Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাধানগর || Bani Basu » Page 9

রাধানগর || Bani Basu

ওর কথায় অবিশ্বাস করবার কিছুই নেই। ও যে মায়ের মেয়ে সেটা ওর চেহারায় সীলমোহর করে দেগে দেওয়া আছে। মন্দাকিনী। আমার বোন। অজানাকে খুঁজতে এসে একটা পুরো রত্নভাণ্ডার যেন কেউ খুলে দিয়েছে আমার সামনে। বোন… দিদিমা… মা… মামার বাড়ি। আমি একটা অচিন্ত্যপূর্ব পারিবারিক উষ্ণতার মধ্যে ঢুকে পড়ছি। কী রকম হবেন আমার দিদিমা? আমার অর্ধেক প্রশ্নের উত্তর তো উনিই দিয়ে দিতে পারবেন।

সামনেই, সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ ইংল্যান্ডের কোনও রানির ছবি। এঁরা কি খুব ইংরেজ-ভক্ত? আমি কিন্তু ভক্তি করি মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ এঁদের, নেতাজির মতো আত্মত্যাগ করতে আমার খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু কার জন্যে করব, এখন তো ভারতবর্ষ আর পরাধীন নেই।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা চওড়া চৌকো মতো জায়গা। একটা গোল শ্বেতপাথরের টেবিল সেখানে, চারদিকে চারটে কাঠের চেয়ার। টেবিলটার ওপর একটা বিরাট খিলির মতো শেডওয়ালা আলো, ওপর থেকে ঝুলছে। বাঁ দিকে সাদা গ্রিল ঢাকা বারান্দা আর ডান দিকে ভারী ভারী পর্দা ঢাকা ঘর। কোথা থেকে গুনগুন স্বরে গান ভেসে আসছে…

আমি মথুরা নগরে প্রতি ঘরে ঘরে

যাইব যোগিনী হয়ে!

রেডিয়োতে হচ্ছে না কি? এখানে এলিয়ট রোডের এই সাহেবি বাড়িতে কীর্তন? বারান্দার শেষ ঘরটার সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটি পর্দা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে গেল। কী যেন নাম ওর? স্টিফেন।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শীতের বিকেলেও ঘামছি আমি। খুব নার্ভাস লাগছে। উনি কি আমার সঙ্গে দেখা করবেন না?

ওই যে স্টিফেন বেরিয়ে আসছে।

—আসুন।—পর্দা সরিয়ে ধরল লোকটি। ঘরটা বাইরে থেকে এসে অন্ধকার লাগছে। স্টিফেন আলো জ্বালিয়ে দিল। ঢুকে ডান দিকে ঘুরে দেখি একটা আরাম চেয়ারে একজন মেম সাহেব বসে আছেন। একটা ঘিয়ে ঘিয়ে রঙের সিল্কের গাউন পরে, ধবধবে ফর্সা একজন সত্যি মেম সাহেব, মাথায় চুড়ো করে রাখা লাল চুল। মেম সাহেবের নাকে হিরের নাকছাবি, কানেও জ্বলজ্বল করছে হিরে। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মতো কিছুর মালা। হাতে সোনার চুড়ি।

এরকম কোনও মানুষ আমি জীবনে এই প্রথম দেখলাম। মা আমাকে যে সব বই কিনে দিয়েছে— অ্যান্ডারসেন, গ্রীম ব্রাদার্সের রূপকথা, গ্রিস আর রোমের গল্প… সেই সব বইয়ে এইরকম মানুষের ছবি দেখেছি। এই বয়স, চেহারা, এই রকম পোশাক…। তবে তাঁদের নাকে নাকছাবি ছিল না। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

—তুমিই মন্দার? রাধানগর থেকে আসছ?

পরিষ্কার বাংলায় বললেন উনি। তখনই আমি বুঝতে পারলাম উনিই গান করছিলেন। এই একই গলা। আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম।

উনি বললেন —আমি ইরাবতীর মা।

ইনি? ইনিই আমার দিদিমা? তা হলে এই জন্যেই রাধানগরে আমার মাকে মেম বলে? মেম সাহেবের মেয়ে বলে?

প্রণাম করবার জন্যে আমি নিচু হলাম। দিদিমা যখন, প্রণাম করাই তো ঠিক? যদিও আমার দিদিমা-ধারণার সঙ্গে এঁর কোনও মিলই নেই।

কালো নরম নরম চটির ওপর আমার হাত পড়ল, উনি মাথায় হাত রাখলেন। একটা মোড়া দেখিয়ে বললেন বসো।

—তোমার বাবা কেমন আছেন?

—ভাল।

—আর সবাই?

—ভাল। —যেন গতানুগতিক কুশল বিনিময়ের সময় এটা।

—এখানকার ঠিকানা কে দিলেন, তোমার বাবার কাছ থেকে পেলে?

হঠাৎ আমার ভেতর থেকে একটা ক্রোধ ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠে আসতে লাগল। সারা জীবন আমি অবহেলার মধ্যে মানুষ হয়েছি। নিজের লোকেরা কেউ কোনওদিন আমাকে পাত্তা দেয়নি। মা আমাকে ফেলে চলে গেছে। বাবা থেকেও নেই। যথেষ্ট ভাল ভাল মার্কস পেয়েও আমি এক নম্বর কলেজগুলোয় ভর্তি হতে পারিনি। এত বড় শহরের কোনও হস্টেলে আমার জায়গা হল না, রয়েছি একটা ইঁদুরের গর্তে, … এতটা পথ পার হয়ে এত খোঁজ খবর করে আমি আমার নিজের মায়ের সন্ধানে এসেছি। আর ইনি এখন… এঁরা তা হলে চাননি আমি এখানে আসি?

আমি উঠে দাঁড়াই। কর্কশ গলায় বলি— মায়ের কাছে এসেছিলাম জানাতে যে আমি কলকাতায় এসেছি। কলেজে ভর্তি হয়েছি। মায়ের ঠিকানাটা যদি পেতাম…। দেবার অসুবিধে থাকলে মাকে বলে দেবেন…।

আমি পেছন ফিরে চলে আসি। উনি চেরা গলায় চিৎকার করেন— কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ মন্দার! স্টিফেন ওকে আটকা। ওকে যেতে দিসনি!

আমি ফিরে বললাম—আর থেকে কী করব? মা তো নেই! আমি এ-ও জানতাম না যে আমার একজন বোন আছে।

—মন্দার বসো আগে বসো উনি কেমন হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন। যতক্ষণ না বসলাম শান্ত হলেন না। আর বসলে দেয়ালের গায়ে একটা অয়েল পেন্টিং-এর দিকে দেখিয়ে বললেন— চিনতে পারো?

ছবিটা স্যুট টাই পরা এক ভদ্রলোকের। বোধ হয় মিলিটারি অফিসার হবেন। আমি ওঁকে চিনি না।

দিদিমা বললেন— চেনো না? হাসলেন উনি, বললেন, —তোমার মায়ের বাবা, ওঁকে তোমার চেনার কথা মন্দার। না-ই বা রইল তোমার মা, তুমি আমার নাতি, ওই ওঁরও নাতি, তোমার অসুবিধে কী?

আমি বলতে পারতাম— আপনাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কই বা কী? কোনওদিন কি খোঁজ নিয়েছেন? কেমন করে বুঝব তা হলে আপনারা আমার কেউ?

—কলেজ থেকে আসছ, না?

আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। রথীদের বাড়ির কথা বেমালুম ভুলে গেছি।

উনি একটা বেল বাজিয়ে স্টিফেনকে ডাকলেন।

—ওর জন্যে খাবার আনো স্টিফেন। খালেদাকে বলো। মন্দার তুমি চা খাও? আমি যে সবে বাধ্য হয়ে চা খাওয়া ধরেছি সে কথা আর ওঁকে বলে কী করব! সায় দিই।

স্টিফেন চলে গেলে উনি আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে আস্তে আস্তে বললেন, বুলা হল তোমার মাসতুতো বোন, কিন্তু ও জানে যে ইরাই ওর মা।

আমি বললাম—তা হলে এখন?

উনি বললেন—এখন সত্যি কথাটা ও জানবে। জানাতে হবে, কষ্ট হবে। কিন্তু জানুক। আর তাছাড়া ইরাই তো ওকে মানুষ করেছে। আমার ছোট মেয়ে ওকে জন্ম দিয়েই মারা যায়। তোমরা দুজন মাত্র ক’দিনের তফাতে জন্মেছ। তা তুমি এখানে কোথায় উঠেছ? হস্টেলে?

আমি রাখালবাবুর বাসার কথা বললাম।

—তোমার মতো ছেলেমানুষের ও রকম লোকের সঙ্গে থাকতে অসুবিধে হয় না?

—হয়। চেষ্টা করছি মানিয়ে নিতে।

উনি প্রশ্ন করে করে আমার সব অসুবিধের কথাই জেনে নিলেন। তারপর বললেন— আমাদের এখানে, যথেষ্ট জায়গা আছে কিন্তু। তুমি থাকবে? তোমার বাবা বা রাধানগরের ওঁরা যদি আপত্তি না করেন…। তুমি যদি অন্যজাতের ছোঁয়া না খাও… তার ব্যবস্থা করে দেব।

আমি বললাম— জাত টাত আমি মানি না।

—তাহলে থাকো না এখানে। এটা তো তোমারও দাদু-দিদিমার বাড়ি?

ভীষণ লোভ হচ্ছিল তক্ষুণি রাজি হয়ে যেতে। কিন্তু নিজেকে অত সস্তা করে দেব কেন? তাই বললাম— দেখি। রাখালবাবুর সঙ্গে কথা বলে।

আমি যতক্ষণ ছিলাম মন্দাকিনীকে দেখতে পাইনি। দিদিমা আমার সঙ্গে চা খেলেন। কিন্তু মন্দাকিনী একবারও মুখটাও দেখাল না। ও আমার বোন জানবার পর আমার সব কীরকম অন্যরকম লাগছিল। ওকে আমার আর ভয় করছিল না। কোনও মেয়েকেই না। এখন যদি ও বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গে পার্টিকল্‌স নিয়ে আলোচনা করতে চায়, তো করব! নার্ভাস লাগার কোনও প্রশ্নই নেই!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress