অষ্টম পরিচ্ছেদ – ইনি স্বয়ং
এই সময়ে একজন লোক সদম্ভপদক্ষেপে সেই গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। তাহার বেশ রাজপুত ভদ্রলোকের ন্যায়। আকার-প্রকার দেখিলে বোধ হয়, তিনি কোন উচ্চ-বংশ সদ্ভূত। গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইয়াই নবাগত ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে হে?”
কর্কশস্বরে আগন্তুক যুবা জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”
দুইজনে এইরূপভাবে বাগ্-বিতণ্ডা হইতেছে, এমন সময়ে সভয়ে ক্ষীণস্বরে অজয়সিংহ নবাগত ব্যক্তিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আমি তোমায় চিনি, তোমার মুখ দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। তোমার বাপের মুখখানি ঠিক যেন তোমার মুখে বসান’ রয়েছে। যদি তারা তোমার কাছে যথাসময়ে উপস্থিত না হ’য়ে সংবাদ দিতে না পেরে থাকে, তাহলেও আজ ভগবান তোমায় এখানে এনে দিয়েছেন। তোমার নাম রায়মল্ল না হ’য়ে যায় না। নিশ্চয় তুমি সেই স্বনামখ্যাত গোয়েন্দা-সর্দ্দার রায়মল্ল।”
রায়মল্ল সাহেব হাসিয়া অজয়সিংহকে প্রণাম করিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ লোকটা কে?”
অজয়। যাক্, যা’ হয়ে গেছে, তা’ হয়ে গেছে। লোকটা প্রবঞ্চক। কি আশ্চর্য্য। তোমার নামে নিজ-পরিচয় দিচ্ছিল।
রায়মল্ল সাহেব যেন কথঞ্চিৎ ক্রুদ্ধ হইয়া উত্তর করিলেন, “বলেন কি? আমার নামে পরিচয় দিচ্ছিল? তবে ত বাস্তবিকই লোকটা কে তা’ দেখা আবশ্যক। “
এই পৰ্য্যন্ত বলিয়াই আগন্তুক যুবাকে ভাবিবার সময় না দিয়াই তাহার দাড়ী গোঁফ ধরিয়া রায়মল্ল সাহেব সজোরে এক টান মারিলেন। পরচুলের দাড়ী গোঁফ খুলিয়া যাওয়ায় রঘুনাথের মূর্ত্তি ধরা পড়িল।
চমকিতনেত্রে অজয়সিংহ সেই মুখপানে চাহিয়া বলিলেন, “কি রঘুনাথ! তোমার এই কাজ! উঃ কি বিশ্বাসঘাতক—“
রায়মল্লের নাম শুনিয়াই ভয়ে রঘুনাথের আত্মাপুরুষ যেন উড়িয়া গিয়াছিল। সে যে-কোন উপায়ে হউক, পলাইবার চেষ্টা দেখিতেছিল। রায়মল্ল সাহেব যখন তাহাকে টানিয়া তাহার পরচুলের দাড়ী গোঁফ খুলিয়া ফেলিলেন, সেই টানাটানির সময়ে, রঘুনাথ তাঁহার হাত ছাড়াইয়া পলায়ন করিল। জোর করিলে যে, রঘুনাথ পলাইতে পারিত তাহা নয়; তবে যে কেন রায়মল্ল গোয়েন্দা তেমন দুৰ্দ্দান্ত দস্যুকে হাতে পাইয়াও ছাড়িয়া দিলেন, তাহার একটি বিশেষ কারণ ছিল। রঘুনাথের ধরা পড়িবার তখনও সময় হয় নাই।
রঘুনাথ রায়মল্লকে চিনিতে পারিল না। তাহার কারণ, তিনি তখন ছদ্মবেশী প্রতাপ ত নন্। কেবল বেশের ভিন্নতা কেন, কণ্ঠধ্বনিও পরিবর্তিত। সে সকল পরিচয় দেবার প্রয়োজন ছিল না বলিয়া, রায়মল্ল রঘুনাথের নিকটে প্রতাপের নাম বা তাহার কথা উত্থাপন করিয়া কোন ঘোর-ঘটা করিলেন না।
রঘুনাথ পলায়ন করিলে রায়মল্ল সাহেব স্থির-ধীর গম্ভীরভাবে অজয়সিংহের শয্যাপার্শ্বে সমাসীন হইলেন; পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি, আমার সহিত সাক্ষাতের বাসনা করেছিলেন?”
অজয়। তোমায় কে বলিল?
রায়মল্ল। সে কথা এখন না-ইবা শুনলেন?
অজয়। তারার সঙ্গে কি তোমার দেখা হয়েছিল?
রায়মল্ল। হয়েছিল।
অজয়। কোথায়?
রায়মল্ল। তারা এখন রঘু ডাকাতের অধীনে বন্দিনী।
অজয়। বন্দিনী! কি ভয়ানক! তবে তোমার সঙ্গে তার কি উপায়ে দেখা হ’ল?
সংক্ষেপে রায়মল্ল সাহেব সমস্ত কথা বিবৃত করিলেন।
ব্যাকুল হইয়া কাঁদিয়া অজয়সিংহ বলিলেন, “আহা বাছা! আমার জন্যই তোমার অমূল্য জীবনরত্ন নষ্ট হ’ল। হায়! আমি কি করলেম—কেন অভাগিনীকে যেতে দিলেম–“
রায়মল্ল সাহেব অজয়সিংহকে সান্ত্বনা করিবার প্রয়াস পাইতে লাগিলেন! কাঁদিতে কাঁদিতে অজয়সিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “রঘু ডাকাত কে?”
রায়মল্ল। যাকে এইমাত্র দেখলেন।
অজয়। রঘুনাথ কি এখন দস্যুদলে মিশেছে?
রায়মল্ল। মিশেছে কি! ঐ ত পাহাড়ী ডাকাতের দলের সর্দ্দার! ওর দলকে দলশুদ্ধ ধরিয়ে দেবার জন্যই ত আমি কোম্পানী বাহাদুর কর্তৃক নিয়োজিত হয়েছি।
অজয়। আমার তারার তবে কি হবে? তাকে কি খুন ক’রে ফেলবে?
প্রশান্তচিত্তে রায়মল্ল সাহেব উত্তর করিলেন, “আপনি চিন্তিত হচ্ছেন কেন? তারার একগাছি চুলও কেউ ছুঁতে পারবে না। আমার প্রাণ যায় সেও স্বীকার, তবু তারার কোন অমঙ্গল হ’তে দিব না। তারার মুখেই আমি আপনার সব কথা শুনেছি—”
রায়মল্লের উক্তি সম্পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা না করিয়াই অজয়সিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি তাহাকে এমন ঘোর বিপদে রেখে ছেড়ে চলে এলে কেন? তাকে নিয়ে এলে না কেন? না জানি, হতভাগিনী কত যাতনাই ভোগ করছে!”
ঈষদ্ধাস্যে রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “আমার উপরে যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, তা’ হলে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তারার কোন বিপদ্ হয় নি—হবেও না—তার বিপদ্ হ তেই পারে না। এখন আপনি যদি আমায় কিছু বলতে চান্ তবে শীঘ্র ব’লে ফেলুন;আর আমার বেশি দেরী করবার সময় নাই। “
অজয়। এত তাড়াতাড়ি কেন?
রায়মল্ল। মনে রাখবেন, আপনার তারা এখন দস্যুহস্তে বন্দিনী—রঘুনাথও অপমানিত হয়ে রেগে ফিরে যাচ্ছে। আমারও সেখানে এখন উপস্থিত থাকা আবশ্যক। কি জানি, যদি তারার কোন বিপদ হয়।
অজয়। সে কথা সত্য। অনেক কথা তোমায় বলতে হবে—অনেক সময় লাগবে। তুমি ভিন্ন এই পিতৃ-মাতৃহীন বালিকার প্রাপ্য সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে আর কেউ সমর্থ হবে না।
রায়মল্ল। কোন্ অনাথা বালিকার কথা বলছেন?
অজয়। আমার পালিতা কন্যা ঐ তারার কথাই বলছি।
রায়মল্ল। আমার প্রাণ দিলে যদি আপনার কোন উপকার হয়, তাও আমি করব। শুনেছি, আপনি একবার আমার পিতার জীবন রক্ষা করেছিলেন। আমি অকৃতজ্ঞ নই, যদি পারি, সে পিতৃঋণ পরিশোধ করব।
অজয়। তুমিই পারবে, অন্য লোকের সাধ্য নয়। তারা আমার, অতুলসম্পত্তির অধিকারিণী;কিন্তু তারার স্বত্বপ্রমাণার্থে যে যে কাগজপত্র বা দলিল-দস্তাবেজের প্রয়োজন, সে সমস্ত খোয়া গিয়াছে। রায়মল্ল। আপনি কেমন ক’রে জানলেন যে, যারা এখন তারার বিষয় নির্বিবাদে ভোগ দখল করছে, তারা সে কাগজ-পত্র নষ্ট করেনি?
অজয়। না-না তা’ পারবে না। সে সব কাগজপত্র নষ্ট করলে, যারা এখন তারার বিষয়সম্পত্তি ভোগ দখল করছে, তাদের আর সে অধিকার থাকবে না।
রায়মল্ল। তা’ আপনি এতদিন এ কথা কারও কাছে প্রকাশ করেন নাই কেন?
অজয়। এতদিন চেষ্টা করলে কোন ফল হত না। এখন যে সুযোগ পেয়েছি, এ সুযোগ পূর্ব্বে ছিল না। সম্প্রতি আমি কতকগুলো কাগজ-পত্র ও দুই-একটা এমন সন্ধান পেয়েছি, যাতে আমার মনে অনেকটা আশা হচ্ছে—তোমার মত লোক এ কাজে হাত দিলে অভাগিনী আপনার ন্যায্যপ্রাপ্য সম্পত্তি পুনঃপ্রাপ্ত হবে।
রায়মল্ল সাহেব আর অধিক সময় ব্যয় করিতে না পারিয়া অতিশয় ব্যস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আমি আর অপেক্ষা করিতে পারি না।”
অজয়সিংহ মঙ্গলকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মঙ্গল! আর আমি কতক্ষণ বাঁচব?” মঙ্গল। এখনও অনেক বৎসর।
অজয়। আমায় প্রবোধবাক্যে সান্ত্বনা করবার কোন আবশ্যক নাই—সত্য বল।
মঙ্গল। সত্যই বলছি, যদি পাহাড়ী গাছপালার রসের কোন গুণ থাকে, আর আমার বৃদ্ধ বয়সে নাড়ীজ্ঞান যদি পরিপক্ক হ’য়ে থাকে, তা’ হলে আমার কথা ঠিক খাবে। আমি নিশ্চয় বলছি, আপনি এখনও অনেক দিন বাঁচ্বেন।
অজয়সিংহ আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন, “তবে যাও রায়! স্বকার্য্যসাধনে অগ্রসর হও। তারাকে দস্যুগণের কবল হইতে উদ্ধার কর। তোমার কার্য্য উদ্ধার হ’লেই আমার কাছে ফিরে এস। আমি তোমায় সে সব গুপ্তকাহিনী বলব।”
রায়মল্ল সাহেব এত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন, যে, এ সকল কথার কোন উত্তর না দিয়াই তিনি প্রস্থান করিলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, তিনি রঘুনাথের পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইবেন; কিন্তু ঘটনাচক্রে তাহার অন্যথা হইয়া পড়িল।
পথে অন্য কার্য্যে রঘুনাথের কিছু বিলম্ব হইয়াছিল। সে বিলম্বের কারণ রায়মল্ল সাহেব জানিতেন তাই তিনি অজয় সিংহের সহিত দুইচারিটী কথা কহিতে অবসর পাইয়াছিলেন। পার্ব্বতীয় পথে অশ্বারোহণে তিনি অত্যন্ত দ্রুতগমন করিতে পারিতেন;সুতরাং তাঁহার কিছু বিলম্ব হইলেও রঘুনাথের পূর্ব্বে তিনি উপস্থিত হইতে পারিয়াছিলেন।
যে স্থানে তারা বন্দিনী ছিল, তাহার কিয়দ্দূরে একটি ক্ষুদ্র জঙ্গলের নিকটে তিনি অশ্ব-গতি রোধ করিলেন। তৎক্ষণাৎ সেই বনমধ্য হইতে কৃষকবেশী একটি লোক বাহির হইয়া অসিল। রায়মল্ল সাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রঘুনাথ ফিরে এসেছে?”
কৃষকবেশী সেই ব্যক্তি বলিল, “না।”
রায়মল্ল। ঐ দূরে অশ্বের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বোধ হয়, রঘুনাথ আছে। সত্বর আমার ছদ্মবেশ আমায় দাও, আর ঘোড়াটিকে নিয়ে যাও।
সে লোকটী তাহাই করিল। দু-চার মিনিটের মধ্যে রায়মল্ল সাহেব বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া লইলেন। সে লোকটী তাঁহার পরিত্যক্ত বসন ও অশ্বটী লইয়া বনের ভিতরে চলিয়া গেল। প্রতাপের বেশে রায়মল্ল সাহেব দ্রুতপদে শিবিরে উপস্থিত হইয়া অন্যান্য নিদ্রিত দস্যুগণের এক পার্শ্বে শয়ন করিলেন।
এরূপ অল্প সময়ের মধ্যে আশ্চর্য্য ব্যাপার সম্পাদন করা গোয়েন্দা সদার রায়মল্লেরই সাজে। অশ্বারোহণে পার্বত্যপথে অবাধে অতিক্রম করা, পথিমধ্যে ছদ্মবেশ পরিত্যাগ ও পরিধান করা, বিষম শত্রুকে সামনাসামনি উপস্থিত হইয়া চমকিত করা, তিনি ভিন্ন অন্য কাহারও সাধ্যায়ত্ত নয়। অনেক বিবেচনা করিয়া কোম্পানী বাহাদুর তাঁহাকে এত সম্মানসহ রাখিয়াছিলেন এবং উচ্চপদ প্রদান করিয়াছিলেন।