কিং সোলায়মান
০৪.
কিং সোলায়মান এবং শেবার রানীর গল্প তো সবাই জানেন। আরেকবার বলি। জানা বিষয় নতুন করে জানায় আনন্দ আছে। অনেকটা শোনা গান আবার শোনার মতো।
কিং সোলায়মান সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শেবার রানী বিলকিস।
রানী রাজদরবারে ঢুকলেন। সোলায়মানের সিংহাসন অনেকটা দূরে। রানীকে কিছুদূর হেঁটে যেতে হবে। রানী ক্ষণিকের জন্যে বিভ্রান্ত হলেন। মেঝে স্ফটিক দিয়ে এমন করে বানানো যে রানীর মনে হলো পানি। তাকে যেতে হবে পানির উপর দিয়ে। নিজের অজান্তেই তিনি তাঁর গায়ের কাপড় খানিকটা উঁচুতে তুললেন, যাতে পানি লেগে ভিজে না যায়।
সিংহাসন থেকে সোলায়মান অবাক হয়ে দেখলেন, এই পৃথিবীর অতি রূপবতী এক তরুণীর পাভর্তি পশুদের মতো লোম। সোলায়মান রাজবৈদ্যকে এই রোগের ওষুধ দিতে বললেন। রাজবৈদ্যের ওষুধে রানীর লোম সমস্যা দূর হলো। কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হয়ে তিনি সোলায়মানকে বিয়ে করলেন। (মিথ হচ্ছে– সোলায়মান তাঁর পোষা জ্বিনদের কাছ থেকে রানী বিলকিসের ওষুধ নিয়েছিলেন।)
সোলায়মান নবপরিণীতা স্ত্রীকে খুশি করার ব্যবস্থা করলেন। দুটা জাহাজ পাঠালেন রত্নের দেশে। দেশের নাম শ্রীলংকা।
শ্রীলংকাকে বলা হয় পৃথিবীর রত্নভাণ্ডার। ব্লু শেফায়ার বা নীলার মতো দামি পাথরে এই দেশ পূর্ণ। সবচেয়ে বেশি রত্ন যেখানে পাওয়া যায় তার নাম রত্নপুরা বা রত্নের নগর। চীনা ভাষায় দ্বীপটির নাম রত্নদ্বীপ। Star of India নাম দিয়ে যে অপূর্ব নীলা পাথরটি নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে প্রদর্শিত হচ্ছে সেটা নীলা পাথর। পাথরটির নাম রাখা উচিত ছিল Star of Srilanka, ব্রিটিশ রাজমুকুটে চার শ ক্যারেটের যে নীলা পাথরটি আছে সেটাও শ্রীলংকার।
পদ্মরাগ মণি (নীলা পাথরের আরেক সংস্করণ। রঙ কমলা ও গোলাপির মিশ্রণ) শুধুমাত্র শ্রীলংকাতেই পাওয়া যায়। অন্য কোথাও না।
নীলা ছাড়াও আরও যেসব পাথর শ্রীলংকায় পাওয়া যায় তা হলো রুবি, একুয়া মেরিন, টোপাজ, গার্নেট, মুনস্টোন এমেথিস্ট, ক্যাটস আই।
মুর পর্যটক ইবনে বতুতা শ্রীলংকায় এসেছিলেন। তিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্তে মুরগির ডিমের চেয়েও বড় রুবি দিয়ে হাতির মাথা সাজানো হতো বলে উল্লেখ করেছেন।
চায়নিজ পর্যটক ফা হিয়েন শ্রীলংকায় একটি রুবি দেখেছিলেন, যা মানুষের বাহুর মতো লম্বা এবং এক বিঘৎ চওড়া। রুবিটি দেখে তার মনে হয়েছে যেন পাথরটিতে আগুন জ্বলছে।
মার্কোপলোও মনে হয় এই রুবিটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
রত্ন আহরণের পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ। নদীর কাদাবালি মেশানো পানি এবং নদীর তলদেশের মাটি ঝুড়িতে নেওয়া হয়। ঝুড়ির নিচটা চালনির মতো। এই ঝুড়ি পানিতে ধুয়ে ধুয়ে কাদামাটি এবং ময়লা দূর করা হয়। ভাগ্য ভালো হলে রত্ন পাওয়া যায়।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের শংখ নদীতে এইভাবে রত্নের অনুসন্ধান করা যেতে পারে। শংখ নদী পাহাড়-পর্বত কেটে সমুদ্রের দিকে আছে। পাহাড়-পর্বতে আটকে থাকা মণিমুক্তা শংখ নদী বেয়ে নিচে নামার কথা।
আমাদের পাশের দেশ বার্মা যদি রুবিতে ভর্তি থাকে, আমরা দোষ করেছি কী? বার্মার মাটি, শ্রীলংকার মাটি আমাদের দেশের মতোই পলিঘটিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো শ্রীলংকার চেয়ে উঁচু। বাংলাদেশে যে রত্নের অনুসন্ধান করা যেতে পারে তা মনে হয় কারও মাথায় আসে নি।
শ্রীলংকার মণিমুক্তা সম্পর্কে বিতং করে লেখার একটি ব্যক্তিগত কারণ আছে। আমার একসময়ের শখ ছিল রত্ন সংগ্রহ করা। পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছি রত্ন কেনার চেষ্টা করেছি। কখনো পেরেছি, কখনো অর্থের অভাবে পারি নি। আমার সংগ্রহের রক্তে শ্রীলংকার দুর্লভ পদ্মরাগ মণি আছে।
আমার পাথর সংগ্রহের নেশা যখন তুঙ্গে তখন দুটি দেশে খুব যেতে ইচ্ছা করত–একটি শ্রীলংকা, অন্যটি বার্মা। বার্মায় পাওয়া যায় খাঁটি রুবি। রুবি, নীলা এবং পদ্মরাগ মণির মতোই দামি। দুটি দেশের কোনোটাইতেই যাওয়া হয় নি। কারণ বার্মায় সামরিক জান্তা। আসল মগের মুল্লুক। আর শ্রীলংকায় চলছে গৃহযুদ্ধ।
দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, শ্রীলংকায় যখন এসেছি তখন আমার রত্ন সংগ্রহু রোগ সেরে গেছে। অল্প বয়সে ছেলেমেয়েরা স্ট্যাম্প কালেক্ট করে খাতা ভরিয়ে ফেলে। একসময় তাদের এই ব্যাধি সেরে যায়। খাতাও হারিয়ে যায়। কয়েন কালেক্টারদের একই অবস্থা। অনেক ঝামেলা করে সংগ্রহ করা মুদ্রা একসময় যেখানে সেখানে পড়ে থাকে।
আমি রত্ন সংগ্রহ করছি ত্রিশ বছর ধরে। সবই বাক্সবন্দি। কাউকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করতে চাইলে বাক্স খুলি।
আজ আমি শ্রীলংকার রাস্তায়। কিছুদূর পরপরই Gems-এর দোকান। একবারও দোকানে ঢুকতে ইচ্ছা করল না।
শাওন বলল, রত্নের দেশে এসে রত্ন কিনবে না?
আমি বললাম,’ আনা রাজুলুন মিসকিন।’
শাওন বলল, এর মানে কী?
আমি বললাম, এর অর্থ আমি একজন মিসকিন। মিসকিনের রত্নরোগ সাজে না। কাজেই রত্ন কেনা হবে না।
শাওন বলল, আমি টাকা দিচ্ছি। তুমি তোমার পছন্দের একটা রত্ন কিনে আনো।
আমি রত্নের দোকানে ঢুকলাম না। কাঠের মূর্তির দোকানে ঢুকে একটি বুদ্ধ মূর্তি কিনলাম।
নাজমা ভাবি মহা রিক্ত হলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, এত দাম দিয়ে বুদ্ধের মূর্তি কিনেছেন। আপনি কি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করবেন?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। শ্রীলংকায় হাঁ-সূচক মাথা নাড়ার অর্থ না। ভাবি তা বুঝলেন না। তিনি স্বামীর কাছে নালিশ করলেন, হুমায়ূন ভাই বৌদ্ধ ধর্ম নিবেন। ছিঃ ছিঃ কী কাণ্ড। লেখক হলেই যা ইচ্ছা তা করা যায়?
আমি নাজমা ভাবির সঙ্গে ঝামেলায় গেলাম না, গৌতম বুদ্ধের মতো মৌনভাব ধারণ করলাম।
রাতে ঘুমাতে যাব হঠাৎ দেখি আমার বালিশের উপর চমৎকার একটি মুন স্টোন। চন্দ্রের আলোর মতো হালকা আলো বের হচ্ছে। মুন স্টোনের সঙ্গে একটি চিঠি। শাওন লিখেছে–
“তুমি বদলে যাচ্ছ কেন?
একসময় পাগলের মতো gems খুঁজে বেড়াতে। আজ ফিরেও তাকাচ্ছ না। বদলে যাওয়া হুমায়ুন আহমেদ আমি দেখতে চাই না। আমি চাই তুমি কখনো বদলাবে না।”
আমি শাওনকে বললাম, চলো দুজন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের পাশ থেকে ঘুরে আসি।
শাওন বলল, নিষাদ নিনিত?
ওরা ঘুমাচ্ছে। নাজমা ভাবিকে বলো ওদের দিকে নজর রাখতে। বেশিক্ষণ তো আর বাইরে থাকব না। বেশি হলে পনেরো মিনিট।
নাজমা ভাবি সব শুনে বললেন, পুলাপানের ক্যাঁও ম্যাঁও আমার ভালো লাগে না। এরা দুজন একসঙ্গে কাঁদে। আমি পারব না।
বলেই তিনি নিজের ঘরে ঢুকে বেশ শব্দ করে দরজা বন্ধ করলেন।
শাওন বলল, প্রথম রাতে গান শুনতে চেয়েছিলে। এখন কি গাইব?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
শাওন গাইছে। আমি দুই পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে তার গান শুনছি
“মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে
ফিরেছ কি ফির নাই, বুঝিব কেমনে।”
পুনশ্চ
শ্রীলংকার সবচেয়ে সুন্দর বুদ্ধমূর্তির নাম ‘আউকানা’। তের মিটার উঁচু গৌতম বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। এই নামের অর্থ সূর্যখাদক (Devourer of the Sun.), অনুরাধাপুরের নৃপতি ধাতুসেনার নির্দেশে এটি বানানো হয়। এই মূর্তিটি সবচেয়ে সুন্দর দেখায় সূর্যোদয়ের মুহূর্তে।
বুদ্ধের মূর্তির বসার ভঙ্গি এবং হাতের মুদ্রার অর্থ আছে। এ থেকে বলে দেওয়া যায় তিনি জেগে আছেন না সমাধিতে চলে গেছেন। আমার কাঠের কেনা মূর্তিটির ভঙ্গি জাগ্রত।
মূর্তিবিষয়ক শেষ কথাটা বলি। পুত্র নিষাদ দেশে ফিরে সবাইকে বলছে, আমরা শ্রীলংকার আল্লাকে কিনে এনেছি।