রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – মহীরাবণের মায়াযুদ্ধ দ্বারা শ্রীরাম লক্ষ্মণকে হরণ
দ্বিতীয় প্রহর নিশি ঘোর অন্ধকার।
বিভীষণ বলে শুন পবন-কুমার।।
আপনি পবন যদি আসে তব পিতা।
প্রবেশ করিতে তারে নাহি দিবে হেথা।।
এত বলি বাহির হইল বিভীষণ।
গড়ের চৌদিকে দেখে করিয়া ভ্রমণ।।
রাবণে প্রণাম করি সে মহীরাবণ।
শ্রীরামের নিকটেতে করিল গমন।।
ঠাট কটক হস্তী ঘোড়া না লয় দোসর।
মায়া করি একাকী চলিল নিশাচর।।
আকাশে আসিতে চক্র দেখিল সত্বরে।
ঠাক কটক দেখে সব গড়ের ভিতরে।।
মনে মনে ভাবে মহী রাবণ-নন্দন।
মায়াতে ছলিব আজি শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
বিভীষণে দেখে তথা গড়ের বাহিরে।
কিরূপে যাইব আমি উহার গোচরে।।
মনে মনে চিন্তা মহী করিয়ে তখন।
মায়াতে হইল অজ-রাজার নন্দন।।
দশরথ হয়ে আসি দিল দরশন।
দশরথ বলে শুন পবন-নন্দন।।
আমার সন্তান দুটি শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সনে করি দরশন।।
হনুমান বলে গোঁসাই করি নিবেদন।
ক্ষণেক বিলম্ব কর আসুক বিভীষণ।।
হেনকালে বিভীষণ দিল দরশন।
তরাসে পলায়ে গেল সে মহীরাবণ।।
হনু বলে শুনহ ধার্ম্মিক বিভীষণ।
দশরথ-রাজা এসেছিলেন এখন।।
বিভীষণ বলে যদি আসে তব পিতা।
প্রবেশ করিতে তবু নাহি দিবে এথা।।
চারিদিকে নিশাচর নানা অস্ত্র হাতে।
নিজ পুরে রহে মহী হরিষ মনেতে।।
হেথায় গড়ের দ্বারে এল বিভীষণ।
হনুমান-স্থানে বার্ত্তা পুছে ঘনে ঘন।।
হনু জানে বিভীষণ গড়ের ভিতরে।
হনুমান দেখে তাকে গড়ের বাহিরে।।
হনুমান বলে কে রাক্ষস বিভীষণ।
ঔষধ বান্ধিতে তুমি গেলে যে এখন।।
বাহির হইয়া এলে কোন পথ দিয়ে।
তোমারে দেখিয়ে মোর স্থির নহে হিয়ে।।
বুঝিতে না পারি কিবা আছে তব মনে।
রাবণের চর হয়ে আছ রাম-স্থানে।।
রাবণের চর হয়ে এস যাও নিতি।
কপট করিয়া রামসহ কৈলে মিতি।।
মোর ঠাঁই রাক্ষসা তোর নাহিক নিস্তার।
লেজের বাড়িতে লব যমের দুয়ার।।
উপাড়িয়া লঙ্কাপুরী ডুবাব সাগরে।
লঙ্কার বসতি পাঠাইব যমপুরে।।
রাবণের দূত তুমি রামের নিকটে।
কি বলিব তোর বাক্যে মম বুক ফাটে।।
বিভীষণ বলে নাহি এসেছি কপটে।
দিব্য করি হনুমান তোমার নিকটে।।
গোবধে ও ব্রহ্মবধে যত পাপ হয়।
যদি ছলে এসে থাকি লইব নিশ্চয়।।
যত পাপ হয় ব্রহ্মবধে সুরাপানে।
আমার সে পাপ, যদি খল থাকে মনে।।
হনুমান বলে তোর দিব্য কিছু নয়।
ব্রহ্মবধ গোবধে রাক্ষসে কোথা ভয়।।
বিভীষণ বলে তুমি বিচারে পণ্ডিত।
বিচার না করে কেন বল অনুচিত।।
কেমনে বলহ মোরে রাবণের চর।
যুক্তি দিয়া বধিলাম যত নিশাচর।।
ইন্দ্রজিৎ-যজ্ঞ-ভঙ্গ সন্ধি কেবা জানে।
যুক্তি দিয়া বধিলাম আপন সন্তানে।।
কত রূপ হয়ে এল সে মহীরাবণ।
ভুলাতে না পেরে শেষে হৈল বিভীষণ।।
হনুমান বলে কথা শুনে লাগে ডর।
মায়াতে কি মহী গেল গড়ের ভিতর।।
লাজে হনুমান বীর করে হেঁটমাথা।
বিভীষণে র্ভৎসিলাম অনুচিত কথা।।
পথ ছেড়ে দিয়ে আমি কৈনু বিপরীত।
বিভীষণে র্ভৎসিলাম নহেত উচিত।।
হনুমান বলে কথা শুন বিভীষণ।
আগে গিয়া দেখি চল শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
মারুতির বাক্যেতে রাক্ষস বিভীষণ।
প্রমাদ পড়িল মনে জানিল তখন।।
বিভীষণ বলে শুন পবন-নন্দন।
চল তবে দেখি গিয়া শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
দ্রুতগতি যায় দোঁহে ধেয়ে ঊর্দ্ধমুখে।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ নাই শূন্যময় দেখে।।
আশ্চর্য্য দেখিল তাহে সুড়ঙ্গ নির্ম্মাণ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে না দেখিয়ে ফাটে প্রাণ।।
কটকের মাঝে নাহি শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
ভূমে গড়াগড়ি দিয়া কান্দে বিভীষণ।।
সুগ্রীব অঙ্গদ আদি ঘুমে অচেতন।
প্রমাদ পড়িল উঠ বলে বিভীষণ।।
কটক-ভিতরে শুনে হৈল মহারোল।
বানর-মণ্ডলে উঠে ক্রন্দনের রোল।।
কান্দিছে সুগ্রীব রাজা নাহিক সম্বিত।
কোথা গেলে লক্ষ্মণ শ্রীরামচন্দ্র মিত।।
ধরণী লোটায়ে কান্দে বীর হনুমান।
রামের উদ্দেশে আমি ত্যজিব পরাণ।।
অগ্নিকুণ্ড সাজাইয়ে তাহে দিব ঝাঁপ।
জীবনেতে না ঘুচিবে মনের সন্তাপ।।
শিরে হাত কান্দে বালি-পুত্র যুবরাজ।
বৃথায় শরীর আর জীবনে কি কাজ।।
আকুল হইয়া কান্দে সেনাপতি নীল।
বাঁচিতে বাসনা আর নাহি এক তিল।।
জাম্ববান বলে সবে না কর ক্রন্দন।
উপায় করহ শুন আমার বচন।।
ক্রন্দন সম্বর শুন বানরের রাজ।
যেমতে নিস্তার পাই চিন্ত সেই কাজ।।
অস্থির না হও কেহ বিপত্তি সময়।
সুস্থির হইলে সর্ব্ব কার্য্যসিদ্ধি হয়।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ দেখ জগতের সার।
বিনাশ করিতে পারে সাধ্য আছে কার।।
সুমন্ত্রণা শুন ওহে সুগ্রীব রাজন।
মারুতিরে পাঠাও করিতে অন্বেষণ।।
মারুতির অগম্য নাহিক ত্রিভুবনে।
অবশ্য পাইবে দেখা শ্রীরাম লক্ষ্মণে।।
আনিতে না পারে যদি শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
তবে সবে অগ্নিকুণ্ডে ত্যজিব জীবন।।
এতেক বলিল যদি ব্রহ্মার কুমার।
কহিল সুগ্রীব রাজা এই যুক্তি সার।।