Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অনুরাধাপুর মৃত নগরী

০৮.

আমরা অনুরাধাপুর মৃত নগরীর গেটে দাঁড়িয়ে আছি। শাওনকে অত্যন্ত বিব্রত এবং লজ্জিত দেখাচ্ছে। সে যতটা বিব্রত, নাজমা ভাবি ততটাই আনন্দিত। ঘটনা হলো–

অনুরাধাপুর মৃত নগরীতে ঢুকতে চড়া দামে টিকিট কাটতে হয়। সার্কদেশের নাগরিকরা পাসপোর্টে দেখালে অর্ধেক দামে টিকিট পায়। শাওন আমাদের পাসপোর্ট আনতে ভুলে গেছে। নাজমা ভাবি তার এবং সেহেরির পাসপোর্ট এনেছেন। তারা অর্ধেক দামে টিকিট কাটতে পারবেন। আমাদের দিতে হবে ডাবল দাম।

নাজমা ভাবি আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে নিজের মনে গজগজ করছেন, দেশ বিদেশ ঘুরলেই হয় না। নিয়মকানুন জানা লাগে। বিদেশের মাটিতে পাসপোর্টে হলো কলিজার মতো। কলিজা সবসময় সঙ্গে থাকা লাগে। কলিজা হোটেলে ফেলে আসতে হয় না।

ড্রাইভার দিগায়ু অনেক চেষ্টা করল সার্ক টিকিটে আমাদের ঢোকাতে। শেষমেষ সন্দেহজনক চেহারার একজনকে নিয়ে এল। সে গলা নামিয়ে বলল, বিনা টিকিটেই সে সবাইকে ঢুকিয়ে দেবে। বিনিময়ে সে সার্ক দেশের হিসেবে টাকা নেবে।

সেহেরি আনন্দিত গলায় বলল, প্রবলেম সলভড। আমরা তোমাকে এখন টাকা দেব না। সব দেখা শেষ হওয়ার পর টাকা পাবে।

ঐ লোক বলল, অসুবিধা নেই।

আমি অবাক হয়ে মেহেদিরঙে রাঙানো ধবধবে সাদা দাড়ির সুফি সাধকদের চেহারার সেহেরির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি বললাম, সেহেরি, এই লোক ঘুষ খেতে চাচ্ছে। আমি তাকে ঘুষ দেব?

সেহেরি বলল, যে টাকাটা আমরা খরচ করতাম, সেই টাকাই তো তাকে দিচ্ছি। আমাদের দিক থেকে আমরা ক্লিয়ার। আমি শাওনের দিকে তাকালাম, সে কিছু বলছে না। এর অর্থ সেহেরির যুক্তি সে মেনে নিচ্ছে। আমি বললাম, টাকা বাঁচানোর জন্যে ভুল যুক্তিতে আমি যাব না। লোকটা তার দেশকে ফাঁকি দিতে চাচ্ছে, সেই সুযোগ তাকে দেব না। আমি একজন লেখক। একজন লেখক কখনো এ ধরনের কাজ করেন না।

টিকিট কাটা হলো। আমি একজন গাইড নিলাম। তাকে দু’হাজার টাকা দিতে হবে। সে মৃত নগরীর সব বিষয় আমাদের বোঝাবে। গাইড কতটুকু জানে তা বোঝার জন্যে আমি বললাম, সংঘমিত্রা কে?

গাইড বলল, ভারত সম্রাট অশোকের একমাত্র মেয়ে। তিনি অনুরাধাপুর এসেছিলেন।

মহেন্দ্র কে?

ইনি সম্রাট অশোকের একমাত্র পুত্র। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে ইনিও অনুরাধাপুর এসেছিলেন।

বোঝা গেল গাইড ভালোই জানে। আমি বললাম, তুমি নিজ থেকে বকবক করবে না। তোমাকে আমরা কেউ যখন কিছু জিজ্ঞেস করব তখনই জবাব দেবে।

গাইড না-সূচক মাথা নাড়ল, এর অর্থ হ্যাঁ।

বিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির লাভায় ঢাকা পড়ে সমৃদ্ধশালী পম্পেই নগরী মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছিল। অনুরাধাপুর মৃত নগরী হয়েছে কালের লাভায় চাপা পড়ে।

অসংখ্য টুরিস্ট বিস্ময় নিয়ে মৃত নগরী দেখছে। সব দলের সঙ্গেই একজন গাইড। গাইডরা মুখস্থ পড়া বলার মতো করে অনুরাধাপুরের ইতিহাস বলছে।

আমি ট্যুরিস্টদের তিন ভাগ করে ফেললাম–

১. এদের হাতে ভিডিও ক্যামেরা। তারা যা দেখছে, ভিডিও ক্যামেরায় তুলে ফেলছে। ভিডিও ক্যামেরা মাঝে মাঝে ধরছে গাইডের মুখে। এই দলে জাপানি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বেশি। ওদের নিজেদের ভিডিও করার আগ্রহ নেই বললেই হয়।

২. এদের হাতে ছোট স্টিল ক্যামেরা। এরাও যা দেখছে তার ছবি তুলছে। নিজেরা দর্শনীয় জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে ছবির জন্যে পোজ দিচ্ছে। বেশির ভাগই ইউরোপের। মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ বৃদ্ধা।

৩. তৃতীয় দলের হাতে কোনো ক্যামেরা নেই। বয়স অল্প। এরা ক্যামেরার চোখ দিয়ে কিছু দেখছে না। এরা এসেছে জোড়ায় জোড়ায়। হাঁটছে একজন আরেকজনের কোমর জড়িয়ে। বেশির ভাগ আমেরিকান। বয়স অল্প। গাইডের কথার প্রতি এদের কোনো মনোযোগ নেই। এদের কাছাকাছি গেলে তীব্র গাঁজার গন্ধ পাওয়া যায়।

আমি দলবল নিয়ে একটা প্রাসাদের পর আরেকটা প্রাসাদে যাচ্ছি। কী বিপুল ঐশ্বর্য এবং সৌন্দর্য নিয়ে এইসব প্রাসাদ দাঁড়িয়ে ছিল। আজ ধ্বংসস্তূপ।

পুত্র নিষাদ অবাক হয়ে বলল, বাবা! আমরা ভাঙাবাড়ি দেখছি কেন?

নাজমা ভাবি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হুমায়ুন ভাইয়ের এই ছেলেটা ট্যালেন্ট। ঠিকই বুঝেছে ভাঙা ঘরবাড়ি দেখার কিছু নাই। এখন পর্যন্ত হাতি দেখলাম না। ভাঙা দালানকোঠার মধ্যে ঘুরছি। সাপে কাটে কি না কে জানে! ভাঙা দালানকোঠা সাপের আখড়া। ডলার খরচ করে এসে সাপের কামড় খাওয়ার কোনো মানে হয়?

ভাবি একা আমাদের সঙ্গে ঘুরছেন। সেহেরি গাড়ি থেকে নামে নি। তার পক্ষে নাকি মাইলের পর মাইল হাঁটা সম্ভব না।

শাওন মহা উৎসাহে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। তার বুকে বেবি ক্যারিয়ারে পুত্র নিনিত ঝুলছে। তার বড়ভাই কাঁদছে না দেখে নিনিতও চুপচাপ। চোখ বড় বড় করে ধ্বংসস্তূপ দেখছে।

আমি নাজমা ভাবিকে বললাম, চলুন, আপনার কিছু ডলার উসুলের ব্যবস্থা করি। বোধিবৃক্ষ দেখে আসি।

নাজমা ভাবি বললেন, বোধিবৃক্ষ আবার কী?

যে বৃক্ষের নিচে সাধনা করে গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন।

সেটা কি এই দেশে?

না। তবে অশোককন্যা সংঘমিত্রা তার একটা ডাল এনে অনুরাধাপুরে লাগিয়েছিলেন। এই গাছটিকেও পবিত্র গণ্য করা হয়। অনেকেই এই গাছের কাছে আসেন পুণ্য লাভের আশায়।

আমরা মুসলমান। আমরা কেন পুণ্য পাব?

তা হয়তো পাবেন না, তারপরেও ভুবনবিখ্যাত একটা বৃক্ষ দেখার আনন্দ তো পাবেন।

বোধিবৃক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে নাজমা ভাবি বললেন, এটা তো একটা বটগাছ। বটগাছ তো কত দেখেছি।

আমি বললাম, বটগাছ না। এটা অশ্বত্থগাছ। ভাবি বললেন, অশ্বত্থ গাছও তো দেখেছি।

আমি বললাম, শ্রীলংকার অশ্বত্থগাছ তো দেখেন নি। বাংলাদেশে কত হাতি দেখেছেন, তারপরেও শ্রীলংকার হাতি দেখার জন্যে আপনি অস্থির।

ভাবি বললেন, হুমায়ুন ভাই, আপনি আমাকে ভোলাচ্ছেন। আপনার মতলব আমি টের পাচ্ছি। আপনি আমাকে হাতি দেখতে দিবেন না। তা হবে না। আমি কিন্তু হাতি দেখব। শ্রীলংকায় এসে হাতি না দেখে গেলে আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারব না।

অনুরাধাপুরের ইতিহাস লিখে পাঠকদের বিরক্ত করছি কি না বুঝতে পারছি না। ভ্রমণকাহিনীর লেখকরা অনেকটা ট্যুরিস্ট গাইডের মতো। গাইডরা টুরিস্টদের সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে বকরবকর করতে থাকে। ভ্রমণকাহিনীর লেখকরা পাঠকদের সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে লেখার মাধ্যমে বকরবকর করতে থাকেন। গাইডদের সঙ্গে তাদের তফাত হচ্ছে গাইডদের ধমক দিয়ে থামানো যায়, লেখকদের যায় না

প্রিয় পাঠক! বেশি বিরক্ত করব না। অনুরাধাপুরের ইতিহাসের মজার অংশটা (আমার কাছে) খুবই অল্প কথায় বলব।

অনুরাধা নামটা শুনলেই মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ের ছবি মনে আসে। অনুরাধা আসলে একজন অত্যন্ত বলশালী পুরুষের নাম। তার নামে যে নগরের প্রতিষ্ঠা তা-ই হচ্ছে অনুরাধাপুর। চব্বিশ শতাব্দী বছর আগের প্রতিষ্ঠিত এই নগরী দর্শনার্থীদের এখনো বিমুগ্ধ করে যাচ্ছে। আমরা অবাক হয়ে ভাবছি, মানুষ তখনো এত ক্ষমতাধর ছিল!

মৃত নগরী দেখার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। নগরীর কোনো নির্জন অংশ বেছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতে হয়। তখন হঠাৎ মৃত নগরী জীবন ফিরে পায়। যে ধ্যান করছে তার কানে জীবন্ত নগরীর নানা শব্দ, বাদ্য-বাজনা ভেসে আসে। আমি তা-ই করলাম। নির্জন একটা জায়গায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি, তখন এক ইউরোপীয় টুরিস্ট এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বলল, Any problem man? আমাকে ধ্যানভঙ্গ করে তাকাতে হলো। মৃত নগরীকে জীবিত করা গেল না।

গাইড ব্যস্ত হয়ে পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শুয়ে থাকা বুদ্ধ দেখানোর জন্যে।

বুদ্ধমূর্তি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তারপরেও গেলাম দেখতে।

গাইড বলল, অনুরাধাপুরে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দাঁত ছিল। এখন আছে ক্যান্ডিতে।

আমি বললাম, তোমাকে তো প্রশ্ন না করলে চুপ করে থাকতে বলেছি। কথা বলছ কেন?

গাইড বলল, না বললে তুমি তো জানতে না এখানে উনার পবিত্র দাঁত ছিল।

আমি বললাম, দাঁত যিনি নিয়ে এসেছিলেন আমি তার নাম জানি। তুমি কি জানো?

না। উনার নাম কী?

আমি বলা শুরু করলাম। পাঠক নিশ্চয়ই ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, “হুঁ বুঝলাম। জ্ঞান ফলানো শুরু হয়েছে।” আমি জ্ঞান ফলানোর জন্যে কিছু বলছি না। গাইডের কাছে জ্ঞান ফলানোর কিছু নেই। আমার লক্ষ্য শাওন। পৃথিবীর সব স্বামীর মতো আমিও স্ত্রীকে মুগ্ধ করতে ভালোবাসি। এই সুযোগ তেমন হয় না। আজ হয়েছে। শাওন ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এসেছে আমার গল্প শুনতে।

আমি ভাব নিয়ে বললাম, যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ৫৪০ বছর আগে বুদ্ধকে দাহ করা হয়। আগুন থেকে তাঁর একটি দাঁত এবং কলার বোন রক্ষা পায়। কলিঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান উড়িষ্যার রাজা এই দুটি সংগ্রহ করেন এবং গভীর যত্নে রক্ষা করতে থাকেন। কলিঙ্গের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পাশের এক নৃপতি। যুদ্ধে হেরে গেলে দাঁত এবং কলার বোন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বলে তিনি তাঁর কন্যা রানী ওয়ালিয়াম কুমারীকে তীর্থযাত্রী সাজিয়ে শ্রীলংকায় পাঠিয়ে দেন। রানী ওয়ালিয়াম কুমারীর ছিল মাথাভর্তি লম্বা চুল। তিনি সেই চুলের ভেতর দাঁত এবং কলার বোন লুকিয়ে শ্রীলংকায় চলে আসেন। অনুরাধাপুরের নৃপতি তখন রাজা শ্রীমেঘাওয়ানা। তাঁকে এই দুই পবিত্র বস্তু দেওয়া হয়। এই হলো ঘটনা।

শাওন বলল, কলিঙ্গের রাজা কি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

শাওন মুগ্ধকণ্ঠে বলল, তুমি এত পড়াশোনা কখন করলে? আই এ্যাম ইমপ্রেসড।

আমি তৃপ্তির হাসি হাসলাম। যাক, অনুরাধাপুরে আসা সার্থক হয়েছে।

পুনশ্চ

অনুরাধাপুরের প্রায় একশ’ ছবি শাওন তার ডিজিটাল ক্যামেরায় তুলেছে। মৃত নগরীর আর্কিটেকচারাল বিউটি তাকে বিমোহিত করেছে। সে অনেক খাটাখাটনি করে ফ্রেম করে যখনই ছবি তুলতে যায়, তখনই নাজমা ভাবি ফ্রেমে ঢুকে পড়ে মিষ্টি হাসি হেসে পোজ দেন। একবার শাওন বলল, ভাবি আপনি বাঁ-দিক দিয়ে ঢুকবেন না। বাঁ-দিকের এই পিলারটা আমার ফ্রেমের শেষ অংশ।

নাজমা ভাবি বললেন, আচ্ছা ঢুকব না। শাওন ফ্রেম করে যেই ছবি তুলতে গেছে, নাজমা ভাবি ডানদিক থেকে টুকে মিষ্টি হাসি হেসেছেন।

শাওনের তোলা একশ’ ছবির আশিটিতে নাজমা ভাবি আছেন। শাওন এখন চেষ্টা করছে ফটোশপের মাধ্যমে ভাবিকে মুছে ফেলতে। একটা ছবিতে কিছু সাফল্য এসেছে। ভাবির শরীর মুছে গেছে, শুধু মুখটা পিলারের মাথায় আটকে আছে। মুখ দূর করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অনুরাধাপুরের একটা পিলার সবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ছবি হিসেবে চমৎকার।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress