রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – প্রহস্তের যুদ্ধ ও পতন
এখানেতে ভগ্নদূত যাইয়া লঙ্কায়।
বজ্রদংষ্ট্র-মৃত্যু-কথা কহিল রাজায়।।
বজ্রদংষ্ট্র পড়ে রণে রাবণ চিন্তিত।
প্রহস্ত মামাকে তবে ডাকিল ত্বরিত।।
রাবণ বলে, মামা তুমি রাজ্যের ঠাকুর।
তিন কোটি বৃন্দ ঠাট তোমার প্রচুর।।
তুমি আমি নিকুম্ভ কুম্ভকর্ণ ইন্দ্রজিৎ।
এই কয়জন আছি সমরে পণ্ডিত।।
বিশেষ অধিক তুমি জানি চিরদিন।
করিয়া অনেক যুদ্ধ হয়েছ প্রবীণ।।
প্রতাপে প্রচণ্ড তাহে জান বহু সন্ধি।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে আন হাতে গলে বান্ধি।।
রাবণের কথা শুনি প্রহস্তের হাস।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে আজি করিব বিনাশ।।
আমি আছি রণে কেন পাঠাও অন্য জনে।
এখনি মারিয়া দিব শ্রীরাম লক্ষণে।।
আগে আমি তোমারে বলেছি যুক্তি সার।
সীতা নাহি দিব যুদ্ধ করিব অপার।।
অবানরা অরামা করিব ধরাতল।
দশানন বলে, মামা জানি তব বল।।
অষ্ট-অঙ্গে পর নানা রত্ন-অলঙ্কার।
যুদ্ধ জিনে এলে মামা সকলি তোমার।।
রাবণের কথা কেহ লঙ্ঘিতে না পারে।
সসৈন্যে প্রহস্ত যায় যুদ্ধ করিবারে।।
চারি বীর অগ্রে যায় হাতে ধরে ধনু।
যজ্ঞধূম মহানদ কোপন মহাহনু।।
দেবগণ স্থির নহে যাহার বিবাদে।
হেন সব বীর ধায় সংগ্রামের সাধে।।
সাজিয়া আইল সৈন্য প্রহস্তের পাশ।
সবারে প্রহস্ত বীর দিতেছে আশ্বাস।।
রাম লক্ষ্মণর আজি অবশ্য মরণ।
শকুনি গৃধিনী উড়ে ঢাকিয়া গগন।।
প্রহস্তের সৈন্যে দশদিক অন্ধকার।
মার মার করিয়া চলিল পূর্ব্ব দ্বার।।
দুই সৈন্যে মিশামিশি দৃঢ় বাজে রণ।
নানা অস্ত্র গাছ পাথর করে বরিষণ।।
প্রহস্তের সেনাপতি প্রধান চারিজন।
হাতে ধনু আইল যে করিবারে রণ।।
যুঝিবার কাজ থাক দেখে চারি বীর।
ভঙ্গ দিল বানর সংগ্রামে নহে স্থির।।
পূর্ব্ব দ্বারে দৃঢ়তর হৈল গণ্ডগোল।
তিন দ্বারে থাকি শুনি কটকের রোল।।
তিন দ্বারে চারি বীর আছিল প্রধান।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র যে অঙ্গদ হনুমান।।
পূর্ব্ব দ্বারে চারি বীর আসে শীঘ্রগতি।
নীলের সপক্ষ হৈল চারি সেনাপতি।।
চারি বীর আসি করে গাছ বরিষণ।
ভঙ্গ দিল রাক্ষস সহিতে নারে রণ।।
প্রহস্তের চারি বীর দেখে দূর হৈতে।
রণেতে প্রবেশ করে ধনুর্ব্বাণ হাতে।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র ও অঙ্গদ হনুমান।
চারি বীর ধনু কাটি নিল চারিখান।।
হাঁটুর চাপন দিয়া চারি ধনু ভাঙ্গে।
মালসাট দিয়ে গেল চারি বীর আগে।।
কুপিয়া অঙ্গদ বীর ছাড়ে সিংহনাদ।
লাথির চোটে মারিল রাক্ষস মহানাদ।।
মহাহনু হনুমানে দোঁহে বাজে রণ।
মহাহনু চেপে ধরে পবন-নন্দন।।
করিয়া পাথালিকোলা লয়ে গেল দূর।
কপটে কহিছে হনু বচন মধুর।।
তোর নাম মহাহনু আমি হনুমান।
মিতালি করিব নাম মিলিল সমান।।
দুই মিতা ছোট বড় কে হয় কেমন।
বারেক করিয়া যুদ্ধ বুঝিব দুজন।।
শুনিয়া ত মহাহনু বলয়ে তরাসে।
মিত্র সনে যুদ্ধ করা যুক্তি না আইসে।।
হনুমান বলে কর বাঁচিবার আশ।
তিলেক বিলম্ব নাই করিব বিনাশ।।
রাক্ষসের সনে মোর কিসের মিতালি।
বজ্রমুষ্টি মারিয়া ভাঙ্গিব মাথার খুলি।।
এত বলি হনুমান কসে মারে চড়।
ভূমে পড়ি মহাহনু করে ধড়ফড়।।
মহাহনু পড়িল রুষিল যজ্ঞধূম।
প্রবেশিল রণে যেন কালান্তক যম।।
কুপিল মহেন্দ্র বীর সুষেণ-নন্দন।
দীর্ঘ এক শালগাছ উপাড়ে তখন।।
এড়িলেক শালগাছ দিয়া হুহুঙ্কার।
রথ সহ যজ্ঞধূম হৈল চূরমার।।
যজ্ঞধূম পড়ে রণে রুষিল কোপন।
রুষিল দেবেন্দ্র বীর সুষেণ-নন্দন।।
এড়িল কোপন বীর তিনশত শর।
বিন্ধিয়া দেবেন্দ্র বীরে করিল জর্জ্জর।।
কুপিয়া দেবেন্দ্র বীর করিল উঠানি।
পর্ব্বতের চূড়া ধরি করে টানাটানি।।
দুই হাতে উপাড়িল গাছ ও পাথর।
গাছ পাথর লৈয়া বীর ধাইল সত্বর।।
ঝঞ্ঝনা পড়য়ে যেন গাছ পাথর হানে।
পড়িল কোপন বীর দুর্জ্জয় চাপনে।।
চারি সেনাপাতি পড়ে প্রহস্ত তা দেখে।
সন্ধান পূরিল চারি বীরের সম্মুখে।।
প্রহস্তের রণে দেবগণ কম্পমান।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র পলায় অঙ্গদ হনুমান।।
পূর্ব্ব দ্বারখান সেই নীলবীর রাখে।
ভাঙ্গিল কটক সব নীল তাহা দেখে।।
নীল বলে, প্রহস্ত কি বাড়িয়াছে আশ।
অবশ্য তোমারে আজি করিব বিনাশ।।
রুষিয়া প্রহস্ত বলে, ওরে বেটা নীল।
পাঠাইব যমালয়ে মেরে এক কীল।।
এত যদি দুই বীরে হৈল গালাগালি।
দুই জনে যুদ্ধ বাজে, দোঁহে মহাবলী।।
তিন শত বাণ বীর যুড়িল ধনুকে।
সন্ধান পুরিয়া মারে নীল বীরের বুকে।।
বাণ খেয়ে নীল বীর করিল উঠানি।
পর্ব্বতের চূড়া ধরি করে টানাটানি।।
দশ যোজন আনে বীর পর্ব্বতের চূড়া।
প্রহস্তের শিরে মেরে মাথা কৈল গুঁড়া।।
প্রহস্ত পড়িল রণে লাগে চমৎকার।
ভগ্নদূত রাবণে জানায় সমাচার।।