Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 4

রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay

দেবলীনা বড় গেটটার গায়ে দুমদুম করে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, দুর্যোধন! গেট খোলো! মনোজবাবু! শশাবাবু! গেট খুলে দিতে বলুন!

কেউ সাড়া দিল না। কাকাবাবু একটা একটা করে সুটকেস বয়ে নিয়ে এলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, এরা টেলিগ্রাম পায়নি না কি? দুটো টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছে!

দেবলীনা বলল, নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। এরা বড্ড তাড়াতাড়ি ঘুমোয়!

সে কী, এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে? ওদের যে রান্না করে রাখতে বলা হয়েছে। আমরা আসবার আগেই ঘুমোবে?

সন্ধের পর এক ঘন্টা জেগে থাকতেও এদের কষ্ট হয়। আগেরবার দেখেছি তো?

এবার দুজন মিলে ধাক্কা দিতে লাগলেন গেটে। চতুর্দিকে এমন নিস্তব্ধ যে, এই শব্দ বেশ ভয়ঙ্কর শোনাল, তবু কোনও মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল না।

মিনিটদশেক বাদে কাকাবাবু বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে ওরা বোধহয় টেলিগ্রাম পায়নি।

দেবলীনা বলল, বাবা নিজে আর বাবার বন্ধুও একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন, তার একটাও পাবে না?

টেলিগ্রাম না পাওয়ার একটা কারণ হতে পারে, হয়তো পোস্টম্যান এসে ফিরে গেছে। এ বাড়িতে কোনও মানুষই থাকে না!

হ্যাঁ, থাকে! একজন দরোয়ান, একজন কেয়ারটেকার আর একজন পুরনো কর্মচারী। আমি আগেরবার এসে দেখেছি তাদের!

তখন তারা ছিল, এখন নেই। আমরা এত চ্যাঁচামেচি করছি, এতে কুম্ভকর্ণেরও ঘুম ভেঙে যাবার কথা!

তা হলে কী হবে, কাকাবাবু?

ড্রাইভারটা তাড়াহুড়ো করে চলে গেল, না হলে আজকের রাতের মতন শহরে ফিরে যাওয়া যেত। দারুকেশ্বর ঠিক পরামর্শই দিয়েছিল। যাই হোক, এখন তো আর ফেরা যাবে না! হাঁ রে দেবলীনা, এবাড়িতে ঢোকার দরজা নেই?

পেছন দিকে আর-একটা দরজা দেখেছি। সেটা সবসময় বন্ধ থাকে। একবার দেখব সেখান থেকে ডাকলে কেউ শুনতে পায় কি না?

কাকাবাবু পকেট থেকে টর্চ বার করে বললেন, এটা নিয়ে যা! দেখিস, সাবধান, সাপ-টাপ থাকতে পারে!

দেবলীনা চলে যাবার পর কাকাবাবু দরজাটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন। পুরনো আমলের দরজা হলেও বেশ মজবুত। বাইরে তালা নেই, ভেতর থেকে বন্ধ। তা হলে ভেতরে নিশ্চিত কোনও মানুষ থাকার কথা!

কাকাবাবু পেছন ফিরে দেখলেন। খানিকটা ফাঁকা জায়গার পরেই জঙ্গলের রেখা। এককালে রাজারা নিরিবিলিতে থাকার জন্য এই জায়গায় বাড়ি বানিয়েছিলেন। নিরিবিলিতে থাকার জন্যও রাজারা সঙ্গে অনেক লোকজন নিয়ে আসতেন। এখন এইরকম জায়গায় এত বড় বাড়ি কে দেখাশুনো করবে?

শেষ পর্যন্ত গেট না খুললে কি সারারাত বাইরে কাটাতে হবে? একটু শীত-শীত করছে।

বড় গেটটার এক পাশে, নীচের দিকে একটা ছোট দরজা খুলে গেল, সেখান থেকে মুখ বার করে দেবলীনা বলল, কাকাবাবু, এইদিক দিয়ে এসো।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুই ভেতরে ঢুকলি কী করে?

পেছন দিকে দেখি যে, এক জায়গায় পাঁচিল একদম ভাঙা! এই গেটে তালা দেবার কোনও মানেই হয় না।

কাকাবাবু মাথা নিচু করে সেই ছোট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সুটকেসগুলো ভেতরে আনলেন। তারপর দুহাত ঝেড়ে বললেন, কী চমৎকার অভ্যর্থনা রে! এই বাড়িতে থাকতে হবে?

আগের বারে কিন্তু খুব ভাল ব্যবস্থা ছিল। কোনও অসুবিধে হয়নি!

কাকাবাবু টর্চটা নিয়ে আলো ফেলে সারা বাড়িটা দেখলেন। এত বড় বাড়িতে দুচারটে চোর-ডাকাত লুকিয়ে থাকলে বোঝার সাধ্য নেই। এবাড়ি পাহারা দেবার জন্য অনেক লোক দরকার, সেইজন্যই বোধহয় কেউই পাহারা দেয় না।

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কাকাবাবু জোর গলায় বললেন, বাড়িতে কেউ আছে?

দেবলীনা ডাকল, দুর্যোধন! শশাবাবু?

এবারে একটা কোণ থেকে শব্দ শোনা গেল…উঁ উঁ উঁ উঁ!

দেবলীনা কাকাবাবুর হাত চেপে ধরল।

কাকাবাবু বললেন, ভূত নাকি রে? দারুকেশ্বরকে জোর করে ধরে আনা উচিত ছিল। আমি কোনওদিন ভূত দেখিনি, এবারে সেটা ভাগ্যে ঘটে যাবে মনে হচ্ছে।

দুতিন ধাপ সিঁড়ির পর লম্বা টানা বারান্দা। আওয়াজটা আসছে ডান দিকের একটা কোণ থেকে, সেই দিকেই ওপরে ওঠবার সিঁড়ি। টর্চটা জ্বেলে রেখে কাকাবাবু সেই দিকে এগোতে-এগোতে জিজ্ঞেস করলেন, তুই ভূতের ভয় পাস নাকি?

কাকাবাবুর হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে দেবলীনা বলল, না!

কাকাবাবু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে? কে ওখানে?

এবারে উঁউ শব্দটা আরও বেড়ে গেল। বোঝা গেল, শব্দটা আসছে সিঁড়ির পাশের একটা ঘর থেকে। একটা ক্রাচ তুলে তিনি ঠেলা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন।

ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন লোক, ধুতি আর গেঞ্জি পরা। লোকটির মাথায় একটাও চুল নেই। টাক না ন্যাড়ামাথা, তা ঠিক বোঝা যায় না।

দেবলীনা বলে উঠল, এ তো শশাবাবু? কাকাবাবু বললেন, ভূত নয় তা হলে? এঃ হে!

দেবলীনা লোকটির কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, শশাবাবু! ও শশাবাবু! কী হয়েছে আপনার?

লোকটি এবারে মুখ ফিরিয়ে বলল, মেরে ফেললে! মেরে ফেললে! ওগো, আমাকে বাঁচাও! বাঁচাও!

দেবলীনা বলল, আপনাকে কে মেরে ফেলবে? এখানে তো আর কেউ নেই।

লোকটি বলল, কে! তুমি কে মা?

আমি দেবলীনা! মনে নেই আমাকে? কয়েকদিন আগেই তো আমি এসেছিলুম।

তুমি…তুমি সেই সুন্দর দিদিমণি? তুমি এসে আমাকে বাঁচালে। ওরা তোমার কোনও ক্ষতি করেনি তো?

ওরা মানে কারা?

কী জানি, দিদিমণি, তা কি জানি! ওরা আমার গলা টিপে মারতে এসেছিল। আমি আর এখানে চাকরি করব না। ওরে বাপ রে বাপ, প্রাণটা বেরিয়ে যেত আর একটু হলে!

দুর্যোধন, মনোজবাবু, এঁরা সব গেলেন কোথায়?

পালিয়েছে বোধহয়। আমাকে ফেলে পালিয়েছে। আমি রান্না করছিলুম, বুঝলে দিদিমণি, হঠাৎ ওপরতলায় ধুড়ম-ধাড়াম, ধুড়ম-ধাড়াম! ওরে বাপ, ঠিক যেন শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল! সে কী আওয়াজ! আমি কে রে, কে রে বলে উঠতেই দেখি মনোজবাবু দৌড়ে পালাচ্ছে। দুর্যোধন ব্যাটা বোধহয় আগেই লম্বা দিয়েছিল। তারপর ওপর থেকে কারা যেন দুদ্দাড় করে নেমে এল.এই দ্যাখো, এখনও আমার বুকটা হাপরের মতন ধড়াস ধড়াস করছে।

তারপর? তারপর কী হল?

আমাকে গলা টিপে মারতে এল গো দিদিমণি! মনোজবাবু কীরকম নিমকহারাম বলো! ওকে আমি কতরকম রান্না করে খাওয়াই, আর সেই লোক কিনা বিপদের মুখে আমায় ফেলে পালিয়ে গেল!

আমরা যে আসব, আপনারা জানতেন না? টেলিগ্রাম পাননি?

হ্যাঁ, পেয়েছি। তোমাদের জন্যেই তো আমি রান্না করছিলুম গো!

কাকাবাবু বললেন, যাক, এতক্ষণে একটা ভাল খবর পাওয়া গেল। বেশ খিদে পেয়ে গেছে। রান্নাটান্নাগুলো আছে তো? নাকি ওই শুম্ভ-নিশুম্ভরা খেয়ে গেছে?

দেবলীনা বলল, শশাবাবু, ইনি কাকাবাবু! এবারে কাকাবাবু এসেছেন, আর কোনও ভয় নেই।

শশাবাবু উঠে বসে চোখ গোল-গোল করে বলল, নমস্কার! আপনারা এ-বাড়িতে থাকতে এলেন, হায় পোড়াকপাল, এখানে যে আপনাদের যত্ন-আত্তি করার কোনও ব্যবস্থাই নেই। আগে কত কিছু ছিল! তার ওপর এখন আবার এইসব উপদ্রব!

দেবলীনা বলল, আমরা যে গত মাসে এলুম, তখন তো ওপরে কোনও আওয়াজ-টাওয়াজ শুনতে পাইনি?

শশাবাবু বলল, মাঝে-মাঝে হয়। এই তো মাস-ছয়েক বাদে আবার শুরু হল। সেবারে তোমাদের বলিনি, ভয়-টয় পাবে…কলকাতার দাদাবাবুকে চিঠি লেখা হয়েছে, উনি কিছুই করছেন না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওরা আপনাকে গলা টিপে মারতে এসেছিল বললেন। তারপর কী হল, আপনাকে মারল না কেন?

শশাবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, অ্যাঁ? কী বললেন?

ওরা আপনাকে গলা টিপে মারতে এসেও শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিল কেন?

ছেড়ে দিল..মানে…আপনি চান ওরা আমাকে মেরে ফেললেই ভাল হত?

না, না, আমি তা চাইব কেন? আমি জানতে চাইছি যে, কারা সব যেন। আপনাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে এল, তারপর কী হল? তারা এমনি-এমনি চলে গেল?

তা জানি না। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম!

তাদের চোখে দেখেছেন? কীরকম দেখতে?

অন্ধকার হয়ে গেল যে! সব বাতি নিভে গেল। শুধু আওয়াজ শুনেছি, বিকট আওয়াজ! ওঃ, ওঃ, কানে তালা লেগে গিয়েছিল..

কাকাবাবু দুবার জোরে-জোরে নিশ্বাস টেনে বললেন, ঘরের মধ্যে একটা গন্ধ পাচ্ছিস, দেবলীনা?

হ্যাঁ, পাচ্ছি! কিসের গন্ধ বলো তো?

গন্ধ আর আওয়াজ! তাই দিয়েই ওদের চেনা যায়, দারুকের এই রকমই। বলেছিল না? তা হলে, শশাবাবু, আপনি দয়া করে আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করুন। কাল বাজার থেকে কয়েক প্যাকেট ধূপ কিনে আনবেন। ধূপের গন্ধ অনেক গন্ধ ঢেকে দেয়। আমরা কোন্ ঘরে থাকব?

ঘর তো অনেকই আছে। যে-ঘরে ইচ্ছে থাকতে পারেন। তবে ওপরতলায় কী হয়ে গেছে, তা জানি না!

দেখুন, আমার একটা পা খোঁড়া। বারবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে আমার অসুবিধে হয়। আমি একতলাতেই থাকতে চাই। একতলায় যদি পাশাপাশি দুখানা ঘর থাকে, তাতে আমি আর দেবলীনা থাকতে পারি।

দেবলীনা বলল, না, কাকাবাবু, একতলার ঘরগুলো কীরকম দিনের বেলাতে অন্ধকার। ওপরের বারান্দা থেকে চমৎকার বৃষ্টি দেখা যায়। আমরা ওপরেই থাকব। তুমি বেশি ওপর-নীচ করবে না।

কাকাবাবু বললেন, শশাবাবু, আপনাদের লণ্ঠন, বা হ্যাজাক কিছু নেই? অন্ধকারের মধ্যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব?

শশাবাবু বলল, হ্যাঁ, হ্যারিকেন, হ্যাজাক, সবই তো থাকার কথা। দুর্যোধন ব্যাটা কোথায় যে গেল! দেখছি, রান্নাঘরের আলোটা যদি জ্বালা যায়?

আপনি আলো জ্বালান। ততক্ষণ দেবলীনা আর আমি ওপরতলাটা দেখে আসি।

শশাবাবু আবার ভয় পেয়ে বলল, না স্যার, আমায় একা ফেলে যাবেন না! একা থাকলেই আমার মাথা ঘুরবে!

হঠাৎ ওপরতলায় ঘট-ঘট-ঘটঘট করে একটা আওয়াজ হল। যেন একটা ভারী কিছু জিনিস গড়াচ্ছে। সেই আওয়াজে শশাবাবু ভয় পেয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, ওই যে, শুনলেন? শুনলেন? আবার শুরু হল!

দেবলীনা অস্বাভাবিক জোরে চেঁচিয়ে বলল, আমি ওপরে যাব। আমি ওপরে গিয়ে দেখব!

কাকাবাবু বললেন, ত্যাঁ, ওপরে তো একবার যেতেই হয়। দেবলীনা, তুই টর্চটা ধর। আমার ঠিক ডান পাশে থাকবি। শশাবাবু, আপনি তো একা নীচে থাকতে পারবেন না। আপনি আমাদের পেছনে পেছনে আসুন!

শশাবাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, এখন ওপরে যাবেন না! ওরা বড় সাঙ্ঘাতিক…কী থেকে কী হয়ে যায় বলা যায় না!

কাকাবাবু বললেন, কী থেকে কী হয়, সেটাই তো আমার খুব দেখার ইচ্ছে। নিন, চলুন।

হাতব্যাগ থেকে রিভলভারটা বার করে নিয়ে, তার ডগায় দুবার ফুঁ দিয়ে বললেন, অশরীরীদের গায়ে তো গুলি লাগে না। তবে মানুষের মূর্তিধারী যদি কেউ থাকে, তাদের জন্য এটা হাতে রাখা দরকার! সিঁড়ি দিয়ে আস্তে-আস্তে উঠবি, তাড়াতাড়ি করার দরকার নেই।

বেশ চওড়া কাঠের সিঁড়ি, একপাশে কারুকার্য করা রেলিং। একসময়ে পুরো সিঁড়িতেই কার্পেট পাতা ছিল, এখন তা ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে, কয়েক জায়গায় তার চিহ্ন দেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ওদের পায়ের শব্দ হতে লাগল।

ওপরের আওয়াজটা থেমে গেছে।

দোতলায় ওঠবার ঠিক মুখে কাকাবাবু থমকে গিয়ে দেবলীনাকে বললেন, আলো ফেলে আগে গোটা বারান্দাটা দেখে নে।

অনেকটা লম্বা বারান্দা, টর্চের আলো শেষ পর্যন্ত ভাল করে পৌঁছয় না। তারই মধ্যে যতদূর মনে হল, বারান্দায় কেউ নেই। খানিকটা দূরে কিছু একটা গোল-মতন জিনিস পড়ে আছে।

শশাবাবু বলল, মু-মু-মু-মু-মুণ্ডু! ওই যে একটা মু-মু-মুণ্ডু!

কাকাবাবু বললেন, কার মুণ্ডু বলুন তো। চলুন, দেখা যাক?

সে-দিকে পা বাড়াবার আগে কাকাবাবু রিভলভারটা উঁচু করে গম্ভীরভাবে ঘোষণা করলেন, এখানে যদি কেউ লুকিয়ে থাকো, সামনে এগিয়ে এসো! কোনও ভয় নেই! আমরা কোনও শাস্তি দেব না!

তারপর তিনি দেবলীনার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ভূত-টুত যদি থেকেও থাকে, অনেক সময় তারাও মানুষকে ভয় পায়, বুঝলি! সব মানুষ যেমন সাহসী হয় না, সেইরকম সব ভূতও সাহসী হতে পারে না!

তারপর তিনি শশাবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ভয় পেলে মানুষের চোখের দৃষ্টিও নষ্ট হয়ে যায় বুঝি? ওই জিনিসটাকে আপনি একটা মুণ্ডু বললেন কী করে? ওটা তো একটা ফ্লাওয়ার ভাস!

বারান্দাটার রেলিংয়ের দিক ঘেঁষে হাঁটতে লাগলেন কাকাবাবু। সারি-সারি ঘরগুলির সব কটারই দরজা বন্ধ। দেওয়াল থেকে দুটো ছবি খসে পড়ে গেছে, এখানে-ওখানে ভাঙা কাচ ছড়ানো। মেঝেতে যেটা গড়াচ্ছে, সেটা একটা নীল রঙের গোল চিনেমাটির ফ্লাওয়ার ভাস, তার পাশে আর-একটা ফুলদানি ভাঙা।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে এই ব্যাপার!

শশাবাবু বলল, ওরা ভেঙেছে! ওরা এখানে দাপাদাপি করেছে!

সেই ওরা-দেরই তো দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধের দিকে এখানে ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল?

আজ্ঞে না! বৃষ্টি মাত্র কয়েক ফোঁটা, আর একটু জোরে হাওয়া দিয়েছিল শুধু?

এই সময় একতলায় কে যেন ডেকে উঠল, শশাদা! ও শশাদা! বাবুরা এসেছেন?

দেবলীনা বলল, ওই তো দুর্যোধন! দুর্যোধনের গলা?

রেলিংয়ের কাছে গিয়ে বলল, এই যে, আমরা ওপরে। দুর্যোধন, তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

তলা থেকে উত্তর এল, দিদিমণি, তোমরা এসে গেছ! আমি তোমাদের গাড়ি দেখবার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ!

কাকাবাবু বললেন, ওকে বল, একটা বাতি জ্বেলে নিয়ে ওপরে আসতে। আমাদের গাড়ি দেখতে গিয়ে ও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল!

তারপর তিনি শশাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, গেট বন্ধ থাকতেও আপনার ওই দুর্যোধন আর মনোজবাবু বাইরে চলে গেল কী করে?

শশাবাবু এতক্ষণে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে। সে বলল, বড় গেট তো বরাবরই বন্ধ থাকে, স্যার। পেছন দিক দিয়ে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা আছে।

তা হলে বাইরের যে-কোনও লোকও পেছন দিক দিয়ে এবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে?

বাইরের লোক এদিকে কেউ আসে না, স্যার! আমরা কজন আছি শুধু চাকরির দায়ে।

দেবলীনা একটা ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলে বলল, আমি আর শর্মিলা এই ঘরে ছিলাম। আর পাশের ঘরটায় বাবা।

কাকাবাবু বললেন, দ্যাখ তো ঘরের মধ্যে চেয়ার আছে কি না। তা হলে বারান্দায় একটু বসা যাবে!

ঘরের মধ্যে ঢুকেই দেবলীনা দারুণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কে? ওখানে…ওরে বাবা, ওরে বাবা…

কাকাবাবু এক লাফে দরজার কাছে এসে দেখলেন, ঘরের মধ্যে এক কোণে দুটো আগুনের ভাটার মতন জ্বলন্ত চোখ। তিনি আর মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে পরপর দুটো গুলি চালালেন। সঙ্গে-সঙ্গে একটা পাখির তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল।

শব্দটি শুনেই কাকাবাবু আফশোসের সঙ্গে বলে উঠলেন, ইস, ছি ছি ছি ছি, একটা প্যাঁচাকে মেরে ফেললাম! দেবলীনা, তুই এমন ভয় পেয়ে চ্যাঁচালি, তোর হাতে টর্চ রয়েছে, ভাল করে দেখে নিতে পারলি না?

ঘরের এক দিকের দেওয়াল ঘেঁষা একটা বড় আলমারি, সেই আলমারির মাথায় বসে ছিল প্যাচাটা। কাকাবাবু কাছে গিয়ে দেখলেন, মেঝেতে পড়ে তখনও পাখিটা ছটফট করছে। বেশ বড় আকারের একটা ভুতুমপ্যাঁচা, দুদিকে অনেকখানি ডানা ছড়ানো।

দেবলীনা প্যাঁচাটাকে ধরতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু তাকে সরিয়ে এনে বললেন, এখন আর ওর গায়ে হাত দিস না। মরণকামড় দিতে পারে। ওর আর বাঁচার আশা নেই।

এক হাতে একটা লণ্ঠন, অন্য হাতে একটা লাঠি নিয়ে একজন রোগা, লম্বা লোক ঘরে ঢুকে বলল, কেয়া হুয়া? কেয়া হুয়া?

দেবলীনা বলল, দুর্যোধন, ঘরের মধ্যে একটা মস্ত বড় প্যাঁচা ঢুকে বসে ছিল কী করে?

দুর্যোধন কাছে গিয়ে বলল, আহা রে! এ বেচারি তো ছাদে থাকে!

কাকাবাবু বললেন, বৃষ্টির সময় ঘরে ঢুকে এসেছে। জানলা তো ভোলাই দেখছি। মেঝেতে বৃষ্টির জল গড়াচ্ছে।

দুর্যোধন এগিয়ে এসে ডানা ধরে প্যাঁচাটাকে উঁচু করে তুলল। এর মধ্যেই তার স্পন্দন থেমে গেছে।

দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, দুর্যোধন, মনোজবাবু কোথায়?

মনোজবাবু তো সাতদিনের ছুটিতে গেছেন। কাল বিকেলে আসবেন।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? এই যে শশাবাবু বললেন, কারা সব ওপরে মারামারি করছিল, তাই দেখে তুমি আর মনোজবাবু ভয়ে পালিয়েছ শশাবাবুকে একা ফেলে। তারা শশাবাবুর গলা টিপে ধরতে গিয়েছিল!

দুর্যোধন বলল, শশাদা, তুমি আজ আবার অনেক গাঁজা খেয়েছ?

কাকাবাবু বললেন, হুঁ, নীচের ঘরে সেই গন্ধটাই পেয়েছিলাম!

শশাবাবু বলল, মোটেই খাইনি, দুটো টান মোটে দিয়েছি। তোকে যে দেখলুম দৌড়ে চলে যেতে?

কাকাবাবু বললেন, আপনারা এমন প্যানিক সৃষ্টি করেছিলেন, যার জন্য প্যাঁচাটা মরল। আমি পাখি মারা মোটেই পছন্দ করি না। ভুতুমপ্যাঁচার চোখ অন্ধকারে হঠাৎ দেখলে সবারই ভয় লাগে। …শুধু শুধু দুটো গুলিও খরচ হয়ে গেল!

দুর্যোধন প্যাঁচাটাকে তুলে নিয়ে বাইরে চলে গেল। কাকাবাবু শশাবাবুকে বললেন, আপনি এবার খাবার গরম করুন। কয়েকটা ঘরে তালা বন্ধ দেখলাম। চাবিগুলো কার কাছে আছে?

শশাবাবু টাকমাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, সে-সব ওই দুর্যোধনের কাছে থাকে। আমি রান্নাবান্না করি। দুর্যোধন মিথ্যে কথা বলেছে, ও ভয় পেয়েই পালিয়েছিল! ওপরে ছবির কাচগুলো ভাঙল কে? ফুলদানিটা কি আপনা-আপনি বারান্দায় গড়াচ্ছিল!

একটু বাদে দুর্যোধনকে ডেকে সব কটা ঘরের দরজা খুলে দেখা হল। কোনও ঘরেই অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না। ঘরগুলোতে অনেকদিন ঝাঁট পড়েনি বোঝা যায়। কাকাবাবু প্রত্যেকটি ঘরের ভেতরে ঢুকে পরীক্ষা করে দেখলেন।

দক্ষিণ দিকের একেবারে কোণের ঘরটির সামনে এসে দুর্যোধন বলল, এটা বাবু তোশক-ঘর!

কাকাবাবু বললেন, তালাটা খোলো।

কত্তাবাবুরা এই ঘর খুলতে বারণ করেছেন। এর চাবি আমার কাছে নাই, মনোজবাবুর কাছে আছে বোধকরি।

তোমার কলকাতার বাবু যে আমাদের বলে দিয়েছেন, আমরা এ বাড়ির যে-কোনও জায়গায় থাকতে পারি? আমি এই ঘরটাও দেখতে চাই। মনোজবাবু কি চাবি সঙ্গে নিয়ে গেছেন? তাঁর ঘরে চাবি আছে কি না দেখে এসো?

দুর্যোধন খানিকটা অনিচ্ছার সঙ্গে নীচে চলে গেল।

কাকাবাবু দেবলীনাকে বললেন, এ যেন ঠিক রূপকথার মতন। দক্ষিণের কোণের ঘরে যাওয়া নিষেধ! দারুকেশ্বরও এই ঘরটা সম্পর্কে আমাদের সাবধান করেছিল না রে?

হ্যাঁ, এই ঘরটা! আমরা আগেরবার এসেও এই ঘরটা ভোলা দেখিনি।

দারুকের ওই কথাটা কেন বলেছিল জানিস? যাতে আমরা এই ঘরটাই ভাল করে দেখি। বারণ করলেই বেশি করে কৌতূহল জাগে তাই না?

থাকার জন্য এই ঘরটাই তো সবচেয়ে ভাল মনে হচ্ছে। বারান্দার এই পাশটা থেকে দেখা যায় একটা পুকুর, তার ওপারে একটা শিবমন্দির। বেশ বড় মন্দিরটা, ভেতরে অন্ধকার-অন্ধকার।

পুকুর আছে, বাঃ? এদের কাছে যদি বঁড়শি পাওয়া যায়, তা হলে আমি কাল দুপুরে মাছ ধরতে বসব! আচ্ছা দেবলীনা, এই বাড়িটার উলটো দিকে যে জঙ্গলটি রয়েছে, তার মধ্যে একটা বালির টিলা আছে। তাই না?

জঙ্গলের মধ্যে টিলা আছে? তুমি কী করে জানলে?

তোর বাবার কাছে শুনেছি। তুই সেই টিলাটার ওপরে উঠেছিস?

না তো?

আগেরবার এসে উঠিসনি? সেখান থেকে কি অনেক দূর দেখা যায়?

আমি দেখিনি তো টিলাটা!

দেখিসনি? ও, ঠিক আছে, তুই আর আমি দুজনে মিলে এবারে দেখতে যাব।

এই সময় দুর্যোধন আর-একটি চাবির গোছা নিয়ে এল। তার মধ্যে থেকে একটা চাবি বেছে কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনি খুলুন, বাবু!

কেন, তোমার আপত্তি কিসের?

এই ঘরে আমাদের মেজোরাজাবাবুর মেয়ে চম্পা…সে মরে গেল তো! সোনার প্রতিমা ছিল, বড় সুন্দর ছিল..অনেকটা এই দিদিমণির মতন দেখতে…

কী হয়েছিল তার? আর বাবু বলবেন না সে কথা। মনে পড়লেই বড় কষ্ট হয়। তারপর থেকে মেজোরাজাবাবু আর এলেনই না এ বাড়িতে।

কাকাবাবু তালাটা খুললেন। দুর্যোধনের কাছ থেকে আলোটা নিয়ে পা বাড়ালেন ভেতরে। ঘরটা লেপ, তোশক, বালিশে প্রায় ভর্তি। অনেকগুলো ঘরের বিছানা এখানে জড়ো করে রাখা আছে। খুব ন্যাপথলিনের গন্ধ।

কাকাবাবু বেশ নিরাশই হলেন ঘরটা দেখে। এই? অন্তত কিছু চামচিকেও যদি ওড়াউড়ি করত, তা হলেও গাটা একটু ছমছম করতে পারত।

দেবলীনা আর দুর্যোধন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কাকাবাবু বললেন, এই ঘরটায় শোওয়া যাবে না রে! এখানে যে বিছানার পাহাড়। এত বিছানা সরাবে কে?

দেবলীনাও খানিকটা হতাশভাবে বলল, এ-ঘরে আর কিছু নেই?

কাকাবাবু বললেন, দক্ষিণের কোণের ঘরে শুধু কতকগুলো বিছানা-বালিশ? ছি ছি ছি! চল দেবলীনা, এখানে আর থাকার দরকার নেই।

দুর্যোধন কাকাবাবুদের শোওয়ার ঘরটা খানিকটা গোছগাছ করে দিল। কয়েকখানা চেয়ার এনে পাতা হল বারান্দায়। দেবলীনা ও কাকাবাবু পোশাক বদলে এসে বসলেন সেখানে। এখন দোতলায় একটি জোরালো হ্যাজাকবাতি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আকাশে কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে জ্যোৎস্না। রাত্তিরে আবার বৃষ্টি হবে মনে হয়।

শশাবাবু একটু পরেই খাবার নিয়ে এল ওপরে। ভাত, ডাল, পটলের তরকারি আর ডিমের ঝোল। রান্নার স্বাদ অবশ্য মন্দ নয়। দেবলীনা ডিম পছন্দ করে না, সে বেশি ভাত খেতে চাইল না।

দোতলাতেই বাথরুম, জলের কল আছে, কিন্তু কলে জল নেই। ওপরের ট্যাঙ্কে জল ভরা হয়নি। দুর্যোধন মগে করে জল নিয়ে এসেছে।

হাত-টাত ধুয়ে কাকাবাবু দুশো টাকা বার করে একশো একশো করে দিলেন দুর্যোধন আর শশাবাবুকে। দুজনকেই বললেন, কালই ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করে জল ভরা চাই। ভাল করে বাজার করে আনবে। ডিম দেবে শুধু ব্রেকফাস্টের সময়। দুপুরে মাছ আর রাত্তিরে মাংস। বাজার কত দূরে?

দুর্যোধন বলল, বাজার তো বাবু ছমাইল দূরে। সাইকেলে যেতে হয়।

শশাবাবু মিনমিন করে বলল, আপনি টাকা দিচ্ছেন? বাজারের টাকা স্যার মনোজবাবু দিয়ে গেছেন। অতিথিদের খরচ এস্টেট থেকে দেওয়া হয়। অনেক ডিম আর আলু কেনা আছে।

কাকাবাবু বললেন, টাকাগুলো রাখো তোমাদের কাছে। আমি সঙ্গে কফি এনেছি। শিশিটা নিয়ে যাও, রাত্তির বেলা খাওয়ার পর আমার এক কাপ কফি লাগে।

দুর্যোধন আর শশাবাবু চলে যাওয়ার পর দেবলীনা একখানা বই খুলে বসল। কাকাবাবু চুপ করে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে। চতুর্দিক একেবারে নিস্তব্ধ, তার মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল শেয়ালের ডাক। একটা শেয়াল সামনের জঙ্গলের একদিক থেকে ডাকল, অন্যদিক থেকে আর-একটা শেয়াল যেন তার উত্তর দিল।

একটু বাদে কাকাবাবু বললেন, দেবলীনা, তোকে একটা কথা বলি। আগেরবার যখন এসেছিলি, তখন পর-পর দুদিন তুই মাঝরাতে জেগে উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলি। সেকথা তোর একটুও মনে নেই, তাই না?

দেবলীনা একটু চমকে উঠে বলল, না। বিশ্বাস করো, কিচ্ছু মনে নেই। বাবা আমাকে বলেছিল, কিন্তু আমার নিজেরই তো বিশ্বাস হচ্ছে না। ঘুমের মধ্যে কেউ হাঁটতে পারে? চোখ খোলা থাকে, না চোখ বোজা?

চোখ বুজে হাঁটা অসম্ভব! চোখ খুলেই হাঁটে, তবে ঘুমের ঘোর থাকে। আচ্ছা, সেবারে এসে তুই এখানে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিলি? কোনও কারণে ভয় পেয়েছিলি?

না, কিছু হয়নি। খুব ভাল লেগেছিল। সে জন্যই তো আবার আসতে ইচ্ছে হল।

সেবারে ওই দক্ষিণের কোণের ঘরটা খুলিসনি? চম্পা বলে যে একটি মেয়ে এই ঘরে মারা গিয়েছিল, সেকথাও শুনিসনি?

না, কেউ বলেননি। সেবারে মনোজবাবু অনেক শিকারের গল্প বলেছিলেন আমাদের। মনোজবাবুর সঙ্গেই আমরা জঙ্গলে গেলুম বেড়াতে। এই শশাবাবু অনোজবাবুকে খুব ভয় পায়। মনোজবাবু থাকলে কাছে আসে না।

তা হলে তুই যে সেদিন বললি, তোর মাঝে-মাঝে মনে হয়, কেউ তোকে অতছানি দিয়ে মাঝে-মাঝে ডাকে, তাকে তুই প্রথমে কোথায় দেখলি?

সে একটা মেয়ে, মনে হয় ঠিক আমারই বয়েসি। সাদা ফ্রক পরা। যসি-হাসি মুখে হাতছানি দিয়ে বলে, এসো, এসো। তাকে আমি প্রথমে দেখি, এবাড়ির পেছনে পুকুরের পাশে যে শিবমন্দিরটা, তার দরজার কাছে। আমাকে হাতছানি দিয়ে সে মন্দিরের মধ্যে ঢুকে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে আর তাকে দেখতে পেলুম না। সেবারে তো আমার সঙ্গে আমার বন্ধু শর্মিলা ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলুম, তুই মেয়েটিকে দেখতে পেয়েছিস? ও বলল, কই না তো? তা হলে নিশ্চয়ই আমার চোখের ভুল। কিন্তু সেই মেয়েটিকে আমি আরও তিন-চারবার দেখেছি। কলকাতাতেও দেখেছি। একটা মেয়ে সত্যি-সত্যি আমায় ডাকে, একটু পরেই মিলিয়ে যায়।

কোনও গল্পে এরকম কোনও মেয়ের কথা পড়েছিস? অনেক সময় গল্পের চরিত্রও খুব সত্যি মনে হয়। আমি যখন ছোট ছিলুম, আমার খুব প্রিয় বই ছিল দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নরদাম। ওর মধ্যে কোয়াসিমমাদো বলে যে চরিত্রটা আছে, তার কথা আমি প্রায়ই ভাবতুম, তারপর সত্যি-সত্যি একদিন জগুবাবুর বাজারে যেন মনে হল, কোয়াসিমোলদাকে দেখতে পেলুম ভিড়ের মধ্যে। আর একদিন তাকে দেখলুম ব্যাণ্ডেল চার্চে। একটু উঁকি মেরেই সে পালিয়ে গেল। আরও কয়েকবার এরকম দেখেছি। তোরও সেরকম হচ্ছে না তো?

কী জানি, তা হতে পারে। কিন্তু কাকাবাবু, ওই মেয়েটিকে দেখলে আমার একটুও ভয় করে না। বরং ও কী দেখাতে চায়, সেটা দেখতে ইচ্ছে করে।

ঠিক আছে, আজকের রাতটা ভাল করে ঘুমিয়ে রেস্ট নেওয়া যাক, কাল সন্ধেবেলা আমি তোর ওপর একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।

কী এক্সপেরিমেন্ট?

একসময় আমি শখ করে কিছুটা ম্যাজিক, হিপনোটিজম এই সব শিখেছিলুম। লন্ডনে যখন পড়াশুনো করতে গিয়েছিলুম, তখন একবার ভিয়েনায় বেড়াতে গিয়ে ডঃ যোহান এঙ্গেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি কে জানিস? ফ্রয়েডের নাম শুনেছিস? সিগমুণ্ড ফ্রয়েড মানুষের মনের চিকিৎসার যুগান্তর ঘটিয়ে দিয়ে গেছেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ-যুগের একজন প্রধান মানুষ। ওই যোহান এঙ্গেল হলেন সেই ফ্রয়েড সাহেবের এক মেয়ের ছেলে, সাক্ষাৎ নাতি যাকে বলে! ভদ্রলোক তখনই বেশ বুড়ো, কিন্তু হিপনোটিজম জানেন খুব ভাল। মানুষকে আস্তে-আস্তে ঘুম পাড়িয়ে তার মনের কথা বার করে আনেন। আমি তাঁর চ্যালা হয়ে গিয়েছিলুম কিছুদিনের জন্য। সত্যি হিপনোটাইজ করলে মানুষ ঘুমের মধ্যে এমন সব কথা বলে, যা তার অন্য সময় মনে থাকে না। কাল তোকে আমি হিপনোটাইজ করে দেখব। তুই ভয় পাবি না তো?

না, ভয় পাব কেন?

এই সময় শশাবাবু কাকাবাবুর জন্য এক কাপ কফি নিয়ে এল। দেবলীনার জন্য এক গেলাস দুধও এনেছে।

দেবলীনা দুধ দেখে হেসে ফেলল। বলল, আমি কচি খুকি না কি, যে রাত্তিরে দুধ খাব?

শশাবাবু বলল, খেয়ে নাও দিদিমণি, এখানকার দুধ খুব খাঁটি, কলকাতায় এরকম পাবে না। রাত্তিরে ভাল ঘুম হবে?

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা–শশাবাবু, তুমি এবাড়িতে কতদিন কাজ করছ?

কিছু একটা চিন্তা করতে হলেই শশাবাবু মাথায় হাত বুলোয়। তাতে যেন তার বুদ্ধি নাড়াচাড়া খায়। কয়েকবার মাথায় হাত বুলিয়ে হিসেব করে সে বলল, তা বাবু, হল ঠিক সাতাশ বছর। প্রথমে কাজ পেয়েছিলাম রাজাবাবুদের কটকের বাড়িতে। তারপর বড় রাজাবাবু বুড়ো বয়েসে এই বাড়িতেই এসে ছিলেন, তিনি আমাকে এখানে নিয়ে এলেন। বড় রাজাবাবু তো মারা গেলেন এবাড়িতেই!

রাজারা কভাই ছিলেন?

পাঁচ ভাই। তার মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র দুজন। ছোট রাজাবাবু থাকেন ভুবনেশ্বরে আর মেজো জন কলকাতায়। এখন তো আর প্রায় কেউ আসেই না। শুধু-শুধু বাড়িটা ফেলে রেখেছেন আর আমাদের মাইনে গুনছেন।

বাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছেন না কেন?

এত বড় বাড়ি এই জঙ্গলের দেশে, কে কিনবে? মেজো রাজাবাবু চেয়েছিলেন বাড়িটা গভর্নমেন্টকে দিয়ে দিতে, কলেজ বা হাসপাতাল করার জন্য। ছোট রাজাবাবু তাতে রাজি নন। তাঁর টাকা চাই।

দুই ভাইতে ভাব আছে?

রাজাবাবুদের মধ্যে খুব ভাব। ছোট-রাজাবাবু টাকা চাইলে মেজো রাজাবাবু দিতে কখনও আপত্তি করেন না শুনেছি। বড় রাজাবাবুর ছেলে, তিনিও থাকেন কলকাতা, সেই বড়কুমারবাবুও মেজোরাজাবাবুকে খুব ভক্তি করেন। তবে মেজো রানীমা আর ছোট রানীমার মুখ-দেখাদেখি বন্ধ। একবার হয়েছিল কী জানেন, ছোট-রানীমার এক ভাই এখানে দলবল নিয়ে শিকার করতে এসেছিল। তারপর এই বাড়িতে সে খুন হয়ে গেল!

তাই নাকি? কে খুন করল?

ধরা তো কেউ পড়েনি। লোকে বলে, মেজো রাজাবাবুর ছেলে তখন এখানে ছিল, তার সঙ্গে ওই শালাবাবুর ঝগড়া হয়েছিল খুব, ওই মেজো কুমারটি খুন করেছে।

পুলিশ-কেস হয়নি?

এই সব বড় বড় লোকদের ব্যাপারে কি পুলিশ কিছু করতে পারে, স্যার? গল্প শুনেছি, কয়েক পুরুষ আগে, এই রাজাদেরই বংশের একজন তরোয়াল দিয়ে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের মুণ্ডু কেটে ফেলেছিলেন এক কোপে। তাঁরও কোনও শাস্তি হয়নি। তিনি চলে গিয়েছিলেন গোয়াতে।

এই বাড়িতে তা হলে অনেক রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে বলো!

আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার। রাজারাজড়াদের ব্যাপার, খুন-জখম তো লেগেই ছিল এককালে!

কাকাবাবু দেবলীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, রাজাবাবু, রানীমা, বড়কুমার, এই সব শুনলে কীরকম মজা লাগে, না রে? জমিদারি, নেটিভ স্টেট কবে উঠে গেছে, তবু এখনও অনেকে রাজা রাজকুমার টাইটেল রেখে দিয়েছে। কলকাতার মতন শহরে এই সব লোকেরা পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ পাত্তা দেবে না! সেজোরাজাবাবুর ছেলেই তো তোর বাবার অফিসে চাকরি করে!

শশাবাবু বলল, এখানকার লোকেরা কিন্তু রাজাবাবুদের দেখলেই প্রণাম করে।

কাকাবাবু বললেন, এই বাড়িটায় এলে অনেকটা পুরনো আমলে ফিরে গেছি। মনে হয়।

এই সময় হঠাৎ একটা দরজা খোলার শব্দ হতেই সবাই চমকে তাকাল।

সেই দক্ষিণের কোণের ঘরটার দরজার দুটো পাল্লাই খুলে গেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এল একজন মানুষ। পায়ে বোধহয় খড়ম পরা, খটখট শব্দে এদিকেই এগিয়ে আসতে লাগল।

কাকাবাবু স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য। দক্ষিণের ঘরটা তালা। দেওয়া ছিল, তবে কি তিনি পরে আবার তালা বন্ধ করতে ভুলে গেছেন? কিংবা দুর্যোধনকে বলেছিলেন বন্ধ করতে?

তিনি নিজে ওই ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানা-বালিশ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি। কোনও মানুষজনের চিহ্নই ছিল না। কেউ কি লুকিয়ে ছিল? প্রায় অসম্ভব সেটা। কেউ লুকিয়ে থাকলেও এখন এরকমভাবে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসবে কেন?

রিভলভারটা ঘরের মধ্যে রয়েছে। কাকাবাবু চট করে সেটা নিয়ে আসবেন ভেবেও থেমে গেলেন। যে-লোকটি এগিয়ে আসছে, তাকে এবার অনেকটা স্পষ্ট দেখা গেল। একজন বেশ লম্বা, বৃদ্ধ লোক। মাথার চুল ও মুখের দাড়ি ধপধপে সাদা। মনে হয় কোনও সন্ন্যাসী। লাল টকটকে ধুতি পরা, গায়ে একটা লাল চাদর, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।

কাকাবাবু এক নজর তাকিয়ে দেখলেন, দেবলীনার মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আর শশাবাবু চোখ দুটো গোল-গোল করে বলছে, গু-গু-গু-গু-গুরুদেব?

কাকাবাবু চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কে ইনি? তুমি জানো?

শশাবাবু বলল, রারারারা-জাদের গুরুদেব! মাঝে-মাঝে আসেন। একশো বছরের বেশি বয়েস।

ওই ঘর থেকে কী করে এলেন?

জা-জা-জা-জা-নি না! ওরে বা-বা-বা-বা…

বৃদ্ধটি অনেক কাছে চলে এসেছেন। তাঁর চোখ সামনের দিকে। এই তিনজনকে যেন তিনি দেখতেই পাচ্ছেন না।

কাকাবাবু হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার।

বৃদ্ধটি একটি হাত তুলে কাকাবাবুর দিকে আশীর্বাদের ভঙ্গি করলেন। কিন্তু থামলেন না। আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে নামতে লাগলেন। নীচে যাবার সিঁড়ি দিয়ে। তাঁর খড়মের শব্দ হতে লাগল খট্ খট খট খট।

কাকাবাবুও এমন অবাক হয়ে গেছেন যে, তাঁর গলা দিয়েও আর কোনও শব্দ বেরোল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress