসায় মুখর হত, কখনও অভিমত প্রকাশ করত, এটা কিনলেন? এটা না কিনে যদি

কাল সুনীল কিছুই বলল না।

অথবা একটা টেনে বার করে পড়তেই বসল না।

ভবানীবাবু ক্ষুব্ধ হলেন।

বই সম্পর্কে কি ইন্টারেস্ট হারিয়েছে সুনীল?…আমি কোথায় ভেবেছিলাম ও বুভুক্ষুর মতো নতুন পুরনো ওই গ্রন্থরাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, দেখছি তা হল না।

আবার ভাবলেন, না না, সেও কি সম্ভব? আসলে বেচারা এখন বড় বেশি ক্লান্ত, তাই কোনও কিছুতেই উৎসাহ বোধ করছে না।…এই তো যার বড় লোভনীয় আকর্ষণের বস্তু নেই, এতদিনের অদেখা সেই প্রথম পুত্র সন্তান, তার ব্যাপারেই বা উৎসাহ দেখা গেল কোথায়?

অপর্ণা কোথা থেকে একখানা গিনির মালা বার করে এনে নিজের ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার ছেলেকে দেখতে বলেছিলেন।

যাকে মুখ দেখা বলে।

সুনীল সেটা হাতে নিয়ে কেমন একরকম বিব্রত ভাবে ছেলেটাকে আলগোছে একটু ধরেই ছেড়ে দিল। ছেলে এবং গিনির মালা দুটোই অপর্ণার এক্তারে চলে এল। ছেলে সম্পর্কে আর কোনও ঔৎসুক্য প্রকাশ করল না সুনীল। অথচ যা রূপ হয়েছে খোকার। পথের লোক চেয়ে দেখে।

অবিশ্যি খোকাটাও কেঁদেকেটে কীর্তি করল একখানা। অথচ নতুন লোক দেখলেই যে এরকম করে তা নয়।

অপর্ণা কত ভোলাতে চেষ্টা করলেন, কতবার তাকে ধরে ধরে বাবা বলাতে চেষ্টা করলেন, কোনওটাই কাজে লাগল না।

অপর্ণা অবশ্যই চেয়েছিলেন নাতির রূপ ও গুণপনা দেখিয়ে ছেলেকে মুগ্ধ করে ফেলবেন, সেটা হল না। অতএব রেগে গেলেন নাতির উপর। রেগে রেগে বললেন, আচ্ছা! এতবার বলছি একবার বাবা বল তা বলা হল না। এরপর দেখব? তখন আর আমাদের চিনতে পারবি না। ওই বাবাই সার হবে।

সুনীল একবার এ কথার প্রতিবাদ করল না, মেনেও নিল না। বলল, থাক থাক, নিয়ে যেতে বলল।

কিন্তু, বইগুলো তো আর কেঁদেকেটে ব্যস্ত করছে না? ওদের তো একবার নিয়ে বসা যেত!

ভবানীবাবু আহত হলেন, ক্ষুব্ধ হলেন, তারপর ভাবলেন, অব্যবহারে মনের তারগুলোয় মরচে পড়ে যায়। সাময়িক ভাবে অন্যরকম হয়ে যায়। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

সব ঠিক।

নিজে থেকে বললেন, কিছু নতুন বই কিনেছি।

প্রশ্ন নয় অতএব উত্তর দেবারও দায় নেই, সুনীল চুপ করে থাকে।

ভবানীবাবু একটু অপেক্ষা করলেন, তারপর বললেন, পোড় আস্তে আস্তে। এখন দুচার দিন খুব টায়ার্ড থাকবে।

সুনীল বলল, না, টায়ার্ড আর কী এমন?

আচ্ছা ভবানীবাবু তো এই সময় বলে উঠতে পারতেন, বলিস কী? আড়াই বছর ধরে তুই জেল খেটে এলি না?

আর তারপর বলতেন, এ দুদিন তো গোলমালে তোর সঙ্গে কথাই হয়নি, বোস তো শুনি তোর এতদিনের সব কথা।

আর সুনীল বলতে বসলে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কী কী অভিজ্ঞতা ঘটেছে তাঁর ছেলের।…কতটা তীব্র, কতটা তিক্ত, কতটা নারকীয়।

শুনতে শুনতে ওই স্থিতপ্রাজ্ঞ ব্যক্তিটি সহানুভূতিতে স্তব্ধ হয়ে যেতেন, আর হয়তো বা অলক্ষিতে চোখের কোণের আর্দ্রতাটুকু মুছে ফেলে নিশ্চিহ্ন করতে চাইতেন।

সেই ভয়ানক দুঃখের কথাগুলো বলবার জন্যে তো প্রাণ ছটফট করছে সুনীলের। ছটফট করছে সমস্ত অন্তরাত্মা প্রতিটি দিনরাত্রির ঘণ্টা মিনিটের ইতিহাস বিবৃত করতে।…

শুনলে বুঝতে পারতে সুনীল নামের ছেলেটার উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে।

তোমাদের এই ছকে বাঁধা শান্ত সুখের জীবনের সোনার সিংহাসনে বসে তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না পঙ্কিল কী কুৎসিত সেই ঝড়।

অথচ আমিও একদা তোমাদের মতোই ছিলাম। জানতাম না পৃথিবীর কোনওখানে এ রকম একটা অন্ধকার জগৎ আছে। প্রথম প্রথম আমি প্রতি মুহূর্তে ইলেকট্রিকের শক লাগার মতো চমকে চমকে উঠতাম অকারণ নোংরা কথায়, অজানিত অশ্লীল শব্দের আঘাতে।

ওইসব ঊর্ধ্বতন অফিসারেরা নাকি তোমাদেরই এই সমাজের জীব।

তোমাদেরই আত্মীয় বন্ধু কুটুম্ব।

তারা নিশ্চয়ই তোমাদের সঙ্গে ভদ্রতা আর সভ্যতার মুখোশ এঁটে ঘুরে বেড়ায়, তোমাদের সামাজিক কাজেকর্মে এসে যোগ দেয়, একাসনে বসে পানভোজন করে।

অথচ তোমরা জানো না তারা কী কদর্য।

অকারণে অহেতুক যে কোনও মানুষ এমন অসভ্য ভাষায় গালাগাল করতে পারে, এমন অশালীন ভঙ্গি করতে পারে, এমন অশ্রাব্য উক্তি করতে পারে, এ কথা আমারও এই তোমাদের মতোই জানা ছিল না।

আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হত, আমার মাথা খুঁড়তে ইচ্ছে হত, আমি কতদিন নিজের হাত নিজে কামড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছি।…

অসভ্যতা কী যন্ত্রণাদায়ক।

সেই বহু যন্ত্রণার ইতিহাস, যা সঞ্চিত হয়ে রয়েছে আমার মনের প্রতিটি অণুপরমাণুতে তা তোমাদের কাছে বলতে না পেলে আমি স্থির হব কী করে? আমার সেই নরকযন্ত্রণার কথা তোমরা কেউ জানতে পারবে না?

অথচ আশ্চর্য, তোমরা কেউ সে কথা তুলছ না। তোমরা যেন ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাচ্ছ।

তোমরা আমার এই আড়াই বছর কালের জীবনটাকে সীল করে ফেলে কোনও একখানে ঠেলে সরিয়ে রাখতে চাইছ।

জেলখানার গেটে যে রকম ভারী লোহার তালা ঝোলানো থাকত, তেমনি একটা ভারী তালা ঝুলিয়ে রাখতে চাইছ তোমরা আমার ওই দিকটায়।

একেই কি সহানুভূতি বলে?

আমি বলতে পারছি না সে কথা। এ তোমাদের পলায়নী মনোবৃত্তি। তোমরা রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছ। তাই কেউ একবারও জিজ্ঞেস করছ না–এই দিনগুলো কেমন করে কেটেছে তোমার?

একটা দাহ হচ্ছিল ভিতরে, সেই সময় ভবানীবাবুর শান্ত মার্জিত কণ্ঠের একটু কথা কানে এল।

কটা বই নতুন কিনেছি।

সুনীল শুনতে পেল।

সুনীলের মুখে একটু ব্যঙ্গ হাসি ফুটে উঠল।

কিনেছ, বেশ করেছ তা আর বলবার কী আছে? আমি তো কৈফিয়ত চাইনি? আমার অভাবে তোমাদের সব কিছু বন্ধ হয়ে বসেছিল, এমন মূঢ় কথা এখন আর ভাবছি না আমি। তখন ভাবতাম।

একটা বুকচাপা বোবা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুম না হওয়া রাতের অস্থিরতা নিয়ে ভাবতে থাকতাম তোমাদেরও বুঝি সব কিছু আমারই মতন থেমে আছে।

ভেবে ভেবে মনে আনতে চেষ্টা করতাম, তোমরা এখন কী করছ। সন্দেহ করতাম, তোমাদের রান্নাঘরে কি আর রান্নাটান্না হয়? তোমরা কি যথারীতি খাও, ঘুমোও, বেড়াও?

না, রমলা রায় আর সুশীল রায়-কে নিয়ে ভাবতাম না আমি, ভাবতাম ভবানী রায়, অপর্ণা রায় আর চন্দ্রা রায়কে নিয়ে।

এখন আমার সমস্ত সন্দেহের অবসান হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু বাবার কথার পর একটা কথা বলা দরকার বইকী! সুনীল নামের ভদ্র মার্জিত সেই ছেলেটা এখন হঠাৎ মুখ ফসকে শালা কি শুয়োরের বাচ্ছা বলে ফেললেও এ সভ্যতাটুকু হারিয়ে ফেলেনি।

বাবার কথায় তাই সুনীলকে বলতে হয়, তাই দেখছি, এগুলো ছিল না।

তোমার বইয়ের ঘরে গিয়েছিলে নাকি?

যাওয়া হয়নি এখনও।

আচ্ছা, এই সুযোগের মুহূর্তে তো সুনীল বলে নিতে পারত, বাবা, ত্রিবেণীর বইগুলোর কী হল?

কই, বললে না তো।

বই সম্পর্কে মূল্যবোধ আপাতত বোধ করি তেমন নেই আর ওর।

ভবানীবাবুকে আবার কথা খুঁজতে হয়।

ভবানীবাবু ভাবতে চেষ্টা করেন, আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছেলের সঙ্গে কী নিয়ে গল্প করতেন তিনি।…মনে পড়লে এখন সুবিধে হত।

কিছুতেই মনে পড়ল না।

অতএব সুবিধেও হল না।

তাই হঠাৎ বলে উঠলেন, ছোট বউমা একটা কাজ করছেন শুনেছ বোধ হয়?

সুনীল বলল, শুনলাম, বউদি বলছিল।

এতে কি তোমার আপত্তি রয়েছে?

আশ্চর্য, ভবানীবাবু এমন বোকার মতো একটা প্রশ্ন করল কেন? যাতে সুনীল হেসে উঠতে পারে?

সুনীল হেসে উঠল।

এখন যে রকম হাসি হাসতে পারে সেই রকম।

হেসে উঠে বলল, আপত্তি? আমার আপত্তি অনুমতির কোনও দাম আর আছে নাকি এখনও?

ভবানীবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, এ কথা বলছিস কেন নীলু? মেয়েটা একা একা থাকত, দেখে তোবোঝা যেত খুব লোলি ফিল করছে। তাই আমি ওকে বারণ করিনি, নইলে ওর বাবার খুবই বিরক্তি ছিল।

সুনীল আবার সেই রকম হেসে উঠে বলে, বারণই বা করবেন কেন? আমার ভবিষ্যতের তো বারোটা বেজে গেছে, যে যার নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেওয়াই ভাল।

ভবানীবাবু বলেন, তোর এখন কিছুদিন বিশ্রামের দরকার নীলু। তারপর এসব নিয়ে ভাবিস। ভবিষ্যৎটা একেবারে গেছে, এ কথা ভাববার কিছু নেই।

সুনীল একটা জ্বালাভরা গলায় বলে, ছেলে ভুলোনো কথা বলে সান্ত্বনা দেবারও কিছু নেই বাবা।

নীলু, এখন তোর শুধু শরীরই নয়, মনও খুব অসুস্থ।

কিছু অসুস্থ নেই বাবা, খুব সুস্থ, বরং আগের থেকে বেশি সুস্থ।

মনে মনে বলল, হ্যাঁ আগে চোখে একটা যে রঙিন চশমা পরে বসে থাকতাম, আর ভাবতাম, এটাই পৃথিবীর রং, এখন সেই চশমাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, এখন সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তবে কেন বেশি সুস্থ নয়?

নীলু তোর মা বোধ হয় ডাকছে, পুরুতমশাই এসেছেন–

আমি আর গিয়ে কী করব? ওসবে আমার আর বিশ্বাস নেই।

না থাকাই স্বাভাবিক। আমারও তো নেই। পুরুষের বিশ্বাস মেয়েদের বিশ্বাসের ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, পৌঁছনো হয়তো হাস্যকরও। কিন্তু তোমার মায়ের বিশ্বাস আর নিষ্ঠার উপর তো শ্রদ্ধা আছে?

সুনীল মাথাটা নিচু করে।

সুনীলের হঠাৎ মনে হয়, এতক্ষণ আমি বাবার সঙ্গে এমন বাঁচালের মতো কথা বললাম কী করে?

.

অপর্ণা বললেন, এই যে এসেছিস? একটু সরে আয় দিকি—

মার হাতে গঙ্গাজলের ঘটি।

অতএব বুঝতে দেরি হয় না মা ফোঁটা কয়েক গঙ্গাজলের প্রয়োগ-কৌশলে নীলুকে বিশুদ্ধ করে নিয়ে পুজোর ঘরে প্রবেশাধিকার দেবেন।

সুনীল আর আগের মতো কৌতুক করতে পারবে না, অপর্ণাও আর সে কৌতুক সহজ ভাবে নিতে পারবেন না, তবে আর কী করা যায়, অপ্রতিবাদে সেই গঙ্গাজলের ঘটির কাছে মাথা পাতা ছাড়া?

একখানি নির্মল উজ্জ্বল স্ফটিক পাত্র ছিল, সেটা ভেঙে ছত্রখান হয়ে গেছে, তবু টুকরোগুলো হয়তো হারায়নি, কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

সুনীল কি সেগুলো খুঁজে খুঁজে এনে জোড়া দিয়ে দিয়ে দেখবে আস্ত হয় কি না!

অপর্ণা বিরক্ত ভাবে বলছিলেন, ছোটবউমা যে সকাল থেকে কোথায় বসে আছে! বড়বউমা পুজোর দিকে রয়েছে, ও একটু ওদিকটা দেখত–

হ্যাঁ বড়বউমা পুজোর দিকেই আছেন সত্যি। রূপ বদলের একটি আশ্চর্য ক্ষমতা আছে রমলার। রমলা আজ ভোরবেলাই, তার চুড়ো খোঁপাটা ড্রয়ারে ভরে রেখে, নখের রং আর চোখের কাজল ভাল করে ধুয়ে ফেলে স্নানশুদ্ধ হয়ে নিজস্ব ঝিরিঝিরি চুলের ডগায় একটি ফাঁস বেঁধে নিয়ে লালপাড় গরদশাড়ি পরে পুজোর ঘরে এসে ঢুকেছে।

নৈবেদ্যর ফল কাটা, চন্দন ঘষা, ঘর পরিষ্কার করা এসব তার ডিউটি। এরপর ধুনোয় বাতাস দেবে, গাল ফুলিয়ে ফুলিয়ে শাঁখ বাজাবে, এবং পুজোর শেষে, অপর্ণাকে ধরে বেঁধে একটু মিশ্রির শরবত কি ডাব খাইয়ে ছাড়বে।

সুনীল দোতলায় উঠে এল, কোথাও দেখতে পেল না চন্দ্রাকে, কী ভেবে দক্ষিণের সেই কোণের ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুনীলের সেই নিজস্ব বইয়ের ঘরে।

সুনীল কি এইখানেই প্রত্যাশা করছিল চন্দ্রাকে?

চন্দ্রা ঝাড়ন নিয়ে তার বরের বইগুলি ঝেড়ে ঠিক করে রাখছে। এইটাই দেখবে ভাবছিল?

ঘরে কেউ নেই। দেয়াল জোড়া আলমারিতে বইগুলি যেন মৌন অভিমানে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে।

দেখতে দেখতে ভারী আশ্চর্য লাগল সুনীলের।

বইগুলো তার সবই তো পড়া।

নতুন বই কেনা মাত্রই পড়ে না ফেলে, থাকতে পারত না সুনীল। তা সে বই যে বিষয়েরই হোক।

এখন ভারী আশ্চর্য লাগছে এই বিরাট গ্রন্থভার পড়ে শেষ করেছে সে। মাথা এত স্থির ছিল তার?

আবার পড়তে হবে আস্তে আস্তে।

কিছুই বোধহয় আর মনে নেই।

মনের মধ্যে উচ্চারণ করল।

তারপর তিনতলায় উঠে গেল।

দেখল চন্দ্রার বেশবাসে যেন বাইরে বেরোবার প্রস্তুতির প্রকাশ। অথবা এই ওর বাড়ির সাজ।

সুনীল বলল, মা তোমায় খুঁজছিলেন।

চন্দ্রা টেবিল থেকে ওটা ওটা টুকিটাকি হাতব্যাগটায় ভরতে ভরতে সহজ ভাবে বলল, এই-তো নেমেই যাচ্ছি একেবারে

দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকাল চন্দ্রা।

চন্দ্রার ওই সহজ ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে দেখে সুনীল কেন কে জানে যেন নিজেকে অপমানিত বোধ করল। সুনীল জোর দিয়ে বলল, তুমি কি আজ অফিস যাবে না কি?

চন্দ্রা যেন বিস্মিত হল।

বলল, যাব না? কেন? আজ তো ছুটি নয়।

সুনীল যদি বলে উঠতে পারত, না যাবে না। কিছুতেই তোমায় যেতে দেব না আমি আজ। দেখি এই ঘর ছেড়ে কেমন যেতে পারো। তা হলে হয়তো শুধু ঘটনারই নয়, জীবনেরও একটা বড় মোড় ঘুরে যেতে পারত। কিন্তু সুনীল তা পারল না, সুনীল এখন অদ্ভুত একটা হীনম্মন্যতার শিকার।

তাই সুনীল নিজের কথা না বলে বলে বসল, আজ বাড়িতে এই সব পুজোটুজো, কাজ রয়েছে—

চন্দ্রা অবলীলায় বলল, কাজ করবার লোকও রয়েছে।

লোক থাকলেই তোমার দায় মিটে গেল? তোমার দিকে কোনও ডিউটি নেই?

চন্দ্রা বলল, অফিসেও একটা ডিউটির প্রশ্ন রয়েছে।

চন্দ্রার কণ্ঠস্বর খুব শান্ত নির্লিপ্ত, এবং শীতল কঠিন।

আচ্ছা চন্দ্রার ভিতরটাও কি এমনি শীতল কঠিন আর শান্ত নির্লিপ্ত হয়ে আছে? কিন্তু ভিতরে দৃষ্টি ফেললে তো তা মনে হচ্ছে না।

সেখানে যে অভিমানের প্রবল সমুদ্র উদ্বেল হয়ে উঠছে। সেখানে চন্দ্রা ভেঙে খান খান হচ্ছে। সেখানে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যাবে, কেন? কেন? কীসের জন্যে থাকব আমি বাড়িতে?…তুমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়াবে, তুমি অনেকক্ষণ পরে এসে আমায় শোনাবে মা তোমায় খুঁজছেন তুমি নিজে সারা সংসারে ডিউটি দিয়ে বেড়াবে, আর আমায় ডিউটির উপদেশ দিতে আসবে, এই সুখ নিয়ে আমি অফিস কামাই করব?…কী দায় আমার?

আমার মন ছিল কানায় কানায় ভরা, আমার সমস্ত হৃদয় উন্মুখ হয়ে ছিল তোমার আসার আশায়, তুমি কী করলে? সেই উন্মুখ হৃদয়ের দিকে তাকালে না, সেই ভরা পাত্রটিকে হাতে নিয়ে দেখলে না, শুধু বর্বরের মতো সবচেয়ে স্কুল পাওনার দিকে হাত বাড়ালে।…তুমি একবার বললে না, খোকাকে কোলে নিয়ে বোসো তো দেখি, কেমন দেখতে লাগে তোমায়, এমনকী নিজেও তাকে একবার কোলে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালে না। তুমি থোকার নামই করলে না।…তুমি তোমার দাদার ছেলেমেয়েদের তবুও একবার ডেকে তল্লাশ নিলে, চন্দ্রার ছেলের নয়।…ওই শঙ্খ আর মিঠু ওরা কি তোমায় আর আগের চোখে দেখছে নাকি? আগে ওরা যে কাকুকে দেখলে আহ্লাদে নাচত, তুমি যে সত্যিই সেই লোকটা, তাই তো বিশ্বাস করছে না। আড়ষ্ট হয়ে আছে।

শিশুর কাছে আড়াই তিনটে বছর কম নয়, ওরা যদি তোমাকে ভুলে গিয়ে থাকে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।…ওদের ছোট্ট দুটো ভাইবোনের ভয় ভয় মাখা আলোচনা আমি শুনেছি, ওরা বলাবলি করছিল, জেলে তো চোর ডাকাতরাই যায় রে? কাকু কেন গিয়েছিল? আবার উত্তরও দিয়েছিল নিজেরাই, বোধহয় কিছু দোষ করেছিল কাকু। পুলিশরা সবই জানতে পারে।

কিন্তু তোমার ছেলে এখনও তোমায় সন্দেহ করতে শেখেনি, তাকে আমি তিল তিল করে গড়ে তুলেছি তুমি এসে পেয়ে কৃতার্থ হয়ে যাবে ভেবে। কৃতজ্ঞ হবে আমার কাছে, এতবড় একটা ঐশ্বর্য আমি তোমার জন্যে মজুত রেখেছি বলে। তুমি কি জানো, ওর জন্যে কত ত্যাগস্বীকার করতে হয়েছে আমায়? আমি মরার সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমার লজ্জা, আমার অপমান, আমার যন্ত্রণা, সে কি তুমি অনুভব করতে পারবে?…পারবে না। তোমার অনুভূতি শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই তুমি আমায় ডিউটির বিভীষিকা দিয়ে বাঁধতে এলে।…

তোমার মনে পড়ল না আমাদের জীবনে আকাশ থেকে বজ্র নেমে আসার ঠিক আগেই আমরা শেষ যেবার কলকাতায় এসেছিলাম, সেদিনও তোমার মার কী একটা পুজোটুজোর ব্যাপার ছিল। আমার তাই নিউ আলিপুরে যাওয়া হল না। তবু তুমি বললে, সেরেছে! তুমি ওই পুজোর ঘরের গাড্ডায় পড়ে থাকবে? এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে আমার দারুণ মাথার যন্ত্রণা হওয়া।

আমি বললাম, মিছে কথা বলবে?

তুমি বললে, মিছে তো নয়। এটা আমাদের বিয়ের মাস, ঘরটায় এসে ফুলশয্যে ফুলশয্যে সৌরভ পাচ্ছি, বউ চলে গেলে মাথায় তো বটেই, বুকেও দারুণ যন্ত্রণা দেখা দেবে।

তুমি আমায় আটকে রাখলে সেদিন।

আর আজ? আজ তোমার হাতে আটকাবার আর কোনও অস্ত্র নেই।

তাই ডিউটি দেখাতে এলে তুমি।

কিন্তু মনের কথা কে কার শুনতে পায়?

পায় না বলেই সুনীল বলে, ভারী তো অফিস! ভারী তো পোস্ট! তার আবার–

বলে কিন্তু নিজেই অবাক হয়ে গেল সুনীল। এ রকম কথা তো সে বলতে যায়নি?…সে শুধু প্রত্যাশা করছিল চন্দ্রা বাড়িতে থাকবে। থাকাই তো উচিত।

এতদিন পরে এসেছে সুনীল, তার মর্যাদা দেবে না চন্দ্রা?

কিন্তু সেভাবে বলা হল না।

কথাগুলো উলটোপালটা হয়ে গেল।

সুনীল কি কথা বলতে ভুলে গেছে? একদা না সুনীলের সামান্য কথাই শিল্প হয়ে উঠত?..সুনীল এখন নিজেই অনুভব করছে, সে ঠিক যে কথাটি বলতে চাইছে, সে কথাটি মুখে জোগাচ্ছে না, যে ভাবটি ফোঁটাতে চাইছে, সে ভাবটি ফুটছে না, সুনীল সূক্ষ্ম সুকুমার শব্দগুলো ভুলে গেছে, ভাষার প্রয়োগ কৌশলের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

না কি সুনীল চন্দ্রাকে আবার নতুন করে হিংসে করছে ওর অফিস যাবার সুখময় অবস্থা দেখে?

চন্দ্রাও হয়তো তাই ভাবল।

আর চন্দ্রা এই ব্যঙ্গটি সয়েও নিল না।

চন্দ্রা মৃদু হেসে বলল, বড় চাকরি উঁচু পোস্ট, ওগুলো তো বিদ্বান পণ্ডিতদের জন্যে। মুখদের দীনহীন পোস্টই ভাল, তাতে কাঠগড়ার ভয় নেই।

বলল।

কিন্তু চন্দ্রাই কি এত কঠিন কথা বলতে চেয়েছিল? এতদিন ধরে ওরা কি পরস্পরের জন্যে এই ঢিল পাটকেল থান ইটগুলোই জমিয়ে রেখেছিল? আর তারই সদ্ব্যবহার করছে?

চন্দ্রার কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল সুনীল।

আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

কিন্তু চন্দ্রা নিজেও কি স্তব্ধ হয়ে গেল না? দাঁড়িয়ে থাকল না অনেক অনেকক্ষণ?

চন্দ্রা তারপর নেমে এসে হাতের ব্যাগটা চেয়ারের পিঠে রেখে রান্নাঘরে এসে আস্তে বলল, ঠাকুর আমায় দিয়ে দাও।

অনুচ্চ স্বর, তবু অপর্ণার কান এড়াল না।

অপর্ণা পুজোর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আহত গলায় ছেলের কথাটারই পুনরাবৃত্তি করলেন, তুমি আজও আপিস যাবে ছোটবউমা?

চন্দ্রা মনকে প্রস্তুত করে নিল।

নম্র গলায় বলল, যেতে বারণ করছেন?

বারণ করবার আমি কে বাছা, বাড়িতে এইসব পুজো আচ্চা, দেখছই তো।

চন্দ্রা যখন দূর আকাশের তারা ছিল, তখন অপর্ণা ওকে যেন সমীহ করতেন, যখন এখানে এসে স্থায়ী হল, কৃতার্থ হয়েছেন, কৃতজ্ঞ হয়েছেন, কিন্তু ওই চাকরিটা ধরা পর্যন্ত চন্দ্রার ওপর তিনি খাপ্পা।

তার উপর আবার লক্ষ করছেন, স্বামী ঘরে ফিরল বলে ধন্য হয়ে যাওয়া ভাবের লেশ নেই। একবার ঠাকুরঘরে মাথাটা নোয়াতে আসে না। এখন তাই অপর্ণার মন বিরূপ।

কিন্তু চন্দ্রা হারতে রাজি নয়।

তাই চন্দ্রা হেসে উঠে বলে, ওসব তত দিদিই করছেন। আপনি আমায় কোনও কাজের ভার দিয়েছেন নাকি?

অপর্ণা গম্ভীর হয়ে বলেন, তোমায় দেখতে পেলে তো দেব।

চন্দ্রা নিজের সঙ্গে লড়ে যায়।

আরও হেসে বলে, আর আমি যে সকাল থেকে আপনার নাতি সামলাচ্ছি পাছে এখানে এসে জ্বালাতন করে।

অপর্ণা এ নস্রতায় কিঞ্চিৎ নরম হন। বলেন, আমার নাতি জ্বালাতন করবার ছেলে নয়।

চন্দ্রা হেসে উঠে বলে, আচ্ছা তা হলে তাকে এখানে ছেড়ে দিয়ে যাই?

অপর্ণাও এখন হেসে ফেলেন, বলেন, তা আর নয়।

তারপর বলেন, যাই বলো বাছা তোমার উচিত ছিল আপিসে দুদশ দিন ছুটি নেওয়া।

দুদশ দিন?

চন্দ্রা হাসবেই।

প্রতীক্ষা।

অপর্ণা জো পেয়ে বলেন, নয় কেন? এতকাল পরে নীলু আবার আমার ঘরে এল, তার এখন যত্ন সেবার দরকার

যত্নটত্ন আপনার থেকে আমি বেশি জানি?

অপর্ণা হৃষ্ট হন।

সন্তোষের গলায় বলেন, যত্ন না পারো কাছে কাছে থাকলেও মনটা ভাল থাকে তো? তুমি ধেয়ে ধেয়ে আপিস চলে গেলে ওর ভাল লাগবে?

চন্দ্রা হাসবেই। হেসে ফেলে বলে, আপনারা সবাই রয়েছেন–

অপর্ণা আরও হৃষ্ট হন।

তাই প্রসন্ন গলায় বলেন, তা বাছা যতই হোক, বউ ঘরে না থাকলে সেই যে গল্প আছে জানো তো? সবাইকে দেখতে পাচ্ছি, কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

আবহাওয়াটা হালকা হয়ে গেল।

চন্দ্রা বলল, আজকেই আবার ওখানে একটু বিশেষ জরুরি কাজ। কী করি বলুন তো মা?

চন্দ্রা অপর্ণার কাছে কী করবে তার পরামর্শ চাইছে, যেটা নাকি অনুমতি চাওয়ারই নামান্তর। অপর্ণা বিগলিত হন। বলেন, তা যখন বিশেষ জরুরি, কী আর বলব? ওদিকে দেরি হবে না তো?

না না।…

চন্দ্রা রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

রমলা বাঁকা কটাক্ষে বলে, যেতে তো হুকুম দিয়ে দিলেন, খোকনকে ভাত খাইয়ে দেবার সময় আজ হবে আপনার?

অপর্ণা এখন রমলার ওপর বেজার হন।

বলেন, শোনো কথা? ছেলেটাকে দুটো খাইয়ে দেবার সময় হবে না?

রমলা কোনওদিনই তার ছেলেমেয়ের ব্যাপারে শাশুড়ির সাহায্য প্রার্থনা করেনি, অপর্ণার খুব ইচ্ছে হলেও একদিনের জন্যে দুধের বোতলটা ধরতে দিত না, সেজন্যে অপর্ণা ক্ষুব্ধ হতেন।

চন্দ্রা ছেড়ে দেয়।

এতে অপর্ণা সন্তুষ্ট।

সুনীল দোতলার বারান্দা থেকে দেখতে পেল চন্দ্রা গেট খুলে বেরোল, গেটটা লাগাল, রঙিন ছাতাটা খুলে মাথার রোদ বাঁচিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে গেল।

চন্দ্রার শাঁখার মতো সাদা বাহু-মূলটা অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেল।

চন্দ্রা যখন ঘুরে দাঁড়িয়ে গেটটা বন্ধ করছিল তখন ওর আলো পড়া মুখটা দেখা গিয়েছিল।

সুনীলের মনে কথাটা উঁচ বিধোতে লাগল, এই রূপের ডালিখানি সারাটা দিন কতকগুলো বাজে লোকের চোখের সামনে সাজানো থাকবে। থেকেছে এতদিন ধরে। যখন সুনীল হতভাগা লৌহকারার অন্ধকারে বসে ঈশ্বর পৃথিবী মানুষ সকলের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল, তখন চন্দ্রা এইভাবে উন্মুক্ত পৃথিবীতে ঝলসে বেড়িয়েছে।

সুনীলের হঠাৎ মনে হল কলকাতা শহরে প্রতিনিয়তই যানবাহন দুর্ঘটনা ঘটে।

.

একটু আগেই বাড়ির পিছন দিকটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছে পিছনে, খানিকটা পরিত্যক্ত জমি বাড়ি তৈরির আমল থেকে পড়ে আছে, সেটা আগাছার জঙ্গলে ভরে আছে।

আহা এতটা জমি, কত ভাল ভাল গাছ হতে পারে। সুনীল ওটা ফুলবাগান করে ফেলবে। এখন সেই ইচ্ছেটা হাস্যকর মনে হল।

সুনীল হঠাৎ তিনতলায় উঠে গেল, ঘরের পরদাটা টেনে দিয়ে চার টেবিল ড্রয়ার আলমারি সব কিছু উটকে দেখতে শুরু করল।

সুনীলের যেন মনে হচ্ছে, উটকোতে উটকোতে ভয়ানক একটা কিছু পেয়ে যাবে।..কারও ফটো, কোনও প্রেমপত্র, কোনও গোপন মিলনের প্রমাণলিপি।

.

ওমা, এত উটকে পাটকে কী খুঁজছ গো?

পরদা ঠেলে রমলা মুখটা বাড়াল।

বউ থাকতে থাকতে কী দরকার-টরকার বলে বার করিয়ে নিও বাপু। পুরুষমানুষ, যতই তোলপাড় করুক, কিচ্ছু খুঁজে পায় না। জানি তো!

রমলাকে চিরদিনই সুনীল কি নার দলে রাখত। বোকাসোকা বলে কৃপা করত, কিন্তু জেলখানার অসহনীয়তা রমলাই দূর করেছে বেশি। রমলাই নিয়মিত গেছে। সেজেগুজেই যাক, আর বোকা বোকা কথা বলে বাজে ঠাট্টা কৌতুক করুক, তবু যেত তো।

ভবানীবাবুও তো বেশি যেতে পারতেন না, অপর্ণা নয়, চন্দ্রার কথা তো বাদই দাও। অতএব রমলার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই সুনীলের।

বুদ্ধি না থাক হৃদয় আছে ওর। আছে সহানুভূতি।

আর সত্যি বলতে, এখন যেন আর তেমন বোকাও লাগে না।

নিজের বুদ্ধিবৃত্তি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে বলেই কি লাগে না।

ঘরে যে কটা ড্রয়ার আছে, ড্রেসিং টেবিলের, আলমারির, খোকনের ছোট্ট লকারের, সব খোলা হাঁ হাঁ করছে, বিছানার উপর কাপড় জামা কাগজপত্রের স্তূপ।

রমলা বোকা বলে এমন বোকা নয় যে রহস্যটা অনুমান করতে পারবে না, তবু রমলা বোকার মতোই মুখ করে বলে, হঠাৎ কোন দ্রব্যের দরকার পড়ল বলল তো? দেখি যদি আমার কাছে থাকে।

সুনীল খাটের উপর বসে পড়ে বলল, না, তোমার কাছে পাওয়া যাবে না। আমার কটা সার্টিফিকেট ছিল, খুঁজছি।

.

রাত্রে খোকার দোলনা খাটের মশারিটি ভাল করে খুঁজে, মাথার জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে, এবং পাখার স্পিড কমিয়ে ধীরেসুস্থে খাটের উপর এসে বসে চন্দ্রা, গভীর গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, সারা ঘর তছনছ করে কীসের সার্টিফিকেট খুঁজছিলে?

সুনীল চমকে গেল।

তারপরই রমলার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।

কই বললে না, হঠাৎ কোন সার্টিফিকেটের দরকার পড়ল?

সুনীল অবহেলার ভানে বলল, দরকার কিছু না, হঠাৎ মনে হল, সেগুলো ঠিকমতো আছে তো?

চন্দ্রার ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকা হাসি ফুটে উঠল, শুধু এই? আমি ভাবলাম হঠাৎ বোধহয় কোনও চাকরি-টাকরির সন্ধান পেলে, তক্ষুনি ইন্টারভ্যু দিতে ছুটতে হবে, ওগুলো দরকার?

আচ্ছা এত হৃদয়হীন কেন চন্দ্রা?

আর চন্দ্রা যাকে ভালবাসে, তাকেই বেশি করে বিদ্ধ করতে চায় কেন?

চন্দ্রা কি বোঝে না এখন সুনীলকে চাকরি নিয়ে ব্যঙ্গ করা কত নিষ্ঠুরতা?

সুনীলের মুখটা যে কালি মেড়ে গেল, তা দেখতে পেল না ও?

চন্দ্রা তো তার রাগটা অন্য কোনও পথে প্রকাশ করতে পারত? অথবা সোজাসুজিই তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের হুল ফুটিয়ে বলতে পারত, কী গো খাটুনির মজুরি পোষাল? পরপুরুষের চিঠি দুদশখানা বার করতে পারলে স্ত্রীর বাক্স থেকে?

না, সেই সোজা পথে গেল না চন্দ্রা।

চন্দ্রা নিষ্ঠুরতা আর নির্লজ্জতার পথে গেল।

চন্দ্রা বলল, প্রাণে বড় আশা হচ্ছিল।

সুনীল এই নিষ্ঠুরা রূপবতীর নিটোল সৌন্দর্যের দিকে জ্বালাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, রূপসী যৌবনবতীরা যত সহজে চাকরি পায়, অভাগারা কি আর তা পায়?

বলল।

সেই সুনীল। মাত্র আড়াইটে বছর আগে যে ছেলেটা কল্পনাও করতে পারত না এ রকম ভাষায় কথা বলবে।

চন্দ্রাও কি ভাবতে পারত সে তার স্বামীর মুখের উপর হেসে বলে উঠতে পারে, তা হলেই বোঝো? বিদ্যে ডিগ্রি, পাশের সার্টিফিকেট, এ সবের থেকে দামি মূলধন কী?

সুনীলের হাতটা নিশপিশ করে।

সুনীলের ইচ্ছে হয় ওই কোমল কমনীয় কণ্ঠখানি এই নিশপিশ করা হাতদুটো দিয়ে চেপে ধরে।

আর বোধ করি এই হিংস্র ইচ্ছার বিকল্পেই দুটো হাত বাড়িয়ে সাঁড়াশির মতো আঙুল দিয়ে চেপে ওই পেলব সুকুমার নিটোল দেহখানাকে টেনে নেয় নিজের আয়ত্তের মধ্যে।

তীক্ষ্ণ কথার পিঠে তীক্ষ্ণ কথা বসিয়ে বসিয়ে যে লড়াইটা হচ্ছিল, কথার সূত্রেই হয়তো সে লড়াইয়ে একটা সন্ধিও হতে পারত। হয়তো হঠাৎ কেঁদে ভেঙে পড়ে বলে ফেলত চন্দ্রা, তুমি কী হয়ে গেছ গো? কী বদলে গেছ?..

অথবা সুনীলই তার বিস্মৃত সত্তাকে খুঁজে পেয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলত, তুমি এত বদলে গেলে কী করে চন্দ্রা?…না কি আমিই বদলে গেছি।

কিন্তু সুনীল তার হারানো সত্তাকে খোঁজবার চেষ্টা করল না, সুনীল তার দীর্ঘদিনের অবদমিত ক্ষুধার আগুনকে আরও জ্বালিয়ে তুলল লোভ আর আক্রোশের আহুতিতে।

চন্দ্রার মধ্যে এই অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কা ছিল না। চন্দ্রা চাপা গর্জনে বলল, ছেড়ে দাও।

কেন ছেড়ে দেব?

সুনীলও তেমনি চাপা গর্জনে বলে, কেন ছেড়ে দেব? দিনেও ছেড়ে দেব, রাতেও ছেড়ে দেব?

তুমি, তুমি একটা জানোয়ার হয়ে গেছ–হাঁপাতে থাকে চন্দ্রা খোকা জেগে উঠবে—

উঠুক। বয়ে গেল।

বয়ে গেল!

চন্দ্রা হঠাৎ জোর ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়, সুনীল পড়ে যেতে যেতে রয়ে যায় খাটের বাজু চেপে ধরে।

চন্দ্রা সেদিকে তাকায় না, ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।

আর চন্দ্রার সমস্ত চেতনার উপর একটা বিদ্যুতের আঘাত এসে স্নায়ু শিরা সব কিছুতে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়।…

শালি হারামজাদি!

অস্ফুট, তবু স্পষ্ট!

এ কণ্ঠস্বর সুনীলের, না তার প্রেতাত্মার।

শূন্য ঘরে খোলা জানলাটার ধারে দাঁড়িয়ে সুনীল নিজেও ওই কথাই ভাবে, এই লোকটা কি আমি? না আমার প্রেতাত্মা?…আমি জানি না কেন এমন হয়! বুঝতে পারি না হঠাৎ কী ঘটে যায়!…

ঠিক বলেছে চন্দ্রা, আমি একটা জানোয়ার বনে গেছি। আমি আর এই ভদ্রজীবনের যোগ্য নেই।

অথবা সবই ঠিক আছে হয়তো, শুধু চন্দ্রার ওই নির্লিপ্ত নিস্পৃহ ভাব আমায় অপমানের জ্বালা ধরিয়ে দেয়, তাই চন্দ্রার ওই নিটোল স্বাস্থ্য, তীব্র রূপ আমায় ক্ষেপিয়ে তোলে।…আমার সন্দেহ হয়, আমার যন্ত্রণা হয়।…আমার হাহাকার আসে, দুর্ভাগ্য আমার হাত থেকে যে জীবনটাকে কেড়ে নিয়ে আমায় দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, ফিরে এসে সেই জীবনটাকে আমি আর পেলাম না। তাই আমার মধ্যে একটা আগুনের জ্বালা আমায় স্থির থাকতে দেয় না।

আমি আর কোনওদিন আমার বাবার সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করবার মতো গল্প খুঁজে পাব না, আমি তেমন অবলীলায় মার সঙ্গে খুনসুড়ি করে তাঁকে খেপাতে পারব না, আমি আর আমার দাদাকে মনে মনে অবজ্ঞা আর করুণা করবার সুখটুকু পাব না, আমি চন্দ্রা আর বউদির তুলনামূলক সমালোচনা করে নিজের দাদার থেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান মনে করতে পারব না। আমি আর কোনওদিন আমার বন্ধুসমাজে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারব না, আত্মীয়সমাজে সহজ হয়ে মিশতে পারব না, আমার বাড়ির চাকর বাকরদের গলা তুলে ডাক দিতে পারব না।

আমি এযাবৎকাল যা যা করে এসেছি অবাধ উল্লাসে, তার কিছুই করতে পারব না।

আর চন্দ্রাকে?

নাঃ কোনওদিনই হয়তো ফিরে পাব না তাকে? আমিই তাকে আছড়ে ভাঙলাম।…আমি তার সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করলাম, আমি এইমাত্র ইতরের মতো তাকে গাল দিলাম।

আশ্চর্য! আমার মুখ দিয়ে ও রকম ইতর কথা বার হল?

তাও চন্দ্রার সম্বন্ধে?

ভবানী রায়ের ছেলে সুনীল রায় তার স্ত্রীকে ইতর ভাষায় গালি দিল।

সুনীলের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল অঝোর ধারায়।

কিন্তু এ অশ্রু জলের সাক্ষী রইল না কেউ, এ অনুতাপ কারও অনুভবের মধ্যে ধরা দিল না।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress