ষোড়শ পরিচ্ছেদ – বিপদের অবসান
সদার রায়মল্ল অনুচরগণের উপর সমস্ত ভার সমর্পণ করিয়া যে নির্জ্জন বাড়ীতে অজয় সিংহ এবং তারাকে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন, তথায় উপস্থিত হইলেন। তথায় গিয়া যাহা দেখিলেন, তাহা পূৰ্ব্বেই বলা হইয়াছে। সেখান হইতে তিনি উন্মত্তের ন্যায় ছুটিয়া তারপর কি করিলেন বা কোথায় গেলেন, তাহা বলি নাই, এখন বলিতেছি।
তিনি একেবারে তারার পিতৃভবনের পশ্চাদ্দেশে উপস্থিত হইলেন। তারার পিত্রালয় না বলিয়া এখন জগৎসিংহের বাটী বলিলেও চলে। তখন লোকজন বড় কেহ ছিল না। তিনি অনায়াসে প্রাচীর উলঙ্ঘন করিয়া বাটীর ভিতরে পড়িলেন।
তারার পিতৃভবনের চতুর্দ্দিকে উদ্যান, মধ্যস্থলে সেই প্রকাণ্ড বাটী। রায়মল্ল সাহেব দ্রুতপদে সেই বাটীর নিকটবর্ত্তী হইলেন। সেই বাটীতে যেন জনমানব নাই। সকলেই যেন ঘোরতর অভিভূত ভাবে নিদ্রিত। রায়মল্ল সাহেব একটি সুদীর্ঘ বৃক্ষে আরোহণ করিলেন। সে বৃক্ষটী এমনভাবে দেওয়াল ঘেঁসিয়া উঠিয়াছে যে, চেষ্টা করিলে তাহারই একটা ডাল ধরিয়া অনায়াসে দ্বিতলের একটি দরদালানে অবতীর্ণ হওয়া যায়, বুঝিয়া রায়মল্ল সাহেব তাহাই করিলেন; তথাপি তিনি কাহারও কণ্ঠস্বর বা পদশব্দ শুনিতে পাইলেন না। তিনি এদিক-ওদিক্ চারিদিকে অনুসন্ধান করিলেন; কিন্তু কোথায়ও কাহারও আগমন অনুভব করিতে পারিলেন না। যেন বাড়ীতে কেহ নাই—চারিদিক্ নীরব।
রায়মল্ল সাহেব ত্রিতলে উঠিলেন। সেখানেও এদিক্-ওদিক্ চারিদিক্ অনুসন্ধান করিয়াও কিছু বুঝিতে পারিলেন না। একটী কক্ষের ভিতরে যেন খুব ক্ষীণ আলোকরশ্মি বহির্গত হইতেছিল। ব্যাগ্রভাবে সেই ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া, খড়খড়ীর একটী পাখী তুলিয়া দেখিলেন, ঘরের এক কোণে নিষ্প্রভভাবে একটি আলোক জ্বলিতেছে। আর শয্যার উপরে একটি স্ত্রীলোক শুইয়া আছে। রায়মল্ল সাহেব সেই কক্ষের দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া দরজার শিকল ধরিয়া টানিলেন। দরজা ভিতরদিক্ হইতে বন্ধ ছিল না, টানিবামাত্র খুলিয়া গেল। তিনি গৃহ মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। শয্যার পার্শ্বে দন্ডায়মান হইয়া দেখিতে পাইলেন, অভাগিনী তারা অচেতন অবস্থায় শিথিলবেশে আলুলায়িতকেশে সেই শয্যার উপরে পড়িয়া রহিয়াছে। রায়মল্ল সাহেব তারাকে সচেতন করিবার অনেক চেষ্টা করিলেন। কিন্তু সে উঠিল না। তিনি বুঝিলেন, তাহারা তারাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলিয়া রাখিয়াছে।
সেই সময়ে গৃহের বহির্দেশে যেন কাহার পদশব্দ শ্রুত হইল। রায়মল্ল সাহেব আর কোন উপায় না দেখিয়া পালঙ্কের নিম্নে লুকাইলেন। এক মুহূর্ত্ত পরেই সেই ঘরে জগৎসিংহ ও তারার বিমাতা প্রবেশ করিল।
তারার বিমাতা কহিল, “দেখ, আমি তোমাকে এখনও বারণ করছি—খুন ক’রো না।”
জগৎ। তুমি বুঝতে পারছ না সুন্দরি। তারাকে খুন করা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। যদি কোন জায়গায় লুকিয়ে রখি। রায়মল্ল তাকে যেমন ক’রে হক্, বার করবেই করবে। অন্তর্যামীর অজানিত ও বরং কিছু থাকতে পারে, কিন্তু ঐ রায়মল্লের অজানা কিছু নাই। এই যে আমরা এইখানে দাঁড়িয়ে কথা কচ্ছি, হয় ত অলক্ষিতভাবে সে আমাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। রায়মল্ল ভূতের মত লোকের পিছনে পিছনে ফেরে। কেউ তাকে দেখতে পায় না, কিন্তু সে সকলকে দেখতে পায়। দেশ- দেশান্তরে কোথায় কি ঘটনা হচ্ছে, সবই যেন তার নখদর্পণে রয়েছে। কে জানে, সে কি রকম? বোধ হয়, পিশাচবিদ্ধ হবে।
তারার বিমাতা বলিল, “এখন রায়মল্ল গোয়েন্দা কোথায়?”
জগৎ। রঘু ডাকাত আর রাজারাম দু’জনে মিলে রায়মল্লের পিছু নিয়েছে। আজ তারা রায়মল্লকে খুন করবে! কিন্তু এখনও ফিরে আসছে না ব’লে আমার সন্দেহ হচ্ছে। হয় ত রায়মল্লের হাতে ধরা প’ড়ে থাকবে।
তারার বিমাতা জিজ্ঞাসা করিল, “তা তুমি এখন কি করবে?”
জগৎ। আর খানিকটে অপেক্ষা ক’রে দেখ। যদি তা’রা ফিরে না আসে, তা’ হ’লে নিজেই খুন কব। দুজন লোক আমাদের খিড়কীর পুকুরের পাড়ে তেঁতুল গাছের তলায় একটা গর্ত খুঁড়ছে। খুন ক’রে সেইখানে পুঁতে ফেলব।
তারার বিমাতা। পুঁতেই যদি ফেলবে, তবে আর খুন করবার দরকার কি? এই অজ্ঞান অবস্থাতেই ত অনায়াসে পুঁতে ফেলতে পার।
জগৎ। ও আপদ চোকানই ভাল।
এই পৰ্য্যন্ত কথাবাৰ্ত্তা কহিয়া উভয়ে প্রস্থান করিল। রায়মল্ল সাহেব তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে বহির্গত হইয়া অলক্ষিতভাবে তাহাদের পশ্চাদগমন করিয়া দেখিলেন, তাহারা একটি পাশ্ববর্তী কক্ষে প্রবেশ করিল। রায়মল্ল সাহেব আর অপেক্ষা না করিয়াই তাড়াতাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। ক্ষিপ্রহস্তে তারাকে নিজস্কন্ধে তুলিয়া লইয়া প্রস্থান করিলেন। ত্রিতল হইতে দ্বিতল, তথা হইতে একতল, কোথাও কেহ বাধা দিল না; কিন্তু একতলে আসিয়া তিনি আর দ্বার খুঁজিয়া পাইলেন না। শেষে পদাঘাতে একটা দ্বারের অর্গল ভগ্ন করিয়া বহির্গত হইলেন।
সেই শব্দে বাড়ীর অন্যান্য লোকজন জাগিয়া উঠিল। ‘বাড়ীতে চোর এসেছে’ ‘ডাকাত পড়েছে’ ইত্যাকার রবে চারিদিকে একটা বিশেষ গোল পড়িয়া গেল। সেই গোলমালে জগৎসিংহ চক্ষু মুছিতে মুছিতে উঠিয়া আসিল, যেন কত নিদ্ৰা গিয়াছিল।
রায়মল্ল সাহেব ততক্ষণে নিরুদ্দেশ! তিনি তীরবেগে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িলেন। প্রথমেই যে প্রহরীকে দেখিলেন, তাহাকেই পুলিশের চিহ্ন দেখাইয়া সাহায্য করিতে বলিলেন। সে “জুড়ীদার হো,” “জুড়ীদার হো” বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে তাহার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়িতে লাগিল। পথিমধ্যে একটা গাড়ীর আড্ডা পাইয়া রায়মল্ল সাহেব একজন নিদ্রিত এক্কাওয়ালাকে উঠাইলেন। সে পাহারাওয়ালা দেখিয়াই চমকিত হইয়া গেল। রায়মল্ল সাহেব তারাকে লইয়া এক্কায় উঠিয়া বসিলেন, পাহারাওয়ালা আর একধারে উঠিল। হাঁকাহাঁকিতে আরও দুই চারিজন পাহারাওয়ালা আসিয়া পৌঁছিল। তাহারাও দুইজন করিয়া একখানি এক্কায় চড়িল। অতি অল্পক্ষণের মধেই রায়মল্ল সাহেব অজয় সিংহের নিকটে চৈতন্যবিহীনা তারাকে আনিয়া পৌঁছাইয়া দিলেন। মঙ্গল তারার সেবা-শুশ্রূষা করিতে লাগিল। রায়মল্ল সাহেব একখানি পত্র লিখিয়া কোতোয়ালীতে পাঠাইয়া দিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে পত্রের উত্তর আসিল। তাহা এই;-
“আপনার আদেশানুসারে আজ সমস্ত রাত্রি এবং কাল যতক্ষণ পর্য্যন্ত আপনার নিকট হইতে আমি নূতন আদেশ না পাই, ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত জগৎসিংহের বাটীর চতুর্দ্দিকে প্রহরিগণ নিযুক্ত থাকিবে। যাহাতে উক্ত বাটী হইতে একজন লোকও পলাইতেও না পারে, তজ্জন্য সম্পূর্ণ সচেষ্ট থাকিব। জগৎসিংহের সদর দরজার নিকটে আমি স্বয়ং ছদ্মবেশে উপস্থিত থাকিব। আপনার আজ্ঞামত আমার প্রহরীরাও সকলে ছদ্মবেশে অপরিচিতের ন্যায় বিচরণ করিবে। যাহাতে জগৎসিংহের বাটীর কোন লোক আমাদের উপস্থিতি বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহ করিতে না পারে, সে বিষয়ে আমার বিশেষ দৃষ্টি থাকিবে।”
পত্রের এইরূপ উত্তর পাইয়া রায়মল্ল সাহেব সেই বাটীতেই সেদিনকার মত বিশ্রামের আয়োজন করিলেন। অনুচরবর্গের মধ্যে তিনি যাহাকে যেরূপ অনুমতি দিলেন, সে তৎপ্রতিপালনার্থ ধাবিত হইল।