ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বন্দিনী তারা
চারিজন ষড়যন্ত্রকারী মাতাল অবস্থায় এই বৃদ্ধকে দেখিয়া সেদিকে বড় নজর করিল না। তাহারা আপনা আপনি যে যার নিজের কথা কহিতে লাগিল।
বৃদ্ধ মাতাল বলিল, “সরাইওয়ালা! আমায় আজ রাত্রের মত একটা ঘর ছেড়ে দিতে পার? দেখ্ছ, আমি কিছুতেই দাঁড়াতে পারছি না। পা দুখানা ভারি অবাধ্য হ’য়েছে।”
সরাই-রক্ষক বলিল, “যাও যাও, আজ আর ঘর ছেড়ে দেয় না, মাতাল কোথাকার। আজ আমার সব ঘরে লোক আছে।”
বৃদ্ধ মত্ততার সহিত মৃদুমন্দভাবে নৃত্য করিতে করিতে বলিল, “ব’লে যাও—বলে যাও বাবা, তোতা পাখি! তুমি বেশ বল্ছ, ভাল গাইছ, একটা দেখে-শুনে দাওনা বাপ্! বেজায় মাতাল হ’য়ে পড়েছি।”
সরাই-রক্ষক। কেন ভিড় বাড়াবে, বাবা? আজ আমার আর জায়গা নাই। তোমায় সিধে পথ দেখতে হচ্ছে। আজ রাত্রে আর এখানে হচ্ছে না।
বৃদ্ধ। রাত্রি কোথায় বাবা, রাত্রি কি আছে? দেখ, এতক্ষণে বুঝি রদ্দুর উঠে প’ড়ল। অন্ততঃ একটাকে তুলে বিদায় ক’রে দিয়ে আমার একটু জায়গা করে দাও না। তারা সারারাত ঘুমিয়েছে, আমি সারারাত মদ খেয়েছি। এখন আমায় খানিক্টে ঘুমুতে দাও।
সরাই-রক্ষক কর্কশস্বরে বলিল, “আমি বলছি, আজ এখানে আর জায়গা নাই—তুমি সোজা পথ দেখ।”
বৃদ্ধ। এখান থেকে আর একটা সরাই কত দূর হবে?
সরাই-রক্ষক। ক্রোশখানেক দূরে। এই রাস্তা ধ’রে বরাবর সমান চ’লে যাও।
বৃদ্ধ বেগতিক দেখিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িল। নানাবিধ অঙ্গভঙ্গী ও মুখভঙ্গীপূর্ব্বক বিজড়িত স্বরে উত্তর করিল, “বাবা, অতদূর! এখান থেকে আর কোন্ বেটা এক পা নড়ে। আমার শিকড় নেমে গেছে, বাবা! এখন আমায় আর টেনে তোলা দায় হবে!” এই বলিয়া বৃদ্ধ সেই উঠানে ঘাসবনের মাঝখানে লম্বাভাবে উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িল, এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহার নাসিকা গৰ্জ্জন আরম্ভ হইল।
তাহার কথাবার্তা ও ভাবগতিক দেখিয়া তাহাকে কেহই সন্দেহ করিতে পারিল না। সরাই-রক্ষক তাহার এই দুরবস্থা দেখিয়া কোন কথা বলিল না। সকলে ভাবিল, “যাক্, বুড়োটা ঐ খানেই মড়ার মত প’ড়ে থাক্, তাতে আর আমাদের কি ক্ষতি হবে?”
ষড়যন্ত্রকারিগণও বৃদ্ধ মদ্যপের এই অবস্থা দেখিয়া আপন-আপন কথাবার্ত্তা আরম্ভ করিল। তার পর তাহাদের সমস্ত কথা শেষ হইলে দুজন সেই অপহৃতা বালিকাকে আনয়নার্থ আর একটি ঘরে চলিয়া গেল। সরাইরক্ষকও ঐ দুর্বৃত্ত কয়জনের ঘোড়া আনিবার জন্য আস্তাবলের দিকে অগ্রসর হইল।
তাহাদের কথাবার্তায় ও পরামর্শে ধার্য্য হইল, ঐ কয়জন লোক জগৎ সিংহের সহিত অশ্বারোহণে কোন পৰ্ব্বত-সমীপস্থ গ্রাম পৰ্য্যন্ত যাইবে। তথায় তাহাকে একখানি গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া টাকা কড়ি চুকাইয়া লইয়া চলিয়া আসিবে।
যে বৃদ্ধ মাতাল কথা কহিতে কহিতে তথায় পড়িয়া কুম্ভকর্ণের মত নিদ্রা যাইতেছিল, সে প্রকৃতপক্ষে মাতাল নহে—নিদ্রিতও হয় নাই। এস্থলে বলিয়া দেওয়া উচিত। এই বৃদ্ধ আর কেহই নহে, সেই রায়মল্ল গোয়েন্দা। এ কথা বোধ হয়, পাঠক অনেক পূর্ব্বে অনুমান করিয়া লইয়াছেন। অনুমানের উপর নির্ভর না করিয়া এস্থলে খুলিয়া বলা গেল। গুপ্ত মন্ত্রণাকারীদের প্রত্যেক কথার উপরে রায়মল্ল লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন। তিনি উপায় কি করিবেন, তাহাই ভাবিতেছিলেন। নিজ জীবনের জন্য যদি হইত, তাহা হইলে তিনি একাকী এই পঞ্চজনের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হইতে বিন্দুমাত্ৰ ভীত বা সঙ্কুচিত হইতেন না;কিন্তু তিনি কি করিবেন, পঞ্চজন ভায়ানক অসম সাহসিক লোকের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া যদি তিনি কোন প্রকারে আহত হইয়া পড়েন, আর এই বালিকা যদি তারাবাই হয়, তাহা হইলে অভাগিনী তারার দশা কি হইবে, এই ভাবনাতেই তাঁহার মস্তিষ্ক আলোড়িত হইতে লাগিল। কেমন করিয়া তারাকে এই দস্যুগণের কবল হইতে মুক্ত করিবেন, তাহাই তাহার একমাত্র চিন্তা হইল। তিনি অবশেষে স্থির করিলেন, দেখি কত দূর গড়ায়! কোন রকম একটা সুবিধা কি হইবে না?
তারার বিপদের উপর বিপদ্ ঘটিতে লাগিল। নিতান্ত বালিকা বয়স হইতে তাহার সম্পত্তি অপহরণ করিবার লোভে তাহাকে স্বীয় জন্মস্থান ছাড়াইয়া বৰ্দ্ধমানে স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল। তারপর সে জীবিত, কী মৃত অনেক দিন কেহ তাহার সন্ধান পায় নাই। মধ্যে রঘুনাথ তাহার রূপমোহে মুগ্ধ হইয়া তাহাকে পাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াও কিছু করিতে পারে নাই। ঘটনাক্রমে অভাগিনী সেই রঘুর হাতে বন্দিনী হয়। রায়মল্ল গোয়েন্দা সহায় না হইলে সে যাত্রা কি হইত বলা যায় না। পাঠক, এ সকল সংবাদ পূর্ব্বেই একবার পাইয়াছেন। সে বিপদে তারার কেহ ক্ষতি করিতে পারিল না বটে, কিন্তু এ আবার কি নূতন বিপদ্! এতদিন পরে জগৎসিংহ, তারা প্রকৃতই জীবিত আছে জানিয়াই কি এইরূপ ষড়যন্ত্র করিয়া তারার প্রাণ বিনষ্ট করিতে বদ্ধ পরিকর হইয়াছে? হায়! অর্থই অনর্থের মূল। যদি তারার বিষয়-বিভব না থাকিত, তাহা হইলে কে তাহার অনিষ্ট করিতে চেষ্টা করিত?
ঘটনাচক্রের আবর্তনে কি অদ্ভুত পরিবর্ত্তন! কি বিষম পরিণাম! কোথাও, স্বনামখ্যাত গোয়েন্দা সর্দ্দার প্রসিদ্ধ রায়মল্ল, আর কোন অভাগিনী রাজপুতবালা তারা! কেমন অপূৰ্ব্ব-সুযোগ! বিধাতা যদি রায়মল্লের প্রাণে এইরূপ দয়ার উদ্রেক না করিয়া দিতেন, তাহা হইলে তারা এতদিন জীবিত থাকিত কিনা সন্দেহ। ইহাই বড় আশ্চর্য্যের কথা বলিতে হইবে যে, দুইবারই ঘটনাক্রমে রায়মল্ল সাহেব যেন তারার বিপদ্ জানিতে পারিয়াই যথাসময়ে কাৰ্য্যস্থলে উপস্থিত হইলেন!
কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইলে পর এক লোমহর্ষক ব্যাপার ঘটিল। যে দৃশ্য দেখিলে কঠোর হৃদয়ও কোমল হয়, প্রস্তর দ্রবীভূত হয়, তাহাই সম্মুখে উপস্থিত হইল।
সেই লোমহর্ষন দৃশ্যে রায়মল্লের ন্যায় ধীর, স্থির, বুদ্ধিজীবী লোকেরও বুদ্ধিভ্রংশ হইবার উপক্রম হইয়াছিল।
অর্দ্ধোলঙ্গ তারাবাইকে লইয়া সেই দুজন দস্যু ফিরিয়া আসিল। একবার দেখিয়াই রায়মল্ল গোয়েন্দা তারাকে চিনিতে পারিলেন। তারা কাঁদিয়া বলিল, “ওগো! তোমরা আমায় একেবারে কেটে ফেল না কেন? এ রকম ক’রে দগ্ধে দগ্ধে মারবার দরকার কি? আমি তোমাদের কোন অনিষ্ট করি নি—কেন তোমরা আমায় এ যন্ত্রণা দিচ্চ? আমি তোমাদের এ অত্যাচারের যে কিছুই কারণ বুঝতে পারছি না। হা ভগবান্! তোমার এমন দয়ালু অনুচর কি এখানে কেউ নাই যে, আমাকে এই বিপদে—“
জগৎসিংহ বাধা দিয়া কহিল, “আমি তোমায় রক্ষা করতে পারতেম; কিন্তু কি করব বল, ওরা তিনজন আমি একা।”
রায়মল্ল গোয়েন্দার একবার ইচ্ছা হইল, তিনি ভূমিতল হইতে লাফাইয়া উঠিয়া ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া অভাগিনী তারাকে বলেন, “ভয় কি তারা! এই যে আমি রয়েছি এখানে। তোমার অনিষ্ট করবার কাহারও ক্ষমতা নাই!” কিন্তু রায়মল্ল গোয়েন্দা তাহা যুক্তিমূলক বিবেচনা করিলেন না। তিনি ক্রমাগত সুবিধাই অন্বেষণ করিতে লাগিলেন।
তারার ক্রন্দন, অনুনয় বিনয় শ্রবণেও ব্যাকুলতা কাতরতা-সন্দর্শনে রায়মল্লের বুক ফাটিয়া যাইতেছিল। তিনি আর ধৈর্য্যধারণ করিতে পারিতেছিলেন না। তাঁহার ইচ্ছা হইতেছিল, ক্ষুধাৰ্ত্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় সেই দুর্বৃত্তগণের স্কন্ধে অধিরুঢ় হইয়া তাহাদের দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া ফেলেন। অত অধিকক্ষণ সহিষ্ণুতা অবলম্বন করিয়া থাকা তাঁহার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর বোধ হইতে লাগিল। অভাগিনীর ক্রন্দনধ্বনি আর তাহার সহ্য হয় না। সহসা তিনি ভান করিয়া জাগরিত হইলেন। কৃত্রিম, কপট নিদ্রাত্যাগের তাঁহার আর একটি কারণ ছিল। তিনি যে কোন প্রকারে হউক, তারাকে ইঙ্গিতে তাঁহার উপস্থিতি বুঝাইয়া দিতে পারিলে, অভাগিনী মনে মনে আশ্বস্ত হইবে, এই উদ্দেশ্যেই ছল করিয়া কপট সুষুপ্তি ভঙ্গ করিয়া উঠিলেন।
সেই কয়জন চক্রান্তকারী দস্যুর সম্মুখে তারা হৃদয়ভেদী ক্রন্দন সহকারে করুণকণ্ঠে কাকুতি- মিনতি করিতেছে, তাহাকে ছাড়িয়া দিতে বলিতেছে, আর সে কখন কাহারও কিছু হানি করে নাই, তাহাই বুঝাইতে প্রয়াস পাইতেছে। তারা মনে মনে ভাবিতেছে, বুঝি সে আবার রঘুনাথের দলের হাতে পড়েছে; এবার বোধ করি, আর তাহার নিস্তার নাই।
রায়মল্ল গোয়েন্দা টলিতে টলিতে তাহাদের মধ্যস্থলে গিয়া দাঁড়াইলেন। বিকৃতভাবে, বিজড়িতস্বরে বলিলেন, “এই বাচ্ছা মেয়ে মানুষটাকে নিয়ে বাঘের মত তোমরা ক’জনে প’ড়ে কেন টানাটানি করছ, বাবা! তোমরা কি মানুষ খাও?”
তারা চীৎকার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “আমায় বাঁচান মশাই। আমায় রক্ষা করুন। আমি নিরপরাধী, এদের আমি কোন অনিষ্ট করি নি, এরা আমায় জোর ক’রে ধ’রে নিয়ে এসেছে, আমায় এরা কেটে ফেলবে, এরা আমার—“
তারা আর কিছু বলিতে পারিল না, তাহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া আসিল।
রায়মল্ল মত্তের ন্যায় মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “তুমি এদের—স-ঙ্গে—যেতে চাও না? না যেতে চাও—এরা তোমায় খেয়ে ফেলবে—তার আগে একটা মজা হোক, আমি তোমার কানটা একবার কামড়ে এঁটো করে দিই—ব্যস্।”
এই কথা বলিয়া ছদ্মবেশী রায়মল্ল টলিয়া টলিয়া, বিস্তৃতরূপে মুখব্যাদন করিয়া একেবারে তারার কানের কাছে মুখ লইয়া গেলেন। চক্রান্তকারিগণ মাতালের মজা দেখিতেছিল। তাহারা প্রথমতঃ বৃদ্ধ সুরাপায়ীর ঐ কার্য্যে বাধা দেওয়া বা আপত্তি করা যুক্তিযুক্ত মনে করিল না। রায়মল্ল সাহেব কিন্তু ইতিমধ্যে ফিফিস্ করিয়া তারার কানে কানে এইমাত্র বলিয়া লইলেন, “কোন ভয় নাই, তারা! আমি এসেছি।”
তাহার পরেই আবার সেইরূপভাবে টলিতে টলিতে বৃদ্ধবেশী রায়মল্ল গোয়েন্দা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এদের সঙ্গে—যেতে— চাও না—না?“
তারা উত্তর করিল, “না—না—ওদের সঙ্গে আমি কখনই যাব না, ওরা ডাকাত! ওরা খুনী! ওরা আমায় বাড়ী থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছে।”
তারা এইরূপভাবে উত্তর করিল বটে, কিন্তু ঐ বৃদ্ধের ঐ কয়েকটি সামান্য ইঙ্গিতেই সে বুঝিল, বৃদ্ধ কে? রায়মল্ল গোয়েন্দাই বৃদ্ধ সাজিয়া ছদ্মবেশে মাতালের ন্যায় কথা কহিতেছেন, তীক্ষ্ণবুদ্ধি তারার আর তাহা বুঝিতে বাকী রহিল না। এতক্ষণে তাহার প্রাণে আশার সঞ্চার হইল। এতক্ষণে সে বুঝিল, আর কেহ তাহার অনিষ্ট করিতে পারিবে না। তারার মনে পড়িল, কি ভয়ানক অবস্থায় রঘু ডাকাতের হস্ত হইতে রায়মল্ল সাহেব তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন! যাঁহার সাহসিকতা তারা একবার প্রত্যক্ষ দেখিয়াছে, তবে এখন তাঁহার তদনুরূপ কর্ম্মে কেন সন্দেহ ঘটিবে?
রায়মল্ল কহিলেন, “না যেতে চাও—নাই যাবে। তার এত ঝগড়া কেন? (ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি) কেন বাবা! তোমরা একে ধ’রে টানাটানি করছ, ওকে ছেড়ে দাও।”
এই কথা শুনিয়াই একজন দস্যু রায়মল্লের মুখের কাছে একটা পিস্তল খাড়া করিয়া বলিল, “তোর সে কথায় দরকার কি রে মাতাল বুড়ো! আমাদের যা’ ইচ্ছে তাই করব, তুই কে?”
পিস্তল দেখিয়াই রায়মল্ল ভয়ে যেন জড়সড় হইয়া পঞ্চ হস্ত সরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “পিস্তল সরাও বাবা! নাকের কাছে পিস্তল খাড়া ক’রে ও কিরকম ইয়ারকি? খুন করবে না কি?”