রাধানগর (Radhanagar) : 02
পাকুড় গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে, আমার বাবা চোখ বুজিয়ে নিম ডাল দিয়ে দাঁতন করছে। জানলা দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে আমি বিছানা থেকে নেমে পড়ি। কেমন মনে হল, আচ্ছা এত কিছু বদলে যায়, বাবার এই চোখ বুজিয়ে দাঁতন করার দৃশ্যটা বদলে যায় না কেন? ধরা যাক উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের বিপ্লবের আগস্ট, ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হল, বাবা কি সেদিনও এমনি করে দাঁতন করছিল? কিম্বা উনিশশো একচল্লিশ সনের ৮ই আগস্ট, বাইশে শ্রাবণ যে দিন রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন? ভুল করছি, বাবা বোধহয় সে সময়ে জন্মায়নি, আচ্ছা ধরা যাক, বাবারই ব্যক্তিগত জীবনের কথা, বাবার তো একজন মা ছিলেন, তিনি তো এইখানে এই রাধানগরেই থাকতেন, তা তিনি যেদিন মারা গেলেন? যদি বাবার জীবৎকালে ভারতবর্ষের কিংবা সমগ্র পৃথিবীরই অন্তিম দিন এসে যায়? সেদিনও বাবা এমনি পাকুড়তলায় দাঁড়িয়ে…। এরপর বাবা ছোলা ভিজে চিবিয়ে বেশ কয়েকটা ডন মারবে। বাবার জলখাবার হল প্রকান্ড এক কাঁসি মুড়ি, জবজব করে তেল দিয়ে মাখা, গোটা সাত আট লাল টকটকে কাঁচা লংকা, আর তারপরে এক ঘটি দুধ। লাল পাড় ধুতি পরে বাবারা। এই ধুতি আর এইরকমই লাল পাড় শাড়ি, ভক্তরা নানান উপলক্ষে পুজো দেয় রাধামাধবকে। অগুন্তি এরকম ধুতি শাড়ি টাল করে রাখা থাকে মন্দিরের ডাইনের ঘরে। সেই কাপড়ই পরে আছে বাবা। কোরা কাপড়। কয়েক কাচের পরে কেমন ময়লাটে হয়ে যায়, সদু ধোপানি অনেক সেদ্ধ করেও আর ধবধবে করতে পারে না।
ভাল করে রোদ না হতেই বাবা হিজলবাগানে চলে যাবে। সারাদিন সেখানেই কাটবে বাবার। মাঝখানে হয়তো খেতে আসতে পারে, না-ও পারে। সূর্য ডুবে গিয়ে সন্ধের অন্ধকার বেশ ভাল করে নেমে না আসা পর্যন্ত বাবা বাড়ি ফিরবে না। অনেক দিন সন্ধেতেও বাবা বাড়ি ফেরে না। কোথায় থাকে এ সময়টা আমি জানি না। হয়তো বন্ধুদের বাড়ি। বুড়ো ভঞ্জ, সেতাব চাচা, মোটা ভটচায্যি, ছোট চক্কোত্তি, ভবতারণ খোলবাজিয়ের দাদা রামতারণ যাকে সবাই বলে গেঁজেল রাম।
যখন ছোট ছিলাম, অনেক সময়ে তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেলে আমি ছুটতে ছুটতে হিজলবাগানে চলে যেতাম।
‘এই আম্রকানন ঁশ্রীশ্রী রাধামাধব জিউর সেবা বিধায় শ্রীযুক্ত উপীন্দ্রনাথ রায়কে দেবত্র অর্পিত হইল, বং ১২৭৩, তাং উনত্রিশে আষাঢ় শ্রীশ্রীরথযাত্রা ইতি’—এইরকম একটা নোটিস হিজলবাগানের ফটকে টাঙানো আছে। নীল টিনের ওপর সাদা দিয়ে লেখা। পুরনো হয়ে গেলে এটা আবার রং করে ঠিকঠাক করা হয়। কত বড় এ বাগানটা আমার কোনও ধারণাই নেই। শয়ে শয়ে আমগাছ ঠিক বড় বড় খোলা ছাতার মতো বাগান জুড়ে আছে। চন্দননগর থেকে একবার কয়েকজন সাহেব বাগান দেখতে এসেছিল। তখন বাবা তাদের বোঝাচ্ছিল ‘ম্যাংগোজ অফ দা বেস্ট কোয়ালিটি হিমসাগর ভ্যারাইটি।’ তবে আম ছাড়াও এ বাগানে আছে আরও বহু রকমের ফল গাছ। জাম, জামরুল, লিচু, বাতাবি লেবু, কাঁঠাল, পেয়ারা, ফলসা, ডালিম..। হিজলপুকুর বলে একটা মস্ত পুকুর আছে এক দিকে। তার পাড় থেকে অনেকটা জুড়ে শীতের সবজির ক্ষেত। এটা বোধহয় আমার বাবার বিশেষ শখের। অনেক সময়েই দেখেছি, বাবা উবু হয়ে বসে টোম্যাটো গাছের পাশে কাঠি পুঁতে দিচ্ছে রঘুদার সঙ্গে, তার ওপর তুলে দিচ্ছে গাছের নরম ডাল। বাবারা বলে বিলিতি বেগুন। তবে বাবার আসল জায়গা হল হিজল পুকুর। প্রকাণ্ড দিঘি। মূলবাগানটার থেকে তারের ঘের দিয়ে আলাদা করা। চোপর দিন এইখানে ছিপ হাতে করে বসে থাকবে বাবা।
আমরা রাধামাধবের সেবাইত। মাছ খাই না। ধরারও কথা নয়। বাবাও খায় না। কিন্তু ধরে। হিজলপুকুরে বোধহয় বাবা প্র্যাকটিস করে। অনেকদিন দেখেছি একটা চ্যাটালো কালচে কাতলা মাছ বাবা ছিপের মুখ থেকে ছাড়িয়ে আবার জলে ফেলে দিল। কিন্তু বাবা বেশ নাম করা মাছ শিকারি। মাঝে মাঝেই বন্ধুদের নিয়ে মাছ ধরতে যায়। সে-সব দিনে বাবার ওই বন্ধুরা—বুড়ো ভঞ্জ আর সেতাব চাচা, মোটা ভটচায্যি আর গেঁজেল রাম আমাদের দাওয়ায় বসে গেলাস গেলাস কড়া চা আর বিড়ি খায়; আর এনতার মাছ ধরার গল্প করে। মাছ ধরার গল্পের সঙ্গে ছিঁচকে চোর আর ডাকাতের দলের গল্পও থাকে, আর থাকে ভূত পেতনির গল্প। গল্পগুলো শুনতে ভাল লাগলেও বাবার এই দোস্তদের আমার ভাল লাগে না।
নস্যি-নেওয়া খোনা গলায় বুড়ো ভঞ্জ বলে—রাজির ব্যাটা পাজি, অ্যাই রাজির ব্যাটা পাজি, ভেতর বাড়ি থেকে এক ঝোড়া তেলে ভাজা ভাজিয়ে নিয়ে এসো তো বাপ।
বাবা আমাকে বাঁচায়—খেতে হয়, কেষ্টর দোকান থেকে আনিয়ে দিচ্ছি। ও সব মতলব ছাড়।
যখন ছোট্ট ছিলাম, সেতাব চাচা দুটো আঙুল সাঁড়াশির মতো করে আমার নরম পেট চিপটে ধরত। কী যে ভীষণ লাগত।
বাবার ঘরে একগাদা ছিপ আর বঁড়শি। খুব সাবধানে সে সব থেকে একটা দুটো বেছে নিত বাবা, বিটকেল সব চার তৈরি করত। রাত থাকতে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে চলে যেত সেজেগুজে। মাছ শিকারেই যাচ্ছে না বাঘ শিকারেই যাচ্ছে।
—কোথায় গিয়েছিলে বাবা?
—সে একটা জায়গায়।
—কোথায়?
—হুগলি বর্ধমানের বর্ডারের দিকে।
—কত বড় মাছ ধরলে?
—হুঁ।
—কত বড়? পাঁচ ছ’ সের?
—হুঁ।
—আর ওরা? চাচারা?
—ভালই।
—কত বড়?
—দেখিনি।
এর চেয়ে বেশি কথা বাবার মুখ দিয়ে বার করা শক্ত ছিল।
কেউ জিজ্ঞেস করলে সে সময়ে আমি বলতাম—‘আমার মা চাকরি করে আর বাবা মাছ ধরে।’
ছোট ছেলের কথায় বোধহয় সবাই মজা পেত। আমার স্কুলের বন্ধু তারক-এর মা বলতেন—আবার বলো! কী, কী করেন তোমার বাবা-মা!
—মা চাকরি করে আর বাবা মাছ ধরে।
মাকে চাকরি করতে হয় বলেই যে মা আমাদের সঙ্গে থাকে না, এ-কথা মা-ই আমাকে বুঝিয়ে ছিল। খুব মস্ত চাকরি। সেখানে মাকে না হলে চলেই না। পরে বুঝেছি, চাকরি হয়তো মা করে। কিন্তু না করলেও মা আমাদের সঙ্গে থাকত না। থাকতে পারত না। মাকে এখানে, এই রাধানগরে কেউ পছন্দ করে না। নন্দপিসি ছাড়া কাউকে তো মায়ের সঙ্গে কথা বলতেই দেখিনি। মা এলে সবাই কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। তবে, মা চলে যাবার পর ফুলকাকিমা কি রাঙাবউদি, নিজেদের ঘরে ডেকে আমাকে এটা-ওটা দিত, হঠাৎ-হঠাৎ জিজ্ঞেস করত মা কী বলল, কী আনল, বাবার সঙ্গে মায়ের কী কথা হল! কৌতূহলটা আমার কান এড়াত না, যদিও খুব স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করত ওরা। অন্য সময়ে আমাদের নিয়ে কারও মাথা-ব্যথা ছিল না।
অনেক দিন পর্যন্ত মা খুব নিয়মিত এসেছে। মাসে একবার কি দুবার। জুটের বাহারি ব্যাগ থেকে তখন বেরোত আমার জামা-কাপড়, জুতো, বই, খেলনা, চকলেট, লজেন্স, প্যাকেট প্যাকেট বিস্কুট, বাবার জন্যে সিগারেট।
মা যে কদিন থাকত, আমাদের দাওয়ার এক পাশে চ্যাটাইয়ের আড়াল দিয়ে কেরোসিন স্টোভে রান্না হত। পোলাও রাঁধত মা। আমাদের ঠাকুর বাড়ির পোলাওয়ের মতো মিষ্টি খেতে নয়। মটরশুঁটি দিয়ে মায়ের সাদা পোলাও, টক ঝাল কপির তরকারি, কড়কড়ে আলুভাজা খুব ভাল লাগত। সারা বছর মিষ্টি মিষ্টি আর মিষ্টি খেয়ে আমাদের মুখ পচে থাকত তো!
ক্রমে ক্রমে মায়ের আসা খুব অনিয়মিত হয়ে গেল। আমি হয়তো জিজ্ঞেস করলাম—সরস্বতী পুজোর সময়ে এলে না তো মা!
মা বলল—কাজ ছিল। —তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—তা ছাড়া তুই তো বড় হয়ে যাচ্ছিস মন্দার!
আমি বড় হয়ে যাচ্ছি বলে মায়ের আর আসার দরকার নেই না কী! সোজাসুজি না বললেও কথাটার অর্থ তো তাই-ই দাঁড়ায়! সত্যিই কমতে কমতে কবে যে মায়ের আসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল! খুব সইয়ে সইয়ে একটু একটু করে ব্যাপারটা হয়েছে বলে আমার নিজেরই খেয়াল হয়নি। সত্যিই তো আমি বড় হয়ে যাচ্ছিলাম! স্কুলে শিশিরদা, বিপিনদা, হেডসার এঁরা আমার বাবার জায়গা নিয়ে নিচ্ছিলেন। ক্রিকেট খেলছি তখন। টিম তৈরি হচ্ছে। তারকের সঙ্গে আমার খুব ভাব। প্রায়ই স্কুল-ফেরত তারকদের বাড়িতে চলে যাই। তারকদের পরিবার একটা স্বাভাবিক পরিবার। ওর বাবা মা ছাড়াও দুজন বোন আছে, ঠাকুমা আছেন, দিদিমা মাঝে মাঝে মামাকে নিয়ে বেড়াতে আসেন। আমি কারও সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হতে পারি না, তবু তারকের সঙ্গে আমার পটে। ও আমায় কথা বলায় না। নিজেই সাতকাহন কথা বলে। আর ওর বাবা আমার সঙ্গে কত গল্প করেন, আমার ইংরেজি অঙ্ক দেখিয়ে দেন, কত রকমের গল্প বলেন, তারকের মা আমাকে কত যত্ন করেন।
তারকের মা-ই একদিন বললেন আমায় কথাটা।
—স্কুলের পাশটা দিয়ে তুমি মায়ের কাছে চলে যেও মন্দার। এভাবে মানুষ বাঁচে? আসলে সেদিন উনি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন,
—সকালে কী দিয়ে ভাত খেয়েছ মন্দার?
—ভাত তো খাইনি আজ মাসিমা! অত সকালে আমাদের ভাত হয় না।
—সে কী? তবে কী খেলে?
—দুধ-মুড়ি।
তখনই উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন কথাটা। —স্কুলের পাশটা দিয়ে তুমি মায়ের কাছে চলে যেও মন্দার। এভাবে মানুষ বাঁচে?
উনি বোঝেননি, মানুষ যেটা কখনও পায়নি, তার জন্য তার অভাববোধও থাকে না। আমি জানতাম না একটা আঁটসাঁট পরিবারের মধ্যে মায়ের স্নেহ, বাবার যত্ন, ভাইবোনেদের সঙ্গে খেলাধুলো ঝগড়াঝাঁটির জীবনটা কীরকম। তাই তার জন্যে আমার কোনও কষ্ট ছিল না। কিন্তু যেই ওঁর কথাটা শুনলাম অমনই কী যেন একটা আমার মধ্যে খুলে গেল। আমি ভাবতে শুরু করলাম।
—এ-ভাবে মানুষ বাঁচে?—কথাটার গুরুত্ব ভীষণ।
কী ভাবে? কী ভাবে বেঁচে আছি?
ওঁর মায়ের মন। শুধু আমার খাওয়া-দাওয়ার অনিয়মের কথা মনে করেই হয়তো করেছিলেন মন্তব্যটা। কিন্তু আমি আমার পুরো জীবনযাত্রাটা সম্পর্কেই জিজ্ঞাসু হয়ে উঠলাম। কী ভাবে? কী ভাবে বেঁচে আছি?
আমরা থাকি পশ্চিম প্রান্তে। আমি আর বাবা। মাটির উঁচু দাওয়ার ওপর খাপরার চালের দুটো ঘর। একটায় বাবা থাকে, শোয়, একা। অগত্যা অন্যটাতে আমি থাকি, শুই একা।
আমরা খাই ন’ জ্যাঠাইমার হেঁশেলে। সকালে স্কুলে যাবার সময়ে ন’ জ্যাঠাইমাদের সবে প্রথম হাঁড়ি চালের ভাত নেমেছে। পঞ্চা, নিতাই, রবি, গায়ত্রী, বিনু, সত্য…এই রকম জনা ছয় সাত স্কুলযাত্রী গরম ভাতে ঘি দিয়ে আলুভাতে মেখে খেয়ে উঠে যায়। আমি বারবার ভাত খেতে পারি না। নন্দপিসি মুড়ির মধ্যে দুধ ঢেলে আমার জন্যে নিয়ে আসে। নারকোল কোরা আর বাতাসা ঢেলে দেয় ওপরে। বিকেল সাড়ে তিনটে চারটের সময়ে স্কুল থেকে ফিরে আমরা ভাত খেতে বসি। শুকতো থেকে অম্বল সব কিছু খেতে হয় আমাদের। তখনও ন জ্যাঠাইমাদের পাত পড়েনি। আমরা উঠব, তবে ওঁরা বসবেন। উনি, ফুলকাকিমা, রাঙাবউদি, লীলাপিসিমা, নন্দপিসি।
ন’ জ্যাঠাইমা হয়তো একদিন বললেন—হ্যাঁরে ছোট সোনা, তোর বাপকে যেন কদিন বসতে দেখিনি!
আমি কী করে জানব? আমি কিছুই জানি না।
নন্দপিসিই বলল—ওর বাপের তো কদিন খুব সর্দি, জ্বরোভাব। আমাকে বললে দুধ-বার্লিক করে দিতে তো তাই দিচ্ছি।
এত মানুষ আর এত বিশৃঙ্খলা যে নিজে উদ্যোগ করে পাতা পেতে না বসলে খাওয়াই জুটবে না এ বাড়িতে। নন্দপিসির যত্ন-আত্তিটুকু ছাড়া ঠাকুর বাড়ির সবই এজমালি, সবই ভাগের—তরিতরকারি, চাল, ডাল, তেল মশলা, কাপড়চোপড় কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু হাত পেতে চেয়ে নিতে হবে। যদি না পারো তো পাবে না।
আমি পারি না, পেতামও না কিছু। হয়তো অযত্নে, অবহেলায়, না খেয়ে মরেই যেতাম। নন্দপিসির দয়ায় বেঁচেছি। ওর দয়াতেই পাই ঠাকুরের প্রসাদ, বছরের জামাকাপড়, রোগের ওষুধ পথ্য। আমার মা থেকেও নেই, বাবা খোঁজ করে না। কিন্তু পঞ্চা, রবি, নিতাই ইত্যাদি আমার জাড়তুত খুড়তুত পিসতুতদের মায়েরা শত কাজেও তাদের ওপর নজর রাখেন। কে তেতো ভালবাসে না, কর মুগের ডাল আর আলুভাজা ছাড়া খাওয়া হয় না, কার প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে, কার জুতো ছোট হয়ে গেছে এ সমস্ত খোঁজ খবরই তাঁরা রাখেন, সেই মতো ব্যবস্থাও নেন। এদের অনেকেরই বাবা চাকরি করেন কোথাও না কোথাও। হয়তো সপ্তাহ শেষে বাড়ি আসেন, সেই সময়ে এস্টেটের হিসেব বহির্ভূত শখের জিনিসও তাঁরা ছেলেমেয়েদের জন্যে আনেন। কিন্তু আমার বাবা হিজল বাগানে জামগাছতলায় বসে মাছ ধরে কিংবা রঘুদার কালো ছাগলছানাটার সঙ্গে কঞ্চি কাড়াকাড়ি খেলে। বাবা নিজেও এস্টেটের কোরা লালপাড় ধুতি ছাড়া পরে না, আমিও বারো মাস তিরিশ দিন পরি এস্টেটের খাকি হাফপ্যান্ট আর ছাই রঙা শার্ট। মা যতদিন আসছিল আমারও কিছু শহুরে শখের জিনিস প্রাপ্তি হচ্ছিল। তখনকার ক্রেয়ন, জলরং, স্কেচবুক, তখনকার গেমস আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু এখন মা আর আসে না, বাবাও যত দিন যাচ্ছে আরও আলগা, আরও ভুলো হয়ে যাচ্ছে।
রাত্তির সাতটা অবধি আমি তারকদের বাড়িতে রয়েছি। সাতটা বেশ রাত। তারকের বাবা জিজ্ঞেস করলেন—বাড়িতে বকুনি খাবে না এতক্ষণ অবধি বাইরে রয়েছ।
—কে বকবেন?—আমার উত্তরে কি দার্শনিকতা মিশে থাকে?
—কেউ ভাববেন না? চিন্তা করবেন না?
—না।
আদরও নেই, শাসনও নেই আমার। আর সব ছেলেমেয়ে অবশ্য বিকেল হলেই বাড়ি ফিরে যায়, সন্ধে হলেই পড়তে বসে, রাত হলেই খেয়ে নেয়, ঘুমিয়ে পড়ে। আমি যদি একদিন হিজলপুকুরে চলে যাই, কোনও বাহাদুরি দেখাতে দিয়ে ডুবে যাই, আমার লাশ ভেসে না ওঠা পর্যন্ত কারও হয়তো খেয়ালই হবে না আমি নেই।
বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই বা আমার যোগ কতটুকু? একই স্কুলে পড়ি, একই বাড়িতে থাকি, কত সময়ে একই সঙ্গে খাই, কিন্তু অনেক লোভ দেখিয়েও ওদের আমি কখনও আমাদের ঘরে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারিনি। চাইনিজ চেকার, তাস, দাবা, লুডো, কিছু দিয়েই না। কিছুক্ষণ গেলেই বড়রা ওদের ডেকে নেন।
একবার, একবারই মাত্র বাড়ির ছেলেদের একজন হবার সুযোগ এসেছিল। শুনলাম পঞ্চা, ভুতু আর আমি—আমাদের তিনজনের নাকি পাঁচ বছর বয়স হয়েছে, এক সঙ্গে হাতে-খড়ি হবে। নতুন কাপড় পরেছি, নতুন স্লেট-পেনসিল হাতে। ফট করে স্লেটে একখানা ‘অ’ লিখে ফেললাম। বিরাট একটা ‘অ’। ফুলকাকিমা আমাকে নিতে এসে সেই লেখা দেখে মুখ কালো করে ফিরে গেলেন। তারপরে নন্দপিসি এসে ধমকে বলল—‘কে তোমাকে বাহাদুরি করতে বলেছিল? নাও, এখন ওরা কেমন মজা করে হাতে খড়ি করবে, তুমি ন্যাড়া-নুলো হয়ে বসে থাকো। বোকা ছেলে কোথাকার!’ জীবনে প্রথম রায়বাড়ির একজন হয়ে, আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গৃহীত হবার একটা সুযোগ এসেছিল, গেল। যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম।
সাধারণত আমি পেছন দিক দিয়ে ঢুকি বাড়িতে। আমাদের ঘর কাছে হয়। আজ সামনে দিয়ে ঢুকি। বাগান ঘেরা—রাধামাধব জিউর মন্দির। মন্দিরটা পোড়ামাটির। কিন্তু পাশে মন্দিরের গা দিয়েই পাকাঘর তোলা হয়েছে কয়েকটা। ডাইনে দুটো, বাঁয়ে দুটো। সামনে লম্বা চওড়া বারান্দা। ঘরগুলোতে ঠাকুরের সাজ-সরঞ্জাম থাকে।
একেবারে ডাইনের ঘরটায় চেয়ার-টেবিল আর গোটা চার স্টিলের আলমারি আছে। এখানে বড় জ্যাঠামশায়কে কাজ করতে দেখেছি।
মন্দিরের পেছনে আছে ঠাকুরের রান্নাঘর। একটা মাটির ঘর, খড়ের চাল। এখানটা সব সময়ে ঘি-এর গন্ধে ম-ম করে। সামনে মন্দিরটা রেখে রায়বাড়ি ক্রমশ পেছন দিকে বিস্তৃত হয়েছে। বাড়ি বললেও, আসলে তো এটা বাড়ি নয়, একটা পাড়া বিশেষ। থেকে থেকেই দুখানা কি তিনখানা ঘরের এক একটা ইউনিট। সামনে বারান্দা। ঘরগুলো বেশির ভাগই মাটির, কয়েকটা মাত্র পাকা ঘর আছে। কিন্তু চাল সবগুলোরই টালির কিম্বা খাপরার, কোনও ঘরই দোতলা নয়। গাছপালায় ভর্তি রায়বাড়ির চৌহদ্দি। কিছুটা কিছুটা অংশ তো রীতিমতো বাগান। পুকুরও আছে গোটা তিনেক। কারও বিয়েটিয়ে হলেই অমনি নতুন ঘর ওঠে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কয়েকটা উঠোন আছে, তারই চারপাশ ঘিরে ঘরগুলো। উঠোন কিন্তু বাঁধানো নয়। খালি জমি বেশ সমান করে পেটানো, তার ওপর সুরকি চালা। ভেতর দিয়ে পথও গেছে, পথের ওপর নুড়ি বিছোনো। আমি পুব দিকে ঠাকুরবাড়ির বাগানের গেট ঠেলে ঢুকলাম। যখন এখানে অনেক লোকের ভিড় থাকে, তখন আমি এ মুখো হই না। আসি যখন কেউ বিশেষ থাকে না।
এখন আরতি হচ্ছে। ভারী ঘণ্টাটার গং গং আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ঘণ্টার নিরবচ্ছিন্ন পাতলা টুং টুং আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে। বারান্দার ওপর আরতি দেখতে রাধানগরের অনেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। রায়বাড়ির মহিলারা অনেকেই রয়েছেন। কাকা জ্যাঠাদের মধ্যেও কেউ কেউ জোড় হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শঙ্খ বাজছে, কাঁসর বাজছে। চক্কোত্তিমশাই পঞ্চপ্রদীপটা নামিয়ে রেখে কর্পূরের দীপটা তুলে নিলেন। পঞ্চপ্রদীপ হাতে নিয়ে সেজ জ্যাঠাইমা এগিয়ে আসছেন ভিড়ের দিকে।
আমি কি একটু তাপ পাব? নাঃ, সেজ জ্যাঠাইমা আমাকে দেখতে পেলেন না। ঠাকুরের পেতলের হাতে মুখে পঞ্চপ্রদীপের ছায়া নাচছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাধামাধবের চোখে চোখ ফেলবার চেষ্টা করি। কিন্তু চারদিকে এত আলো এত শব্দ, এত ভক্তি, কেনই বা ওঁরা আমার অন্ধকার কোণের দিকে তাকাবেন?
চক্কোত্তিমশাই তামার থালা থেকে চামর তুলে নিলেন। আমি আর অপেক্ষা করি না, এ ঘর সে ঘরের পাশ দিয়ে দিয়ে নিজেদের আস্তানার দিকে এগোতে থাকি।
মেজ ঠাকুরদার ঘরের সামনের বারান্দায় কয়েক জন বসে। মেজ ঠাকুরদা আমার চলার আওয়াজ পেলেন বোধহয়। চেঁচিয়ে বললেন —কে যায়?
—আমি সোনা।
—সোনারুপো আবার কেডা?
মেয়ে গলার আওয়াজ পাই— ওই তো ছোট খুড়োমশায়ের ঘরের রাজু গো, ওরির ছেলে।
—রাজু? কোন রাজু?
—আহা বললুম তো! রাজেন যে ম্যাম বিয়ে করেছে।
—তাই বলো।
আমাকে এঁরা ‘আমি’ বলে চেনেনই না আমার পরিচয় আমার বাবার পরিচয়ে রাজুর ছেলে। আবার বাবার পরিচয় আমার মার পরিচয়ে। ‘যে রাজু ম্যাম বিয়ে করেছে।’
মাকে এঁরা মেম বলেন কেন? মা তো শাড়ি-পরা বাঙালি মেয়েই। খুব ফর্সা বলে? না ছোট চুল বলে? ছেলেদের মতো পা-ঢাকা নিউ কাট জুতো পরে আসত মা। চলার ভঙ্গি খুব সোজা। দৃপ্ত ধরনের। তাতে তো বরং মাকে দুর্গা কি জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মতো লাগত! মেম-মেম নয় মোটেই। আর সুদ্ধু ছোট চুল আর সোজা হাঁটার জন্যেই কি এত ব্যঙ্গ? অদ্ভুত তো!
পারা-চটা গোল আয়নাটায় বাবা খুব মনোযোগ দিয়ে দাড়ি কামাচ্ছে। আমি বিনা ভূমিকায় জিজ্ঞেস করলাম— ‘বাবা, মা আর আসে না কেন?’
থতমত খেয়ে গেল বাবা, কোনওদিন কোনও জরুরি প্রশ্ন তো বাবাকে করিনি। তবে বাবা যা বলল, তাতে আমারও থতমত খাবার কথা। বলল— ‘আমি কী করে জানব?’
যদি বলত— ‘জানি না’, তার একটা মানে হত। কিন্তু ‘আমি কী করে জানব?’ বাবার জানার কথাই নয়? মা তো বাবারই বউ? সেই মা কেন আসে না, বাবা জানে না, জানার কথা বলেও মনে করে না!
—কে জানবে তা হলে? কে জানে? আমি ছাড়ব না আজ।
— কেন আসে না, মা?—আর একটু দৃঢ় গলায় জিজ্ঞেস করি।
—তোমার মা-ই জানে।
এর ওপরে আর কী কথা চলতে পারে! মায়ের আসা-না-আসা নিয়ে বাবার কোনও আগ্রহ উদ্বেগ নেই। কোনও ভূমিকাই নেই। মা নিজের ইচ্ছেয় আসত, নিজের ইচ্ছেয় আসা বন্ধ করেছে— এমনটাই বুঝতে হয়। তা যেন হল। কিন্তু আমি তো মায়ের ছেলে? যতই এরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করুক, যতই বাবা উদাসীন থাকুক, আমার জন্যেও মা আসবে না? আমার কথা মনে করে…। তবে কি মা আর নেই? মারা গেছে? আমাকে লুকিয়ে যাচ্ছে বাবা? লুকোবেই বা কেন? আমার দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বাবার বা আর কারও তো এত মাথাব্যথা দেখিনি? তা ছাড়া মা মারা গেলে শ্রাদ্ধ বলেও তো কিছু আমার করণীয় থাকে! বাচ্চা তো আর নই! হাতে-খড়ি বাদ দিলেও চলে। কিন্তু মাতৃশ্রাদ্ধ? নাঃ, মা মারা যায়নি। বেঁচে আছে কোথাও। আমার মন বলছে ভালই আছে। খারাপ থাকার মানুষ আমার মা নয়। কোনও অজ্ঞাত, রহস্যজনক কারণে এখানে আসা মায়ের বন্ধ হয়ে গেছে। চিঠিপত্র দেওয়ারও উপায় নেই। হয়তো দেয়, আমি পাই না। এ সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ছোট থেকেই আমি আমার ব্যথা-বেদনা না প্রকাশ করে অভ্যস্ত। ব্যথা-বেদনার অনুভূতিই কি আমার আছে? বুঝি না। তবে স্কুলের পরীক্ষাটা পাশ করে আমি মায়ের কাছে চলে যাব। কেন না, এভাবে কি মানুষ বাঁচে?