কাকাবাবু বুঝতে পারলেন
কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, কে যেন তাঁকে ডাকছে। কেউ তাঁর গায়ে হাত দিয়ে ঠেলছে তবু তাঁর চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। আরও ঘুম পাচ্ছে। ঘুম কী আরামের!
তারপর তিনি সন্তুর গলার আওয়াজ চিনতে পারলেন। একবার চোখ মেললেন অতিকষ্টে। হ্যাঁ, সন্তুই তো দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বিছানার কাছে। কাকাবাবু ভাবলেন, এটা তাঁদের কলকাতার বাড়ি, তাঁর নিজের বিছানা। এখন। অনেক রাত, শুধু-শুধু সন্তু এই সময় তাঁর ঘুম ভাঙাল কেন? তবে বোধহয় সন্তু তাঁর জন্য কফি এনেছে।
তিনি ঘুম-চোখেই একটা হাত বাড়িয়ে বললেন, দে, কফিটা দে!
সন্তু মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে ব্যাকুলভাবে বলল, কাকাবাবু, তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ?
কাকাবাবু কপাল কুঁচকে বললেন, নাঃ, আমার কেন শরীর খারাপ হবে? তুই তো আমায় ডেকে তুললি। তোর কী হয়েছে?
কাকাবাবু, দেবলীনা কোথায়?
দেবলীনা? কে দেবলীনা? ও হ্যাঁ? শৈবাল দত্তের মেয়ে। সে এখানে। কী করে আসবে? কেন, সে নিজের বাড়িতে নেই?
কাকাবাবু, ভাল করে তাকাও। দেবলীনা তোমার সঙ্গে এখানে এসেছিল! সে কোথায়? তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
এবারে কাকাবাবু ভাল করে চোখ মেলে ঘরের ছাদ ও দেওয়াল দেখে বেশ অবাক হয়ে বললেন, আরে, কোথায় শুয়ে আছি আমি? এটা কোন্ বাড়ি? ৩৪৪
সন্তু বলল, এটা কেওনঝড়ের সেই রাজবাড়ি। তোমার কী হয়েছে, তোমাকে কেউ ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে?
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ঘুমের ওষুধ? না তো? এটা কেনঝড়ের সেই রাজবাড়ি? তা হলে তুই কী করে এখানে এলি?
আমি আর জোজো সকালের বাসে এখানে চলে এলুম। বাসটা লেট করেছিল, পৌঁছল বিকেলবেলায়। এখানে আসতে আসতে সন্ধে। তখন থেকে দেখছি তুমি ঘুমোচ্ছ। কিছুতেই জাগানো যাচ্ছে না। দেবলীনাকেও দেখতে পাচ্ছি না!
রাত্তির হয়ে গেছে…আজ কতারিখ?
আজ ন তারিখ। তোমরা এখানে এসেছ তিনদিন আগে।
তিনদিন? না দু দিন? তিনদিন! তোমাকে আমি একটা খুব জরুরি খবর দিতে এসেছি!
তিনদিন, তুই কী বলছিস রে, সন্তু! কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তা হলে মাঝখানে একটা দিন কোথায় গেল?
নীচে একটা লোক বলল, তুমি সারাদিন ধরে ঘুমোচ্ছ! তোমাকে খাবার দেবার জন্য ডাকতে এসেছিল, তুমি তাও জাগোনি!
সারাদিন ঘুমিয়েছি? যাঃ! আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না?
আমরা প্রথমে ডাকাডাকি করে কারও সাড়াশব্দ পাইনি। তারপর বাড়ির পেছন দিকের একটা ভাঙা জায়গা দিয়ে ঢুকে পড়লুম। একতলায় একটি ঘরে দেখি একজন লোক ঘুমোচ্ছ। তার নাম শশধর দাস। সে কোনও কথারই জবাব দিতে পারে না!
শশধর দাস। মানে, শশাবাবু! হ্যাঁ, হ্যাঁ, শশাবাবু। মাথাজোড়া টাক তো! সন্তু, ওকে বল না আমাকে এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে। সন্তু চেঁচিয়ে ডাকল, জোজো, এই জোজো, শোন!
জোজো একটা টর্চ নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সন্তুর ডাক শুনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, একেবারে সিনেমার ভুতুড়ে বাড়ি রে, সন্তু। কতগুলো ঘর! সব ফাঁকা! কাকাবাবু জেগেছেন? সন্তু বলল, হ্যাঁ, তুই একটা কাজ কর তো!
জোজো বলল, কাকাবাবু, আমরা আবার সেই মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলের টিম! এবারে ওড়িশার জঙ্গলে অভিযান! এবারে হাতির পিঠে চড়ব।…কই রে সন্তু, কাকাবাবু যে এখনও ঘুমিয়ে আছেন দেখছি!
সত্যিই, কাকাবাবুর মাথাটা আবার ঘুমে ঢুলে পড়ছে। চক্ষু বোজা!
সন্তু বলল, এইমাত্র যে জেগে কথা বললেন!
জোজো বলল, সেটসি মাছি কামড়েছে। আমি আফ্রিকায় দেখেছি, সেটসি মাছির কামড় খেয়ে অনেকের এইরকম ঘুম-রোগ হয়। ভেরি ডেঞ্জারাস!
সন্তু বলল, যাঃ, আফ্রিকার সেটসি মাছি এখানে আসবে কী করে?
এখানকার জঙ্গলে থাকতে পারে। কিংবা কেউ আফ্রিকা থেকে নিয়ে এসে কাকাবাবুর গায়ে ছেড়ে দিয়েছে। একটা ঘরে কতবড় একটা মাকড়সা দেখলুম জানিস? এই আমার হাতের সমান!
তুই এক কাজ কর তো, জোজো! নীচে যে লোকটা আছে, তাকে গিয়ে বল, খুব কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে। দুধ-চিনি বাদ!
আমি একলা একলা যাব? সিঁড়িটা বড্ড অন্ধকার!
এই জোজো, তোর এরকম করলে চলবে না বলে দিচ্ছি। আমি তোর সঙ্গে গেলে কাকাবাবুর কাছে কে থাকবে? টর্চটা নিয়ে যা!
জোজো চলে যাবার পর সন্তু তখন আর কাকাবাবুকে জাগাবার চেষ্টা করল। না। তার সারা মুখে দুশ্চিন্তা। দেবলীনা কোথায় গেল? নীচের লোকটা বলেছে যে, সেও সারাদিন দেবলীনাকে দ্যাখেনি। তবে কে একজন মনোজবাবু নাকি বলেছে যে, দেবলীনা নিজে নিজে কলকাতায় ফিরে গেছে। তা কখনও হয়! দেবলীনা কাকাবাবুকে এই রকম অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যাবে?
সন্তু বাইরে বারান্দায় এসে দেখল, একটা চেয়ারের ওপর দেবলীনার। একখানা বই ভোলা অবস্থায় ওলটানো। ঠিক যেন সে বইটা পড়তে-পড়তে উঠে গেছে। সেই চেয়ারের কাছে পড়ে আছে দেবলীনার চটি। ঘরের মধ্যে সে দেবলীনার স্যুটকেস, জামাকাপড়ও দেখতে পেয়েছে। দেবলীনা একটু পাগলি-পাগলি আছে ঠিকই, একদিন সন্তুদের বাড়ি থেকে রাগ করে চটি ফেলে রেখেই খালি পায়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখান থেকেও সে ওইভাবে চলে যেতে পারে?
জোজো কফি নিয়ে আসবার পর সন্তু কাকাবাবুর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল কয়েকবার।
কাকাবাবু একটুখানি চোখ মেলে বললেন, অ্যাঁ? কী হয়েছে?
কাকাবাবু, তোমার কফি!
কফি? ও, আচ্ছা?
এবারে ভাল করে উঠে বসে কাকাবাবু খুব গরম ধোঁয়া-ওঠা কফি তিন-চার চুমুকে খেয়ে ফেললেন। তারপর আপন মনে বললেন, তিনদিন? মাঝখানের একটা দিন কোথায় গেল?
জোজো বলল, আমিই শশধরবাবুকে রাত্তিরের খাবার অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। বলল, ভাত আর ডিমের ঝোল ছাড়া কিছু হবে না। লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল, আমরা কবে যাব! আরে, এই তো সবে এলুম!
সন্তু বলল, ওই লোকটার কথা পরে হবে। তার আগে দেবলীনাকে খুঁজে বার করা দরকার। কাকাবাবুর যে কিছুতেই ঘুম ছাড়ছে না? ৩৪৬
কাকাবাবু নিজের চুল মুঠি করে চেপে ধরে বললেন, আমার যে কিছুই মনে পড়ছে না রে সন্তু! কী হল বল তো!
তারপর নিজের কালো ড্রেসিং গাউনটা একটু তুলে বললেন, এটাতে জল-কাদা মাখা! এই নোংরা পোশাকটা না খুলেই আমি শুয়ে পড়েছিলুম? কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? আমার এখনও ঘুম পাচ্ছে!
সন্তু বলল, আর-এক কাপ কফি আনব?
কাকাবাবু বললেন, না, একটু হাঁটাহাঁটি করে দেখি তো! আমার ক্রাচ দুটো কোথায় গেল?
সন্তু বলল, এই তো, খাটের পাশেই রয়েছে।
কাকাবাবু সেদিকে তাকিয়ে অবাকভাবে বললেন, ক্রাচ দুটো রয়েছে? সব কিছু ঠিকঠাক আছে? তবু আমি ঘুমোচ্ছি কেন?
বিছানা থেকে নেমে তিনি ক্রাচ বগলে নিয়ে বারান্দায় এলেন। বেশ জোরে-জোরে চলে গেলেন খানিকটা। আবার ফিরে এসে বললেন, নাঃ, মনে পড়ছে না! কাল রাত্তিরে আমি আর দেবলীনা বসে ছিলাম এখানে, একটা পেট্রোম্যাক্স জ্বলছিল, আকাশে মেঘ ছিল না, বই পড়ছিলাম দুজনে…তারপর কী হল?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, দেবলীনা কাল রাত্তির থেকেই নেই?
কাকাবাবু বললেন, যাঃ, তা কি হয়? দেবলীনার কোনও বিপদ হলে আমি কি বিছানায় নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমোতে পারি? আমি যখন খাটে গিয়ে শুয়েছি, তখন দেবলীনাও নিশ্চয়ই আগে শুতে গিয়েছিল। ঠিক কি না বল?
সন্তু চুপ করে রইল।
জোজো বলল, দেবলীনা কোথাও লুকিয়ে থেকে আমাদের সঙ্গে মজা করছে না তো? এতগুলো ঘর, কেউ লুকিয়ে থাকলে ধরবার উপায় নেই!
সন্তু বলল, তা হয় নাকি? কাকাবাবুকে অসুস্থ দেখেও দেবলীনা এতক্ষণ ইচ্ছে করে বাইরে থাকতে পারে?
কাকাবাবু বললেন, আমি অসুস্থ? কিসের অসুখ? তবে কিছু মনে করতে পারছি না, এটাও ঠিক?
এই সময় বাইরে একটা গাড়ির আওয়াজ হল। এই নিস্তব্ধ জায়গায় গাড়ির আওয়াজ এমনই অস্বাভাবিক যে, চুপ করে গেল সবাই। গাড়িটা এদিকেই। আসছে। গেটের বাইরে এসে থামল। তারপর একজন কেউ ডাকল, রায়চৌধুরীবাবু! রায়চৌধুরীবাবু!
সন্তু কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকাতেই কাকাবাবু বললেন, এ তো মনে হচ্ছে দারুকেশ্বর ওঝা! সন্তু, যা তো, দ্যাখ, ওই বড় গেটটার নীচে একটা ছোট গেট আছে, সেটা খুলে দিয়ে আয়। ওই দারুকেশ্বর কিছু জানতে পারে।
তারপর তিনি চেঁচিয়ে বললেন, যাচ্ছে, দরজা খুলে দিচ্ছে!
সন্তু জোজোর কাছ থেকে টর্চ নিয়ে ছুটে গেল। কাকাবাবু রেলিংয়ের কাছে এসে ওদের দেখবার জন্য দাঁড়িয়ে আবার ঘুমে ঢলে পড়লেন।
দারুকের ওপরে উঠে এসে বলল, রায়চৌধুরীবাবু, কী হয়েছে? কী সব শুনছি।
কাকাবাবু চোখ মেলে বললেন, কে? কে আপনি?
দারুকেশ্বর খানিটা থতমত খেয়ে গিয়ে বললেন, সে কী, আমায় চিনতে পারছেন না? আমি দারুকেশ্বর!
কাকাবাবু ক্রাচ ঠকঠকিয়ে এগিয়ে এসে দারুকেশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে অতিকষ্টে চোখ খুলে বললেন, হ্যাঁ, দারুকেশ্বর, দেবলীনা কোথায়?
দারুকেশ্বর বলল, দেবলীনা-মামণি কোথায় তা তো আমি জানি না! আপনি একটা গাড়ি ভাড়া করে আনতে বলেছিলেন, সকালে গাড়ি নিয়ে এসে শুনলুম আপনি ঘুমোচ্ছন। এক ঘন্টা বাদে ঘুরে এসে দেখি তখনও আপনি ঘুমোচ্ছেন। আমার জঙ্গলে একটু কাজ ছিল, সেখানে চলে গেলুম গাড়িটা নিয়ে। দুপুর দেড়টার সময় আবার এসে দেখি, তখনও আপনার ঘুম ভাঙেনি। আমি আর ডিসটার্ব করলুম না। দেবলীনাকেও দেখতে পাইনি।
কাকাবাবু বললেন, আমি কাল রাত্তির থেকে আজ এই এত রাত্তির পর্যন্ত ঘুমিয়েছি? একখনও সম্ভব? আমার জীবনে কক্ষনো এমন হয়নি! ওই শশাবাবুকে ডাকুন তো?
দারুকেশ্বর বলল, ও ব্যাটাকে তো এখান থেকে ডাকলে আসবে না। ধরে আনতে হবে। রোজ এই সময় গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে। দুর্যোধন কোথায়?
দারুকের বারান্দা দিয়ে গলা বাড়িয়ে হাঁক পাড়ল, দুর্যোধন! দুর্যোধন? কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। সন্তু বলল, চল তো জোজো, তুই আর আমি ওই শশাবাবুকে ধরে নিয়ে আসি?
ওরা ছুটে চলে যাবার পর দারুকেশ্বর বলল, কাল রাত্তিরে আবার কিছু ভয়-টয় পাননি তো? আমি বলেছিলাম সার্কিট হাউসে থাকতে। বেশ চারদিকে বেড়াতে যেতে পারতেন। এ বাড়িটা ভাল না!
কাকাবাবু বললেন, কাল রাত্তিরে? কী হয়েছিল কাল রাত্তিরে? আঃ! কিছু মনে পড়ছে না! মাথাটায় কে যেন তালা লাগিয়ে দিয়েছে, কিছুতেই বুদ্ধি খুলছে না।
কাকাবাবুর যেন দারুণ কষ্ট হচ্ছে, কুঁকড়ে গেছে মুখটা। তিনি এক হাতে নিজের মাথার চুল ধরে এমন জোরে টানলেন, যেন সব চুল উপড়ে আসবে!
দারুকের চমকে গিয়ে বলল, মনে পড়ছে না? আপনাকে কেউ শল্যকরণী খাইয়ে দেয়নি তো?
কাকাবাবু বললেন, শল্যকরণী? সে আবার কী?
আছে, আছে, সে একটা বড় সাঙ্ঘাতিক গাছের বীজ। যদি কেউ খাইয়ে দেয়, তা হলে মনে হবে আপনার গায়ে শত-শত বাণ বিধছে! তারপর আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন! সে বড় ভয়ঙ্কর ঘুম! থাক ভয় নেই। আমার কাছে। বিশল্যকরণী ওষুধ আছে, গন্ধমাদন পাহাড় থেকে জোগাড় করেছি। সে ওষুধের খোঁজ এখন কেউ রাখে না, শুধু আমি জানি। আজ রাতেই আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দেব?
দেবলীনা কোথায় গেল?
আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে কী জানেন? এই রাজবাড়ির একজন গুরুদেব ছিলেন, আপনাকে বলেছিলাম। তাঁর নাম খগেশ্বর আচার্য। লোকে বলে তিনি এখনও দেখা দেন মাঝে-মাঝে, তিনি দিব্য-দেহ ধারণ করতে পারেন, তাঁর বয়েস একশো বছরের বেশি। আমি হিসেব করে দেখলুম, অত বয়েস হবে না, আমি তো এক সময় দেখেছি তাঁকে, এখন বেঁচে থাকলে তাঁর বয়েস পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর হত। লোকে যখন মাঝে-মাঝে তাঁকে দেখতে পায়, তা হলে তিনি বোধহয় বেঁচেই আছেন। আপনারাও তো পরশু রাতে তাঁকে একবার দেখেছিলেন। সেই গুরুদেবই দেবলীনাকে ধরে নিয়ে গেছেন হয়তো! তিনি চম্পাকে খুব ভালবাসতেন।
পরশু রাতে দেখেছিলুম। কাল রাতে কী হল? সেই বুড়োটা চম্পাকে ধরে নিয়ে কোথায় যাবে?
তা জানি না। গুরুদেব যদি বেঁচেই থাকেন, তা হলে কোনও একটা জায়গায় তাঁকে থাকতে হবে নিশ্চয়ই। খাওয়াদাওয়া করতে হবে। শুধু হাওয়া খেয়ে তো মানুষ দেহ ধরে বাঁচতে পারে না? কী বলেন! আমি কাল জঙ্গলে একটা আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে শুনলাম, গোনাসিকা পাহাড়ে নাকি এক সাধুর আশ্ৰম আছে। সেই সাধুকে সহজে কেউ দেখতে পায় না, তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা আছে, তিনি জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যান, তিনি কখনও কখনও স্বর্গ থেকে ঘুরে আসেন, এইসব আর কী! আদিবাসীরা রোজ তাঁর আশ্রমের সামনে ফলমূল রেখে আসে। এখন জঙ্গলের সেই সাধু আর রাজাদের গুরুদেব একই নন তো? চম্পার মৃত্যুর পর তিনি প্রায় পাগলের মতন হয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলেন কেউ জানে না।
কাকাবাবু আপন মনে বললেন, চম্পা আর দেবলীনা। দেবলীনা আর চম্পা! মাঝখানে পনেরো বছর! দক্ষিণের ঘর থেকে সেই সাধু বেরলো কী করে!
জোজো আর সন্তু দু হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল শশাবাবুকে। সে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমি তো রান্না করে দিচ্ছি বাবু! দেব না সেকথা তো বলিনি?
দারুকেশ্বর তাকে ধমক দিয়ে বলল, রান্নার কথা কে জিজ্ঞেস করছে! দেবলীনা-দিদিমণি কোথায় গেল?
শশাবাবু মাথা টিপে ধরে বলল, আজ্ঞে, উনি কোথায় গেছেন, তা কি আমার জানার কথা? আমায় তো কিছু বলে যাননি। তবে সকালবেলা ম্যানেজারবাবু এসেছিলেন, তিনি বললেন, দিদিমণিটি বড় রাস্তায় গিয়ে বাস ধরে টাউনে চলে গেছেন। ওপরে যে-বাবু ঘুমোচ্ছেন, তাঁকে খবর দিতে বলেছেন।
ম্যানেজারবাবু মানে মনোজবাবু? তিনি এসেছিলেন, আবার কোথায় গেলেন?
তিনি বললেন, তাঁর বাড়িতে কার অসুখ, তাই তিনি আবার চলে যাচ্ছেন। থাকতে পারবেন না।
মেয়েটা এমনি-এমনি শহরে চলে গেল, একলা একলা?
মনোজবাবু তো সেই কথাই বললেন। তার বেশি তো আমি কিছু জানি না, বাবু!
দুর্যোধন কোথায়?
সে ব্যাটার কখনও পাত্তা পাওয়া যায়? সে সাইকেল নিয়ে বাজারে চলে গিয়ে গাঁজা খায়!
দুর্যোধন বলে, তুমি গাঁজা খাও। আর তুমি বলছ সে গাঁজা খায়। বাঃ, বেশ বেশ।
কাকাবাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলেন, আবার ঘুমে ঢুলে আসছিল তাঁর চোখ। এবারে তিনি সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিলেন। তারপর পাঞ্জাবির এ-পকেট ও-পকেট খুঁজে রিভলভারটা পেয়ে গিয়ে বার করে আনলেন।
শশাবাবুই প্রথম সেটা দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠে বলল, ও কী, বাবু, আমায় মারবেন না। আমায় মারবেন না। আমি কিছু মিছে কথা বলিনি। মনোজবাবু যা বলেছেন..
কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, চুপ, সবাই চুপ! একটু দূরে সরে যাও!
তিনি রিভলভারের সেফটি ক্যাচ খুলে, চেম্বারটা একবার দেখে নিয়ে, নলটা ধরলেন নিজের কানের কাছে। তারপর ট্রিগারে আঙুল দিলেন।
সন্তু ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, কাকাবাবু, ও কী করছ? ও কী?
দারুকেশ্বর ফিসফিস করে বলল, এই রে! শল্যকরণী! শল্যকরণী! বোধবুদ্ধি সব লোপ পায়।
কাকাবাবু অন্য একটা হাতের আঙুল ঠোঁটের কাছে নিয়ে বললেন, চুপ। কোনও কথা নয়। সবাই একটু দূরে সরে যাও!
তারপর তিনি ট্রিগার টিপলেন। প্রচণ্ড জোরে শব্দ হল, গুলিটা লাগল বারান্দার সিলিংয়ে, অনেকটা সুরকি ইট-বালির চাপড়া খসে পড়ল।
কাকাবাবু এবারে রিভলভারটা পকেটে ভরে দ হাতে কান চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন জোরে জোরে।
সন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, এবারে কাকাবাবুর ঘুম কেটে যাবে।
জোজো বলল, বাপ রে, আমারই কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম।
এতক্ষণ পরে কাকাবাবুর মুখে একটু হাসি ফুটে উঠেছে। তিনি আস্তে-আস্তে বললেন, এতক্ষণ এই বুদ্ধিটা কিছুতেই মাথায় আসছিল না। শব্দই একমাত্র ওষুধ! খুব জোর শব্দ শুনলে ঘোর কেটে যায়।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এবারে সব মনে পড়েছে?
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়া, দাঁড়া, একটু একটু করে মনে করছি। দুপুরবেলা পুকুরধারে… শিবমন্দির… সেখানে সুড়ঙ্গ… তার মধ্যে কিছু নেই। এক জায়গায় বন্ধ! দারুকেশ্বর, ওই শিবমন্দিরের তলায় যে সুড়ঙ্গ আছে, তা আপনি জানতেন?
না, স্যার। শুনিনি কখনও।
শশাবাবু, তুমি জানতে?
আজ্ঞে না। কোনও সুড়ঙ্গ-টুড়ঙ্গের কথা তো আমি জানি না!
ঠিক আছে, শশাবাবু, তুমি যাও!
শশাবাবু চলে যাবার পর কাকাবাবু বললেন, সুড়ঙ্গ একটা আছে ঠিকই। আমি নিজে তার মধ্যে ঢুকে দেখেছি। সেটা বেশ লম্বা, তবে মাঝখানটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত অনেক পুরনো আমলের সুড়ঙ্গ, এখন সবাই ভুলে গেছে সেটার কথা। সেই সুড়ঙ্গের সঙ্গে ওই দক্ষিণের কোণের ঘরে কোথাও যোগ আছে নিশ্চয়ই, সেটা আমি খুঁজে পাইনি! তারপর কী হল? দেবলীনা একা জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিল, আমি তাকে বারণ করিনি। সে কিন্তু ঠিক ফিরে এসেছিল, কোনও বিপদ হয়নি তার! শুধু সে জঙ্গলে কোনও একটা লোককে দেখতে পেয়েছিল, নোকটা দেবলীনাকে দেখেই লুকিয়ে পড়ে। সে কিন্তু এই বুড়ো সাধু নয়। তারপর?
সবাই ব্যর্থ হয়ে শুনছে। কাকাবাবু আবার দু কানে হাত দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন।
এরপর সন্ধেবেলা আর কিছু হয়নি। আমরা খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করেছি। তারপর…তারপর… ওঃ হহ, আমিই একটা দারুণ ভুল করেছিলুম। আমি দেবলীনার অবচেতন মনের কথা বার করবার জন্যে ওকে হিপনোটাইজ করতে গেলুম। তাতে ফল হল উলটো, দেবলীনা হঠাৎ চম্পা হয়ে গেল, আমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল দৌড়ে। কোথায় যেন গেল, কোথায় যেন..ওঃ হে, জঙ্গলের মধ্যে একটা বালির ঢিপির ওপরে। সেখানে সে বারবার যায়। কেন? নিশ্চয়ই সেখানে কিছু আছে। সন্তু, সন্তু, চল্ তো, এক্ষুনি ওই জায়গাটা খুঁজে দেখতে হবে। বড্ড দেরি হয়ে গেছে, কাল রাত আর আজ রাত…
কাকাবাবু ক্রাচ বগলে নিয়ে দ্রুত চলতে শুরু করলেন। সন্তু, জোজো, দারুকেশ্বর, সবাই তাঁর সঙ্গ নিল। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একটা জিপগাড়ি। তার ড্রাইভার ঘুমোচ্ছে। দারুকেশ্বর জিজ্ঞেস করল, রায়চৌধুরীবাবু, গাড়িটায় যাবেন?
কাকাবাবু বললেন, না, গাড়িটা থাক। ওই জঙ্গলে গাড়ি ঢুকবে না। ইস, এখনও কেন মনে করতে পারছি না যে, ওই পর্যন্ত যাবার পর আমার কী হল? কী করে আমি ফিরে এলাম নিজের বিছানায়?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, দেবলীনা চম্পা হয়ে গেল, তার মানে কী?
কাকাবাবু বললেন, সে-সব তুই পরে শুনবি। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, এ-বাড়িতে চম্পা নামে এক রাজকন্যা ছিল, সে খুব রহস্যময়ভাবে মারা যায়। পনেরো বছর আগে। আমাদের দেবলীনাকে ঠিক সেই চম্পার মতন দেখতে।
জোজো বলল, গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এ আছে, আমেরিকার মেমফিস শহরের একটা মেয়ে আর পাপুয়া নিউগিনির একটা মেয়েকে হুবহু একরকম দেখতে। গলার আওয়াজ পর্যন্ত একরকম। অথচ দুজনের বাড়ির মধ্যে হাজার হাজার মাইল তফাত! আমি ওদের দুজনের ছবি দেখেছি, ওদের দুজনকে চম্পার মতনই দেখতে। গিনেস বুককে খবরটা জানোনো উচিত, তিনটি মেয়েই একরকম চেহারার!
সন্তু বলল, তিনজন না, চারজন।
জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে কাকাবাবু বললেন, এইবার আর-একটা কথা মনে পড়ল। এখানে এসে আমি দেবলীনার গান শুনতে পেয়েছিলাম। অথচ এমনিতে দেবলীনা গান করে না। গানের শব্দটা কোন দিক থেকে আসছিল। ওই ডান দিক থেকে! দারুকেশ্বরবাবু, আপনি এই জঙ্গলে কখনও ওষুধ খুঁজতে আসেননি?
দারুকেশ্বর বলল, না! এখানে সেরকম কিছু নেই, বড় বড় গাছ শুধু!
সন্তু আর জোজো আগে-আগে দৌড়ে যাচ্ছে। সকলের হাতে টর্চ। ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছে সামনে সেই বালির টিলাটা দেখে কাকাবাবু থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর চিবুক কঠিন হয়ে গেল, চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল।
তিনি দারুকেশ্বরের দিকে ফিরে বললেন, আরও খানিকটা মনে পড়ে গেছে। এইখানে, ঠিক এইখানে সেই বুড়ো সাধুটা হঠাৎ এসে উদয় হয়েছিল। চমকে দিয়েছিল আমাকে, আমি সাবধান হবার সময় পাইনি। বুড়োটা আমাকে হিপনোটাইজ করল, আমি কিছুতে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। তারপরেই নিশ্চয় অজ্ঞান হয়ে গেছি।
দারুকেশ্বর বলল, সাধু-সন্ন্যাসীদের এরকম অলৌকিক ক্ষমতা থাকে। রাজাদের সেই গুরুদেব যদি হন…, আমি শুনেছি, তিনি খুব বড় তান্ত্রিক ছিলেন।
অলৌকিক ক্ষমতা না ছাই! আমিও ইচ্ছে করলে লোককে অজ্ঞান করে দিতে পারি। কিন্তু বুড়োটা আমাকে তৈরি হবার সময় দেয়নি। যদি
আর-একবার তার দেখা পাই…
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, দেবলীনা কোথায় ছিল?
কাকাবাবু বললেন, এই ছোট টিলাটার মাথার কাছে তাকে শেষ দেখেছি। এই বালির টিলাটার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু আছে। লোকজন জোগাড় করে এটা খুঁড়ে দেখতে হবে।
সন্তু দৌড়ে টিলাটার মাথায় উঠে গেল, তারপর নেমে গেল উলটো দিকে। জোজোও গেল তার পেছনে। তারপর দুজনে টিলাটার এদিক-ওদিক ঘুরে দেখতে লাগল। দুজনের হাতে টর্চ জ্বলছে।
এক সময় সন্তু চেঁচিয়ে বলে উঠল, কাকাবাবু, এখানে একটা লাল রিবন! ঝোপে আটকে আছে। দেবলীনা মাথায় রিবন বাঁধে না?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, কাল ওর মাথায় রিবন ছিল। ওই জায়গাটা ভাল করে খুঁজে দ্যাখ তো?
সন্তু আবার বলল, ঝোপের মধ্যে একটা আলগা বড় পাথর, মনে হচ্ছে একটা গুহার মুখে চাপা দেওয়া।
জোজো বলল, এই, সাবধান। এইসব গুহার মধ্যে বড় বড় মাকড়সা থাকে!
কাকাবাবু ক্রাচ দুটো দারুকেশ্বরকে দিয়ে বললেন, আপনি এগুলো ধরুন তো। এখানে আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হবে। বালিতে ক্রাচ বসে যাবে।
সন্তু আর জোজো ততক্ষণে ঝোপের আড়ালের পাথরটা সরিয়ে ফেলেছে। কাকাবাবু সেখানটায় এসে ভেতরটায় একটু উঁকি মেরে বললেন, গুহা নয়, সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গের আর-একটা মুখ। এটাকে লুকোবার জন্যই এককালে এখানে বালি-পাথর এনে টিলাটা তৈরি করা হয়েছিল। এখানে বসে কেউ গান গাইলে ভেতর থেকে শুনতে পাওয়া যাবে, তাই না?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কিন্তু দেবলীনা এখানে এসে শুধু-শুধু গান গাইবে কেন? ওর কি মাথায় বুদ্ধি নেই?
কাকাবাবু বললেন, ঠিক বুদ্ধির ব্যাপার নয় রে। সব রহস্য আমিও জানি, বুঝতে পারিনি এখনও। খুব সম্ভবত ওই বুড়ো সন্ন্যাসীটা কোনও সময় দেবলীনার কাছে এসে ওকে হিপনোটাইজ করে ওর মনের মধ্যে চম্পার ছবিটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যাতে ওর মধ্যে চম্পার চরিত্রের লক্ষণগুলো আস্তে-আস্তে ফুটে ওঠে।
দেবলীনা সে কথা বলেনি তোমাকে?
সজ্ঞান অবস্থায় তো এসব মনে থাকে না। দ্যাখ না, আমিই তো সব ভুলে গিয়েছিলাম। এখনও মনে করতে পারছি না, কী করে এখান থেকে ফিরে গেলাম বিছানায়।
কাকাবাবু, এই সুড়ঙ্গের মধ্যে আমি ঢুকি?
তুই না, আগে আমি। সেই বুড়োটার শক্তি সাঙ্ঘাতিক। শোন্, একটা কথা বলে রাখি। যদি পাকা-চুল আর দাড়িওয়ালা কোনও বুড়োকে দেখতে পাস, সঙ্গে-সঙ্গে চোখ ঢাকা দিয়ে ফেলবি। ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু ওর দিকে তাকাবি না!
জোজো বলল, আমার বাবা ওয়ার্ল্ড হিপনোটিজম কমপিটিশনে পরপর দুবার ফাস্ট হয়েছেন। আমি ওসব বুড়ো-ফুড়ো গ্রাহ্য করি না!
সন্তু বলল, তোর বাবা ফার্স্ট হয়েছেন, তুই তো ফাস্ট হোসনি! তুই আমার পেছনে থাকবি।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই টর্চ ধর। আমাকে হাতে ভর দিয়ে নামতে হবে।
কাকাবাবু সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। আজ আর এর মধ্যে মশাল জ্বলছে। টর্চের আলোয় পা টিপেটিপে এগোতে হচ্ছে। কাকাবাবুর হাতে রিভলভার। আজ তিনি ঠিক করেই ফেলেছেন যে, সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে দেখলেই তার পায়ে গুলি করবেন। লোকটি জীবিত, না প্রেতাত্মা, তা আজ জানতেই হবে!
দারুকেশ্বর হঠাৎ এক সময় বলে উঠল, গন্ধ পাচ্ছি। আমি গন্ধ পাচ্ছি। খুব খারাপ গন্ধ! সেই গন্ধ!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেই গন্ধ মানে? কিসের গন্ধ? দারুকের কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ওনাদের গন্ধ। রাত্তিরে নাম করতে নেই।
কাকাবাবু বললেন, আস্তে, কেউ কথা বলবে না। সামনে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে।
দারুকেশ্বর বলল, রায়চৌধুরীবাবু, ফিরে চলুন। আমার অনুরোধ, আর যাবেন না। এখানে জ্যান্ত মানুষ কেউ নেই, শুধু ওনারা রয়েছেন।
কাকাবাবু বললেন, এটা কী দেখুন তো? চিনতে পারেন? সন্তু, আমার হাতে এবার টর্চটা দে!
সেই ঘরের মতো জায়গাটায় পৌঁছে গেছে ওরা। মেঝেতে ত্রিশূল পোঁতা রয়েছে, শুকনো ফুল-পাতা ছড়ানো, সেইখানে অনেক আতপ চাল, অর্ধেক পোড়া ধূপকাঠি, এক হাঁড়ি দই, অনেকগুলো টাটকা জবাফুল, একটা আস্ত কাতলা মাছ, কয়েকটা মাটির প্রদীপ।
কাকাবাবুর টর্চটা যেখানে থেমে গেল, সেটা একটা কঙ্কাল, তার গায়ে লালপাড় শাড়ি জড়ানো। তার করোটিতে মাখানো রয়েছে চন্দন।
জোজো সন্তুর হাত চেপে ধরে বলল, ভূ-ভূ-ভূ-ভূত!
সন্তু বলল, চুপ!
কাকাবাবু দারুকেশ্বরকে বললেন, আপনি যে গন্ধ পেয়েছিলেন, সেটা ধূপের গন্ধ। একটু আগে এখানে মানুষজন ছিল। এখন যেটা পড়ে আছে, সেটা একটা কঙ্কাল। কঙ্কাল আর ভূত কি এক?
দারুকের দুদিকে মাথা দোলাল।
কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার কঙ্কাল, তা আন্দাজ করতে পারেন? গায়ে যখন শাড়ি জড়ানো, তখন কোনও মেয়ের বলেই মনে হয়?
দারুকেশ্বর বলল, খুব সম্ভবত এই হচ্ছে চম্পা। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে কেউ এই সুড়ঙ্গ-পথে নিয়ে এসেছিল!
কাকাবাবু বললেন, আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। এই সুড়ঙ্গটা সামনের দিকে আরও গেছে। ওদিকটাও দেখতে হবে।
জোজো অনেকটা সামলে নিয়ে পকেট থেকে একটা ক্যামেরা বার করে বলল, কাকাবাবু, এই জায়গাটার একটা ছবি তুলতে পারি? আমার ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ আছে। ছবিটা গিনেস বুক অব রেকর্ডসে পাঠাব। শাড়ি-পরা কঙ্কালের ছবি ওয়ার্ডে আগে কেউ তুলতে পারেনি।
কাকাবাবু আর দারুকের এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। অনেক যত্ন নিয়ে এই সুড়ঙ্গটা কাটা হয়েছিল, তা বোঝা যায়। দুদিকের দেয়াল বেশ মসৃণ। কোথাও মাকড়সার জাল নেই। দেখে বোঝা যায় যে, সম্প্রতি এটা ব্যবহার করা হয়েছে। খানিকটা এগোবার পর কাকাবাবু দেখতে পেলেন, এক জায়গায় অনেকগুলো লম্বা লম্বা রঙিন কাঠের টুকরো পড়ে আছে।
কাকাবাবু বললেন, খুব সম্ভবত এগুলো ছবির ফ্রেম। চোরেরাও এই সুড়ঙ্গটা ব্যবহার করে মনে হচ্ছে। রাজবাড়িতে অনেক ঘরের দেয়ালে আমি চৌকো-চৌকো সাদা দাগ দেখেছি, বোধ হয় সেখানে কিছু মূল্যবান ছবি ছিল। চোরেরা ফ্রেম খুলে ছবি নিয়ে গেছে।
দারুকেশ্বর বলল, চোরেরা ছবিও নেয় বুঝি?
কাকাবাবু হাসলেন। তারপর বললেন, অবশ্য, সেই সব চোরদের ছবির সমঝদার হতে হবে। সাধারণ চোরে নেবে না।
এক জায়গায় সুড়ঙ্গটা দুভাগ হয়ে গেছে। সামনে একটা দরজা। ডান দিক দিয়ে আর-একটা সুড়ঙ্গ ওপরের দিকে উঠে গেছে, ছোট-ছোট সিঁড়ি রয়েছে সেদিকে।
কাকাবাবু বললেন, শিবমন্দিরের দিক দিয়ে ঢুকে আমি একটা দরজা দেখেছিলাম। মনে হচ্ছে এইটাই। দরজাটা এদিক থেকে শেকল ভোলা। এ-দরজা দিয়ে কেউ যায়নি। আমি ডান দিকটা দিয়ে যেতে চাই।
দারুকেশ্বরের কাছ থেকে ক্রাচ দুটো চেয়ে নিয়ে কাকাবাবু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। কুড়ি-পঁচিশটা সিঁড়ির পরেই আর-একটা দরজা। এটাও ভেতর দিক থেকেই শেকল তোলা। কাকাবাবু শেকল খুলে দরজাটায় একটা ধাক্কা দিলেন। তারপর টর্চ ফেলে দেখলেন সেটা একটা বাথরুম।
ভুরু কুঁচকে তিনি বললেন, এ আবার কোথায় এলাম?
বাথরুমের পরে একটা খালি ঘর। তারপর একটা বারান্দা। এবার স্পষ্ট বোঝা গেল। ওঁরা রাজবাড়ির দোতলায় উঠে এসেছেন। যে-ঘরটা থেকে এইমাত্র কাকাবাবুরা বেরিয়ে এলেন, সেটা দক্ষিণের কোণের ঘরের দুটি ঘর আগে।
কাকাবাবু অনুচ্চ গলায় হেসে বললেন, এবার বোঝা গেল! দক্ষিণের কোণের ঘর সম্পর্কে এমন একটা গুজব ছড়ানো আছে যে, আমরা শুধু ওখানেই পথ খুঁজেছি। কিন্তু অন্য কোনও ঘর থেকেও তো দক্ষিণের ওই কোণের ঘরে যাওয়া যায়!
দারুকেশ্বর বলল, চম্পাকেও বোধহয় এইরকম কোনও পথ দিয়েই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রায়চৌধুরীবাবু, এবার আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।