গোলাম কাদের বলিল
গোলাম কাদের বলিল, ‘বাবুজী, আমার এই কাহিনী আপনি বিশ্বাস করুন। আর নাই করুন, আমি যে পাগল নাই—আমার এই কথাটি আপনি অবিশ্বাস করিবেন না। সত্য কথা বলিতে কি, আমার কাছেও ইহা এক অদ্ভুত ব্যাপার; আমি কিতাব পড়ি নাই, আজীবন মাংস বিক্রয় করিয়াছি। গল্প বানাইয়া বলিবার শক্তি আমার নাই। যাহা আজি বলিব, তাহা আমি নিজে প্ৰত্যক্ষ করিয়াছি বলিয়াই বলিব। অথচ এ সকল ঘটনা আমার—এই গোলাম কন্দেরের জীবনে যে ঘটে নাই, তাহাও নিশ্চিত। আপনাকে কেমন করিয়া বুঝাইব জানি না, আমি মুখ লোক। শুধু এইটুকু বলিতে পারি যে, ইহা আজিকার ঘটনা নয়, বহু বহু যুগের পুরাতন।
‘তবে শুরু হইতেই কথাটা বলি। পনের-ষোল বৎসর পূর্বে আমার স্ত্রী এক কন্যা প্রসব করিতে গিয়া মারা যায়, মেয়েটিও মারা গেল। কি করিয়া জানি না, আমার মনের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া গেল যে, কোনও দুশমন আমার স্ত্রী-কন্যাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিয়াছে। শোকের অপেক্ষা ক্রোধ ও প্রতিহিংসায় আমার অন্তঃকরণ অধিক পূর্ণ হইয়া উঠিল; সর্বদাই মনে হইত, যদি সেই অজ্ঞাত দুশমনটাকে পাই, তাহা হইলে তাহার প্রতি অঙ্গ ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া ইহার প্রতিশোধ बल।
‘এইভাবে কিছুদিন কাটিবার পর ক্রমে বুঝিতে পারিলাম যে, ইহা আমার ভ্রান্তি-—সত্যের উপর ইহার কোনও প্রতিষ্ঠা নাই। তারপর যত দিন কাটিতে লাগিল, আস্তে আস্তে শোক এবং ক্ৰোধ দুই ভুলিতে লাগিলাম; কিন্তু আর বিবাহ করিতে পারিলাম না। শেষ পর্যন্ত হয়তো জীবনটা আমার এমনই সহজভাবে কাটিয়া যাইত, যদি না সে-দিন অশুভক্ষণে সেই লোকটা আমার দোকানো পদাপণ করিত।
‘শুনিয়াছি, মানুষ জলে ডুবিলে তাহার বিগত জীবনের সমস্ত ঘটনা ছবির মতো চোখের পর্দার উপর দেখিতে পায়। এই লোকটাকে দেখিবামাত্র আমারও ঠিক তাহাই হইল। এক মুহুর্তের মধ্যে চিনিয়া লইলাম—এই সেই নৃশংস রাক্ষস, যে আমার স্ত্রী-কন্যা এবং পিতাকে হত্যা করিয়াছিল। ছবির মতো সে সকল দৃশ্য আমার চোখের উপর জাগিয়া উঠিল। মজ্জামান জাহাজের উপর সেই মরণোন্মুখ অসহায় যাত্রীদের হাহাকার কানে বাজিতে লাগিল। ভাস্কো-ডা-গামার সেই ক্রুর হাসি আবার দেখিতে পাইলাম।
‘আমার জজসাহেবরা হত্যার কারণ খুঁজিতেছিলেন, কৈফিয়ৎ চাহিতেছিলেন। বাবুজী, আমি কি কৈফিয়ৎ দিব, আর দিলেই বা তাহা বুঝিত কে?
‘আপনি হয়তো বুঝিবেন। আপনার চোখে মুখে আমি তাহার পরিচয় পাইয়াছিলাম, তাই আপনাকে এই কষ্ট দিয়াছি। ইহাতে ফল কিছু হইবে না জানি, কিন্তু আমার হৃদয়ভার লাঘব হইবে; এ ছাড়া আমার অন্য স্বাৰ্থ নাই।
‘আমার এই কসাই।–জীবনের ইতিহাসটা এখানেই শেষ করিতেছি। এবার যাহার কথা আরম্ভ করিব, তাহার নাম মির্জা দাউদ বিন গোলাম সিদ্কী। আমিই যে এই মির্জা দাউদ, তাহা এখন ভুলিয়া যান। মনে করুন, ইহা আর কাহারও জীবনের কাহিনী।”—
কালিকটের নাম আপনি শুনিয়া থাকিবেন। মালাবার উপকূলে অতি সুন্দর মহার্ঘ মণিখণ্ডের মতো একটি ক্ষুদ্র নগর। মোরগের ডাক যতদূর শুনা যায়, ততদূর তাহার নগর-সীমানা। নগরের পশ্চাতে ছোট ছোট পাহাড়, উপত্যকা, কঙ্করপূর্ণ সমতল ক্ষেত্র, এবং তাহার পশ্চাতে অভ্ৰভেদী পশ্চিমঘাট সমস্ত পৃথিবী হইতে যেন এই স্থানটুকুকে পৃথক করিয়া ঘিরিয়া রাখিয়াছে। সম্মুখে অপার সমুদ্র ভিন্ন কালিকটে প্রবেশ বা নিস্ক্রমণের অন্য সুগম পথ নাই। এই সমুদ্রপথে অসংখ্য বাণিজ্যতরণী কলিকটের বন্দরে প্রবেশ করে, আবার পাল তুলিয়া সমুদ্রে বিলীন হইয়া যায়। কালিকট যেন পৃথিবীর সমগ্র বণিক-সমাজের মোসাফিরখানা।
পীতবর্ণ চৈনিক, তাম্রবর্ণ বাঙালী, লোহিতবর্ণ পারসিক, কৃষ্ণবর্ণ মুর—সকলেই কালিকটের পথে সমান দাপে পা ফেলিয়া চলে, কেহ কাহারও অপেক্ষা হীন নহে। চীন হইতে লাক্ষা, দারুশিল্প; ব্ৰহ্ম হইতে গজদন্ত; মলয়দ্বীপ হইতে চন্দন; বঙ্গ হইতে ক্ষৌম পট্টবস্ত্ৰ, মলমল, ব্যাঘ্রচর্ম; চম্পা ও মগধ হইতে চামর, কস্তুরী, চারু-কেশরার পুষ্পবীজ; দক্ষিণাত্য হইতে অগুরু, কপূর, দারুচিনি; লঙ্কা হইতে মুক্তা আসিয়া কালিকোট স্তুপীকৃত হয়। পশ্চিম হইতে তুরস্ক, পারসিক, আরব ও মুর সওদাগর তাঁহাই স্বর্ণের বিনিময়ে ক্রয় করিয়া জাহাজে তুলিয়া, কেহ বা পারস্যোপসাগরের ভিতর দিয়া ইউফ্রোটেস নদের মোহনায় উপস্থিত হয়, কেহ বা লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্তে নীলনদের সন্নিকটে গিয়া তরণী ভিড়ায়। তথা হইতে প্রাচী-র পণ্য সমগ্র পাশ্চাত্য খণ্ডে ছড়াইয়া পড়ে। কলিকটের রাজা সামরী বাণিজ্যতরণীর শুল্ক আদায় করিয়া রাজ্যের ব্যয়ভার নির্বাহ করেন। রাজকোষ সর্বদা সুবৰ্ণ-মণিমাণিক্যে পূর্ণ। রাজ্যে কোথাও দৈন্য নাই, অশান্তি নাই, অসন্তোষ নাই; ইতর-ভদ্র সকলেই সুখী।
মির্জা দাউদ এই কালিকটের একজন সন্ত্রান্ত ব্যবসায়ী। তাঁহার একুশখানি বাণিজ্যতরী আছে —‘হোয়াংহো হইতে নীলনদের প্রান্ত পর্যন্ত তাহদের গতিবিধি। যখন এই তরণী সকল শুভ্ৰ পাল তুলিয়া শ্রেণীবদ্ধভাবে সমুদ্রযাত্রায় বাহিত হয়, তখন মনে হয়, রাজহংস শ্রেণী পক্ষ বিস্তার করিয়া নীল আকাশে ভাসিয়া চলিয়াছে।
মির্জা দাউদ জাতিতে মুর। কালিকটে তাঁহার শ্বেত-প্রস্তরের প্রাসাদ মুর-প্রথায় নির্মিত। সুদূর মরক্কো দেশে এখনও তাঁহার বৃদ্ধ পিতা বর্তমান; কিন্তু তিনি কালিকোটকেই মাতৃভূমিত্বে বরণ করিয়াছেন। অনেক বৈদেশিক সওদাগরই এরূপ করিয়া থাকেন। মির্জা দাউদ ধর্মে মুসলমান হইলেও একপত্নীক। সম্প্রতি চৌত্ৰিশ বৎসর বয়সে প্রথমে একটি কন্যা জন্মিয়াছে। কন্যার জন্মদিনে মির্জা দাউদ এক সহস্ৰ তোলা সুবর্ণ বিতরণ করিয়াছেন—তারপর তাঁহার গৃহে সপ্তাহব্যাপী উৎসব চলিয়াছিল। নগরে ধন্য ধন্য পড়িয়া গিয়াছিল।
বস্তুত মির্জা দাউদের মতো সর্বজনপ্রিয় বহু-সম্মানিত ব্যক্তি নগরে আর দ্বিতীয় নাই। উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। স্বয়ং রাজা সামরী তাঁহাকে বন্ধুর মধ্যে গণ্য করেন। এদিকে ব্যবসায়ে দিন দিন অধিক অথাগম হইতেছে। মানুষ পৃথিবীতে যাহা কিছু পাইলে সুখী হয়, কিছুরই তাঁহার অভাব নাই।
একদিন গ্ৰীষ্মের সায়াহ্নে পশ্চিম দিশ্বলয় রঞ্জিত করিয়া সূৰ্য্যস্ত হইতেছে। সমুদ্রের জল যতদূর দৃষ্টি যায়, রাঙা হইয়া টলমল করিতেছে। দূর লাক্ষাদ্বীপ হইতে সুগন্ধ বহন করিয়া স্নিগ্ধ বায়ু বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। আকাশ মেঘ-নির্মুক্ত।
সমস্ত দিন গরম ভোগ করিয়া নগরের নরনারী শীতল বায়ু সেবন করিবার জন্য এই সময় বন্দরের ঘাটে আসিয়া জমিয়াছে। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি ঘটে—বড় বড় চতুষ্কোণ পাথর দিয়া বাঁধানো। পাথরের উপর সারি সারি জাহাজ বাঁধিবার লোহার কড়া। জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল ওই ঘাটের কানায় কানায় ভরিয়া উঠে, আবার ভাঁটার সময় সিক্ত বালুকারাশি মধ্যে রাখিয়া দূরে সরিয়া যায়। এই ঘটই নগরের কর্মকেন্দ্র। ক্রয়-বিক্রয়, দর-দস্তুর, আমোদ-প্ৰমোদ সমস্তই এই স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। তাই সকল সময় এখানে মানুষের ভিড়।
সে সময় ঘাটে একটিও নবাগত কিংবা বহিগামী বাণিজ্যতরী ছিল না। কাজকর্ম কিছু শিথিল। নাগরিকগণ নানা বিচিত্র বেশ পরিধান করিয়া কেহ সন্ত্রীক সপুত্রকন্যা পদচারণা করিতেছে, কেহ উচ্চৈঃস্বরে গান ধরিয়াছে। চঞ্চলমতি কিশোরগণ ছুটাছুটি করিয়া খেলা করিতেছে, আবার কেহ বা ঘাট হইতে সমুদ্রের জলে লাফাইয়া পড়িয়া সন্তরণ করিতেছে।
চীনদেশীয় এক বাজিকর নানা প্রকার অদ্ভুত খেলা দেখাইতেছে। জনতার মধ্য হইতে মাঝে মাঝে উচ্চ হাসির রোল উঠিতেছে।
বাজিকর একজন স্থূলকায় প্রৌঢ় সিংহলীকে ধরিয়া তাহার কানের মধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, ‘তোমার মাথার মধ্যে ২৫৬টি পাথরের নুড়ি রহিয়াছে, বল তো বাহির করিয়া দিই।’ অমনিই জনতা সোল্লাসে চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘বাহির কর, বাহির কর।’ তখন বাজ্যিকর ক্ষিপ্ৰহস্তে ক্ষুদ্র চিমটা দিয়া তাহার কর্ণ হইতে সুপারীর মতো বড় বড় অসংখ্য পাথর বাহির করিয়া মাটিতে স্তুপীকৃত করিল। প্রৌঢ় সিংহলী বিস্ময়ে বিহ্বল হইয়া চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহা দেখিতে লাগিল। ভারি হাসির একটা ধুম পড়িয়া গেল। একজন পরিহাস করিয়া বলিল, “শেঠ, তোমার মাথা যে এত নিরেট, তাহা জানিতাম না।’
ক্ৰমে সূর্য অস্তমিত হইল। সমুদ্রের গায়ে সীসার রং লাগিল। দিগন্তরেখার যে স্থানটায় সূর্য অস্ত গিয়াছিল, তাহাকে কেন্দ্ৰ করিয়া সন্ধ্যার রক্তিমাভা ধীরে ধীরে সংকুচিত হইয়া আসিতে লাগিল।
এমন সময় দূর সমুদ্রবক্ষে সেই রক্তিমাভার সম্মুখে তিনটি কৃষ্ণবর্ণের ছায়া আবির্ভূত হইল। সকলে দেখিল, তিনখানি জাহাজ বন্দরের মধ্যে প্ৰবেশ করিতেছে।
তখন, জাহাজ কোথা হইতে আসিয়াছে, কাহার জাহাজ-ইহা লইয়া ঘাটের দর্শকদিগের মধ্যে তর্ক চলিতে লাগিল। কেহ বলিল, আরবী জাহাজ, কেহ বলিল, চীনা; কিন্তু অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছিল—কোন দেশীয় জাহাজ, নিশ্চয়রূপে কিছু বুঝা গেল না।
মির্জা দাউদ ঘাটে ছিলেন। তিনি বহুক্ষণ একদৃষ্টি সেই জাহাজ তিনটির প্রতি চাহিয়া রহিলেন। ক্রমে তাঁহার মুখে উদ্বেগের চিহ্ন দেখা দিল। তিনি অস্ফুটম্বরে কহিলেন, ‘পোর্তুগীজ জাহাজ!—কিন্তু ফিরিঙ্গী কোন পথে আসিল?”
তারপর গগনপ্রান্তে দিবা-দীপ্তি নিবিয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি জীর্ণ সিন্ধুবিধ্বস্ত ক্ষুদ্র পোত ছিন্ন পাল নামাইয়া কালিকটের বন্দরে আসিয়া ভিড়িল।
পরদিন প্ৰভাতে সূযোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মির্জা দাউদ বন্দরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, কয়েকজন বিদেশীকে ঘিরিয়া ভারি ভিড় জমিয়া গিয়াছে। ফিরিঙ্গীগণ অপরিচিত ভাষায় কি বলিতেছে, কেহই বুঝিতেছে না এবং প্রত্যুত্তরে নানা দেশীয় ভাষায় তাহাদের প্রশ্ন করিতেছে। মির্জা দাউদ ভিড় ঠেলিয়া তাহাদের সম্মুখীন হইলেন। তাঁহাকে আসিতে দেখিয়া সকলে সসম্মানে পথ ছাড়িয়া দিল।
আগন্তুকদিগের মধ্যে একজন বলিল, ‘এখানে পোর্তুগীজ ভাষা বুঝে, এমন কেহ কি নাই? আমি জামেরিনের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাই-দোভাষী খুঁজিতেছি।’
মির্জা দাউদ দেখিলেন, বক্তা শালপ্ৰাংশু বিশালদেহ এক পুরুষ। তপ্ত কাঞ্চনের ন্যায় বর্ণ, দীর্ঘ স্বণভি কেশ এবং হ্রস্ব সূচ্যগ্ৰ শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল। উধ্বাঙ্গে সোনার জরির কাজ-করা অতি মূল্যবান মখমলের অঙ্গরক্ষা, কটি হইতে জানু পর্যন্ত ঐ মখমলের জঙিয়া এবং জানু হইতে নিম্নে পদদ্বয় চমনির্মিত খাপে আবৃত। মস্তকে টুপির উপর কঙ্কপত্র বক্রভাবে অবস্থিত; এই পুরুষের সহিত অন্য পাঁচ-ছয় জন যাহারা রহিয়াছে, তাহারাও প্রায় অনুরূপ বেশধারী। সকলের কোটবন্ধে তরবারি।
মির্জা দাউদ এই প্রধান পুরুষের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া গভীরস্বরে কহিলেন, ‘আমি পোর্তুগীজ ভাষা বুঝি।’
নবাগত কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে মির্জা দাউদের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। তাহার মুখ অন্ধকার হইল। সে ধীরে ধীরে কহিল, ‘তুমি দেখিতেছি মুর!’
এই তিনটি শব্দের অন্তর্নিহিত যে সুতীক্ষ্ণ ঘৃণা, তাহা মীর্জা দাউদকে বিদ্ধ করিল। তিনিও মনোগত বিদ্বেষ গোপন করিবার চেষ্টা না করিয়া কহিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি মূর। তোমরা দেখিতেছি পোর্তুগীজ—জলদস্যু; তোমাদের সহিত পরিচয় আমার প্রথম নহে, কিন্তু ফিরিঙ্গীর সঙ্গে আমাদের সদ্ভাব নাই।’
এতক্ষণে দ্বিতীয় একজন পোর্তুগীজ কথা কহিল। তাহার বয়স অল্প, উদ্ধতকণ্ঠে বলিল, ‘মূর-কুকুরের সহিত আমরা সদ্ভাব রাখি না।—মুরের উচ্ছেদ করাই আমাদের ধর্ম।’
নিমেষমধ্যে মির্জা দাউদের কটি হইতে ছুরিকা বাহির হইয়া আসিল, দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল; কিন্তু পরীক্ষণেই আগন্তুকদিগের প্রধান ব্যক্তি হাত তুলিয়া তাহাকে নিরস্ত করিল। বিনীতস্বরে কহিল, ‘মহাশয়, আমার এই স্পর্ধিত সঙ্গীকে ক্ষমা করুন। আপনি মুর এবং আমরা পোর্তুগীজ বটে; কিন্তু আমরা উভয়েই ব্যবসায়ী, জলদস্যু নাহি। অন্যত্র যাহাই হোক, এখানে আমার সহিত আপনাদের বিবাদ নাই। বরঞ্চ আপনার হৃদ্যতা লাভ করিলেই আমরা কৃতাৰ্থ হইব।’ তারপর নিজ সঙ্গীর দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘পেড্রো, আর কখনও যদি তোমার মুখে এরূপ কথা শুনিতে পাই, তোমার প্রত্যেক অস্থি চাকায় ভাঙিয়া তারপর ডালকুত্তা দিয়া খাওয়াইব।’
ভয়ে পেড্রোর মুখ পীতবর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু তথাপি সে কম্পিত বিদ্রোহের কণ্ঠে কহিল, ‘আমি সত্য কথা বলিতে ভয় করি না। মূরমাত্রেই আমাদের ঘৃণার পাত্র। আপনি নিজেও তো মূরকে—’
তাহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই প্রথম ব্যক্তি বিদ্যুতের মতো দুই হাত বাড়াইয়া তাহার কণ্ঠ চাপিয়া ধরিল। বজমুষ্টিতে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাহার কণ্ঠনালী চাপিয়া থাকিবার পর ছাড়িয়া দিতেই পেড্রো হতজ্ঞান হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। তাহার প্রতি আর দৃকপাত না করিয়া প্রথম ব্যক্তি মির্জা দাউদের দিকে ফিরিয়া ঈষৎ হাস্যে কহিল, ‘মিথ্যাবাদীর দণ্ডদান ধার্মিকের কর্তব্য। এখন দয়া করিয়া আমার সহিত জামোরিনের নিকট গিয়া আমার নিবেদন তাঁহাকে বুঝাইয়া দিলে আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ রহিব।”—বলিয়া মাথার টুপি খুলিয়া আভূমি লুষ্ঠিত করিয়া অভিবাদন করিল। দর্শকবৃন্দ—যাহারা পোর্তুগীজ ভাষা বুঝিল না, তাহারা অবাক হইয়া এই দুর্বোধ্য অভিনয় দেখিতে লাগিল।
মির্জা দাউদ আগন্তুকের মিষ্ট বাক্যে ভুলিলেন না, অটল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। শেষে ধীরে ধীরে কহিলেন, ‘ফিরিঙ্গী, তুমি অতি ধূৰ্ত। কি জন্য সামরীর রাজ্যে আসিয়াছ, সত্য বল।’
‘বাণিজ্য করিতে।’
‘খ্রীস্টান, আমি তোমাদের চিনি। কলহ তোমাদের ব্যবসায়, লোভ তোমাদের ধর্ম, পরশ্ৰীকাতরতা তোমাদের স্বভাব। এ রাজ্যে কলহ-বিদ্বেষ নাই—হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, হিব্রু নির্বিবাদে শান্তিতে ব্যবসায়-বাণিজ্য করিতেছে। সত্য বল, তোমরা কি উদ্দেশ্যে এই হিন্দে পদাৰ্পণ করিয়াছ?’
ফিরিঙ্গীর মুখ রক্তহীন হইয়া গেল! শুধু তাহার চক্ষুযুগল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো নিশ্বফল ক্রোধ ও হিংসা বিকীর্ণ করিতে লাগিল; কিন্তু পরীক্ষণেই আপনাকে সংবরণ করিয়া সে কণ্ঠবিলম্বিত সুবৰ্ণ-ত্রুশি হস্তে তুলিয়া বলিল, “এই ক্রুশ স্পর্শ করিয়া সত্য করিতেছি।–সকলের সহিত সদ্ভাব রাখিয়া বাণিজ্য করা ব্যতীত আমাদের আর অন্য উদ্দেশ্য নাই।”
ক্ষণকাল নিঃশব্দে তাহার মুখের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া মির্জা দাউদ কহিলেন, “তোমার কথা বিশ্বাস করিলাম। চল, সামরীর প্রাসাদে তোমাদের লইয়া যাই।”
তখন বিদেশীরা মির্জা দাউদের অনুসরণ করিয়া রাজপ্রাসাদ অভিমুখে চলিল। পেড্রোর সংজ্ঞাহীন দেহ ঘাটের পাথরের উপর মৃত্যুবৎ পড়িয়া রহিল।
প্রাসাদে উপস্থিত হইয়া সামরীর সম্মুখে নতজানু হইয়া তাঁহার বস্ত্রপ্রান্ত চুম্বন করিয়া পোর্তুগীজ বণিকদিগের অধিনায়ক বলিল, “আমার নাম ভাস্কো-ডা-গামা—আমি পোর্তুগালের রাজদূত। আপনার নিকট কালিকটে বাণিজ্য করিবার অনুমতি প্রার্থনা করিতেছি।” এই বলিয়া পোর্তুগাল-রাজ-প্রেরিত মহার্ঘ উপটৌকন সকল সামরীর সম্মুখে স্থাপন করিতে সঙ্গীগণকে ইঙ্গিত করিল।