রাঢ় অঞ্চলের লোকদেবতা- সিনি ঠাকুর
জঙ্গলমহলের প্রান্তিক মানুষ জন যারা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকেন তারা প্রকৃতি পূজার সনাতন ঐতিহ্যকে এখনো মেনে আসছেন। মনসা, চন্ডী, বডাম , শীতলা এঁরা অবশ্যই লোকদেবতা। আজ রাঢ় অঞ্চলে পূজিত লোকদেবী সিনি ঠাকুরের পরান কথা শোনাবো। সিনি ঠাকুরের নামকরণের সাথে জড়িয়ে আছে বৌদ্ধ ভাবনা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন মানুষ গুরুর কৃপায় দেবত্ব লাভ করে দেবতা অপেক্ষা বড় হতে পারে। বৌদ্ধধর্মে বিভিন্ন দেব দেবীর পুজারি পূজারিণী “দেববাসী ” বা “দেব বাসিনী “নামে অভিহিত হতো! পরে দেব বাসীর অপভ্রংশ “দিয়াসী” এবং দেব বাসিনীর অপভ্রংশ” দিয়াসিনী” শব্দে রূপান্তর ঘটে। বৌদ্ধমতে অনেক দিয়াসিনী সিদ্ধা রমনীরা অলৌকিক শক্তি সম্পন্না ছিলেন।এঁরা মৃত্যুর পর দেবী রূপে পূজিতা হয়ে থাকেন। দিয়াসিনীর শেষাংশ “আসিনী” যোগে সমস্ত সিদ্ধা রমণীর নামকরণ হত! পরবর্তী সময়ে আসিনী শব্দটি সর্বত্র যুক্ত না হয় সংক্ষেপে সিনি শব্দটি প্রচলিত হয়েছে। বিস্তীর্ণ রাঢ় অঞ্চলের মধ্যে বাঁকুড়া পুরুলিয়া পশ্চিম মেদিনীপুর হুগলি ও বর্ধমান জেলার কিছু কিছু অংশে এই দেব-দেবীর পূজা হয়ে থাকে। কোন কোন অঞ্চলে গ্রামের নামের সাথে সিনি শব্দটি জুড়ে গ্রামদেবতা রূপে পূজিত হন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহল সংলগ্ন গ্রামে গ্রাম দেবতারূপে সিনি ঠাকুরের বহুল প্রচলন আছে। মূলত প্রান্তিক সাঁওতাল মাহাতো শবর ভূমিজ লায়েক সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পূজা অধিক প্রচলিত। এই দেবতার কোন মনুষ্য অবয়ব নেই ।পাথর রূপে , পোড়ামাটির ছলনে এই দেবতার পূজা হয়ে থাকে! মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের লায়েক অধ্যুষিত অঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তি বা মাঘ মাসের প্রথমে এই পুজো হয়ে থাকে। লোকবিশ্বাস যে সিনি ঠাকুর গ্রামকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করেন এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে ক্ষেতের ফসল রক্ষা করেন। সেই কারণে ফসল তোলার পর পৌষের শেষে বা মাঘের প্রথমেই পুজো হয়ে থাকে। সাধারণত গ্রামের কোন বৃহদাকার বৃক্ষের নিচে এই দেবতা অবস্থান করেন যাকে” ঠাকুর থান “বলে। গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখ আবেগ ভালোবাসা ধীরে ধীরে এই দেবতার সাথে জড়িয়ে যায়। এই অঞ্চলে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে সিনি ঠাকুরের পুজো হয়। গোয়ালতোড় এর মা সনকাই সিনি বা সনকা রামেশ্বরের মা দুয়ারসিনি, চৈতার চৈতাসিনি এবং বাগলা গ্রামের বাগলাসিনি জঙ্গলমহল জুড়ে বিখ্যাত। শাল জঙ্গল ঘেরা এই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গ্রামে সিনি ঠাকুর পূজিত হন। গ্রামের নামের সাথে নাম যুক্ত হয়ে সেই ঠাকুরের পরিচিতি। যেমন গোবরু গ্রামের “গোবরুসিনি”! লায়েক সম্প্রদায়ের কোনো মানুষই বংশপরম্পরায় এই সিনি ঠাকুরের পুজো করেন। এই অঞ্চলটি লায়েক সম্প্রদায় অধ্যুষিত। অব্রাহ্মণ দেহুরি সম্পূর্ণ লৌকিক রীতিতে এই পুজো করে থাকেন। পূজারী তার মনের কামনা ফুল ও বেলপাতা সহযোগে দেবতার মাথায় স্থাপন করেন। মহিলারাফল মিষ্টান্ন ভোগ হিসাবে নিবেদন করে থাকেন। কোথাও কোথাও জাথাল বা খিচুড়ি ভোগ নিবেদন করা হয়। এই পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলিপ্রথা ।পাঁঠা মুরগিপ্রভৃতি দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়। কোন কোন গ্রামে শসা কুমড়ো আখ ও বলি হয়। রাঢ় অঞ্চলেএই পুজো মূলত পৌষ সংক্রান্তির দিন হলেও পশ্চিম মেদিনীপুরে তা মানা হয়না কারণ কর্ণগড়ে মা মহামায়া রপুজো ও মেলা বসে এই মকর সংক্রান্তিতে। তাই প্রতিবছর সিনি ঠাকুরের পুজো হয় পয়লা বা দোসরা মাঘ। পয়লা মাঘ বাগলা গ্রামে “বাগলা সিনি “পূজা হয়! চৈতা গ্রামে চৈতাসিনি পূজা হয় দোসরা মাঘ। এই দুই মেলাতেই কবিগানের আসর বসে দেবতাকে প্রসন্ন করার জন্য। এই কবিগানের আসর ই হলো এই দুই গ্রামের পূজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতিকে ধরে রাখার এ এক সুন্দর প্রচেষ্টার উদাহরণ। শালবনি সংলগ্ন এই দুই গ্রামে প্রচুর জনসমাগম ঘটে এই মেলায়। স্থানীয় ভাষায় এই উৎসব “যাত” বা “জাত” “বলা হয় যা দেবতার উৎসবে যাত্রার অপভ্রংশ!
সমাজে শিক্ষা সংস্কৃতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এই লোক দেবতাদের গুরুত্ব কমতে শুরু করেছে। তবুও শাল মহুয়ার ছায়ায় ঘেরা এই জঙ্গলমহলে রয়ে গেছে এই দেবতাদের পদধ্বনি। প্রান্তিক সহজ-সরল মানব জীবনের সুখ-দুঃখের দৈনন্দিনতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এঁরা। কোন কোন জায়গায় এই দেব-দেবীদের উত্তরণ ঘটেছে। প্রচলিত আছে যেখানে সিনি ঠাকুর আছেন সেখানে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ ।সব ক্ষেত্রে তা মানা হয়না। প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তার কারণে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় সনকাইসিনি ঠাকুরকে দুর্গাপূজার সময় দুর্গা রূপে পূজা করা হয়। বাঁকুড়া জেলার ছন্দরে জম্ভলাসিনি কেও দুর্গা রূপে পূজা করা হয়।
জনপ্রিয়তার কারণে বিভিন্ন সিনি ঠাকুরকে নিয়ে বন্দনাগীতি ও প্রচলিত যেমন—-
গোহালি তোডে বন্দিব ঠাকুর সনকাইসিনি
ধলভূমে বন্দিব মৌলার রঙ্কিনী
পাথরাসনি বন্দিব করি জোড পানি
তারপরে বন্দিব হে ঠাকুর জান্দাসিনি।
এই লালমাটিয়া অঞ্চলের বিশাল জনজীবনের সাথে মিশে আছে এই লোকদেবদেবীর পরান কথা। এই রুক্ষ জঙ্গলঘেরা অহল্যা ভূমির প্রান্তরে সরল প্রান্তিক মানুষদের বিশ্বাসেই পাথর জাগ্রত হয় প্রচলিত কাহিনী ও সিঁদুরের মহিমায়। এই লোক দেবতাদের চরণে নিবেদিত হয় তাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের নৈবেদ্য। প্রকৃতিকে ঈশ্বরজ্ঞানে অর্চনা করার আবহমান ঐতিহ্যকে বজায় রেখে চলেছেন এঁরা। লোক দেবতারা মানুষের দিনযাপনের মাঝে মিশে গেছেন। বর্তমানের আবিল নাগরিক সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেই এই জঙ্গলমহল সংলগ্ন গ্রামগুলি আজও সিনি ঠাকুরের পূজার মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষদের সনাতন সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। প্রকৃতি আর মানুষের সেই আবহমান সম্পর্কের মিলন সেতু এই সিনি ঠাকুর।