Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাধানগর || Bani Basu » Page 15

রাধানগর || Bani Basu

আমাদের ব্রেকফাস্ট টাইম কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাড়ে আটটা। বহুদিন থেকে এ নিয়ম চলে আসছে! সম্ভবত দাদার টাইম থেকে। এই সময়টা যাদের সুট করবে না, যেমন আমার, তারা পুরো ব্রেকফাস্ট না করে অল্পস্বল্প খেতে পারে, আমি যেমন একটি বিস্কিট, একটু দুধ বা চা খেয়ে থাকি, কিন্তু এই সময়টা আমাদের এই গোল টেবিল কনফারেন্সে যোগ দিতেই হবে।

ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি দিয়া আর মা ইতিমধ্যেই এসে গেছে। কথা বলছে। খাবার-দাবার এখনও এসে পৌঁছয়নি। ওরা দুজনে কথা বলবে বলেই বোধহয় একটু আগে এসে গেছে। আলাদা কথা বলার দরকার ছিল তো সেটা ঘরেই সারলে পারত! আমাকে আসতে দেখেই এই থেমে যাওয়া এটা তো এড়ানো যেত! এটা কি অভদ্রতা নয়? এর পর মন্দার বেচারি আসবে, তো তাকে দেখে তো এরা হাত বাড়িয়ে মুখোশ তুলে মুখে আঁটবে মনে হচ্ছে।

আমার মুখোমুখি বসেছে দিয়া। দিয়া রোজই আজকাল বেশ সকাল-সকাল গোসল করে নিচ্ছে দেখছি। সাদা শাড়ি পরেছে। খুব ফাইন মিলের শাড়ি, ব্লু পাড়, দিয়া কি হিন্দু বিধবা সাজতে চায় না কি? কপালে আবার একটা চন্দনের ফোঁটা। এই ফোঁটাটা কাটলেই দিয়ার পুরো গেট-আপটা পাল্টে যায়। কৃষ্ণভক্ত-কৃষ্ণভক্ত দেখায়। দিয়া বোধহয় সেটা ভালই জানে। নাতিকে ইমপ্রেস করতে দিয়া এটা করছে। যদিও নাতি কৃষ্ণভক্ত কি না দিয়া এখনও জানে না।

মা-ও দেখছি আজ শাড়ি পরেছে। মুসৌরিতে মা একেবারেই শাড়ি পরে না। ওবেরয়ে যখন যেত, তখন তো দারুণ সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরে যেত, কোনও কোনও দিন বাঙালি সীজনে, অর্থাৎ পুজোর সময়ে ভাল ভাল সিল্কগুলো মার বেরোত, সে-ও ক্রেতা মজাতে। অন্য সময়ে মায়ের পোশাক হল প্যান্ট, কিংবা সালোয়ার কামিজ। আজকে এই পীচরঙের সুতির শাড়িটা মা কোথা থেকে আমদানি করল? এখানকার আলমারি থেকেই বার করেছে নির্ঘাত। ভাল। বাড়িতে একটা পুরুষ মানুষ এসেছে, এদের পোশাক-পরিচ্ছদ হাবভাব থেকেই বোঝা যাচ্ছে। আঠারো হোক উনিশ হোক আ ম্যান ইজ আ ম্যান।

কাল রাতে, মা এসেছে শুনে একবার জাস্ট ঘরে গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম। মাতৃদেবী তখন মন্দার নামক বৈদ্যুতিক শকে অপ্রকৃতিস্থ। শয্যা আশ্রয় করে উপুড় হয়ে শুয়েছিলেন। আমার সঙ্গেও বিশেষ কথা বলার মুডে ছিলেন না। কারও মুড-টুড খারাপ থাকলে আমি আবার তাকে বিরক্ত করবার পক্ষপাতী নই। মুড খারাপের ঝামেলা তো আমারও আছে কি না! সে সব সময়ে আমিও বিরক্ত হতে পছন্দ করি না।

—হাই মিসেস রডরিগস।

মা ফিরে তাকাল। পীচ রঙের শাড়ির আভা সত্ত্বেও মাকে খুবই শুকনো দেখাচ্ছে। চোখ দুটো বেড়ালের মতো সতর্ক হয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাশে। মেরুন কুমকুমের টিপটা কোনও কাজেই আসেনি। অন্য সময় হলে আমার সম্বোধনে মা নির্ঘাত তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠত। আজ কিন্তু খেয়ালই করল না।

—তুমি কি ওকে বলেছো?—মা জিজ্ঞেস করল সন্তর্পণে।

—কী? কী বলব? আমিও জিজ্ঞেস করলাম যেন কিছুই বুঝছি না।

দিয়া তাড়াতাড়ি বলল—হ্যাঁ বলেছে। তাইতেই তো সেদিন রাত্তির দশটায়।… বললাম না তোমায় গতকাল!

মা বলল—ও ব্রেকফাস্ট করতে এখানে আসবে না? ওকে ডেকে নিয়ে এসো না বুলা।

—সো য়ু আর রেডি নাও? আমি হেসে বলি।

—নো। নট ফর ইয়োর সারকাজমস। ইয়েট। —মা ঝাঁঝিয়ে উঠল। অর্থাৎ এতক্ষণে নিজের স্থৈর্য ফিরে পেয়েছে।

দিয়া বলল—বুলা প্লিজ আর কথা বাড়াসনি, যা।

সুতরাং পুরুষমানুষটির ঘরে গিয়ে নক করি।

—কে?

—আমি বুলা—ভেতরে গিয়ে দেখি। চান হয়ে গেছে। ভাল করে দাড়ি কামিয়েছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বেশ ফিটফাট হয়ে বসে আছে টেবিলের সামনে চেয়ারে।

—চলো, ওয়েট করছ কীসের জন্য?

—যাব?

—বাঃ, যাবে বই কী!

কী একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। বলল—তুমি যাও, আমি আসছি। আবার কী রাজকার্য আছে কে জানে?

ফিরে দেখি খাবার-দাবার এসে গেছে। বাঃ। আজ রুটি-মাখন-ডিম প্রতিদিনের এই একঘেয়ে ব্রেকফাস্টোও নয়। ডলি বেবি এসেছে কি না, খালেদা তাই দু-তিন রকমের পরোটা করে এনেছে। জিভে-জল আনা আচার, গাজরের হালুয়া, আলু কপি কড়াইশুঁটি-বীন এ সব দিয়ে একটা শুকনো শুকনো বস্তু। তার মানে আজ আমি ব্রাঞ্চ খাব। এই সব মুখরোচক জিনিস তো আর রিফিউজ করতে পারি না। এইগুলো খেয়েই আজ কলেজ যাব।

মন্দার আসছে। দাড়ি গোঁফ কামিয়ে কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওকে। পাতলা পাতলা গজিয়ে ছিল, না কামালেই পারত। মায়ের সঙ্গে লড়াইটার কারণে শক্তি সংগ্রহ করবার জন্যেই হঠাৎ ক্ষুর ধরে ফেলল, না কী?

মা পাশ ফিরে বসে আছে। মায়ের চেয়ার পর্যন্ত এগিয়েই, অদ্ভুত কাণ্ড, মন্দার নিচু হয়ে মাকে প্রমাণ করল।

এমন অদ্ভুত, অত্যাশ্চর্য, সমস্ত প্রত্যাশার বাইরে জিনিসটা যে কেউ আমরা কথা বলতে পারলাম না। প্রণাম আমাদের অভ্যাসের মধ্যে পড়ে না। দিয়া বা মাকে গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খাওয়াই আমাদের রীতি। তাই বলে কি আর প্রণাম জিনিসটা জানব না? স্কুলে কত করেছি। কিন্তু এখন, এই প্রণামটা এমন একটা শ্রদ্ধানিবেদনের মতো দেখালো যে চুপ, একেবারে চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। মায়ের চোখ দিয়ে দেখি ধারা নেমেছে। এখন তো আর হাতের কাছে রুমাল নেই। নিজের আঁচলটাই মা চেপে ধরেছে চোখে, অবিকল বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো। মন্দারও না এবার ওর জীবনের তৃতীয় কান্নাটা কাঁদে।

ডান হাতটা পুরো আশীর্বাদের ভঙ্গিতে মা ওর মাথায় রেখেছে। কিছু বলতে পারছে না। কিছু না বলেই ওকে নিজের দিকে টানল। পাশের চেয়ারটায় বসতে ইশারা করল। দিয়া মুখ নিচু করে প্লেটে প্লেটে খাবার তুলছিল। একটা প্লেট নিঃশব্দে আমার দিকে এগিয়ে দিল, সেটা আমি মন্দারের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।

—এই যে বিগ বেবি, খান। আপনার মা কি আপনাকে খাইয়ে দেবেন?

সকলেই একটু-একটু হাসছে। যাক, যে কোনও মুহূর্তে মেঘ ভেঙে তুমুল বর্ষণ হবার সম্ভাবনাটা রুখে গেছে, রুখে দিয়েছি।

—আমি এগুলো খাব?—মন্দার জিজ্ঞেস করল।

—খাবে না কেন? তোমার তো হয়েছিল ম্যালেরিয়া, হেপাইটাইটিস তো আর হয়নি।

দিয়া বলল—খেতে কি ইচ্ছে করছে না?

—না, না, খুব ইচ্ছে করছে।

তাড়াতাড়ি পরোটা ছিঁড়ল ও। যাক বাবা। হালকা হয়ে যাচ্ছে হাওয়াটা। সবাই খালেদাকে বাহবা জানাতে জানাতে খাচ্ছে। মেথি পরোটার রেসিপি বলছে খালেদা মাকে। আমি দিয়ার কাছ থেকে আরও একটা নিই।

—শাক দিয়ে এমন পরোটা হয় আমি জানতাম না—মন্দার বেশ সহজ ভাবে বলল।

দিয়া বলল— তোমাদের ওখানে তবে কী হয়? আলু পরোটা?

—পরোটা জিনিসটারই চল নেই তেমন। লুচিই হয় বেশির ভাগ। তবে কোনও কোনও পূর্ণিমার দিন শখ করে কেউ হয়তো ঢাকাই পরোটা ভোগ দিলেন ঠাকুরকে। সেই ঢাকাই পরোটার অংশবিশেষ প্রসাদ খেয়ে আমার অবস্থা কাহিল।

—কেন? আমি জিজ্ঞেস করি।

—ওইটুকু খেয়ে কি আর সাধ মেটে? — বাঃ মন্দার দেখছি সত্যিই সহজ হয়ে গেছে।

মা এবার মন্দারের মুখের দিকে অসংকোচে তাকাল। এতক্ষণ তাকাতেই পারছিল না। দিয়ার দিকে চেয়ে বলল—মা, মন্দারকে একেবারে অবিকল বাবার মতো দেখতে হয়েছে দেখেছ!

দিয়া এতক্ষণে হাসি হাসি মুখ করে বলল— তুই-ই বললি, আর আমার খালেদ বিবি, আর তো কেউ…..

—কালকেই দেখেছি। স্ট্রাইকিং রিজেমব্ল্যান্স! দেখে একেবারে থ হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক যেন বাবা, বাবাই অ্যালবামের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে আমায় দরজাটা খুলে দিল। তারপর দেখি মন্দার!

—সেটাতেও থ হয়েছ কম না— আমি বললাম— ডাব্‌ল থ, এখন গলে জল। বাটি-টাটি দেব?

—সবকিছুতেই এমন ইয়ার্কি করিস! মা বিরক্ত। মা জানে না এই ইয়ার্কিই মাকে বাঁচাচ্ছে।

মন্দার বলল—আমার আসার খবর কি তোমরা মাকে দাওনি? মন্দাকিনী?

দিয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল—আমরা ওকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম মন্দার। আসতে লিখেছিলাম, কিন্তু কেন সেটা লিখিনি।

ও বলল, সারপ্রাইজই হয়ে গেল। তবে ভেরি ভেরি আনপ্লেজেন্ট। তাই না মা?

মা অভিমানের দৃষ্টিতে তাকাল একবার মন্দারের দিকে তারপর দিয়াকে বলল—খবরটা না দিয়ে ভাল করনি মা। বুলার কথা ছেড়ে দাও, তুমি যে এরকম ছেলেমানুষি করবে…।

—জানলে কী করতে মা?—মন্দারের চোখে এবার হাসি চকচক করছে, যদিও হাসিটা ঠিক হাসির মতো নয়।

—চলে আসতাম, তোমার ভর্তি-টর্তির ব্যবস্থা করতাম।

—সে সব কি আর তোমার করার জন্যে বসেছিল? তুমি জানো না, এখন অ্যাডমিশন কী রকম ঝামেলার ব্যাপার হয়ে গেছে! বড় জ্যাঠামশাই, খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে সাহায্য করলেন, শিশিরদা স্কুলের একজন মাস্টারমশাই সঙ্গে এলেন … তুমি হঠাৎ দৈবাৎ আমার আসার খবর পেয়ে এত সব করতে পারতে? তুমি তো রেডিও ছিলে না।

—তুই কি আমায় জেরা করছিস?

—যদি করি মা। এতগুলো বছর। তুমি কি জানতে আমি বেঁচে আছি, না মরে গেছি!

এবার মিসেস রডরিগস কী উত্তর দেন শোনবার জন্য কান খাড়া করে রয়েছি। এ তো তাঁর উদ্ধত, সভ্যতা-ভব্যতার-ধার-না-ধারা মেয়ে নয়, এ হল তাঁর মাথা নিচু করে প্রণাম করা বৈষ্ণব বিনয় আর ক্ষমার অবতার, পুত্র।

—মন্দার, তোকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। সব কথা বলা না হলে, তোর পক্ষেও কিছু বোঝা সম্ভব নয়। বিশ্বাস কর…

আমার হঠাৎ ভীষণ রাগ হয়ে গেল, বললাম—ও তো একটা সিম্পল কোয়েশ্চন রেখেছে তোমার কাছে। ও বেঁচে আছে না মরে গেছে সে খবরটা তুমি রাখতে কি না। সেইটুকুর উত্তর দিলেই তো হয়। বাকি আর সব গল্প তুমি না হয় পরে কোরো। কৈফিয়তগুলো পরে দিয়ো।

মায়ের মুখে রাগ ঝলসে উঠল। আমি গ্রাহ্যও করলাম না। বললাম —মন্দার তো তোমার কোনও রকম পাত্তাই জানত না। বেচারি থাকত শেয়ালদার একটা এঁদো ঘরে একটা বাজে লোকের সঙ্গে। লোকটা মাতলামি করত, ওকে ফরমাশ খাটাত আর যাচ্ছেতাই গালমন্দ করত। দিনের পর দিন এই শহরে না-খেয়ে ও ঘুরেছে। তুমি কি জানো আমার চেহারায় তোমার সঙ্গে মিল দেখে কপাল ঠুকে ও আমার পেছু নিয়েছিল! আমি যদি বাই চান্স ওর কলেজে ভর্তি না হতাম তা হলে ও কোনওদিনও তোমায় খুঁজে বার করতে পারত না, আর এই চেহারার মিল দেখে পেছু নেওয়ায় যদি ওর কোনও ভুল হয়ে যেত? তা হলে কী হত বুঝতে পারছ, স্রেফ গণপিটুনি খেয়ে ও মরে যেতে পারত, মা! ইউ ও হিম সাম এক্সপ্লানেশন!

মার মুখটা থমথম করছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মুখটা তুলতে পর্যন্ত পারছে না। দু’ একবার কিছু বলতে গেল। বলতে পারল না।

হঠাৎ মন্দার ভেজা-ভেজা গলায় বলল— বুলা, মাকে কষ্ট দিস না। আমি চলে যাচ্ছি। কোনও প্রশ্নের জবাব আর আমার চাই না।

ও উঠে চলে গেল। আজ প্রথম ও আমাকে ‘বুলা’ বলল, ‘তুই’ বলল।

আমার দশটা পঁয়তাল্লিশে কেমিষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল। আমাকেও উঠে পড়তে হল। সারাদিন ওদের কেমন কাটবে জানি না। ভাবুক ওরা ভাবুক। দিয়া। মা। নিজেদের জীবনে ওরা নানান জট পাকিয়েছে। সে জটিলতার ভুক্তভোগী তো দেখছি আমরাই। ওরা কি মনে করে কতগুলো গল্প বলে দিলেই সব আবার যেমন কে তেমন হয়ে যাবে? সারাদিন প্রচুর ক্লাস। প্র্যাকটিক্যালের পর কয়েকটা ক্লাস লাস্ট বেঞ্চে বসে কাটিয়ে দিলাম। তারপর আর ভাল লাগল না। প্রথমে গেলাম কনভেন্ট রোড। নেক্সট্‌ মাস থেকেই মন্দার আসবে প্রদ্যুম্নদার কাছে পড়তে। সেটা ওঁকে বলা দরকার। আমারও বেশ কয়েকদিন বাদ গেছে। একটা ব্যাচ পড়াচ্ছে প্রদ্যুম্নদা। আমাকে অবশ্য বলল—ওয়েট করতে। দূর, বেশি কথা বলতেও আমার আজ ভাল লাগছে না। মা এসেছে—বসতে পারছি না বলে দিই। হাঁটতে হাঁটতে যাই।

এন্টালি বাজারের বাইরে একটা লোক দেখি গ্ল্যাডিওলাস বিক্রি করছে, সাদা আর কমলা রঙের। আঠেরোটা স্টিক কিনলাম। গোলাপও নিলাম অনেকগুলো, দিয়ার জন্য হলুদ গোলাপ, মায়ের জন্য লাল। কেন গোলাপগুলো নিলাম কে জানে? গোলাপ হল ভালবাসার ফুল। এই ফুল দিয়ে কি আমি আসলে মা আর দিয়ার কাছে ক্ষমা চাইছি? না কি শুধুই এদের আশ্বস্ত করতে চাইছি—আমার ব্যবহারে দুঃখ পেও না মা, দুঃখ পেও না দিয়া, এই দেখো তোমাদের জন্য ভালবাসাও এনেছি।— কে জানে?

লাইব্রেরির রকিংচেয়ারটায় হেলান দিয়ে মন্দার ‘ব্রাদার্স কারামাজোভ’ পড়ছে। আমি চুপিচুপি মায়ের ঘরে ঢুকে দেখি মা নেই,— লাল গোলাপগুলো টেবিলের ওপরে রেখে দিই। মা নিজের ইচ্ছে মতো সাজাবে এখন। মন্দারের ঘরে গ্ল্যাডিওলাসগুলো টেবিলের ওপর ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখি। দিয়ার ফুলগুলো নিয়ে ঘরে ঢুকতে যাব, শুনি মায়ের গলা। মা এখানে? কয়েকটা কথা কানে আসতেই আর আমার ঘরে ঢোকা হয় না। চট করে থেমে যাই। পরের কথা আড়ি পেতে শোনা উচিত নয়? পর তো নয়! আমারই মা, আমারই দিদিমাকে আমার কথা বলছে। শুনব না?

মা বলছে—এ সব কি ছেলেমেয়েদের বলা যায়? কী যে বলো মা।

দিয়া—ওরা বড় হয়ে গেছে ডলি। একটু সাহস করে বলেই দেখ না।

মা—কী বলব? রাজেনকে নিয়ে আমার আর মিলির মধ্যে রাইভ্যালরি ছিল? জেলাসি ছিল? এই কথা ওদের বলব? বলা যায়? আমি পারব না। তোমার আর কী? এখন তো আর কারও কাছে ইমেজ নষ্ট হবার ভয় নেই।

দিয়া—ঠিক আছে, আমার না হয় ভয় নেই। কিন্তু তোমারই বা ভয় কীসের ডলি? তুমি তো ওদের নাগালের বাইরেই চলে গেছ।

—না, নাগালের বাইরে যাওয়া যায় না মা। দে আর মাই চিলড্রেন, আই ডু কেয়ার ফর দেম। আমার আর সন্তান হবে না মা। ওরাই আমার প্রথম, ওরাই আমার শেষ। মে বি, এর পরে আমি হয়তো ঘন ঘন আসব এখানে। ওদের কেরিয়ারের ব্যাপারে ইন্‌ট্‌রেস্ট নেব। হতে পারে মুসৌরি ছেড়ে পাকাপাকি এখানেই চলে এলাম।

—সে কী?—দিয়ার গলায় উদ্বেগ—আবার কিছু গোলমাল হয়েছে না কি স্যামুয়েলের সঙ্গে?

—গোলমাল ঠিক নয়। হি ইজ ভেরি ভেরি ন্যাস্টি অ্যাট টাইম্‌স্‌। ন্যাস্টি অ্যান্ড মীন। ওর ওই স্বভাবের জন্যেই তো বুলা টিঁকতে পারল না ওখানে। আমাকে চাকরিটা ছাড়াল জোর করে। অতদিনের চাকরি। কিন্তু এখন টাকা পয়সা দেবার বেলায় হাত মুঠো। ভাবছি আবার চাকরি ধরব। ওখানে না পাই তো এখানে।

—একজনকে ছাড়লে ডলি। তার জন্যে বোনের সঙ্গে কত কামড়া-কামড়ি। এখন আবার…

—জানতাম এই কথাই বলবে। আচ্ছা সত্যি কথা বলো তো মা রাজেনকে দেখে যে তোমার মনে হয়েছিল আরেক বিনয়ভূষণ ফ্যামিলিতে এল, সেটা কেন? ওকে পেয়িং গেস্ট নেবার আগে কি তোমার দুবার ভাবা উচিত ছিল না? বাড়িতে আমরা উঠতি বয়সের দুটো মেয়ে।

আমরা মানে আমি হলে তো ভাবতাম তুমি ভাবনি কেন না ওই মোহ, ও-ও বিনয়ভূষণের মতো! তুমি আমাদের এনকারেজ করোনি? আমরা ভুল করতেই পারি, ভুল করারই বয়স। কিন্তু ওর যে চেহারা, স্বাস্থ্য অর্থাৎ বডিটা ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না। একটা টোট্যালি অকর্মণ্য পুরুষ, এটা তোমার বোঝা উচিত ছিল।

— বুঝিনি ডলি, এখনও বুঝি না। মিলি হয়তো ওর সঙ্গে সুখী হতে পারত। তোমার পথ পরিষ্কার করার জন্য তো মিলিকে চলেই যেতে হল।

—মা এই দোষটা তুমি আমার ঘাড়ে কিছুতেই চাপাতে পারো না। মিলি ওর সঙ্গে ইনভল্‌ভ্‌ড্‌ হয়েছিল সমস্ত জেনে বুঝে। আমি কি ওকে বলেছিলাম—তুই মরে যা। আমি তোমাকে আবারও বলছি মা— মিলি নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে ছিল। তখন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ও যদি আমার ওপর টেক্কা দিতে গিয়ে নিজেকে বিপদে ফেলে তার দায় কি আমার? ডু য়ু ওয়ান্ট মি টু আনডু দা পাস্ট অ্যান্ড বি ইন মিলিজ প্লেস। এ কথা তখন বলনি কেন মা? বিষ হয়তো খেতে পারতাম না। কিন্তু তোমাদের চোখের সামনে থেকে সরে যেতে তো পারতাম!

—মা কি কান্নাকাটি করেছে না কি? বাইরে থেকে একটু আওয়াজ করে দিয়ার ঘরে ঢুকলাম। গোলাপগুলো দিয়ার হাতে দিলাম।—বাঃ— দিয়া বলল যন্ত্রের মতো। মাকে বললাম—তোমারও আছে। তোমার টেবিলে রেখে এসেছি।

—আমি কি ফুল পাবার যোগ্য বুলা! আই ডোন্ট ডিজার্ভ এনিথিং ফ্রম য়ু।

আমি মায়ের হাঁটু জড়িয়ে ধরে কোলের ওপর মাথা রাখলাম। রডরিগস্‌-এর সঙ্গে মায়ের বনছে না। বনবে না অনেক আগেই জানতাম। লোকটা যেমন হামবাগ, তেমনই মীন। মা আবার এখানে আসবে, এই এলিয়ট রোডে, আমরা সকলে আবার একসঙ্গে থাকব, প্লাস মন্দার। আমাদের পুরো পরিবার। আমার ভীষণ খুশি লাগছিল।

পুরো পরিবার! পুরো পরিবার! ব্যাপারটা কেমন তাই-ই আমি জানি না। হয় থেকেছি দিয়ার কাছে, দিয়া আর আমি। নয় তো মায়ের কাছে—মা আর আমি। বাবা—নেই, দাদা—নেই। মাসি—নেই। আর কোনও ভাইবোনের কোনও প্রশ্নই ছিল না। আজ কোথা থেকে একটা সত্যিকারের ভাই তো জুটে গেছেই। মা-ও চলে আসছে। আর—বিনয়ভূষণ, মিলি, রাজেন্দ্রনারায়ণ—এদের নাম, এদের প্রসঙ্গ ঘুরে ঘিরে বারবার উঠছে, যেন এরা জীবিত।

বিনয়ভূষণ অবশ্য এ বাড়ির সাজ-সজ্জায়, নিয়মকানুনে, গল্পগাছায় বেঁচে আছেন। দিয়া ক্রমশই তাঁকে পূজনীয় পুরুষ থেকে মহাপুরুষ বানিয়ে তুলছে। কিন্তু মাসি? মাসিকে নিয়ে যে দিয়ার মনে একটা কষ্ট আছে এ কথাটা আমি জানতাম। অত অল্প বয়সে মেয়ে মারা গেছে। কষ্ট থাকতেই পারে। কিন্তু তার পিছনে যে একটা ত্রিকোণ প্রেমের গল্প আছে। আত্মহত্যা আছে এতসব তো কোনওদিন শুনিনি। রাজেন্দ্রনারায়ণ তা হলে এ বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে এসেছিল? এ বাড়ির দুই নন্দিনীকে একসঙ্গে জয় করে কেটে পড়ে? দিয়া তাকে অ্যাপ্রুভ করেছিল? দেখতে হয় লোকটাকে!

—একটা কথা বলবে মা? —এখন আমি মাকে আদর করেছি, মার মনটা নরম আছে। মা আমার দিকে ছলছলে চোখে চেয়ে বলল—বলো, বলে ফেলো।

—আমাদের দুজনের জন্মের তারিখে তফাত ঠিক পাঁচ দিনের। আমি আর মন্দার। দুজনেই তো তোমার বাচ্চা হতে পারি না। দিয়া মন্দারকে বলেছে আমি ওর মাসির মেয়ে, আর আমাকে বলেছে মন্দার আমার মাসির ছেলে। কোনটা সত্যি?

মা গম্ভীর মুখে বলল— বলব, কিন্তু তোমাকে একটা কথা দিতে হবে তার আগে। ওয়ার্ড অফ অনর।

—বলো কী কথা? না শুনে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না।

—এই সব নিয়ে কোনও প্রশ্ন এর পরে যেন আর তোমার মুখে না শুনি।

—ফেয়ার এনাফ। তুমি ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে দিলে, আর কেন জিজ্ঞেস করব?

মা বলল—হতে পারে তোমাদের মধ্যে পাঁচদিনের তফাত। কিন্তু তোমরা দুজনেই আমার সন্তান। দিস ইজ গডস ট্রুথ। আমি তোমাদের দুজনেরই মা। না না। মায়ের কাছে ক্রস চেক করার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। মা নিজেই তখন চোখের অপারেশনের জন্য ম্যাড্রাসে, নেত্রালয়ে। মা কিছু জানে না।—হয়েছে?

—তুমি বেবি সুইচ করেছিলে?

—আবার কথা?

—বলো না!

—আমার দুটো বেবি বুলা। একটাকে তার বাবার কাছে দিয়েছি। আর একটা আমার কাছে রেখেছি। একটা মেয়ের মা-ছাড়া বড় হয়ে উঠতে খুব অসুবিধে তাই গার্ল-চাইল্ডটাকে কাছে রেখেছিলাম। বাস। তুমি কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করছ বুলা। …মন্দার কী করছে? এখনও লাইব্রেরিতে? নাঃ আমি ওর কাছে যাই। মা তুমি বিশ্রাম করো।

আমি ঘরে গেলাম হাত-মুখ ধুতে। জামাকাপড় বদলালাম। কিছুক্ষণ গান শুনলাম। গান মানে মিউজিক। আলি আকবর। আমার ঘরের দরজাটা খুলে রাখলাম। সরোদের আওয়াজটা বাইরে যাক। ওই ছেলেটা কীর্তন ছাড়া আর কিছু শোনেনি, আমরা যে সব গান শুনি, সেগুলো শুনে বলে—ওগুলো আবার গান না কি? ওকে ওর এই রোগশয্যায় বেশ কিছু গানবাজনা শোনালাম। সরোদ ওর খুব ভাল লেগেছে।

শুনতে শুনতে ঘুম এসে গিয়েছিল, দালানের বড় ঘড়িটার আওয়াজে চোখ মেলে দেখি সাড়ে আটটা বাজল। আশা করি, এবার ওরা খাওয়া-দাওয়ার জোগাড় করবে।

মা এখনও মন্দারের সঙ্গে কথা বলছে। রকিং চেয়ারটায় এখন মা। মন্দার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসেছে। বইটা টেবিলের ওপর ফেস-ডাউন করে রাখা।

—সর্বনাশ! এমন করে রেখেছ কেন? বইটা সোজা করে, পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখে নিয়ে বন্ধ করে দিই।

মন্দার বলল—ইস খুব ভুল হয়ে গেছে? আর কখনও হবে না। বুলা প্লিজ দিয়াকে বোলো না।

ওরা নাকি সন্ধে থেকেই গল্প করছে। জিজ্ঞেস করলাম—কীসের গল্প?

মন্দার বলল—রাধানগরের।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress