Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » লাল জঙ্গল || Sunil Gangopadhyay

লাল জঙ্গল || Sunil Gangopadhyay

লাল জঙ্গল

চান করবার জন্যে বাথরুমে ঢুকলেই দিপুর প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায়। মা, বাবা, দিদি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এই সময় সকলেরই ইস্কুল-কলেজ-অফিস যাওয়ার তাড়া। এখনকি বেশিক্ষণ বাথরুম আটকে রাখলে চলে? দিদি আর মা ঘুরে ফিরে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলেন, এই দিপু, তোর হল? এতক্ষণ কী করছিস? এইবার বেরো!

দিপু কোনও উত্তর দেয় না।

বাথরুমে ঢুকলেই দিপু নানারকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্ন তো যে-কোনও জায়গাতেই দেখা যায়। তবু বাথরুমের ছোট্ট ঘরটায় দরজা-জানলা বন্ধ করে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার যেন বেশি সুবিধে হয়। মাথার ওপর শাওয়ারটা খুলে দিয়ে সে সামনের সাদা দেওয়ালের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তখন দেওয়ালটা হয়ে যায় ছায়াছবির পর্দা। দিপু তার ওপরে মনে-মনে সিনেমা বানায়!

কল্পনায় দিপু সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আকাশে উড়ে বেড়াতে। প্লেনে, হেলিকপ্টারে বা প্যারাসুটে নয়, এমনকী পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চেপেও নয়। দিপু নিজেই একটা উড়ন্ত যান তৈরি করে ফেলেছে মনে-মনে। কাগজে সেই উড়ন্ত যানটার ছবিও সে এঁকেছে অনেকবার; বড়মামাদের বাড়িতে দিপু একটা পোরসিলিনের বাথটাব দেখেছিল। পুরোনো আমলের জিনিস, বাইরেটা বেশ কারুকার্য করা। দিপুর উড়ন্ত যানের তলাটা ঠিক ওই বাথটাবের মতন, আর ওপরটা কাঁচ দিয়ে ঢাকা। সেই কাঁচের দেয়াল প্রায় দু-মানুষ লম্বা, ভেতরে সিঁড়ি আর দুটি জানলা আছে।

দিপু যখনই ইচ্ছে করে তখনই এই উড়ন্ত যানটা তার কাছে এসে উপস্থিত হয়। তারপর সে ঘুরতে বেরোয়। কোনওদিন এভারেস্টের চূড়ায়, কোনওদিন সমুদ্রের বুকে। কোনও দ্বীপে।

মনে-মনে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে দিপু বুঝতে পারে যে ভূগোল বইতে বা ম্যাপে কোনও উল্লেখ নেই এমন অনেক জায়গাই এখনও পৃথিবীতে আছে। যেমন এই তো গতকালই দিপু নেপালের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে ধওলাগিরি শৃঙ্গ পেরিয়ে একটা উপত্যকা দেখতে পেল, যেখানে সবকটা গাছের রং লাল। এর আগে কেউ তো পুরোপুরি লাল রঙের একটা জঙ্গলের কথা বলেনি।

দিপু অনেকক্ষণ ছিল সেই উপত্যকায়।

সেই জঙ্গলে দিপু অতিকায় পাখির মতন এক ধরনের রহস্যময় প্রাণীও দেখতে পাচ্ছিল, কিন্তু বেশিক্ষণ দেখা হল না। তার আগেই দিদি ধাক্কা মেরে দিল বাথরুমের দরজায়।

কল্পনার জগতে যে কোনও ম্যাপ থাকে না, সেইটাই যা মুস্কিল। তার পরের দিন দিপু আর সেই লাল জঙ্গলটা খুঁজে পায় না। তার রকেট চালিয়ে সে নেপালের পাহাড়ি উপত্যকায় অনেক ঘোরাঘুরি করল কিন্তু সেই লাল জঙ্গলের কোনও চিহ্নই নেই। সেটা কোথায় হারিয়ে গেছে।

শুধু বাথরুমে কেন, স্কুলের ক্লাসে বসে কিংবা ঘুড়ি ওড়াবার জন্য ছাদে গিয়েও দিপু এমন অনেক কিছু দেখতে পায় যা অন্য কেউ দেখে না। যেমন সে একদিন দেখেছিল তাদের ভূগোলের টিচারের দুটি ডানা স্মেছে।

ভূগোলের টিচার জ্যোতিপ্রকাশবাবু পড়ান বেশ ভালো, কিন্তু মানুষটি কেমন যেন অদ্ভুত। তিনি ক্লাসে পড়ানো ছাড়া আর একটাও অন্য কথা বলেন না। কখনও হাসেন। না। প্রায়ই জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাইরের দিকে। যেন তার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও।

দিপু একদিন দেখল, ছুটির পর জ্যোতিপ্রকাশবাবু স্কুলের পেছনের দিকে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আস্তে-আস্তে তার দু-হাতের পাশ দিয়ে দুটি ডানা ফুটে বেরুল। বেশ বড় ডানা। বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের মতন। গরুড়ের যেমন ডানা আছে, হাতও আছে, সেইরকম।

ভূগোলের টিচারের সেরকম ডানা দেখে সে আশ্চর্য হয়নি। এরকম তো হতেই পারে।

কিন্তু জ্যোতিপ্রকাশবাবু সেই ডানা মেলে ওড়বার উদ্যোগ করে একবার পেছন ফিরে তাকালেন। অমনি দিপুর সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হয়ে গেল।

তিনি সঙ্গে-সঙ্গে গলা খাঁকারি দিয়ে ডানা গুটিয়ে ফেললেন, তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন নিচে।

দিপু ঠিক করেছিল ভূগোলের স্যারের সঙ্গে এই ডানার বিষয়ে একদিন আলোচনা করবে। তিনি যদি শিখিয়ে দেন যে কী করে ডানা গজাতে হয়, তাহলে বেশ হয়।

কিন্তু দিপু সে সুযোগ আর পেল না। কয়েকদিন পর থেকেই জ্যোতিপ্রকাশবাবু স্কুলে আসা একেবারে বন্ধ করে দিলেন। তারপর জানা গেল তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। তার বাড়ির লোকও কেউ বলতে পারে না যে তিনি কোথায় চলে গেছেন বা কোথায় যেতে পারেন। পুলিশে খবর দিয়েও কোনও লাভ হল না।

একমাত্র দিপু জানে ভূগোলের টিচারের কী হয়েছে। জ্যোতিপ্রকাশবাবু মাঝে-মাঝেই গোপন ডানা মেলে অনেক দূরে-দূরে বেড়াতে যেতেন। একদিন ওইরকম কোথাও গিয়ে ফেরার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন। কিংবা এবারে যেখানে গেছেন সেই জায়গাটাই এত পছন্দ হয়ে গেছে যে আর ফিরে আসতে মন চাইছে না।

এই কথা বললে অবশ্য কেউ বিশ্বাস করবে না। দিপুকে ভাববে পাগল কিংবা গুলবাজ। কিন্তু দিপু যে একদিন নিজের চোখে ভূগোলের টিচারের ডানা বেরুতে দেখেছে।

আর একদিন দিপু ছাদে বসে আছে একা। খুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। দুটো শালিক কার্নিসে বসে কিচির-মিচির করছে। বিকেল হয়ে আসছে, আকাশের মেঘ রং বদলাচ্ছে। দিপু প্রায়ই এই সময়টায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। তার ধারণা হঠাৎ মেঘের আড়ালে কোনও একদিন একটা কিছু দেখা যাবে।

সেরকম কিছু দেখতে পেল না অবশ্য, কিন্তু একসময় সে শুনতে পেল, একটা শালিক আর একটা শালিককে বলছে, আর বলিস না… আর বলিস না, ওই ছেলেটা সব বুঝতে পেরে যাবে।

দিপু চমকে তাকাল। শালিকরা ওই কথা বলছে কেন? সে কী বুঝতে পারবে? শালিকদের বুঝি গোপন কথা থাকে?

তারপর সে আরও চমকে গেল এইজন্য যে, শালিকটা মানুষের ভাষায় কথা বলে উঠল কী করে?

সে উঠে দাঁড়াতেই শালিক দুটি তার দিকে তাকিয়ে ঠিক যেন মুচকি হেসে পিড়িং করে উড়ে গেল।

দিপু খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল। শালিকরা মানুষের ভাষা শিখে নিতে পারে? মানুষের কাছাকাছিই তো ওরা থাকে। রোজ মানুষের কথা শোনে। কিন্তু কোন জিনিসটা ওরা দিপুর কাছ থেকে গোপন করতে চাইছিল?

এই ঘটনাটাও দিপু কারুকে জানাতে পারেনি। যে কেউ শুনলেই বলবে, দিপু ভুল শুনেছে।

এইসব রহস্যময় ব্যাপারের চেয়েও বাথরুমের দেয়ালটাকে সিনেমার পর্দার মতন করে নিয়ে দিপু যখন কল্পনার জগতে উড়ে যায়, তখন সে অনেক বেশি আনন্দ পায়।

তার বাথটাবের মতন আকাশ যানটিকে সে এক-একদিন নতুনভাবে সাজায়। কাঁচের গোল ঘরটাতে আগে সিঁড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না। একদিন সে সিঁড়িটার গায়ে লতানে গাছ জড়িয়ে দিল। লাল গাছ নয় অবশ্য, সবুজ।

চার্লি-চ্যাপলিনের একটা পোস্টার-ছবি দিপুর খুব প্রিয়। একদিন সেই ছবিটাকেও রকেটে নিয়ে নিল।

দিপুর একটা মুস্কিল হয়ে গেল পুজোর ছুটিতে।

বাবা সবাইকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন মধ্যপ্রদেশে। মা, বাবা, দিদি আর সে। ছোটমামা দন্ডকারণ্যে চাকরি নিয়েছেন, তিনিই নেমন্তন্ন করেছেন।

দিপুর অবশ্য ট্রেনে বেড়াতেও খুব ভালো লাগে। সবচেয়ে ভালো লাগে রাত্তির বেলা। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ছুটে যায় ট্রেন। সামনে কী আছে কেউ জানে না। রাত্তির বেলা চলন্ত ট্রেনে ঘুম আসে না, দিপু জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে।

রায়পুরে নেমে নেওয়া হল একটা জিপ। তারপর অনেক দূরের পথ। যেতে যেতে জঙ্গল, পাহাড় কত কী পার হয়ে যেতে হল।

প্রায় গোটা একবেলা পার করে ওরা পৌঁছলো জগদলপুরে। সেখানে ছোটমামা অপেক্ষা করছিলেন।

এককালে বাস্তার নামে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। এই জগদলপুর ছিল তার রাজধানী। এখন তো আর রাজাদের রাজত্ব নেই, আর বাস্তার এখন মধ্যপ্রদেশের একটি জেলা। জগদলপুরকে দেখেও আগেকার রাজধানীর কিছুই চেনা যায় না, শুধু পুরোনো দু-একটা বাড়ি চোখে পড়ে।

শহরটা দেখে বাবার পছন্দ হল না। তিনি ছোটমামাকে বললেন, এ কোথায় নিয়ে এলে? এই যে শুনেছিলুম তুমি মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে থাকো?

ছোটমামা হেসে বললেন, জঙ্গলে থাকলে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনীয়ারের চাকরি করা যায়? ঠিক আছে, চিন্তা করবেন না। জামাইবাবু, আপনাদের জন্য আমি জঙ্গলে থাকারই ব্যবস্থা করে রেখেছি।

জগদলপুরে দু-দিন থেকে ওরা চলে এল সেখান থেকে বাইশ মাইল দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক বাংলোতে। বাংলোটি বেশ সুন্দর। সামনে বাগান, পেছন দিকে পাহাড়।

জায়গাটা সকলেরই বেস পছন্দ হল, অসুবিধে হল শুধু দিপুর। এই বাংলোর সবই ভালো, শুধু বাথরুমটা অন্ধকার।

আগেকার দিনের তৈরি বাড়ি, বাথরুমটাও শোওয়ার ঘরের মতন বড়। কিন্তু তাতে জানলা নেই। ওপরের দিকে আছে স্কাই-লাইটের কাঁচ। কিন্তু কদিন ধরেই আকাশ মেঘলা বলে আলো আসে না। এ বাংলোতে ইলেকট্রিসিটিও নেই যে লাইট জ্বালা যাবে।

স্নান করতে গিয়ে দিপু বাথরুমের দেয়ালের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু দেয়ালটা ভালো দেখা যায় না বলে সেটা সিনেমার পর্দা হয়ে ওঠে না।

স্নানের আগে কিছুক্ষণ বাথটাবের মতন আকাশযানে শূন্যে উড়ে আসা দিপুর অভ্যাস। এখন আর সেটি হচ্ছে না। দিপু কিছুতেই তার আকাশযানকে দেখতে পাচ্ছে না। এমনকী চোখ বুজলেও সে দেখতে পায় না।

এরজন্য দিপুর যে কী কষ্ট তা অন্য কেউ বুঝবে না!

একদিন গেল, দুদিন গেল, তৃতীয় দিন তো সারাদিনই টিপির-টিপির বৃষ্টি। দিপুর মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেছে। অন্য কারুর সঙ্গে তার কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না।

বৃষ্টির দিনে দিদি স্নান করে না। বাবাও বাদ দিয়ে দেন। সুতরাং বাথরুম বেশিক্ষণ আটকে রাখলে কোনও অসুবিধেই নেই। কিন্তু স্নান করতে এসে দিপুর কান্না পেয়ে গেল।

বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করলে এমন অন্ধকার হয়ে গেল যে দিপু প্রায় নিজেকেই দেখতে পায় না, দেয়াল দেখবে কি? আজও সে উড়তে পারবে না! আকাশযানটা কি কলকাতা ছেড়ে বাইরে এসে আর দিপুর দখলে থাকবে না?

দিপু সেই অন্ধকারের আবছা দেয়ালের সামনেই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর খুব মন দিয়ে আকাশযানটার কথা ধ্যান করতে লাগল। ওকে আসতেই হবে এখানে।

কিন্তু কিছুতেই আসছে না। দিপু দেয়ালে কোনও ছবি দেখতে পাচ্ছে না।

বাথরুমের দরজাটা খুলে দিল, তাতে একটু আলো হল। দিপু আবার তীব্র মনোযোগ দিয়ে তার বাথটাব আকাশযানটার কথা চিন্তা করতে লাগল বেশ খানিকক্ষণ ধরে। তাতেও সে ব্যর্থ হল। নোনাধরা দেওয়ালটাতে শুদু ফাটা-ফাটা দাগ, তাতে কোনও ছবিই ফোটে না।

সেদিন দুপুর তিনটের সময় খেয়ে-দেয়ে সবাই যখন একটু শুয়েছে, দিপু একা বেরিয়ে পড়ল বাংলো থেকে। বৃষ্টি তখনও পড়ছে, তবু দিপুর ভূক্ষেপ নেই। কেউ যেন তাকে ডাকছে, যেতেই হবে।

বাংলোটার সামনের রাস্তা পেরুলেই জঙ্গল। প্রথমে পাতলা-পাতলা, তারপর গভীর।

দিপু ঢুকে পড়ল সেই জঙ্গলের মধ্যে। দূরে দড়-দড় করে জলের শব্দ হচ্ছে। ওখানে একটা ছোট ঝর্ণা আছে। সেখানেই যেন যেতে হবে দিপুকে।

ঝর্ণার কাছে জঙ্গলটা একটু ফাঁকা। দিপু দূর থেকে দেখল, ঝর্ণার পাশে তার বয়েসি একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

দিপুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছেলেটি হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল।

আরও কাছে গিয়ে দিপু দারুণ অবাক হয়ে বলে উঠল, এ কি!

ছেলেটি শুধু যে দিপুর সমবয়েসী তাই-ই নয়, তাকে অবিক দিপুর মতনই দেখতে। মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত পুরোপুরি মিল আছে।

ছেলেটি একটু হেসে বলল, কেমন আছো দিপু?

দিপু বলল, তুমি…তুমি..মানে…তুমি কে? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?

ছেলেটি বলল, মোটেই স্বপ্ন দেখছ না। গায়ে চিমটি কেটে দ্যাখো। আমি তোমার প্রতিভাস।

দিপু বলল, তার মানে?

ছেলেটি বলল, তুমি প্রতিভাস গ্রহের নাম শোনওনি? তোমরা, পৃথিবীর মানুষরা বড় পিছিয়ে আছো?

দিপু তবু কিছু বুঝতে পারছে না। সে অনেক অদ্ভুত, অলৌকিক দৃশ্য দেখে, কিন্তু এটা সে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। ছেলেটি কি অন্য গ্রহ থেকে এসেছে? তা আসতে পারে। তাতে এত আশ্চর্য হবার কিছু নেই। মানুষ চাঁদে পোঁছে গেছে, কিছুদিন পরে অন্য গ্রহতেও যাবে। অন্যান্য গ্রহের মানুষ বা অন্য কোনও প্রাণী থাকলে তারাও পৃথিবীতে আসতে পারে। কিন্তু এর চেহারা দিপুর মতন হবে কী করে? এমনকী পোশাক পর্যন্ত একরকম!

ছেলেটি যেন দিপুর মনের কথা বুঝতে পারল।

সে হেসে বলল, শুধু চেহারা আর পোশই এক নয়, আমার নামও দিপু।

দিপু বলল, তা হলে এটা নির্ঘাৎ স্বপ্ন।

ছেলেটি বলল, মোটেই স্বপ্ন নয়। তোমাদের পৃথিবীতে যা-যা আছে, আমাদের প্রতিভাস গ্রহে অবিকল সেই সবই আছে। আমাদের অবশ্য দু-চারটে জিনিস আছে, সেগুলো তোমরা মাঝে-মাঝে কল্পনা করে পুষিয়ে নিচ্ছ। যেমন…

ছেলেটি হঠাৎ থেমে গিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।

দিপুর প্রথমে একটু ভয় লাগছিল, এবারে সে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির গায়ে হাত রাখল। হ্যাঁ, রক্ত-মাংসেরই মানুষ–স্বপ্ন নয়, ছায়া নয়।

দিপু বলল, ব্যাপারটা কী হচ্ছে, একটু বুঝিয়ে দাও তো!

অন্য দিপু বলল, অত বুঝে কী হবে? ধরে নাও না, ঠিক তোমার মতন আর একজন কেউ অন্য কোথাও আছে। তোমার বাবার মতন, তোমার মা, দিদি, ছোটমামা সকলেরই মতনই এক-একজন আমাদের ওখানে আছে।

–সত্যি?

–আমি তো মিথ্যে কথা বলতে এখানে আসিনি। বরং তোমাকে একটু সাহায্য করতে এসেছি।

–কী সাহায্য?

–আমার একটা শূন্য যান আছে, সেটা ঠিক বাথটাবের মতন দেখতে। ওপরে কাঁচের গোলঘর, ভেতরে সিঁড়ি।

–অ্যাঁ! কী বলছ তুমি?

–আমার ওই শূন্য যানটিকে তুমি প্রায়ই কল্পনা করতে। আজ তুমি এমন তীব্রভাবে কল্পনা করছিলে যে আমার যানটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। জানো তো, খুব মন দিয়ে কোনও কিছু চাইলে তো ঠিকই পাওয়া যায়। তোমার জন্য ওটা আমি নিয়ে এসেছি।

–ওটা মানে?

–আমার বাথটাব আকাশ-যান। দেখবে এসো। দিপুর হাত ধরে অন্য দিপু নিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।

একটা ফাঁকা জায়গায় পড়ে আছ পোর্সিলিনের বিরাট একটা বাথটাব, তার ওপরে কাচের গোল ঘর। ভেতরে কাঠের সিঁড়ি, তাতে লতানো গাছ জড়ানো। কাঁচের দেওয়ালে সাঁটা একটা চার্লি চ্যাপলিনের পোস্টার।

অন্য দিপু তার দরজা খুলে দিপুকে বলল, চলো, একটু ঘুরে আসা যাক!

দিপু বলল, এখনও বলছ আমি স্বপ্ন দেখছি? তোমার আকাশযানে আমার ঘরের চার্লি চ্যাপলিনের ছবি কী করে এল?

অন্য দিপু বলল, এটা এমন আর কী শক্ত কাজ! তুমি যে-যে জিনিস খুব বেশি চাও কল্পনায়, সেটা আমি তৈরি করে নিই। তোমাকেও সেরকম করতে হয়। যেমন, আমি যখন খুব কল্পনা করি যে-কোনও পাখি মানুষের ভাষায় কথা বলছে, তখন তুমি সেটা সত্যি-সত্যি শুনতে পাও।

–আমি এখন বিশ্বাস করতে পারছি না।

–বিশ্বাসের দরকার নেই। কোথায় ঘুরে আসতে চাও বলো।

–তুমি আমাকে লাল জঙ্গল দেখাতে পার?

অন্য দিপু চমকে উঠে বলল, আবার লাল জঙ্গল। একবার দেখেছিলে, তাতে শখ মেটেনি?

–মোটে একটুখানি দেখেছিলুম।

–ওই যথেষ্ট। না, লাল জঙ্গল থাক, চলো, অন্যকোথাও যাই। উত্তর মেরুতে যাবে?

–সেখানে তো খুব শীত। কেন, লাল জঙ্গলে যেতে চাইছ না কেন?

–সে বড় সাংঘাতিক জায়গা। সেখানে গেলে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। তুমি তো যাওনি, আমি গিয়েছিলুম একদিন, তুমি শুধু কল্পনায় দেখেছ। আমি অতি কষ্টে ফিরিয়ে এনেছি নিজেকে।

–সেখানে ভয়ের কী আছে? খুব বড়-বড় পাখি দেখেছিলুম!

–ওগুলো পাখি নয়। লাল জঙ্গলে ভয়ের কিছু নেই। বিপদও নেই। কিন্তু কিছু একটা জাদু আছে। চুম্বকের মতন টেনে রাখে।

–যদি যেতে হয় তো আমি ওখানেই যাব।

–তুমি দেখছি ঠিক আমারই মতন জেদি। চলো তা হলে। কিন্তু খুব সাবধান। যখন ফিরতে বলব, তখনই ফিরবে।

দুজনে ভেতরে ঢুকতেই আকাশ-যানটা আকাশে উঠে গেল। কোনও ইঞ্জিন নেই, মেশিনঘর নেই, ওটা ইচ্ছাশক্তিতে চলে।

জঙ্গল, পাহাড়, নদী পেরিয়ে সেটা মুহূর্তে বহু দূরে চলে গেল। বহু উঁচুতে উঠে তারপর আস্তে-আস্তে নামতে লাগল নিচের দিকে।

অন্য দিপু বলল, ব্যস, আর নয়। এবার চেয়ে দ্যাখো।

দিপু দেখল, নিচের পাহাড়ি উপত্যকা থেকে একটা লাল আভা আসছে শুধু। গাছগুলোকে ভালো দেখা যাচ্ছে না।

দিপু বলল, আর একটু নিচে নামো।

–না থাক, আর দরকার নেই।

–গাছগুলোকে যে দেখতেই পাচ্ছি না!

–বেশি নিচে নামব না কিন্তু।

আর-একটু নিচে নামার পর দেখা গেল বড়-বড় গাছ। টকটতে আগুনের মতন লাল তাদের পাতার রং। মাঝখান দিয়ে একটি নদী বইছে, তার জলের রং সোনালি। সেই নদীর ওপরে উড়ছে কয়েকটা খুব বড়-বড় পাখি।

দিপু জিগ্যেস করল, ওগুলো কি পাখি?

–ওটা পাখি নয়, মানুষ।

–অ্যাঁ! কী বলছ?

–ঠিকই বলছি। চলো, ফিরে যাই।

–না, আর একটু নিচে নামব।

দুজনের দুরকম কথায় আকাশযানটা মজার ব্যবহার করতে লাগল। যেই একজন বলে ফিরে যাই, অমনি সেটা ওপরে উঠতে শুরু করে। আর যেই অন্যজন বলে নিচে নামবো, অমনি আকাশ-যানটা আপনি-আপনি নেমে যায় আবার।

একবার অনেকখানি নিচে নেমে এসে দিপু সেই মানুষ পাখিগুলোর মুখ দেখতে পেল। তার মধ্যে একটি মুখ তার খুব চেনা। তাদের সেই ভূগোল টিচার জ্যোতিপ্রকাশবাবু!

দিপু চেঁচিয়ে উঠল, স্যার!

অন্য দিপু বলল, ডেকো না। ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে নেই!

দিপু বলল, আমি নিচে নামব। ওঁদের সঙ্গে কথা বলব।

–না।

–হ্যাঁ, আমি যাবোই। আমি ফিরতে চাই না।

–তোমাকে লাল জঙ্গলের জাদুতে টেনেছে। ফিরে চলো।

–চুপ করো। তোমার কথা শুনতে চাই না।

আকাশ-যানটা ওদের কথা অনুযায়ী একবার উঠছে, একবার নামছে।

একবার খুব নিচে নেমে আসায় দিপু আনন্দে চেঁচিয়ে উঠাল–আমি জিতে গেছি। এবারে আমরা লাল জঙ্গলের মাটিতে নামব।

–তাহলে তোমার কল্পনাশক্তি নষ্ট হয়ে যাবে, তাই চাও?

–অ্যাঁ! কী বললে?

–এখানে কারুর স্মৃতি থাকে না। ওই পাখি-মানুষগুলো ফেরার রাস্তা ভুলে গেছে সেইজন্য। এখানে কেউ কিছু কল্পনা করে না। এখানে বাথরুমের দেয়াল নেই

দিপু বলে উঠল, তা হলে নিচে নামব না। এবার আমরা ফিরব।

অন্য দিপুও চেঁচিয়ে উঠল, ফিরব, ফিরব।

আকাশ-যানটা আবার শোঁ-শো করে ওপরে উঠে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *