চতুর্থ পরিচ্ছেদ – রায়মল্লের আবির্ভাব
রায়মল্ল সাহেব অন্যান্য কাজকর্ম্ম সারিয়া অনুচরবর্গের প্রতি আদেশ দিলেন, “তোমরা প্রতি দস্যুর সঙ্গে দুইজন করিয়া লোক থাক। কোনরূপে পলাইতে বা পৰ্ব্বত হইতে খড়ের ভিতর লাফাইয়া পড়িতে না পারে। খবরদার! খুব সাবধান!”
প্রায় একঘণ্টা পরে প্রহরিবর্গবেষ্টিত একদল দস্যু বন্দী হইয়া পাৰ্ব্বতীয় পথে চলিতে লাগিল। সে দৃশ্য দেখিতেও কৌতুকপ্রদ! মধ্যাহ্নকালের মধ্যে অন্যান্য ভিন্ন ভিন্ন স্থান হইতেও ঐরূপভাবে দস্যুগণকে গোয়েন্দার লোকের বন্দীকৃত করিয়া আনিতে লাগিল। রায়মল্ল সাহেব চারিদিকে জাল ফেলিয়া রাখিয়াছিলেন। যখন তিনি সে জাল গুটাইলেন, তখন দেখা গেল, এই দুই বৎসরে প্রায় দুই হাজার পাঁচ শত দস্যু বন্দী করিয়াছেন। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বনমধ্যস্থ ভগ্নদুর্গে নিভৃত নিৰ্জ্জন পৰ্ব্বতগুহায়, স্থানীয় ছোট ছোট কোতোয়ালীতে, গ্রাম মধ্যে কারাগারে তিনি এতদিন ধরিয়া কেবল দস্যুগণকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিলেন। আজ এতদিন পরে তাহাদিগকে সমস্ত একত্র করিলেন। এ দৃশ্য দেখিবার যোগ্য বটে।
গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে এ কথা প্রচারিত হইল। রায়মল্ল গোয়েন্দা দুই বৎসর পরিশ্রমের পর রঘু ডাকাতের ভয়ানক দলকে দলশুদ্ধ বন্দী করিতে পারিয়াছেন, এ কথা ক্ষণেকের মধ্যে বোধ হয়, বিশ ক্রোশ ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। তবে ক্রমে ক্রমে যে সমধিক বা অত্যাধিক মাত্রায় সংবাদটা অতিরঞ্জিত হইতে লাগিল, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই।
চারিদিকে যে যে শুনিল, তাহারাই রায়মল্ল গোয়েন্দাকে অজস্র ধন্যবাদ ও প্রাণ ভরিয়া আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিল। সকলেই পুলকিত হইল। স্ত্রী-পুত্রাদি লইয়া এখন গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে নির্ভয়ে লোক বাস করিতে পারিবে, তাহাদের মনে সে আশা হইল। কোম্পানী-বাহাদুর রায়মল্ল গোয়েন্দাকে উপাধি ও কয়েক সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক স্বরূপ প্রদান করিলেন।
দুইদিন দুই রাত্রি অনবরত পরিশ্রম করিয়া, রায়মল্ল সাহেব দস্যুগণের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা খাড়া করিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত মনে অবসর গ্রহণ করিলেন।
তারাকে যথাসময়ে অজয় সিংহের ভবনে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল।
সুতরাং সে বিষয়ে রায়মল্ল সাহেব এক প্রকার নিশ্চিন্ত ছিলেন। এই ঘটনার পর তৃতীয় দিবসে তিনি অজয় সিংহের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য বহির্গত হইলেন।
পথিমধ্যে রাত্রি হইলে তিনি সেই রাত্রিটার জন্য পার্ব্বতীয় একটি সামান্য চটিতে আশ্রয়- গ্রহণার্থে প্রবেশ করিলেন। তখন তাঁহার হস্তে আর অন্য কার্য্য নাই। তিনি এইবার তারার অপহৃত বিষয়-সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে যত্নবান হইলেন।
সরায়ে প্রবেশ করিয়াই তিনি শুনিলেন, দুই-চারিজন লোক একত্রে বসিয়া তাঁহারই নামোচ্চারণ করিতেছে। তাহারা একটি কক্ষে একখানি তক্তপোষের উপরে বসিয়া মদ্যপান করিতেছে, আর তাঁহার সম্বন্ধেই আলোচনা করিতেছে।
রায়মল্ল গোয়েন্দা গৃহে প্রবেশ করিয়াই শুনিলেন, একজন বলিতেছে, ‘হাঁ, আমার বিবেচনা রায়মল্ল কিছু কম পাজী নয়। ভয়ানক ঘুসখোর! ভয়ানক পাজী! রঘু ডাকাতের চেয়ে রায়মল্ল কিছু কম পাপী নয়। লুকিয়ে লুকিয়ে সব বদমায়েসীটুকু করে, আর লোকের কাছে সাধুতা জানায়। “
রায়মল্ল গোয়েন্দাকে দেখিয়া সেই লোকদের চুপ করিয়া থাকিবার কোন আবশ্যকতা বোধ হয় নাই। বিশেষতঃ তাঁহাকে দেখিলে কেহ অনুমান করিতে পারে না যে, তিনি সেই অসাধারণ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। শান্তভাবে তাঁহাকে দেখিলে অপরিচিত কোন ব্যক্তিই তাঁহাকে সেই স্বনামখ্যাত রায়মল্ল গোয়েন্দা বলিয়া অনুমান করিতে পারে না। ভীতিদায়ক কোন চিহ্ন তাঁহার শরীরে ছিল না। তবে তাঁহার উজ্জ্বল ও সতর্ক চক্ষুদ্বয় দেখিলে বিচক্ষণ ব্যক্তি মাত্রেই অনুমান করিতে পারেন, সে নয়নযুগলে অপূৰ্ব্ব জ্যোতিঃ বিরাজমান! তাহাতে অভূতপূর্ব্ব সাহসিকতা ও দূরদৃষ্টির পরিচায়ক! অনেক মহাপাপী সেই চক্ষের জ্যোতিতে ঝসিয়া গিয়াছে। সে চাহনি ও বঙ্কিম ভ্রূভঙ্গে অনেক সময়ে অনেককে কম্পিত করিয়াছে।
রায়মল্ল গোয়েন্দার বড় আনন্দ হইল। এ পাৰ্ব্বত্য প্রদেশে এই ছোট ছোট সরায়ে অপরিচিত লোকজনের সহিত সকলেই কথা কয়—আলাপ পরিচয় করে, তাহাতে কেহ সঙ্কুচিত হয় না। আলাপ নাই বলিয়া কেহ কাহারও সহিত কথা কহিতে পরাজুখ হয় না, সকলেই ক্ষণমধ্যে আপনার মত করিয়া লয়। যেন কতদিনের আলাপ—কতদিনের পরিচয়। একবার দেখিয়াই পরস্পরে আকৃষ্ট হইয়া পড়ে।
রায়মল্ল গোয়েন্দা সেই লোকটীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি বোধ হয়, রায়মল্লকে চেনেন না, তাই তাঁর প্রতি অযথা দোষারোপ করছেন। আপনার সঙ্গে রায়মল্লের পরিচয় আছে কি?”
উত্তর। আছে।
রায়মল্ল। কখনই নয়, যদি আপনার সহিত তাঁর পরিচয় থাকৃত তা’ হ’লে কখনই এরূপ অন্যায় দোষারোপ করতে পারতেন না।
উত্তর। হতে পারে। আপনার সঙ্গে রায়মল্লের আলাপ আছে কি?
রায়মল্ল। আজ্ঞে হাঁ, তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কিছু আলাপ আছে।
সে লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি তাকে ভাল লোক ব’লে, বিবেচনা করেন?’
রায়মল্ল। আজ্ঞে হাঁ।
যে কয়জন লোক তথায় বসিয়াছিল, তাহারা এ কথোপকথন বা বাদ বিসম্বাদে যোগ দিল না। তাহারা স্থিরভাবে উভয়ের কথাবার্তা শুনিতে লাগিল।
সেই লোকটি উদ্ধতভাবে বলিল, “আমি বলছি, সে লোক ভাল নয়। কৈ—কে আমার কথায় প্রতিবাদ করতে সাহস করে দেখি।”
রায়মল্ল। তাঁকে ভাল লোক না বলার আপনার কোন বিশেষ কারণ আছে কি?
উত্তর। কারণ? কারণ আবার কি? চোর না হ’লে কি চোর ধরতে পারে?
রায়মল্ল। সব সময়ে সকলের পক্ষে ও কথা খাটে না।
উত্তর। তুমি কে হে? তোমায় ত কেউ আমাদের কথাবার্তায় বাধা দিতে ডাকে নি। তোমার এ রকম চড়া চড়া কথায় আমার রাগ হচ্ছে, বলছি—
রায়মল্ল। (বাধা দিয়া) রাগ হয়, ঘরের ভাত বেশি করে খেয়ো। তোমার কথা আমার অন্যায় ব’লে বোধ হ’ল, তাই আমি প্রতিবাদ করলেম। রায়মল্ল বোধ হয়, কখনও তোমার কিছু অনিষ্ট করেন নি। তাঁর অপরাধ দেওয়াতে তোমার কোন লাভ নাই।
উত্তর। তুমি কেমন ক’রে জানলে, সে কখনও আমার কোন অনিষ্ট করে নি?
রায়মল্ল। বটে, তবে তুমিও বুঝি রঘুনাথের দলের একজন? রঘুনাথকে দল শুদ্ধ ধরিয়ে দেওয়াতে বুঝি, তোমার এত গায়ের জ্বালা হয়েছে?
রায়মল্ল সাহেব যে লোকটার সঙ্গে কথা কহিতেছিলেন, তাহার আকার প্রকার দেখিলে সাধারণ লোক ভয় পায়। তাহার দেহ বেশ বলিষ্ঠ, সুগঠিত। সহসা দেখিলেই মনে হয়, তিনি অমিত পরাক্রমশালী তাহার সহিত এরূপভাবে বচসা করাতে সেখানে যে কয়জন লোক বসিয়াছিল, তাহারাসকলেই একটা ভয়ানক মারামারির সম্ভাবনা ভাবিতেছিল। সকলেই মনে করিতেছিল, এত বড় একটা প্রকাণ্ড পালওয়ানের সঙ্গে ঐ ক্ষীণদেহবিশিষ্ট, শান্তপ্রকৃতি লোকটা কি সাহসে এত বচসা করিতেছে। সে ওর একটা চড়ের ভর সহিতে পারিবে না যে! যাহা হউক, কেউ কিন্তু কোন কথা বলিতে সাহস করিল না। সে অনলে ঘৃতাহুতি প্রদানে কে উৎসুক হইবে?
সে লোকটি কিন্তু ক্রোধোন্মত্ত নয়। সুতরাং সে স্থির, ধীর, তজ্জন্য গম্ভীর হইয়া সে ব্যক্তি উত্তর করিল, “আমার বোধ হয়, তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ, তা’ জান না। আমি এখনও তোমার ভালর জন্য বলছি, মুখ সামলে কথা কও।”
রায়মল্ল। যে মহাপুরুষের সঙ্গে আমি কথা কইছি, সৌভাগ্যক্রমে তাঁর পরিচয় এখনও পাই নি আর জাব্বারও বড় বিশেষ কোন আবশ্যকতা দেখছি না।
তৎপরে রায়মল্লের প্রতি প্রশ্ন হইল, “তুমি কি এইখানকার লোক?”
রায়মল্ল। আমি যখন যেখানে থাকি, তখন সেইখানকার লোক। আমি এই রাজ্যের একজন প্ৰজামাত্র।
পুনরায় সেই লোকটা জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি দেখছি, রায়মল্লের বেজায় গোঁড়া। তার কোন অপবাদ শুনলে তোমার বড় কষ্ট হয়। কেমন, এই কথা ন্যায়? ‘
রায়মল্ল বলিলেন, “হাঁ, এ কথা কতকটা সত্য বটে। তাঁর অনুপস্থিতে যদি তাঁর উপরে কেউ মিথ্যা দোষারোপ করে, তা আমি সে কথা সহ্য করিতে পারি না।”
“আমি কি মিথ্যা দোষারোপ করছি?”
“নিশ্চয় করছ, তার আর কোন ভুল আছে? “
“আমার যা’ বিশ্বাস, আমি তাই বলছি।”
“তোমার এ বিশ্বাস ভুল।”
“কি! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? ফের্ যদি ও কথা বলবে, তবে এখনই মজা দেখাব, এখনই টের্ পাবে।”
“সেজন্য আমি কিছুমাত্র ভীত বা নিশ্চিন্ত নই। তুমি অনায়াসে আমার মজাটা দেখাতে পার আমি তার জন্য প্রস্তুত হ’য়েই আছি।”
“দেখ বন্ধু। তোমার মত স্পষ্টবক্তা লোক বড় ভালবাসি।”
রায়মল্ল। ইঃ। সহসা তোমার এরূপ বিরূপভাব দেখে আমার যে মনে বড় আশঙ্কা হচ্ছে। অকস্মাৎ মহাশয়ের মনোগতি এরূপভাবে পরিবর্তিত হ’ল যে?
“দেখ, তোমার মত আমুদে লোক আমার একটি দরকার; তুমি আমায় যে সব কড়া কথা বলেছ, সে সব আমি ক্ষমা করতে প্রস্তুত আছি।”
“আজ্ঞে সহসা অতটা দয়ালু হ’য়ে পড়বেন না। অধীন আপনার অনুগ্রহ প্রয়াসী নয়!” “তবে তুমি আমাকে রাগাবার জন্যই এই সব কথা বল্ছ?”
সেই মহাবলশালী ব্যক্তি এইবারে কিছু গম্ভীর অথচ ঈষৎ কোপান্বিত হইয়া উপরোক্ত কথা কয়টি বলিলেন। যেন বোধ হইল, এইবার রায়মল্ল গোয়েন্দা আর দ্বিতীয় কথা কহিলেই তিনি তাঁহাকে আক্রমণ করিবেন।
কিন্তু রায়মল্ল সাহেব এ কথায় কোন উত্তর না দিয়া মৃদু-মধুরভাবে হাসিতে লাগিলেন। সেই লোকটি তাঁহার এত সাহস দেখিয়া সেই সরাই-রক্ষককে সম্বোধন করিয়া বলিল, “এই লোকটা কি তোমার পরিচিত?“
সরাই-রক্ষক উত্তর করিল, “আমি ওকে পূৰ্ব্বে কখনও দেখি নাই, তবে আমি এই পৰ্য্যন্ত বলতে পারি, যে ভদ্রলোক আমার এই সামান্য চটিতে আসেন, ভদ্র ব্যবহার করেন, তিনি আমার বন্ধু”।
“দেখ, তোমায় আমি বলছি, তুমি ঐ লোকটিকে এখনই এই স্থান পরিত্যাগ করতে বল; তা’ না হ’লে ভাল হবে না।”
সরাই-রক্ষক উত্তর করিল, “ওকে তাড়িয়ে দেবার ত বিশেষ কোন কারণ দেখছি না। আমার এখানে আপনারও যেমন অধিকার, তারও সেই রকম। উনি ত কোন অন্যায় ব্যবহার করেন নি, কেন আমি ওকে চলে যেতে বলব?”
“তুমি যদি ওকে সরাই থেকে বিদায় করে দিতে না পার, তবে আমাকেই কি সে কাজ করতে হবে?”
আশে-পাশে বসিয়া যে-সকল লোক কেবল মজা দেখিতেছিল, তাহারা ভাবিল, “এইবারেই একটা বুঝি লড়াই বাধে।”