ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – রক্ষাকৰ্ত্তা
সহসা বজ্রপতন হইয়া যদি সেই স্থলে একজনের মৃত্যু হইত তাহা হইলেও দস্যুগণ এত চমকিত হইত কি না সন্দেহ; কিন্তু সে কোথা হইতে কথা কহিতেছে, জানিতে না পারিয়া তাহারা আরও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল।
দস্যুগণ বড় বিচলিত হইল বটে, কিন্তু তারার মনে অপার আনন্দ। এত সহজ উপায়ে তাহার কাৰ্য্যসিদ্ধি হইল দেখিয়া, সে নিশ্চিন্ত হইল।
রঘুনাথ তখন এক-এক করিয়া প্রত্যেকের সম্মুখে উপস্থিত হইল, প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এ কথা বলেছ?” কেহই স্বীকার করিল না। অবশেষে রঘুনাথ প্রতাপের নিকটে উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “প্রতাপ, তবে তুমি আমাকে রাগাবার জন্য এ কথা বলেছ?”
পাঠক! জানিয়া রাখুন, রায়মল্ল সাহেব প্রতাপসিংহ নামে দস্যুগণের নিকটে পরিচিত ছিলেন।
প্রতাপবেশী রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “প্রমাণ কর।”
রঘুনাথ। প্রমাণ করবার আমার দরকার নাই! আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে, তুমিই বলেছ। তা’ দেখ, আমি তোমায় সোজা কথা বলছি, যদি ভাল চাও, এ রকম করে আর আমায় রাগিয়ো না। ফের যদি এ রকম কাজ কর, তা’ হ’লে তোমারই একদিন, কি আমারই একদিন।
প্রতাপ ওরফে রায়মল্ল কোন কথা কহিলেন না। তাঁহার যুক্তি ও কার্য্যের ফল অন্য লোকের বুদ্ধির অগম্য। অন্য লোকে হয় ত ভাবিত, এরূপ করিলে পাকে-প্রকারে ছদ্মবেশী ধরা পড়িবে; কিন্তু রায়মল্ল সাহেব এরূপ স্থলে ভাবিতেন, ইহাতে তাঁহার কার্য্যসিদ্ধি হইবে। অপরে যাহা ঠিক বলিয়া বিবেচনা করিত, তিনি তাহা তাহার বিপরীতভাবে দেখিতেন।
রায়মল্ল সাহেব আবার আগুনের কাছে গিয়া বসিলেন।
ভোজসিংহ জিজ্ঞাসা করিল, “এ প্রতাপ লোকটা কে? কোথা থেকে এল?”
রঘুনাথ বলিল, “ও জয়পুরে একটা ডাকাতের দলে ছিল।”
একজন দস্যু জিজ্ঞাসা করিল, “এখানে কেমন ক’রে জুল?”
আর একজন দস্যু উত্তর করিল, “রাজারাম সিংহের ডাকাতের দলে এসে প্রতাপ প্রথমে ভৰ্ত্তি হয়। তারপর রায়মল্ল সাহেব যখন রাজারামের সমস্ত দল পাকড়াও করে, সেই সময়ে প্রতাপ আর দুই-তিনজন ছিকে এসে রঘুনাথের দলে মেশে; কিন্তু রঘুনাথের সঙ্গে প্রতাপের ভাল বনে না। একদিন-না-একদিন দুজনে খুনোখুনী হবে।”
রঘুনাথ তারার নিকটে আসিয়া বলিল, “তারা! তুমি আজ রাত্রির মত ঐ ছোট তাঁবুর ভিতরে গিয়ে থাক, কাল তোমার সঙ্গে কথা হবে। এখন একটা বিশেষ কাজে যাব, তোমার কোন ভয় নাই: কাল সকালে আমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।”
তারা যাহাতে পলাইতে না পারে, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া রঘুনাথ অন্যান্য দুই-চারিজন অনুচরসহ প্রস্থান করিল। অনন্যোপায় হইয়া তারা ক্ষুদ্র শিবিরের দিকে অগ্রসর হইতেছে, এমন সময়ে রায়মল্ল সাহেব ইঙ্গিতে তাহাকে ডাকিলেন। তারা তাঁহার নিকটে গেল।
রায়মল্ল সাহেব ওরফে প্রতাপ বলিলেন, “আমার কথার কোন জবাব দিতে হবে না; আমি যা’ বলি, মন দিয়ে শুনে রাখ। বোধ হয়, তুমি বুঝতে পেরেছ, আমি কে?”
তারা ঘাড় নাড়িয়া বুঝাইল, “সে বুঝিতে পারিয়াছে।”
রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “যদি বুঝতে পেরে থাক, তা’ হলে আমার উপর বিশ্বাস ক’রে নির্ভয়ে তাঁবুর ভিতরে গিয়ে শুয়ে থাক— নির্ভয়ে নিদ্রা যাও; কেউ তোমার দেহস্পর্শ করতে পারবে না। এইখানে সকল সময়ে তোমাকে রক্ষা করবার জন্য আমি ছাড়া অন্য তিন-চারিজন লোক আছে। তোমার কোন ভয় নাই। আমি তোমার বাবার কাছে চল্লেম। রঘুনাথও সেখানে যাবে, তা’ আমি বেশ বুঝতে পেরেছি।”
রায়মল্ল সাহেব চলিয়া গেলেন। তারা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় যতক্ষণ তাঁহাকে দেখা গেল, ততক্ষণ তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল।