পঞ্চম পরিচ্ছেদ – আবির্ভাবের ফল
রায়মল্ল সাহেব শঙ্কিত বা সঙ্কুচিত হইবার কোন চিহ্ন দেখাইলেন না। বরং সেই লোকটিকে আরও ক্রুদ্ধ করিবার জন্য উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিয়া উঠিলেন।
সরাই-রক্ষক বলিল, “যদি দরকার বিবেচনা হয়, আমার সরাই থেকে একজন লোককে আমিই বের্ ক’রে দিতে পারি—অন্য লোকের সে কাজে হাত দেবার কোন দরকার নাই।”
“ও লোকটি অনর্থক আমাকে রাগিয়েছে, ওকে এই দণ্ডেই এখান থেকে স’রে যেতে হবে।”
রায়মল্ল গোয়েন্দা বিদ্রূপচ্ছলে স্বরভঙ্গী করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়ের নাম? থাকা হয় কোথায়?”
সেই ব্যক্তিটি শান্তভাবে, ধীর গম্ভীরস্বরে উত্তর করিলেন, “জগৎ সিংহ! এ পাৰ্ব্বতীয় প্রদেশে আমায় জানে না বা ভয় করে না, এমন লোক একটিও নাই।”
জগৎ সিংহ মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম শুনিলেই ঘরসুদ্ধ লোক চমকিয়া উঠিবে, এবং যে লোকটি তাঁহার সহিত বাগ্বিতণ্ডা করিতেছে, সেও ক্ষান্ত হইয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিবে, অথবা মূৰ্চ্ছা যাইবে;কিন্তু অত্যন্ত ক্ষোভের বিষয়, রায়মল্ল সে নাম শুনিয়া মূর্ছিত চমকিত বা কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না; বরঞ্চ তাঁহার মনে আনন্দ হইল। জগৎ সিংহের আরও পরিচয় জানিতে তাঁহার ইচ্ছা হইল, তবে প্রকাশ্যে তিনি সে ভাব জ্ঞাপন করিলেন না।
জগৎ সিংহ বাস্তবিকই সে প্রদেশের একজন প্রসিদ্ধ দুর্দান্ত ব্যক্তি বলিয়া পরিচিত। দস্যুদলের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, এ কথাও অনেকে অনুমান করিত। প্রকাশ্যভাবে এ পর্য্যন্ত যদিও তাঁহাকে কখনও দস্যুদলের সংস্রবে কেহ দেখে নাই, কিন্তু গুপ্তভাবে তিনি যে রঘুনাথের সঙ্গে অনেক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, অনেকেই তাহা কানাকানি করিত, কাজেই সর্ব্বসাধারণেই তাহা শুনিয়াছিল। তিনি আত্মপরিচয় প্রদান করিবামাত্রই গৃহমধ্যস্থ অন্য সকল লোকেই চমকিত হইল; কিন্তু রায়মল্ল গোয়েন্দা ঠিক পূৰ্ব্বপ্রকৃতি, সহাস্যবদন ও শান্তভাব বজায় রাখিলেন। জগৎ সিংহ যাহা আশা করিয়াছিলেন, তাহা ঘটিল না দেখিয়া যেন কথঞ্চিৎ নিরাশ হইলেন। মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, “আমার নামে বাঘে বলদে একঘাটে জল খায়, আর এ লোকটা বিন্দুমাত্র বিচলিত হ’ল না! কে এ ব্যক্তি? এর সাহস ত বড় কম নয়!”
রায়মল্ল গোয়েন্দা কহিলেন, “তবে রঘুনাথ দলকে-দল শুদ্ধ ধরা পড়াতে তোমার বড় ক্ষতি হয়েছে?”
জগৎ সিংহ এই কথা শুনিয়াই ক্রোধে রক্তবর্ণচক্ষুঃ হইয়া কঠোরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলে? তোমার এ কথার মানে কি?”
রায়মল্ল। কেন? আমি বেশ সাদা কথায় বলেছি। এর মানে ত বুঝিয়ে দেবার দরকার নাই। আমি যা বলেছি, তা’ তোমার মত চালাক লোকের খুব সহজে একেবারেই বোঝা উচিত।
জগৎ। তুমি ফের ও কথা বলিলে তোমার মাথা গুঁড়িয়ে দেবো।
রায়মল্ল। সাহস থাকে অনায়াসে চেষ্টা ক’রে দেখতে পার; কিন্তু আমার মাথাটা কিছু শক্ত — সহজে ভাঙা যায় না।
জগৎ। তুমি না বল্ছিলে, আমি রায়মল্লের উপরে মিথ্যা দোষারোপ করেছি?
রায়মল্ল। হাঁ, তা’ ত আমি বলেছি। বলেছি কেন? এখনও বলছি, তুমি ঘোরতর মিথ্যাবাদী।
জগৎ সিংহের আর সহ্য হইল না। তিনি নিজ অঙ্গরাখার মধ্য হইতে পিস্তল বাহির করিবার জন্য যথাস্থানে হস্ত প্রদান করিলেন। তৎপরেই বলিলেন, “খবরদার! মুখ সামলে কথা কও! এখনই উচিত মত শিক্ষা পাবে।”
রায়মল্ল গোয়েন্দা দেখিলেন, জগৎ সিংহ তাকে গুলি করিবার নিমিত্ত পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছেন। তিনি তথাপি বিচলিত হইলেন না; বরং জগৎ সিংহ অপেক্ষা কঠোরতর স্বরে বলিলেন, “আমি কেন তোমায় মিথ্যাবাদী বলেছি, তা’র কারণ আছে। রায়মল্ল গোয়েন্দা তোমার কোন ক্ষতি করেন নাই, অথচ তুমি তাঁর বদনাম দিচ্ছিলে–“
তাঁহার সমস্ত কথা মুখ হইতে বাহির হইতে-না হইতেই জগৎ সিংহ ঈষৎ পশ্চাতে হটিয়া আসিয়া অঙ্গরাখার ভিতর হইতে পিস্তলটা বাহির করিয়া ফেলিলেন। রায়মল্ল গোয়েন্দাও তাহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনিও নিমেষ মধ্যে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় জগৎ সিংহের ঘাড়ের উপরে লাফাইয়া পড়িলেন। যাহারা রায়মল্ল সাহেবের শান্তমূর্তি দর্শনে তাঁহাকে নিরীহ ভালমানুষ ভিন্ন আর কিছুই ভাবেন নাই, তাঁহারই চকিতনেত্রে চাহিয়া দেখিলেন, অত বড় প্রকাণ্ড দেহধারী জগৎ সিংহকে তিনি জাপ্টাইয়া ধরিয়া, অকাতরে অল্প চেষ্টায় অধিক ধস্তাধস্তি না করিয়া মুহূর্তের মধ্যে ভূমিতে ফেলিয়া দিলেন; পরে বলিলেন, “এখন মানে মানে পিস্তলটি ফেলে দেবে কি না? “
জগৎ সিংহের হাত হইতে পিস্তলটি পড়িয়া গেল। কেহ তাঁহাদিগের কার্য্যে বাধা দেয় নাই; কিন্তু ব্যাপার দেখিয়া প্রত্যেকেই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিল। বলিতে গেলে জগৎ সিংহকে ভূতলশায়ী করিতে বোধ হয় রায়মল্লের অতি সামান্যই ক্লেশ হইয়াছিল; কাহারও রক্তপাত হইল না, অথচ সেই শান্ত শিষ্ট ক্ষুদ্রাকৃতি রায়মল্ল অত বড় একজন কুস্তিগীর পুরুষকে যেমন একটি বালকের ন্যায় ভূশায়ী করিলেন। জগৎ সিংহ পিস্তলটা ফেলিয়া দিবামাত্র রায়মল্ল সাহেব সেই পিস্তলটী কুড়াইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। জগৎ সিংহ একখানি শাণিত ছুরিকা কটিদেশ হইতে বাহির করিয়া রায়মল্লকে আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইলে তৎক্ষণাৎ গোয়েন্দা-সর্দ্দার রায়মল্ল সেই পিস্তলটা তাহার দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “তোমার নিজের পিস্তলেই নিজে মরবে কেন—এখনও সতর্ক হও।”
জগৎ সিংহ উচ্চরবে জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুই?”
রায়মল্ল। আমি কে, তুমি জানতে চাও?
জগৎ। হাঁ।
রায়মল্ল। লোকে আমায় ‘রায়মল্ল গোয়েন্দা’ ব’লে ডাকে, আর কোম্পানি-বাহাদুর ‘রায়মল্ল সাহেব’ বলেন।
জগৎ সিংহ তৎক্ষণাৎ নিজ হস্তস্থিত শানিত ছুরিকা ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া যেন কত ভালমানুষের মত বিনীতভাবে বলিল, “ওঃ! তা’ না হ’লে কি এত সাহস হয়? আপনাকে চিনতে পারি নি, মাপ করবেন।”
জগৎ সিংহ যখন দম্ভভরে নিজ নাম উচ্চারণ করিয়াছিল, তখন অন্য লোকজন যত না চমকিত হইয়াছিল, রায়মল্ল গোয়েন্দার নাম উচ্চারিত হইবামাত্র তাহারা যেন সেইখানে একেবারে জমাট বাঁধিয়া গেল। হতবাক হইয়া তাহারা সেই অদ্ভুত গোয়েন্দার মুখপানে চাহিয়া রহিল। এতদিন যে লোকের কেবল নাম শুনিয়া তাহারা বিস্মিত হইত, আজ সেই লোক সম্মুখে উপস্থিত।
রায়মল্ল গোয়েন্দা এ সকল বিষয়ে লক্ষ্য না করিয়া, পার্শ্বস্থ একটি ক্ষুদ্র গৃহে প্রবেশ করিয়া তাহার দ্বার রুদ্ধ করিলেন। পান্থশালাধ্যক্ষকে কেবল বলিয়া গেলেন, “সকাল হইলেই আমার ঘুম ভাঙিও।” ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন বটে, কিন্তু তিনি নিদ্রাগত হইলেন না। তাঁহার মনে এখন একটা নতুন ভাবনা জুটিল। তিনি কেবল জগৎ সিংহের নাম লইয়াই ভাবিতে লাগিলেন। জগৎ সিংহের নাম তিনি অনেকবার শুনিয়াছেন। তিনি পাৰ্ব্বতীয় প্রদেশস্থ একজন বিখ্যাত বদমায়েস। তাঁহার নামে অনেক খুন মোকদ্দমা, অনেক গ্রেপ্তারী পরওয়ানা আছে; কিন্তু তা’ ছাড়াও জগৎ সিংহের নাম যেন তিনি আর কাহারও কাছে শুনিয়াছেন। অনেকক্ষণ চিন্তার পর তাঁহার মনে পড়িল, অজয়সিংহ একবার তাঁহার সাক্ষাতে তাহার পরিচয় দিবার সময়ে এই নাম উচ্চারণ করিয়াছিলেন। তখন তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “এই কি সেই জগৎ সিংহ? এই লোকই কি তারার বিমাতার সহিত অবৈধপ্রণয়ে আবদ্ধ? এই কি তারার বিষয়-সম্পত্তি নির্বিঘ্নে ভোগদখল করিতেছে? যাহাকে বহু অনুসন্ধানে বাহির করিতে হইত, ভাগ্যক্রমে সে কি আজ আপনা-আপনি আমার সহিত পরিচিত হইয়া গেল!”
এইরূপ ভাবনা চিন্তায় তিনি অনেকক্ষণ অতিবাহিত করিলেন। হঠাৎ তাঁহার চিন্তায় বাধা পড়িল। সরাইয়ে বহির্দেশে তিনি যেন কাহার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলেন। কে যেন অতিশয় ব্যস্ত-সমস্তভাবে বলিতেছে, “আজ রাত্রে গিয়ে আর কি ফল হবে? কাল সকালে তখন যাবেন।”
আর একজন লোক উত্তর দিল, “না—না—আমাকে এই রাত্রেই যেতে হবে। তুমি আমার ঘোড়াটা নিয়ে এস।”
“এই অন্ধকারে কেমন ক’রে যাই বলুন, তবে আপনি একান্ত পীড়াপীড়ি করলে বাধ্য হয়েই যেতে হবে।”
“আমি আজ যাবই—আমাকে আজ যেতেই হবে।”
রায়মল্ল সাহেব এই কথোপকথন ও কণ্ঠস্বর শুনিয়াই অনুমান করিলেন, জগৎ সিংহ সরাই পরিত্যাগ করিয়া সেই রাত্রেই প্রস্থানের উদ্যোগ করিতেছে, আর সরাই-রক্ষক তাহাতে বাধা দিতেছে। তিনি ভাবিতে লাগিলেন কেন জগৎ সিংহ এত ব্যস্ত হইয়া আজ রাত্রিতেই এখান হইতে পলায়নের চেষ্টা করিতেছে।
কিয়ৎক্ষণ পরেই তিনি আবার সরাই-রক্ষকের কণ্ঠস্বর শুনিলেন। সে বলিল, “রাত্রে পাহাড়ীপথে যাওয়া বড় ভয়ানক কাজ। আমি এখনও আপনাকে বারণ করছি, আপনি যাবেন না। গেলে বিপদে পড়বেন।”
রায়মল্ল সাহেব কান পাতিয়া বেশ ভাল করিয়া সব শুনিতে লাগিলেন। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “এই রাত্রে জগৎ সিংহ কেন এখান হইতে চলিয়া যাইতে চায়?”
রায়মল্ল সাহেব উন্মুক্ত বাতায়ন-পথ দিয়া দেখিতে লাগিলেন, জগৎ সিংহ অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া সরাই-রক্ষককে জিজ্ঞাসা করিল, “এখান হইতে বুঁদী গ্রামে যাবার কোন সহজ রাস্তা নাই?“
সরাই-রক্ষক উত্তর করিল, “না।”
জগৎ। এখান থেকে কত দূর হইবে?
সরাই-রক্ষক। প্রায় দশ ক্রোশ।
রায়মল্ল সাহেব এই কথা শুনিয়াই ভাবিলেন, “এ বুঁদীগ্রামে যেতে চায় কেন? নিশ্চয় কোন বিশেষ দুরভিসন্ধি আছে। হ’ল না, আজ রাত্রে আমার শোয়া হ’ল না দেখছি।”
কিয়ৎক্ষণ পরেই তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া, বাতায়ন পথ দিয়া লাফাইয়া পড়িলেন। অন্ধকারে আস্তাবলের দিকে গিয়া আপনার অশ্বটিকে বন্ধনমুক্ত করিয়া লইলেন। অশ্বের পদশব্দে পাছে জগৎ সিংহ বুঝিতে পারেন, তিনি তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিতেছেন, তাই তিনি অশ্বপদ হইতে লৌহনিৰ্ম্মিত ‘নাল’ খুলিয়া লইলেন। অশ্বারোহণে অর্দ্ধ ঘণ্টাকালের মধ্যেই তিনি জগৎ সিংহের অশ্বের পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। তখন তাঁহার মনে অপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হইল। দূরে একটি সরায়ের ক্ষুদ্র আলোকরশ্মি তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল। সহসা তিনি আর জগৎ সিংহের অশ্বের পদশব্দ শুনিতে পাইলেন না। তিনি বুঝিলেন, সেই সরায়ে জগৎ সিংহ আশ্রয় লইলেন। সে সরায়ে কিরূপ লোকের গমনাগমন হইত, তাহা রায়মল্ল গোয়েন্দার অবিদিত ছিল। তিনি জানিতেন, যত চোর বদমায়েস, প্রবঞ্চক, খুনী, ফেরারী লোক পরস্পরের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিত ও সন্ধান লইয়া রজনীযোগে তথায় সম্মিলিত হইত এবং নিজ নিজ কার্য্যসাধন করিয়া চলিয়া যাইত। জগৎ সিংহ এখানে আসিয়া কি উদ্দেশ্যে অবতরণ করিলেন, তাহাই জানিবার জন্য রায়মল্ল গোয়েন্দা বড় ব্যগ্র হইলেন। তিনি অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া, একটি বৃক্ষে তাহাকে বাঁধিয়া রাখিয়া উচু নীচু পাহাড় ও গাছপালার অন্তরালে থাকিয়া প্রায় জগৎ সিংহের নিকটবর্ত্তী হইলেন। দেখিলেন, জগৎ সিংহ আপনার অশ্বটিকে একটি তরুতলে রাখিয়া পথিকশালার অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। রায়মল্ল গোয়েন্দাও খুব সাবধানে পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।
সহসা একবার বংশীধ্বনি শ্রুত হইল। তিনি বুঝিলেন, ইহাও জগৎ সিংহের কার্য্য। সরায়ে নিশ্চয়ই তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার কারণে কোন লোক অপেক্ষা করিতেছে। তাহাকে দূর হইতেসংবাদ দিবার জন্য এই বংশীবাদন হইল। প্রকৃতপক্ষে ঘটিলও তাহাই। জগৎ সিংহের সেই বংশীরব শুনিবামাত্র পান্থশালার দ্বারদেশ উন্মুক্ত হইল। একজন লোক বাহিরে অসিয়া ঠিক সেইরূপ বংশীধ্বনি করিয়া জানাইল, সে উপস্থিত আছে। তাহার পরেই তাহার সঙ্গে আরও দুইজন লোক বাহির হইয়া আসিল। রায়মল্ল গোয়েন্দা দেখিলেন, তিনজন লোক ও জগৎ সিংহ নিকটস্থ একটী বৃক্ষতলে সমবেত হইয়া কথাবার্তা কহিতে লাগিল। তিন্যি লুক্কায়িতভাবে তাহাদিগের পশ্চাতে গিয়া এমন স্থানে দাঁড়াইলেন, যেখান হইতে অনায়াসেই তাহাদিগের পরামর্শ সব শোনা যায়। এইরূপভাবে তাহাদিগের নিকটস্থ হইতে পারায় তিনি মনে মনে নিজ-সৌভাগ্যের প্রশংসা করিতে লাগিল।
জগৎ সিংহ সেই তিনজন লোককে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “খবর ভাল ত?”
একজন উত্তর করিল, “ভাল।”
জগৎ। ঠিক জায়গায় যেতে পেরেছিলে?
উত্তর। হাঁ।
জগৎ। কাজ হয়েছে?
উত্তর। হয়েছে।
জগৎ। তাকে দেখেছ?
উত্তর। হাঁ।
জগৎ। তাকে আনতে পারবে?
উত্তর। নিশ্চয়।
জগৎ। কখন?
উত্তর। আমাদের পাওনার কথা ঠিক হলেই।
জগৎ। আমি ত তোমাদের আগেই বলেছি, এক হাজার ক’রে এক একজনকে দেবো।
উত্তর। তাতে হবে না—এখন অবশ্যই কিছু বাড়াতে হবে।
জগৎ। কত চাও?
উত্তর। প্রত্যেকে দুই হাজার করে।
জগৎ। একটা সামান্য কাজের জন্য অনেক টাকা চাইছ!
উত্তর। বড় সোজা কাজও নয়।
জগৎ। কেন?
উত্তর। এখন রায়মল্ল গোয়েন্দা তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়েছে। তা’ ছাড়া আর একটা কথাও শুন্লেম, ঐ মেয়েটা নাকি অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারিণী; অথচ কে বঞ্চনা করে তার বিষয়-আশয় ভোগ-দখল করছে। রায়মল্ল সাহেব না কি প্রতিজ্ঞা করেছেন, সে সব অপহৃত বিষয়-সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করবেন।
জগৎ। এ ভুল সংবাদ কে তোমাদের দিলে? কোথা থেকে এ গাঁজাখুরী কথা শুনলে?
উত্তর। আছে—আছে। আমাদেরও সন্ধান-সুলভ আছে। তা সে কথা নিয়ে সময় কাটাবার দরকার কি?
জগৎ। রায়মল্ল সাহেবই যে সেই ছুঁড়ীটার রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়েছে, তা’কেমন ক’রে জানলে? গুজব কথাও ত হ’তে পারে।
উত্তর। না গুজব কথা নয়।
জগৎ। তা’ যা’ হোক্, তোমরা তাকে আনতে পারবে?
উত্তর। হাঁ।
জগৎ। কখন?
উত্তর। এই রাত্রেই—যদি সব বন্দোবস্ত ঠিক হয়; আমরা যা’ চাই তা’ যদি আপনি দিতে রাজী হন্।
জগৎ। আজ রাত্রের মধ্যেই কেমন ক’রে?
উত্তর। সে ভার আমাদের—আপনি আমাদের কথায় রাজী হ’লেই কাজ হাঁসিল হবে।
জগৎ। এখান থেকে বুঁদী গ্রাম কত দূর?
উত্তর। প্রায় পাঁচক্রোশ হবে।
জগৎ। আজ রাত্রের মধ্যে তবে যাওয়া-আসা অসম্ভব।
উত্তর। সে কথায় আপনার দরকার কি? আপনার কাজ নিয়ে কথা। আপনি দু’হাজার করে দিতে স্বীকৃত হ’লেই আমরা আমাদের কাজ দেখাব।
জগৎ। আচ্ছা, সেই বালিকাকে আমার কাছে এনে দাও, আমি তোমাদের কথাতেই রাজী আছি।
একজন বলিল “দু’ হাজার করে দিতে হবে।”
জগৎ। দু’ হাজার করেই দেবো।
আর একজন বলিল, “তখন পেছলে কিন্তু আমরা শুনব না।”
জগৎ। আমি যখন বলছি দেবো, তখন আর কথায় কাজ কি?
অমনই তৃতীয় ব্যক্তি বলিল, “আমরা তাকে এনেছি।”
অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জগৎ সিংহ জিজ্ঞাসা করিল, “এনেছ?”
উত্তর। হাঁ।
জগৎ। কাকে বল দেখি?
উত্তর। যাকে আপনি আনতে বলেছিলেন।
জগৎ। কোথায়?
উত্তর। দেখুন, আমরা সুবিধা পেয়ে ছাড়ব কেন?, রাত্রে ঘাটে কাপড় কাচ্তে যাচ্ছিল, সেই সুযোগে তাকে ধ’রে ফেলি, তাকে এখন এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি।
জগৎ। কোথায়? এই সরায়ে?
উত্তর। তা’ এখন বল্ব কেন?
এইরূপ কথাবার্তা শুনিয়া রায়মল্ল সাহেব স্পষ্টই বুঝিলেন, তাহারা কোন্ বালিকাকে অপহরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছে। তিনি ভাবিলেন, হয় ত জগৎ সিংহ তারাকে হত্যা করিয়া নির্বিবাদে তাহার বিষয়-সম্পত্তি ভোগদখল করিবার জন্যই সকল ষড়যন্ত্র করিয়াছে। ইহাই সম্ভব।
জগৎ সিংহ ও সেই তিনজন লোক সরায়ের দিকে অগ্রসর হইল। সরাইরক্ষকও যে এই ভয়ানক কার্য্যে তাহাদের সহায়তা করিতেছে, তাহাও তিনি অনুমান করিলেন। সরায়ে উপস্থিত হইয়াই সেই দুবৃত্তগণ বেগবান্ অশ্বের পদশব্দ শুনিয়া চমকিত হইল। সরাই-রক্ষককে এ কথা জিজ্ঞাসা করাতে সে অবাক হইয়া কেহ তথায় আসিতেছে কিনা দেখিতে লাগিল। অবশ্য কাহারও আসিবার কথা ছিল না বলিয়া, সে সহসা ঐ কথায় কোন উত্তর দিতে পারিল না।
জগৎ সিংহ জিজ্ঞাসা করিল, “ও কে আসে?”
সরাই-রক্ষককে আর কোন উত্তর করিতে হইল না। একজন বৃদ্ধ মাতাল টলিতে টলিতে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল।