Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

তিত্তিকে লইয়া হুড়ার সহিত আমার যুদ্ধ অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছিল। তিত্তিকে আমি ভালোবাসিতাম না, তাহাকে দেখিলে আমার বুকের রক্ত গরম হইয়া উঠিত না। কিন্তু সে ছিল আমাদের জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠা যুবতী—সুন্দরী-কুলের রানী। আর আমি ছিলাম যুবকদের মধ্যে প্রধান, আমার সমকক্ষ কেহ ছিল না। সুতরাং তিত্তিকে যে আমি গ্রহণ করিব এ বিষয়ে কাহারও মনে কোনও সন্দেহ ছিল না— আমারও ছিল না।

আমাদের গোষ্ঠীর মধ্যে নারীর সংখ্যা কমিয়া গিয়াছিল। আমরা জোয়ান ছিলাম প্রায় দুই শত, কিন্তু গ্ৰহণযোগ্য যুবতী ছিল মাত্ৰ পঞ্চাশটি। তাই নারী লইয়া যুবকদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল। আমাদের ডাইনী বুড়ি রিকখা তাহার গুহার সম্মুখের উচু পাথরের উপর পা ছড়াইয়া বসিয়া দুলিয়া দুলিয়া সমস্ত দিন গান করিত—

আমাদের দেশে মেয়ে নেই! আমাদের ছেলেদের সঙ্গিনী নেই! এ জাত মারবে–এ জাত মারবে! হে পাহাড়ের দেবতা, বিষরি স্রোতে যেমন পোকা ভেসে আসে, তেমনই অসংখ্য মেয়ে পাঠাও। এ জাত মারবে! মেয়ে নেই— মেয়ে নেই!…

রিকখার দন্তহীন মুখের স্বলিত কথাগুলি গুহার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইয়া অশরীরী দৈববাণীর মতো বাতাসে ঘুরিয়া বেড়াইত।

সঙ্গিনীর জন্য সকলে পরস্পর লড়াই করিত বটে, কিন্তু তিত্তির দেহে কেহ হস্তক্ষেপ করিতে সাহস করে নাই। দূর হইতে লোলুপ ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে চাহিয়া সকলে সরিয়া যাইত। তিক্তির রূপ দেখিবার মতো বস্তু ছিল। উজ্জ্বল নব-পল্লবের মতো বর্ণ, কালো হরিণের মতো চোখ, কঠিন নিটোল যৌবনোদ্ভিন্ন দেহ–ন্যগ্রোধপরিমণ্ডলা! তাহার প্রকৃতিও ছিল অতিশয় চপল। সে নির্জন পাহাড়ের মধ্যে গিয়া তরুবেষ্টিত কুঞ্জের মাঝখানে আপন মনে নৃত্য করিত। নৃত্যু করিতে করিতে তাহার অজিন শিথিল হইয়া খসিয়া পড়িত, কিন্তু তাহার নৃত্য থামিত না। বৃক্ষগুলোর অন্তরাল হইতে অদৃশ্য চক্ষু তাহার নিরাবরণ দেহ বিদ্ধ করিত। কিন্তু তিত্তি দেখিয়াও দেখিত না— শুধু নিজ মনে অল্প অল্প হাসিত। সে ছিল কুহকময়ী চিরন্তনী নারী।

আমার মন ছিল শিকারের দিকে, তাই আমি তিত্তির চপলতা ও স্বৈরাচার গ্রাহ্য করিতাম না। কিন্তু ক্ৰমে আমারও অসহ্য হইয়া উঠিল। তাহার কারণ হুড়া। হুড়া ছিল আমারই মতো একজন যুবক, কিন্তু সে অন্যান্য যুবকদের মতো আমাকে ভয় করিত না। সে অত্যন্ত হিংস্র ও ক্রুরপ্রকৃতির ছিল, তাই শক্তিতে আমার সমকক্ষ না হইলেও আমি তাহাকে মনে মনে সন্ত্ৰম করিয়া চালিতাম। সেও আমাকে ঘাঁটাইত না, যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিত। কিন্তু তিত্তিকে লইয়া সে এমন ব্যবহার আরম্ভ করিল যে, আমার অহংকারে ভীষণ আঘাত লাগিল। সে নিঃসংকোচ তিত্তির পাশে গিয়া বসিত, তাহার হাত ধরিয়া টানাটানি করিত, চুল ধরিয়া টানিত, তাহার কান হইতে পাকা বন্দরী ফলের অবতংস দাঁত দিয়া খুলিয়া খাইয়া ফেলিত। তিত্তিও হাসিত, মারিত, ঠেলিয়া ফেলিয়া দিত, কিন্তু সত্যিকার ক্ৰোধ প্ৰকাশ করিয়া হুড়াকে নিরুৎসাহ করিত না।

এইরূপে হুড়ার সহিত আমার লড়াই অনিবার্য হইয়া পড়িয়াছিল।

সেদিন প্ৰকাণ্ড একটা বরাহের পিছনে পিছনে বহু ঊর্ধের্ব পাহাড়ের প্রায় চূড়ার কাছে আসিয়া পড়িয়াছিলাম। হাতে তীরন্ধনুক ছিল। কিন্তু বরাহটাকে মারিতে পারিলাম না। সোজা যাইতে যাইতে সহসা সে একটা বিবরের মধ্যে অন্তর্হিত হইল। হতাশ হইয়া ফিরিতেছি, এমন সময় চোখে পড়িল, নীচে কিছুদূরে একটি সমতল পাথরের উপর দুটি মানুষ পরস্পরের অত্যন্ত কাছাকাছি বসিয়া আছে। স্থানটি এমনই সুরক্ষিত যে, উপর হইতে ছাড়া অন্য কোন দিক হইতে দেখা যায় না। মানুষ দুটির একটি স্ত্রী, অন্যটি পুরুষ। ইহারা কে, চিনিতে বিলম্ব হইল না— তিত্তি এবং হুড়া! তিত্তির মাথা হুড়ার স্কন্ধের উপর ন্যস্ত, হুড়ার একটা হাত তিত্তির কোমর জড়াইয়া আছে। দুইজনে মৃদুকণ্ঠে হাসিতেছে ও গল্প করিতেছে।

আমি সাবধানে পিঠ হইতে হরিণের শিঙের তীরটি বাছিয়া লইলাম। এটি আমার সবচেয়ে ভালো তীর, আগাগোড়া হরিণের শিং দিয়া তৈয়ারি, যেমন ধারালো তেমনই ঋজু। এ তীরের লক্ষ্য কখনও ব্যর্থ হয় না। আজ তিত্তি ও হুড়াকে এক তীরে গাঁথিয়া ফেলিব।

ধনুকে তীর সংযোগ করিয়াছি, এমন সময় তিত্তি মুখ ফিরাইয়া উপর দিকে চাহিল। পরীক্ষণেই অস্ফুট। চিৎকার করিয়া সে বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া একটা প্রস্তরখণ্ডের পিছনে লুকাইল। হুড়াও সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, আমাকে দেখিয়া সে হিংস্ৰ জন্তুর মতো দাঁত বাহির করিল; গর্জন করিয়া কহিল, গাক্কা, তুই চলে যা, আমার কাছে আসিস না। আমি তোকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।

আমি ধনুঃশর ফেলিয়া নীচে নামিয়া গেলাম, হুড়ার সম্মুখে দাঁড়াইয়া গর্বিতভাবে বলিলাম, হুড়া, তুই পালিয়ে যা! আর যদি কখনও তিক্তির গায়ে হাত দিবি, তোর হাত-পা মুচড়ে ভেঙে পাহাড়ের ডগা থেকে ফেলে দেব। পাহাড়ের ফাঁকে মরে পড়ে থাকবি, শকুনি তোর পচা মাংস ছিড়ে খাবে।

হুড়ার চোখ দুটা রক্তবর্ণ হইয়া ঘুরিতে লাগিল, সে দন্ত কড়মড় করিয়া বলিল, গাক্কা, তিত্তি আমার! সে তোকে চায় না, আমাকে চায়। তুই যদি তার দিকে তাকাস, তোর চোখ উপড়ে নেব। কেন এখানে এসেছিস, চলে যা! তিত্তি আমার, তিত্তি আমার! —বলিয়া ক্রোধান্ধ হুড়া নিজের বক্ষে সজোরে চপেটাঘাত করিতে লাগিল।

আমি বলিলাম, তুই তিত্তিকে আমার কাছ থেকে চুরি করে নিয়েছিস; যদি পরিস কেড়ে নে;-–আয়, লড়াই কর!

হুড়া দ্বিতীয় আহ্বানের অপেক্ষা করিল না, বন্য শূকরের মতো আমাকে আক্রমণ করিল।

তখন সেই চত্বরের ন্যায় সমতল ভূমির উপর ঘোর যুদ্ধ বাধিল। দুইটি ভালুক সহসা ক্ষিপ্ত হইয়া গেলে যেভাবে যুদ্ধ করে, আমরাও সেইভাবে যুদ্ধ করিলম। সেই আদিম যুদ্ধ, যখন নখ-দন্ত ভিন্ন অন্য অস্ত্ৰ প্ৰয়োজন হইত না। হুড়া কামড়াইয়া আমার দেহ ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিল, সবঙ্গ দিয়া রক্ত ঝরিতে লাগিল। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, শক্তিতে সে আমার সমকক্ষ ছিল না। আমি ধীরে ধীরে তাহাকে নিস্তেজ করিয়া আনিলাম। তারপর তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার পিঠের উপর চিড়িয়া বসিলাম।

নিকটেই একখণ্ড পাথর পড়িয়াছিল। দুই হাতে সেটা তুলিয়া লইয়া হুড়ার মাথা গুড়া করিয়া দিবার জন্য ঊর্ধ্বে তুলিয়াছি, হঠাৎ বিকট চিৎকার করিয়া রাক্ষসীর মতো তিত্তি আমার ঘাড়ের উপর লাফাইয়া পড়িল। দুই হাতের আঙুল আমার চোখের মধ্যে পুরিয়া দিয়া প্রখর দন্তে আমার একটা কান কামড়াইয়া ধরিল।

বিস্ময়ে, যন্ত্রণায় আমি হুড়াকে ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম, তিত্তি কিন্তু গিরগিটির মতো আমার পিঠ আঁকড়াইয়া রহিল। চোখ ছাড়িয়া দিয়া গলা জড়াইয়া ধরিল, কিন্তু কান ছাড়িল না। ওদিকে হুড়াও ছাড়া পাইয়া সম্মুখ হইতে আক্রমণ করিল। দুইজনের মধ্যে পড়িয়া আমার অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিল।

তিত্তিকে পিঠ হইতে ঝাড়িয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলম, কিন্তু বৃথা চেষ্টা। হাত-পা দিয়া সে এমনভাবে জড়াইয়া ধরিয়াছে যে, সে নাগপাশ হইতে মুক্ত হওয়া একেবারে অসম্ভব। তাহার উপর কান কামড়াইয়া আছে, ছাড়ে না। এদিকে হুড়া আমার পরিত্যক্ত প্রস্তরখণ্ডটা তুলিয়া লইয়া আমারই মস্তক চুৰ্ণ করিবার উদ্যোগ করিতেছে। আমার আর সহ্য হইল না, রণে ভঙ্গ দিলাম।

অসমতল পাহাড়ের উপর একটা উলঙ্গ উন্মত্ত ডাকিনীকে পিঠে লইয়া দৌড়ানো সহজ কথা নহে। কিন্তু কিছুদূর গিয়া সে আপনা হইতেই আমাকে ছাড়িয়া দিল। আমার কর্ণ ত্যাগ করিয়া পিঠ হইতে পিছলাইয়া নামিয়া পড়িল। আমি আর ফিরিয়া তাকাইলাম না। পিছনে তিত্তি চিৎকার করিয়া হাসিয়া করতালি দিয়া নাচিতে লাগিল। —

গাক্কা ভীতু, গাক্কা কাপুরুষ। গাক্কা মরদ নয়! সে কোন সাহসে তিত্তিকে পেতে চায়? তিত্তি হুড়ার বৌ! হুড়া তিত্তিকে গাক্কার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, তিত্তির ভয়ে গাক্কা পালিয়েছে। গাক্কা ভীতু! গাক্কাকে দেখে সবাই হাসবে। গাক্কা আর মানুষের কাছে মুখ দেখাবে না। গাক্কা কাপুরুষ! গাক্কা মরদ নয়?-তিত্তির এই তীব্ৰ শ্লেষ রক্তাক্ত কৰ্ণে শুনিতে শুনিতে আমি উর্ধর্বশ্বাসে পলাইলাম।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress