রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – হনুমান কর্ত্তৃক রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ
রাম লক্ষ্মণ সুগ্রীব ধার্ম্মিক বিভীষণে।
চারি জনে যুক্তি করে রাবণ না জানে।।
দশানন ভাবে রাম যুঝিতে না পারে।
পলাইয়া যাবে বুঝি ত্যজিয়ে সীতারে।।
এতেক ভাবিয়া রাবণ সুস্থ কৈল বুক।
এখন পাইলে সীতা দুঃখোপরি সুখ।।
মরিয়াছে মেঘনাদ সে মহীরাবণ।
সীতা পেলে সব দুঃখ হয় নিবারণ।।
এত ভাবি দশানন হরষিত হয়।
শ্রীরামেরে উপদেশ বিভীষণ কয়।।
পূর্ব্বের এক কথা প্রভু হইল স্মরণ।
তপস্যা করিনু যবে ভাই তিন জন।।
বর দিতে পদ্মযোনি আইল যখন।
চাহিল অমর বর রাজা দশানন।।
ব্রহ্মা বলিলেন শুন ওহে নিশাচর।
না মাগ অমর বর চাহ অন্য বর।।
দশানন বলে অন্য বর নাহি চাই।
অতুল ঐশ্বর্য্য ধনে কোন কার্য্য নাই।।
ব্রহ্মা বলে দশানন দুঃখ কেন ভাব।
প্রবন্ধেতে দিয়া বর অমর করিব।।
দশমুণ্ড কুড়ি হস্ত কাটা যদি যায়।
তথাপি তোমার মৃত্যু নাহি হবে তায়।।
খণ্ড খণ্ড করে যদি কাটে কলেবর।
তাহে তুমি না মরিবে শুন নিশাচর।।
সংগ্রামের রীতি এই শুন দশানন।
আকিঞ্চন করে মাথা করিতে ছেদন।।
হস্ত পদ কাটি ফেলে মারি তীক্ষ্ণশর।
অস্ত্রঘাতে খণ্ড খণ্ড করে কলেবর।।
অতএব তোরে বলি শুন-দশানন।
কর পদ মুণ্ড ছেদে না হবে মরণ।।
কাটা মুণ্ড জোড়া লাগিবেক তব স্কন্ধে।
সহজে অমর হবে বরের প্রবন্ধে।।
মর্ম্মে যবে ব্রহ্ম-অস্ত্র পশিবে তোমার।
তখন রাবণ তুমি হইবে সংহার।।
অন্য অস্ত্র না হইবে প্রবিষ্ট শরীরে।
তোমার সে মৃত্যু অস্ত্র রবে তব ঘরে।।
সৃজন করেছি আমি সেই ব্রহ্মবাণ।
ধর ধর দশানন রাখ তব স্থান।।
বিপক্ষে এ অস্ত্র যদি পায় কোনমতে।
প্রহার করয়ে যদি তোমার মর্ম্মেতে।।
তখন মরিবে তুমি সন্দ তাহে নাই।
তোমার এ মৃত্যু-অস্ত্র রাখ তব ঠাঁই।।
বর শুনে অস্ত্র পেয়ে রাজা দশানন।
স্বস্থানে রাবণ গেল বাল্মীকিতে কন।।
সেই বাণ রাখিয়াছে মন্দোদরী রাণী।
কোথায় রেখেছে অস্ত্র কিছুই না জানি।।
এই কথা বিভীষণ কহে শ্রীরামেরে।
আর একমত কথা কহে মতান্তরে।।
সেই অস্ত্রে নাভিদেশ ভেদিবে যখন।
তখনি সে রাবণের হইবে পতন।।
কোন মতান্তরে বলে শিব দিলা বর।
রাবণে রাখিবে শিব সংগ্রাম ভিতর।।
হস্ত পদ দেহ মুণ্ড কাটা যাবে যবে।
কুড়ায়ে শঙ্কর লয়ে অঙ্গে সোড়া দিবে।।
পুরাণ অনেক মত কে পারে কহিতে।
বিস্তারিয়া কহি শুন বাল্মীকির মতে।।
বিভীষণ কহিলেন রামের গোচরে।
রাবণের মৃত্যুবাণ রাবণের ঘরে।।
সে অস্ত্র আনিতে কারো নাহিক শকতি।
রাম বলে, না মরিবে লঙ্কা-অধিপতি।।
সে বাণ আনিতে যোগ্য কে আছে এমন।
কোথা আছে সে বাণ না জানে বিভীষণ।।
মন্দোদরীর নিকটে আছয়ে সে বাণ।
সে বাণ আনিলে হয় বিনাশ রাবণ।।
মন্দোদরীর অন্তঃপুর ভয়ঙ্কর স্থান।
ব্রহ্মা আদি দেবগণ নিকটে না যান।।
বারণের ভয়ে বাত না বহে পবন।
সে স্থান হইতে বাণ আনে কোন্ জন।।
এত যদি কহিল রাক্ষস বিভীষণ।
হেনকালে উপনীত পবন-নন্দন।।
হনুমান বলে, কেন ভাব রঘুমণি।
আমি গিয়া মৃত্যুবাণ আনিব এখনি।।
রাম বলে বহু শ্রম কৈলে বারম্বার।
না হলো রাবণ বধ সকলি অসার।।
হনুমান বলে প্রবু কর আশীর্ব্বাদ।
এখনি আনিব বাণ কিসের প্রমাদ।।
এত বলি রঘুনাথে প্রণাম করিয়ে।
জাম্ববান সুগ্রীবের পদধূলি লয়ে।।
ধীরে ধীরে অন্তঃপুরে করিল প্রবেশ।
মায়া করি হৈল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশ।।
কক্ষতলে পাঁজি পুঁথি ডান হাতে বাড়ি।
কপালেতে দীর্ঘ ফোঁটা যায় গুড়ি গুড়ি।।
লোলিত চক্ষের মাংস পাকা সব কেশ।
মলিন হয়েছে মাংস ছাড়ি গণ্ডদেশ।।
কুশমুষ্টি কুশাঙ্গুরী যজ্ঞসূত্র গলে।
রাবণ রাজার জয় ঘন ঘন বলে।।
জ্যোতিষ গণনে আমি বড়ই পণ্ডিত।
এত বলি রাণীর অগ্রেতে উপনীত।।
পার্ব্বতীর আরাধনে ছিল মহারাণী।
চারিদিকে বেড়ি দশ হাজার সতিনী।।
বৃদ্ধ বিপ্র দেখি রাণী পুলকিত মন।
বৈস বৈস বলি দিল রত্ন-সিংহাসন।।
রাণী দিল সিংহাসন তাহে না বসিয়ে।
কক্ষে ছিল কুশাসন বসিল বিছায়ে।।
দ্বিজ বলে, আমি বড় জ্যোতিষে পণ্ডিত।
চিরকাল চিন্তা করি রাবণের হিত।।
নর-বানরেতে আসি পাড়িল প্রমাদ।
হউক রাজার জয় করি আশীর্ব্বাদ।।
প্রত্যহ জ্যোতিষ গণি দেখি পূর্ব্বাপর।
কি করিতে পারিবেক নর ও বানর।।
মন্দোদরী যে ধন আছে তোমার ঘরে।
শত রামে রাবণের কি করিতে পারে।।
মন্দোদরী বলে, এমন আছয়ে কি ধন।
দ্বিজ বলে দেখিলাম করিয়া গণন।।
জ্যোতিষ গণনে জানি যত সমাচার।
রাজার জীবন মৃত্যু গৃহেতে তোমার।।
প্রবন্ধে রাবণ রাজা হয়েছে অমর।
প্রকাশিয়ে না কহিবে কাহারো গোচর।।
এতেক কহিয়া ছলে উঠে দ্বিজবর।
কহে মন্দোদরী রাণী করি যোড়কর।।
কি ধন গৃহেতে মম আছয়ে এমন।
জ্যোতিষেতে কি দেখিছ করিয়া গণন।।
দ্বিজ বলে, মন্দোদরী কারো না ছলনা।
বড় অসম্ভব বিদ্যা আমার গণনা।।
লঙ্কাপুরে যে দ্রব্য আছয়ে যেখানেতে।
বলে দিতে পারি যদি গণি খড়ি পেতে।।
সে সকল কথাতে নাহিক প্রয়োজন।
কহি যে স্থানে আছে গোপনে সেই ধন।।
ব্রহ্মা আসি কহে যদি তোমার সাক্ষাতে।
প্রকাশিয়া সে কথা না বল কোনমতে।।
বিপ্রের বচনে রাণী হইলা বিস্ময়।
সামান্য গণক এই দ্বিজবর নয়।।
এত ভাবি মন্দোদরী কহে দ্বিজবরে।
লুকায়ে রেখেছি তাহা পরম আদরে।।
দ্বিজ বলে তুষ্ট হলেম তোমার বচনে।
সাবধানে রেখো যেন কেহ নাহি শুনে।।
ইহা বলি দ্বিজবর চলিল সত্বরে।
পাদ দুই গিয়া পুনঃ দাণ্ডাই ফিরে।।
দ্বিজবর কহে শুন রাণী মন্দোদরী।
যত কহ তবু তুমি হীনবুদ্ধি নারী।।
রেখেছ গোপনে সত্য মিথ্যা কভু নয়।
তথাপি তোমার বাক্যে না হয় প্রত্যয়।।
ঘরভেদী বিভীষণ যে দারুণ বৈরী।
প্রমাদ ঘটাতে পারে কুমন্ত্রণা করি।।
বিভীষণ-অজ্ঞাত লঙ্কাতে নাহি স্থান।
কিরূপে রাবণ রাজা পাবে পরিত্রাণ।।
মন্দোদরী বলে, দ্বিজ না ভাব অন্তরে।
বিভীষণের সাধ্য হৈত থাকিলে বাহিরে।।
পরম হিতৈষী তুমি রাজার পক্ষেতে।
বিশেষ না কব কেন তোমার সাক্ষাতে।।
তব আশীর্ব্বাদের তাহা কে লইতে পারে।
রেখেছি জড়িত এই স্তম্ভের ভিতরে।।
বিশেষ নারীর মুখে শুনিয়া মারুতি।
ভাঙ্গিল স্ফটিক-স্তম্ভ মারি এক লাথি।।
ভাঙ্গিল স্ফটিক-স্তম্ভ দৃষ্ট হৈল বাণ।
বাণ লয়ে লাফ দিল বীর হনুমান।।
নিজ মূর্ত্তি ধরি গিয়া বসিল প্রাচীরে।
আর এক লাফে গেল রামের গোচরে।।
বাণ দিয়া রঘুনাথে করিল প্রণাম।
মহানন্দে হনুমানে কোল দেন রাম।।