Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রঘু ডাকাত : পুণ্যের জয় হইল (দ্বিতীয় খণ্ড) || Panchkari Dey » Page 3

রঘু ডাকাত : পুণ্যের জয় হইল (দ্বিতীয় খণ্ড) || Panchkari Dey

এতক্ষণে দুই-একটি পূর্ব্ব ঘটনা বিবৃত করিবার সময় আসিয়াছে। রায়মল্ল গোয়েন্দা প্রায় দুই বৎসর ধরিয়া রঘু ডাকাতের দলকে-দল ধরিয়া দিবার জন্য চেষ্টা করিতেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি স্বকার্য্যসাধন করিতেছিলেন। তাঁহার পূর্ব্বে অন্যান্য অনেক সুদক্ষ পুলিশ-কৰ্ম্মচারী এ কার্য্যে নিয়োজিত হইয়াছিলেন; কিন্তু কেহই কৃতকাৰ্য্য হন্ নাই। এমন কি তাঁহাদের মধ্যে অনেককে আর জীবিত ফিরিয়া আসিতে দেখা যায় নাই। সাধারণের বিশ্বাস, তাঁহারা দস্যুগণের হস্তে নিহত হইয়াছেন।

রঘু ডাকাতের দলে প্রায় তিন সহস্র লোক। সে তাহাদিগের সদর। রঘু ডাকাতের দল নানাদিকে নানা কাৰ্য্যে ব্যাপৃত হইত। কোন সময়েই এক স্থানে সমস্ত লোক থাকিত না। ভিন্ন ভিন্ন কাৰ্য্যে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রেরিত হইয়া সমস্ত ভারতবর্ষ ছাইয়া থাকিত।

রায়মল্ল গোয়েন্দা দুই বৎসর ধরিয়া এই দস্যুদলের মূলোচ্ছেদ করিবার জন্য নানাবিধ উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন দোষে দোষী সাব্যস্ত করাইয়া তিনি দিনে দিনে রঘুনাথের দলের লোকসংখ্যা কমাইতেছিলেন। রঘুনাথ জানিত, তাহার দল সমস্ত ভারতবর্ষ ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে, আবশ্যক মত তাহাদের সাহায্য পাওয়া যাইবে; তবে এক-একটি লুণ্ঠনকার্য্যে এক-একটি দল নিযুক্ত হইয়া আর ফিরে আসে না কেন, এ সন্দেহও তাহার মনে মধ্যে মধ্যে উদিত হইত। কখনও রঘুনাথ ভাবিত, তাহারা আরও কোন নূতন কার্য্যে দূরদেশে গমন করিয়াছে, তাই ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব হইতেছে। কিন্তু ইহাও রায়মল্ল গোয়েন্দার ছল। রায়মল্ল প্রতাপের বেশে দস্যুদলের মধ্যে মিশিয়াছিলেন, সুতরাং কোন সংবাদই তাঁহার অগোচর থাকিত না কোথায় কখন্ কোন্ দল লুণ্ঠনকার্য্যে অগ্রসর হইতেছে, তিনি সে সকল সংবাদই রাখিতেন এবং পূৰ্ব্ব হইতেই তদপেক্ষা অধিক লোক সংগ্রহ করিয়া, তাহাদিগকে বন্দী করিয়া প্রমাণ-প্রয়োগ সংগ্রহে রাজদ্বারে দন্ডিত করাইতেন। অতর্কিত অবস্থা—এমন কি কখন কখন পথিমধ্যে নিদ্রিত অবস্থায় এক-একটি ছোট দস্যুদল ধৃত হইত; এইরূপে দিন দিন রঘুনাথের দলের সংখ্যা কমিয়া আসিতেছিল, তাহা রঘুনাথ অনুভব করিতে পারে নাই।

রায়মল্ল সাহেব দস্যুগণের ন্যায় কর্কশস্বরে কথা কহিতে পারিতেন। তাহাদের চলতি কথা, গ্ৰাম্য শব্দের ব্যবহার, ইঙ্গিত, গুপ্তকথা অনেক প্রকার গুপ্ত সঙ্কেত সকলই জানিতেন। এই কারণেই অনেকের সন্দেহ হইতে তিনি নির্বিঘ্নে পরিত্রাণ পাইতেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন দস্যুগণও তাঁহাকে সহজে চিনিতে পারিত না। একে একে তিনি রঘুনাথের দল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া নিজের লোক দ্বারা তাহাদিগের স্থান অধিকৃত করিতেছিলেন। তিনি সহসা কোন কাজ করেন নাই। চারিদিকের আটঘাট বাঁধিয়া, বেশ হিসাবে দোরস্ত রাখিয়া কৰ্ম্ম সম্পন্ন করিয়াছেন। ইহাতে বিঘ্ন-বিপত্তি হইবার, কত বিপদ-আপদ ঘটিবার, কতবার প্রাণ বিনষ্ট হইবার আশঙ্কা তাঁহাকে অতিক্রম করিতে হইয়াছিল।

এত বিপৎসঙ্কুল অবস্থায় পড়িয়াও রায়মল্ল সাহেব তারার কথা মুহুর্ত্তের জন্যও বিস্মৃত হন নাই। তাঁহার লোকজনের উপরে এই আজ্ঞা ছিল যে, যদি তারাকে সহসা কোন বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিতে কাহারও প্রাণ যায়, তথাপি প্রাণের আশা ছাড়িয়াও সে তাহা সম্পন্ন করিবে। মনে করিলে তিনি তারাকে যখন ইচ্ছা করিতেন, তখনই বলপ্রকাশে উদ্ধার করিতে পারিতেন; কিন্তু আত্মপ্রকাশ করিলে পাছে এতদিনের চেষ্টা বিফল হয়, পাছে রঘু ডাকাত পলায়ন করিতে সমর্থ হয়, এই ভয়ে তিনি যতক্ষণ পর্য্যন্ত না সমস্ত আয়োজন পূর্ণ করিতে পারিয়াছিলেন, ততক্ষণ বাধ্য হইয়া তারাকে দস্যু-কবল হইতে উদ্ধার করিতে চেষ্টা করেন নাই। বিশেষ প্রয়োজন হইলে তারার রক্ষার্থ নিশ্চয়ই তিনি নিশ্চেষ্ট থাকিতেন না।

পূর্ব্ব পরিচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনায় স্পষ্টই বলা হইয়াছে, রায়মল্ল গোয়েন্দার নাম উচ্চারিত হইবামাত্রই দস্যুগণ চমকিত বিস্মিত ও চকিত হইয়াছিল; তাহাদের কেশরাশি কণ্টকিত হইয়া ভয়ে সৰ্ব্বাঙ্গ কম্পান্বিত হইয়াছিল। সেই একজনের নামেই তাহাদের উষ্ণ শোণিত শীতল হইয়া গিয়াছিল। সদার রঘুনাথের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়াছিল। তাহার কথা কহিবার সামর্থ্য ছিল না। অতিকষ্টে ক্ষীণস্বরে সে বলিল, “আমি সব বুঝেও কানা হইয়াছিলাম।”

তারা আশ্চর্যান্বিত হইয়া এই অপূর্ব্ব ব্যাপার সন্দর্শন করিতেছিল। চারিদিকে এত লোক, সশস্ত্র প্রহরিবর্গ বেষ্টিত হস্তবদ্ধ দস্যুগণ, অথচ সেদিকে তাহার দৃষ্টি নাই। সে নির্নিমেষ নয়নে রায়মল্ল সাহেবের সেই বীরবপু প্রাণ-মন ভরিয়া দেখিতেছিল। মহা-সমর-বিজয়ী সেনাপতির ন্যায়-মহোল্লাসে উল্লসিত, অথচ চিন্তাযুক্ত ও ভবিষ্যৎ ভাবনায় চঞ্চল সেই নয়নদ্বয়ের দিকেই তাহার স্থির দৃষ্টি পড়িয়াছিল।

তারা ভাবিতেছিল, “এত গুণ না থাকিলে ভারতবর্ষের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কর্নে রায়মল্ল সাহেবের নাম প্রতিধ্বনিত হইবে কেন? এত সাহস, এত বুদ্ধি না থাকিলে এ গুরুতর কার্যভার তাঁহার উপরে পড়িবে কেন? বাস্তবিক বিনা রক্তপাতে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এই দস্যুগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা কম সাহস ও বুদ্ধির পরিচয় নয়।”

তারার দিকে একবার দৃষ্টি পড়াতেই রায়মল্ল সাহেব তাহার মনের ভাব বুতে পারিলেন;বুঝিয়া একটু হাসিলেন, তারা লজ্জিতা হইল।

রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “রঘু! এখন তোমার কি মনে হয়? কোম্পানী বাহাদুরের হাতে পড়লেই ত তোমার যাবজ্জীবন কারাবাস দন্ড হবে—”

কথায় বাধা দিয়া ক্রোধোন্মাদে রঘুনাথ বলিল, “রায়মল্ল গোয়েন্দা! কি আর বলব, রাগে আমার গা কাঁপছে; তোমার সর্ব্বনাশ হোক্!”

হাসিয়া রায়মল্ল কহিলেন, “রঘুনাথ! আমার সর্বনাশ যখন হবার তখন হবে, তখন তোমায় সাহায্যের জন্য ডাকতে যাব না; কিন্তু তুমি যার যোগ্য নও, যে অনুগ্রহ তোমার উপর করা যায় না, আমি আজ তাই করতে প্রস্তুত। তুমি আমার দয়া পেতে ইচ্ছা কর?”

রঘুনাথ। তোমার আর এত অধিক অনুগ্রহ দেখাতে হবে না। আজই না হয় বুদ্ধির দোষে তোমার হাতে পড়েছি। চিরদিন কখন এ রকম যাবে না। আমারও সময় আসবে, তখন দেখে নেবো, তুমি কত বড় গোয়েন্দা!

রায়মল্ল এ কথায় কর্নপাত না করিয়া হাসিমুখে অথচ অল্প গাম্ভীর্য্যের সহিত উত্তর করিলেন, “আমি তোমার উপকার করতে পারি, এ যাত্রা তোমায় বাঁচিয়ে দিতে পারি। মনে পড়ে, গাছের গুঁড়িতে ছোরা ছুড়ে কতকগুলো অকৃতকর্ম্মা লোকের কাছে এই আত্মশ্লাঘা করেছিলে যে, যদি আমার দেখা পাও, তা’ হ’লে আমার সেই দশা করবে—আমাকেও সেইরকম ক’রে হত্যা করবে। কৈ, আজ আমি ত একক তোমাদের সম্মুখে উপস্থিত। তোমার সে আত্মশ্লাঘা মনে পড়ে না?”

রঘু। তা’ হ’লে তুমি তখন ছদ্মবেশে আমাদের দলে মিশেছিলে, কেমন?

রায়মল্ল! হাঁ।

রঘু। তখন তুমি লোকটা কে, একবার অঙ্কুশেও জানতে দাও নি কেন? তা’ হলেই আমি তোমার কি করতেম, তা’ দেখতে পেতে।

রায়মল্ল। তখনও দেখা দেবার সময় হয় নি, তাই জানতে দিই নাই।

রঘু। তার মানে কি?

রায়মল্ল। কেন জান, তোমার সেদিনকার আত্মশ্লাঘা দেখে আমার মনে হয়েছিল, যেদিন সুযোগ হবে, সেইদিন তোমার দর্প চূর্ণ করব। আজ এতদিন পরে আমার মনের আশা মিটেছে। আমি যা’ বলি, তা’ করবে?

রঘু। তোমার কোন কথাই আমি আর শুতে চাই না।

রায়মল্ল। আমি যদি তোমার পালাবার উপায় করে দিই, তা’ হ’লে তুমি কি বল?

রঘুনাথ। পালাবার উপায় তুমি ক’রে দেবে? হাঁ ধিক্! মিথ্যাবাদী—প্রবঞ্চক!

রায়মল্ল। আমি মিথ্যা বলছি না। যদি তুমি আমার সঙ্গে পেরে উঠ, তা’ হ’লে তোমায় ছেড়ে দেবো।

রঘুনাথ। ছেড়ে দেবে? আশ্চৰ্য্য কথা!

রায়মল্ল সাহেব সদম্ভে বলিলেন, “হাঁ, ছেড়ে দেবো। তুমি আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছ?”

রঘুনাথ। যদি তোমায় খুন করে ফেলি, তা’ হ’লে যে আমার ফাঁসী হবে।

রায়মল্ল। আমি বলছি তোমার কিছু হবে না; বরং তুমি পালাতে পারবে।

রঘুনাথ। তোমার এই সব লোকজন আমায় সহজে ছাড়বে কেন?

রায়মল্ল। ওরা আমার হুকুম শুনতে বাধ্য। আমি যা’ বল্ব, তাই করবে। আমার আদেশ থাকলে ওরা তোমার কেশস্পর্শ করবে না।

রঘুনাথ। আমি ওসব কথা শুনতে চাই না। তোমার মত বিশ্বাসঘাতক লোকের কথায় আমার বিশ্বাস হয় না।

ক্রুদ্ধভাবে রায়মল্ল বলিলেন, “কি! যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা! যদি তুমি বন্দী না হ’তে, তা’ হ’লে আমায় বিশ্বাস করতে কি না করতে তা’ দেখে নিতুম। মুখ চিরে তোমার মুখের কথা মুখে প্রবেশ করিয়ে দিতুম।”

রঘুনাথ। এখন আমি তোমার হাতে বন্দী! তুমি যা মনে করবে তাই করতে পারবে। ইচ্ছা করলে তুমি আমায় কেটে ফেলতে পার। তোমার দয়ার উপরে এখন আমার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।

রায়মল্ল। বাঃ! তুমি ত বেশ মজার লোক দেখতে পাই। হাজার হাজার পাপ ক’রে হাজার হাজার লোকের ধন-রত্ন লুণ্ঠন, সতীত্বাপহরণ, প্রাণ বিনাশ ক’রে এখন আবার কেটে ফেলার কথা বলছ? মনে ক’রে দেখ দেখি, নিঃসহায় নিরপরাধ ব্যক্তিগণকে পাৰ্ব্বতীয় পথে যখন সামান্য ধনলোভে হত্যা করতে, তখন কি জানতে— তোমারও পাপের শাস্তিবিধান করবার জন্য উপরে একজন আছেন? তখন কি মনে হত, মানুষের প্রাণ সবারই সমান? তোমার প্রাণের যত মায়া-মমতা, তার প্রাণের ততোধিক মায়া হ’তে পারে। একদিনের তরেও কি ভেবে দেখেছিলে, দর্পহারী কারও দর্প রাখেন না— তোমারও দর্পও একদিন চূর্ণ হবে। আমি তোমায় অস্ত্ৰ-শস্ত্র দিচ্ছি, যা’ তোমার ইচ্ছা, তাই নাও—একবার আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর। যদি আমায় খুন করতে পার, তা হ’লেই তুমি আবার স্বাধীন হবে।

রঘুনাথ। আর তোমার এতগুলো লোক কোথায় যাবে? ওরা কি আমাকে সহজে ছাড়বে?

রায়মল্ল। একজন লোকও আমাদের যুদ্ধে বাধা দিবে না।

রঘুনাথ। আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব না।

রায়মল্ল। ভীরু! এতদিনের পর এই একটা সত্য কথা তোর মুখ থেকে বেরুল। তুই আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবি নি—নরাধম! তোর সাহস হয় না তাই বল্। তুই নেড়ী-কুত্তার জাত্।

রঘুনাথ। এখন তোমার মুখে যা’ আসে তাই বলতে পার; আমি তোমার অধীন। সকল কথাই আমাকে সহ্য করতে হবে।

রায়মল্ল। তোর মত ভীরু কাপুরুষ আমি নই। সম্মুখ-যুদ্ধে মরণকে আমি তুচ্ছজ্ঞান করি। আমি আমার এক হাত শরীরের সঙ্গে বেঁধে আর এক হাতে তোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছি। তোর দু’হাতে তুই যে অস্ত্র ইচ্ছে নে, আর আমার এক হাতে কেবল একখানা তলোয়ার দে, আমি সেই এক হাতেই তোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছি। আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি, কেউ আমার সহায়তা করতে আসবে না—কেউ আমাদের যুদ্ধে বাধা দেবে না—কেউ আমাদের মানা করবে না।

রঘুনাথ। রায়মল্ল, কিছুতেই আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজী নই।

ক্রোধে অধীর হইয়া বন্দী দস্যুগণের প্রতি দৃষ্টিসঞ্চালন করিয়া রায়মল্ল গোয়েন্দা বলিলেন, “দেখরে হতভাগারা! এতদিন কার সেবা করছিলি, কার অনুগত হয়েছিলি, কার কথায় উঠতিস্, বতিস্, কি রকম লোক তোদের উপরে প্রভুত্ব করত, কাকে তোরা রাজভোগ খাওয়াতিস্, লুণ্ঠিত দ্রব্যের অর্দ্ধভাগ প্রদান করতিস্। তোদের দলপতি কতবড় সাহসী বীরপুরুষ, একবার চেয়ে দেখ।”

বন্দী দস্যুগণ রায়মল্ল সাহেবের বীরত্বের প্রশংসা ও রঘুনাথের ভীরুতার নিন্দা করিতে লাগিল। এতদিন কুক্কুরের সেবা করিয়াছে বলিয়া তাহাদের অন্তরের অন্তস্তল হইতে ঘৃণার উদ্রেক হইল। সে চিহ্ন মুখে পৰ্য্যন্ত স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতে লাগিল।

রায়মল্ল গোয়েন্দা বড় আশা করিয়া এই সকল কথা বলিতেছিলেন;একদিন হাতে হাতে রঘুনাথকে নিজের বলবীর্য্য দেখাইবার জন্য তাঁহার বড় আশা ছিল। রঘুনাথকে এত ভীরু কাপুরুষ বলিয়া তিনি অনুমান করেন নাই। যখন দেখিলেন, রঘুনাথ যুদ্ধে কিছুতেই অগ্রসর হইতে সাহস করিতেছে না, তখন তিনি বলিলেন, “আচ্ছা রঘুনাথ! আমি তোমার দলকে দলশুদ্ধ ছেড়ে দিতে রাজী আছি, তুমি একবার আমার সঙ্গে সাহস ক’রে যুদ্ধ কর। মানুষ কেউ ত আর অমর নয়, একদিন না-একদিন মরতে ত হবেই, তবে বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে মর না কেন? রাজপুতের নামে কলঙ্ক ঘুচিয়ে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন কর না কেন? দেখ, যুদ্ধের কথা কিছু বলা যায় না। হয়ত তোমার অস্ত্রাঘাতে আমার প্রাণ বিয়োগ হ’তে পারে, হয়ত তুমি বেঁচে যেতে পার; তা’ হ’লে আজীবন তোমার একটা কীর্তি থাকবে—তোমার অনুচরগণ তোমায় দেবতার ন্যায় ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। কখনও কেউ তোমায় আর জেলে দিতে পারবে না, কখনও কেউ তোমায় বন্দী করতে সমর্থ হবে না। তুমি যেমন স্বাধীন ছিলে, যেমন পাৰ্ব্বতীয় প্রদেশের রাজা ছিলে, সেই রকমই থাকবে। আর কেউ তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে সাহস করবে না। কেউ তোমার কাছে ঘেঁসতে পারবে না।

রঘুনাথের আর উচ্চবাচ্য নাই। মুখে আর কথা সরে না। চারিদিকে দস্যুগণ গালি পাড়িতেছে। একজনের জন্য সকলের মুক্তি পাইবার আশা সত্বেও সে তাহাতে অগ্রসর হইতেছে না দেখিয়া, তাহাদের অন্তৰ্দ্দাহ উপস্থিত হইয়াছে। রঘুনাথের আর মুখ তুলিবার যো নাই, সাহস করিয়া কোনদিকে চাহিবার উপায়ও নাই।

তখন রায়মল্ল সাহেব নিরাশচিত্তে ঘৃণাসূচক স্বরে একজন প্রহরীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ইহাকে পদাঘাত করিতে করিতে কোতোয়ালীতে নিয়ে যাও। মানুষের চামড়া এর গায়ে আছে বটে, কিন্তু ওর দেহে মনুষ্যত্বের একবিন্দু নাই। যদি আমি দস্যুদলের মধ্যে ভীরু কাপুরুষ অথচ আত্মশ্লাঘায় পূৰ্ণ কোন লোক দেখে থাকি, তা’ হলে এর চেয়ে হীন ও নীচ আর কাকেও দেখি নি।”

রঘুনাথ মনে মনে বলিতে লাগিল, “মা গো বসুমতি দ্বিধা হও, আমি তোমার মধ্যে প্রবেশ করি—আর সহ্য হয় না।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *