Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 5

রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay

সকাল আটটার সময় কাকাবাবু দেবলীনাকে ডেকে তুললেন। এর মধ্যে কাকাবাবুর স্নান করা, দাড়ি কামানো হয়ে গেছে। আগে নিজে এক কাপ চা-ও খেয়েছেন। আবার এক পট চা দিয়ে গেছে দুর্যোধন।

কাকাবাবু বললেন, ওঠ দেবলীনা, দ্যাখ কী সুন্দর সকাল! উঠোনের দেবদারু গাছে একঝাঁক টিয়াপাখি এসে বসেছে!

দেবলীনা চোখ খুলল, তার এখনও ঘুমের ঘোর লেগে আছে। সে যেন মনে করতে পারছে না কোথায় আছে। তারপরই ধড়ফড় করে উঠে বসল।

কাকাবাবু বললেন, ট্যাঙ্কে জল ভরে দিয়েছে। বাথরুমে কলে জল পাবি। মুখ-টুক ধুয়ে আয়। তুই চা খাস তো?

হ্যাঁ খাব? শশাবাবুকে ব্রেকফাস্ট বানাতে বলেছি, একটু বাদেই এসে যাবে!

দেবলীনা বাথরুমে ঢুকতেই কাকাবাবু ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাড়ির পেছন দিকেও অনেক দেবদারু গাছ। রাজাদের বোধহয় এই গাছের শখ ছিল। এখান থেকেও পুকুরটার একটা অংশ দেখা যায়। প্রায় জুড়ি-পঁচিশটা বক বসে আছে সেখানে।

এক সময় তাঁর চোখে পড়ল মেঝেতে খানিকটা রক্ত শুকিয়ে আছে। লকের সেই প্যাঁচাটার রক্ত। তিনি ভাবলেন, দুর্যোধনকে ডাকিয়ে জায়গাটা গুছিয়ে ফেলতে হবে। শোবার ঘরের মেঝেতে রক্ত পড়ে থাকা খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার।

প্যাঁচাটার জন্য তাঁর আবার দুঃখ হল। তিনি নিজেই যদি একটু ভাল করে দেখে নিতেন, তা হলে প্যাঁচাটা মরত না।

দেবলীনা মুখ ধুয়ে আসার পর কাকাবাবু চা ঘেঁকে দিলেন তাকে। চামচে ভর্তি চিনি নিয়ে গুলতে লাগলেন টুং-টুং শব্দ করে।

দেবলীনা একটুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতন তাকিয়ে রইল কাকাবাবুর মুখের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, কাল রাত্তিরে কী হল? আমরা কী দেখলুম?

কাকাবাবু বেশ হালকা মেজাজে বললেন, কেন রে, কী দেখলি, তোর মনে নেই? ভুলে গেলি এর মধ্যে? কাল তো তুই জেগেই ছিলি!

ভুলিনি, মনে আছে। কিন্তু…কিন্তু ওই লোকটা কোথা থেকে এল?

দক্ষিণের কোণের ঘরটা থেকেই তো বেরোতে দেখলাম, তাই না?

কী করে বেরোল? ও ঘরে কেউ ছিল না। সত্যিই তা হলে ভূত…

কাকাবাবু হা-হা করে হেসে উঠলেন।

কাল রাতে সেই বৃদ্ধকে দেখার পর শশাবাবু শেষ পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। দুর্যোধনকে ডাকাডাকি করে সাড়া পাওয়া যায়নি। শশাবাবুর চোখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনার পরেও সে আর ভয়ের চোটে নীচে যেতে চায়নি। সে শুয়েছিল কাকাবাবুর পাশের ঘরে। দেবলীনাকেও একা ঘরে শুতে দেওয়া হয়নি।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ভূত, তার সত্যি-মিথ্যে কী? ভূত হলে ভূত, না হলে নয়! আজ তোকে আমি ওর থেকে অনেক আশ্চর্য একটা জিনিস দেখাব! সেটা দেখলে তুই এমন অবাক হয়ে যাবি…

না কাকাবাবু, তুমি বলো, ওই বুড়োটা কি মানুষ না ভূত?

তা বলা শক্ত। তবে, ভূত কি কখনও সন্ন্যাসী সাজে? রুদ্রাক্ষের মালা পরে? আর যদি তা-ও হয়, একটা বুড়ো-সন্ন্যাসীর ভূত আমাদের কী ক্ষতি করবে? তাকে দেখে আমাদের ভয় পাওয়ার কী আছে?

আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমি এখনও বুঝতে পারছি না।

তবে তোকে সত্যি কথা বলি। আমারও এক সময় ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠেছিল। আমি, রাজা রায়চৌধুরী, জীবনে কত বিপদে-আপদে পড়েছি, কখনও ঠিক ভয় পাইনি, অথচ কাল রাত্রে ওই সন্ন্যাসীকে দেখে আমারও প্রায় কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?

দক্ষিণের কোণের ঘরের দরজা বন্ধ ছিল না?

হ্যাঁ, বন্ধ তো ছিল ঠিকই!

খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে এসে শশাবাবু বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে একটা লোক দেখা করতে এসেছে।

কাকাবাবু বললেন, এখানে আমার কাছে কে আসবে? নিশ্চয়ই দারুকেশ্বর। পাঠিয়ে দাও, পাঠিয়ে দাও।

দারুকেশ্বর আজ পাজামার ওপর একটা সুবজ পাঞ্জাবি পরে এসেছে, সেই পাঞ্জাবির গায়ে সংস্কৃতে কীসব যেন লেখা। তার মুখের দাড়ি ও মাথার বাবরি চুল বেশ তেল-চুকচুকে ও সুন্দরভাবে আঁচড়ানো।

একগাল হেসে সে বলল, এই যে রায়চৌধুরীবাবু, কেমন আছেন? কাল রাত্তিরে ভাল ঘুম হয়েছিল তো? আপনাদের খবর নিতে এলাম। …কেমন আছ মামণি?

কাকাবাবু বললেন, আসুন, আসুন, এখানে এসে বসুন। চা খাবেন তো? কাল রাত্তিরেই ভূতদর্শন হয়ে গেল।

তাই নাকি? কী রকম, কী রকম? শুনি শুনি।

একেবারে চোখের সামনে জলজ্যান্ত ভূত দেখেছি। অবিশ্বাস করার কোনও উপায় নেই। আচ্ছা দারুকেশ্বরবাবু, আপনার ভূত ধরার ফি কত? মনে হচ্ছে, আপনাকে কাজে লাগাতে হবে।

দারুকেশ্বর প্রাণখোলা দরাজ গলায় হেসে নিল খানিকটা। তারপর বলল, কাল ট্রেনে কীরকম জমিয়েছিলুম, সেটা বলুন! আমি মশাই ট্রেনে চুপচাপ বসে থাকতে ভালবাসি না। আপনি কি ভেবেছিলেন আমি সত্যি-সত্যি ভূত ধরার ব্যবসা করি? আমার পদবি ওঝা শুনলেই সবাই ভাবে, হয় আমি ভূতের ওঝা, কিংবা সাপের ওঝা। তাই আমি কখনও ভূতের গল্প, কখনও সাপের গল্প শুরু করি। আসলে আমি ওষুধের ফেরিওয়ালা। আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিক্রি করি, তাই প্রায়ই ট্রেনে যেতে হয় এখানে-সেখানে। তবে আমি ভূতের গন্ধ পাই। ঠিকই।

দেবলীনা বলল, কিন্তু কাল আমরা সত্যিই যে একজনকে দেখলুম।

কী দেখলে বলো তা মামণি।

দক্ষিণের কোণের ঘরের দরজাটা বন্ধ ছিল। সেখান দিয়ে একটি বুড়ো সন্ন্যাসী বেরিয়ে এল রাত্তিরবেলা, আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল।

ভেরি ইন্টারেস্টিং! ভেরি ইন্টারেস্টিং! চোরেরা অনেক সময় সাধু সাজে শুনেছি, কিন্তু ভূতও যে সাধু হয়, তা কখনও শুনিনি!

কাকাবাবু বললেন, শশাবাবুদের মতে, ওই বৃদ্ধটি হচ্ছেন এই রাজবংশের গুরুদেব। একশো বছরের বেশি বয়েস। উনি মরে গেছেন না বেঁচে আছেন, তা কেউ জানে না। তবে উনি নাকি সশরীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন। হঠাৎ দেখা দেন, হঠাৎ মিলিয়ে যান। একে ঠিক ভূত বলা যায় কি?

দারুকেশ্বর বলল, স্যার, আপনি নিশ্চয়ই আমার থেকে অনেক বেশি। লেখাপড়া জানেন। আপনিই বলুন, জ্যান্ত মানুষ কি কখনও অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে?

কাকাবাবু একথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা পারুকেশ্বরবাবু, আপনি যে আমাদের দক্ষিণের কোণের ঘরটা সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন, তার কারণ কী?

ওই ঘরটা সম্পর্কে অনেক রকম গল্প আছে। বছর পনেরো আগে রাজাদের এক মেয়ে, তার নাম ছিল চম্পা, ওই ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

সেই মেয়েটিও অদৃশ্য হয়ে যায়? মারা যায়নি ওই ঘরে?

কেউ বলে মরে পড়ে ছিল। কেউ বলে তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি। অথচ দরজা বন্ধ ছিল ভেতর থেকে। অনেকদিন আগের কথা তো! একটা কিছু সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হয়েছিল ঠিকই। তারপরেও নাকি অনেকদিন ওই ঘরের মধ্যে একটি মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেছে। রাত্তিরবেলা। ধুপধাপ শব্দও শোনা গেছে।

আপনি এবাড়িতে এসেছেন কখনও?

হ্যাঁ, এসেছি কয়েকবার! এক সময় অনেক মানুষের আনাগোনা ছিল। বছর দশ বারো হল বিশেষ কেউ আর আসে না।

চলুন, তা হলে দক্ষিণের কোণের ঘরটা একবার দেখা যাক।

তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট শেষ করে কাকাবাবু উঠে পড়লেন। বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা বার করে ভরে নিলেন পকেটে। ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।

লম্বা টানা বারান্দা। সাদা ও কালো পাথরে চৌখুপি কাটা। এখন ঝকঝকে রোদ এসে পড়েছে সেখানে। কাকাবাবুর ক্রাচের তলায় রবার লাগানো, তাই শব্দ হয় না। কাল রাতে সেই বৃদ্ধ সাধু যখন এখান দিয়ে গিয়েছিল, তখন খটখট শব্দ হচ্ছিল। এখন শুধু কাকাবাবু ও দারুকেশ্বরের চটির শব্দ, দেবলীনা খালি পায়ে এসেছে।

দক্ষিণের কোণের ঘরটার দরজায় এখন তালা লাগানো।

কাকাবাবু সেই তালাটা ধরে বললেন, এটা একটা টিপ-তালা। খুলতে চাবি লাগে। বন্ধ করার সময় লাগে না। কাল আমি নিজের হাতে চাবি দিয়ে তালাটা খুলেছিলুম। তারপর বন্ধ করেছি কি করিনি, তা মনে নেই। তাতে কিছু যায় আসে না। অনেক পুরনো তালা, এর ভেতরের কলকজা অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। এই দেখুন।

কাকাবাবু দরজার পাল্লা দুটো ধরে জোরে টানলেন। তালাটা আপনিই খুলে গেল।

তিনি দেবলীনাকে বললেন, বুঝলি, দরজায় এই তালা লাগানো আর -লাগানো সমান! সুতরাং দরজাটা খুলে যাওয়া আশ্চর্য কিছু না। কিন্তু এরপর তোদের সত্যিকারের একটা আশ্চর্য জিনিস দেখাব!

কাকাবাবুই আগে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন, দেবলীনা আর দারুকেশ্বর দরজার কাছ থেকে উঁকি মারল।

কাল সন্ধেবেলা যেরকম দেখা গিয়েছিল, ঘরটা এখনও ঠিক সেই রকমই আছে। দুদিকের দেওয়ালে লেপ-তোশক বালিশের পাহাড়।

কাকাবাবু বললেন, রাত্তিরে আমি আর এ-ঘরে আসিনি। বেশ একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলুম। কিছুতেই ব্যাখ্যা করতে পারছিলাম না ঘটনাটার। সারা রাত ভাল করে ঘুমই হল না। সকালবেলা মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। নিজের চোখে যা দেখেছি, তা কক্ষনো ভুল হতে পারে না। ঘটনাটা নিশ্চয়ই ঘটেছে। এবং তার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা থাকতেই হবে! তাই ভোরবেলা আমি এই ঘরে এসে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছি। একটা জিনিস দেখে আরও বেশি চমকে উঠেছি। এবার তোমাদের সেটা দেখাব।

কাকাবাবু একদিকের দেওয়ালের বালিশ-তোশক টেনে নামাতে লাগলেন। তাঁর পাশে এসে দারুকেশরও হাত লাগাল, সব জমা হতে লাগল পায়ের কাছে। একটু বাদে দেখা গেল দেওয়ালের গায়ে একটি ছবির ফ্রেম। বেশ বড়। আস্তে আস্তে দেখা গেল ছবিটা। একটি কিশোরী মেয়ের অয়েল পেইন্টিং! লাল রঙের ফ্রক পরা চোদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ে, মাথার চুলে রিবন বাঁধা, অবাক-অবাক চোখের দৃষ্টি।

দারুকেশ্বর অস্ফুট গলায় বলল, চম্পা! চম্পার ছবি!

দেবলীনা বলল, এ কী! এ তো আমার ছবি!

দারুকেশ্বর পাশ ফিরে দেবলীনাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, তাই তো! এ-ছবি তো হুবহু এই মামণির মতন। এ কী করে সম্ভব হল?

কাকাবাবু বললেন, পনেরো বছর আগে মারা গেছে কিংবা হারিয়ে গেছে যে চম্পা, তার সঙ্গে দেবলীনার মুখের কী আশ্চর্য মিল! ঠিক যেন দেবলীনারই ছবি।

এঁকে রেখেছে কেউ!

দারুকেশ্বর বলল, ছবিটা পুরনো, অনেকদিন আগে আঁকা।

কাকাবাবু বললেন, এ বাড়ির অন্য ঘরেও বেশকিছু ছবি আছে, আমি দেখেছি। আমরা যে-ঘরে শুয়েছি, সে-ঘরের দেওয়ালেও একটা সাদা চৌকো জায়গা, সেখানে একটা ছবি টাঙানো ছিল মনে হয়। কেউ খুলে নিয়েছে। রাজাদের কারও ছবির শখ ছিল।

দারুকেশ্বর বলল, চম্পাকে আমিও দুএকবার দেখেছি। অনেকদিন আগের কথা, এখন মনে পড়ছে। ঠিকই তো, এই মামণির চেহারার সঙ্গে খুব মিল ছিল। যেন দুটি যমজ বোন, কিংবা এই দেবলীনা-মামণিই সেদিনের চম্পা!

কাকাবাবু বললেন, চম্পা বেঁচে থাকলে এখন তার বয়েস অন্তত তিরিশ বহর হবার কথা।

দেবলীনার ঠোঁট কাঁপছে। ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে বলল, কাকাবাবু, এই মেয়েটা, এই মেয়েটাই আমায় মাঝে-মাঝে ডাকে। দারুকেশ্বর বলল, আশ্চর্য! এরকম কী করে হয়! এমন হতে পারে?

কাকাবাবু শেকসপিয়ারের হ্যামলেট নাটক থেকে আবৃত্তি করলেন, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ, হোরেসিও, দ্যান আর ড্রেষ্ট অব ইন ইয়োর ফিলসফি! জীবনে এরকম কিছু-কিছু আশ্চর্য ব্যাপার আজও ঘটে। এক কোটি বা দশ কোটি মানুষের মধ্যে একজনের সঙ্গে আর-একজনের চেহারার হুবহু মিল থাকা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু চম্পা যে-ঘর থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেই ঘরে চম্পারই মতন দেখতে দেবলীনা ফিরে এসেছে এতদিন বাদে, এটাই একটা মহা আশ্চর্যের ব্যাপার।

দারুকেশ্বর বলল, আমি এখনও যে বিশ্বাস করতে পারছি না।

কাকাবাবু ছবিটার গায়ে হাত দিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, ছবিটা পুরনো, এটা দেবলীনাকে দেখে আঁকা হয়নি। চম্পারই ছবি।

দারুকেশ্বর বলল, চোখ দুটো দেখলে মনে হয়, ঠিক যেন জীবন্ত!

কাকাবাবু বললেন, আপাতত ছবিটা ঢেকে রাখাই ভাল। দুর্যোধন আর শশাবাবুকে কিছু বলবার দরকার নেই। শশাবাবু চম্পাকে কখনও দ্যাখেনি। দুর্যোধন দেখেছে বটে, সে একবার বলেওছিল, চম্পার সঙ্গে দেবলীনার মিল আছে, কিন্তু ঠিক কতখানি যে মিল, তা তার মনে নেই।

কাকাবাবু ছবিটাকে দেওয়াল থেকে একবার খুলে নিলেন, তারপর পেছনের দেওয়ালে টোকা মারলেন কয়েকবার। নিরেট দেওয়াল, কোনও শব্দ হল না।

কাকাবাবু দারুকেশ্বরকে জিজ্ঞেস করলেন, আগেকার দিনে এইসব পুরনো রাজবাড়িতে হঠাৎ শত্রুর আক্রমণ থেকে পালাবার ব্যবস্থা রাখার জন্য গুপ্ত-ঘর বা গোপন সুড়ঙ্গ থাকত। এ বাড়িতে সেরকম কিছু আছে কি না, জানেন কি?

দারুকেশ্বর ঠোঁট কামড়ে একটুক্ষণ চিন্তা করে বলল, নাঃ, সেরকম কিছু শুনিনি।

চম্পা যদি এ-ঘর থেকে উধাও হয়ে থাকে, তা হলে এই ঘরেরই কোথাও কোনও গোপন সুড়ঙ্গ-পথে এসে কেউ তাকে নিয়ে গেছে, এরকম মনে করাই

তো স্বাভাবিক তাই না? তখন খোঁজাখুঁজি করে দেখা হয়নি?

এই ঘরের সঙ্গে একটা বাথরুম আছে। তার জানলা ভাঙা ছিল। পুলিশ এসে বলেছিল, ওই জানলা দিয়েই কেউ ঢুকে চম্পাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে, তারপর মেরে ফেলেছে। আবার কারও কারও ধারণা, যুগলকিশোরের প্রেতাত্মাই চম্পাকে ভুলিয়েভালিয়ে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে, প্রতিশোধ নেবার জন্য।

যুগলকিশোর কে?

ছোটরানীমার ভাই। সে খুন হয়েছিল এই বাড়িতেই!

হুঁ! চম্পার দেহ আর পাওয়া যায়নি?

নাঃ! অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছে, পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে, জঙ্গলে একসোজন লোক লাগানো হয়েছিল। এই রাজবংশের একজন গুরুদেব চম্পাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি এবাড়িতে উপস্থিত থাকতেও চম্পার ওরকম পরিণতি হল বলে তিনি দুঃখে, অনুশোচনায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। আপনারা কাল বোধহয় তাঁকেই দেখেছেন। জীবিত না প্রেতাত্মা দেখেছেন, তা বলতে পারব না।

কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। চম্পার ছবিটাকে একটা তোশকের ভাঁজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি এগিয়ে গিয়ে খুলে ফেললেন, বাথরুমের দরজাটা।

পেছন ফিরে বললেন, ভোরবেলা আমি ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে গেছি। বাথরুমের জানলা এখন আর ভাঙা নয়, তাতে শিক বসানো আছে। জানলা ভেতর থেকে বন্ধ। কাল রাতে যে বৃদ্ধটি এ-ঘর থেকে বেরিয়েছিল, সে জানলা দিয়ে ঢোকেনি। সে অন্য কোনও পথে এসেছিল। যাকগে, ব্যস্ততার কিছু নেই, সেটা পরে দেখলেও চলবে।

দেবলীনা থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, ওই মেয়েটা সত্যি মরে গেছে? ওকে কেন মেরে ফেলেছিল?

কাকাবাবু বললেন, তা তো জানি না। অনেকদিন আগেকার ব্যাপার, এখন আর বোধহয় জানাও যাবে না! চল, এ-ঘর থেকে বাইরে যাই!

বারান্দার চেয়ারে এসে বসবার পর দারুকেশ্বর বলল, এর পরেও আপনারা এবাড়িতে থাকবেন?

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, কেন, থাকব না কেন? না থাকার কী আছে? বেশ তো চমৎকার বাড়ি। কী রে, দেবলীনা, তোর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না?

দেবলীনা বলল, হ্যাঁ, থাকব।

কাকাবাবু বললেন, আমার তো দারুণ এক্সাইটিং লাগছে, আজ রাত্তিরে যদি সেই বুড়ো সন্ন্যাসীকে দেখা যায়, তা হলে আজ আর ঘাবড়ালে চলবে না, সোজা গিয়ে পা চেপে ধরব। দেখতে হবে সে সত্যি-সত্যি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে কি না?

দারুকেশ্বর বলল, আপনার সাহস আছে দেখছি! দিনের বেলা ভয় কিছু নেই, কিন্তু রাত্তির হলে এসব জায়গায় আমার গা-ছমছম করে। আমি লোকের কাছে ভূত ধরার গল্প করি বটে, কিন্তু নিজে বেশ ভূতের ভয় পাই। এক-এক সময় এমন বিচ্ছিরি গন্ধ ছাড়ে এরা..

আপনি ওই দক্ষিণের ঘরটায় কিছু গন্ধ-টন্ধ পেলেন?

না, তা পাইনি। দিনের বেলা অনেক সময়ই পাওয়া যায় না। তা হলে আমি এখন উঠি। আমাকে একটু জঙ্গলের দিকে যেতে হবে শেকড়বাকড় বুজতে। আমি তো ভেষজ ওষুধ বানাই!

কিসের ওষুধ বানান?

এই পেটের অসুখ, মাথা গরম, বুক ধড়ফড়, কান কটকট, আরও অনেক রোগের ওষুধ আছে।

চলুন তা হলে আপনার সঙ্গে আমরাও একটু জঙ্গলে ঘুরে আসি। শুধু শুধু বাড়িতে বসে থেকে কী করব?

কিন্তু আমি সাইকেলে এসেছি। আমার সঙ্গে আপনারা কী করে যাবেন?

তা হলে তো মুশকিল! হাঁটা-পথে অনেক দূর হবে, তাই না? আমাদের একটা গাড়ি ভাড়া করে রাখা উচিত ছিল। আপনাকে কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিলে আপনি শহর থেকে আমাদের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে পাঠিয়ে দিতে পারবেন?

আজ তো আর হবে না। কাল সকালে আমি নিজেই একটা গাড়ি জোগাড় করে আনব।

দারুকেশ্বরের সঙ্গে দেবলীনা আর কাকাবাবুও নীচে নেমে এলেন। রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁক-ছ্যাঁক রান্নার আওয়াজ আসছে। উঠোনে মাটি কোপাচ্ছে দুর্যোধন। দেবদারু গাছের মাথায় এখনও অনেক টিয়াপাখি টিটি করে ডেকে খেলা করছে নিজেদের মধ্যে। বড় গেটটার ওপরে বসে আছে একটা শঙ্খচিল।

কাকাবাবু দুর্যোধনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ও-ই এখানকার দরোয়ান কাম মালিকাম জল তোলার লোক। তবে ওর নাম দুর্যোধন না হয়ে কুম্ভকর্ণ হওয়া উচিত ছিল। কাল রাতে ওকে এত ডাকলুম, কিছুতেই উঠল না! যে-দরোয়ান এত ঘুমোয়, সে কী করে বাড়ি পাহারা দেবে?

দারুকের বলল, এবাড়ি থেকে কী-ই বা নেওয়ার আছে? টাকা-পয়সা তো কিছু নেই, বড়বড় খাট, চেয়ার, টেবিল, কে-ই বা বয়ে নিয়ে যাবে! রাজারা বাড়িটা বিক্রি করতে চান, কিন্তু খদ্দের পাচ্ছেন না। একেই তো এত বড় বাড়ি, তার ওপর বদনাম আছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে জানেন, আর দুচার বছরের মধ্যেই দেখবেন, এটা একেবারে পোডড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বেশির ভাগ রাজবাড়িগুলোর এই দশাই হয়। কুচবিহারের রাজবাড়ি দেখেছেন? দেখলে চোখে জল আসে।

বড় গেটের মধ্যে ছোট গেট দিয়েই ওদের বেরোতে হল বাইরে। বড় গেটটা যে বহুদিন খোলা হয়নি, তা বোঝা যায়। দারুকের সাইকেলে উঠে পড়ে হাত নেড়ে চলে গেল।

কাকাবাবু জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বললেন, দুর্যোধনেরও একটা সাইকেল আছে না? ইস, এককালে আমিও খুব ভাল সাইকেল চালাতুম রে, দেবলীনা! এখন খোঁড়া পায়ে আর পারি না। না হলে তোকে ক্যারি করে আমরা সাইকেলেই ঘুরে আসতে পারতুম জঙ্গলে।

আমি সাইকেল চালাতে জানি, কাকাবাবু। আমি তোমাকে ক্যারি করে নিয়ে যাব?

যাঃ, তুই আমার এত বড় শরীরটা টানবি কী করে? সে হয় না।

আমার সাইকেল চলাতে ইচ্ছে করছে। আমি তা হলে একটু একা ঘুরে আসব, কাকাবাবু?

কাকাবাবু দেবলীনার মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, যেতে নিষেধ করা আমার স্বভাব নয়। তুই একলা যেতে চাইছিস, কোনও বিপদে-টিপদে পড়বি না তো?

দিনের বেলা আবার কী বিপদ হবে? বেশি দূরে যাব না?

ঠিক আছে, ঘুরে আয়। একটা কথা শোেন, সেই যে মেয়েটা তোকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, তাকে কি সত্যি চম্পার মতন দেখতে?

এক ঝলকের জন্য শুধু দেখতে পাই। অনেকটা ওই রকম।

এবারে যদি সেরকম দেখতে পাস, তুই একলা একলা তার পেছনে ছুটে যাবি না। আমাকে ডাকবি। কী, মনে থাকবে তো?

হ্যাঁ, তোমায় ডাকব।

তুই কী রকম সাইকেল চালাতে পারিস, দেখি!

দুর্যোধনের সাইকেলটা গেটের পাশেই হেলান দিয়ে রাখা। দেবলীনা বেশ সাবলীলভাবে তাতে চেপে এক পাক ঘুরে এল। কাকাবাবু প্রশংসার চোখে তাকিয়ে বললেন, বাঃ, বেশ ভালই চালাতে পারিস রে। ঘুরে আয় তা হলে। দেরি করে আমায় চিন্তায় ফেলিস না যেন! আমি ততক্ষণ পুকুরধারটা ঘুরে আসি।

দেবলীনা জঙ্গলের পাশের রাস্তাটা দিয়ে একটু বাদেই চলে গেল চোখের আড়ালে।

কাকাবাবু আস্তে-আস্তে হাঁটতে লাগলেন বাড়ির পেছন দিকে। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে, কোথাও কোথাও মাটি বেশ নরম, তাঁর ক্রাচ বসে যাচ্ছে। এদিকে ওদিকে কিছু অস্পষ্ট পায়ের ছাপ দেখতে পেলেন। দুর্যোধন শশাবাবুরা বাড়ির পেছন দিক দিয়েই যাতায়াত করে। পেছন দিকে অনেক জায়গায় পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। একতলার একটা ঘরের দরজা আধখানা ভাঙা। কুকুর-বেড়াল-শেয়াল অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে।

পুকুরটা চৌকো, কিন্তু খুব বেশি বড় নয়। বহুদিন পরিষ্কার করা হয়নি, জলের মধ্যে শ্যাওলা আর শাপলা অনেক। মাঝপুকুরে একটা মাছ ঘাই মারল, তা দেখে কাকাবাবুর মনে পড়ল, ছিপ বঁড়শি আছে কি না তা খোঁজ করা হয়নি শশাবাবুদের কাছে। এত বক বসে আছে যখন, তখন পুকুরটায় নিশ্চয়ই বেশ মাছ আছে।

একটা বড় বাঁধানো ঘাট, তার দুপাশে পাথরের নারীমূর্তি বসানো। দুটো মূর্তিরই নাক ভাঙা, হাত ভাঙা। ঘাটের সিঁড়িগুলোও ভেঙে পড়েছে অনেক জায়গায়। দারুকেশ্বর ঠিকই বলেছে। আর কিছুদিন পরেই এই রাজবাড়িটা পোড়াবাড়ি হয়ে যাবে।

পুকুরের এক ধারে সাত-আটখানা মাটির বাড়ি। দেখলেই বোঝা যায়, ওই সব বাড়িতে এখন কোনও লোক থাকে না। রাজারা যখন নিয়মিত আসতেন, তখন তাঁদের ঠাকুর-চাকর-ধোপা-নাপিত লাগত নিশ্চয়ই, তাদের জন্য ওইসব বাড়ি বানানো হয়েছিল। এখন নিশ্চয়ই তারা শহরে চলে গেছে। এখন যে তিনজন কর্মচারী আছে, তারাও ঠিকমতন মাইনে পায় কি না কে জানে! মাইনে বন্ধ হলেই ওরাও পালাবে!

শিবমন্দিরটা পুকুরের ঠিক ডান কোণে। পুজো-টুজো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দিনই। মন্দিরের গা দিয়ে একটা বটগাছের চারা উঠে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এই বটগাছটাই একদিন মন্দিরটা গুঁড়ো করে ফেলবে।

মন্দিরের চাতালে উঠে ভেতরে তাকিয়ে কাকাবাবু অবাক হলেন। মন্দিরটার তুলনায় শিবলিঙ্গটা বিরাট। প্রায় দুজন মানুষের সমান গোল আর ছফুটের মতন লম্বা। মন্দিরের ভেতরটা অন্ধকার। জানলা-টানলা কিছু নেই।

কাকাবাবু মন্দিরের মধ্যে ঢুকে ভাল করে দেখলেন। এককালে একটা জানলা ছিল, পরে কোনও কারণে ইট দিয়ে গেঁথে সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে একটা টকটক গুমোট গন্ধ। মেঝেতে এখানে-সেখানে জল, হয়তো বৃষ্টির সময় কোনও ফাটল দিয়ে জল পড়ে।

খানিকক্ষণ শিবলিঙ্গটা দেখার পর কাকাবাবু তার সামনে বসে পড়লেন। কী ভেবে সেটার গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতে লাগলেন শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে। খুব জোরে একটা চাপ দিতেই শিবলিঙ্গটা সরে গেল পেছনের দিকে। তার নীচে দেখা গেল একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ।

কাকাবাবুর মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তাঁর অনুমান ঠিক হয়েছে। রাজবাড়ি থেকে তিনি গোপন সুড়ঙ্গটা খুঁজে পাননি বটে, কিন্তু এটাই সেই সুড়ঙ্গের বেরোবার পথ! পালাবার পক্ষে এই তো আদর্শ জায়গা!

কাকাবাবু একবার ভাবলেন, পরে এক সময় দেবলীনা আর দারুকেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে এসে, ওদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে, তারপর তিনি এই সুড়ঙ্গের ভেতরটায় ঢুকে দেখবেন। এই রকম অন্ধকার ঠাণ্ডা জায়গায় সাপ থাকতে পারে। আরও কিছু গণ্ডগোল থাকাও বিচিত্র কিছু নয়। একা-একা ঢোকা ঠিক হবে না।

কিন্তু তিনি কৌতূহল সামলাতে পারলেন না। এক্ষুনি দেখতে ইচ্ছে হল। ক্রাচ দুটো রেখে দিয়ে তিনি সুড়ঙ্গের মধ্যে পা বাড়ালেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress