Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রাশা বারান্দায় পা তুলে বসে আছে, তাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড়! বেশ কিছু পেট মোটা শিশু একধরনের কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের গায়ে কোনো কাপড় নেই, পোশাক বলতে কোমরে একটা কালো সুতো, সেখান থেকে নানা আকারের তাবিজ ঝুলছে। কিছু কম বয়সী মেয়েও আছে, তাদের এক-দুইজন শাড়ি পরে আছে, তাই তাদের দেখে রীতিমতো বড় মানুষের মতো মনে হচ্ছে। কয়েকজন রুগ্‌ণ মহিলা, তাদের কোলে ন্যাঁদা ন্যাঁদা বাচ্চা, বাচ্চাদের গলায় বড় বড় তাবিজ।

রাশা কী করবে ঠিক বুঝতে পারছিল না, যারা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তারা কোনো কথা বলছে না, নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবছিল তখন, রুগণ একজন মহিলা জিজ্ঞেস করল, “তুমি নীলু বুবুর মেয়ে না?”

রাশা মাথা নাড়ল। মহিলা এবারে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাপ তোমার মায়েরে ছেড়ে দিয়েছে না?”

রাশা একটু অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। যখন তার আব্বু-আম্মুর মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে তখন ওর ক্লাসের সবাই সেটা জেনে গিয়েছিল কিন্তু একদিনও কেউ তাকে এটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অথচ চেনা নেই জানা নেই মহিলাটি কী সহজে তাকে এটা জিজ্ঞেস করে ফেলল। রাশা একটু অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল, সে কিছু বলার আগেই আরেকজন মহিলা মাথা নেড়ে বলল, “ছেড়ে চলে গেছে, অমিরা জানি।”

প্রথম মহিলা জিজ্ঞেস করল, “এখন তোমাদের চলে কেমন করে?”

রাশার নিজের কানকে বিশ্বাস হতে চায় না যে কেউ এরকম একটা প্রশ্ন করতে পারে। সে একটু অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল, তখন আবার আরেকজন গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়ে দিল, বলল, “টাকা-পয়সার টানাটানি তো হয়েছেই, তা না হলে নীলু বুবু মেয়েটারে এইখানে ফেলে যায়?”

কমবয়সী একজন গম্ভীর গলায় বলল, “স্বামী ছেড়ে গেলে অনেক কষ্ট।”

বয়স্কা একজন মহিলা বলল, “মনে নাই জমিলার কথা? দুইটা বাচ্চা নিয়া সোজা বাপের বাড়ি। বাপের নিজের পেটে ভাত নাই তখন তার সাথে মেয়ে আর দুই বাচ্চা।”

রাশা নিশ্বাস বন্ধ করে আলাপ-আলোচনা শুনছিল, তখন সাত-আট বছরের একটা মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

“রাশা”

“রাশা? এইটা আবার কী রকম নাম?”

“কেন? রাশা নামে সমস্যা কী?”

“আমরা কোনোদিন এই রকম নাম শুনি নাই।”

মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা বলল, “শহরের মানুষের নাম এই রকমই হয়। আমার ননদের ছেলেমেয়ের নাম এই রকম। তুরকা মুরকা—”

শহরের মানুষের বাচ্চাদের নাম তরকা মুরকী হয় শুনে ছোট বাচ্চাগুলো আনন্দে হেসে ওঠে। নাক থেকে সর্দি বের হচ্ছে এরকম একজন ছেলে তখন সাহস করে এগিয়ে এসে রাশার কনুইটা ছুঁয়ে দেখল। মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার বিয়ে হয়েছে?”

রাশা চোখ কপালে তুলে বলল, “বিয়ে? আমার?”

“হ্যাঁ।”

“আমার এখনই বিয়ে হবে কেন? আমি এখন মাত্র ক্লাস এইটে পড়ি।”

যে মহিলাটির ননদের ছেলেমেয়ের নাম তুরকা মুরকা সে গম্ভীর হয়ে বলল, “শহরের মেয়েছেলেদের বিয়েশাদি অনেক দেরি করে হয়।”

কমবয়সী একটা মেয়ে কিন্তু শাড়ি পরে থাকার কারণে যাকে বড় লাগছে, সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কতদিন থাকবে?”

রাশা কষ্ট করে মুখের চেহারা স্বাভাবিক রেখে বলল, “আমি জানি না। মনে হয় কিছুদিন থাকব।”

আলোচনা আরো কিছুক্ষণ চলত কিন্তু এরকম সময় কোথা থেকে জানি নানি এসে হাজির হলেন, তাকে দেখেই ন্যাংটা ছোট বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে ছুটে পালিয়ে গেল, যারা একটু বড় তারাও পিছিয়ে এলো। নানি এগিয়ে এসে চোখ সরু করে সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী দেখতে এসেছ, সার্কাস?”

মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা বলল, “না খালা। শুনতে পেলাম নীলু বুবুর মেয়ে এসেছে তাই

“যদি সার্কাস না হয়ে থাকে তাহলে এই রকম ভিড় করে আছ কেন? বাড়ি যাও সবাই।”

কোনো কথা না বলে সবাই তখন সরে পড়ল। রাশা বারান্দা থেকে নিচে নেমে বলল, “থ্যাংকু নানি।”

নানি বললেন, “একটু সহ্য করো। এই গাঁও-গেরামে কারো কিছু করার নাই। একটা ছাগলের বাচ্চা হলে সেইটাই হয় একটা ঘটনা। দশ গ্রামের মানুষ সেটা দেখতে আসে। তুই তো আস্ত মানুষ। তোকে দেখতে আসবে না?”

ব্লাশা কোনো কথা বলল না। নানি নিজের মনে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। রাশা উঠানের মাঝখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, নানি মনে হয় ঠিকই বলেছেন। যেখানে কোনো কিছু ঘটে না সেখানে শহর থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া বাবা-মায়ের একটা মেয়ের চলে আসাটা নিশ্চয়ই অনেক বড় ঘটনা। গ্রামের মানুষ সেই মেয়েটাকে দেখতে আসতেই পারে। রাশার ইচ্ছে করল কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকে। তার এই নানি বাড়িতে সে কোথায় থাকবে কিছু জানে না। তার নিজের খানিকটা জায়গা হবে কিনা সেটাও সে জানে না, কোথায় গিয়ে সে লুকাবে কে জানে?

পুকুরের ঘাটটা নিরিবিলি, হয়তো চট করে সেখানে কেউ চলে আসবে। রাশা তাই সেদিকেই এগিয়ে গেল। ঘাটের পাশে বসার জন্যে যে জায়গাটা আছে সেখানে বসে থাকলে কেউ দেখে ফেলবে, তাই সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে এমন জায়গায় বসে যেন কেউ তাকে সহজে দেখতে না পায়।

রাশা কালো পানির দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারে জায়গাটা আসলে খুব সুন্দর। তার মন ভালো নেই তাই তার চোখে পড়ছে না পুকুরটার চারপাশে গাছ, সেই গাছে পাখি কিচমিচ করে ডাকছে। জনমানবহীন নির্জন এলাকা, কেমন জানি একটু গা ছমছম করা ভাব আছে।

রাশা পুকুর ঘাটে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকে, সে এখনো পরিষ্কার করে কিছু বুঝতে পারছে না। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এখানে হয়তো তার বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। সে এখনো জানে না সে আর লেখাপড়া করতে পারবে কিনা। রাশার মনে হয় তার বুঝি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।

ঠিক এরকম সময় সে একজনের পায়ের শব্দ শুনতে পেল, কেউ একজন পুকুর ঘাটের দিকে আসছে। একটু পরেই সে মানুষটিকে দেখতে পেল, সাত-আট বছরের একটা শুকনো ছেলে, মাথায় এলোমেলো চুল, কাদামাখা শরীর। ছেলেটি আপন মনে কোনো একটা গান গাইছে, গলায় কোনো সুর নেই কিন্তু তাতে তার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। রাশা এমনভাবে বসেছিল যেন তাকে সহজে দেখা না যায়, তাই ছেলেটি তাকে দেখল না। পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে সে তার শার্ট খুলে ঘাটে ছুঁড়ে ফেলল, তারপর তার প্যান্ট খুলে ফেলতে শুরু করল।

না জেনে অপরিচিত একটা মেয়ের সামনে প্যান্ট খুলে ফেলে ছেলেটি লজ্জা না পেয়ে যায়, তাই রাশা একটু কাশি দেয়ার মতো শব্দ করল। কিন্তু তার ফল হলো ভয়ানক। শুকনো ছেলেটি চমকে উঠে মাথা ঘুরে তাকাল এবং রাশাকে দেখতে পেয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং কিছু বোঝার আগেই সে তাল হারিয়ে ঝপাং করে পানির মাঝে পড়ে গেল।

রাশা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, ছেলেটা ততক্ষণে সাঁতরে পুকুরের মাঝামাঝি চলে গেছে, সেখান থেকে সে চিৎকার করতে থাকে। রাশা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার?”

ছেলেটা সাঁতরে পুকুরের অন্য পাশে চলে যেতে যেতে বলল, “ভূত!”

“ভূত!” রাশা অবাক হয়ে বলল, “কোথায় ভূত?”

“তুমি!”

রাশা চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি? আমি ভূত?”

“হ্যা”

“না–” রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “আমি ভূত না।”

“খোদার কসম?”

“খোদার কসম।”

“তুমি তাহলে কে?”

“এইটা আমার নানি বাড়ি। আমি আমার নানির কাছে এসেছি। আমার নাম রাশা।”

“লাশা?”

“না। লাশা না। রাশা।”

ছেলেটা নিশ্চয়ই পানির পোকা, মাঝ পুকুরে ভাসতে ভাসতে বলল, “সত্যি কথা বলছ?”

“হ্যাঁ সত্যি কথা বলছি।”

ছেলেটা তখন সঁতরে সাঁতরে পুকুর ঘাটের দিকে আসে। শ্যাওলা ঢাকা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রাশার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল, তার মাথা থেকে চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। রাশা একটু এগিয়ে যেতেই সে চিৎকার করে বলল, “কাছে আসবা না।”

রাশা দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “ঠিক আছে আসব না।”

ছেলেটি বলল, “এইটা তোমার নানি বাড়ি?”

“হ্যাঁ।”

“মিছা কথা।“

“কেন? মিথ্যা কথা কেন হবে?”

“আমি তোমারে আগে কোনোদিন দেখি নাই।”

“আমি আগে কোনোদিন আসি নাই, সেই জন্যে দেখো নাই।”

“খোদার কসম?”

রাশা বলল, “খোদার কসম।”

মনে হয় এইবার ছেলেটার একটু বিশ্বাস হলো, সে ঘাটে উঠে এসে বলল, “তোমারে দেখে যা ভয় পাইছিলাম।”

“ভয় পাওয়ার কী আছে?”

“মঙ্গলবার দুপুর খারাপ সময়। ভূত-পেত্নি বের হয়।”

রাশা এইবারে একটু হেসে ফেলল, সত্যি কথা বলতে কি অনেক দিন পর সে প্রথমবার একটু হাসল। রাশাকে হাসতে দেখে ছেলেটা কেমন যেন চটে উঠে, গরম হয়ে বলল, “হাসো কেন তুমি? হাসো কেন?”

“তোমার কথা শুনে।”

“আমার কোন কথাটা হাসির?”

“ভূত-পেত্নির কথাটা।”

“তুমি বলতে চাও শনিবার আর মঙ্গলবার ভূত-পেত্নি বের হয় না?”

“ভূত-পেত্নি থাকলে শনি, মঙ্গল কেন অন্যবারেও বের হতো। ভূত পেত্নি বলে এই দুনিয়াতে কিছু নাই।”

ছেলেটা একধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয়, রাশার কথায় সে বুঝি রীতিমতো অপমানিত বোধ করছে। ক্রুদ্ধ মুখে বলল, “যেই জিনিসটা জানো না সেইটা নিয়ে কথা বলা ঠিক না।”

“আমি জানি। সেই জন্যেই বলছি।”

“তুমি জিন ভূত-পেত্নি বিশ্বাস করো না?”

“না।”

“যখন দেখবা তখন মজাটা টের পাবা।”

রাশা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তুমি আমাকে একটা ভূত দেখাতে পারবে?”

“সেইটা আর কঠিন কী? অমাবস্যার রাতে শুশানঘাটে গেলেই দেখবা ভূত-প্রেত আর পিশাচ ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

রাশা তার মুখের হাসিটা আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, “তুমি আমাকে একটা ভূত ধরে এনে দিতে পারবে?”

“ভূত ধরে আনব?”

“হ্যাঁ যদি ভূত ধরে আনতে পারো তাহলে তোমাকে আমি একশ টাকা দিব। আর যদি একটা শিশিতে ভরে এনে দিতে পারো তাহলে তোমাকে দিব একশ তিরিশ টাকা।”

ছেলেটা কয়েক সেকেন্ড রাশার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুমি আমার সাথে মশকরা করছ?”

রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

ছেলেটার আরো রেগে উঠার কথা ছিল কিন্তু সে রেগে না উঠে হঠাৎ করে দাঁত বের করে হেসে ফেলল, বলল, “তুমি অনেক আজিব মানুষ।”

“আজিব কোনো শব্দ নাই। শব্দটা আজব।”

ছেলেটা আরো জোরে জোরে হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, “আজিব! আজিব! একদম আজিব।”

রাশা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

“জিতু। জিতু মিয়া।”

“ভেরি গুড জিতু মিয়া। তোমার সাথে আমার পরিচয় হলো।”

জিতু মিয়া আবার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে থেমে গেল, বলল, “তোমারে আমি কী ডাকব? রাশা খালা?”

“খবরদার। আমাকে খালা ডাকলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।”

“কিন্তু তুমি তো সম্পর্কে আমার খালা। তোমার মা হচ্ছে আমার নানির ফুপাতো বোন-”

“আমি এতো কিছু বুঝি না, কিন্তু আমাকে খালা ডাকতে পারবে না। আমাকে খালা ডাকলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।”

রাশার কথা শুনে জিতু মিয়ার খুব আনন্দ হলো, সে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, “আজিব! আজিব! তুমি এক্কেবারে আজিব!”

“আজিব হলে আজিব।”

“তাহলে তোমাকে কী বলে ডাকব?”

“আমার নাম রাশা। রাশা বলে ডাকো।”

জিতু মিয়া জিবে কামড় দিল, বলল, “সর্বনাশ! তুমি আমার বড়, তোমারে নাম ধরে ডাকলে গুনাহ হবে।”

“তাহলে রাশা আপু বলে ডাকো। শর্টকাট করে বলতে পারো রাশাপু।”

এই নামটা জিতু মিয়ার খুব পছন্দ হলো, হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “রাশাপু! রা-শা-পু! এইটা ঠিক আছে। খালারে আপু ডাকলে লোকজন মনে হয় পাগল বলবে। বললে বলুক!”

জিতু মিয়া এবারে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল সেখানে থেকেই একটা লাফ দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তাকে দেখা গেল না, একটু পরে পুকুরের মাঝামাঝি ভুস করে সে ভেসে উঠল, চিৎকার করে কিছু একটা বলে সে আবার পানিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। দেখে রাশার রীতিমতো হিংসা হয়, বাচ্চা ছেলেটা পানিতে কী সুন্দর দাপাদাপি করছে, দেখে মনে হয় শুকনো মাটি থেকে পানিটাই বুঝি তার জন্যে সহজ! এই বাচ্চাটার মতো সেও যদি সাঁতার জানত তাহলে সেও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত!

নানি বাড়িতে সন্ধে হলো খুব বিচিত্রভাবে। আশেপাশে যা কিছু ছিল সবাই যেন বুঝে গেল, সন্ধে হচ্ছে, তাই বাড়ি ফিরতে হবে। গরু লাইন ধরে তাদের বাড়ি ফিরে এলো। পুকুর থেকে হাঁসগুলো থপ থপ করে উঠে এলো, মোরগ-মুরগিরাও ব্যস্ত হয়ে তাদের ঘরে ঢুকে পড়তে লাগল। আশেপাশের গাছে পাখির কিচিমিচি ডাক একশ গুণ বেড়ে গেল, আকাশে বড় বড় বাদুড় উড়তে লাগল। দূর থেকে উলুধ্বনি শোনা গেল, তারপর আরো দূর থেকে আজান। তারপর আস্তে আস্তে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। ইলেকট্রিসিটি নেই, তাই কোনো বাতি জ্বলে উঠল না। নানি একটা হ্যারিকেন আর দুটি কুপি বাতি জ্বালালেন। কুপি বাতির আলোটা একটা জীবন্ত প্রাণীর মতো দপদপ করে জ্বলতে থাকে, রাশা অবাক হয়ে দেখে আগুনের শিখার সাথে সাথে তার বড় একটা ছায়া টিনের দেয়ালে ছটফট করে নড়ছে। এর আগে রাশা মনে হয় কখনোই ঠিক করে অন্ধকার দেখেনি, ঘর কখনো অন্ধকার হলেই টুক করে লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে, সাথে সাথে অন্ধকার ছুটে পালিয়েছে। এই প্রথমবার চারিদিক থেকে অন্ধকার তাকে চেপে ধরছে, কুপি বাতির আলো সেই অন্ধকারকে কোনোভাবেই দূর করতে পারছে না। বরং মনে হচ্ছে এই আলোর কারণে চারপাশে অন্ধকার বুঝি আরো জমাট বেঁধে যাচ্ছে।

রাশা বারান্দায় চুপচাপ বসে রইল। শুনতে পেল আস্তে আস্তে পাখির কিচিমিচি ডাক কমে আসছে, বাতাসে শুধু গাছের পাতার শিরশির এক ধরনের শব্দ। কী অদ্ভুত সেই শব্দ, শুনলেই বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা লাগতে থাকে।

হঠাৎ খুব কাছে থেকে ঠিক মানুষের গলায় কে জানি হোয়া হোয়া হোয়া করে শব্দ করে উঠল, রাশা চমকে ওঠে, ভয়ে তার বুক ধক ধক করতে থাকে। লাফিয়ে উঠে সে ঘরের ভেতর ছুটে গেল। কোনার রান্নাঘরে মাটির চুলোতে নানি রান্না করছেন, রাশাকে ছুটে আসতে দেখে বললেন, “কী হয়েছে?”

“ওটা কীসের শব্দ?”

নানি বললেন, “কোনটা?”

“ঐ যে ডাকছে।”

নানি কান পেতে শুনলেন, তারপর ফিক করে হেসে বললেন, “ও মা! তুই কখনো শেয়ালের ডাক শুনিসনি?”

“এটা শেয়ালের ডাক?”

“হ্যাঁ।”

“কী আশ্চর্য, ঠিক মানুষের মতো গলা!”

“কে জানে হয়তো মানুষই ডাকছে। শেয়ালেরা মাঝে মাঝে মানুষের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যায়। নিজের বাচ্চার মতো করে পালে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। আমি যখন ছোট তখন এই গ্রামে শেয়ালের খুব উৎপাত। সবাই মিলে তখন শেয়ালের গর্তে ধোয়া দিয়ে শেয়ালগুলোকে বের করে পিটিয়ে পিটিয়ে মারল! মরা শেয়ালগুলো যখন ফেলে দিচ্ছিল তখন দেখে একটা শেয়াল অন্যরকম, লেজ নাই, গায়ে লোম নাই। ভালো করে তাকিয়ে দেখে মানুষের বাচ্চা!”

রাশা একটু শিউরে উঠে বলল, “ইশ!”

“গাঁও-গেরায়ে যখন বাচ্চা হয় তখন খুব সাবধানে থাকতে হয়।”

নানি আবার চুলোতে কিছু শুকনো পাতা গুঁজে দিয়ে আগুনটা আরেকটু বাড়িয়ে নিলেন। চুলোর কাছে এত গরমে নানি রান্না করছেন তার কোনো কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয় না। রাশা কিছুক্ষণ রান্নাঘরে নানিকে রান্না করতে দেখে, তারপর আবার বের হয়ে এসে বারান্দায় বসল।

বাইরে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর অন্ধকারে চোখ একটু সয়ে আসার পর সবকিছু আবছা আবছাভাবে দেখা যেতে থাকে। রাশা আকাশের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল, সারা আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা ঝকঝক করছে। সে কোনোদিন টের পায়নি যে আকাশে এতে তারা আছে, সত্যি কথা বলতে কী, সে আগে কখনো আকাশের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি। আকাশে যখন তারাগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে তখন সেটা যে এত সুন্দর হতে পারে সে কল্পনাও করেনি। ঠিক তখন সে দেখল একটা তারা আকাশ থেকে খসে পড়ল। কী আশ্চর্য! সে বইয়ে পড়েছে রাতের আকাশে যখন উল্কা ছুটে যায় তখন সেটা জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যায়। সে এই প্রথমবার একটা উল্কাকে এভাবে ছুটে যেতে দেখল। রাশা অনেকটা সম্মোহিতের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাতের খাবারের আয়োজন হলো খুব সাদামাটা। ঘরের মেঝেতে একটা পাটি বিছানো হলো, সামনে রান্নার ডেকচি আর থালা। নানি একটা পিড়িতে পা ছড়িয়ে বসলেন, প্লেটটা নিলেন নিজের কোলে। রাশার প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললেন, “তোর মনে হয় এখানে খাবার কষ্টে হবে। আমি একা মানুষ, এতদিন ঘাস-লতাপাতা খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। তুই তো পীরবি না।”

রাশা বলল, “তুমি যদি ঘাস-লতাপাতা খেতে পারো, আমিও পারব।” নানি মাথা নাড়লেন, বললেন, “না। তোদের বাড়ন্ত শরীর। ভালো করে খেতে হবে।”

নানি রাশার প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগলেন। ভাত, সবজি, মুরগির মাংস। রাশার কেমন জানি রাক্ষসের মতো খিদে পেয়েছিল, সে বুভুক্ষের মতো খেল। খাবারে ঝাল একটু বেশি কিন্তু খুব চমৎকার রান্না, বাসায় ফ্রিজের বাসি খাবার গরম করে খাওয়া থেকে একবারে অন্যরকম। সবকিছুতে কেমন যেন একটা তাজা তাজা ঘ্রাণ।

রাশা বলল, “নানি তুমি খুব সুন্দর রান্না করতে পারে!”

নানি হাসলেন, বললেন, “একসময় পারতাম। এখন অভ্যাস চলে গেছে। নিজের জন্য নিজে রান্না করা যায় না। রান্না করে সবসময় কাউকে খাওয়াতে হয়। তোর নানা খুব ভালো খেতে পছন্দ করত।”

হঠাৎ করে নানি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। কোলের মাঝে প্লেটটা রেখে চুপচাপ বসে রইলেন। চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয় কিছুই দেখছেন না। রাশা কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, নানিকে দেখে তার কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে।

ঘরে একটা মাত্র ছোট খাট, তাই রাতে কেমন করে ঘুমানো হবে সেটা নিয়ে রাশার ভেতরে খানিকটা দুশ্চিন্তা ছিল। খাবার পরেই নানি বিছানায় একটা পরিষ্কার কথা বিছিয়ে দিয়ে বললেন, “নে ঘুমা।”

রাশা বলল, “তুমি?”

“আমি মাটিতে একটা মাদুর বিছিয়ে নেব।”

“না না–সেটা কেমন করে হয়। তুমি বিছানায় ঘুমাও নানি, আমি নিচে ঘুমাব।”

“তুই নিচে ঘুমাবি?”

“হ্যাঁ।“

“রাত্রিবেলা যখন শরীরের ওপর দিয়ে ইঁদুর দৌড়ে যাবে তখন ভয় পাবি না তো?”

“ইঁদুর?” রাশা চোখ কপালে তুলে বলল, “শরীরের ওপর?”।

নানি হাসলেন, বললেন, “ধুর বোকা মেয়ে, ঠাট্টা করলাম। ইঁদুর তো আছেই। তারা এত বোকা না যে মানুষের শরীরের ওপর দিয়ে দৌড়াবে।”

“স-সত্যি? ইঁদুর আছে?”

“গাঁও-গেরামে ইঁদুর থাকবে না তো কী থাকবে? ইঁদুর ইঁদুরের মতো থাকে আমরা আমাদের মতো থাকি। কেউ কাউকে ঘাঁটাই না।”

“তাই বলে ইঁদুর?”

“ইঁদুরের কথা শুনেই এত ভয় পাচ্ছিস, সাপ দেখলে তোর কী অবস্থা হবে?”

“সাপও আছে?” রাশা ফ্যাকাসে মুখে বলল, “ঘরের ভেতরে?”

“এখন নাই। বর্ষাকালে যখন পানি হবে তখন ঘরের ভেতরেও সাপ চলে আসে। সাপদের থাকতে হবে না কোথাও?”

“কামড় দেয় না?”

“শুধু শুধু কামড় দেবে কেন? আমরা ওদের ঘাটাই না ওরাও আমাদের ঘাটায় না।”

রাশা একটু ইতস্তত করে বলল, “নানি।”

“কী হলো?”

“একটা কাজ করা যাক।”

“কী কাজ?”

“তুমিও বিছানার ওপর চলে এসো। দুইজনের জায়গা হয়ে যাবে।”

নানি হাসলেন, বললেন, “তাহলে তুই ঘুমাতে পারবি না। আমার সারারাত ঘুম হয় না। আমি শুধু ছটফট করি। পাগল মানুষ তো, মাথার ভিতরে আউলাঝাউলা হয়ে আছে, উল্টাপাল্টা জিনিস দেখি। হাহুতাশ করি। বেশির ভাগ রাত্রে আমি বারান্দায় বসে থাকি।”

“বসে কী করো?”

“কিছু করি না। মাথাটা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করি।”

রাশা কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “ও।” একটু পরে বলল, “আমিও বারান্দায় বসে ছিলাম, বসে বসে আকাশের তারা দেখেছি।”

নানি মাথা নাড়লেন, বললেন, “আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা।”

“আমি যখন তারা দেখছিলাম তখন একটা তারা শাই করে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হলো যেন পড়ে গেল।”

“তখন কী চাইলি?”

“চাইলাম? কার কাছে?”

“ও! তুই জানিস না? যখন আকাশ থেকে তারা খসে পড়ে তখন সেই তারার দিকে তাকিয়ে যেটা চাওয়া যায় সেটাই পাওয়া যায়।”

“সত্যি?”

“লোকেরা তো বলে! চেষ্টা করে দেখিস পরেরবার।”

রাত গম্ভীর হলে রাশা বিছানায় শুতে গেল। বিছানায় শুয়ে সে তার ঘড়িটা দেখে অবাক হয়ে যায়, মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। এর মাঝে চারপাশে নিশুতি রাত।

বিছানায় শুয়ে রাশ এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। সারাটা দিন কিভাবে কিভাবে যেন কেটে গেছে, এখন রাতে অন্ধকার একটা ঘরে ছোট একটা বিছানায় নরম কাথার উপর শুয়ে শুয়ে রাশার সবকিছু মনে পড়ে যায়। রাশার মনে হতে থাকে তার বুকের ভেতরটা যেন গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। কী চমৎকার একটা স্কুলে সে পড়ত, তার কত চমৎকার বন্ধুরা ছিল সেখানে, তার স্কুলের ম্যাডামরা তাকে কত আদর করতেন। বাবা চলে গেছেন, মায়ের সাথে বিশাল একটা দূরত্ব হয়ে ছিল, তারপরেও তো তার নিজের একটা ঘর ছিল, সেই ঘরে তার প্রিয় বইগুলো ছিল। তার ঘরে একটা জানালা ছিল সেটা দিয়ে আকাশটা দেখা যেত না সত্যি কিন্তু রাস্তাটা দেখা যেত, মানুষজন হাঁটছে-বাস-গাড়ি-টেম্পো চলছে। তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার কম্পিউটার, সেটাও ছিল একটা জানালার মতো, সেটা দিয়ে সে পুরো পৃথিবীটার দিকে উঁকি দিতে পারত। এখন এই ছোট টিনের ঘরে সে তার মাথা খারাপ নানির সাথে আটকা পড়েছে। তার লেখাপড়া বন্ধ, স্কুল নেই, গ্রামের মানুষেরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কেমন করে থাকবে সে এখানে? এর চাইতে তার কি মরে যাওয়া ভালো ছিল না?

রাশা হঠাৎ নিজেকে সামলাতে পারল না, হাউমাউ করে সে কেঁদে দিল। প্রাণপণে সে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। সে দমকে দমকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

হঠাৎ করে রাশা তার কপালে একটা হাতের স্পর্শ পেল। তার নানি মাথার কাছে এসে বসে তার কপালে হাত রেখেছেন। রাশা শুনল তার নানি ফিসফিস করে বলছেন, “কাদিস না সোনা। কেউ কাঁদলে কী করতে হয় আমি জানি না।”

রাশা ঘুরে অসহায়ের মতো নানির কোলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার কী হবে নানি? আমার এখন কী হবে?”

“সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস সোনা আমার। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কেমন করে ঠিক হবে নানি? আমি তো লেখাপড়া করতে চেয়েছিলাম। আমার কী সুন্দর একটা স্কুল ছিল, বন্ধুরা ছিল, স্যার-ম্যাডাম ছিল। এখন আমি এখানে একা একা কী করব? কেমন করে করব?”

“সব ঠিক হয়ে যাবে সোনা।”

রাশা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “হবে না নানি হবে না। আমি জানি। আমি মরে যাব নানি। আমি মরে যাব।”

নানি রাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ছিঃ! এভাবে বলে না। আমি তো পাগল মানুষ, এত কিছু বুঝি না। আমি শুধু একটা জিনিস বুঝি। সেটা হচ্ছে বেঁচে থাকতে হয়। মরে গেলে সব শেষ তখন আর কিছু করা যায় না। কিন্তু বেঁচে থাকলে একটা উপায় হয়। তুই দেখিস তোর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

“তুমি সত্যি বলছ নানি?”

“হ্যাঁ সোনা। আমি সত্যি বলছি।”

রাশা তার নানিকে শক্ত করে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। এই মানুষটিকে সে চব্বিশ ঘণ্টা আগেও চিনত না, কখনো দেখেনি। এখন তার

এই মাথা খারাপ নানিটিই হচ্ছে সারা পৃথিবীর মাঝে একমাত্র ভরসাস্থল। নানি রাশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, তার মাথার মাঝে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল, তারপরও তিনি রাশাকে ধরে রাখলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *