চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – সাহস সঞ্চার
রঘুনাথ রায়মল্ল গোয়েন্দার ভয়ে পার্ব্বতীয় নিভৃত উপত্যকায় গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিল। রাজেশ্বরী উপত্যকায় বড় ভূতের ভয়! সাধারণজনগণ বা পৰ্ব্বতনিবাসী নীচজাতি পৰ্য্যন্তও তথায় কেহ গমনাগমন করিত না। বিশেষতঃ সে প্রদেশ নিবিড়-জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কাঠুরিয়া ছাড়া তথায় আর কাহারও যাইবার বিশেষ আবশ্যক হইত না। রাজেশ্বরী উপত্যকায় একটি মাত্র দ্বার। প্রবেশ ও প্রত্যাগমনের পথ সেইটি ব্যতীত আর দ্বিতীয় নাই। দসুগণ তাহাই জানিত, জনসাধারণেও তাহাই জানিত। পার্ব্বতীয় জাতির মধ্যে দু-একজন অশীতিপর বৃদ্ধের মুখে শোনা যাইত, অন্যদিক্ দিয়া রাজেশ্বরী উপত্যকায় যাইবার ও আসিবার আরও একটি পথ ছিল;কিন্তু তাহা জঙ্গলে এমন পূর্ণ হইয়া গিয়াছে যে, বর্তমানে এখন তাহার চিহ্নমাত্রও লক্ষিত হয় না। রায়মল্ল গোয়েন্দা কোন বৃদ্ধের মুখে এই কথা শুনিয়া রাজেশ্বরী উপত্যকার অন্য পথ আবিষ্কার করিতে যত্নবান্ হন্। অনেক দিন অনুসন্ধানের পর তিনি তাহা আবিষ্কার করিয়া লোকজন লাগাইয়া বন পরিষ্কৃত করা
সে প্রদেশের বাল-বৃদ্ধ-বনিতা জনিত, রাজেশ্বরী উপত্যকায় প্রেতযোনীর উপদ্রব আছে; কিন্তু রায়মল্ল গোয়েন্দা জানিতেন, সে প্রেতযোনী আর কেহ নহে—দস্যুগণই সেই প্রেতযোনী আখ্যাপ্রাপ্ত হইয়া নির্ভয়ে তথায় বাস করে। তাহাদের অত্যাচারে সে প্রদেশস্থ অধিবাসিগণ অস্থির। কাজেকাজেই সকলে বলে রাজেশ্বরী উপত্যকায় অসংখ্য প্রেতের আবাস।
এমন কোন পাপকার্য্য নাই, যাহা রঘুনাথ জানিত না—বা করিত না। রাজেশ্বরী উপত্যকায় সেদিন জনকয়েক নোট-জালিয়াতের জন্য সে অপেক্ষা করিতেছিল। রঘুনাথকে যে যখন যে কাজে নিয়োজিত করিত, কখনও সে ‘না’ বলিত না। খুন, ডাকাতি প্রভৃতি তাহার নিকটে মানাস্পদ কাৰ্য্য। তাহাতে কখনও সে পশ্চাৎপদ হইত না।
উক্ত উপত্যকায় পৌঁছিয়া দুই-তিনটি শিবির সংস্থাপিত হইলে, বেলা তিন-চারিটার সময়ে রঘুনাথ একবার তারার শিবিরে উপস্থিত হইল। পূর্ব্বস্থান পরিত্যাগ করিয়া অবধি, এ পর্যন্ত তারার সহিত রঘুনাথ কোনও কথা কহে নাই।
তারা অসহায়া—অভাগিনী, সরলা বালিকা হতাশায় ম্রিয়মানা। রঘুনাথ সেই শিবিরে প্রবেশ করিবামাত্র তাহার হৃদয়ে মহাভীতির সঞ্চার হইল। আশা-ভরসা তাহার হৃদয়ে তখন আর কিছুই স্থান পাইতেছিল না। মায়া-মমতাবিহীন নরপিশাচবৎ রাক্ষসগণের হস্তে পরিত্রাণের উপায় একমাত্র প্রতাপসিংহ, তিনিও ত অন্তর্হিত। তাঁহারও ত আর কোন খোঁজ-খবর নাই—তাঁহাকেও তারা অনেকক্ষণ দেখে নাই। তবে কি যথার্থই রঘুনাথের ঘৃণিত চক্রান্তে পড়িয়া মহাশূর রায়মল্ল গোয়েন্দা ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন? এই সকল ভাবনা তারার মনোমধ্যে উপস্থিত হইল।
রঘুনাথের মহাস্ফূর্ত্তি, বড় আস্ফালন। মুখে আর হাসি ধরে না। সে কঠোর স্বর, সে কর্কশ কথা, সে ভীষণ দৃষ্টি এখন যেন আর কিছুই নাই। নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্ত মনে নির্ভয় রঘুনাথ জিজ্ঞাসা করিল, “তারা! এতটা পথ এসে বড় ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছ?”
ক্রোধকষায়িতলোচনে, কম্পিতদেহে কঠিনকণ্ঠে তারা উত্তর করিল, “খুনি! মহাপাতকি! তুই আবার আমার সামনে এসেছিস?”
রঘুনাথ। আমি খুনি?
তারা। খুনী নয় ত কি?
রঘুনাথ। কাকে খুন করতে তুমি আমায় দেখেছ?
তারা। প্রতাপকে।
রঘুনাথ। তাতে আমার দোষ কি? আমাদের দলের কেউ তাকে ভালবাসত না, সকলের সঙ্গেই তার মহা শত্রুতা। কারও সঙ্গে বোধ হয় ঝগড়া হয়েছিল, সে রাগ সামলাতে না পেরে মেরে ফেলেছে।
তারা। রাক্ষস! এই কথা ব’লে তুই এখন আমায় ভুলাতে চাস্—হৃদয় থেকে কি এ কথা বলছিস্, নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখ দেখি।
আর রঘুনাথ সহ্য করিতে পারিল না। শিরায় শিরায়, ধমনীতে ধমনীতে রক্তস্রোতঃ প্রবাহিত হইতে লাগিল। সক্রোধে রঘুনাথ বলিল, “শোন তারা! তোমার অনেক কথা আমি সহ্য করেছি, কিন্তু আর করব না। আজ রাত্রে তোমাকে আমার উপভোগ্য হতেই হবে—আজকেই আমাদের বাল্যকালের বিবাদভঞ্জন হবে—আজই আমি তোমার আন্তরিক ঘৃণার পরিশোধ নেব।”
তারার দেহের সমস্ত শোণিত জল হইয়া আসিতে লাগিল। মৃত্যুর ভীষণ ছায়া যেন তাহার সম্মুখে নৃত্য করিতে লাগিল। যদি রঘুনাথ ব্যস্ত বা কোন বিষয়ে চিন্তিত থাকিত, তাহা হইলে তারা কতকটা নির্ভয়ে সুসময়ের অপেক্ষা করিতে পারিত; কিন্তু তাহার নিশ্চিন্ত, ভাবনাবিহীন, হাসিমাখা মুখ দেখিয়া ও এইরূপ মিষ্টলাপ শুনিয়া তারার সকল আশাভরসা উন্মুলিত হইয়াছিল।
তারা জিজ্ঞাসা করিল, “রঘু! তোমাকেও একদিন মরতে হবে। সে কথা কি একবারও ভেবে দেখ না?”
রঘু। না।
তারা। কি? তুমি মরবে না? তোমার ইহজন্মে মৃত্যু হবে না?
রঘু। না—আমার কখনও মৃত্যু হবে না। আমি মহাদেবের মত অমর হ’য়ে চিরকাল বেঁচে থাকব। তোমার তাতে কিছু আপত্তি আছে?
তারা। আচ্ছা, সব বুঝলেম। কেন তুমি আমার সর্ব্বনাশ করতে উদ্যত হয়েছ?
রঘু। তোমাকে বড় ভালবাসি ব’লে।
তারা। ভালবাসা কি এর নাম—এই রকম করে বন্দিনী ক’রে রেখে, অবলা অসহায়া অনাথিনীর সর্ব্বনাশ সাধন করা কি ভালবাসার লক্ষণ?
রঘু। আমি তোমায় ভালবাসি কি না, তার প্রমাণ দিচ্ছি। যে কথা বলি মন দিয়ে শোন।
তারা। আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না। আমায় বাড়ী পাঠিয়ে দাও। আমার বৃদ্ধ পিতার মৃত্যু শয্যাপার্শ্বে একবার আমায় যেতে দাও।
রঘু। আমি তোমাকে আজ যথারীতি বিবাহ ক’রে আমার ভালবাসার পরিচয় দিতে চাই। আজ সন্ধ্যার সময় তুমি আমার পরিণীতা বনিতা হবে।
চক্ষু বড় করিয়া দৃঢ়তাপরিপূর্ণস্বরে তারা বলিল, “কখনই না—কখনই না।”
রঘু। আর আমি বলছি, নিশ্চয়—নিশ্চয়! অদ্য রাত্রে আমায় স্বামী ব’লে তোমাকে স্বীকার করতেই হবে। চন্দ্র সূর্য্য মিথ্যা হবে, তথাপি আমার কথা বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে না।
তারা। ততক্ষণ পর্যন্ত আমায় জীবিত দেখতে পাবে কি না, সন্দেহ। তোমার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার যদি আর কোন উপায় না পাই, আত্মহত্যা করব।
রঘু। যাতে আত্মহত্যা না করতে পার, সে বিষয়ে আমার বিশেষ দৃষ্টি থাকবে। তার উপায় আমি করছি, তার পরে যখন তুমি আমার পত্নী হবে, তখন তোমার রক্ষণাবেক্ষণের ভার লওয়ায় আমার সম্পূর্ণ অধিকার থাকবে।
তারা। রঘুনাথ! আমি এখনও বলছি, তোমার পাপ-অভিসন্ধি কখনই পূর্ণ হবে না—ভগবান্ আমায় রক্ষা করবেন
রঘু। তোমার ভগবানে আমি বড় বিশ্বাস করি না। মানুষ ত কোন্ ছার! এখানে এসে তোমার সে ভগবাও তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না। এখানে যত লোক দেখছ, সকলেই আমার বিশ আমার কথায় সকলেই ওঠে-বসে। আমি এখানে রাজা, যা’ মনে করব, তাই করতে পারব।
তারা। কিন্তু তুমি যা স্বপ্নে ভাব নাই, এমন উপায়ে আমার জীবন রক্ষা হতে পারে, আর সেই সঙ্গে তোমারও সর্বনাশ হতে পারে।
রঘু। তারা! যার আশায় এখনও এত সাহস ক’রে কথা কইছ, সেই প্রতাপ আর জীবিত নাই। তোমার সকল আশা, সেই প্রতাপের ঘৃণিত দেহের সঙ্গে অবসান হয়েছে।
বাস্তবিক তারার চক্ষে এখন চারিদিক্ অন্ধকার বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। নিঃসহায়া অবলাবালার সহায়তা করে বা তাহাকে উৎসাহ দেয়, এমন লোক আর কেউ নাই। শমন যেন ভীষণ মুখব্যাদন করিয়া তারাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে! এ অবস্থায় তারা কাহার আশায় জীবিত থাকিবে? কে এ বিপদে অভাগিনীকে রক্ষা করিবে; কে এ ভয়ানক পাপাচারী, নরহত্যাকারী রাক্ষসগণের হস্ত হইতে এই বিপদগ্রস্তা, কাতরা, ব্যাকুলা রাজপুতবালাকে উদ্ধার করিবে? রঘুনাথের মুখ দেখিয়া ও তাহার কথাবার্তা শুনিয়া এখন তাহার মনে এই সকল কথা উদয় হইতে লাগিল। এত বিপদেও তারা স্থিরপ্রতিজ্ঞ। তারা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, যদি মৃত্যু হয়, তাহা হইলেও সে রঘুনাথের পত্নী হইবেনা।
রঘুনাথ বলিল, “তারা! এখন বিবেচনা করে কাজ কর। ভালমানুষী করবার এখনও সময় আছে! এখনও তোমার প্রতি আমি বল প্রকাশ করি নি।”
তারা কোন উত্তর দিবার পূর্ব্বেই দূরে দস্যুগণের বংশীধ্বনি শ্রুত হইল। রঘুনাথ ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ বলিল, “বাহিরে আমায় কে ডাক্ছে। তোমায় ভাল করে বুঝাতে সময় পেলেম না—আমি চল্লাম। যত শীঘ্র পারি, ফিরে আছি। ইতিমধ্যে তুমি মন স্থির কর, যাতে বিনা বলপ্রকাশে আমার প্রস্তাবে সম্মত হ’তে পার, তজ্জন্যও প্রস্তুত হও।”
অনেকক্ষণ ধরিয়া তারা অনেক কথা ভাবিল। যাহার উৎসাহবচনে উৎসাহিত হইয়া সে আশায় বুক বাঁধিয়াছিল, সেই প্রতাপসিংহ রঘুনাথের ভীষণ চক্রান্তে অকালে কালকবলিত হইলেন। এখন কে আর তাহাকে এ বিপদে উদ্ধার করিবে? কে তাহাকে রঘুনাথের কঠোর হস্ত হইতে রক্ষা করিবে?
তারা বসনে বদনাবৃত করিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিল। একবার তাহার পালক-পিতা অজয়সিংহের দুর্দ্দশার কথা তাহার মনে উদিত হইল। তাঁহার সেই রোগশয্যা, সেই আসন্ন-মৃত্যুকাল সমস্তই মনে পড়িল। আর মনে পড়িল, পূর্ব্বেকার সুখের দিন, বর্তমান দুঃখের দশা! কল্পনাপথে বাল্যকালের সকল কথাই একে একে অন্তরে জাগিতে লাগিল। শৈশবে সেই রঘুনাথের আদর, সেই একসঙ্গে খেলা-ধূলা, একসঙ্গে দৌড়াদৌড়ি, একসঙ্গে খেলাঘরে কত পরামর্শ—সকলই স্মৃতিপথে দেখা দিল। তার পর কি ভাবিয়া তারা উঠিয়া দাঁড়াইল। বক্ষঃস্থলের আবরণ উন্মোচন করিয়া একখানি সুতীক্ষ্ণ ছুরিকা টানিয়া বাহির করিল, আত্মহত্যায় প্রস্তুত হইল। আপনা-আপনি বলিল, “আর কেন, এই ত সময়! আর কার আশায় জীবন রক্ষা করব? রঘুর বিবাহিত পত্নী হওয়া অপেক্ষা আমার মরণই ভাল।” তারা নিজ বক্ষঃ লক্ষ্য করিয়া দৃঢ়মুষ্টিতে তাহা ধারণ করিল। তৎক্ষণাৎ সেই শানিত ছুরিকা ঊর্দ্ধে উত্থিত হইল।
এমন সময় কে পশ্চাদ্দিক হইতে বলিল, “থামো, আত্মহত্যা ক’রো না।”
চমকিত হইয়া তারা পশ্চাদ্দিকে ফিরিয়া চাহিল। ঠিক পশ্চাতে শিবিরের যবনিকা ঈষৎ অপসাহিত করিয়া কে একজন লোক তাহার দিকে স্থিরলক্ষ্য করিয়া রহিয়াছে।
তারা জিজ্ঞাসা করিল, “কে আপনি! কেন আমায় এমন বাধা দিলেন?”
সে লোকটি বাহির হইতে গম্ভীরস্বরে বলিলেন, “তুমি বড় চপলা বালিকা! এত ভীত হচ্ছ কেন?
তোমার কোন ভয় নাই—রঘুনাথ তোমার একগাছি চুলও ছুঁতে পারবে না।”
এই পৰ্য্যন্ত বলিয়াই সে লোকটি তদ্দণ্ডেই অন্তর্হিত হইল! কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ়া হইয়া তারা সেইখানে বসিয়া পড়িল।