রঙ-বেরঙের পাখিরা সব
১).
একটি কবিতা লিখতে বসে আজ , হঠাৎ একটা প্রশ্ন আমার মাথায় এসে উঁকি দিয়ে গেল।
কবিতা লেখা কি একটা কাজ?
আর দশটা কাজের মতোন। যেমন, আলু-পটল বেচা, চাকরী করা, ডাক্তারী করা, সংসার করা, হিসাব রাখা, কবিতা লেখাও কি তেমন একটা কাজ?
কবি বোর্হেস এই সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন কবিতা লেখা একটা কাজ। একজন মানুষ ঘাড় গুঁজে দিনের পর দিন গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে কাজ করে গেলেন,কিন্তু একবারের জন্যও গ্রহ নক্ষত্রের দিকে তাকালেন না।’
কবি জীবনানন্দ দাশ তার একটা সম্ভাব্য উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন, ‘কবিতার কথা’য়। তাঁর মতে “যেহেতু কবি সকলেই নন, এবং যিনি কবি, তাঁর মানস গঠন যেহেতু বিশেষ, সেহেতু কবির মনে একটা বিষয়ের অভিঘাত যেভাবে তৈরি হবে, যিনি কবি নন তাঁর মধ্যে সেটা হবে না।”
তবে কবিতা যদি প্রত্যক্ষ আনন্দ বেদনা প্রেমের অনুভূতি থেকে জারিত না হয়ে শব্দের ওম থেকে জারিত হয়, বিশেষ কোন দোষ নেই তা’তে। কিন্তু সেটাই যখন একমাত্র কাম্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিশেষ ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে । সেটা এই যে, সমাজে লালন ফকির, হাছন রাজাদের জন্ম নেবার পথটা অমসৃন কঠিন হয়ে পড়ে।
পোনা মাছের ঝাঁক যখন মনে এসেছে তখন জানান দিয়েই হঠাৎ করে পালিয়ে যায়। গান গেয়ে ওঠার যে সহজ-আনন্দের পথ খোলা ছিল লালনের , সেটা রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
এই আধুনিকতা-বাদের প্রবঞ্চনা শুধু এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকারই ক্ষতি করেনি, ক্ষতি করেছে ইউরোপের আমেরিকারও।
বোদলেয়ারের, রিলকে ও মালার্মেকে কেন্দ্র করে ‘বিশেষ কবিতার জন্য’ যে আধুনিক ধারার সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার সমাজে। পরিতাপের বিষয় সেটাই!
যে সমাজ, তাদের নিজস্ব জলবায়ু, জনপদ, তাদের জীবনধারণ, হাসি কান্না প্রেম বেদনার নিজস্ব রকমফের আছে, এবং তা গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছরের এক মানবিক সাধনার পথ ধরে ; সেখানে মানুষের শব্দ-স্বর , গান ও গায়কি ঢঙ , প্রকাশ-ভঙ্গী , ভাষা , রসবোধ , প্রাণ-প্রাচুর্য , সবই আলাদা এবং একেবারেই নিজস্ব , তাদের অর্থনীতির ধরণও একেবারেই আলাদা।
সেই দেশের আধুনিকতার ভাব-ধারা (ধ্যান-ধারণা) সেই দেশের মাটি থেকে তৈরি হবে, সেটাই কাম্য। যে'(ভাবে পারস্যে হয়েছে এবং সেখানে হাজার হাজার ধরে মহৎ কবির জন্ম হয়েছে। আফ্রিকায় আফ্রিক্যানিটি আন্দোলনের সাথে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, সেঙ্ঘর সহ অন্যান্য আরও বড় কবিরা, তাঁরা সবাই ইউরোপীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে, বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, এবং নিজেদের মতোন করে কবিতা লিখেছেন। তাঁরা সব মনে করতেন,
ওই ‘বিশেষ কবিতার জন্য’ যে আধুনিক ধারার – সৃস্টি হযেছে তা’তে, যে’সব বিষয় তাঁদের ভাল লাগে , সে’সব বিষয় নিয়ে তাঁরা প্রকাশ্যে বলতে চান, তা বলতে পারতেন না। তাই সেটা সংশয় এবং সংকোচ হয়ে মর্মে বিঁধে থাকত।
তাই ওঁদের বলতে হতো , যা ওঁদের বলতে বাধ্য করা হতো, শিখিয়ে দেয়া হতো।
২).
রুমি’র “The Garden Of Soul” থেকে –
“Come back my soul,how much longer
will you linger in the garden of deceit?
I have sent you a hundred messages
I have shown you a hundred ways
either you never read them
or you ignore my advice
Come back my soul,don’t waste
time with cold hearted
they don’t know your worth,
Why do you seek water
when you are the stream?…”
” ফিরে এসো হৃদয় আমার , আর কতদিন
তুমি প্রতারণার বাগানে থাকবে?
আমি তোমাকে একশো বার্তা পাঠিয়েছি
আমি তোমাকে একশ পথ দেখিয়েছি
হয় এগুলি তুমি পড়নি
অথবা আমার পরামর্শ উপেক্ষা করেছো
ফিরে এসো আমার আত্মা, নষ্ট করো না
সময় ঠান্ডা হৃদয়ের সাথে
তারা তোমার মূল্য জানে না,
তবু কেন তুমি জল চাও
তুমি যখন নিজেই স্রোত?… ”
এই কবিতাটা শুধুমাত্র আমাদের ভালোবাসাকে সংক্রমিত করলো না, বার বার ফিরে যাবার টানও তৈরি করে রাখলো।
আবার জীবনান্দ দাশ যখন লিখলেন –
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;’
আমাদের ভালোবাসা সংক্রমিত হলো। শুধু তাই নয়, বারবার এই শব্দবন্ধের কাছে ফিরে ফিরে যেতে হলো, এবং এই ফিরে-ফিরে-যাওয়া শব্দবন্ধের শক্তিকে ব্রহ্মময়ী করে তুললো।
নক্ষত্র, রূপালি, আগুন, ভরা, রাত’-এ সবই আমাদের কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কবি তাকে সাজিয়ে তুললেন। এবং শব্দ হয়ে উঠল আকর্ষণী অপরূপ দ্যুতিময়!শক্তিময়! কী কী অসামান্য কল্পনা-জাগানিয়া! প্রতিটি শব্দ নতুন করে প্যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেল। নতুন অর্থ তৈরি হয়ে উঠল তার। এমনতর-কবিতায় আলাদা কোনও ইঙ্গিত না-থাকলেও, জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতার কথা’ অনুযায়ী, ‘তা আমাদের কল্পনার ও সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছে।’
কিন্ত এটা যদি শক্তিমানের হাতে না-পড়ে আনাড়ি শব্দ-কারিগরের হাতে পড়ে, তখন তা হয়ে উঠে শব্দের জঞ্জাল। যেহেতু যে কোনও শব্দের সাথে যে কোনও শব্দ যুক্ত করার অধিকার তাঁর আছে, এবং আলাদাভাবে কবিতায় গভীর কোনও ইঙ্গিত সঞ্চারের দায় থেকে তিনি মুক্ত হলে, তবে তা হয়ে উঠে একটি শব্দ-দানব। এবং শব্দের সাথে শব্দের এতসব বিয়ের আয়োজন সত্ত্বেও শেষে যদি তাকে না দেখায় আত্মবিশ্বাসী, সদা-স্মিতহাস্য সফল ঘটকের মতো। তাতে এ জগতে কার বা কি ক্ষতি? যেহেতু অসফল শব্দ-ঘটকের সংখ্যাই বেশি এবং তাঁদের উৎপাদনই বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান, দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুযায়ী, পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে বৈকি। এটাই হয়ে উঠছে আজকাল কবিতার সাধনা-মার্গের একমাত্র পথ। অন্তত নতুন লিখিয়েরা তাই সার-সত্য ভেবে নিচ্ছে। এভাবেই চলছে অচ্ছেদ্য এক দুষ্টু-চক্র।
তলস্তয় তাঁর ‘What is art?’-র শুরুতেই প্রশ্ন করেছিলেন , ‘যে শিল্পের বেদীতে লক্ষ লক্ষ লোকের শ্রম, মানুষের জীবন, সর্বোপরি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা সবই বিসর্জিত হয় সে শিল্পই ক্রমশ অস্পষ্টতর এবং মানুষের বুদ্ধির কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে।’
সে প্রশ্ন, বিশেষ করে, এখন, এইসব কবিতার শব্দ-জঞ্জাল সম্পর্কে একান্ত ভাবেই প্রযোজ্য বলে মনেহয় আমার ।
এবং আরও বিশেষ করে বললে, প্লেটোর ‘Allegorical cave’এর সেই মানুষদের মতো একটা ছায়া-সত্যকে সত্য জেনে কাটিয়ে দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের লিখিয়েরা। কত মহৎ প্রতিভার সীমাহীন অপচয় ঘটছে তা’তে, তার আর কে হিসেব রাখে !
‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে!’ হায়
কবিতার ঊষালগ্ন থেকে কেন পৃথিবীতে , কিছু কিছু কবিতা সেই হাজার হাজার বছর আগে লিখিত হওয়া সত্ত্বেও কেন পাঠকেরা এত যত্ন করে তা তাদের হৃদয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছে, আর কিছু কবিতা একটা নির্দিষ্ট সময়কে শাসন করবার পর হারিয়ে গেছে পাঠকের মন থেকে। কেন এটা ঘটছে?
ধরা যাক, একজন কট্টর ক্লাসিকপন্থী কবিও যখন হাজার বার শোনা রবীন্দ্রনাথের কোনো গান শুনছেন, তখন হঠাৎ কেন তিনি হঠাৎ আটকে গেলেন মুহূর্তের জালে; এবং তিনি, চেতনে অবচেতনে, কোনো ভাবেই কেন বিবেচনায় আনলেন না এটা রোম্যান্টিক কি মিস্টিক?
এর কারণ খুঁজতে হলে, আমাদের যেতে হবে মানব সভ্যতার চৈতন্যের গভীরে। মানুষ সদা-যুক্তিবোধ দ্বারা চালিত কোনো প্রাণী নয়, তার চৈতন্যে নানা ধরণের বৈপ্যরীত্যের সমাহার আছে। তিনি একাধারে ক্লাসিক, অন্যমনে রোম্যান্টিক, অথবা মিস্টিক, একদিকে তিনি যৌক্তিক, অন্যদিকে তিনি একই সাথে যুক্তির বাইরে আরও এক অতীন্দ্রিয় মরমী জগতের বাসিন্দা।
হয়ত কারও মধ্যে কোনোটা প্রবল, কারও মধ্যে কোনোটা প্রচ্ছন্ন। এবং রোম্যান্টিক, ক্লাসিক-এই শ্রেণী বিভাজনের সোশ্যাল ও রাজনৈতিক কন্টেক্সট একটা আছে বৈকি, কিন্তু বাস্তবতা এই যে, ওয়াল্টার পিটার যেভাবে বললেন, ‘রোম্যান্টিসিজম কোনো বিশেষ যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা একটা বিশেষ ধরণের প্রবণতা মাত্র যেটা সব যুগেই কিছু কিছু দেখা যায়।’
আমরা যদি ইয়েটসের পরিণত কবিতাগুলি লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, সেগুলো রোম্যান্টিকতার ওম থেকে জাড়িত। সম্প্রতি সমালোচকরা , এলিয়টের ‘Waste land’ এর মধ্যেও অনেকে রোম্যান্টিসিজমের ছায়া খুঁজে পেয়েছেন। যাঁরা দাবি করেন ১৯২২ সালেই রোম্যান্টিক ধারার কবিতার অপমৃত্যু ঘটে গেছে তাঁদের এই ধারণাটাই এক ধরণের রোম্যান্টিক ধারণা।
এলিয়ট তাঁর ‘Tradition and the individual talent’ এ আমাদের জানান, ‘কবিতা তাঁর কাছে আবেগের বাঁধন আলগা করা নয়, বরং আবেগ থেকে মুক্তি।’ এলিয়টের এই ধারণার সাথে মানব চৈতন্যের গভীর মনস্তত্ত্বের একটা সুস্পষ্ট বিরোধ আছে।
আমরা যে পরীক্ষায় নেমেছিলাম, উপরোক্ত কবিতায়, শব্দ-বন্ধন কীভাবে আমাদের ভালোবাসাকে সংক্রমিত করল, তা নিয়ে। উপরোক্ত শব্দ-বন্ধ, চেতনে-অবচেতন মনে, আমাদেরকে এক মিস্টিক জগতে নিয়ে ছেড়ে দেয়। যেখানে আমরা মূক ও বিবশ হয়ে পড়ি। এই মিস্টিক জগৎ ধর্ম অধর্মের বাইরের জগৎ। যেখানে মানুষ অন্তর্জগতে লীন হয়ে মুক্তি পায়।
৩).
এই সমস্ত জগতের গভীরে যে ইঙ্গিত বয়ে চলেছে ক্ষুদ্র থেকে মহতের দিকে, তার সুরটা মূলত মিস্টিক। এ’কথা মিথ্যে নয় , জগতের সৃষ্টি প্রলয় সব কিছুকেই আশ্রয় করে আছে দুঃখের সমুদ্র। তার শুরু কিংবা শেষে সমস্ত ব্যাপারটা মধ্যেই এক মহা-ট্র্যাজিক সিম্ফনি বেজে চলছে নিরন্তর। সব আনন্দেরই শেষ পরিণতিতে থাকে দুঃখ।
‘কোথায় ব্যথা নেই এ-পৃথিবীতে!’ (জীবনানন্দ দাশ)। কবির মতো বিস্ময়বোধ – কি আমাদেরও বিস্মিত করে না?
কিন্তু ক্লাসিকদের সাথে মিস্টিকদের অন্যতম পার্থক্য নিহিত রয়েছে , দুঃখকে দেখবার এবং গ্রহণ করবার উপলব্ধি থেকে । মিস্টিকরা দুঃখকে দুঃখের বাইরে নয়, গভীরে নিয়ে গিয়ে এক অন্তর্হিত সত্যে, সেটাকে তা’রা আনন্দের মুখোমুখি করে তোলেন। তাই সমস্ত জগৎ তাঁদের কাছে অনিঃশেষ এক আনন্দময় ঘনছায়া।
আর ক্লাসিকপন্থীরা দুঃখের এই সত্যকে গ্রহণ করেন প্রত্যক্ষভাবে। প্রত্যক্ষের শক্তি আছে, কিন্তু মূক ও বিবশ করে তোলার সামর্থ্য নেই।
তবু নির্নিমেষ ট্রমার মধ্যে মানুষের, সমস্ত সৃষ্টির, এই-সরল-স্বাভাবিক প্রাণ এই-যে এমনভাবে বয়ে চলছে, যার শুরু থেকে শেষ অব্দি পাতা রয়েছে এক মহা-প্রতারণার ফাঁদ , তাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে , নিরাসক্তভাবে দেখার দায়টা যেমন জরুরী , তেমনি জরুরী আসক্তভাবে তাকে উপভোগের ও উদযাপনের। এই উদযাপন এই কারণে নয় যে , তাতে বেঁচে থাকাটা সহজ ও সহনীয় হয়ে ওঠে , সেই উদযাপনের অন্যতম প্রধান কারণ , জগতের সমস্ত শব্দ ও বস্তুর আড়ালে দৃশ্যমান সত্যের বাইরে আরও এক নিবিড় সত্য বিদ্যমান আছে। তা প্রকাশের মাধ্যম যে-ভাষা , তা শুধু সীমাবদ্ধই নয়, সোস্যুরের ভাষা-দর্শন অনুযায়ী তা , ‘শব্দ ও অর্থের দিক থেকে এক গভীর অনির্ণেয়ক সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ,এবং সেই সম্পর্ক আর্বিট্যারি।’
সেটা অনুভবের মাধ্যম যে-আমাদের-চর্মচক্ষু তার সীমা শুধু নির্দিষ্টই নয় , আর তা , তার-চেয়েও বেদনার ব্যাপার এই-যে , তা সর্বমানস-অগম্য।
এই মিস্টিসিজম ধর্ম অনুষঙ্গের বাইরের মিস্টিসিজম , যেখানে সর্ববস্তুই যে-সত্যে বাঁধা পড়ে আছে , সেটা তার দৃশ্যমান অস্তিত্বকে জিয়িয়ে রাখে। জীবনান্দ দাশ লিখেছিলেন ,
‘খুব গভীরতম বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুইই আমাদের ক্ষতি করে গেছে। ’
কবিতার অনবদ্যতা নিয়ে জীবনানন্দ দাশের উত্তর যথার্থ।
‘কবিতায় যা প্রকাশ করা যায় অন্য কোনোভাবে তা যেহেতু প্রকাশযোগ্য নয়, সুতরাং শিল্প হিসাবে কবিতা অনবদ্য।’
কবির দায় থাকতে পারে একটা কবিতাকে কবিতা করে তোলার দায় , দায় থাকতে পারে তাঁর কবিতা দিয়ে মানুষের ভালোবাসাকে সংক্রমিত করবার দায় , তাকে অনির্বচনীয় করে তোলবার দায় , শব্দ এবং স্বরের ব্যাপারে সময়ের ক্লিশেগুলি থেকে বেরিয়ে আসবার দায় , কিন্ত কেন তাঁকে আধুনিক হবার দায় বহন করতে হবে?
কেন তাঁকে পশ্চিমের এই তকমাবাজির পিছে ছুটতে হবে? কেন তাঁকে তত্ত্বের অনুগামী হয়ে অধ্যাপকের গবেষণার টেবিলে মালার্মের কবিতার মতো মৃতপ্রাণ কবিতা হিসাবে টিকে থাকার রাজনীতি করতে হবে?
৪).
কেন কবিতার এই বিশেষ প্রবণতাটি প্রধান হয়ে উঠল , তার উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে , আধুনিকতার সাথে যে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি এক গভীর অন্বয়ে বাঁধা পড়ে আছে , সেখানে। এই দুষ্টু-চক্র কীভাবে সভ্যতার এই সময় গ্রন্থিতে প্রধান স্থান অধিকার করে নিলো। এর পেছনে সমাজের পুঁজি-ব্যবস্থা কী গভীর ভাবেই না জড়িত! আধুনিকতার এই তথাকথিত প্রবণতার লক্ষ্য আর কর্পোরেট পুঁজির লক্ষ্য অভিন্ন। দুটোই অর্জন করতে চায় , সংস্কৃতির সব বৈচিত্র্যের বিলোপ করে দিয়ে , সর্বোচ্চ সাধারণ এক-রঙা এক অপসংস্কৃতি। পৃথিবীর এতসব বিচিত্র জাতিগোষ্ঠী-এতসব বিপুল বিস্ময়কর সংস্কৃতি , সংগীতন, সুর আর আনন্দ নিয়ে যারা তাদের মতো করে সুন্দর হয়েছিল , কর্পোরেট পুঁজি সেখানে ঢুকে গিয়ে তাদেরকে হীনম্মন্য করে তুললো। তারা তাদের সুন্দরকে লুকিয়ে রেখে, তাদের শেখানো সুন্দরকে , সুন্দর বলতে শিখাল। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে থাকল হাজার হাজার বিস্ময়কর বৈচিত্র্য- কী ভাষায়, কী ভাবে, কী কবিতায়, কী সংস্কৃতিতে- সর্বত্র।
আমাদের দাবী –
‘রঙ-বেরঙের পাখিরা সব অনায়াসে
ডানা মেলুক আজ খোলা আকাশে।’
পারস্যের কবিরা কবিতা বলতে বুঝতেন, ‘কিভাবে বলা হচ্ছে, কী বলা হচ্ছে, এবং তা মানুষকে খুব গভীরে কোথায়ও যুক্ত করছে কি-না। ’
এবং পারস্যে এই যে হাজার হাজার মহৎ কবির জন্ম এবং তাঁদের মহত্তম কবির এবং কবিতার সংখ্যা এত বিপুল যে , সেখানে কোনও জাতীয় কবির ধারণাই তৈরি হতে পারল না।
গ্যেটে থেকে শুরু করে পাউলো কোহেলো পর্যন্ত ঋণ স্বীকার করেছেন পারস্যের কবি ও কবিতার কাছে। পূর্ব-য়ুরোপ ,তুরস্ক ,আলবেনিয়ার অনেক বড় বড় কবিদের ওপর ছিল তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রভাব।
আর ভারত উপমহাদেশের গালিব , ইকবালের উপর পারস্যের প্রভাব তো সর্বজনবিদিত।
হোমারের ইলিয়াড ওডেসি’র দু’য়ে মিলে যে আয়তন, ফেরদৌসের ‘শাহনামা’-র তার তিনগুণ বেশী আয়তনে এবং উপস্থাপনায় তার চেয়ে ঢের বেশী আকর্ষণীয়।
এবং রুমি’র ‘মসনবি’ কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই এখন পর্যন্ত।
হাফিজের ‘ডিভান (কবিতার বই)’ ছিল গ্যেটের কাছে ‘পবিত্র গ্রন্থ’। সাদির ‘গুলিস্তাঁ এবং বুস্তাঁ’ ছিল সর্বজন পাঠ্য। এবং এ প্রশ্ন অনেকেই করে গেছেন, নিজামি’র ‘শিরি ফরহাদ’ কেন ‘রোমিও জুলিয়েট’ থেকে মহত্তর নয়? তার কোন যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর পাওয়া যায়নি।
আরবি এবং ফার্সি কবিতার এতসব প্রাচুর্য বাদ দিয়ে আমরা যদি শুধুমাত্র আঙ্গিকটাও দেখি, কত সব বিচিত্র আর অসামান্য আঙ্গিক সব সেখানে! হাজার বছর ধরে মানুষ তন্নিবিষ্ট হয়ে ছিল সেসব আঙ্গিকে।
রুবাই, কাসিদা, গজল, মসনবি, কিতা, বিনো রাইম, মুখাম্মাস এবং আরও অনেক উজ্জ্বল ধরণ ছিল কবিতার। রুবাই ছিল চার লাইনের কবিতা। প্রথম তিন লাইন হচ্ছে চতুর্থ লাইনের প্রস্তুতি।
চতুর্থ লাইনটাতে থাকত জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের সাথে মানুষকে যুক্ত করে দেবার লাইন।
চিনের কবিতার ইতিহাস আরও সুপ্রাচীন।
খ্রীষ্টের জন্মের কত শত বছর আগে থেকে ওদের ওরাল ট্র্যাডিশন শুরু! আজকের দুর্দৈবের কালে যে বিষয়টা মানুষের প্রধান মনোযোগ পাবার কথা, চিনের প্রাচীন কবিরা তাকেই তাঁদের কাব্যসাধনায় ধ্যানের বিষয় করে তুলেছিলেন।
তাঁরা এই মহাবিশ্ব, মানুষের চৈতন্য এবং ভাষার মধ্যে এক অখণ্ড ঐক্যের সুর খুঁজে পেয়েছিলেন। ধ্যান যেমন মানুষের আত্মদর্শন ঘটায়, একটা সার্থক কবিতার পাঠও মানুষকে আয়নায় দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখানে নিজের সাথে নিজের সত্যিকারের এক যোগ-সূত্র তৈরি হয়, এই ছিল তাঁদের কবিতার নন্দন-তত্ত্ব।
আফ্রিকার কবিতার আদলটা ছিল পশ্চিম থেকে একেবারেই আলাদা । আফ্রিকানরা শিল্প বলতে, পশ্চিমের মতো, প্রকৃতির অনুকৃতিকে বোঝেননি। তাঁরা বুঝেছিলেন, জগতের গভীরে যে সত্য রয়েছে, তার সাথে শিল্পীর সংবেদনশীল মনের প্রত্যক্ষ যোগ, এবং তার মধ্যে দিয়ে জগতকে বুঝে ওঠা এবং ব্যাখ্যা করার ব্যপার। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যায় ,আফ্রিকার পরাবাস্তববাদ ইউরোপের পরাবাস্তববাদ থেকে আলাদা, অনেকটা আরবি ফার্সি সাহিত্যের মিষ্টিসিজমের মতো। সেঙ্ঘর বললেন, ‘ইউরোপের সুররিয়ালিজম হচ্ছে অভিজ্ঞতাবাদের সুররিয়ালিজম, আফ্রিকার সুররিয়ালিজম মিস্টিক।’
তাঁদের কবিতার মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য সংগীতময়তা! যেমন ছিল তিরিশ-পূর্ব আমাদের বাংলা কবিতায়।
সেক্সর বলতেন, ‘একটা কবিতা তখনই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন তা একাধারে, সংগীত, বাণী এবং সুরের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
ইউরোপ প্রভাবিত আধুনিক কবিতাকে তিনি ‘এন্টি-পোয়েম’ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,‘কবিতাকে তার উৎসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, যখন কবিতা গীত হতো এবং মানুষ তার সাথে নাচত, যেমনটা দেখা গেছে গ্রীসে, ইসরায়েলে, ফারাওদের মিশরে এবং আফ্রিকায়।’
আফ্রিকাতে কবিতার ব্যাপারে সবচেয়ে প্রচলিত বক্তব্যটা ছিল এমন, ‘যে বাণী-বন্ধ হৃদয় এবং কর্ণকে আনন্দিত করে, তা-ই কবিতা।’
আর লাতিন আমেরিকার কবিতা তো সুঘ্রাণে ভরা এক গোলাপ বাগান, যে-গোলাপ কণ্টকাকীর্ণ। একটা মহাদেশের দেশগুলোর সীমারেখার যখন ভারচুয়াল বিলুপ্তি ঘটে শুধু এ’কারণে যে, সেখানকার সব মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম অকহতব্য শ্রীহীন রক্তাক্ত এক অপমানের জীবন বয়ে চলেছে, তার যোগসূত্র ধরে, তখন সেখানকার কবিতা ও কবিতার নন্দন যে, দেশের সীমা ছাড়িয়ে, মহাদেশের সীমা ছাড়িয়ে,পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কবিতা হয়ে উঠবে, সেটা মোটেও বিস্ময়কর নয়। যেমন হয়ে উঠেছে ওদের কথাসাহিত্য। আর লাতিন আমেরিকার কবিতা হয়ে উঠেছে,খনি শ্রমিক থেকে শুরু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শসা ফেরি করা ছেলেটির মুখের গান। তার মন -প্রাণ খুলে গাইবার গান।
এমনও হয়েছে, ফুয়েন্তেসের এক অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, খনি শ্রমিকরা কাজ শেষে গোল হয়ে বসে যে গান গাইছে, সে-গান পাবলো নেরুদার গান অথচ তারা জানেই না এ-গান কেউ লিখতে পারে। তারা জানে এ-গান তাদের গান। এ-গান তারাই গায়। এর বাইরে রয়েছে সেইসব আদিবাসী বা বেদুইনদের গান, যেখানে সভ্যতার আলো তা’রা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় স্তিমিত করে রেখে, নিজেদের গান গেয়ে চলছে, সে’সব কত বিপুল, বিচিত্র এবং অনবদ্য!’
এই-যে এত বিপুল বিচিত্র কবিতা ও তার নন্দনতত্ব , সারা বিশ্বব্যাপী এত উজ্জ্বল এত দ্যুতিময় হয়ে মানুষকে , তার বেঁচে থাকাকে , তার সীমাহীন বেদনার জীবনকে, অপার আনন্দের জীবনকে , অপমান ও নিরানন্দের জীবনকে এক গভীর বিস্ময়ের সাথে যুক্ত করে রেখেছে , সেখান থেকে যদি ক্ষমতা ও পুঁজির রাজনীতির কারণে ইতিহাসের কোন এক বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ কবিতার লক্ষণ সারা বিশ্বময় এক বিশেষ তকমার আড়ালে পড়ে প্রধান হয়ে ওঠে এবং বিশ্ব-শাসন করতে থাকে , তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, তাতে করে সমস্ত পৃথিবী শুধু যে এক অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয় শুধু তাই নয়, সত্যিকারের কবি-প্রাণ প্রকাশিত হবার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। নতুন কোনো লালন ফকির বা হাসন রাজার জন্মলাভের সম্ভাবনা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কবিতার বিস্তীর্ণ কানন ভরে ওঠে শব্দের জঞ্জালে। জাতকের সেই বিখ্যাত গল্পটা তখন উলটো করে বলতে ইচ্ছে হয়, একদিন এক পাহাড়ে অনেক ধরণের পাখি বসে ছিল। সূর্যের আলোয় তাদের সবাইকে সোনালী লাগছিল। তারা আলাদা করে, নিজের রঙে প্রকাশিত হবার তাগিদে পাহাড় ছেড়ে উড়ে গেল আকাশে । এই ছিল জাতকের গল্প।
আর আমাদের সংস্কৃতির বাস্তবতা এখন ঠিক তার উলটো দিকের অবস্থানে।
এতদিন এতসব বিচিত্র রঙের পাখিরা আকাশে উড়ছিল আনন্দে। তারা সবাই আজ পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা সোনালী রঙ পাবার জন্য আকাশ ছেড়ে , নিজেদের রঙ ছেড়ে পাহাড়ে এসে জড়ো হয়ে বসেছে। তাই সোনালী রঙে ঢাকা পড়ে গেছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব রঙের সৌন্দর্য। শুরু হলো আকাশের দুঃখের দিন, পাখিদের দুঃখের দিন। আর শুরু হলো আমাদেরও মতোন সংস্কৃতি-প্রেমীদেরও বিষাদের দিন।
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত ]
————————————————
* ঋণ স্বীকার – নাসিরুল ইসলাম।