Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রক্তের আততায়ী (২০১৪) || Samaresh Majumdar » Page 3

রক্তের আততায়ী (২০১৪) || Samaresh Majumdar

মিনিট আটেকের মধ্যে গভীর জঙ্গলের ভেতরে পৌঁছে গেল ওরা। চার ধার ভয়ংকর থমথমে। সবচেয়ে বিস্ময়ের, গাছগুলোতে কোনও পাখি নেই। ডুয়ার্সের জঙ্গলে ঢুকলে পাখিরা প্রবলভাবে হইচই করে। এখানে তাদের আত্মীয়রা নেই কেন? সড়সড় শব্দ কানে আসতেই অর্জুন ইশারায় মেজরকে থামতে বলল। শব্দটা ভেসে আসছে ডানদিকের ঝোঁপ থেকে। মেজর ফিসফিস করলেন, চার পায়ের জন্তু। অ্যাটাক করলে বিপদে পড়ব। সঙ্গে কোনও আর্মস নেই।

জঙ্গলে ঢোকার পর একটু মোটা ডাল কুড়িয়ে নিয়েছিল অর্জুন। সেটা দিয়ে আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়, ভয় দেখানো যেতে পারে। ঝোঁপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অর্জুন হেসে উঠল, একটা বুনো শুয়োরের বাচ্চা মুখ বের করে তাদের দেখছে। তারপরেই সম্ভবত ওর মা, ওকে টেনে নিয়ে গেল ঝোঁপের ভেতরে। পায়ের আওয়াজগুলো দূরে মিলিয়ে গেল।

অর্জুন বলল, মেজর আপনি ঠিক বলেছিলেন, চার পায়ের জন্তু।

তাই বলে ভেবো না শুয়োরও ছাগলদের মতো নিরীহ প্রাণী। বুনো শুয়োরের ভয়ংকর দাঁতের আঘাতে বাঘও আহত হয়ে পালায়। চলো। মেজর আবার সহজ হলেন। তারপর পকেট থেকে চুরুট বের করেও রেখে দিলেন, না, থাক।

ক্রমশ আকাশ চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছিল। লম্বা গাছগুলো তাদের ডালপালা ছড়িয়ে আকাশকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। মেজর বললেন, ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন সেভেন্টি–। সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে তাকে থামাল অর্জুন।

মেজর মুখ বন্ধ করে কান পাতলেন, কেক কেক শব্দ এখন স্পষ্ট। শব্দটা যেদিক থেকে আসছিল সেদিকে খানিকটা এগোতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল ওরা। একটা বড় সাইজের হরিণকে গেলার চেষ্টা করছে বেশ মোটা সাপ। অতবড় হরিণের শরীর অর্ধেক গিলে ফেললেও বাকিটাকে পেটে চালান করতে অসুবিধে হচ্ছে। সাপের মুখ অতটা বড় হতে পারে তা অর্জুনের কল্পনার বাইরে। হরিণের শিং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। মেজর নিচু গলায় বললেন, আনাকোন্ডা!

অসম্ভব। ওটা অজগর। অর্জুন প্রতিবাদ করল।

একই ব্যাপার। ওরা ভাই ভাই। মেজরের কথা শেষ হতেই জঙ্গলের ভেতর থেকে মানুষের গলা ভেসে এল। বেশ উত্তেজিত হয়ে এদিকে আসার সময় বুনো ঝোঁপ কাটছে। অর্জুন বলল, তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ুন। ওইদিকে।

পেছনের এক ঘন ঝোঁপের আড়ালে চলে গিয়ে মেজর ফিসফিস করলেন, হোয়াই? লুকোলে কেন? যারা আসছে তারা তো জানোয়ার নয়।

জঙ্গলের গভীরে যেসব মানুষ লুকিয়ে থাকে তারা জানোয়ারের চেয়েও হিংস্র হতে পারে। চুপচাপ দেখি। অর্জুন বলল।

চারটে লোক, জন ভুটানি, হাতে লম্বা ছুরি, এগিয়ে এসে সাপ এবং হরিণটাকে দেখল। তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাপের ওপরে। সাপ তখন হরিণকে উগরে দেওয়ার চেষ্ট করছে। কিন্তু তার আগেই লোকগুলো ওকে মেরে ফেলল। পেট কেটে ফেললে হরিণটার শরীর বেরিয়ে এল বাইরে। দেখামাত্র উল্লসিত হল চারজন। হরিণটার চারটে পা বেঁধে গাছের ডাল কেটে ঝুলিয়ে নিল। সাপের মাথার নীচে শক্ত সুতোর বাঁধন দিয়ে টানতে টানতে ওরা আবার ঢুকে পড়ল যেদিক থেকে এসেছিল সেইদিকে।

মেজর বললেন, অদ্ভুত, এরা হরিণের মাংস খেতেই পারে কিন্তু সাপের মাংসও খাবে?

অর্জুন বলল, চিনে শুনেছি সাপের মাংস খুব জনপ্রিয়। কিন্তু এই লোকগুলো জঙ্গলে কেন?

মেজর বললেন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

কী?

লোকগুলোর কাছে গিয়ে আমরা অ্যাপ্রোচ করতে পারি, ওরা যদি নাতাশাকে খানিকটা রক্ত এক্সপেরিমেন্টের জন্য দেয় তা হলে তার বদলে টাকা পাবে। মেজর বললেন।

ওরা রাজি হবে বলে মনে হচ্ছে আপনার?

আলবাত হবে। ওরা জঙ্গলে পড়ে আছে কেন? নিশ্চয়ই টাকা রোজগার করতে আর সেটা বেআইনিভাবে! টাকা পেলে বর্তে যাবে ওরা।

না মেজর, এমন তো হতে পারে ওরা ভুটানের বনদফতরের কর্মী। জঙ্গলের ভেতরে থেকে পাহারা দেওয়াই ওদের ডিউটি। অর্জুন বলল।

মেজর ঘড়ি দেখলেন, তা হলে কী করবে?

এখন এই পর্যন্ত থাক। আপনার নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে!

দাড়িতে আঙুল ঢোকালেন মেজর, ঠিক বলেছ!’

.

মুরগির মাংস, স্কোয়াসের তরকারি আর ভাত। দারুণ রান্না করেছিল লিটুর সহকারী। মেজর উঃ, আঃ, করেও পুরোটা খেয়ে নিলেন। খেতে খেতে নাতাশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মাই গড, তুমি চিকেন খাচ্ছ কী করে? ঝাল লাগছে না?

নাতাশা নাথা নাড়ল, না তো, খুব সুন্দর। এত ভাল চিকেন আর কখনও খাইনি! মেজর বিড়বিড় করলেন, তা হলে কি আমার মুখে ঘা হয়েছে।

লিটু পরিবেশন করছিল। বলল, মেমসাহেবের জন্যে আলাদা রান্না করা হয়েছে। আপনার যদি ভাল লেগে থাকে তা হলে আপনাকেও ওইরকম রান্না করে দেব। মেজর কথা বলছিলেন ইংরেজিতে। চোখ বড় করলেন, তুমি ইংরেজি বোঝো!’

অল্প অল্প।

খবরদার। আমাকে আজ যা দিয়েছ তাই দেবে।

খাওয়া হচ্ছিল একটা ফোল্ডিং টেবিলের চারপাশে চেয়ার পেতে। এগুলো সহজে ভাঁজ করে নিয়ে আসা হয়েছে তাঁবুর সঙ্গে।

জঙ্গলে আজ অজগরকে হরিণ গিলতে দেখলাম। অর্জুন বলল।

অমল সোম বললেন, নতুন কথা নয়। পৃথিবীর সর্বত্র অজগরেরা হরিণ পেলেই গিলে ফ্যালে। শক্তি যার বেশি সে দুর্বলকে শোষণ করে।

মেজর বললেন, সেই সাপ আর হরিণকে মেরে নিয়ে গেল কয়েকটা লোক। সাসপিসিয়াস ক্যারেক্টার।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কোথায় কোথায় গেলেন?

এই এদিক ওদিক। অমল সোম বললেন, আমি বুঝতে পারছি না নাতাশার কাজ কী করে সহজ হবে। অবশ্য হতে পারে একটু মিথ্যাচার করলে।

কীরকম? মেজর জিজ্ঞাসা করলেন।

অমল সোম মুখ ফেরালেন, লিটু, এদিকে এসো।

লিটু এগিয়ে এলে বললেন, তুমি তো এখানে আগেও এসেছ। তাই?

হ্যাঁ, সাহেব। লিটু মাথা নাড়াল।

আচ্ছা, এখানকার মানুষ অসুস্থ হলে কোথায় চিকিৎসা করায়?

একজন ভুটানি হাকিম আছে। তার কাছে যায়। যার পক্ষে সম্ভব সে। থিমারেখার হেৰ্থ সেন্টারে চলে যায়। লিটু বলল।

সেখানে তো রক্ত পরীক্ষা করা হয় না।

না সাহেব। সেটা করাতে যে টাকা লাগে তা এরা কোথায় পাবে। আর রক্ত পরীক্ষা তো থিম্পু বা চুখা ছাড়া সম্ভব হয় না। অতদূর যেতে পারে না ওরা। লিটু বলল, অসুখ হলে খুব বিপদ।

এই যে মেমসাহেব আমাদের সঙ্গে এসেছেন, ইনি একজন ডাক্তার। যদি কেউ চায় তা হলে এখানে এসে ওর কাছে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারে। সেই রিপোর্ট থিমারেখার হেৰ্থ সেন্টারের ডাক্তারকে দেখালে তিনি থিম্পু থেকে ওষুধ আনিয়ে দিতে পারেন। তুমি এখানকার লোকদের বলতে পারো, তারা যদি উৎসাহিত হয়।

লিটু মাথা নাড়ল, মনে হয় না কেউ রাজি হবে। শরীর থেকে রক্ত বের করতে খুব ভয় পায় এরা। তবু সাহেব যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই সবাইকে। জানাব।

খাওয়ার পর সবাই যখন তাঁবুতে বিশ্রাম নিতে ঢুকে গেল তখন অর্জুন জায়গাটাকে দেখতে বের হল। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি, মানুষগুলো যে অত্যন্ত অভাবী তা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। একটা দোকান চোখে পড়ল, যেখানে অতি প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়। এখানকার লোকজনের রোজগার কী থেকে হয়? বেঁচে থাকতে হলে তো টাকার প্রয়োজন। অর্জুন। লক্ষ করছিল এখানকার কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। পুরুষরা বাড়ির সামনে। অলসভাবে বসে আছে। যেন তাদের কিছুই করার নেই।

রাস্তার বাঁক ঘুরতেই একটা জটলা দেখতে পেল অর্জুন। কেউ একজন উত্তেজিত হয়ে ভুটানি ভাষায় চিৎকার করছে। বাকিরা মাথা নিচু করে শুনছে। অর্জুন আর একটু এগিয়ে যেতেই লোকটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল। সেই লোকটা! তিস্তার চরে, রিকশায়, থিমারেখায় যে লোকটকে দেখেছিল সে এখানে কাউকে শাসাচ্ছে। শাসানির ভাষা বোঝার দরকার হয় না। অর্জুন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পাশ দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করল। হঠাৎ লোকটা চিৎকার থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ট্যুরিস্ট?!

অর্জুন দাঁড়াল, হ্যাঁ, বেড়াতে এসেছি।

লোকটা হিন্দিতে বলল, এখানে কেউ বেড়াতে আসেন। থিম্পু, পারোতে যায়। এখানকার খবর আপনাকে কে দিল?

নেট থেকে পেয়েছি। গুগলে গেলেই পাবেন।

লোকটা হাত তুলল, জানি জানি। এই কম্পিউটার মানুষের সমস্ত প্রাইভেসি কেড়ে নিচ্ছে। কোথায় উঠেছেন?

আমরা তাবুতে আছি।

কজন?

চারজন ট্যুরিস্ট আর পোর্টার।

আপনি হিন্দু না মুসলমান?

প্রশ্নটা শুনে মজা লাগল অর্জুনের। বলল, আমি তো খ্রিস্টানও হতে পারি। কেন জানতে চাইছেন?

তার মানে আপনি বৌদ্ধধর্মের মানুষ নন?

বুদ্ধদেবকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি!

ঠিক আছে। যান। হাত নাড়ল লোকটা।

বেশি দূর যেতে হল না। পথ শেষ হয়ে গেছে পাহাড়ের গায়ে। অর্জুন ফিরে আসার সময় দেখল লোকটা সেখানে নেই। যাকে লোকটা ধমকাচ্ছিল সে দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। অর্জুন কাছে যেতেই শুনতে পেল, একটু পরেই অন্ধকার নামবে সাহেব। তার আগেই টেন্টে ফিরে যান।

লোকটা হিন্দিতে কথাগুলো বলল। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আমি যে টেন্টে থাকব বলেই মনে পড়ে গেল তার, এ কথা তো সে একটু আগেই এখানে বলেছে। ততক্ষণে লোকটা কাছে এসেছে, সাহেব আমি লিটুর বন্ধু। ওর কাছে আপনাদের আসার কথা শুনেছি।

অর্জুন লোকটিকে দেখল, অন্ধকার নামলে কি এই জায়গা নিরাপদ নয়?

লোকটা ইতস্তত করল, তারপর বলল, আপনি যেমন ভাববেন।

তোমার কথা নিশ্চয়ই শুনব। কিন্তু বলো তো, একটু আগে একটা লোক এখানে দাঁড়িয়ে খুব ধমকাচ্ছিল, যাকে ধমকাচ্ছিল সে ওখানে বসে কাঁদছে, কী ব্যাপার?

লোকটা পেছনদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, আপনি টেন্টের দিকে এগিয়ে যান, আমি একটু পরে এসে বলছি। এখানে বললে বিপদ হবে।

অর্জুন ধীরে হাঁটতে শুরু করল। লিটুর পরিচিত এই লোকটার কথায় রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল, তিস্তার চরের ওই লোকটা এখানে বেশ ক্ষমতাবান। সাধারণ মানুষ ওকে ভয় পায়।

মিনিট দশেক হাঁটার পর অর্জুন দেখল লিটুর বন্ধু পাকদণ্ডির পথ ধরে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসছে। পাশে পৌঁছে লোকটা বলল, আমার নাম নিমা, নিমা ভুটিয়া। আপনারা যে কদিন থাকবেন সেই কয়েকদিন একটা চাকরি দিন না সাহেব। খুব উপকার হয়।

অর্জুন অবাক হল, এ কথা তুমি লিটুকে বলছ না কেন?

বলেছি। ও বলল, সাহেবদের সঙ্গে সেই কথা হয়নি। সাহেব আমি আপনাদের সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখাব। আমার মতো ভাল গাইড আপনি পাবেন না।

এই পাহাড়ি জঙ্গলটাকে চেনো?

খু-উ-ব।

ওই জঙ্গলের ভেতরে কি মানুষ থাকে?

একটু ভাবল লোকটা। তারপর বলল, এখান থেকে অন্তত দশ মাইল জঙ্গল ভেঙে যাওয়ার পর একটা আদিবাসীদের গ্রাম পড়বে। ওরা মাসে একবার থিমারেখায় গিয়ে যা চাষ করে তা বিক্রি করে কাপড়, নুন তেল, মশলা কিনে নিয়ে যায়। থিমারেখায় যাওয়ার জঙ্গুলে পথ আছে। আরও ভেতরে কিছু কিছু গ্রাম আছে যেখানে যাওয়া বিপজ্জনক। ভুটানি পুলিশ মাঝে মাঝে যায়। ওরাও নীচে নামে না।

তা হলে তুমি ঠিক খবর রাখো না। অর্জুন হাসল।

কেন সাহেব? কী ভুল বললাম?

জঙ্গলের দুই মাইলের মধ্যে কিছু সভ্য চেহারার মানুষ থাকে। তারা হরিণ অথবা সাপ খায় সুযোগ পেলেই। অর্জুন বলল।

ও! আপনি এই খবর পেলেন কী করে? লোকটা অবাক।

সত্যি কি না, তাই বলো!

আপনি ঠিক বলেছেন। এই জঙ্গলের ভেতরে একটা তান্ত্রিক বৌদ্ধদের মন্দির আছে। ভয়ংকর মন্দির। এখানকার কেউ সেখানে যেতে সাহস পায় না। বুদ্ধদেবের বাণী ছিল শান্তির, মানুষের উপকার করার। কিন্তু তার শিষ্যদের একটা দল কী করে তান্ত্রিক হয়ে গেল তা জানি না। যে মানুষদের কথা আপনি বললেন তারা ওই মন্দির পাহারা দেয়। ওই মন্দিরে একজন বৃদ্ধ তান্ত্রিক বাবা থাকেন। তিনি ভুটিয়া নন, লেপচা। নিমা ভুটিয়া জানাল।

লেপচারা কি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

এ কথা আমি জানি না। তবে এই তান্ত্রিক আর তাঁর শিষ্যরা বাবা বুদ্ধদেবের উপদেশমতো চলেন না। শুনেছি ওখানে একটা ভয়ংকর চেহারার কালীমূর্তি আছে। কিন্তু তাকে দেখার সুযোগ বা সাহস আমার হয়নি। নিমা ভুটিয়া বলল।

বেশ। ওই লোকটার কথা বলো, ও কেন ধমকাচ্ছিল?

সাহেব, ওর নাম ডেলা ভুটিয়া। এখানকার লোকদের মধ্যে ও সবচেয়ে বড়লোক। রাজার লোকদের সঙ্গে ওর ভাল সম্পর্ক আছে। মাঝে মাঝেই ডেলা বাইরে চলে যায়। কোথায় যায় কেউ জানে না। এখানে ও একা থাকে। শুনেছি, পারোতে ওর বউ-বাচ্চারা থাকে। এখানকার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজন ওকে খুব খাতির করে। যে ফরেস্ট অফিসারকে ও পছন্দ করে না তাকে অল্পদিনের মধ্যেই অন্য জায়গায় বদলি হয়ে যেতে হয়। এই ডেলা জঙ্গলের মন্দিরের বড় ভক্ত। একমাত্র তাকেই তান্ত্রিক বাবা মন্দিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। প্রত্যেক বছর তান্ত্রিক বাবা সেই কালীমূর্তিকে মানুষের রক্ত দিয়ে একটি বিশেষ দিনে স্নান করান। নিমা ভুটিয়া বলল।

মানুষের রক্ত পায় কী করে? তোমাদের এখানে কেউ কি এই কারণে মারা যায়।

না না সাহেব। কারণ ভুটিয়াদের রক্তে স্নান করালে নাকি তান্ত্রিকের পুজো সম্পূর্ণ হবে না। নিমা বলল।

তা হলে রক্ত কোথায় পায়?

আমি জানি না সাহেব। কিন্তু গুজব আছে। একমাত্র লেপচাঁদের রক্তেই স্নান করালে ওই মূর্তি খুশি হয়। এখানে কোনও লেপচা নেই তাই এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। যে লোকটাকে কাঁদতে দেখলেন সেই লোকটার ছেলেকে ডেলা পারোতে চাকরি দিয়েছে। তার বিনিময়ে ওকে দিয়ে অনেক কাজ করায়। কয়েকদিন আগে ডেলা বাইরে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় ওকে বলে গিয়েছিল দশটা মোরগ কিনে রাখতে। তার জন্য টাকাও দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানকার লোক খুব বেশি দাম না পেলে মোরগ বিক্রি করে না। থিমাশিলায় গিয়ে ওরা মুরগি বিক্রি করে আসে। ওই লোকটা কোনওরকমে ছয়টা মোরগ কিনতে পেরেছিল। অভাবী মানুষ, বাকি টাকাগুলো সংসারে খরচ করে ফেলেছে। মোরগ না পেয়ে ডেলা এসে সব শুনে ভয়ংকর রেগে গেল। কয়েকটা ঘুষিও মেরে দিল। শাসিয়ে গেল, টাকা ফেরত না পেলে ওর ছেলের চাকরি খতম করে দেবে। বেচারা। নিমা ভুটিয়া মাথা নাড়ল, সাহেব অন্ধকার নেমে আসছে।

ঠিক আছে। তুমি কাল সকালে দেখা কোরো। আমি অন্যদের সঙ্গে কথা বলে দেখি। অর্জুন হাঁটতে শুরু করল।

অন্ধকার নামছে পাহাড়জুড়ে, সেই সঙ্গে ঠান্ডা বাড়ছে। কিন্তু অর্জুনের মনের অস্বস্তি একটু একটু করে বড় হয়ে উঠল। জঙ্গলের ভেতরে বৌদ্ধ তান্ত্রিকের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষ অথচ তার শিষ্য বা অনুরাগীরা ভুটানি, সেই লেপচা তান্ত্রিক প্রত্যেক বছরের একটা দিনে কালীমূর্তিকে লেপচা সম্প্রদায়ের রক্তে স্নান করান। কেন? আর সেই রক্ত পান কোত্থেকে? প্রশ্নটা মনে আসতেই অর্জুনের চোখের সামনে ভেসে উঠল তিস্তার চরে পড়ে থাকা দুটো নীরক্ত শরীর। যারা দার্জিলিং জেলার পাহাড় থেকে নেমে এসেছিল তিস্তার চরের ছটপুজোর মেলায়। অর্জুন খুব উত্তেজিত হয়ে পা চালাল।

দূর থেকেই তাঁবুর আলো দেখা যাচ্ছিল। অন্ধকারে সামান্য আলো। কাছে। এসে দেখল আলোগুলো জ্বলছে তাঁবুর বাইরে আর তাদের ঘিরে রাজ্যের পোকা পাক খাচ্ছে। আছড়ে পড়ছে আলোর ওপর। সম্ভবত জঙ্গলের এই পোকাগুলো এর আগে আলো দেখেনি।

নিজেদের তাবুর দরজা খুলতেই মেজর চিৎকার করলেন, কুইক ভেতরে ঢুকে পড়ো, নইলে হতচ্ছাড়া পোকাগুলো সারারাত ঘুমোতে দেবে না।

বাইরের আলোর যেটুকু তাঁবুর ভেতরে ঢুকেছিল তাতেই তিনজনকে দেখতে পেল অর্জুন। মেজর তার নিজস্ব বোতল থেকে এক টোক গলায় ঢেলে বললেন, আমি মিস্টার সোমকে বলছিলাম, এখানে তাবু না ফেলে জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে আমাদের থাকা উচিত ছিল। তাতে অনেক উত্তেজনার স্বাদ পাওয়া যেত।

বাইরে থেকে লিটুর গলা শোনা গেল, সাব, চা।

সন্তর্পণে দরজা সরিয়ে চারটে গ্লাস আর কেটলি নিয়ে সে ভেতরে ঢুকতেই মেজর বললেন, নো টি। ওদের দাও।

চায়ের পরে ঝোলা থেকে বিস্কুট বের করল লিটু। সেটা নিয়ে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এখানে নিমা নামের কোনও লোককে তো তুমি চেনো?

জি সাব!’

তার সঙ্গে তো দেখাও হয়েছে?

জি সাব!’

লোকটা কেমন?

এমনি আলাপ। তবে এই পাহাড়টাকে ও ভাল জানে।

নিমা আমাদের কাছে কাজ করতে চায়। তুমি কী বলো?

আমরা চালিয়ে নিতে পারি। তবে ও থাকলে সুবিধে হবে।

ডেলা ভুটিয়াকে চেনো?

সাব, ওকে সবাই চেনে। তবে ওর কাছাকাছি না যাওয়াই ভাল।

কেন?

খুব বদমেজাজি লোক। এখানকার কাউকে পাত্তা দেয় না। ভাল পয়সা আছে। থিম্পুতে প্রায়ই যায়। ভারতেও যাতায়াত করে। নিমা বলল।

তুমি কি এখানকার লোকদের খবরটা দিয়েছ?

হ্যাঁ সাব। আমি খবর পৌঁছে দিয়েছি। মনে হয় অনেকেই আসবে।

ঠিক আছে। তুমি যেতে পারো। অর্জুন মাথা নাড়লে নিমা চলে গেল।

অমল সোম চুপচাপ শুনছিলেন, নিমা বেরিয়ে গেলে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বেড়ানোটা মনে হচ্ছে কাজে এসেছে।

অর্জুন ধীরে ধীরে যা দেখেছে এবং শুনেছে তা সময় নিয়ে বলল, ইংরেজিতে বলার জন্য একটু অসুবিধে হলেও তা বুঝতে পেরে নাতাশা উত্তেজিত হল, ও মাই গড।

অমল সোম বললেন, এসব শুনে উত্তেজিত হওয়ার কোনও কারণই আমাদের নেই। এখানে আমরা এসেছি নাতাশার জন্য, ওর একটা বিশেষ কাজে সাহায্য করতে। কে কোথায় কার জন্য লেপচাঁদের রক্ত সংগ্রহ করেছে। তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ! কাল যদি লিটু কিছু লোককে নিয়ে আসতে পারে তা হলে তাদের যেমন উপকার করা হবে তেমনি নাতাশার গবেষণার কাজও এগিয়ে যাবে।

রাইট! মেজর ধোঁয়া ছাড়লেন।

মেজর! নাকে হাতচাপা দিল নাতাশা, প্লিজ, এবার আমার কষ্ট হচ্ছে।

সরি বেবি! আমি বাইরে যাচ্ছি। মেজর তাবুর বাইরে চলে গেলেন।

অর্জুন নাতাশাকে জিজ্ঞাসা করল, যারা রক্ত পরীক্ষা করাতে আসবে তারা নিশ্চয়ই অসুস্থ। তাদের রক্তে কাজ হবে তোমার?

অসুস্থ মানুষের রক্ত পরীক্ষা করলে কারণটা জানা যায়। কিন্তু রক্তের মূল চরিত্র বদলে যায় না। ধরা যাক কারও লিউকোমিয়া হয়েছে, রক্তে খুব দ্রুত হিমোগ্লোবিন কমে যাচ্ছে। আচমকা তার শরীরে আঘাত লাগলে সেখানে কি কালশিটে দেখা যাবে না? যাবে। নাতাশা হেসে অমল সোমের দিকে তাকাল। কিন্তু স্যার, একটা আদিম সংস্কার চালু রাখার জন্য এই যে এত রক্ত নষ্ট করা হচ্ছে, এ দেশের সরকার কিছু বলছে না?

অমল সোম বললেন, হয়তো সরকারের কাছে খবর পৌঁছোয়নি। তা ছাড়া ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ কিছু করলে এশিয়ার দেশগুলোর সরকার নীরব থাকে। আমি বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের ওপর কিছু লেখা পড়েছি কিন্তু রক্ত দিয়ে মূর্তি স্নান করানোর কথা কোথাও পাইনি। অর্জুন, তুমি যদি ভুল শুনে না থাকে তা হলে মন্দিরের পুরোহিত নিজে লেপচা সম্প্রদায়ের হয়েই শুধু লেপচার রক্তে স্নান করান, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনও রহস্য আছে।

মেজর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চুরুট শেষ করলেন। তারপর পকেট থেকে চ্যাপটা বোতল বের করে তলানিটা গলায় ঢাললেন। খুবই কড়া পদার্থ। আমেরিকা বা কলকাতা হলে ভুল করেও খেতেন না। কিন্তু এই অজপাহাড়ে যা পাওয়া যাচ্ছে তা খাওয়ার সময় স্কচের কথা ভাবতে নেই। কয়েক পা এগোলেন মেজর। সামনেই জঙ্গলের শুরু। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। বরং, উলটোদিকের গ্রামের দিকে তাকালে কয়েকটা আলো মিটিমিটি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ চোখ স্থির হল মেজরের। জঙ্গলের ভেতর থেকে কিছু একটা বেরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অন্ধকারেও তার শরীর ঘোলাটে দেখাচ্ছে, মুখ বা পা বোঝা যাচ্ছে না। জন্তুটা নিশ্চয়ই বাঘ নয়, তা ছাড়া এই জঙ্গলে প্যান্থার। আছে বলে এদের বিশ্বাস, তাদের গায়ের রং কালো, অন্ধকারে বোঝাই যাবে না। এক পা এগিয়ে মেজর শরীরের সমস্ত শক্তি হাতে এনে তার শেষ হয়ে যাওয়া বোতলটা ছুড়লেন প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে। লক্ষ্য অব্যর্থ হল কারণ যন্ত্রণা জড়ানো গলায় একটা আওয়াজ তুলে প্রাণীটা জঙ্গলের ভেতর মিলিয়ে গেল। মেজর মাথা নাড়লেন, এই আওয়াজ মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর গলা থেকে বের হতে পারে না।

আওয়াজটা তাঁবুগুলোতে পৌঁছেছিল। প্রথমে ছুটে এল লিটু এবং তার দুই সঙ্গী। টর্চের আলোয় মেজরকে দেখতে পেয়ে লিটু জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে সাহেব?

আমার কিছু হয়নি। মেজর দেখলেন অমল সোম, অর্জুন এবং নাতাশা বাইরে চলে এসেছে। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, মনে হল কেউ আর্তনাদ করল?

হ্যাঁ। অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। একটা ছায়াছায়া প্রাণীকে জঙ্গলের বাইরে আসতে দেখে বোতলটা ছুঁড়েছিলাম। তার পরেই আর্তনাদ করে সেটা জঙ্গলে ঢুকে গেল। মেজর বললেন, জঙ্গল থেকে কোনও মানুষ বেরিয়ে আসবে তা ভাবিনি।

অর্জুনের মনে পড়ল সেই লোকগুলোকে, যারা সাপ আর হরিণ নিয়ে গেছে। লিটু বলল, সাহেব, আপনারা তাবুর ভেতরে চলে যান। আজ রাতে আমাদের পালা করে জেগে পাহারা দিতে হবে। যদি মানুষের গায়ে লেগে থাকে তা হলে সে দলবল নিয়ে বদলা নিতে আসতে পারে।

অমল সোম বললেন, লিটু ঠিকই বলেছে। তোমাদের থাকতে হবে না লিটু। আমরা তিনজনই জেগে পাহারা দেব। অর্জুন তুমি মাঝরাতে আর মেজর শেষ রাতে জাগবেন। প্রথম রাতটা আমি জাগছি।

নাতাশা কথাগুলো বাংলা-হিন্দিতে হওয়ায় বুঝতে পারেনি। মেজর তাকে বুঝিয়ে দিলেন, নাতাশা বলল, আপনারা তিনজন কেন, আমিও জাগব।

অর্জুন বলল, বেশ তো, মেজর ওঠার আগে আমি তোমায় ডেকে দেব।

.

সেই রাতে কোনও ঘটনা ঘটল না। ভোরবেলায় লিটুর দেওয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মেজর বিরক্তি প্রকাশ করলেন, ননসেন্স। কাওয়ার্ড।

অর্জুন হেসে ফেলল, কাকে বলছেন?

ওই লোকটাকে। মার খেয়ে হজম করে ফেলল? বদলা নিতে এল না? মেজর আফশোসের গলায় বললেন। এই সময় নাতাশা তার তাবু থেকে বেরিয়ে এসে অনুযোগ করল। আমাকে ডেকে দেওয়া হয়নি কেন?

ধন্যবাদ দাও। ডেকে দিলে মশার কামড় খেতে মা, নো উত্তেজনা। কেউ একটা টোকা মারেনি। মেজর বললেন।

বেলা হল। চারধার আজ ঝকঝক করছে রোদ্দুরে। নাতাশা একটা টেবিলে রক্ত গ্রহণ করার যন্ত্রপাতি সাজিয়ে বসেছিল। শেষতক সে উদ্বিগ্ন হল; আচ্ছা এখনও কেউ আসছে না কেন? অমল সোম ঘড়ি দেখলেন। আটটা বাজে। পাহাড়ি মানুষের পক্ষে কি এই সময়টা আলস্যের? হঠাৎ দূরে একটি লোককে দেখা গেল। দ্রুত হেঁটে আসছে। কাছাকাছি হতেই লিটু চেঁচিয়ে উঠল, আরে! নিমা আসছে।

নিমা এসে প্রত্যেককে নমস্কার করে অর্জুনের সামনে দাঁড়ল, সাহেব, খুব খারাপ খবর আছে। কাল যারা রক্ত পরীক্ষা করাতে রাজি হয়েছিল তাদের কেউ আজ আসবে না। আমি অনেক বলেও এদের আনতে পারলাম না। ওপাশ থেকে মেজর গর্জন করে উঠলেন, হোয়াই? কেন?

নিমা বলল, ওদের ভয় দেখানো হয়েছে, ডেলা ভুটিয়া হুকুম করেছে যে ওখানে রক্ত পরীক্ষা করাতে আসবে তার শরীরের সমস্ত রক্ত বের করে নিয়ে জঙ্গলের প্রাণীদের খাওয়ানো হবে। এটা শোনার পর কেউ আর সাহস পাচ্ছে। না এখানে আসতে।

মেজর হাত মুঠো করলেন, আই উইল কিল হিম। ওর কাছে আমাকে নিয়ে চলো। অমল সোম বললেন, জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে কোনও লাভ নেই। মনে রাখবেন, এটা এমন একটা জায়গা যেখানে কোনও থানা নেই।

অর্জুন নাতাশাকে ব্যাপারটা অনুবাদ করে শোনালে সে খুব হতাশ হল। বলল, তা হলে এখানে থেকে কোনও লাভ হবে না। আমাদের অন্য জায়গায়। যাওয়া উচিত।

অমল সোম মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। লিটু, তুমি বলো তো, কোথায় গেলে এরকম সমস্যা হবে না?

শেষ লাইনটা হিন্দিতে বলছিলেন অমল সোম, লিটু নিমার দিকে তাকাল। নিমা বলল, সব জায়গার তো একই অবস্থা, শুধু, সাহেবরা কি যেতে পারবেন?

কোন জায়গায়?

জঙ্গলের গভীরে যে গ্রামগুলো আছে সেখানে ডেলা ভুটিয়ার কোনও প্রভাব নেই। ওদের ভগবানও আলাদা। নিমা জানাল।

কতটা দূরে ওই গ্রাম? মেজর জিজ্ঞাসা করলেন।

এখন রওনা হলে পৌঁছোতে বিকাল হয়ে যাবে। নিমা বলল।

মেজর বললেন, লেটস গো। আপনি কী বলেন?

নাতাশার যদি উপকার হয় তা হলে যেতে আপত্তি নেই। অমল সোম লিটুর দিকে হাত নেড়ে ইশারা করলেন।

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে লিটুর লোকজন তাঁবু গুটিয়ে রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল। পথ চেনে নিমা, তাই তাকে দৈনিক মজুরিতে দলে নেওয়া হল। অর্জুন হেসে বলল, মেজর, জঙ্গলে ঘঁটা আমাদের কপালে থেকেই গেল। বয়স হয়েছে আপনার, সাবধানে হাঁটবেন।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? আমার বয়স হয়েছে বললে ভুল কথা বলা হয়। মেজর নাক দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করলেন।

.

এক ঘণ্টা হাঁটতেই মনে হচ্ছিল অনেকটা শক্তি চলে গেল। ঘন জঙ্গল, চারপাশে লতানো ডালপালা। সেগুলোকে কেটে এগোচ্ছিল নিমা। তার পেছনে ওরা চারজন, শেষে লিটু এবং তার দুই সহকারী।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, নিমা, মন্দির কোন দিকে?

নিমা বাঁ হাত তুলে বলল, এক কিলোমিটার দূর দিয়ে যাচ্ছি, আমরা ভুলেও ওই মন্দিরের কাছে যাই না।

কেন?

ওই লেপচা তান্ত্রিক খুব রাগী, লোকে বলে ওর অভিশাপে কেউ কেউ এই জঙ্গলের জানোয়ার হয়ে গেছে।

অর্জুন হেসে ফেলল, তা হলে তো লোকটাকে দেখা দরকার।

না সাহেব, ভুলেও ও কথা মুখে আনবেন না। নিমা হাত নাড়ল।

ঠিক তখনই ফোঁটা ফোঁটা জল এসে পড়ল শরীরে, মাথার ওপরে গাছের বড় বড় পাতার আচ্ছাদন থাকায় আকাশ দেখা যাচ্ছে না।

লিটু বলল, জোর বৃষ্টি নামবে সাহেব। দাঁড়িয়ে যান।

সকালে আকাশজুড়ে রোদ ছিল। এই সময়ের মধ্যে কখন মেঘ চলে এল টের পাওয়া যায়নি। পাতার আড়াল থাকায় মেঘ দেখাও যাচ্ছে না। গাছগুলো রয়েছে স্থির দাঁড়িয়ে। জলের ফোঁটার তেজ বাড়ছিল। অমল সোম লিটুকে বলল, অন্তত দুটো তাবু খাটাও। এভাবে ভেজা উচিত নয়।

নিমাও হাত লাগাল। তাঁবু খাটাতে অসুবিধে হচ্ছিল গাছের জন্য। কিন্তু ওরা একটা ব্যবস্থা করে ফেলল। তাঁবুর ভেতর ঢুকতেই বৃষ্টির তেজ বেড়ে গেল। বিছানা নয়, চারটে চেয়ার তাবুতে রেখে লিটু বলল, সাহেব, দুপুর হতে বেশি দেরি নেই। জঙ্গলে আলো ঢোকে না বলে সময় বোঝা যাচ্ছে না। এই বৃষ্টি সহজে থামবে বলে মনে হয় না। মনে হচ্ছে, লাঞ্চ বানিয়ে ফেলাই ঠিক হবে।

গুড’। মেজর বললেন, আজ তো ব্রেকফাস্টও হয়নি। লাঞ্চ বানাও, তারপর বৃষ্টি থামলে আবার হাঁটা যাবে।

খুশি হয়ে লিটু চলে গেলে কোথাও বাজ পড়ল। তার শব্দে সারা গা। কুঁকড়ে গেল। অর্জুন বলল, ভয় পাবেন না। বাজ আপনার কাছে পৌঁছোবে না। ওপরের গাছের ডালে আটকে যাবে।

অমল সোম একটা কাঠি জোগাড় করে নাতাশার সামনে নিচু হয়ে বসে ওর জুতো থেকে বেশ কসরত করে একটা জোঁক টেনে তুললেন, এই হল সমস্যা। এমনিতেই এরা নাছোড়বান্দা, জল পড়লে ক্ষতি নেই।

নাতাশা ভয় পেয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বলল, সর্বনাশ! আমি তো টেরই পাইনি। ওটা তো রক্ত খায়!

হ্যাঁ’ অর্জুন হাসল, আমরা রক্তের জন্য এসেছি, ও রক্তের আশায় এসেছে। মেজর বললেন, আর একজন রক্ত সংগ্রহ করে বিগ্রহকে স্নান করাচ্ছে।

অমল সোম কাঠিসমেত জোঁকটাকে তাঁবুর বাইরে ফেলে দিলেন।

.

দুটো ঘণ্টা চলে গেল কিন্তু বৃষ্টি থামার লক্ষণ দেখা গেল না। উলটে জঙ্গলের মধ্যে জলের স্রোত বয়ে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। তাঁবুর ভেতরে জল ঢোকেনি। লাঞ্চ দিতে এসে লিটু জানাল, জঙ্গলের নালাগুলো এখন ঝরনা হয়ে গিয়েছে। তবে এই বৃষ্টি তাদের একটা উপকার করেছে। বৃষ্টির জল খালি ক্যানে ধরে রেখেছে তারা।

মেজর মাথা নাড়লেন, ওষুধ না দিয়ে ওই জল আমাদের খাইয়ো না।

না সাহেব, আপনাদের জন্য আলাদা জল আছে।

লিটু বলতেই ওর পাশে এসে দাঁড়াল নিমা, সাহেব, মনে হচ্ছে আজ এখানেই থেকে যাওয়া উচিত।

মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? আমাদের সময়ের দাম নেই বলে ভেবেছ?

না সাহেব। এখনও বৃষ্টি বন্ধ হয়নি। অনেক জায়গায় জল জমে গেছে। এখন জোঁক তো বেড়ে যাবেই, সাপও গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে’ নিমা বলল।

অমল সোম নাতাশাকে ইংরেজিতে সমস্যার কথা বললেন। জোঁকের কথা শুনে সে আঁতকে উঠল। বলল, নিমার কথাই সবার মেনে নেওয়া উচিত।

দুপুরের কিছু পরে বৃষ্টি থামল। তবু গাছের পাতায় জমে থাকা জল পড়ে যাচ্ছিল টুপটাপ শব্দ তুলে। অর্জুন লক্ষ করছিল, এই যে এত বৃষ্টি হল কিন্তু ঝড় দূরের কথা জোরালো বাতাস বয়ে যায়নি জঙ্গলে। পাখিদের আওয়াজ আগাগোড়াই ছিল না, বৃষ্টি থামার পর অদ্ভুত আওয়াজ শুরু হল। এগুলো কোনও ক্ষুদ্র প্রাণীর ডাক।

লিটুরা পাকাপাকিভাবে তাঁবু তৈরি করে দিলে অর্জুন ঘড়ি দেখল, সাড়ে তিনটে বাজে। কিন্তু জঙ্গলের ভেতরে ছায়া ঘন হয়ে গেছে। অর্জুন আর মেজর তাদের তাবুতে বসে কথা বলছিল।

মেজর বলছিলেন, একটা দিন নষ্ট হল। এভাবে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। বিরক্তিকর।

অর্জুন বলল, চলুন, একটু ঘুরে আসি। অবশ্য যদি আপনার অসুবিধা না হয়।

অসুবিধে? মেজর হাসলেন, আমাজনের জঙ্গলে একা তিন দিন হেঁটেছি হে, চলো।

লিটুর কাছ থেকে একটা শক্ত লাঠি চেয়ে নিল অর্জুন। অমল সোম বললেন, বেশি দূরে যেয়ো না। অন্ধকারে তোমাকে খুঁজতে যেতে হবে তা হলে।

লিটু বলল, সাহেব, এই টর্চটা সঙ্গে রাখুন।

মেজর সেটা নিলেন এবং এমন করে ধরলেন যেন বন্দুক ধরেছেন।

খানিকটা হাঁটতেই মনে হল আর যাওয়া যাবে না। গাছ থেকে নেমে আসা লতাগুলো জালের মতো সামনে ঝুলছে। পাশ কাটিয়ে আর কিছুটা ডানদিকে যেতেই জলের আওয়াজ কানে এল। সেই সন্ধে হবহব আবহাওয়ায় ওরা একটা ছোট্ট ঝরনা দেখতে পেল। কুলকুল শব্দে জল বয়ে যাচ্ছে।

মেজর বললেন, বিউটিফুল।

অর্জুন বলল, চলুন ফিরে যাই। এর পরে আর কিছু দেখা যাবে না।

মেজর বললেন, ওই দিক দিয়ে ঘুরে যাই, সঙ্গে তো টর্চ আছে। খানিকটা হাঁটার পরে অর্জুনের মনে হল পথটা গুলিয়ে যাচ্ছে। ওরা টেন্টের অনেক দূরে চলে এসেছে। আরও একটু এগোতেই কানে শব্দ এল। ঢোলের শব্দ। এই জঙ্গলে খুব ধীরে ঢোল বাজাচ্ছে কেউ? কে হতে পারে? ক্রমে আওয়াজটা এগিয়ে এল। অর্জুন নিচু গলায় মেজরকে বলল, ওই ঝোঁপটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াই, যারা আসছে তারা আমাদের পছন্দ নাও করতে পারে।

মিনিটদশেকের মধ্যে ছায়াছায়া মূর্তিগুলোকে দেখা গেল। একজন লোককে হাত বেঁধে তিনজন নিয়ে আসছে। একটা বিশাল গাছের নীচে এসে ওদের কেউ বলল, এখানেই হোক। খুব বড় গাছ।

সঙ্গে সঙ্গে হাত বাঁধা লোকটি বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, তোমাদের পায়ে পড়ি। আর কখনও ভুল করব না।

কিছু করার নেই। তোকে কালো বাঘের পেটে যেতেই হবে। বুড়োবাবার হুকুম ব্যর্থ হয় না। এই ওর পা দুটো বেঁধে দে’ একজন হাসতে হাসতে বলল।

লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেও তার পা বাঁধা হল, তারপর গাছের সঙ্গে জড়িয়ে রেখে লোকগুলো চলে গেল জঙ্গলের ওপাশে। বন্দি লোকটি তখনও চিৎকার করে কেঁদে তাদের ডাকছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় চুপ করল সে।

অর্জুন বলল, চলুন।

মেজর বললেন, শিয়োর; লোকটাকে প্যান্থারের পেটে যেতে দেওয়া যায় না। তারা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা যেন হতভম্ব হয়ে গেল। অর্জুন হিন্দিতে বলল, পালাবার চেষ্টা করবে না। করলে ওরা তোমাকে কালো বাঘের পেটে রেখে গিয়েছিল, আমরা অতক্ষণ অপেক্ষা করব না।

আপনারা, আপনারা কে? লোকটা আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করল। বাঁধন খুলে দিয়ে অর্জুন বলল, বাঁচতে চাও তো আমাদের সঙ্গে চলো। লোকটা এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, অনুসরণ করাই যুক্তিসংগত বলে মনে করল। প্রথমে মেজর, মাঝখানে লোকটা, শেষে অর্জুন হাঁটছিল জঙ্গল সরিয়ে। হঠাৎ লোকটা চিৎকার করে মেজরকে টেনে পেছনে আনতেই অর্জুন আবছা আলোয় সাপটাকে দেখতে পেল। বেশ মোটা কালো সাপটা গাছের ডালে ঝুলছে। একমুহূর্ত নষ্ট না করে হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করল অর্জুন। সাপটাকে কাহিল করতে দ্বিতীয়বার লাঠি চালাতে হল, বেশ শব্দ হল ওটা মাটিতে পড়ার সময়। তৃতীয়বার মাথায় আঘাত পাওয়ার পর সাপটা স্থির হয়ে গেল। মেজর ইংরেজিতে লোকটাকে বললেন থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু সাপটি কি বিষধর? প্রশ্নটা যেহেতু হিন্দিতে তাই লোকটা জবাব দিল, ওর ছোবলে বাইসন মরে যায়। হরিণ মরলে তার মাংস খাওয়া যায় না। এক মিনিটের মধ্যে মানুষ মুখ থেকে ফেনা তুলে মরে যায়।

তা হলে তো এতক্ষণে আমি–! মেজর বড় শ্বাস ফেললেন।

অর্জুন বলল, চলুন। নজর রেখে পা ফেলবেন।

লোকটা বলল, আপনাদের কাছে ছুরি থাকলে আমাকে দিন।

ছুরি নিয়ে তুমি কী করবে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

ওর মাথাটায় বিষ থাকে। মাথা কেটে বাদ দিলে চার-পাঁচ কেজি মাংস পাওয়া যাবে। লোকটা বলল।

অর্জুন বলল, অদ্ভুত কথা! একটু আগে তুমি নিজে কালো বাঘের পেটে যাওয়ার জন্য ভয়ে কাঁদছিলে আর এরই মধ্যে সাপের মাংস খেতে চাইছ? চলো! আবার বৃষ্টি নামলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

দূর থেকে আগুন দেখতে পেয়ে তাবুতে পৌঁছোতে সুবিধে হল। লিটু তাঁবুর সামনে কাঠ জ্বেলেছে। রাজ্যের পোকা তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অমল সোম তাদের দেখে বললেন, গেলে দু’জন ফিরলে তিনজন। কী ব্যাপার?

মেজর বললেন, এ পেছনে না থাকলে আমি এতক্ষণে, বিশাল সাপ। ও টেনে সরিয়ে দিয়েছিল বলে আমাকে কামড়াতে পারেনি।

আচ্ছা। কিন্তু এর পরিচয় কী? অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।

অর্জুন সমস্ত ব্যাপারটা অমল সোমকে বলল। অমল সোম লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কী?

রুকু।

ওই মন্দিরে থাকতে?

জি’

ওরা যখন তোমাকে বেঁচে থাকতে দেবে না, তখন আমাদের সঙ্গেই থাকো। অমল সোম বললেন, লিটু, তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। ভোর হওয়ামাত্র রওনা হব।

মেজর অবাক হলেন, এ কী? আমাদের তো এখনই ওই মন্দিরে অভিযান করা উচিত। একটা মানুষকে বেঁধে ওরা বাঘের খাদ্য করতে চেয়েছিল।

ঠিকই। কিন্তু আমরা তো ওসব করতে আসিনি মেজর। এই মেয়েটা সেই আমেরিকা থেকে যে কারণে এখানে এসেছে সেই কাজটাই তো প্রথমে করা উচিত। আমরা কাল জঙ্গলের গ্রামে যাব। অমল সোম তাঁবুর মধ্যে যেতে গিয়ে দাঁড়ালেন, রুকু, তুমি কি জঙ্গলের গভীরে একটা গ্রামে যাওয়ার রাস্তা জানো?

জি’ মাথা নাড়ল লোকটা।

অমল সোম লিটু আর নিমাকে ডাকলেন, তোমরা একে কখনও দেখেছ? দু’জনেই মাথা নেড়ে না বলল।

তা হলে এর সঙ্গে কথা বলে সব জেনে নাও। অমল সোম তাঁবুর ভেতরে চলে গেলেন। মেজর অর্জুনকে বললেন, তোমার দাদাকে আমি আজও বুঝতে পারি না। এরকম সুন্দর চান্স ছিল লেপচা পুরোহিতের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার অথচ উনি সেটা করলেন না। অবশ্য নাতাশার কথাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

.

স্বচ্ছন্দে হাঁটা মুশকিল। জঙ্গল আরও ঘন হচ্ছে। গতকালের বৃষ্টিতে মাটি পিছল। ভোর হওয়ামাত্র তাবু গুটিয়ে বেরিয়েছিল ওরা। মাঝখানে একটা ঝরনার ধারে খানিকটা বিশ্রাম। তখনই খাওয়া দাওয়া। আবার হাঁটা শুরু। রুকু আগে যাচ্ছে, তার পাশে নিমা। নিমা মালপত্র কাঁধে নিয়েছে। হঠাৎ রুকু দাঁড়িয়ে ইশারা করল থামতে। অর্জুন কয়েক পা এগিয়ে উঁকি মারতেই অদ্ভুত চেহারার ঘর দেখতে পেল। বাঁশের দেওয়াল, বাঁশের চাল, তার ওপর খড় জাতীয় কিছু চাপানো। কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছিল না। সবাইকে ওখানেই। অপেক্ষা করতে বলে রুকু এগিয়ে গেল গ্রামের ভেতর।

আলো কমে আসার আগেই ফিরে এল সে। বলল, গ্রামের একজনের খুব অসুখ। গুনীন বলছে রাত্রের মধ্যেই মরে যাচ্ছে লোকটা। তাই তার চারপাশে সবাই চুপচাপ বসে আছে বিদায় জানাতে।

অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে তার?

ওরা জানাল, শরীরের তাপ বেড়ে গেছে।

অমল সোম নাতাশার সঙ্গে কথা বললেন। তারপর রুকুকে বললেন, তুমি তাড়াতাড়ি যাও। এই মেমসাহেব ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে পারেন। ওরা যদি রাজি থাকে তো আমরা যেতে পারি। শোনামাত্র রুকু দৌড়োল। মেজর বললেন, এদের এত কুসংস্কার, মনে হয় না রাজি হবে। যদি বা রাজি হয় তা হলে আর নাতাশা বাঁচাতে না পারে তা হলে আমাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে। আরে বাবা, নাতাশা তো ডাক্তার নয়।

অমল সোম হাসলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, দেখা যাক।

একটু পরেই কিছু লোক পায়ে পায়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তাদের বিস্মিত চোখ রুকুকে অনুসরণ করছে। রুকু কাছে এসে বলল, ওরা রাজি হয়েছে, আসুন।

পোর্টারদের সেখানেই রেখে ওরা চারজন রুকুর সঙ্গে এগিয়ে গেল। যাওয়ার সময় নাতাশা একটা বড় ব্যাগ তুলে নিল।

মানুষগুলোর চেহারা পোশাক দেখে বোঝা যায় কী ভয়ংকর দরিদ্র ওরা। বেশিরভাগই খাটো। বেশ সন্দেহ ওদের দৃষ্টিতে। একটা বড় ঘরের মাঝখানে মৃত্যুপথযাত্রী শুয়ে আছে। তার পাশে পা ছড়িয়ে বসে দুটি নারী একটানা কেঁদে চলেছে। নাতাশা মানুষটির পাশে বসে কপালে আঙুল রেখে বলল, মাই গড। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তারপর ব্যাগ খুলে সিরিঞ্জ বের করে সামান্য রক্ত টেনে নিল হাতের ভেইন থেকে। সেই রক্ত দুটো কাঁচের স্লাইডে ঢেলে আরও কিছু যন্ত্রপাতি বের করল। মিনিটদশেক পরীক্ষার পরে নাতাশা মুখ তুলল।

যে জীবাণু ওর শরীরে আছে তা থেকে অনেক রোগ হতে পারে কিন্তু সেটা পরীক্ষা করার কোনও যন্ত্রপাতি আমার সঙ্গে নেই। আমি একটা চান্স নিচ্ছি।

সে একটা ছোট্ট শিশির ভেতরের তরল ওষুধ সিরিঞ্জে তুলে লোকটার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিল। তারপর বলল, ওকে ভেজা কাপড় দিয়ে বারবার মুছিয়ে দেওয়া দরকার।

রুকু সে কথা কান্না থামানো মহিলাদের বলতেই তারা উদ্যোগী হল। অর্জুন দেখছিল গ্রামের সমস্ত মানুষ খানিকটা দূরে জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের দিকের লোকগুলোর হাতে লাঠি অথবা বল্লম।

মেজর ইংরেজিতে বললেন, লোকটা মরে যাওয়ার আগেই এখান থেকে আমাদের সরে পড়া উচিত। মিস্টার সোম কী বলেন?

সরে যাবেন কোথায়? অন্ধকার নামল বলে। তখন আমরা অন্ধ, কিন্তু জঙ্গলেও ওরা দেখতে পাবে। অমল সোম নির্বিকার গলায় বললেন।

ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ প্রবল চিৎকার করে উঠল লোকগুলো। অর্জুন দেখল মৃত্যুপথযাত্রী লোকটা চোখ খুলেছে। নাতাশা সঙ্গে সঙ্গে ওর কপালে আঙুল ছোঁয়াল। তারপর হেসে বলল, জ্বর কমছে।

লোকটার শরীর নড়াচড়া করছে। উঠে বসার চেষ্টা করছে সে। নাতাশা ইশারায় মহিলাদের বলল, ওকে একটু জল খাইয়ে দিতে। সেটা দুই ঢোক খেল লোকটা। আর তারপরেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল।

গ্রামের ছেলে-বুড়ো লাইন দিয়ে বসে গেল। রুকু ওদের সঙ্গে কথা বলে এসে জানাল, খুব সমস্যা সাহেব। যেহেতু মেমসাহেব একটু রক্ত ওই সিরিঞ্জের সাহায্যে শরীর থেকে বের করেছেন বলে লোকটা বেঁচে গেল, তাই এরা সবাই বলল মেমসাহেব ওদের শরীর থেকে বদ রক্ত বের করে দিন। সেটা বেরিয়ে গেলে ওরা আর অসুস্থ হবে না। কী করবেন?

অমল সোম নাতাশাকে বললেন, এভাবেই আচমকা সুযোগ এসে যায়। ওরা অসুস্থ হবে না এমন পরিমাণ রক্ত তুমি সংগ্রহ করতে পারো এখন।

.

রাতে খাওয়ার আগে অমল সোম বললেন, এই মানুষগুলোর শরীরে কখনওই কোনওরকম ওষুধ যায়নি। আমাদের রোগ সারাতে যে পরিমাণ ওষুধ খেলে কাজ হয় এদের ক্ষেত্রে তার অনেক কমে কাজ হওয়াই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল আমার। নাতাশা বলেছিল ওর কাছে নানা ধরনের অসুখের। ওষুধ আছে। কোনওটা ক্যাপসুল অথবা ট্যাবলেট, কোনওটা ইঞ্জেকশন। একেবারে শেষ অবস্থায় চলে না গেলে ওই ওষুধে কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস ছিল। সেটাই সত্যি হল।

অর্জুন নাতাশাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মিশন সাকসেসফুল?

একশো ভাগ। এখন যত তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে পারি ততই মঙ্গল। আমি যেভাবে রক্ত রেখেছি তাতে তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনও চিন্তা নেই। নাতাশা হাসল।

অমল সোম বললেন, তা হলে কালই ভুটান ছেড়ে ভারতের বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পৌঁছোতে হয়।

মেজর বললেন, একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না, আপনি লেপচা তান্ত্রিকের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না কেন? তিস্তার চরে খুন করে রক্ত নিয়ে এসেছে যে লোকটা তাকে ছেড়ে দেবেন? কোনও শাস্তি পাবে না!

অমল সোম বললেন, ওটা পুলিশের কাজ। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, আমরা বিদেশি রাষ্ট্রে আছি। এখানে এমন কোনও কাজ করতে পারি না যা বিদেশিদের করা উচিত নয়। ঠিক আছে?

পরের ভোরেই আবার ফেরার পালা। অর্জুন লক্ষ করছিল অমল সোম মাঝেমধ্যেই রুকুর সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছেন। একটা বড় অভিযান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে মেজরের মতো তারও আফশোস হচ্ছিল। ডেলা ভুটিয়াকে শাস্তি দেওয়া দরকার ছিল। অবশ্য এ কথা ঠিক আইন নিজেদের হাতে নিলে ভুটান সরকার হয়তো তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিত। সে দেখল মেজরের মুখও গম্ভীর।

বিকাল নাগাদ ওরা পৌঁছে গেল জঙ্গলের বাইরে। অমল সোম বললেন, আমি ড্রাইভারকে ফোন করছি, সে যদি আজই এখানে এসে তোমাদের নিয়ে ফুন্টশলিং-এ নেমে যায় তা হলে আগামীকাল নাতাশা বাগডোগরা পৌঁছে প্লেন ধরতে পারবে।

অর্জুন প্রতিবাদ করল, আমাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন, আপনি নিজে যাবেন না?

অমল সোম বললেন, উত্তেজিত হচ্ছ কেন? আমাকে কাল অবধি এখানে থাকতে হতে পারে। অবশ্য তুমি যদি যেতে না চাও, বেশ তো, থাকতে পারো।

মেজর বললেন, আমি কী দোষ করলাম?

নাতাশাও একই কথা বলল। একদিন অপেক্ষা করে গেলে তার সংগৃহীত রক্ত নষ্ট হবে না। অতএব, তাবু খাটানো হল। অমল সোম রুকুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন হাঁটতে।

চুরুট টানতে টানতে মেজর বললেন, কোথায় গেলেন বলো তো?

অর্জুন বলল, নিজে না বলতে চাইলে আমরা জানতে পারব না।

.অমল সোম ফিরে এলেন যখন তখন পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে গেছে। সঙ্গে রুকু নেই। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গিয়েছিলেন জানতে চাইছি না, কিন্তু রুকু কোথায়?

ওর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। হাসলেন অমল সোম, জঙ্গলের মধ্যে। মন্দির তৈরি করে ডেলা ভুটিয়া তন্ত্র সাধনার ভয় দেখিয়ে মানুষকে ওদিকে না যেতে বাধ্য করেছে, কারণ ওখানেই ও বিশাল পপিফুলের বাগান তৈরি করেছে। ওই ফুল থেকেই যেসব নেশাদ্রব্য তৈরি হয় তার মূল্য কোটি কোটি টাকা। এটা ডেলা ভুটিয়া বছর দেড়েক হল শুরু করেছে। রুকু একটু বেশি জেনে ফেলেছিল বলে তান্ত্রিক পুরোহিত ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল। তোমরা যদি ওকে মুক্ত না করতে তা হলে এখন ওর হাড়ও খুঁজে পাওয়া যেত না। অমল সোম বললেন, যাও খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ো। সকালে অনেক কাজ করতে হবে।

.ভোর হওয়ামাত্র ভুটানের বিরাট পুলিশ বাহিনী থিম্পু থেকে থিমারেখা হয়ে ছুটে এল জঙ্গলের ধারে। অমল সোম তৈরি ছিলেন। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা রুকুর সঙ্গে পুলিশের বড়কর্তার পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। বড়কর্তা বললেন, কাল আপনার কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েই আমরা অ্যাকশন নিতে তৈরি হয়েছি। আপনার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছি আপনি এবং আপনার শিষ্য অর্জুন সত্যসন্ধানী। তা সত্ত্বেও আপনারা নিজেরা অ্যাকশন না নিয়ে আমাদের জানিয়েছেন বলে ধন্যবাদ। আমরা এখনই মন্দির ঘিরে ফেলছি।

অমল সোম বললেন, এই ব্যাপারে রুকু আপনাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে। মনে হচ্ছে ডেলা ভুটিয়াকে আপনারা ওখানেই পেয়ে যাবেন।

পুলিশ জঙ্গলে ঢুকে যাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই গাড়ি এসে গেল থিমারেখা থেকে। মেজর খুব আফশোস করেছিলেন অ্যাকশনের সময় থাকার সুযোগ পেলেন না বলে। গাড়ি যখন নীচের দিকে নামছিল ঠিক তখনই গুলির শব্দ কানে এল। মেজর উত্তেজিত হয়ে বললেন, ফায়ারিং হচ্ছে। তারপরই গুটিয়ে গিয়ে বিড়বিড় করলেন, গান ফায়ার ইন ভুটানস জাঙ্গল।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress