লালন কথা
সময়ের এই জটিল সন্ধিক্ষণে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে জাতিগত বিদ্বেষ সম্প্রসারণের পথে দ্রুত ধাবিত , তখন যার কথা খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, তার নাম মহাত্মা ‘লালন ফকির’। তাঁর জীবন দর্শন নিয়ে আলোচনা ও ভাবনার সময় এসেছে আবার নতুন করে।
লালনের জন্মবৃত্তান্ত কুহেলিকাময়। তাঁর
জীবন সম্পর্কে বিষদ কিছু জানা যায় না।
তিনি নিজেও জীবদ্দশায় এ’বিষয়ে আলোচনায় খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। শিষ্যরা এ’বিষয়ে তার কাছে বেশী কিছু জানতে পারেননি। তবে তাঁর সম্পর্কে যায় শোনা যায়, তিনি অবিভক্ত বাংলার ঝিনাইদহ জেলার, হরিণাকুন্ড উপজেলার হবিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
কোন কোন লালন গবেষক মতে, কুষ্টিয়ার কুমীরখালি থানার চাপড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। লালনের জন্ম কেউ বলেন – ১৭৭২ সালে, আবার কেউ বলেন ১৭৭৪ সালে। তার মৃত্যু হয় ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর। আবার কেউ বলেন, ১৮৯১ সালের ১৭ই অক্টোবর।
লালন নিজে একজন স্বনাম ধন্য মানুষ ছিলেন। কবিগুরু তার গান ও নাম প্রচারের আলোয় আনেন। তিনি তার গানের মানবিক ভাব দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে প্রায় দেড় শতাধিক গান রচনা করেন। তিনি লালনের কথা বারবারই নানা আলোচনায় প্রকাশ করেছেন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ,সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের পরিচয় ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের একটি প্রতিকৃতি আঁকেন। সেটা আজও রক্ষিত আছে। নন্দলাল পরবর্তীকালে লালনের একটি স্কেচ আঁকেন। সেটি বহুল প্রচারিত।
কেউ বলেন,নতার পদবী দাস, কেউ বলেন সেন, কেউ বলেন কর, আবার কেউ বলেন তার পদবী শাহ ছিল। কেউ বলেন তিনি হিন্দু, কেউ আবার বলেন তিনি মুসলমান ছিলেন। লালন নিজে অবশ্য তাকে ফকির বলে পরিচয় দিতেন।
” সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?
লালন বলে,জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে,
ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,নারী লোকের হয় কি বিধান?
বামুন চিনি পৈতায় বামনী চিনি কি দেখে?
কেউ মালা কেউ তসবির গলে, তাই দেখে জাত ভিন্ন বলে . . . “
শোনা যায়, তিনি একবার বাউল দাসের সঙ্গে তীর্থ ভ্রমণে বার হন, পথের মধ্যে তার গুটিবসন্ত রোগ হয়। মারত্মক আকার ধারণ করে, তার শ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসে, তখন তার নাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে, সহ-তীর্থযাত্রীরা তখন তাঁকে মৃত ভেবে নদীতে ভাসিয়ে দেন। এবং তারা গ্রামে ফিরে এসে বলেন, পথের মধ্যে লালন বসন্ত রোগে মারা গেছেন।
অলৌকিক ভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
যখন তিনি নদীতে ভেসে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে দেখতে পান এক সাত্ত্বিক প্রকৃতির মহিলা (জাতে মুসলমান তাঁতী) নাম মতিজান। তিনি সন্তানহীনা ছিলেন। আল্লার কাছে প্রতিদিন সন্তানের কামনা করতেন। তিনি তাঁকে আল্লার দান মনে করলেন। তিনি যখন তাকে দেখেন,
তার দেহ পঁচাগলা অবস্থায় ছিল।তিনি তাঁকে তুলতে ভরসা পেলেন না। তিনি তার স্বামী মলম শাহকে ডেকে আনলেন, রমলম শাহ তাঁকে কলাপাতায় করে তুলে ঘরে নিয়ে এলেন। তিনি জড়িবুটির চিকিৎসা জানতেন। তার আর তার স্ত্রী মতিজানের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রাণপন সেবা যত্নে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্ত তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তাঁর নাম রাখার জন্য নাকি মলম শাহ কোরাণ হাদিস এনে জড়ো করলে, মতিজান বলেন, এ’সব দিয়ে কি হবে? মলম শাহ বললেন, নতুন অতিথির নাম রাখা হবে।
মতিজান বলল, আমি ওকে লালন পালন করেছি যখন, তখন ওর নাম হবে – লালন।
মতিজানদের পরিবারের গুরু ছিলেন সিরাজ সাঁই। সেখানেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় লালনের।
সুস্থ হয়ে উঠে কিছুদিন সেখানে থাকার পর তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে চাইলে, মতিজান বলল,
হ্যাঁ বাপ, তুমি তোমার বাপ মায়ের কাছে ফিরে যাও।
দেখো তোমায় ফিরে পেয়ে তারা কত খুশি হবেন।
লালন সেইমত নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। কিন্তু তার মা পদ্মাবতী দেবী, (বুক ফেটে গেলেও) সামাজিক প্রতিবন্ধকতার দায়ে, তাকে ঘরে তুলতে পারেননি। তার স্ত্রী তার সহগামী হতে চাইলেও সমাজপতীদের বাঁধায়, তা হতে পারেননি।নফলে, লালন মনে মনে ভীষণ আঘাত পান, পরে সন্যাসী হয়ে নানা স্থানে ঘুরতে ঘুরতে কালীগঙ্গার ধারে ছেঁউড়িয়া গ্রামে একটি বটগাছের নীচে অধিবেশন করেন। এই গ্রামের মলম শাহ একজন স্বাতিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন( সেই মলম শাহ,যিনি তার পঁচাগলা দেহ উদ্ধার করে তাতে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন)। তিনি সেই বটতলা থেকে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন। স্বামী স্ত্রী দু’জনে মিলে ভক্তি ভরে তার সেবাযত্ন করেন। এমন কি নিজের জমিজমা তার নামে লিখে দেন। তারা নিজেরা তাঁর আশ্রমের বাসিন্দা হিসাবে সেখানে বসবাস শুরু করেন। সেখানে কালে কালে তার অনেক শিষ্য জুটে যায়।
লালনের আশ্রমে আম জাম কাঠালের গাছ ছিল।বালকেরা ইচ্ছে মতো সেই বাগানের ফলমূল খেতো, লালন কখনই তাতে বিরক্ত হতেন না। তার আশ্রমের জমি লাখোরাজ ছিল। ইহা রবীন্দ্রনাথের অবদান। পরবর্তী কালে প্রয়োজনে তার কিছুটা বিক্রি করে চার বিঘার উপর নতুন আশ্রমটি গড়ে তোলা হয়। এক মুসলমান তাঁতীকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তাকে লোক চক্ষুর আড়ালে রাখতেন।
শোনা যায় তিনি খুব পান খেতেন, দিনে শতাধিক। তাঁর জন্য একজন শিষ্য সারারাত ধরে মিহি করে সুপারী কাটতেন। তাঁর জন্য নাকি একটা পানের বরোজ ছিল। সেখানে কখনও তিনি কাজ করতেন, কোন কাজে
তার হীনমন্যতা ছিল না।
তার আশ্রমে মণিরুদ্দীন নামে একজন পন্ডিতব্যক্তি পাঠশালা চালাতেন। আর লালন একটি জলচৌকিতে বসে গান করতেন। জলচৌকিটি এখনও আশ্রমে সংরক্ষিত আছে। মোট তিনি ২৮৮ টি গান রচনা করেছেন। সবগুলির সুর দিয়ে যেতে পারেননি। তিনি দেখতে সুপুরুষ ছিলেন।
তার একটি ঘোড়া ছিল। তিনি ঘোড়ায় চড়ে দূরের শিষ্যদের বাড়িতে যেতেন। পন্ডিত মণিরুদ্দীন এই ঘোড়ার সহিস ছিলেন।
লালনের গান রচনা শেষ হলে, তিনি পরের দিন সকালে তার শিষ্যদের তা ডেকে শেখাতেন। আবার সন্ধ্যাবেলা বসতেন সেই গান নিয়ে। শিষ্যদের কাছে তা শুনতে চাইতেন। কেউ কোন ভুলচুক করলে তাকে শংকর মাছের চাবুক দিয়ে নিষ্ঠুর ভাবে প্রহার করতেন, তাতে কারও কারও গা কেটে যেতো।
লালন নিজে বেশী দূর লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। কিন্তু তার গানে মেধা ও মননশীলতার কোন ঘাটতি ছিল না।
” তারে ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।”
কিংবা,
” কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ
যে রে?
হারায়ে সেই মানুষে খুঁজে বেড়াই দেশ বিদেশ . . . “
এই ধরণের বহু জ্ঞানগর্ভ গান তিনি রচনা করেছেন।
তাঁর তেরোজন শিষ্য ছিল, তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই ধনী ও শিক্ষিতব্যক্তি ছিলেন। তারা সকলেই সংসারী ছিলেন। স্ত্রী সহবাস করতেন, কিন্ত স্ত্রীগর্ভে বীজ বপন করেননি। তাদের মিলন উর্দ্ধগমী পদ্ধতিতে হতো। একসময় তারা সকলে ঘর বাড়ি ত্যাগ করে এসে আশ্রমে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে কাটাতেন। তাদের মধ্যে মলম শাহ, ভোলা শাহ, মণিরুদ্দীন শাহ, ভাঙুরানী ফকিরানী উল্লেখযোগ্য।
লালনের গান ও দর্শনদ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, এলেন গীন্সবার্গ (আমেরিকান কবি), তিনি তাঁকে নিয়ে After Lalon নামে একটি কবিতা লেখেন।
১৯৬৩ সালে তার ছেউড়িয়া আখড়া ঘিরে ‘লোক সাহিত্য কেন্দ্র ‘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৮ সালে তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লালন একাডেমী’। তার মৃত্যুদিনে ১৭ই অক্টোবর ‘ লালন স্মরণ উৎসব’ – এ দেশ বিদেশের ভক্তরা এসে উপস্থিত হন। এখন উৎসব চলে পাঁচদিন ব্যাপী।
লালনকে নিয়ে নাটক লেখা হয়েছে,
‘উত্তর লালন চরিত’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়ে খুব সুনাম অর্জন করেছিল। তাকে নিয়ে উপন্যাস লেখা হয়েছে। রঞ্জিত কুমারের লেখা উপন্যাস,
‘সেন বাউল রাজারাম’, সুনীল গাঙ্গুলীর ‘মনের মানুষ’। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গোড়া’-র শুরু লালনের গান দিয়ে-‘ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়।’
সুনির্মল বসু ‘ লালন ফকিরের ভিটে ‘ নামে একটি ছোটগল্প লিখেছন। শওকত ওসমান লালনকে নিয়ে ছোটগল্প লিখেছেন, ‘দুই মুসাফির’।
লালনকে নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। ১৯৭২ সালে সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালনা করেন ‘ লালন ফকির’।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৮৬ সালে ওই একই নামে একটি ডকুমেন্টারী ছবি করেন। তানভির মোকাম্মেল ১৯৯৬ সালে তথ্যচিত্র করেন ‘লালন’ নামে। এটি জাতীয় পুরস্কার পায়। ২০১০ সালে সুনীল গাঙ্গুলীর উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ নির্মান করেন, ‘মনের মানুষ’, যা ওই বছর ‘ জাতীয় সেরা পুরস্কার পায়। ২০১১ সালে মুক্তি পায় হাসিবুর রেজা কল্লোল পরিচালিত ‘ অন্ধ নিরাঙ্গম’।
গান্ধীজীর আগেই তিনি মহত্মা উপাধীতে ভূষিত হয়েছেন। তাকে বাউলদের জনক বলা হয়। উনিশ শতকে তিনি বাউল গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। অধিকাংশ বাউলরাই তাকে ভক্তি শ্রদ্ধার চোখে দেখেন।
তিনি ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। শেষদিকে তিনি চলাফেরা করতে পারতেন না। পেটের অসুখে আর বাতের ব্যথায় ভুগতেন। তার খাদ্য ছিল শুধু দুধ। তিনি সে সময় খুব মাছ খেতে চাইতেন।
তিনি ধর্ম ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধী ছিলেন। ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে তাঁর গানে,নানা প্রশ্ন তোলায়, ধার্মিকরা তাঁকে ঘৃণা করতেন, কাফের ভাবতেন। সাম্প্রদাযিক ধর্মবাদীরা তাকে অসাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা করতেন।
তাই আজ লালন প্রাসঙ্গিকতা আরও বেশী করে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে এই জটিল সময়ের প্রেক্ষাপটে।