Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

১১.

সন্ধে হয়ে গেছে। সাগু বিছানায় শুয়ে আছে। কম্বল গায়ে দিয়ে। চান করেনি। মুখ চোখ শুকনো। নীহার রান্নাঘরে ছিলেন। সুরজের মা ঘর মুছছিল। সুরজ গোয়ালঘরে। এমন সময় খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে রিয়া ঢুকল। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রাখল একটি গাছে হেলান দিয়ে। তারপর দৌড়ে সাগু সাগু বলে ডাকতে ডাকতে ভেতরে গেল।

মাসিমা সাগু কেমন আছে?

রিয়া দৌড়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল, নীহারের উদ্দেশে।

ওইরকমই আছে মা! জ্বর আর বাড়েনি। তবে কমেওনি। হিম লাগিয়েছে মাথায়। তুমি যাও না। ঘরেই তো আছে। কেবলই ভুগছে। আজ এটা কাল সেটা।

ঘরে ঢুকে রিয়া বলল, কী রে! কী হয়েছে?

রিয়ার মুখের দিকে চেয়েই উত্তেজিত হয়ে বিছানাতে উঠে বসতে গেল সাগু, তারপর গায়ের ব্যথায় অপারগ হয়ে আবার শুয়ে পড়ে বালিশে মাথা হেলিয়ে বলল, তোর কী হয়েছে রে রিয়া? মুখ এত ফ্যাকাশে কেন? হাঁপাচ্ছিস কেন?

রিয়া গলা নামিয়ে বলল, একটু আগেই গুণ্ডা বীরজু সিংকে পান্ডে স্যারের কোচিং ক্লাসের সামনে পায়ের চটি খুলে মেরে এসেছি অনেক লোককে সাক্ষী রেখে।

ভয়ে নিজের মুখও ফ্যাকাশে হয়ে গেল সাগুর। ধরা গলায় বলল, সেকী রে! কেন? কী হবে এখন?

ও তোকে আর অনিকে জড়িয়ে সব নোংরা কথা বলছিল। ওকে আর তোকে বীরজু নাকি পুনপুন নদীর বালিতে গাছের ছায়াতে এমন অবস্থাতে দেখেছে যে, তাতে ওর মাথা গরম হয়ে গেছে। বলেছে, আমাদের মহল্লার ছোঁকরি ভোগে লাগবে চেঞ্জারের? ফসলি বটেরের? তোদের দুজনকেই ও খতম করে দিতে চায়। আর চটি মেরেছি বলে, আমাকেও বে-ইজ্জত করবে বলেছে।

সাগু বালিশে কনুই ভর দিয়ে উঠে বসল। চোখ দুটো জ্বলছিল। বলল, মিথ্যুক। যদি বীরজু সিং তাই বলেই থাকে তাতে তোর কী? যা বিপদ, তা তো আমার আর অনিরই। তোর এত গাত্রদাহ কেন?

বাঃ। অদ্ভুত তো তুই। তোকে ভালোবাসি বলে। আবার কেন?

আমাকে? ভালোবাসিস? তাতে…

হ্যাঁ। তোকে।

সাগু ফিসফিসে গলায় বলল, তারপর? তারপর কী হল?

তারপর আর কী! ভয়ে মরে যাচ্ছি। বে-ইজ্জত করবে কথাটা এমনভাবে বলল যে কী করতে চায় তা-ভেবেই ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে যাচ্ছে।

তুই তোর কথাই ভাবছিস শুধু, দু-দিনের জন্যে বেড়াতে আসা ভালোমানুষ অনির কথা ভাবছিস না একবারও? ওর তো প্রাণও চলে যেতেও পারে। বীরজু সিং তো শুনেছি কলিয়ারির মাফিয়াদের হয়ে কাজ করে। মাত্র পঞ্চাশ টাকা আর একবোতল মদ পেলেই ও যেকোনো মানুষকে খুন করে। অনির কী দোষ? তোর বলা উচিত ছিল সত্যি কথাটা।

কী? কোন সত্যি কথাটা? তুই নির্দোষ?

সেকথা তুই শত চেষ্টাতেও বলতে পারতিস না। তবে অনির কথাটা বলতে পারতিস। ওকে বাঁচাবার জন্যে, বলতে পারতিস যে, দোষ সংজ্ঞার। সংজ্ঞাই অনিকে ভালোবাসে, ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু অনি তাকে একটুও ভালোবাসে না। বানিয়ে বানিয়েই বলতিস।

আমার কী দায়? তুই, ঝাঁজী, উকিলের কাছে গিয়ে অ্যাফিডেফিট করে এইসব কথা বললেই পারিস। একটু থেমে বলল, অনি তোকে ভালোবাসে কি বাসে না তা আমিই জানি।

রিয়া, তুই কি আমার বন্ধু?

এই সংসারে সকলেই সকলের বন্ধু। স্বার্থে হাত পড়লেই বন্ধুত্বের খোলসটা খুলে পড়ে। তুইও কি আমার বন্ধু? উলটে জিজ্ঞেস করল সংজ্ঞা।

দেখ রিয়া, অন্য কোনোদিন তোর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করব। আজ আমার প্রচন্ড মাথাতে ব্যথা, মাথা তুলতে পারছি না। কী হয়েছে বুঝতে পারছি না কিছুই। জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। কাল কালীপুজোয় মা কি পাগু কাউকেই কিছু বলিনি। এরকম অসুখ আমার কখনোই হয়নি।

সুখও হয়তো নয়। থাকলে অনিকে খবর দিয়ে যাচ্ছি। এসে তোর কপালে একবার হাত রাখলেই ভালো হয়ে যাবি। আরও যদি ভালো হতে চাস তো….

যন্ত্রণায় আবার বালিশে মাথা নামিয়ে শুয়ে পড়ল সাগু। ওর চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে। নিশ্বাস খুব গরম। চোখের সামনে থেকে সবকিছু মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

পাণ্ড কোথায়? রিয়া শুধোল।

অনিদের বাড়িতে গেছে। জোর করেই ভজুকা নিয়ে গেছেন। তুবড়ি দেখবে, আর রিয়া বলল, ইশ। রাত হয়ে এল। আমি এবারে যাই রে। ভালো হয়ে উঠবি। অনিরুদ্ধ একবার এসে তোর পাশে বসলেই ভালো হয়ে যাবি। জেগে থাকিস কিন্তু। কখন যে সে আসবে তার তো ঠিক নেই কোনো।

চললে রিয়া? কেমন দেখলে বন্ধুকে?

রান্নাঘরের ভেতর থেকে নীহার রিয়ার হুড়দাড় করে চলে যাওয়ার শব্দ শুনে বললেন।

হ্যাঁ মাসিমা। রাত হয়ে গেল, যাই। ভালোই তো দেখলাম ওকে। ওর অসুখটা যতটা শরীরের তার চেয়েও বেশি মনের।

কথাটাতে একটু আহত হলেন নীহার। সংজ্ঞার বাবা যে, রাঁচির মানসিক হাসপাতালে আছেন এ কথাটা সকলেই জানেন। সেই কারণে মেয়েদের বিয়ে নিয়েও গোলমাল হতে পারে যে, সেই বিপদ সম্বন্ধেও উনি ওয়াকিবহাল। কিন্তু মুখে বললেন, মনের অসুখ কার নেই মা! সেদিন যোগেনবাবু বলেছিলেন যে, এখনকার নব্বই ভাগ মানুষই মনের অসুখে ভোগে। এটা আর বিশেষ কিছু

কথা শেষ করার আগেই দেখতে পেলেন যে, রিয়া জোরে সাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে ঝুপড়ি অন্ধকার ভরা উঁচু নীচু পথ বেয়ে। ওর সাইকেলের ব্যাটারির আলোটা নাচতে নাচতে যাচ্ছে সামনে সামনে। ওদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন নীহার। রান্নাঘর থেকেই ডাকলেন সুরজের মাকে। বললেন, ও সুরজকা মায়ি। জারা দিখো তো বিটিয়া হ্যায় ক্যাইসি? বুখার ফিন চড়হা কি উতরা থোরা?

আয়ি, মাইজি।

সুরজের মা জবাব দিল। জবাব দিয়েই কোমরে হাত দিয়ে হাতে ঝাঁটা নিয়ে বসে থাকা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল।

.

১২.

চ্যাটার্জিসাহেবের বাড়ির মালি রিয়াদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিল। রিয়া বারান্দায় রোদে বসে পড়ছিল। মালিকে যেতে দেখে, কী মনে করে ডেকে বলল, খবর কী মালিদাদা? তোমার দাদাবাবু কী করছেন?

দাদাবাবু আমার কুকুরের গায়ের আঠালি ছাড়াচ্ছেন।

মালি বলল।

নিজের গায়ে যেটা লেগেছে সেটিকেও ছাড়াতে বোলো। তিনি কি জানেন কিনি লেগেছেন?

জি? নেহি সমঝা…

তোমার দাদাবাবু ঠিকই সমঝে যাবেন। বোলো যে, আমি বলেছি। তাঁর নিজের গায়ের আঠালিটি আগে ছাড়িয়ে তারপর যেন তোমার কুকুরের কল্যাণে লাগেন।

তারপর বলল, তুমি হনহন করে চললে কোথায়?

সাগু দিদিদের বাড়ি।

কেন? এই সাতসকালে?

দাদাবাবু চিঠি দিয়েছেন।

কাকে?

সাগু দিদিমণিকে।

চোখ দুটি জ্বলে উঠল রিয়ার। ঔৎসুক্যে, ঈর্ষার ক্রোধে। বলল, দেখি দেখি।

মালি দোনামনা করছিল। কিন্তু তার আগেই মালির খাকি জামার পকেট থেকে ছোঁ মেরে চিঠিটি উঠিয়ে নিল রিয়া। কিন্তু খামের মুখে সেলোটেপ সাঁটা ছিল। তাই বাধ্য হয়েই আবার মালির পকেটেই রেখে দিল।

মালি বলল, অব চলে, দিদিমণি।

মালি চলে যেতেই নিজেকে খুব ছোটো মনে হল রিয়ার। ও খুবই ছোটো, নীচ হয়ে গেছে। হয়তো আগেই হয়ে গেছিল যখন মদনদার কাছে বানিয়ে সাগু ও অনির নামে বলেছিল, কিন্তু কী করবে! অনিকে যে…। অনিকে যে, ও বড়ো ভালোবেসে ফেলেছে।

দাঁতে দাঁত চেপে নিরুচ্চারে ও বলল, নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ অ্যাণ্ড ওয়ার।

সংজ্ঞার আবারও জ্বর এসেছে। খুব দুর্বল। ও বারান্দাতে রোদে পিঠ দিয়ে বসেছিলো। এখনও চান করেনি। আগামী কাল চান করবে। হেমন্তের ঝকঝকে রোদ সতেজ সবুজ গাছপালাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। পাখি ডাকছে নানারকম। এমন মাঝ-সকালে রোদে পিঠ দিয়ে বসলে এই প্রকৃতির নিভৃত মনোরম আবেশ আর পাখির ডাকের আবহ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। চোখ আপনা থেকেই বুজে এসেছিল সাগুর। এমন সময় গেট খোলার শব্দ হল। ও চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিল। এবার মুখে রোদ পড়ছে। দেখল, চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলোর মালি আসছে। তার হাতে কিছু নেই। মা আর পাগু তো গেছেন অনিদেরই বাড়িতে। অনিরা তো চলে যাবেন অল্প কদিন পরেই। সাগুর মন ভালো নেই। যতগুলো বছর ওর জীবনে। এসেছে তারমধ্যে বাবার অসুখ ছাড়া এত বেশি মন খারাপ ও কারও জন্যেই বোধ করেনি।

মালি কেন এল কে জানে! তার চেয়ে অনি এলে কি ভালো হত? রোদের মধ্যে বসে ওর সঙ্গে গল্প করত। বাড়িতেও এখন একাই ছিল। অনি কাছে থাকলে যে কী ভালো লাগে।

ক্যা মালিদাদা!

খাত ভেজিন।

কওন?

দাদাবাবু।

কিসকি লিয়ে?

আপকি লিয়ে?

খুশিতে সাগুর মুখ হেমন্তের রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

চা খাবে মালিদাদা? সাগু বলল।

নেহি দিদি! বহত কাম ছোড়কর আয়া। আভভি যানা হ্যায়।

বলেই, চলে যেতে গিয়ে পড়ল সিঁড়ির একধাপ নেমে। তারপর হেসে, বুকপকেট থেকে একটি লাল কুড়ি টাকার নোট শেয়াল পন্ডিতের কুমিরের বাচ্চার মতো উঁচু করে দেখিয়েই নামিয়ে নিল। তারপর নমস্তে বলে চলে গেল।

সাগুর কানের মধ্যে সরোদে যেন কেউ ভৈঁরো বাজাতে লাগল। আলাপ-টালাপ নয়। একেবারে ঝালা। চিঠিটি নিয়ে প্রথমে তার বুকের ওপরে রাখল কিছুক্ষণ তারপর সাবধানে খুলল, যেন ছিঁড়ে-টিড়ে না যায়।

গামারিয়া
শনিবার

সংজ্ঞা, মনোনীতা, বিশ্বাস করবে কি না জানি না। আমি এর আগে বাবা মা ঠাকুরদা ঠাকুমা এবং বন্ধুদের ছাড়া আর কাউকেই চিঠি লিখিনি। কোনো মেয়েকেও নয়, তোমার মতো মেয়েকে তো নয়ই।

কী যে ঘটে গেছে আমার মধ্যে! কী যেন হয়ে গেছে আমার। আমার সব সপ্রতিভতা, সব মুখরতা হঠাৎ-ই কার অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে রাখা টবের ডিফিওনবিচিয়া প্ল্যান্টস-এর পাতা যেমন পুবের জানালার দিকে হাত বাড়ায় আমার ভেতরের আমার শাখা-প্রশাখাও ঠিক তেমন করেই তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছে।

আমি যখন কলেজে পড়তাম, সম্ভবত ফাস্ট-ইয়ারে, তখন একটি কবিতা লিখেছিলাম নিছকই কল্পনার বশে। সেই কবিতাটিকে যে আজ এমন সত্যি বলে মনে হবে, কবিতার বক্তব্য যে, এমন বাস্তব হয়ে উঠবে, তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।

তোমার অসুস্থতার সময়ে তোমার বিছানাতে বসে তোমার হাতটি হাতে নিয়ে যে, দুটি ঘণ্টা বসেছিলাম তাই আমার জীবনের পরম পাওয়া হয়ে থাকবে।

ভালোবাসা কাকে বলে আমি জানি না। তুমিও কি জানো? কিন্তু এটুকু বুঝেছি, ভালোবাসার আর এক নাম দুঃখ। বড়ো গভীর দুঃখ। এবং আরও অনেক গভীর বোধ হয় সেই দুঃখের সুখ।

আমরা চলে যাবার আগে যে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে, যাওয়ার সময় হাত নেড়ে আমাকে বিদায় দেবে, একথা ভাবতেই আমার ভালো লাগছে। তুমি সম্পূর্ণ ভালো না হয়ে উঠলে হয়তো আমি গামারিয়া ছেড়ে যাবই না, বাড়ির অন্যরা যদি ফেরেনও।

তবে গামারিয়াতে আবারও আসব। আসতে আমাকে হবেই। হয়তো একাই আসব। এলে তোমাদের সুরজদাদার কোয়ার্টারে আমাকে কি থাকতে দেবে?

তোমার মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, রিয়া এবং তোমার সঙ্গে আমার একইসঙ্গে আলাপ হয়েছিল অথচ তোমাকেই আমার ভালো লাগল কেন? তাহলে বলি যে, ভালো লেগেছিল দু-জনকেই। কিন্তু ভালো লাগা আর ভালোবাসা তো এক নয়। কত মানুষকেই তো আমার তোমার এবং সকলেরই ভালো লাগে কিন্তু তাই বলে কি তাদের সকলকেই ভালোবাসা যায়? ভালোবাসা হঠাই হয়ে যায় বোধ হয়। ভালো লাগা মনের ঢালু জমিতে গড়িয়ে যেতে যেতে কখন যে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়ে যায় তা বোধ হয় যারা ভালোবাসে তারা নিজেরাও জানে না।

আমি তো আমার কথাই অকপটে নির্লজ্জের মতো জানালাম তোমাকে। তোমার কথা জানব কী করে? চলে যাবার আগে তুমি কি জানাবে না আমাকে, তুমি আমার এই পবিত্র নৈবেদ্য গ্রহণ করলে কি না?

আমি কিন্তু এ ক-দিন গরমের দুপুরের চড়াই পাখির মতো অপেক্ষার ধুলোর মধ্যে ছটফট করে মরব। তোমার মনের কথা অবশ্যই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাবে। তুমি বড়ড়া কম কথা বলো। রিয়াকে সহজে বোঝা যায়। তোমাকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না। তোমার নাম সংজ্ঞা না হয়ে হওয়া উচিত ছিল দুয়ো।

ভালো থেকো,

ইতি– তোমার অস্থির অনিরুদ্ধ

চিঠিটা পড়া শেষ করেই ব্লাউজের ভেতরে লুকিয়ে ফেলল। মা ও পাণ্ড যেকোনো সময়েই ফিরে আসতে পারেন। চিঠিটি লুকিয়ে সূর্যের দিকে চোখ বন্ধ করে ও বসে রইল। ওর জীবনে এই প্রথম প্রেমপত্র। চোখের নীরব ভাষায় প্রেম জানিয়েছে অনেক ছেলেই এর আগে। কিন্তু এমন স্পষ্ট ভাষায় চিঠিতে আর কেউই জানায়নি। বন্ধ দু-চোখের পাতার সামনে লাল, গাঢ় নীল, ফিকে নীল, বেগুনি, কালো, হলুদ সবুজ কত রঙের যে নীরব হলিখেলা চলতে লাগল তা সাগুই জানে। কানের মধ্যে নিখিল ব্যানার্জির সেতারের আলাপ বাজছে যেন কোনো প্রভাতি রাগের। সুখের যে কত্বরকম হয়, সুখের গভীরতার পরিমাপ যে কত বিচিত্র হয় এসব কথা ও জানত না। এই একটি চিঠি তার মনের আর অনুভূতির জগতের পরতের পর পরত সরিয়ে দিয়ে তাকে এই পুরোপুরি অচেনা নতুন এক তীব্র অভিজ্ঞতার শরিক করে তুলল। সে অভিজ্ঞতায় শরীর কতখানি শরিক আর মন কতখানি তা ও সেই মুহূর্তে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু বুঝতে পারছিল যে, শরীর ও মন দুই-ই সমানভাবে জড়িয়ে গেছে এতে। অঙ্গাঙ্গি ভাবে।

সূর্যমুখী ফুলেরা সূর্যের দিকে চেয়ে ফোটে কিন্তু সংজ্ঞা মানুষী বলেই ঘুমিয়ে পড়ল। মেয়েরা ফুলেরই মতো, কিন্তু সত্যি ফুল নয় বলেই হয়তো এরকম। কতক্ষণ ওই হিমেল সকালে রোদের আমেজে ঘুমিয়ে ছিল ও জানে না। হঠাৎ-ই ঘুম ভাঙল কারও অস্ফুট ডাকে।

চমকে চোখ খুলে দেখল, চ্যাটার্জিসাহেবের বাড়ির মালি।

দিদি।

ক্যা হুয়া? ফিন?

অবাক হয়ে সংজ্ঞা শুধোল।

দাদাবাবু বোলিন খাত কি জবাব তুরন্ত লেকে আনা। আভভি।

সংজ্ঞা হেসে ফেলল। হেসে ফেলেই নিজেকে সামলে নিল মালির সামনে, বলল, মালিদাদা আপ ইক মিনট রোকনা। ম্যায় জবাব লেকর আ রহা হু। মনে মনে বলল, পাগল আর কাকে বলে!

ঘরের ভেতর যেতেই চোখে সব অন্ধকার দেখতে লাগল ও। সূর্যের দিকে চেয়ে থাকার এই দোষ। তা খোলা চোখেই চাওয়া হোক কী বন্ধ চোখে।

পড়ার টেবলে গিয়ে একটু কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে লিখল :

অনিরুদ্ধ, ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।

তুমি বড়ো বোকা। এবং ভালো।

ভালোবাসি, ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি।

আর কী করে জানাব?

তোমার মতো চিঠি লিখতে পারি না আমি।

আজকে কখন দেখা হবে? সন্ধেবেলা আসবে তো? না এলে ভীষণ খারাপ লাগবে।

কাউকে কখনোই এমন করে সমৰ্পণ করিনি নিজেকে। কখনো যে করব এমন কথাও ভাবিনি। জানি না কী হবে! সর্বনাশ হল আমার। সর্বনাশের অনেকই রকম হয়ত!

ইতি– তোমার ধন্যা সংজ্ঞা

চিঠি লেখা শেষ হলে কোথাও একটিও খাম খুঁজে পেল না বাড়িময়।

মালি বাইরে থেকে অধৈর্য গলায় ডাকল, দিদি।

আয়ি।

খাম ছিল না যে তা নয়, ছিল। মায়ের চিঠির লেখার বাক্সে। কিন্তু তা পোস্টাপিসের খাম। বাবাকে লেখার জন্যে। কোনো খামই না পেয়ে চিঠিটাকে চার ভাঁজ করে বাইরে এসে বলল, মালিদাদা ইয়ে খাত লে জানা।

সামহালকর লেনা। লেফাফা নেহি হ্যায় ঘরমে। মনে মনে বলল অনিকে,

ইয়ে দিল হামরা,
সামহালকার হাতমে লেনা।
নাজাকত ইসমে ইতনি হ্যায়
যব নজারসে গিড়া টুটুা।

ঠিক হ্যায়। মালি বলল।

দাদা কী করছে?

আমার কুকুরের গায়ে খুব আঠালি হয়েছে তাই ওষুধ দিয়ে আঠালি পরিষ্কার করছে। আমার কোয়ার্টারের বারান্দাতে বসে।

পাগল অনিরুদ্ধর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় গলে গিয়ে হেসে বলল সংজ্ঞা, তাই?

জি হ্যাঁ!

দাদাবাবুর হাতেই দিয়ো কিন্তু। যখন আর কেউ থাকবে না। বুঝেছ?

লজ্জা-লাল রাঙা মুখে বলল সাগু।

জি হাঁ!

মালি চিঠিটি নিয়ে চলে গেল। মালি যখন চিঠিটি নিয়ে রিয়াদের বাড়ির কাছে এল, তখন দূর থেকেই দেখতে পেল মালি যে, রিয়া বারান্দা থেকে নেমে গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মালি গেটের কাছে আসতেই রিয়া মালিকে বলল, জবাব দিয়েছে তো সাগুদিদি?

কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে মালি বলল, আপ জানি থি কি ইয়ে খাতকি বারেমেভি?

নেহি তো ক্যা? লাও তো, কেয়া লিখিন সাগু দিদিনে জেরা জলদি পড়লি।

ইয়ে খাত স্রিফ…মালি আপত্তি জানিয়ে বলল।

আরে ম্যায় তো তুমহারা দাদাবাবু আর সাগু দিদিকি দুশমন নেহি না হু, দোস্ত-ই হু।

রিয়া মালির আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে বলল।

ইয়ে বাত তো ঠিকই হ্যায়। তবভি, বলে পকেট থেকে চার ভাঁজ করা চিঠিটা অনিচ্ছার সঙ্গে বের করে দিল।

চিঠিটি পড়তে পড়তে এক আকাশ রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়েও রিয়ার সুন্দর মুখটি অন্ধকার হয়ে এল। ওর হাত-পা কাঁপতে লাগল। চিঠিটি মালিকে কোনোক্রমে ফেরত দিয়ে বলল, জলদি লে যাও। বহত-ই জরুরি খাত হ্যায় ই।

মালি চলে যেতেই রিয়া বারান্দাতে ফিরে গিয়ে চেয়ারে বসল। ওর দু-কান এবং মাথা গরমে ঝমঝম করছিল। রিয়ার মা গণপত রিকশাওয়ালাকে নিয়ে চওকে গেছেন কেনাকাটা করতে। আজ রাতে অনিদের বাড়ির সকলকেই খেতে বলেছেন মা ওদের বাড়িতে। রিয়ার ওপর অনেকই কাজের ভার দিয়ে গেছেন যাওয়ার আগে, কিন্তু কিছুই করা হয়নি। আর যা হয়নি তা হবেও না আর।

কোনোক্রমে রাতের নেমন্তন্নটা বাতিল করে দিতে পারলেই ভালো হত। ভাবছিল রিয়া। এমন সময় মদন এল সাইকেল নিয়ে।

রিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী ব্যাপার মদনদা?

ব্যাপার ভালো নয়, তাই-ই তো এলাম। সেদিন তোমার অমনভাবে ভরতের পানের দোকানের সামনে বীরজুকে চটি দিয়ে মারাটা খুবই ডেঞ্জারাস কাজ হয়েছে। আমি শুনতে পেলাম যে, ও যা বলেছে ও তাই করবে। ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল গাঙ্গুরগঞ্জের চিকনা। ফলে, এক ঘুসিতে তারই দুটো দাঁত উপড়ে দিয়েছে। তোমাকে তাই সাবধান করে দিতে এলাম।

রিয়া একটু ভেবে বলল, যখন চটি দিয়ে মেরেছিলাম অত লোকের সামনে আমি জানতামই যে, কাজটা ভালো হল না কিন্তু চারধারের পুরুষেরা যদি মেয়েদের সম্মান বাঁচাতে পারে তাহলে মেয়েদেরই বা উপায় কী বলো? তোমরা যেন একপাল লকড়া। কিছু মনে কোরো না মদনদা। কিন্তু ভারী লজ্জা করে তোমাদের দেখে।

মদন বলল, আহত হয়ে লেহ লটকা। তোমার ভালো করতে এসে শালা আমারই ঝাড় খেতে হচ্ছে।

রিয়া দৃঢ় শক্ত গলায় বলল, মদনদা, তুমি বীরজুর সঙ্গে আমার একবার দেখা করিয়ে দাও। বোঝা-পড়া যা করার তা আমি একাই করতে পারব। কিন্তু কোনো নির্জন জায়গাতে আসতে বোলো। আজই, দুপুরে।

মদন অবাক এবং কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বলল, সে কী? আজই? এ যে দেখি উঠল বাই তো কটক যাই ব্যাপার।

তারপর একটু ভেবে বলল, আর নির্জনে পেয়ে তোকে যদি…

সে আমি বুঝে নেব মদনদা। আমার কোমরে রেমিংটনের ছুরি খুঁজে যাব। ও বদমাইশি করতে চাইলে ওর জান চলে যাবে আমার হাতে। তুমি এখন যাও ওকে খবর দিতে। ওকে পাবে তো?

হ্যাঁ, তা পাব না কেন। এখন তো ভরতের দোকানের সামনেই বসে আছে। মহুয়া খেয়ে চুর হয়ে।

তবে তো দোপহের তক বেহেসও হয়ে যেতে পারে। তুমি বরং বলে গিয়ে সময়মতোই আসতে। মানে এখন থেকে ঠিক আধঘণ্টা পরে।

কোথায়? লেহ লটকা। এ কী সারহুল লাচ গো।

না-না ইয়ার্কি নয়, ঝিরাত এর টাঁড়ে। আমি একটু পরই রওয়ানা হচ্ছি। বলবে ঝিরাত-এর টাঁড়ে মস্ত জোড়া-শিমুল আছে না, তারই পাশের ঝাঁটি জঙ্গলে আমি অপেক্ষা করব। সাইকেলে যেতে দশ মিনিট লাগবে আমার। এক্কেবারে সাননাটা জায়া শুন শান।

সাচমুচ অজীব লেড়কি হে তু রিয়া।

তুমি যাও মদনদা। দেরি কোরো না আর।

ঠিক আছে।

বলেই, মদন সাইকেলে উঠল। প্যাডলে একটু চাপ দিয়ে বলল, এই হিরোর ওপরে কিন্তু আমাদের এখানকার সব ছেলে ছোকরাদেরই খুব রাগ। তোমরা ওকে নিয়ে জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরলেই তো পারতে। বাজারে চওকে হাটে যাবার দরকার কী ছিল?

রিয়া বলল, যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে। পেছনে তাকাই না আমি। এখন যা করার তা করো। আমি কিন্তু ওই নির্জন বনে গিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকব, মনে রেখো। ওকে সাড়ে এগারোটার আগেই আসতে বোলো।

ঠিক আছে।

সাড়ে এগারোটার আগেই কিন্তু।

হুঁ।

.

১৩.

অনিরুদ্ধরা যেখানে উঠেছে, সেই চ্যাটার্জিসাহেবের বাড়ির ভোলই পালটে গেছে এই ক দিনে। আজ কালীপুজোর আগের রাতে চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। দুপুরে অনেক খুঁজে পেতে চোদ্দো শাক জোগাড় করে এনে রান্না হয়েছিল। ভজুকা এরই মধ্যে তুবড়ি বানিয়েছেন। কেমন হয়েছে তারই পরীক্ষা চলছে আজ, দীপাবলির রাতে রিয়াদের বাড়ির এবং সংজ্ঞাদের বাড়ির সকলকেই নেমন্তন্ন করেছেন অনির দাদু-দিদা। ভজুকা যা প্রেডিক্ট করেছিল তাই হয়েছে। ওয়েস্ট জার্মানি থেকে বড়ো ইমপোর্টার চলে আসাতে অনির বাবা নরেনবাবু গতকালই সকালে ড্রাইভারকে নিয়ে রাঁচি চলে গেছেন, রাঁচি থেকে প্লেন ধরে দিল্লি পৌঁছোবেন বলে।

বারান্দাতে সকলে বসে আছেন এখন। একমাত্র ভজুকা, ড্রাইভার মুকুন্দবাবু, এবং ওদের একজন কাজের লোক গগন, বারান্দার সামনের লনে তুবড়ি ফাটাতে ব্যস্ত। দিদা ও দাদু দুটি বালাপোশ গায়ে জড়িয়ে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আছেন। মা একবার রান্নাঘর আর একবার বারান্দা করছেন। ভজুকা ভুনি-খিচুড়ি খেতে চেয়েছেন তাই মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। কাল রাতে কচি পাঁঠার মাংস, লুচি, বেগুন ভাজা, দই দিয়ে আলুর দম এবং রাবড়ির মেনু ঠিক হয়েছে।

ভজুকা বললেন, এই অনি। কী জ্যাঠার মতো বারান্দাতে বসে আছিস। একটা তুবড়ি তো প্রায় আমার হাতে ফেটে গেল। এত করে বললাম তোকে যে, ভালো করে গাদ; তা নয়। কোনদিকে যে তোর মন থাকে। লোহাচুরও এনেছিলি বটে। এ দিয়ে বম বানালে হিটলারের জার্মানি উড়িয়ে দেওয়া যেত।

আমি কি বাচ্চা আছি? তোমার এইসব বালখিল্য ব্যাপারে আমি নেই।

তা তো বটেই! এই বয়েসেই বুড়ো বুড়ো ভাব। সাধে কি বলি যে, বাঙালির কিসসু হবে না।

নীপবালা বললেন, ওরে ভজু। এবারে দেরিতে পুজো গেল, এই হেমন্তের হিম লাগছে মাথায়, একটা টুপি পরে নে। একটা চুলও যদি তাও থাকত মাথাতে।

তা লাগুক। তা বলে মেসোর ওই বাঁদুরে টুপি আমি পরতে পারব না। ওই টুপি একবার যে পরবে সে জন্মের মতো বুড়ো হয়ে যাবে।

নীপবালা হেসে উঠে বললেন, তাহলে একটা মাফলার-টাফলার মাথায় জড়িয়ে নে।

ভজুকা বললেন, আমি কি সাগুদের সুরজ-গয়লা নাকি? কী ভেবেছ আমাকে? এখনও কত বিয়ের সম্বন্ধ আসে এই টাক সত্ত্বেও!

যোগেনবাবু বললেন, তা আসতে পারে। এই দেশে আত্মহত্যা করার মতো মেয়ের তো অভাব নেই। মেয়েকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলার মতো বাবারও অভাব নেই।

এমন সময় অল্পবয়েসি গগন, মালির কুকুরটার গলাতে দড়ি বেঁধে ধরে আনল। আলোর বৃত্তের বাইরে-থাকা মালির ঘরে দিকের কোণের ঝুপড়ি-অন্ধকারের প্রান্তর থেকে।

গগন বলল, এনেছি বাবু।

কুকুরটা তুবড়ির আলো দেখে গলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেঁউ কেঁউ করে ডাকছিল।

এনেছিস! বাঃ বেশ করেছিস। অনি, তোর সেলোটেপটা একটু দে তোর চিঠি লেখার বাক্স থেকে এনে।

অনিরুদ্ধ বলল, সেলোটেপ দিয়ে কী করবে? ভজুকা?

ভজুকা বললেন, বড়ো বেশি প্রশ্ন করিস তুই। মেসো অর্ডার করছে, বিনা বাক্যব্যয়ে এনে দিবি। অত কৈফিয়ত কীসের? বেশি প্রশ্ন করলে তোর মুখও বন্ধ করে দেব।

অনি ভেতরে যেতেই, ভজুকা যোগেনবাবু আর নীপলাবার মধ্যে আলোয়ান জড়িয়ে বসে থাকা পাগুকে বললেন, এই পাণ্ড, চট-জলদি তোর তারাবাজির প্যাকেটটা নিয়ে আয় তো মা।

একটু ইতস্তত করে পাগু বলল, কী করবেন ভজুকা। আমার তারাবাজি দিয়ে?

আরে মোলো! এও যে দেখি অনিরই শাগরেদ। আনো তাড়াতাড়ি।

কুকুরটা এইদিকে কঁকিয়েই যাচ্ছিল কেঁউ-কেউ-কেঁউ করে।

যোগেনবাবু বললেন, আঃ কী অশান্তি যে শুরু করলি ভজু। ছেড়ে দে না কুকুরটাকে। আগুন দেখে ভয় পাচ্ছে যে বেচারি।

ভজুকা বললেন, ছাড়িব। ছাড়িব। সময় হইলেই ছাড়িব। আমরাও তো কত ভয় নিয়ে বাঁচছি সারাক্ষণ। আমাদের কি কেউ ছাড়িতেছে?

সিঁড়ি দিয়ে তারাবাজির বাক্স হাতে নেমে এসে কৃপণের মতো একটি মাত্র তারাবাজি বের করে দিল পাগু। বলল, নাও।

ভজুকা বললেন, আরে! মোটে একটাই দিলি। আর একটা দে শিগগির। তোকে কাল কিনে দেব বারো বাক্স। লাল-নীল দেশলাই। সাপবাজি। রংমশাল। চড়কি। দেখিসই না!

অনিরুদ্ধ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সেলোটেপটা ভজুকার হাতে দিয়ে বলল, এই নাও।

ভজুকা বললেন, কাঁচিটা কে দেবে? আমি কি দা দিয়ে সেলোটেপ কাটব? প্রেসিডেন্সি কলেজে যে কী লেখাপড়া শিখিয়েছিল তা তোরাই জানিস।

অনিরুদ্ধ ফিরে গেল কাঁচি আনতে। যেতে যেতে বলল, তুমি তো মাত্র তিন মাসই পড়েছিলে।

ভজুকা বললেন, তাই যথেষ্ট ছিল। তখনকার তিন মাস এখনকার দশ বছর। তোর কিসসু হবে না। মেসো-মাসিই আদরে আদরে তোকে গোবর করে দিল। তাড়াতাড়ি আন। কখন সন্ধে হয়ে গেছে আমার রাম-নাম শুরু করতে পারলাম না এখনও তোদের জ্বালায়।

যোগেনবাবু বললেন, ওরে ঠাণ্ডা লেগে যাবে ভজু। ততক্ষণে তুই গরম দুধে ফেলে আমার চ্যবনপ্রাশ খেয়ে নে বড়ো চামচের একচামচ।

ভজুকা বললেন, বলিহারি তোমাকে মেসো। মাসি বলছে বাঁদুরে টুপি পরতে, তুমি বলছ চ্যবনপ্রাশ খেতে। তোমরা পেয়েছ কী আমাকে?

অনিরুদ্ধ কাঁচি হাতে ফিরে এসে বলল, এই নাও।

ভজুকা বললেন, একটু দাঁড়াও প্রিন্স অফ ওয়েলস। এগুলো আবার দয়া করে নিজেই নিয়ে গিয়ে যথাস্থানে রেখো, তোমারই চিঠি লেখার কাজে লাগবে।

বলেই, গগনকে বললেন, নিয়ে আয় গগন ব্যাটাকে। দেখিস কামড়ায় না যেন! নাম কী রে ওর?

গগন বলল, লালুয়া।

বা:। লালুয়াকে এবারে হালুয়া করে দিচ্ছি দেখ। ভজুকা বললেন।

গগন হি: হি: করে হাসল। বাবু এমন মজার মজার কথা বলেন না।

ধর, দু-পা দিয়ে চেপে ধর কোমরের কাছটা ভালো করে। অ্যাই, দেখি দেখি, অ্যাই যে! বলেই, লালুয়ার লেজের শেষপ্রান্তে দুটি তারাবাজি সেলোটেপ দিয়ে ভালো করে সেঁটে নিজের সিগারেট লাইটার দিয়ে তারাবাজি দুটোর মুখে আগুন ধরিয়ে দিলেন। কুকুরটা কাঁই-মাঁই করে উঠে প্রথমে তিন-চার পাক ঘুরে গিয়ে নিজের ল্যাজ নিজেই কামড়াতে গিয়ে তারাবাজির আগুনের ফুলকির ছ্যাঁকা গায়ে লাগতেই প্রচন্ড চিৎকার করে প্রাণপণে দৌড়োতে লাগল। কিন্তু গেট বন্ধ থাকায় এবং গেটের বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং জঙ্গল থাকায় বাইরে যেতে পারল না। অথবা গেল না। কম্পাউণ্ডের মধ্যেই গোল হয়ে ঘুরতে লাগল।

অনিরুদ্ধ চেঁচিয়ে উঠল। আঃ, কী করছ ভজুকা! ওর লাগছে না? এমন ইনহিউম্যান ব্যাপার করতে পারো তুমি!

ইনহিউম্যান কী? বল ডগি ব্যাপার। তোদের আলগা পিরিতে গা জ্বলে!

ঠিক আছে। আগামী বছর কালীপুজোর দিন তোমার সাধের ল্যাব্রাডরের ল্যাজে আমি যদি না তারাবাজি বেঁধে দিই তো কী বলেছি?

ভজুকা বললেন, ওরে, অনি এ যে আমাদের দেশের লালুয়া। আমাদের দিশি মানুষেরই মতো দিশি কুকুরও। আমাদের শরীরের এবং মনেরও নাম মহাশয়, যা সওয়াবি তাই সয়। আমাদের সহ্যশক্তির কি শেষ আছে কোনো? লালুয়া যা পারে আমার ইংরেজ পিংকি পারবে কী করে।

ওর ল্যাজে কিন্তু এবার ছ্যাঁকা লাগছে। পেতলের তারটা ক্রমশ গরম হয়ে যাচ্ছে না? অনিরুদ্ধ বলল, উত্তেজিত গলায়।

ভজুকা বললেন, তা তো হবেই। ওর কষ্ট হচ্ছে বলেই তো আমাদের আনন্দ হচ্ছে। সংসারের তো এই নিয়ম। লালুয়ার কষ্টে তোর চোখে একেবারে জল ভরে আসে। কিন্তু কই লিলুয়ার লালুয়ার মালিক, আমাদের দুখিয়া মালির কষ্টে তো জল আসে না? বলেই, ইংরিজিতে ভজুকা বললেন, ঊ্য নে হাউ মাচ ডাজ হি গেট অ্যাজ মান্থলি স্যালারি? হান্ড্রেড রুপিজ আ মান্থ। ঊ্য হিয়ার ফ্রম মি! প্লাস থার্টি রুপিজ ফর ফিডিং দ্য ডগ। দিস ডগ লালুয়া। দুখিয়া হ্যাজ আ ফ্যামিলি অফ ফোর, এক্সকুডিং হিম। অর্থাৎ মানুষের বরাদ্দ মান্থলি টোয়েন্টি রুপিজ আর লালুয়ার জন্যে বরাদ্দ থার্টি রুপিজ। বুয়েচিস রে ইডিয়ট! তোদের চ্যাটার্জিসাহেব আবার দেশসেবাও করেন, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্যে কেঁদে মরেন।

কী হল! কী হয়েছে! সুরজদাদা!

বলেই চেঁচিয়ে উঠল পাগু।

সুরজ কটাং আওয়াজ করে গেটটা খুলেই দৌড়ে এসে বলল, জলদি চলনা ঘোটাদিদি, বড়োদিদি বেহোশ হো গ্যয়া।

ওরা প্রত্যেকেই দাঁড়িয়ে উঠলেন। যোগেনবাবু ডাকলেন, মুকুন্দবাবু, মুকুন্দবাবু! যোগেনবাবুর সাদা দাড়ি গোঁফ ও দীর্ঘ চুলে ওঁকে একজন দীর্ঘাঙ্গ শীর্ণ পাদরির মতো দেখায়।

পাগু বলল, মুকুন্দবাবু তো বাজারের দিকে গেলেন। হাতে লাঠি আর টর্চ নিয়ে।

তাই?

হ্যাঁ। সন্ধের আগেই। আমি আর দাঁড়াব না, আমি যাই। চল সুরজদাদা।

সুরজ বলল, চলো ছোটাদিদি। বলেই লাঠি আর লণ্ঠনটা বাঁ-হাতে নিয়ে ডান হাতে পাগুর হাত ধরল সুরজ।

ভজুকা বললেন, আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমরাও তো যাব।

অনিরুদ্ধ দৌড়ে গাড়ির চাবি নিয়ে এসে ছোটোগাড়িটা বের করল।

যোগেনবাবু বললেন, আমিও যাব।

অনিরুদ্ধ বলল, সুরজ ভাইয়া, তুমি দৌড়ে এগোও। গাড়িতে এত লোক আঁটবে না। আমরা এই পৌঁছোলাম বলে।

সুরজ যখন ‘ভালোবাসা’র গেট খুলে লাঠি আর লণ্ঠন নিয়ে ঢুকছে, ততক্ষণে ওরাও গাড়ি নিয়ে গিয়ে পৌঁছোল।

যোগেনবাবু বললেন, কী হল মা নীহার? কী হল আমার সংজ্ঞা মায়ের?

কী জানি বাবা। আবার সামান্য জ্বর হয়েছিল কাল সকাল থেকে। এরজন্যে পান্ডেজির কোচিং ক্লাসেও আজ যেতে দিইনি। অতখানি রাস্তা উঁচু-নীচু পথ পেরিয়ে যাবে। কিন্তু বাড়ি বসেই পড়াশুনো করেছে বাথরুমে গুনগুন করে গানও গাইছিল শুনেছি।

ভজুকা বললেন, দুপুরে কিছু গুরুপাক খেয়েছিল কি?

না, না। শুধু সাবুর খিচুড়ি।

তারপর? সাগুর নাড়ি ধরে বললেন, যোগেনবাবু।

তারপর…

নীহার যেন খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। চোখের পাতা বন্ধ। মেয়ের মুখ নীল। হাত-পা ঠাণ্ডা। এই সময় কিছু করা দকার। তা না প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন এঁরা।

ভজুকা বললেন, চলো অনি, ডাক্তার নিয়ে আসি। সুরজকে কি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি?

ওকে নিলে…নীহার দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন।

ভজুকা বললেন, জায়গাটা তো ঠিক আমরা…ডাক্তার কোথায় পাওয়া যাবে…

অনিরুদ্ধ বলল, চলো, রিয়াদের বাড়ির মালিকে তুলে নেব, কালিয়া নাকি নাম যেন।

তাই ভালো। কিন্তু এই অন্ধকার রাতে এরা বাড়িতে একা থাকবেন?

গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট করে জোরে গেট থেকে বাইরে পড়েই অনিরুদ্ধ বলল, ভজুকা তাহলে তুমিই থাকো রিয়াদের বাড়িতে। আমি কালিয়াকে নিয়েই যাচ্ছি। দিওয়ালির তেওহার। আগের রাতে ডাক্তার এলে হয়!

ভজুকা বললেন, আর দিওয়ালির আগের রাত! কলকাতায় হলে তো কোনো ডাক্তারই আসতেন না। তাঁদের তো রোজই পরব। আজ খবর দিলে পরশু আসেন। বাঙালি ডাক্তারদের মতো সামাজিক উৎসবে জীবনযাপন করা মানুষ কলকাতায় এখন আর বেশি নেই। বড়ো দুঃখের কথা। তুই ডাক্তারি পড়লে পারতিস। অধ্যাপকদের, ডাক্তারদের জীবিকা, জীবিকাই শুধু নয়; এ যে এক ধরনের পুজো। আজকাল তো সকলেই লক্ষ্মীরই পুজো করেন। অন্য দেবদেবীকে আছড়ে ভেঙে ফেলেছেন সকলেই।

দাঁড়া! দাঁড়া! রিয়াদের বাড়ি তো ছেড়ে এলি ভজুকা! বললেন।

সরি। কালিয়া। এ কালিয়া।

কওন? অন্দর ঘুসেগা তো খুপরি তোড় দুংগা। সামহালহো। গেট মে তালা লাগা হুয়া হ্যায়।

এ কী জ্বালা রে বাবা! কোনোদিন তো এমন সন্ধেবেলা তালা বন্ধ হয় না!

আরে হাম আর অনিবাবু হ্যায়, সাগু অজ্ঞান হো গ্যয়া হ্যায়। হাম হিয়া রহে গা, তুম জারা অনিবাবুকি সাথ ডাগদার সাবকি পাস যাও। ম্যায় তো নেহি চিনতা-জানতা হ্যায়।

ততক্ষণে রিয়া ও নলিনী ভজুকার হিন্দি শুনে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন। টর্চ জ্বেলে গাড়িটাকেও দেখলেন। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে নলিনী বললেন, কী হয়েছে ভজুবাবু? অনি? সাগুর কী হয়েছে?

অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ইশ কেন?

পরে বলব, ভেতরে আসি। আও কালিয়া ভাই। তুমহারা লাঠি হামকো দে দো।

নেহি নেহি। লাঠি হামারা সাথহি রহেগা।

কালিয়াকে বসিয়ে অনি জোরে গাড়ি ছুটোল।

মুঝে রাস্তা বাতা দেনা কালিয়া। দুরহিসে বোল দেনা কওন তরফ মোড় লেনা হ্যায়।

কওন ডাগদারকি পাস যানা হ্যায়? সুঁই দেনেওয়ালা কি হোমিপ্যাথি?

সুঁই দেনেওয়ালা। ডাগদার কৈসি হ্যায়!

ঠিক্কে হ্যায়। মারীজ মরতা হ্যায় উনিকি হাঁথোসে, মগর দশমে পাঁচ ছে। উসসে জাদা নেহি।

আঁতকে উঠল অনি একথা শুনে।

ফিস কিতনা?

মারীজ সমঝকর লেতা উনোনে। আপলোগোঁসে তো জরুর দুশো লে লেগে। হামলোগোঁমে তো বিশ-পঁচিশ রুপাইয়া, আণ্ডা, মোরগা, দুধ ইসব লেকর ছোড় দেতে হ্যায়।

কিতনা দূর হ্যায় ঔর? বাজারে পৌঁছে বলল অনি।

ঔর ইক মাইল।

বাবাঃ। ওর মুখে চিন্তা ফুটে উঠল।

ডাক্তারের বাড়ির সামনে আরও দু-তিনটি অ্যাম্বাসাডর, মারুতি, ফিয়াট, অটো রিকশা, রিকশা। লাল নীল টুনি বালবে সাজানো হয়েছে বাড়ি। ভেতর থেকে গাঁক গাঁক করে অমিতাভ বচ্চন আর শত্রুঘ্ন সিনহার ছবির হিন্দি গানের ক্যাসেট বাজছে মাইকে। কথা শোনা যায় না কোনো। কালিয়া ডা. মহেশপ্রসাদের বসবার ঘরে নিয়ে গেল অনিকে। প্রথমে ওর লোকেরা বলল, আজ ডাক্তাবাবু বেরোবেন না। আজ আর কাল ছুটি।

মারীজ বেহোঁশ হো গ্যয়ি।

বেহুশ নেই হোনেসে মারীজ ক্যা বা?

মরভি যানে শকতি। জওয়ান লেড়কি।

মরনেকো ওয়াক্ত আনে সে তো মরনেই পরেগা। ইসমে হল্লা মাচানা কি জরুরত ক্যা?

অজীব আদমি হ্যায় ভাই তু।

হিন্দুস্থান ইক অজীব দেশ হ্যায় ভাই।

বলে, সে ভেতরে চলে গেল।

ডাক্তার মহেশপ্রসাদ, বয়েস পঁয়তাল্লিস হবে, মোটা-সোটা হাসি-খুশি হাতে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে এসে বললেন, ক্যা বাত?

অনিরুদ্ধ ইংরিজিতে বলল, মহেশপ্রসাদকে ইমপ্রেস করার জন্যে উই উইল বি গ্রেটফুল ইফ ইউ উইল কাইগুলি কাম উইথ আস। উই উইল পে হোটাটেভার উ্য ওয়ান্ট অ্যাজ ফিস।

হাঃ হাঃ! রুপাইয়াকা কাম নেই হ্যায়। লকসমীজিকি দোয়াসে ম্যায় ভরপুর, হ্যায়। আভি জারা রেস্ট মাংগতা হু। রেস্ট। ইয়ে দোদিন কোই কলমে ম্যায় জাতে নেহি। আপ মাফ কিজিয়েগা।

ভেতর থেকে শব্দ ও হুল্লোড় ভেসে এল, আররে-এ মহেশ, তেরা পাস রুহিতন হ্যায় কি নেহি? সরি?

আভভি আয়া। হুল্লা মত মাচানা। বলেই, অনির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, পরশু সুবে চেম্বারমে আনেসে শোচকে দিখেগা জানা পসিবল হ্যায় কি নেহি। সরি।

ডাক্তারকে নমস্কার করে অনি বেরিয়ে এল।

অব ক্যা কিজিয়েগা? হোমিপ্যাথি পাস যানা হ্যায় কি না?

হোমিপ্যাথি তো মেরি দাদানে খুদই জানতে হেঁ।

তব অব ঘরহ লেওট চলনা।

একটু এগিয়েই একটা ডিসপেনসারি থেকে স্মেলিং সল্ট কিনে নিল একশিশি। আর কী করবে ভেবে পেল না অনি।

.

১৪.

কোথায় কষ্ট সাগু? নীহার বললেন।

উঁ? যেন দূর থেকে উত্তর দিল সাগু।

কী বিপদে যে পড়লাম। মেয়েকে নিয়ে, আজ দেওয়ালির রাতে। সুরজের মা, কী বলব।

সুরজের মা বলল, তুমি অত চিন্তা কোরো না মাইজি। সব মুসিব্বত কেটে যাবে। আমাদের বাবু এত ভালো লোক, এত লোকের এত ভালো করেছেন, তাঁর মেয়ের কিছু খারাপ হবে না। রামজিকি দোয়াসে সবই ঠিক হোয়ে যাবে।

নীহার বললেন, বাইরে প্রদীপগুলো দিয়েছ? তুলসীতলায়, গেটে? বারান্দাতে? জানালাতে?

হাঁ মাইজি, একবার বাইরে বেরিয়ে দেখে এসো না।

দূর! মনই ভালো লাগে না। একবার টাইফয়েড হয়েছিল মেয়ের, যখন ওর পাঁচ বছর বয়েস। কলকাতা থেকে ওর বাবা ডা. সেনকে নিয়ে এসেছিলেন। তখনকার ডাক্তাররাই ছিলেন অন্যরকম। কত মায়া-দয়া ছিল, ডাক্তারের কথা শুনে আর চেহারা দেখেই রুগি আদ্দেক ভালো হয়ে যেত।

সুরজের মা বলল, এই যে ডাগদারবাবু এসেছিলেন রাঁচি থেকে এও তো বেশ ভালোই মাইজি। বয়েস কম বটে, কিন্তু কী সুন্দর দেখতে, কী ভদ্র, সভ্য, কী নরম মিঠি জবান। আমাদের সাগুর যদি এইরকম একজন বর হত, বড়ো ভালো মানাত। সাগুর মতো মেয়ে তো আর হয় না, আহা, রামজির কী ইচ্ছা কে বলতে পারে!

নীহার বললেন, আঃ। তুমি বড়ো বেশি কথা বলো সুরজের মা। যা নয় তাই। ওই কাঁচের বাটিটা নিয়ে গিয়ে জল পালটে আর একটু ওডিকোলন ঢেলে নতুন জল নিয়ে এসো তো, নতুন করে পটি দিয়ে দিই মাথায়। কপালটা এখনও আগুনের মতো তেতে রয়েছে।

সুরজের মা কাঁচের বাটিটা হাতে উঠে যেতেই, নীহার স্বগতোক্তির মতোই বললেন চলে যাওয়া সুরজের মাকে, আমাদের পাগুর আক্কেলটা একবার দেখলে! দিদি জ্বরে বেহুশ আর চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলো থেকে ভুজুবাবু নিতে এলেন বলেই ধেই ধেই করে সেজেগুজে চলে গেলেন মেয়ে। দিদির ওপর একটুও দরদ নেই।

সুরজের মা ফিরে বলল, আহা। বাচ্চা মেয়ে। ও-ই বা এখানে বসে থেকে কী করবে? আমরা তো আছিই।

বাইরে রাতপাখি ডাকছিল। প্রথমবার ডাকতেই নীহার চমকে উঠলেন। গা ছমছম করে উঠল ওঁর। পরমুহূর্তেই একটি হুতোম পেঁচা দুরগুম দুরগুম করে ডেকে উঠল ঝুপড়ি গাছের ডাল থেকে। তারপর পেঁচা-পেঁচির ঝগড়া শুরু হল। কিচি-কিচি-কিচির করে। অস্বস্তি লাগতে লাগল নীহারের। মনটাও খারাপ হয়ে গেল।

সাগু বলে উঠল, মা।

বলেই, চোখ খুলল ওই পেঁচা ডাক শুনে।

মেয়ে ও মায়ের চোখাচোখি হল। সাগুর চোখেও ভয় ছায়া ফেলে গেল একপলক।

এমন সময় সাগু বলল, একটু বাথরুমে যাব মা, আমাকে ধরবে একটু?

সুরজের মা এবং নীহার সাগুকে ধরে আস্তে আস্তে বাথরুমে নিয়ে গেলেন, ওঁরা ভেতরে যেতে চাইছিলেন। সাগু মানা করল ইঙ্গিতে।

নীহার বললেন, দরজাতে ছিটকিনি দিসনি।

জবাব দিল না সাগু। কিন্তু দরজাটা ভেজিয়েই রাখল। ফ্লাশ-এর শব্দ হল। সাগু বাইরে এল। এবং সঙ্গে সঙ্গে বাইরে একটি গাড়ির শব্দ।

গাড়ি থেকে রিয়া ও নলিনী নামলেন ভজুকার সঙ্গে।

এই যে বউদি। সাগু কেমন আছে এখন? ভজুকা বললেন!

ওইরকমই ভাই।

ওঁরা সকলে একসঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়লেন বসবার ঘর পেরিয়ে।

নীহার বললেন, সাগু, একটু না হয় চেয়ারে বোস। ভালো লাগতে পারে।

রিয়া বলল, কী রে, তুই যে তিন দিনের জ্বরেই একেবারে কাহিল হয়ে গেলি!

সাগু ম্লান হাসি হাসল। কথা বলল না।

পুজোর দিন, শাড়িটা ছাড়িয়ে ওকে একটা ভালো শাড়ি পরিয়ে দিন না বোন। নলিনী বললেন।

ভজুকা সঙ্গে সঙ্গে বলল, এই যে নতুন শাড়ি। জেঠিমা পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাণ্ড তো অলরেডি পরে ফেলেছে।

কী রে পরবি? নীহার বললেন।

রিয়া বলল, এই দেখ আমিও পরে এলাম ঠাকুরমার দেওয়া কাঞ্জিভরম।

সুরজের মা! নীহার ডাকলেন।

ভজুকা বললেন, আমি বাইরে বসছি গিয়ে বউদি। মুকুন্দবাবুর আসবার সময় হয়ে গেছে। এলেই ওষুধপত্র বুঝে নিয়ে অনি এখানে চলে আসবে। আপনারা ততক্ষণে তৈরি হয়ে নিন। সুরজের মা ও সুরজও। অনিই পাহারা দেবে সাগুকে।

রিয়া বলল, তাই বুঝি! সেবা করবে সাগুর?

পুরুষমানুষ ও কী করে সেবা করবে সাগুর! রিয়ার কথা বলার ঢঙে বিরক্ত হরেই বললেন।

বাইরে বসেই ভজুকা বললেন, সেবার চেয়ে সান্নিধ্যটাই বড়ো কথা।

নীহার বললেন, আমি যাব না ভজু ভাই। আমার মনও ভালো না। আপনারা চলে যান, আমি একটু পরে সুরজ ও সুরজের মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তা বললে তো শুনব না বউদি। মেসো, মাসি, বউদি সকলে বসে আছেন আপনাদের জন্যে। আর তো সাতটা দিন থাকব আমরা। অমন করবেন না বউদি।

তা ছাড়া যাব না ঠিক করেই আমি যে এখনও তৈরিও হইনি ভজু ঠাকুরপো!

তাহলে আমি রিয়া আর নলিনীবউদিকে আগে পৌঁছে দিয়ে আসছি, এসে আপনাকে, মানে আপনাদের নিয়ে যাব।

না গেলে একেবারেই চলবে না?

একেবারেই চলবে না।

সাগু খুব কষ্টে বলল, যাও না মা। এত করে বলছেন, আগে থেকে সব ঠিক আছে।

রিয়া বলল, তোর কাছে কি আমি থাকব সাগু?

আমার কাছে আমিই থাকব। কারুরই থাকতে হবে না। মা, তোমরা সকলে গেলেই আমার আনন্দ হবে। আমার একা থাকলেই ভালো লাগবে। একটু একা।

বাইরে আর একটা গাড়ির আওয়াজ হল। হেডলাইটের আলো জানালার পর্দার ওপর দিয়ে ঘরের মধ্যে ঝিলিক মেরে গেল। এবং পরমুহূর্তেই লোডশেডিং হয়ে গেল। গাড়ির এঞ্জিন বন্ধ হওয়ার আওয়াজের পরই কয়েকমুহূর্ত চুপচাপ। অন্ধকার। ঝিঁঝির ডাক।

নীহার বললেন, সুরজ, বাবা লণ্ঠন আন। সুরজের মা।

অনিরুদ্ধ বলল, মাসিমা। আমি এসেছি।

এসো বাবা, সাবধানে সিঁড়ি উঠো। আজ অমাবস্যা, ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ভজুকা বললেন, কী খবর অনি?

সুরজের মা এবং সুরজ প্রায় একইসঙ্গে লণ্ঠন নিয়ে এল দুটি।

অনিরুদ্ধ বলল, খবর ভালো। ম্যালেরিয়া হয়েছে। ম্যালেরিয়ার সঙ্গে বাঙালি তো সহাবস্থানে অভ্যস্তই হয়ে গেছে বহু শতাব্দী হল। দু-দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবে সাগু। আমরা চলে যাওয়ার আগে ওকে সুস্থ করে, হাঁটিয়ে তারপর…

হঠাৎ এই চলে যাওয়ার কথাটা যেন সকলকেই চমকে দিল। লণ্ঠনের আলো পড়েছিল সাগু, নীহার, রিয়া এবং নলিনীর মুখের একেক দিকে। মুখের একপিঠে অন্ধকার অন্য পিঠ আলোকিত। অনিরা যে এখানে চিরদিনের মতো থাকতে আসেনি এই সত্যটা যেন ওঁদের প্রত্যেককে একইসঙ্গে বিদ্ধ করল।

নলনী বললেন, হ্যাঁ বাবা অনি। তোমরা বোধ হয় না এলেই ভালো হত। আজ অবধি চ্যাটার্জি সাহেবের বাংলোতে তো কত চেঞ্জারই এলেন। তোমরা…

অনিরুদ্ধ বলল, ভজুকা তুমি আর দেরি কোরো না। মায়েরা সব বসে আছেন। সাগুও বিরক্ত তোমাদের দেরি দেখে। দাদু তো ঠিক দশটাতে শুয়ে পড়বেন খেয়ে দেয়ে।

হ্যাঁ। চলুন বউদি। আমরা এগোই। ভজুকা বললেন।

রিয়া বলল, আমি না হয় একটু থাকি। মাসিমার সঙ্গেই যাব।

না, না, এখনও চলো রিয়া। মাসি একবার আমার ওপর চটলে তাঁকে সামলানো কারও কর্ম নয়। আমি তোমাদের নামিয়েই এখুনি এসে বউদিকে নিয়ে যাব। ভজুকা বললেন।

রিয়া বলল, সাগুর কাছে তাহলে অনি একা থাকবে?

অনিরুদ্ধ বলল, একা কোথায়? দোকা তো!

অপ্রস্তুত হওয়া হাসি হাসল রিয়া। মুখের ওপর রাগ ছায়া ফেলে গেল।

চলুন তাহলে বউদি। ভজুকা বললেন।

ওঁরা চলে গেলেন। ভজুকার সঙ্গে সামনের সিটে বসে সুরজও। ওঁরা চলে গেলে ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিয়ে অনি বাইরে এসে বসল একটা চেয়ার নিয়ে।

অন্ধকারে কেন বাবা?

আমরা শহরের জন্তু মাসিমা। অন্ধকার আমাদের কাছে বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে একটি।

তাহলে একটু বোসো। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

ভেতর থেকে সাগু আদুরে গলায় বলল, আমাকে কি ডাক্তার শুধু ওষুধ খেয়েই থাকতে বলেছেন?

অনিরুদ্ধ চমকে উঠে বলল, একদম না। ম্যালোরি জ্বরের মতো জ্বরই নেই। জ্বরের মনে জ্বর চলবে; খাওয়ার মনে খাওয়া। যা খুশি খেতে পারো। যখন ইচ্ছে করবে। ডাক্তার কাল আবার তোমাকে দেখতে আসবেন নিজেই গাড়ি চালিয়ে।

বলেই, একটু থেমে বলল, জানেন মাসিমা। তাঁর কথাবার্তা শুনে আমার কিন্তু মন বলছে…

কী বলছে মন?

ডাক্তারের খুবই মনে ধরে গেছে সাগুকে। চমৎকার মানুষ কিন্তু। আমাদের চেয়ে কতটুকুই বা বড়ো। কিন্তু কী প্র্যাকটিস। সবচেয়ে বড়ো কথা একটুও গুমোর নেই। সুদর্শন, পয়সাওয়ালা, কৃতী অথচ সত্যিকারের বিনয়ী।

নীহার বললেন, সেকথা তো তোমার বেলাও খাটে বাবা। মানে এইসব গুণের কথা।

অনিরুদ্ধ হাঃ হাঃ হো: হো করে হেসে বলল, কার সঙ্গে কার তুলনা মাসিমা! আমি তো কিছুই নই এখনও। আমার বাবা বড়োলোক। বাবার পরিচয় তো আমার পরিচয় নয়। যারা নিজের পরিচয়ে পরিচিত না হতে পারে তারাও কি মানুষ! বাবার পয়সা থাকা একটা গুণ নাকি? না, পরিচয় দেবার মতো?

একটু পরে নীহার বাইরে এসে বললেন, চলো বাবা। তুমি একেবারে একা থাকবে সাগুর কাছে, তার চেয়ে সুরজের মাকেও রেখে যাই, ওর খাবার না হয় নিয়ে আসব আমি ফেরার সময়, নয়তো সুরজকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব।

আপনি যা ভালো মনে করেন মাসিমা। সাগুর জন্যেও গরম গরম লুচি, বেগুন ভাজা, কুমড়োর ছক্কা, এসব পাঠিয়ে দেবেন। মাংস আর রাবড়ি বোধ হয় জ্বরের মধ্যে না খাওয়াই ভালো হবে।

পাঠাব। ডাক্তারের যখন নিষেধ নেই। নীহার বললেন।

অনিরুদ্ধ বলল, ওই যে ভজুকা আসছেন। আপনি ফিরে এসে দেখবেন সাগুর জ্বর কমে গেছে, কি ছেড়েই গেছে। ম্যালেরিয়া জ্বর তো ভালুকের জ্বরেরই মতো।

চলুন মাসিমা। বউদি বললেন অনি আর সাগুর খাবার হট-কেসে করে পাঠিয়ে দেবেন সুরজের হাতে। গরম-করা প্লেটচামচ-টামচ সব ন্যাপকিনে মুড়ে পাঠিয়ে দেবেন। আজ ওদের পিকনিক।

নীহার বললেন, চলোম রে সাগু। অনিকে জ্বালাস না। সুরজের মা, তোমার জন্যেও খাবার…

গাড়িটা চলে গেল। অন্ধকারের মধ্যে গাড়ির টেইল লাইটে লাল ধুলো উড়ছে দেখা গেল। ভজুকা, গেট পেরিয়ে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেটটাকে বন্ধ করলেন।

অনি সুরজের মাকে জিজ্ঞেস করল, মাইজি, আমি কি সাগুর কাছে যেতে পারি?

সুরজের মা বলল, দু-মিনিট আর।

সাগুকে শাড়ি শায়া বদলে জামা বদলে মুখটা একটু পরিষ্কার করে খাটে শুইয়ে চাদর দিয়ে গা ঢেকে দিল সুরজের মা। জ্বরের মধ্যে ব্রেসিয়ার পরেনি সাগু।

আইয়ে দাদাবাবু।

খুব দেখালে যা হোক ভেলকি। আমরা ভেবে ভেবে মরি। ডাক্তার তো সন্দেহ করেছিলেন খারাপ কিছু। অনি বলল সাগুর ঘরে ঢুকে খুশি মনে।

কী?

এনকেফেলাইটিস।

তোমরা তো এসেছ এখানে মজা করতে ক-দিনের জন্যে। মিছিমিছি পরকে আপন করে নিয়ে এমন ঝামেলায় পড়া কেন?

তা ঠিক। কিছু মানুষ থাকে অবশ্য আমাদের মতো, যারা পরকে আপন করে, আপনারে পর…

গানটা জানো?

জানি, বাহিরে বাঁশির ডাকে ছেড়ে যায় ঘর, ওরা পরকে আপন করে আপনারে পর..

শোনাবে?

আজ নয়। অন্য কোনো সময়ে।

সময় তো আর বেশি নেই।

কার?

তোমার?

কেন?

থাকবে তো মোটে আর কটা দিন। রাত পোয়ালে হাতে থাকবে আর কটা দিন!

অনেকই দিন। ওয়াটার্লুর যুদ্ধ ক-দিনে শেষ হয়েছিল জানো?

আসলে দিনের সংখ্যা দিয়ে দিন কখনো মেপো না। দিনের ঔজ্জ্বল্য দিয়েই দিন মাপতে হয়।

তা ঠিক।

একটু চুপ করে থেকে সাগু বলল, তুমি আবার কখনো আসবে এখানে? অনি?

সত্যি বলব? না মিথ্যা?

সত্যি যা তাই বলো।

আমি নিজেই জানি না।

কেন?

এই একটা মাত্র জীবনে আমি তুমি আমরা সকলেই ঝড়ের পাতারই মতো, কোন উড়ানে কোন হঠাৎ-হাওয়া যে, আমাদের এই বিপুল পৃথিবীর কোন কোণে উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে তা আমরা নিজেরা কেউই জানি না।

তার মানে, আসবে না আর?

তা কিন্তু বলিনি।

কী বললে, তাহলে?

বললাম, না থাক। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।

খুবই ভালো পারো।

কখনো, কখনো পারি না। দাও, তোমার মাথাটা টিপে দিই।

মাথায় খুব ব্যথা?

ছিল। এখন নেই।

তোমার হাত টিপে দেব?

হাতে তো ব্যথা নেই, ম্লান হেসে বলল সাগু।

টিপে তাহলে ব্যথা করে দিই? অনিরুদ্ধ বলল।

সাগু হেসে ফেলে, চাঁদরের ভেতর থেকে ডান হাতটা বের করে দিল।

বাঃ, কী সুন্দর তোমার হাতের আঙুলগুলি। আর্টিস্টিক।

তোমার চোখ সুন্দর, তাই সবই সুন্দর দেখো।

একটা কথা বলব?

কী?

তুমি কখনো চোখে কাজল দিয়ো না। সেদিন যেমন দিয়েছিলে।

কেন?

তোমার চোখ দুটিকে এমন দেখায় কাজল পরলে যে, আমার বুক ধড়ফড় করে। হয়তো সকলেরই করে। কী দরকার অমন কষ্ট বাড়িয়ে?

মিথ্যুক।

সত্যি বলছি। উর্দুতে একটা শায়ের আছে—

উলঝি সুলঝি রহনে দো
কিউ শরপর আফত লাতি হো?
দিলকা ধড়কান বাড়তি হ্যায়
যব বাঁলোকো সুলঝাতি হো।

বিচ্ছিরি উচ্চারণ তোমার উর্দুর। সংজ্ঞা বলল।

তা হতে পারে। বক্তব্য তো সুন্দর। অনি জবাব দিল।

মানেটা বলো আমাকে, শুনি।

উসকো-খুসকোই থাকো তুমি, আমার শিরে বিপদ ডেকে এনো না লক্ষ্মীটি। তোমার চুল আবার কেন আঁচড়াচ্ছ? আমার বুকের ধড়ফড়ানি তাতে বেড়ে যায় যে!

উর্দু কবি সজ্জন। তুমিই ডাহা মিথ্যেবাদী।

যে-কথা সত্যিই সত্যিই সে-কথা বেশির ভাগ সময়েই মিথ্যের মতো শোনায়।

হয়তো তাই।

ভালো লাগছে তোমার?

খুউব।

কেন? তোমার হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি বলে?

না। শুধু সেজন্যেই নয়। তুমি কাছে আছ বলেও। আমার এই ছোট্ট জীবনে এত ভালো আর কখনো লাগেনি।

অনি মাথা নীচু করে সাগুর চোখের পাতাতে একটি আলতো চুমু খেল। অস্ফুটে বলল, তুমি খুব ভালো জানো। ভাগ্যিস এই গামারিয়াতে এসেছিলাম। এই অচেনা-অজানা জায়গাতে আসতে খুবই আপত্তি ছিল আমার। কিন্তু না এলে তো তোমার সঙ্গে আলাপ হত না। এখন ভাবি।

দু-দিকে মাথাটা এপাশ ওপাশ করল সাগু বালিশের ওপর। দু-চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে গেল। চোখ বুজে ফেলল ও।

এ কী!

কিছু না। আমি এইরকমই… দুঃখে হাসি, আনন্দে কাঁদি।

এইবার একটা ট্যাবলেট খেতে হবে। দাঁড়াও উঠে দিই তোমাকে।

সুরাতিয়া মউসিকে ডাকো না।

ও তো জানে না কোন ওষুধ। ওষুধ খাওয়ানো কী এমন কষ্টের কাজ বলে, তেপায়া থেকে কাঁচের গ্লাসে জল ঢেলে নিয়ে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের স্ট্রিপ থেকে ওষুধ ছিঁড়ে নিয়ে ট্যাবলেট বের করে সাগুর কাছে এসে বলল, খাও। নিজে কি উঠতে পারবে?

ওঠবার চেষ্টা করল সাগু, কিন্তু পারল না।

সাগু বলল, মাথাটা বড়ো ভার হয়ে আছে।

অনিরুদ্ধ বলল, আমি ধরছি। বলে, ওর মাথার নীচে দিয়ে কাঁধে হাত দিয়ে মাথাটা একটু উঁচু করে ট্যাবলেটটা দিয়ে বলল, নাও–বলে জলের গেলাসটা ঠোঁটে ছোঁওয়াল। ওষুধ খাওয়া হলে মাথাটা নামিয়ে নিজের হাতটা আস্তে করে বের করে আনল।

আলো আজ আর আসবে না বোধহয়। এখানে এরকম হয় মাঝে মাঝে।

নাই-ই বা এল। ভয় কী? অমাবস্যা রাতেও কত তারা দেখা যায়। কলকাতায় সত্যিই কারওই থাকা উচিত নয়। না বোঝা যায় পুর্ণিমা, না অমাবস্যা।

এখানে আবার যদি কখনো আসে তাহলে কোজাগরি পূর্ণিমার আগে এসো। একেবারে অন্যরকম মনে হবে।

তুমি যেখানে থাকবে সেখানেই তো পূর্ণিমা। সব সময়ই।

মিথ্যে কথা তোমার মতো সুন্দর করে কেউ বলতে পারে না। আর এমন করে বলো যে, সত্যি বলে বিশ্বাসও করতে ইচ্ছা করে।

একটু চুপ করে থেকে, সাগু বলল, আমি আর কথা বলতে পারছি না, বড্ড দুর্বল লাগছে। তুমি একটা গান শোনাবে আমাকে?

হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলি রে, হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে..খালি গলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইল অনি।

বাইরে পায়ের শব্দ পেয়ে, অনি বলল, কওন?

সুরজের মা বলল, সুরজ এল আমার আর সাগুর খাবার নিয়ে।

অনিরুদ্ধ সাগুকে বলল, তাহলে আমি এবারে যাই? অনেকক্ষণ পাহারা দিলাম তোমাকে।

সাগু কিছু না বলে চেয়ে থাকল নীরবে।

অনি ওর হাতে হাত রেখে আসি বলে চলে গেল।

.

১৫.

চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলো।

খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। এবারে বাড়ি যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে সকলে। পাগু তখনও মালির সঙ্গে বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে তারাবাতি জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

নলিনী বললেন, বাবাঃ, যা খাওয়া হল। বহুদিন এমন খাইনি।

রিয়া বলল, যা বলেছ মা।

নীহার বললেন, আমাকে হজমের ওষুধ খেতে হবে।

নীপবালা বললেন, কী যে বলো না তোমরা! এই টুকু-টুকু মেয়ে সব। বেশি বেশি। তারপর বললেন নলিনী, তোমার মালির জন্যে খাবার নিয়েছ তো?

হ্যাঁ মাসিমা।

ওই দেখো পানই যে দিতে ভুলে গেলাম। ভজু এত কষ্ট করে চওক থেকে মিষ্টি পান। সেজে আনল।

রাবড়ি খেয়ে মুখ মেরে গেছে। পান নিয়ে যাচ্ছি। কাল খাব।

অনিকে আসতে দেখে, টর্চ জালাতে জ্বালাতে অনি আসছিল অন্ধকারে পথ দেখে, রিয়া বলল, এই যে অনি। তুমি এত দেরি করলে, দেখো সকলে খেয়ে দেয়ে চলে যাচ্ছেন।

আমি তো রোগিনিকে পাহারা দিচ্ছিলাম। কর্তব্য করছিলাম। কর্তব্য শেষ না হলে আসি কী করে?

সত্যি! ভারতের ঘরে ঘরে এমন কর্তব্যজ্ঞানী মানুষ হোক।

রিয়ার কথা এবং কথার ধরনে সকলেই একটু অবাক হলেন।

কিন্তু সপ্রতিভ অনি গা না করে বলল, তুমিও এক্ষুনি চললে নাকি? রাত তো মোটে সাড়ে ন-টা। বোসো না। ভজুকাকা কেমন জমিয়ে গল্প করবেন। শোনো। ভজুকাকার বাঘ শিকারের গল্পটা না শুনে তো যাওয়া চলবে না তোমার।

সুমিতা বললেন, অনি তুই এবারে খেয়ে নে। আমাকেও তো ওঁরা জোর করে সঙ্গে বসালেন।

বেশ করেছ। তা খাব এখন আমি। ভজুকা নিশ্চয়ই খায়নি।

সুমিতা বললেন, সে এখন খাবে?

তাহলে আর কী! কী রিয়া? থাকো না। ভজুকা পৌঁছে দেবে তোমাকে।

রিয়া বলল, নাঃ। থ্যাঙ্ক ইউ। দেখা হবে। চলো মা। চলি মাসিমা, ঠাকুমা,–বলে, সকলের আগে আগেই রিয়া সিঁড়ি দিয়ে নামল।

সুমিতা একটু বিরক্তিমাখা গলায় বললেন, অনি এখন খাবে ভজু, তুমিই ওঁদের একটু ছেড়ে দিয়ে এসো। নীহারকেও নামিয়ে দিয়ো।

ভজুকা বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়। কোই বাত নেহি। চলুন, চলুন।

অনি বলল, আমি গরম জলে একটু চান করে নিচ্ছি। তুমি এলেই বসব ভজুকা।

তথাস্তু।

গাড়িতে উঠে স্টার্ট করল ভজুকা, এমন সময় মুকুন্দবাবু এসে বললেন, আমি ছেড়ে দিয়ে আসছি। আপনি আবার কেন যাবেন?

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress