যোদ্ধামূর্তি রহস্য
তখন বিকেল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ পালমা বন্দরে নোঙর করে রয়েছে। ফ্রান্সিসের বীর—বন্ধু ভাইকিংরা অনেকেই জাহাজের ডেক-এ উঠে এসেছে। কেউ কেউ শুয়ে বিশ্রাম করছে। অনেকেই বসে আছে। জাহাজের রেলিঙ ধরে তাকিয়ে দেখছে পালমা বন্দরের ব্যস্ততা। ফ্রান্সিসদের জাহাজের কাছাকাছি আরো তিন-চারটে ভিনদেশি জাহাজ নোঙর করা। নানা দেশের পতাকা উড়ছে সেইসব জাহাজে। সেইসব জাহাজের বন্দরের কর্মীরা বাদাম তেলের পিপে তুলছে। ডুমুর, খুবানির বস্তা তুলছে জাহাজঘাট থেকে।
নিজেদের কেবিনঘরে ফ্রান্সিস বিছানায় বসে আছে কাঠের দেয়ালে পিঠের ভর রেখে। মারিয়া বিছানার একপাশে বসে সুঁচ সুতো দিয়ে নিজের একটা পোশাকের সেলাই ছিঁড়ে যাওয়া জায়গাটা সেলাই করছিল।
বিকেলের আলো কমে এসেছে। মারিয়া সেলাই বন্ধ করে সবকিছু একটা চামড়ার পেটিতে তুলে রেখে বলল ফ্রান্সিস—আর কোথাও নয়। এবার দেশের দিকে জাহাজ চালাতে বলো।
ফ্রান্সিস ও এই কথাটাই ভাবছিল। অনেকদিন হয়ে গেল ওরা দেশ ছেড়ে এসেছে। কতদিন কত রাত কেটে গেল সমুদ্রে বিদেশের মাটিতে। বন্ধুদের মনের অবস্থা ও ভালো করেই বুঝতে পারছে। মারিয়া তো দেশে ফেরার কথা বলবেই। এতদিন ও কখনো বাবা মাকে ছেড়ে থাকেনি। ফ্রান্সিস হ্যারি, আর বন্ধুদের তো বিদেশের বন্দরে-বন্দরে ঘুরে বেড়ানো কত বিচিত্র মানুষদের জীবন ওরা দেখেছে। কখনো সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও বন্দী দশার জীবন তো কাটিয়েছে। এবার ওরা তো ফিরতে চাইবেই।
ফ্রান্সিস এসব ভাবছে তখনই হ্যারি এলো। ফ্রান্সিসদের পাশে বসল। মারিয়া বলল, হ্যারি-বন্ধুকে বুঝিয়ে বলল এবার দেশের দিকে জাহাজ চালাতে।
হ্যারি বলল,ফ্রান্সিস-এবার দেশেই ফিরে চলল।
—দেখো হ্যারি ফ্রান্সিস আস্তেআস্তে বলল—তুমি ভালো করেই জানো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অলস জীবন আমাকে কোনোদিন টানেনি। আমি ভালোবাসি অভিযাত্রীর জীবন। ঝড়বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র। দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা দেশ, মানুষজন তাদের জীবন তাদের সঙ্গে ভালোবাসার সম্বন্ধ।
হ্যারি বলল—আমি জানি ফ্রান্সিস কিন্তু তোমার জীবন সম্পর্কে এই ধারণা যে সবাই বোঝে না। প্রায় সকলেরই ঘরমুখী মন।
ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল ঠিক আছে। এখন তো আমরা ভূমধ্যসাগর অঞ্চল আছি। জাহাজ চালককে বলো দেশের দিকে জাহাজ চালাতে।
খবরটা জাহাজে রটে গেল। বন্ধু ভাইকিংরা লেগে পড়ল দড়িদড়া বাঁধা আর পাল খাটানোর কাজে। সন্ধে নাগাদ জাহাজে পাল খাটানো শেষ হলো। সমুদ্রে শো শো শব্দে বাতাস ছুটেছে। ঘড় ঘড়শব্দে জাহাজের নোঙর তোলা হলো। নজরদার পেড্রো জাহাজের মাস্তুলে জড়ানো দড়ি বেয়ে-বেয়ে মাস্তুলের মাথায় উঠে গেল। পালগুলো হাওয়ার তোড়ে ফুলে উঠল। জাহাজ চলল মাঝসমুদ্রের দিকে।
জাহাজ চলেছে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর ভাইকিংরা পালা করে জাহাজ পাহারা দিচ্ছে। আকাশে চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। বেশদূর পর্যন্ত সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। নজরদার পেড্রো নজর রাখছে চারিদিকে। যদি হঠাৎ কখনো জলদস্যুদের জাহাজ নজরে পড়ে তবে আগে থেকেই সাবধান হওয়া যাবে।
রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটল। পরদিন সকালে বাতাস বেশ পড়ে গেল। জাহাজের গতিও কমে গেল। ফ্রান্সিসকে খবর দেওয়া হলো। ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে ডেক-এ উঠে এলো। জাহাজচালকের কাছে এলো। বলল-তোমার কী মনে হয়? বাতাসের গতি কমে গেল কেন?
জাহাজের হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে চালক বলল—চারপাশের সমুদ্রের ঢেউ দেখে বাতাসের গতি বুঝে মনে হচ্ছে আমরা এখনও ভূমধ্যসাগর এলাকার মধ্যেই আছি। এই বাতাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া গুমোট ভাব এই সবকিছু ঝড়ের পূর্বাভাস বলে আমার সন্দেহ হচ্ছে।
ফ্রান্সিস বলল—তাহলে তো আমাদের সাবধান হতে হবে।
—ঝড়ের সঙ্গে লড়বার জন্য আমাদের তো তৈরি হতেই হবে—হ্যারি বলল।
জাহাজচালক বলল—যদি ঘন্টা তিনেকের মধ্যে ঝড় ছুটে না আসে তবে আবার বাতাসের বেগ বাড়বে, গুমোট ভাবটা আর থাকবে না।
কিন্তু ফ্রান্সিস সেই অনুমানের ওপর খুব ভরসা করতে পারল না। ও বিস্কোকে ডাকল। বিস্কো এলো। ফ্রান্সিস বলল—সবাইকে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলল। ঝড়ের আশঙ্কা আছে। সব পাল গুটিয়ে ফেলে তৈরি হও সবাই।
বিস্কো জাহাজের ডেক-এর বন্ধুদের সবাধান হ’তে বলল। কেবিনঘরে গিয়ে খবর দিল সবাইকে। রসুইঘরে গিয়ে রাঁধুনি বন্ধুদের তাড়া দিল তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করার জন্য। দুপুরের আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে সব ভাইকিংরা তৈরি হতে লাগল যদি ঝড় আসে ভবে ঝড়ের সঙ্গে লড়বার জন্য।
আশ্চর্য। জাহাজচালকের আশঙ্কাই সত্যি হলো। একটু বেলা হতেই দক্ষিণ দিক থেকে হালকা মেঘের সারি উড়ে আসতে লাগল। একটু পরেই ভারি কালো মেঘের সারি ছুটে আসতে লাগল। কালো মেঘ জতে লাগল। সূর্য ঢাকা পড়ে গেল। তারপরই প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল উন্মত্ত বাতাস।
ততক্ষণে ভাইকিংরা সব পাল গুটিয়ে ফেলেছে। নজরদার পেড্রো মাস্তুলের মাথা থেকে নেমে এসেছে। মাস্তুল ঘিরে, রেলিঙের ধারে-ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে ভাইকিংরা। মাস্তুলের লম্বা টানা দড়ি, পাল খাটানোর কাঠে বাঁধা ঝোলানো দড়ি সব টেনে ধরে ভাইকিংরা ঝড়ের প্রথম প্রচণ্ড ঝাপ্টা সামলাল। জাহাজটা প্রথম ধাক্কায় কাত হয়ে গেলেও ভাইকিংদের অভিজ্ঞ হাতে টানা দড়ির টানে আবার সোজা হয়ে গেল। এবার মেঘের গায়ে আঁকাবাঁকা বিদ্যুতের আলো চমকাতে লাগল। ঘন ঘন বাজ পড়ার প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। মাস্তুলের টানাদড়ি, রেলিঙের দড়িদড়া, পাল খাটানো কাঠের ঝোলানো দড়ি প্রাণপণে টেনে ধরে ভাইকিংরা ঝড়ের সঙ্গে লড়তে লাগল। জাহাজের দুলুনির সঙ্গে তাল রেখে ওরা জাহাজের সঙ্গেই উঠতে পড়তে লাগল। কিন্তু কেউ নিজের জায়গা ছাড়লো না।
ফ্রান্সিসদের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বিকেলের আগেই ঝড় থেমে গেল। হাওয়ার বেগ কমল। আকাশে আর মেঘ নেই। পশ্চিম দিকে সূর্য নেমে এসেছে। রোদের তেজও কমে এসেছে। ঝড়বৃষ্টি বেশিক্ষণ ছিল না। ঐটুকু সময়ই ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে লড়াই করে ভাইকিংরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ক্লান্তিতে ডেক-এর ওপরেই এখানে-ওখানে কেউ কেউ শুয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বসে পড়েছে।
নজরদার পেড্রো মাস্তুলের দড়িদড়ায় পা রেখে উঠতে লাগল মাস্তুলের মাথায়। নিজের জায়গায় গিয়ে বসে চারদিকে নজর রাখাই তো ওর কাজ। নিজের জায়গায় মাস্তুলের মাথায় পৌঁছবার পর ওর নজরে পড়ল পুবদিকে পাথুরে ডাঙা। পেড্রো চেঁচিয়ে উঠল—ডাঙা-ডাঙা দেখা যাচ্ছে।
ডেক-এর ওপরে যে ভাইকিংরা শুয়ে বসে ছিল তাদের কয়েকজন এসে রেলিঙ ধরে দাঁড়াল। ওরাও দেখল পাথুরে ডাঙা। বিস্কোও ছিল তাদের মধ্যে। ও একজন ভাইকিং বন্ধুকে বলল—ফ্রান্সিস-হ্যারি দের আসতে বলল।
বন্ধুটি ছুটল সিঁড়ি দিয়ে নেমে কেবিনঘরের দিকে। কেবিনঘরে ক্লান্ত ফ্রান্সিস শুয়ে বিশ্রাম করছিল। মারিয়া এমব্রয়ডারির কাজ করছিল। দরজায় টোকা পড়তে মারিয়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ভাইকিং বন্ধুটি বলল—ফ্রান্সিস, ডেক-এ এসো। পেড্রো ডাঙা দেখতে পেয়েছে।
ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে চাল ডেক-এ ওঠার সিঁড়ির দিকে। মারিয়াও চলল পেছনে পেছনে।
ডেক-এ উঠে রেলিঙের ধারে এলো ফ্রান্সিস বিস্কো আঙ্গুল দিয়ে পুবদিকটা দেখান। বিকেলের আলো অনেকটা কমে এসেছে। তবু দেখা গেল উঁচুনিচু পাথুরে জমি। কিছু কাঠপাথরের বসতি এলাকাও দূরে দেখা গেল। আর পড়ন্ত রোদে দেখা গেল উঁচু মিনারের মতো। শঙ্কুর আকারের। নীচের দিকটা গোল, ছড়ানো। পাথরের দেয়াল। একটা বেশ বড়ো খাঁড়ির মতো। সমুদ্রের জল অনেকটা ভেতরে এখানে গেছে।
ততক্ষণে হ্যারি এসে পড়েছে। সবাই উৎসুক চোখে দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি, কিছু বুঝতে পারছো?
—কোনো দ্বীপটিপহবে বসতি এলাকা খুব বড়ো নয় বলেই মনে হচ্ছে। হ্যারি বলল। ফ্রান্সিসদের জাহাজটা তখনই একটু উত্তরমুখো হলো। এবার দেখা গেল বন্দর এলাকা। বড় খাঁড়িরমুখে জাহাজঘাটা। দুটো জাহাজ নোঙর করা। একটা জাহাজ বড়। যুদ্ধ জাহাজ। তবে মালবহনের কাজও করে। অন্য জাহাজটা ছোট। ঝকঝকে সবুজসাদা রঙ করা। বেশ শৌখিন জাহাজ। পালগুলো গুটোনো। মাস্তুল ডেকও রঙ করা। সবুজ রঙের মোটা দড়ির রেলিং। তাতে ছোট ছোট পতাকা বসানো। হাওয়ায় উড়ছে পতাকাগুলো। জাহাজটার মাথায় একটা সবুজ রঙের দামী কাপড়ের পতাকা উড়ছে। তাতে কিছু একটা নকশা আঁকা। শেষ বিকেলের আলোয় ঠিক বোঝা গেল না কিসের নকশা। আলো কমে আসায় আর বিশেষ কিছু দেখা গেল না। জাহাজ দুটোয় মাত্র কয়েকজনকে দেখা গেল। তারা পাহারদার সৈন্য না আরোহী বোঝা গেল না। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি, কি করবে?
—আমরা বন্দরের দিকে যাবোনা। খাঁড়ির এপাশে বেশ দূরে আমাদের জাহাজ নোঙর, করবো-হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস বলল, বেশ। জাহাজচালককে তাই বলো।
বিস্কো জাহাজ চালককে নির্দেশ দিতে চলে গেল। মারিয়া বলল—কিন্তু কোথায় এলাম। এটা কোনো দ্বীপনা দেশ সেটাও তো জানতে হবে।
-তাহলে তো আমাদের এখানে নামতে হবে, হ্যারি বলল। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল, হ্যারি—সেটা আমিও ভাবছি। কিন্তু খোঁজটা নেবো কি করে?
হ্যারি বলল,—যা বুঝতে পারছি ঐ জাহাজ দু’টোয় যারাই থাকুক তাদের কারোও থেকে এসব জানতে গেলে বিপদ হতে পারে।
—হুঁ ঠিক বলেছো—ফ্রান্সিস বলল-ঐ সুন্দর ঝকঝকে জাহাজটা দেখে আমার সন্দেহ হচ্ছে নিশ্চয়ই ওটা কোনো রাজা বা ধনী ব্যবসায়ীর। তাদের কাছে কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা কম। উল্টে আমাদের ওরা জলদস্যুর দল ভেবে আক্রমণ করতে পারে। তাতে আমাদের আত্মরক্ষার জন্য লড়াইয়ে নামতে হতে পারে। আমরা কোন লড়াইবা ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে যাবো না। আমাদের কোনো ক্ষতি হয়, এমন কিছু আমরা করবো না।
হ্যারি বলল, হ্যাঁ আমরাও তাই মত। একটু থেমে বলল—সবচেয়ে ভালো হয় একটু রাত হলে নৌকায় চড়ে আমরা খাড়ির গায়ে গিয়ে নামবো। ধারে-কাছের বাড়িগুলোর কোনোটাতে গিয়ে কোথায় এলাম এটা জেনে নিয়ে চলে আসবো।
-ঠিকই বলছো হ্যারি এতে বিপদের আশঙ্কা কম-মারিয়া বলল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ এতক্ষণে থেমে গেছে। বেশি শব্দ না করে আস্তে আস্তে নোঙর ফেলা হ’ল। সন্ধে হলো। ফ্রান্সিস, হ্যারি আর শাঙ্কো তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম করতে লাগল। রাতে বেরুতে হবে নৌকায় চড়ে।
রাত হলো। ভাইকিং বন্ধুরা সব খাওয়া-দাওয়া সেরে নিচ্ছে তখন হ্যারি এসে ওদের বলে গেল খাওয়া-দাওয়ার পরে ওরা সবাই যেন ডেক-এ উঠে আসে ফ্রান্সিস তাদের কিছু বলবে।
খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই জাহাজের ডেক-এ জড়ো হলো। একুট পরে পোশাক পরে কোমরে তলোয়ার নিয়ে ফ্রান্সিস, হ্যারি আর শঙ্কো এলো। মারিয়াও এলো।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলতে লাগল—ভাইসব যে ডাঙা আমরা দূরে দেখছি আমরা জানি না সেটা কোনো দ্বীপ না দেশ। সেটা না জানতে পারলে আমরা কোথায় এলাম, আমাদের দেশ কতদূর, এসব কিছুই বুঝতে পারবো না। তাই এসব খোঁজখবর নিতে আমি হ্যারি আর শাঙ্কোকে নিয়ে নৌকায় চড়ে তীরে যাবো। গোপনে খোঁজখবর নিয়ে আসবো। সে কাজটা এমনভাবে সারতে হবে যাতে কোনো বিপদে না পড়ি। তোমরা ঘুমোও কিন্তু কযেকজনকে ডেক-এ সতর্কভাবে থাকতে হবে। যদি কোন বিপদে পড়ি তাহলে যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অঞ্চল থেকে পালাতে পারি।
ফ্রান্সিস থামল হ্যারি আর শাঙ্কোকে নিয়ে চলল জাহাজের পেছন দিকে। হালের কাছে এসে ফ্রান্সিস দেখল একটা নৌকো জলে নামানো হয়েছে। ঢেউয়ে অল্প অল্প দু’লছে নৌকোটা। প্রথমে ফ্রান্সিস তারপরে শাঙ্কো আর হ্যারি জাহাজের বড় হালের খাঁজে পা রেখে নৌকোয় নেমে বসে পড়ল। জাহাজের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা খুলে ফ্রান্সিস নৌকো ছেড়ে দিল। দাঁড় টানতে লাগল। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে নৌকো তীরের দিকে চলল।
জাহাজের রেলিং ধরে পঁড়িয়ে ছিল মারিয়া। ফ্রান্সিসদের নৌকোটা দেখতে লাগল। ওর মন খারাপ হয়ে গেল। এই বিদেশ বিভুইয়ে কে জানে কোনো বিপদে পড়ে কিনা ফ্রান্সিসরা। কিন্তু ফ্রান্সিসকে কোনোভাবেই সংকল্পচ্যুত করা যাবে না, এটা মারিয়া জানে। ভয় কাকে বলে ফ্রান্সিস জানে না। ওর আত্মবিশ্বাসও প্রবল।
নৌকা চলেছে। সমুদ্র বেশ শান্ত। হাওয়ার বেগও বেশি নয়। তবু দূরবিস্তৃত সমুদ্রের শোঁ-শোঁ শব্দটা শোনা যাচ্ছে। দাঁড় বাইছে ফ্রান্সিস আর একটা দাঁড় হালের মতো ধরে চুপ করে বসে শাঙ্কো নৌকোর অন্য কোণটায়। মাঝখানে হ্যারি আকাশ তারার মেলা বসে গেছে। ভাঙা চাঁদ। চাঁদের আলো খুব উজ্জ্বল নয়। তবে অস্পষ্ট হলেও ফ্রান্সিস দেখল ওদের নৌকো খাড়িটার তীরের কাছে চলে এসেছে। ফ্রান্সিস চাঁদের আলো দেখে নৌকোটা খাঁড়িটায় ঢুকিয়ে দিল। তারপর তীরের কাছ দিয়ে নৌকো চালাতে লাগল। খাঁড়ির পার ধরে চলেছে উঁচু উঁচু বিরাট পাথুরে চাঁই। খাঁড়ির ওপারে দেখা যাচ্ছে সেই তলামোটা মিনার মতো। বেশ উঁচু। কিন্তু ওপর থেকে অনেকটা ভাঙা, যেন ধস নেমেছিল। ধসের মধ্যে চৌকোনো বড় বড় পাথরের চাঙ ছড়ানো। বোঝাই যাচ্ছে, ঐ মিনারেরই ভগ্নস্তূপ। খাঁড়ি শেষে যে তলামোটা মিনারটা দেখা যাচ্ছে সেটা কিন্তু অটুট। পাথর-বাঁধানো। দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ঐ তলামোটা মিনারগুলো কিফ্রান্সিসরা বুঝতে পারলোনা।
খাঁড়ির জলে তেমন ঢেউ নেই। অল্প জ্যোৎস্নার আলোয় সবই দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস খাঁড়ির ধারের উঁচু-উঁচু পাথরের চাঁইগুলোর দিকে নজর রেখে চলল যদি সমতল এলাকা পায়। সমতল এলাকাতেই বাড়ি ঘর থাকবে। লোকজনের বাস সেখানেই তো হবে।
দু’তিনটে পাথরের চাইয়ের পাশ দিয়ে খাড়ির জল অনেকটা ঢুকে গেছে। এখানটায় আসতেই ফ্রান্সিস দেখল পাথরের চাঁইগুলোর আড়াল থেকে একটা এদেশীয় নৌকো দ্রুত ওদের নৌকোর দিকে ছুটে আসছে। নৌকোটায় তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে খোলা তলোয়ার। ফ্রান্সিসরা কিছু বোঝার আগেই নৌকোটা ওদের নৌকার গায়ে এসে লাগল। ঝাঁকুনি সামলে তিনজন সশস্ত্র লোকই ফ্রান্সিসদের নৌকায় লাফ দিয়ে নামল। শাঙ্কো দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে কোমর থেকে তলোয়ার খুলল। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলল—তলোয়ার নামাও।
শাঙ্কো তলোয়ার নামাল। ফ্রান্সিস পর্তুগীজ ভাষায় বলল—আমরা বিদেশি—লড়াই চাই না। লোক তিনটি কিছুই বুঝল না। তবে তলোয়ার নিয়ে আক্রমণও করল না। নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এবার হ্যারি লো লাতিন ভাষায় বলে উঠল—আমরা বিদেশি, ভাইকিং, লড়াই নয় বন্ধুত্ব চাই।
এবার লোক তিনজন বুঝল। ওরা তলোয়ার নামাল। আস্তে আস্তে টাল সামলে নৌকোটায় বসে পড়ল। লোকগুলোর গায়ে এখানকার জেলেদের জোব্বামতো পোশাক। অল্প চাঁদের আলোয় দেখে হ্যারি বুঝল ওদের পোশাক জলে ভেজা। ওদের মধ্যে রোগা আর লম্বামতো লোকটি লো ল্যাতিন ভাষায় বলল, তোমরা বিদেশী ভাইকিং এখানে এসেছো কেন?
—সে অনেক কথা—হ্যারি বলল, শুধু এটুকু বলছি যে আমরা মোজারকা দ্বীপ থেকে আসছি। যাবো পর্তুগালের দিকে। এটা কি কোনো দ্বীপ?
—হ্যাঁ। এটা সার্দিনিয়া দ্বীপের উত্তরের সাসারি বন্দর। কিন্তু তোমরা হঠাৎ এখানে এসেছো কেন?
—একটু দূরে আমাদের জাহাজ নোঙর করা আছে। আমরা কোথায় এলাম, তার হদিশ জানতে এসেছি হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস বলল হ্যারি, জিজ্ঞেস করো তো ঐ তলামোটা মিনার মতো-ওগুলো কী?ফ্রান্সিস কথাটা বলল স্পেনীয় ভাষায়। দেখা গেল লোকগুলো স্পেনীয় ভাষা বুঝল। লম্বামতো লোকটা পরিষ্কার স্পেনীয় ভাষায় বলল—ওগুলো নুরাঘি। সার্দিনিয়ার অনেক জায়াগায় নুরাঘি আছে।
—এগুলো কি দুর্গ? শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল।
লোকটি বলল—হ্যাঁ। সৈন্যরা থাকে।
—তোমার নাম কি ভাই?
—দোনিয়া লোকটি বলল।
হঠাৎ পেছন ফিরে কি দেখেই দোনিয়া এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। চাপাস্বরে বলে উঠল—রাজার জাহাজ। পালাও। দোনিয়ার সঙ্গী দু’জনও উঠে দাঁড়াল।
ফ্রান্সিসরা পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল সেই সুদৃশ্য সুন্দর ছোট্ট জাহাজটা নিঃশব্দে এদিকেই আসছে। সেই জাহাজের সম্মুখে দুটো ছোট নৌকো খুব দ্রুত আসছে। নৌকো দুটো সাধারণ মাছধরা নৌকো না। বেশ সৌখিন সুন্দর নৌকো। নৌকো দু’টোয় প্রায় জনাদশেক সৈন্য। খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। সৈন্যদের মাথায় শিরস্ত্রাণ, বুকে লোহার বর্মআঁটা।
দোনিয়া আর তার সঙ্গী দু’জন নিজেদের নৌকোয় লাফিয়ে উঠতে গেল। নৌকোটা। টাল সামলাতে না পেরে একজন সঙ্গী জলে পড়ে গেল। তাকে হাত বাড়িয়ে নৌকোয় তুলতে গিয়ে দোনিয়ার দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণ সৈন্যবোঝাই নৌকো দু’টো অনেক কাছে চলে এসেছে। সৈন্যদের নৌকো থেকে কে যেন চিৎকার করে বলল, দোনিয়া—পালাবার চেষ্টা করবেন না। আজকে আপনাকে ধরা দিতেই হবে।
দোনিয়া ততক্ষণে সঙ্গীটিকে নৌকোয় তুলে ফেলেছে। দোনিয়া দেখল রাজার নৌকো জাহাজের অনেক কাছে চলে এসেছে। এত সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। দোনিয়া পাথরের চাই-ওঠা তীরের দিকে তাকাল। ওর লক্ষ্য সাঁতার দিয়ে তীরে উঠে পালানো। কিন্তু দেখলো তীরে পাথরের চাইয়ের ওপর খোলা তলোয়ার হাতে কয়েকজন সৈন্য এসে দাঁড়িয়েছে। বোঝা গেল সৈন্যরা আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। যাতে দোনিয়া কোনোভাবেই পালাতে না পারে।
দোনিয়া বুঝলো পালাবার কোনো উপায় নেই। ও কোমরে গোজা তলোয়ার খুলে নৌকোর গলুইয়ে ফেলে দিল। সঙ্গী দু’জনও তাই করে। তারপর নৌকায় বসে পড়লো।
সৈন্যভর্তি একটা নৌকো ফ্রান্সিসদের নৌকো ছাড়িয়ে দ্রুত দোনিয়াদের নৌকোর গায়ে গিয়ে লাগল। দু’জন সৈন্য তলোয়ার কোমরের খাপে ভরে দোনিয়াদের নৌকোয় উঠল। নৌকো থেকে মোটা দড়ির মাথা ছুঁড়ে দেওয়া হলো। সৈন্য দু’জন দোনিয়ার নৌকোটার হালের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধল।
এদিকে অন্য নৌকোটা ফ্রান্সিসদের নৌকোর গায়ে এসে লাগল। চাঁদের অল্প আলোয় ফ্রান্সিসদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখেই বুঝলো –এরা বিদেশী।
সকলের সামনের সৈন্যটি খোলা তলোয়ার হাতে লাফিয়ে ফ্রান্সিসদের নৌকোয় উঠল। লো লাতিন ভাষায় বলল—তোমরা কারা?
হ্যারি উঠে দাঁড়াল। কোমর থেকে তলোয়ার খুলে নৌকোর গলুইয়ে রেখে। বলল—আমরা বিদেশি, ভাইকিং। আমরা লড়াই চাই না।
আপনাদের বন্ধুত্ব চাই। সৈন্যটি খোলা তলোয়ার কোমরে গুঁজে রাখল। হাত বাড়িয়ে সৈন্যদের নৌকো থেকে বেরিয়ে ধরা দড়ির মাথাটা নিল। ফ্রান্সিসদের নৌকোর গলুইয়ের কাঠের সঙ্গে দড়িটা বাঁধল।
—তোমাদেরও বন্দী করা হলো। কালকে রাজা এনজিওর কাছে হাজির করা হবে তোমাদের। রাজা যা বিচার করবেন, তাই করা হবে।
দু’তিনজন ফ্রান্সিসদের নৌকোতেও উঠল। এবার নৌকো দটো দড়ি দিয়ে বাঁধা দোনিয়া ও ফ্রান্সিসদের নৌকো টেনে বাঁধল। দোনিয়াদের নৌকোর সৈন্যটি তলোয়ার উঁচিয়ে দূরের নুরাঘিটা দেখিয়ে বলল—নুরাঘিতে টেনে নিয়ে চলো।
নৌকো দু’টো আগে চলল। পেছনে দড়ি বাঁধা দোনিয়া ও ফ্রান্সিসদের নৌকো। রাজার জাহাজটা দেখা গেল খাড়ির মুখের দিকে চলে যাচ্ছে।
দড়িবাঁধা দোনিয়া ও ফ্রান্সিসদের নৌকো দুটো টেনে নিয়ে চলেছে সৈন্যদের নৌকো দুটো। শাঙ্কো আস্তে নৌকোর গলুইয়ের ধারে সরে এলো। ও তখন দ্রুত ভাবছে আর দেরি করলে চলবেনা। রাত থাকতে থাকতেই পালাতে হবে। জাহাজেফিরে বন্ধুদের সব জানাতে হবে। কালকে রাজা বিচার করবে। ওদের কি শাস্তি দেবে কে জানে ওদের কাউকে কাল সকালেও ফিরতে না দেখলে বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে যাবে। হয়তো ওদের খোঁজ নিতে জাহাজ চালিয়েই ওরা খাড়িতে ঢুকে পড়বে। রাজার জাহাজে অন্য জাহাজটায় অনেক সৈন্য আছে। হয়তো লড়াই হতে পারে। সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে বন্ধুরা হারবে। মৃত্যু হবে অনেক বন্ধুর। বন্দীও হবে অনেকে। কাজেই যে করে হোক ওদের সব খবর দিয়ে সাবধান করে দিতে হবে।
শাঙ্কো আরো স’রে এল। গলা নামিয়ে ফিফিস্ করে ডাকল—ফ্রান্সিস ফ্রান্সিসের কানে ডাক গেল। কিন্তু ও মাথা ঘুরিয়ে শাঙ্কোর দিকে তাকাল না। আঙুল দিয়ে বাঁ কানটা ছুঁল। তার মানে ও ডাক কানে শুনতে পেয়েছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকালে সৈন্য দু’জনের সন্দেহ হতে পারতো কি কথা বলছে ওরা? শাঙ্কো আগের মতোই চাপা গলায় বলল আমি সাঁতরে পালাচ্ছি বন্ধুদের খবর দেব।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ ভাবল। তারপর মাথা ওঠানামা করে সম্মতি জানাল। তবে ফিফিস্ করে বলল—সাবধানে।
শাঙ্কো সৈন্য দু’জনের দিকে তাকাল। দেখল সৈন্য দু’জন তখনও খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে দূরের নুরাঘিটার দিকে।
শাঙ্কো নৌকো থেকে আস্তে-আস্তে দু’পা জলে নামল। তারপর সৈন্য দু’জনের অন্যমস্কতার সুযোগ নিয়ে দু’হাতে ভার দিয়ে জলের মধ্যে শরীরটা ছেড়ে দিল। টুপ করে জলে ডুবে গেল শাঙ্কো। সৈন্য দু’জন কিছুই বুঝতে পারল না।
শাঙ্কো এক ডুবে যতটা সম্ভব দূরে এসে আস্তে আস্তে মাথা ভাসাল। দেখল নৌকোগুলো অনেক দূর চলে গেছে। শাঙ্কো জলে কোনোরকম শব্দ না করে আস্তে আস্তে সারাতে লাগল তীরের দিকে।
কিছু পরে নৌকোগুলো নুরাঘির কাছে এলো। তখনও অন্ধকার কাটেনি। দেখা গেল জলের ধারটা পাথর বাঁধানো। রাস্তা চলে গেছে ওখান থেকে নুরাঘির সদর প্রবেশপথের দিকে। প্রবেশপথের কাঠের দরজা। তার মাথায় মশাল জ্বলছে। পাথরের টানা দেওয়ালের মাথায় এখানে আরো মশাল জ্বলছে। কয়েকজন পাহারাদার সৈন্য নুরাঘি পাহারা দিচ্ছে। তবে তাদের তলোয়ার কোষবদ্ধ। পাথর বাঁধানো তীরে নৌকোগুলো ভিড়ল। আস্তে আস্তে সবাই নামতে লাগল। সৈন্যরা নেমে সারি দিয়ে দাঁড়াল। সৈন্যদের দলনেতা গলা চড়িয়ে বলল—সব বন্দীরা উঠে এসো। ফ্রান্সিস, হ্যারি, দোনিয়া তার সঙ্গী দু’জন—সবাই আস্তে-আস্তে তীরে নামল।
সৈন্যদের মাঝখান দিয়ে ফ্রান্সিসরা চলল নুরাঘির প্রধান ফটকের দিকে। ততক্ষণে ফটকের বড় কাঠের দরজা পাহারাদার সৈন্যরা ঠেলে খুলে দিয়েছে। রাস্তা পার হয়ে ফ্রান্সিরা প্রধান ফটক দিয়ে নুরাঘির ভেতরে ঢুকল।
ছোট পাথরের চত্বরের পর নুরাঘি। গোল তলাটা। অনেকগুলো ঘর। ফ্রান্সিস মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল—গোল নুরাঘি ওপরের দিকে উঠে গেছে। ওপরেও বেশ কিছু লোহার গরাদবসানো জানালা। তার মানে ওপরেও আরো ঘর আছে।
দলনেতার নির্দেশে ফ্রান্সিসদের একটা ঘরে ঢোকানো হলো। ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস জ্বলন্ত মশালের আলোয় দেখল ঘরটা খুব বড়ো নয়। পাথরের মেঝেয় শুকনো ঘাসের ওপর কাপড়পাতা বিছানা। পাঁচ-ছ’জন সৈন্য ঘুমিয়ে আছে। ফ্রান্সিসদের ঢোকার শব্দে দু’একজন সৈন্যের ঘুম ভেঙে গেল। একজন উঠে বসে হাই তুলল।
ফ্রান্সিস বুঝল এটা সৈন্যাবাস,কয়েদঘর নয়। ও একে খুশীহলো। কয়েদঘরের বন্দীদশার হাত থেকে বাঁচা গেল। এখন দেখা যাক-রাজা ওদের কি শাস্তি দেয়।
দোনিয়া ঘাসের বিছানায় বসল। তরপর শুয়ে পড়ল। বোঝা গেল—দোনিয়া খুবই ক্লান্ত। ফ্রান্সিসরাও ঘাসের বিছানায় বসল। একপাশে হ্যারি বসল। অন্যপাশে বসল দোনিয়ার সঙ্গী দু’জন। দেখা গেল দরজায় কোনো পাহারাদার নেই। তবে কিছু সশস্ত্র সৈন্য ঘোরাফেরা করছে দরজার কাছে।
রাত শেষ হয়ে আসছে। কিছু সৈন্য অস্ত্রশস্ত্র খুলে ঘরগুলোয় ঢুকছে। বোধহয় শুয়ে বিশ্রাম করবে এখন।
ফ্রান্সিস এবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। হ্যারি ক বলল—হ্যারি শুয়ে বিশ্রাম।
হ্যারি ও শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস বলল—শাঙ্কো পালিয়েছে। খুব বাঁচোয়া যে ওর কোনো বিপদ হয়নি। মারিয়া বন্ধুরা অন্তত নিশ্চিত হবে শাঙ্কোর কাছে খবর পেয়ে যে আমাদের এখনও কোনো বিপদ ঘটে নি। আমরা ভালো আছি।
হ্যারি বলল—ভালোই হলো। শাঙ্কো খুব কায়দা করে পালিয়েছে। আমি তো বুঝতেই পারিনি। একটু চুপ করে থেকে হ্যারি বলল—আমরা বিপদ থেকে বাঁচবো কিনা, সেটা এখন নির্ভর করছে রাজা এনজিওর মর্জি-মেজাজের ওপর।
—দেখা যাক কপালে কি আছে। ফ্রান্সিস বলল।
ওদিকে শাঙ্কো সাঁতরে সাঁতরে যাচ্ছে। চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় দেখল রাজার জাহাজটা ঠিক খাঁড়ির মুখে নোঙর করে আছে। শাঙ্কো বুঝল—ওদিক দিয়ে পালানো যাবে না। ও সাঁতরে সাঁতরে তীরের কাছে এল। দেখল এখানে তীরের কাছটা পাথর ছড়ানো মাটি। অনেকটা সমতল। ও তীরের কাছে পায়ের নীচে পাথুরে মাটি পেল। কোমরজলে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম করল। ও তখনও হাঁপাচ্ছে। আস্তে আস্তে হাঁপ ধরা ভাবটা যেন কমল।
শাঙ্কো ছোট ছোট পাথরকুঁচি ছড়ানো মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে জল থেকে তীরে উঠল। ও স্থির করল পশ্চিমমুখো হেঁটে ঠিক খাঁড়ির মুখ থেকে দূর চলে যাবে। তারপর সমুদ্রের জলে নেমে সাঁতরে নিজেদের জাহাজে ফিরবে।
পাথুরে জমি পেরিয়ে বেশ একটা টানা সমতল এলাকা পেল শাঙ্কো। চলল পশ্চিমমুখে। হাঁটতে লাগলো শাঙ্কো। সমতল হলেও এখানে-ওখানে পাথর ছড়িয়ে আছে। কাজেই শাঙ্কোকে বেশ সাবধানেই হাঁটতে হচ্ছিল। গায়ে জলে ভেজা পোশাক সমুদ্রের জোর। হাওয়ার শরীর কেঁপে উঠছিল। বেশ শীত শীত লাগছিল। একসময় সমুদ্রের ধারে এলো শাঙ্কো। দেখল খাঁড়ির মুখে রাজার জাহাজ অনেক দূরে। শাঙ্কো পা টিপে টিপে পেছল পাথরের ওপর পা রেখে। সমুদ্রের জলে নামল। দূরে ওদের জাহাজ দেখা যাচ্ছে। শাঙ্কো ওদের জাহাজ লক্ষ্য : করে সাঁতরাতে লাগল।
একটু পরেই মাথার ওপর কালো; আকাশের অন্ধকার কেটে যেতে লাগল। শাঙ্কো মুখ তুলে পুবদিকে তাকাল। দেখল।—লালচি হয়ে উঠেছে। পূর্ব দিগন্তের—আকাশে সূর্য উঠতে দেরি নেই। শাঙ্কো প্রক এবার দ্রুত সাঁতরাতে লাগল। রোদ চড়া হলে বিপদ হতে পারে। অনেকটা দূর হলেও রাজার জাহাজ থেকে কারো নজরে পড়ে যেতে পারে ও। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তল্লাট ছেড়ে পালাতে হবে।
শাঙ্কো সাঁতরে চলল। হাত-পা যেন আর চলছেনা। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তবুশাঙ্কো গতি কমাল না। পাথরের মতো ভারি হাত-পা। তবু প্রাণপণে সাঁতার কেটে চলল শাঙ্কো।
পুব আকাশে সূর্য উঠল। নরম আলো ছড়ানো শান্ত সমুদ্রের জলে। রোদ চড়া হতে লাগল। শাঙ্কো তখনও সাঁতরে চলল।
ওদের জাহাজের কাছে যখন এলো তখন রাজার জাহাজ অনেক দূরে। নজরে পড়ার সম্ভাবনা নেই। চারদিকে তাকাচ্ছে তখনই হঠাৎ দেখল জলের ওপর চলন্ত পাখনা। শাঙ্কোর বুক কেঁপে উঠল। হাঙর জল কেটে ঘুরছে। শাঙ্কো ভালো করে আবার চারদিকে তাকাল। না, আর কোনো চলন্ত পাখনা জল কেটে ছুটছেনা। শাঙ্কো যখন সাঁতরাতে শুরু করে তখন তলোয়ারটা কোমরে গোঁজা ছিল। কিন্তু হাত পা চালিয়ে সাঁতার কাটতে গিয়ে পায়ে খাপছাড়া খোলা তলোয়ারের খোঁচা লেগে কেটে ছড়ে যাচ্ছিল। তলোয়ারটা নানাভাবে পিঠের নীচে পোশাকে ঢুকিয়ে বুকের কাছে পোশাকে ঢুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিল। এতে পরিশ্রমই বেশি হতে লাগল। তলোয়ারের খোঁচার হাত থেকে বাঁচা গেল না। কেটে যাওয়া, ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলোয় সমুদ্রের নোনা জল লেগে ভীষণ জ্বালা করছিল। তখন শঙ্কো তলোয়ারটা ফেলে দিয়েছিল। এখন বুঝল—খুব ভুল হয়েছে। হাঙরের কামড় থেকে বাঁচবার আর কোনো উপায় রইল না। শাঙ্কো সাহস সঞ্চয় করল। এখন ভয় পেলে চলবেনা। হাঙর যাতে দূরে দূরে সরে যায় তার জন্যে শাঙ্কো জলে দু’পা দাপাতে দাপাতে সাঁতরাতে লাগল। এতে হাঙরটা দ্রুত আক্রমণ করতে পারল না। শাঙ্কোর চারপাশে পাক খেতে লাগল। বুঝে নিচ্ছে-লোকটা সশস্ত্র কিনা।
জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মারিয়া। সারারাত ঘুমোয় নি মারিয়া। রেলিঙের ধারে কখনো বসেছে, কখনও উঠে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি খাঁড়ির মুখের দিকে। ফ্রান্সিসরা ফিরল কিনা। শাঙ্কোকে প্রথম মারিয়াই দেখতে পেল। মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ডাকল—বিস্কো—তোমরা শিগগির এসো। শাঙ্কো সাঁতরে আসছে। মারিয়ার ডাকে ডেক-এ ঘুমন্ত ভাইকিংদের ঘুম ভেঙে গেল।
মারিয়া তখনই দেখল শাঙ্কোর ঠিক ডান পাশে হাতকয়েক দূরে হাঙরের চলন্ত পাখনা। ভয়ে মারিয়ার বুক কেঁপে উঠল। মারিয়া কারো জন্যে অপেক্ষা না করে ছুটে হালের কাছে গেল। হালের কাঠের খাঁজে খাঁজে পা রেখে দ্রুত নেমে এলো দড়িবাঁধা একটা নৌকোয়। দড়ি খুলে জোরে দাঁড় বাইতে লাগল।
ততক্ষণে বিস্কো ও আরো পাঁচ-ছ’জন ভাইকিং রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখছে মারিয়া নৌকো চালিয়ে চলেছে শাঙ্কোর দিকে। ওরা প্রথমে বুঝল না মারিয়া এত দ্রুত নৌকোয় চড়ে যাচ্ছে কেন। তখনই হাঙরের পিঠের চলন্ত পাখনা জলের ওপর ভেসে উঠল। ওরা চমকে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। হাঙর!বিস্কো চিৎকার করে বলল, রাজকুমারী-হাতের দাঁড়টা জলে জোর জোর ফেলুন যাতে বেশিদূর পর্যন্ত জল ছিটকায়।
হাঙর তাড়াবার এসব নিয়ম মারিয়ার জানার কথা নয়। বিস্কো বারবার চিৎকার করে কথাটা বলতে লাগল। মারিয়া বিস্কোর নির্দেশমতো তাই করতে লাগল। সত্যি হাঙরটা দূরে সরে গেল। ততক্ষণে শাঙ্কো নৌকোর গায়ে হাত রেখেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে নৌকোর ওপরে কোমর পর্যন্ত তুলে লাফিয়ে তারপর পা দুটো তুলে নৌকোর গলুইয়ের মধ্যে গড়িয়ে একেবারে মড়ার মতো পড়ে রইল। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল। চোখবোঁজা। মারিয়া নৌকো চালাল ওদের জাহাজ লক্ষ্য করে। জাহাজ থেকে তখন সমস্ত ভাইকিংরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল—ও—হো-হো। ওরা চিৎকার করে মারিয়াকে উৎসাহ দিতে লাগল।
মারিয়ার নৌকো জাহাজের গায়ে এসে লাগল। মারিয়া হালের কাছে এসে হালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে জাহাজে উঠে এলো। বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে দড়িতে ঝুলে পড়ে নৌকোটায় নামল। ততক্ষণে ভাইকিং বন্ধুরা জালের মতো বাঁধা দড়িদড়া নামিয়ে দিল নৌকোর ওপর। বিস্কো শাঙ্কোকে অনেক কষ্টে ধরে ধরে দাঁড় করিয়ে সেই দড়ির জালে বসিয়ে দিল। বন্ধুরা দড়ি টেনে টেনে শাঙ্কোকে জাহাজের রেলিঙের কাছে নিয়ে এলো। তারপর ওকে টেনে ধরে নামিয়ে জাহাজের ডেক-এ শুইয়ে দিল। বিস্কো ততক্ষণে নৌকো থেকে জাহাজের ডেক-এ উঠে এসেছে। বিস্কো আর দু’তিনজন ভাইকিং শাঙ্কোকে কাঁধে করে নীচে নামবার সিঁড়ির দিকে চলল। আস্তে আস্তে ওরা শাঙ্কোকে নামিয়ে এনে ওর কেবিনঘরে নিয়ে গেল। গায়ের ভেজা পোশাক খুলে ওকে শুকনো পোশাক পরিয়ে দেওয়া হলো। বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো। শাঙ্কো অসাড় শুয়ে রইল। সকলের মনেই তখন প্রশ্ন ফ্রান্সিস হ্যারির কী হলো? ওরা কোথায়? কিন্তু ঐ অবস্থায় শাঙ্কোকে কিছু জিজ্ঞেস করা বৃথা। ও তখন কথাও বলতে পারছেনা। ও চোখ বুজে তখনও হাঁপাচ্ছে। হাত-পা ছড়িয়ে একইভাবে পড়ে আছে।
ভয়ে আশঙ্কায় মারিয়ার বুক কাঁপছে তখন। এতক্ষণের উত্তেজনায় যে কথা মারিয়া ভুলে গিয়েছিল সেটাই মনে পড়ল তখন। ফ্রান্সিস, হ্যারির কি হয়েছে? পুরুষ ভাইকিং বন্ধুরা দুঃসাহসী। কিন্তু মারিয়া তো মেয়ে। ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বিস্কো সান্ত্বনা দিতে লাগল—কাঁদবেন না রাজকুমারী। আপনাকে কাঁদতে দেখলে শাঙ্কো আরো নিস্তেজ হয়ে পড়বে।
মারিয়া দু’হাতে চোখ মুছে শান্ত হবার চেষ্টা করল। কিন্তু ফ্রান্সিস, হ্যারির কথা মনে হতেই আবার দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠতে লাগল।
একটু পরে শাঙ্কো আস্তে-আস্তে চোখ মেলে তাকাল। বিস্কো শাঙ্কোর মুখের ওপর ঝুঁকে চেঁচিয়ে থেমে থেমে বলল—শাঙ্কো—ফ্রান্সিস আর হ্যারি—ভালো থাকলে—মাথাটা আস্তে-আস্তে—ওঠানামা করো।
বিস্কো কথাটা দুবার বলল। বিস্কোর কথা শেষ হইেমারিয়া আর অন্য ভাইকিং বন্ধুরা সাগ্রহে শাঙ্কোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। শাঙ্কো অনেক কষ্টে একটু হাসল—তারপর আস্তে মাথা ওঠানামা করল। সবকিছু ভুলে ভাইকিংরা চিৎকার করে উঠল-ও হো হো—।
মারিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। নিজের কেবিনঘরে চলে এলো। আস্তে আস্তে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল। ফোঁপাতে লাগল। ভাইকিং বন্ধুরা আস্তে আস্তে ডেক-এ উঠে এলো। ওরা তখন এই ভেবে নিশ্চিন্ত হলো যে ফ্রান্সিস আর হ্যারির কোনো, বিপদ হয়নি। ওরা ভালো আছে।
ওদিকে নুরাঘির সৈন্যদের ঘরে ঘাসের বিছানায় ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। পাশে হ্যারি তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে দু’একটা পাখির ডাক শোনা গেল। রাত শেষ হয়ে এসেছে। দোনিয়া তখনও ঘুমুচ্ছে। দোনিয়ার একজন সঙ্গী শুয়ে আছে। অন্য সঙ্গীটা দুহাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে।
ফ্রান্সিস চোখ বুজে ভাবছে তখনও। এরপরে ওরা কি করবে? রাজা এনজিও কি বিচার করবে কে জানে। ঠিক তখনই দোনিয়া মুখে কি বিড়বিড় করে বলে পাশ ফিরল। ফ্রান্সিস দোনিয়ার দিকে তাকাল। হঠাৎই মনে হলো—দোনিয়া কে, তা তো জানা হয়নি। সৈন্যদের দলপতি দোনিয়াকে আপনি করে বলছিল। তার মানে দোনিয়া সামান্য মাছ ধরা পেশার জেলে নয়। দোনিয়ার পরিচয়টা তো পেতে হবে। উনি জেলেদের পোশাক পরে জেলেদের সঙ্গে গভীর রাতে নৌকোয় চড়ে ঘুরে বেড়ান কেন?
ফ্রান্সিস উঠে বসল। হাঁটুতে হাত রেখে মাথা পেতে বসে ছিল দোনিয়ার যে সঙ্গীটি, তার হাত ধরে একটু টানল। লোকটা মাথা তুলল। ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস স্পেনীয় ভাষায় বলল—ভাই। তুমি স্পেনীয় ভাষা জানো?
লোকটি মাথা কাত করে স্পেনীয় ভাষায় বলল—হ্যাঁ তবে কাজ চলা গোছের।
-আমার তাতেই হবে—ফ্রান্সিস বলল—আচ্ছা ভাই—দোনিয়া কে? কেনই বা তোমরা গভীর রাতে নৌকোয় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে?
লোকটি বলল,—সেসব দোনিয়া জানেন। তবে সোনিয়ার কথা বলছি শুনুন। দোনিয়া এখানকার প্রাচীন এক অভিজাত বংশের সন্তান। কিন্তু উনি বরাবরই বংশের আভিজাত্যের ব্যাপারটা মানতেন না। উনি তিন-চারটে ভাষা জানেন। লেখাপড়া নিয়েই থাকেন। অবসর সময় আমাদের জেলেপল্লীতে চাষীদের বাড়িতে চলে আসেন। আমাদের সুখ-দুঃখের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। নিজের উচ্চ বংশ নিয়ে উনি কখনও গর্ব করেন না। অন্য অভিজাত পরিবারের বাড়িতে উনি কখনও যান না। এই সাসারির এমন কি, রাজধানী কাগলিয়ারির গরীব মানুষেরা দোনিয়াকে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করে।
—কিন্তু গভীর রাতে নৌকায় চড়ে এই এই খাঁড়ি এলাকায় ঘুরে বেড়ান কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
-দোনিয়া মাঝেমাঝেই মূল ভূখণ্ডের জেনোয়া পিসায় চলে যান। লোকে বলে উনি নাকি ওখানে পড়াশুনো করতে যান।
লোকটি থামল। তারপর বলতে লাগল—মাস ছয়েক আগে তিনি হঠাই ফিরে আসেন। একদিন সন্ধেবেলা আমাদের জেলে পাড়ায় আসেন। আমরাও তাঁর কাছে গেলাম। উনি বললেন একটা বিশেষ প্রয়োজনে আমার কয়েকজন সাহসী সঙ্গী চাই। তোমরা আমাকে সাহায্য করবে? আমরা সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হলাম। সেই রাতেই তিনি আমাদের দু’জন বন্ধুকে নিয়ে গেলেন। এরকম করে দিন কয়েক পরে পরে রাত হলে আসেন আর দু’জন করে সঙ্গী বেছে নিয়ে যান। লোকটি থামল। তারপর আস্তে আস্তে বলতে লাগল—গত সাতদিন ধরে আমরা দু’জন তাঁর সঙ্গে আছি।
-কি করো তোমরা? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
—রাত একটু বাড়লেই এই ক্যালে মানে খাঁড়ির ধারে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রাখা নৌকোয় চড়ে খাড়িটায় ঘুরে বেড়াই। এসময় দোনিয়া একটা লম্বা দড়ির মাথায় বাঁধা লোহার বড় বড় বড়শির মতো কি যেন খাড়ির জলের নীচে ফেলে দেন। তারপর নৌকো চলার সঙ্গে-সঙ্গে ঐ দড়িবাঁধা বঁড়শিগুলো টেনে নিয়ে চলেন। সারারাত এই বঁড়শিটানা চলে। ভোর হবার আগেই নৌকো লুকিয়ে রেখে চলে আসি আমরা।
—কিন্তু বঁড়শি টেনে দোনিযা কি কিছু খোঁজেন? ফ্রান্সিস বলল।
—হ্যাঁ, একদিন রাতে আমি জানতে চাইলাম—দোনিয়া—সারা রাত জেগে বঁড়শি ফেলে আপনি কী খোঁজেন?
দোনিয়া বললেন তোমরা ঠিক বুঝবে না। শুধু এটুকু জেনে রাখো আমি কয়েকটি যোদ্ধামূর্তি খুঁজছি। কথাটার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝলাম না।
লোকটি থামল। ফ্রান্সিস আপন মনে বলল-যোদ্ধামূর্তি! ফ্রান্সিস বার বার জানতে চাইল সেই যোদ্ধামূর্তি লোহার না অন্য কোনো দামী ধাতুর তৈরি।
লোকটি বারবারই মাথা নেড়ে বলল—সে সব আমরা কিছুই জানি না। দোনিয়া সব জানেন। তাঁকেই জিজ্ঞেস করুন।
ফ্রান্সিস দোনিয়ার দিকে তাকাল। দেখল—দোনিয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। দোনিয়া চোখ খুলে দু’হাত ওপরে তুলে হাই তুলল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসল। ফ্রান্সিস বলল—দোনিয়া—যদি কিছু মনে না করেন আপনার কাছ থেকে কয়েকটা কথা জানার ছিল।
দোনিয়া ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। বলল—বলুন।
—আপনার সঙ্গীর কাছে শুনলাম—আপনি এই সার্জিনিয়ার এক অভিজাত পরিবারের মানুষ। দোনিয়া সামান্য হাসল, একটু মাথা নেড়ে বলল—অভিজাত হলেই সে হৃদয়বান, সৎ, নির্লোভ মানুষ হয়না। কত অভিজাত মানুষ দেখেছি-নৃশংস, লোভী, অর্থ পিশাচ অন্যাচারী। বংশের আভিজাত্য নয়—একজন মানুষের পরিচয় তার কথায়, ব্যবহারে মানবিকতাবোধে।
দোনিয়া কথা থামিয়ে দরজার দিকে তাকাল। দেখল—বাইরে রোদ উঠেছে। তবে ঘরটার অন্ধকার এখনও সবটা কাটে নি। মশালও নেভানো হয় নি।
তখনই দু’জন সৈন্য সাধারণ পোশাকে ঘরে ঢুকল। তাদের হাতে চীনে মটির বড় থালা বাটি। তাতে সকলের খাবার। থালায় গোল কাটারুটি, বাটিতে বিভিন্ন শাকসজির ঝোলমতো। খাবার থালাগুলো সঙ্গীদের সামনে বিছানায় রাখল ওরা। ফ্রান্সিস হ্যারিকে ডাকল। হ্যারি উঠে বসলো। ফ্রান্সিসরা খেতে লাগল। সকলেরই খুব খিদে পেয়েছে তখন। . ফ্রান্সিস খেতে খেতে চারদিক তাকিয়ে দেখল, ঘরের সৈন্যরা জেগে আছে। ফ্রান্সিস ভাবল সৈন্যদের সামনে দোনিয়াকে সব জিজ্ঞেস করে জানাটা ঠিক হবে না। দোনিয়াও হয়তো সব কথা বলতে চাইবে না। ফ্রান্সিসদের খাওয়া হয়ে গেল। একটা বড় কাঠের পাত্র থেকে ওরা জল নিল। সৈন্য দু’জন চলে যেতেই ঘর প্রায় কঁকা হয়ে গেল। বিছনার কোণার দিকে দু’জন সৈন্য তখনও ঘুমুচ্ছে। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল হ্যারি,একটা বেশ রহস্যময় ঘটনার কথা শুনেছি। পরে তোমাকে সব বলবো।
ফ্রান্সিস এবার সোনিয়াকে বলল—আপনার অনেক কথাই আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু যোদ্ধামূর্তির ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারি নি।
দোনিয়া চোখ খুলে বলল আমার সঙ্গী এ ব্যাপারটা আপনাকে না বললেই ভালো—হতো। যাক গে, আমার শুধু একটাই প্রশ্ন—আপনার এই ব্যাপারে এত আগ্রহ কেন?
এবার বলল—দেখুন ওর নাম ফ্রান্সিস, আমার বাল্যবন্ধু। ফ্রান্সিস এর আগে অনেক রহস্যের সমাধান করেছে। মূল্যবান সোনার ঘন্টা, হীরের পাহাড় মুক্তোর সমুদ্র, তুষারে গুপ্তধন ফ্রান্সিস আবিষ্কার করেছে নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে।
—হুঁ—হলে মূল্যবান ধনভাণ্ডার নিখোঁজ মূল্যবান জিনিসের প্রতি আপনার লোভ আছে। দোনিয়া বলল।
—বিন্দুমাত্র না—ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।
—তবে আপনার আগ্রহ হয় কেন? দোনিয়া বলল।
—বলতে পারেন এটা আমার এক জীবনদর্শন। আমি ভালোবাসি ঝড়বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র, দেশবিদেশের মানুষের সঙ্গ, তাদের ভালোবাসা পাওয়া। স্বার্থান্ধ হয়ে কারো কোনো ক্ষতি আমি কোনোদিন করি নি, করবোও না। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল। হারি বলল, এসব ফ্রান্সিসের মুখের কথা নয়। এসব ওর গভীর বিশ্বাসের কথা। ফ্রান্সিসের সঙ্গে মিশলেই আপনি ওকে ঠিক বুঝতে পারবেন। দোনিয়া একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল—দেখুন যোদ্ধামূর্তির ব্যাপারটা বুঝতে হলে আপনাকে এই সার্দিনিয়ার অতীত ইতিহাস একটু জানতে হবে।
—আমার অনুরোধ, আপনি সব বলুন। আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। ফ্রান্সিস বলল।
—একটা মজার কথা বলি। অতীতে গ্রীক ব্যবসায়ীরা এই সার্দিনিয়া দ্বীপের নাম দিয়েছিল ইচনিসা অর্থাৎ মানুষের পায়ের ছাপ। এই দ্বীপটি দেখতে ওরকমই। প্রায় দু’শো বছর আগের ঘটনা—দোনিয়া আস্তে আস্তে বলতে লাগল –তখন সার্দিনিয়ার রাজা প্রথম ফ্রেডারিক। স্পেনের দোনিয়া অঞ্চলের আরবীয় সুলতান মুজাহিদ সার্দিনিয়া আক্রমণ করেছিল। কয়েকটি যুদ্ধজাহাজে সৈন্যবাহিনী নিয়ে মুজাহিদ প্রথমে এই সাসারি বন্দর আক্রমণ করে সহজেই এই উত্তর সার্দিনিয়া দখল করে নিয়েছিল। রাজধানী কাগলিয়ারি দক্ষিণ সার্দিনিয়ায়। সেখানে যতদিনে খবর পৌঁছল, ততদিনে মুজাহিদ এই উত্তর সার্দিনিয়া সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছিল। রাজা প্রথম ফ্রেডরিক কাগলিয়ারি থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এখানে এসেছিলেন স্থলপথে। তাতে বেশ সময় লেগেছিল। যাইহোক—মুজাহিদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে ফ্রেডারিকের সৈন্যবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল এই সাসারিতে। যুদ্ধে ফ্রেডারিক হেরে গিয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে একটা ছোট জাহাজে চড়ে অনেক কষ্ট পালাতে পেরেছিলেন। তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন মূল ভূখণ্ডের জেনোয়ায়। বছরখানেক পরে জেনোয়া আর পিসার শাসকদের সহায়তায় অনেক যুদ্ধ জাহাজ ও সৈন্য নিয়ে তিনি সাসারি আক্রমণ করেছিলেন। এই যুদ্ধে মুজাহিদের সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়েছিল। সেই রাতে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গিয়েছিল সাসারির এই অঞ্চল দিয়ে। সেই সুযোগে মুজাহিদ একটা ছোট্ট জাহাজে চড়ে স্পেনে পালাতে পেরেছিল। এই হলো ইতিহাসের ঘটনা দোনিয়া থামল।
—আমার মনে হয় এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা আছে। হ্যারি বলল। মাথা একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে দোনিয়া বলল—ঠিক। এবার শুনুন সেটা। মুজাহিদ যখন সাসারি দখল করে তখন এখানে এইনুরাঘিটা তো ছিলই আর একটানুরাঘি ছিল খাঁড়ির বাঁদিকের তীরে। কি কারণে জানা যায় না সেই নুরাঘিটার অর্ধেকটা ভেঙে পড়েছিল। এখন তো প্রায় ধ্বংসস্তূপ। এইনুরাঘিটা তখনও ভেঙে পড়ে নি। মুজাহিদ তার লোকজন দিয়ে এই নুরাঘিটা খুবমজবুত করেছিল। এইনুরাঘির দোতলায় সে তার রাজসভা বসাত। একেবারে ওপরের ঘরটা ছিল ফ্রেডারিক প্রতিষ্ঠিত গির্জা। এখনও সেই গির্জা আছে। গির্জায় যীশুর মূর্তি এখনও আছে। বেদীর কাছেই এলো সাতটি ঝুলন্ত সৈন্যমূর্তি। সেই সৈন্যমূর্তিগুলোয় দু’টো রূপার হাতলমতো দিয়ে, ঘা দিয়ে দিয়ে একজন বাদ্যকর সুন্দর সুরধ্বনি তুলতেন। গির্জার ঘণ্টার কাজ করত সেই সুরধ্বনি। প্রতিদিন ভোরবেলা যেই বাদ্যকর এই বাজনা বাজাতেন। সেই সুরধ্বনি ছিল স্বর্গীয়। নিশ্চয়ই এক গভীর সান্ত্বনার পরিবেশ সৃষ্টি হতো এখানে। আমাদের দুর্ভাগ্য আজকের আমরা কেউ সেই সুরধ্বনি শুনিনি। দোনিয়া থামল।
-কেন বলুন তো? ফ্রান্সিস বলল।
—কারণ মুজাহিদ সেই সাতটি সৈন্যমূর্তি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল যখন সে একটা ছোট জাহাজে চড়ে পালাচ্ছিল। দোনিয়া বলল।
—মূর্তিগুলো কি মূল্যবান ছিল?হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
—হ্যাঁ, সবকটাই ছিল সোনার। প্রায় একফুট করে উচ্চতা ছিল মূর্তিগুলোর। শুধু পঞ্চম সৈন্যমূর্তিটি ছিল উচ্চতায় চারফুট আর শুধু ওটাই ছিল নিখাদ সোনার। কাজেই সবচেয়ে মূল্যবান। দোনিয়া বলল।
—তাহলে মুজাহিদ সেসব মূর্তি নিজের দেশেই নিয়ে গেছে। হ্যারি বলল।
—এতদিন আমরাও তাই শুনে এসেছি। কিন্তু বছরখানেক আগে পিসার এক অভিজাত পরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় পড়াশুনো করবার সময় আমি একটা আরবী ভাষায় লেখা জোতিষবিদ্যার চামড়ায় তৈরি গ্রন্থে হঠাৎই একটা ছেঁড়া পাতা পাই। একটা চিঠি। আলগা চামড়ায় লেখা। গ্রন্থটায় গুঁজে রাখা।
—কার চিঠি? ফ্রান্সিস সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল।
—চিঠিটা আমার পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে। বলছি শুনুন। দোনিয়া আস্তে আস্তে বলতে লাগল—
ভাই আবু—
সার্দিনিয়া অঞ্চলের সকলেই জানে সে সুলতান মুজাহিদ গির্জা হইতে সাতটি সোনার সৈন্যমূর্তি চুরি করিয়া স্পেনে লইয়া গিয়েছেন। কিন্তু ইহা সত্য নহে।
যুদ্ধে পরাজিত হইয়া মুজাহিদ সাসারি হইতে পালাইবার উপায় খুঁজিতেছিলেন। সুলতানের কয়েকজন দেহরক্ষী সৈন্য একটি হালভাঙা জাহাজ জোগাড় করিয়া ছিল। সেই জাহাজের পিছনে একটি নৌকা বাঁধা ছিল।
তখন গভীর রাত্রি। আমরা সকলেই সাসারির নুরাঘিতে সুলতানের সঙ্গে জাগিয়া ছিলাম। সকলেরই চিন্তা কি করিয়া সাসারির খাঁড়ি পার হইয়া সমুদ্রে গিয়া পড়িব।
ভাগ্য ভালো। হঠাই সমুদ্রের উপর প্রচণ্ড ঝড় ছুটিয়া আসিয়া সাসারির বন্দর এলাকায় ঝাপাইয়া পড়িল। সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। সুলতান মুজাহিদ আনন্দে চিৎকার করিয়া উঠিলেন এই সুযোগ। জাহাজ ছাড়ো। সুলতান নুরাঘি হইতে বাহির হইলেন। আমরা সুলতানের পিছনে আসিতেছিলাম। হঠাৎ সুলতান আমাদের কয়েকজনকে বলিলেন গির্জা হইতে সমস্ত সোনার সৈন্যমূর্তিগুলি লইয়া পিছনের নৌকায় রাখো। আমরা ছুটিয়া গিয়া গির্জায় উঠিলাম। সবগুলি সৈন্যমূর্তি খুলিয়া লইয়া ছুটিতে লাগিলাম জাহাজঘাটার দিকে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কোনোরকমে মূর্তিগুলি নৌকায় রাখিলাম। সুলতান এই সংবাদ পাইয়া জাহাজ চালাইতে হুকুম দিলেন।
অন্ধকারে প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে জাহাজ চলিল। দুই-পার্শ্বের পাহাড়ি এলাকা হইতে তখনও রাজা ফ্রেডারিকের সৈন্যরা স্লিং-এ চড়াইয়া বড় বড় পাথরের টুকরো আমাদের জাহাজ নৌকা লক্ষ্য করিয়া মাঝেমাঝেই খুঁড়িতে ছিল। একটা বড় পাথরের চাই আমাদের নৌকার মুখে আসিয়া পড়িল। জাহাজের সঙ্গে বাঁধা দড়ি ছিঁড়িয়া গেল। সেই সঙ্গে ঝড়ের প্রবল ধাক্কায় আমাদের নৌকা কত হইয়া ডুবিতে লাগিল। নৌকায় আমার একমাত্র সঙ্গীটিকে বারবার ডাকিয়াও কোনো সাড়া পাইলাম না।
আমি আর কাল বিলম্ব না করিয়া অন্ধকারের ঝড়বিক্ষুদ্ধ খাঁড়ির জলে ঝাঁপাইয়া পড়িলাম। আজ আর আমি জানি না কীভাবে আমি তীরে আসিয়া পৌঁছাইয়াছিলাম।
যাহা হউক, আমি সাসারিতে কিছুদিন আত্মগোপন করিয়া ছিলাম। এক্ষণে আমি পিসায় আসিয়া নিম্নলিখিত সরাইখানায় আছি। তুমি আমাদের দুইজনের পরিচিত কয়েকজনকে লইয়া আমার পত্র পাওয়ামাত্র পিসায় আসো। সাসারির ঐ খাঁড়ি অঞ্চলে নৌকায় চড়িয়া সন্ধান করিতে পারিলে আমরা সাত সৈন্যমূর্তি জলের তলা হইতে উদ্ধার করিতে পারিব। মূর্তি গলাইয়া সোনা বিক্রয় করিয়া আমরা অচিরেই ধনী হইতে পারিব। তোমরা আসিলে নিখোঁজ সাতমূর্তির সন্ধান আরম্ভ করিব।
ইতি—মুবারক।
দোনিয়া এত বড় চিঠি নির্ভুল মুখস্থ বলে গেল,এই শুনে ফ্রান্সিস হ্যারি দু’জনেই বেশ আর্ম হলো। হ্যারি বলল—
—দোনিয়া,-আপনি শুধু বিদ্বান নন, জ্ঞানীও।
দোনিয়া মৃদু হাসল।
-–তারপর আপনি কি করলেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
—আমিও আগ্রহী হলাম। স্থির করলাম, আমি চেষ্টা করবো ঐ সাত স্বর্ণমূর্তি উদ্ধারের জন্যে। মাসকয়েক আগে আমি সাসারিতে এলাম। গেলাম রাজধানী কাগলিয়ারিতে। রাজা এনজিওর সঙ্গে দেখা করলাম। মুবারকের চিঠির কথা বললামনা। শুধু বললাম—কোনো এক সূত্র থেকে আমি জানতে পেরেছি যে মুজাহিদ সাত স্বর্ণমূর্তি নিজের দেশেনিয়ে যেতে পারে নি। সাসারির খাঁড়িঅঞ্চল যে নৌকোয় রেখে স্বর্ণমূর্তিগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেটা ঐ খাঁড়ি কোথাও ডুবে গিয়েছিল। আমার স্থির বিশ্বাস—ঐ সাত মূর্তি আছে ঐ খাঁড়ি অঞ্চলেই জলের নীচে কোথাও। আপনি অনুমতি দিলে আমি সন্ধানকার্য চালাতে পারি। শুনে রাজা এনজিও তো খুশিতে আটখানা। একটুক্ষণ থামলো দোনিয়া। ফ্রান্সিস আস্তে বলল—বুঝলাম পরে রাজা সম্মতি দেন নি। দোনিয়া ম্লান হেসে বলল-আপনি বেশ বুদ্ধিমান। ঠিকই অনুমান করেছেন। একটু থেমে দোনিয়া বলতে লাগল—আসলে ছোটবেলা থেকেই সংসারের সঙ্গে আমার বিশেষ কোনো সম্পর্কই ছিল না। গানবাজনা, পড়াশুনা এসব নিয়েই থাকতাম। তাই স্বার্থান্ধ মানুষ কতটা নীচহীনমনা হতে পারে এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা গড়ে ওঠে নি। যাক গে-রাজা এনজিওর বয়স কম। রাজাকে চালায়, স্পিনোলা নামে অভিজাত পরিবারের এক প্রৌঢ়। পরের বার দেখা করলাম রাজা এনজিওর সঙ্গে। আবার অনুমতি চাইলাম। রাজা এনজিও বলল—কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে ঐ খাঁড়িতেই সাত সৈন্যমূর্তি নিয়ে নৌকোটা ডুবে গিয়েছিল?
বুঝলাম স্পিনোলা রাজাকে অন্যরকম বুঝিয়েছে। বললাম—আমি সন্ধানকার্য চালাবো। যদি মূর্তিগুলো না পাই তাহলে তো আমারই পণ্ডশ্রম। কতদিন ধরে এই সন্ধানকার্য চালাতে হবে কে জানে! আমি যদি নিশ্চিতই না হবে তাহলে বোকার মতো এত কষ্ট স্বীকার করবো কেন?
এবার স্পিনোলা একটু হেসে বললেন—আচ্ছা দোনিয়া-এত কষ্ট করে আপনি সোনার মূর্তিগুলো উদ্ধার করতে চান কেন?
—আমাদের দেশের সম্পদ, তাই আমি বললাম। স্পিনোলা বললেন—
বুঝলাম। ধরুন ঐ মূর্তিগুলো উদ্ধার করলেন। ঐ সোনার মূর্তিগুলো বিশেষ করে সবচেয়ে বড় নিরেট সোনার মূর্তিটি—অনেক মূল্য ঐ মূর্তিগুলোর। আপনি সেসব উদ্ধার করে কি করবেন? বিক্রি করে আরো বড়লোক হবেন?
আমি বললাম,-না আমি সেসব রাজা এনজিওকে দেব। বদলে সমমূল্যের অর্থ তিনি আমাকে দেবেন। এবার রাজা এনজিও বলল, সেই অর্থ নিয়ে আপনি কি করবেন? এবার আমি আসল কথাটা বললাম-ঐ অর্থ দিয়ে আমি এখানকার দরিদ্র জেলেদের বেশ শক্তপোক্ত নৌকো তৈরি করিয়ে দেবো, মাছধরার উন্নতমানের সাজসরঞ্জাম দেবো, যাতে তারা গভীর সমুদ্রে গিয়ে নিশ্চিন্তে বেশি মাছ ধরতে পারে। উত্তর সার্দিনিয়ায় আমি ঘুরে বেড়াবোও চাষযোগ্য জমি উদ্ধার করবো। চাষীদের চাষবাসের ভালো সরঞ্জাম কিনে দেবো, যাতে তারা বেশি ফসল ফলাতে পারে। জেলে ও চাষীদের বসতি এলাকার বাড়িঘর নতুন করে তৈরি করিয়ে দেবো। চিকিৎসা আর শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে দেবো যাতে দরিদ্র জেলে আর চাষীরা সুখে, স্বচ্ছন্দে তাদের জীবন কাটাতে পারে।
আমার স্বপ্নের কথা, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা রাজা এনজিও কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনল। স্পিনোলা হেসে উঠলেন—এসব আপনার মুখের কথা। মূর্তিগুলো পেলে আপনি, সেসব নিয়ে সাসারি থেকে পালিয়ে জেনোয়া কি পিসায় চলে যাবেন। সেসব গালিয়ে বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে রাজার হালে বাকি জীবন কাটাবেন।
স্পিনোলার কথা শুনে দুঃখে চোখে জল এসে গেল। মানুষ এত নীচ হয়?
—রাজা এনজিও কি বললেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
সেদিন কিছু বলল না। কয়েক দিন পরে আসতে বলল। গেলাম কয়েকদিন পরে। রাজা এনজিও পরিষ্কার বলল—আমরা ভেবেচিন্তে দেখলাম। শুধু আপনার মুখের কথার ওপর বিশ্বাস করে আমি অনুমতি দিতে পারবো না। আমি বললাম—অত মূল্যবান মূর্তিগুলো জলের নীচে পড়ে থাকবে? আমি বেশ দুঃখের সঙ্গেই বললাম। স্পিনোলা বলে উঠলেন—আপনার অনুমান তো সত্যি নাও হতে পারে। মুজাহিদ হয়তো সেই মূর্তিগুলো নিয়ে নিজের দেশ স্পেনে পালিয়ে যেতে পেরেছিল।
দোনিয়া থামল। হ্যারি বলল—তারপর?
দোনিয়া বলল—আমি নানাভাবে রাজা এনজিওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রাজা এনজিও আমাকে কিছুতেই অনুমতি দিল না। বুঝলাম গোপনেই আমাকে এই সন্ধান চালাতে হবে। তাই কয়েকজন পরিচিত জেলেকে নিয়ে রাতের পর রাত জেগে নৌকোয় চড়ে সন্ধান চালাতে লাগলাম।
—তারপর? হ্যারি বলল।
দোনিয়া বলল—জানি না কি করে আমার এই গভীর রাতে সন্ধানের কথা স্পিনোলার কানে গেল। স্পিনোলা সঙ্গে সঙ্গে রাজা এনজিওকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করলেন। তারপর রাজা এনজিওর ব্যক্তিগত জাহাজটায় রাজাকে নিয়ে এখানে এলেন। এখানকার রাজপ্রাসাদে এসে উঠলেন। নৌবাহিনীর চারজন বাছাই করা সৈন্যকে হুকুম দিলেন যে করেই হোক আমাকে বন্দী করতে হবে। ঐ সৈন্যদের হাত থেকে বারকয়েক পালাতে পেরেছিলাম। গত রাতে আর পারলাম না। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। তাই ধরা পড়তে হলো।
দোনিয়া থামল। ফ্রান্সিস স্যার দু’জনেই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হারি বলল—আমরা দুঃখিতআমাদেরজন্যই আপনারা ধরা পড়লেন দোনিয়া কোনো কথা বলল না। ফ্রান্সিস সমস্ত ঘটনাটা ভাবল। তারপর বলল—দোনিয়া, আপনার অন্তঃকরণ মহৎ এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আপনার মতো মানুষ আমি কমই দেখেছি-একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল-তবে আপনি কিছু ভুল করেছেন। একেবারে সাদা মনের মানুষ বলে রাজা এনজিওকে আপনি সবকথাই বলেছেন। স্পিনোলার মত মানুষ সেই সুযোগটাই নিয়েছেল। তবে মুবারকের চিঠির ব্যাপারটা গোপন করে খুব বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। স্পিনোলা চিঠির কথা জানতে পারলেই আপনার কাছে মূল চিঠিটা চাইতেন, আপনিও দিতেন। তখন স্পিনোলা নিজেই ঐ মূর্তি উদ্ধরের কাজে লাগনে। আপনার সব স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত।
দোনিয়া মাথা ওঠানামা করল। বলল—আপনি ঠিকই বলেছেন।
এবার ফ্রান্সিস হেসে বলল—যদি কিছু না মনে করেন তাহলে বলি।
—বলুন। দোনিয়া বলল।
—স্বর্ণমুর্তির মূল্যের সমান অর্থ দিতে আপনি রাজা এনজিওকে বলেছিলেন।
কোনো কথা না বলে দোনিয়া মাথা ওঠানামা করল।
—এক্ষেত্রে সমমুল্য চাওয়াটা কিন্তু ভুল হয়েছে। আপনার মতো উদার মন তো সকলের নয়। স্পিনোলা এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন। রাজাকে বুঝিয়েছেন আপনার সমান মূল্যের অর্থ চাওয়া মানেই আপনি অর্থলোভী। হয়তো দরিদ্র জেলে চাষীদের জন্য কিছু খরচ করবেন, বাকি অর্থ আপনি নিজে আত্মসাৎ করবেন।
দোনিয়া একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল—হ্যাঁ—স্পিনোলা যেরকম মানুষ তাতে রাজাকে এরকম ভুল বোঝাতে পারেন।
—সবচেয়ে ভালো হতো যদি আপনি মোট মূল্যের চারভাগের একভাগ চাইতেন। তাহলে স্পিনোলা রাজাকে আপনার বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারতো না। স্পিনোলা তো বটেই রাজা এনজিও নিজেও অর্থমৃধু। তিনভাগ অর্থ দিতে হবে না ভেবেই তারা খুশি হতেন। আপনাকে অনুমতি দিতেন—ফ্রান্সিস বলল।
দোনিয়া একটুক্ষণ ভেবে বলল—তা ঠিক কিন্তু চারভাগের একভাগ তো খুব কম।
—সেটা মূর্তিগুলো উদ্ধারের পর সোনা দেখে সঠিক মূল্য পেয়ে হিসেব করে বোঝা যেত। এখনো তো মূর্তিগুলো উদ্ধারই করা যায় নি। আগে নিখোঁজ মূর্তিগুলো তো উদ্ধার করুন-ফ্রান্সিস বলল।
-দেখি আপনার কথাটা ভেবে-দোনিয়া বলল।
হ্যারি বলল—দেখুন দোনিয়া, এত বড় খাঁড়িটায় শুধু ঐ দড়িবাঁধা বঁড়শিগুলো দিয়ে খুঁজে খুঁজে কি মূর্তিগুলো উদ্ধার করতে পারবেন?
—জানি না পিরবো কি না। তবে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবো-দোনিয়া বলল।
ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি ঠিকই বলেছে, অতবড় খাঁড়ির জলে কোথায় ডুবো নৌকাটা। একটা বড়শি ফেলে ফেলে খুঁজে বের করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। এভাবে কতদিন আর খোঁজ চালিয়ে যেতে পারবেন। তাছাড়া আপনাকে খোঁজ চালাতে হবে রাতে। রাতের পর রাত কতদিন জেগে পারবেন?
—কিন্তু আমাকে যে গোপনেই খোঁজ চালাতে হবে-দোনিয়া বলল।
-–ঠিক আছে। রাজা এনজিওর কাছে তো আমাদের নিয়ে যাওয়া হবেই। তখন আমি চেষ্টা করবো রাজার অনুমতি আদায় করতে। শুধু আপনি আমার অভিমতের বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না, আমাকে সমর্থন করবেন। ফ্রান্সিস বলল।
—বেশ। কিন্তু আপনি কি পারবেন অনুমতি আদায় করতে? দোনিয়া বলল।
—দেখি চেষ্টা করে-ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি বলল—দেখো ফ্রান্সিস, আমার কেমন মনে হচ্ছে নৌকোটা সোনার মূর্তিগুলো নিয়ে খাড়ির কোথায় ডুবে গিয়েছিল, তার কোনো না কোনো সূত্র মুবারক নিশ্চয়ই কোথাও যেভাবে তোক রেখে গেছে।
-আমারও তাই বিশ্বাস। তবে সব না দেখে-শুনে এখনই ঠিক বলতে পারছি না মুবারক কোথায় কিভাবে জায়গাটার হদিশ রেখে গেছে-ফ্রান্সিস বলল।
-আচ্ছা এও তো হতে পারে যে মুবারক তার বন্ধুদের সাহায্যে পরে জলের তলা থেকে মূর্তিগুলো সব তুলে নিয়ে গেছে-হ্যারি বলল।
—আমরা তা মনে হয় না। কারণ সেই চিঠিটা মুবারক লিখেছিল তার স্বদেশের বন্ধুদের কাছে—স্পেনের দোনিয়ায়। কিন্তু চিঠিটা আমি পেয়েছি পিসায়। চিঠিটা যদি স্পেনে চলেই যেত তাহলে পিসায় চিঠিটা আমি পেতাম না-দোনিয়া বলল।
ফ্রান্সিসরা কথাবার্তা বলছে তখনই একজন সৈন্য এসে বলে গেল ওরা যেন স্নানখাওয়া সরে নেয়।
একটু বেলায় ফ্রান্সিসদের খেতে দেওয়া হল। চিনে মাটির বড় থালায় বড় বড় দুটো গোল রুটি। বাটিতে ভেড়ার মাংসের ঝোল। ঐ ঘরেই ঘাসের বিছানায় বসে ওরা খেতে লাগল। খেতে খেতে হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস এবার কী করবে?
—সেটা নির্ভর করছে রাজা এনজিও কি বলে তার ওপর-ফ্রান্সিস বলল।
—যদি মূর্তি উদ্ধার করতে দিতে সম্মতি দেয়? হ্যারি বলল।
—তাহলে থেকেই লেগে পড়বো-ফ্রান্সিস বলল।
—কিন্তু মারিয়া আর বন্ধুরা কি আর এই সার্দিনিয়ায় অপেক্ষা করতে চাইবে?
—দেখা যাক-ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি আর কিছু বলল না। ওদের খাওয়া শেষ হল। তখনই একজন বেশ মোটা দাড়িগোঁফওলা একজন সশস্ত্র লোক ঘরে ঢুকল। তার পেছনে কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য। দোনিয়া গলা নামিয়ে আস্তে বলল—ইনিই সেনাপতি।
সেনাপতি বেশ গম্ভীর ভঙ্গীতে বলল—দোনিয়া—আপনারা আর ঐ বিদেশীরা চলুন। রাজা এনজিও আপনাদের প্রাসাদে নিয়ে যেতে বলেছেন।
—আমদের কি বন্দী করা হবে? দোনিয়া বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল।
—এখনো তো আপনাদের হাত-পা বাঁধা হয়নি। রাজা এনজিও পরে যা হুকুম দেবেন তাই হবে-সেনাপতি বলল।
নুরাঘি থেকে বেরিয়ে ফ্রান্সিসরা পাথর বাঁধানো পথ দিয়ে চলল। সামনে পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে কয়েকজন সৈন্য। সবার সামনে সেনাপতি। সেনাপতির শিরস্ত্রাণ আর বুক বাঁধা বর্ম পেতলের। সৈন্যদের মতো লোহার নয়।
পথের দুপাশে পাথরের বাড়িঘর। এখানে লোকের বসতি আছে। বাড়ির জানালা, দরজা দোকান থেকে লোকজন ফ্রান্সিসদের চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। ওরা দোনিয়াকে চেনে ওটা ওদের মুখে দেখেই বোঝা গেল। ফ্রান্সিসদের চেহারা পোশাক দেখে ওরা একটু আশ্চর্য হলো। এই বিদেশীদের রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন এটা ওরা বুঝে উঠতে পারল না।
পাথুরে পথ ধরে কিছুটা যেতেই একটা ঘাসে ঢাকা উপত্যকামতো। সেখানেই ছাই ছাই রঙের পাথরে তৈরি একটা লম্বাটে বাড়ি দেখা গেল। বেশ বড় বাড়ি। বোঝা গেল এটাই এখানকার রাজপ্রাসাদ। রাজা এনজিও এখন এখানেই আছেন।
প্রাসাদের বেশ বড় সদর দরজাটা খোলা। দরজাটা ওক কাঠের। কাঠের দরজায় কুঁদে কুঁদে পাতা ফুল লতার পাখির নকশা তোলা। দরজার দু’ধারে খোলা তলোয়ার হাতে প্রহরীরা। সকলেই মাথা একটু নুইয়ে সেনাপতিকে সম্মান জানাল।
সদর দরজাটা পার হতে একটা পাথর বাঁধানো চত্বর। তারপর একটা পাথরের তৈরি ঘর। ঘরে ঢোকার দরজার পাশে দ্বাররক্ষী দু’জন। ওদের হাতে চকচকে পেতলের বর্শা। এ দ্বাররক্ষী দু’জনও সেনাপতিকে মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানাল।
চত্বর পার হচ্ছে যখন তখনই ফ্রান্সিস দোনিয়াকে জিজ্ঞেস করল-–রাজা এনজিও কি এখানেই বরাবর থাকেন?
—না। রাজধানী কাগলিয়ারিতে বিরাট প্রাসাদে থাকে। নিখোঁজ মূর্তি সন্ধানের খবর পেয়ে তিনেক হলো এখানে এসেছে। উদ্দেশ্য আমাকে বন্দী করা। সৈন্যদের হাত থেকে বার কয়েক পালিয়েছি। কাল রাতেই ধরা পড়ে গেলাম। দোনিয়া বলল।
ওরা ঘরটায় ঢুকল। প্রশস্ত ঘর। মেঝের পাথরে মোজেকের কাজ করা। লোহার গরাদ বসানো পাথরের জানালা দিয়ে রোদ পড়েছে ঘরটার একপাশে। ঘরটার শেষের দিকে এক মানুষ সমান উঁচু পিঠঅলা চেস্টনাট কাঠের সিংহাসন। তার গায়ে কুঁদে কুঁদে নানা কাজ করা। সিংহাসনের লাল ভেলভেট-ঢাকা আসেন। রাজা এনজিও বসে আছে। ফ্রান্সিস দেখল। রাজাকে। বয়েস বেশি নয়-ওদেরই বয়েসী। দুধে আলতায় গায়ের রঙ। মুখে দাড়িগোঁফ কামানো। মাথায় তিনকোণা ওঠা সোনার মুকুট। গায়ে দামী কাপড়ের সোনারূপোর সুতোর কাজ করা। গলায় মুক্তোর মালা। সিংহাসনের বাঁপাশে পাথরের। আসনগুলো নীল ভেলভেট কাপড়ে ঢাকা। আসনে একজন প্রৌঢ় বসে আছেন। গায়ে হলুদরঙের জোব্বামতো। মাথার চুল দাড়িগোঁফ সব সাদা। ফ্রান্সিস বুঝল ইনিই স্পিনোলা। রাজা এনজিওর পরামর্শদাতা। সম্মানিত অমাত্য।
ফ্রান্সিসদের সিংহাসনের সামনে নিয়ে আসা হলো। সেনাপতি মাথা অনেকটা নুইয়ে রাজাকে সম্মান জানিয়ে লো লাতিন ভাষায় একনাগাড়ে কি বলে গেল। হ্যারি ফ্রান্সিসকে মৃদুস্বরে বলল—সেনাপতি কীভাবে আমাদের ধরা হয়েছে, তার কথা বলল। আমাদের কথাও জানাল। আমরা বিদেশি এটাও বুঝেছে কিন্তু কোন দেশী তা জানে না। রাজা এনজিও আর স্পিনোলা দু’জনইমন দিয়ে সেনাপতির কথা শুনলেন।
রাজা দোনিয়ার দিকে তাকাল। বলল-দোনিয়া, আপনি আমার সম্মতি না নিয়ে যা করে চলেছিলেন তাতে অন্য কেই হলে তাকে কয়েদঘরে পাঠাতাম। নেহাৎ আপনি সার্দিনিয়ার এক অভিজাত বংশের সন্তান। ঐ শাস্তি আপনাকে দেব না। তবে শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে।
এবার স্পিনোলা গলা খাঁকারি দিল। হেসে বলল-মাননীয় রাজামহাশয়, অভিজাত পরিবারের হলেও পরিবার পরিজনদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। চাষাভুষা জেলেদের সঙ্গেই তাঁর যত সম্পর্ক। যাক—গেমনে হয় একটা শাস্তি দিলেই দোনিয়াকে শায়েস্তা করা যাবে।
—ঠিক আছে। বলুন সেটা কী? রাজা বলল।
—দোনিয়া কোনোদিন এই সাসারিতে প্রবেশ করতে পারবে না। সাসারিতে তাকে দেখলেই বন্দী করা হবে। এবং তৎক্ষণাৎ বিনা বিচারে এখানকার কযেদঘরে বন্দি করে রাখা হবে। হ্যারি ফ্রান্সিসকে সব কথাবার্তা বুঝিয়ে বলছিল। স্পিনোলা যে কত বড় ধূর্ত আর কুচক্রী, স্পিনোলার বক্তব্য শুনেই ফ্রান্সিস বুঝল। দোনিয়াকে যদি সাসারিতে ঢুকতে না দেওয়া হয় তাহলে দোনিয়ার সব চেষ্টাই বানচাল হয়ে যাবে। কারণ এই সাসারির খাড়িতেই তো জলের তলায় রয়েছে সাত সৈন্যমূর্তি। ফ্রান্সিস এও বুঝল যে এক্ষুণি এই শাস্তিদান বন্ধ করতে হলে ওকে এগিয়ে আসতে হবে। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—রাজাকে বলো যে আমরা স্পেনীয় ভাষায় কিছু বলতে চাই। উনি এবং স্পিনোলা যেন স্পেনীয় ভাষায় যা বলার বলেন।
হ্যারি ডান হাতটা তুলে রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। রাজা বলল—হ্যাঁ। শুনলাম তোমরা বিদেশি। তোমরা কোন দেশের লোক এবং এখানে এসেছো কেন?
—আমরা জাতিতে ভাইকিং-হ্যারি বলল।
রাজা স্পিনোলাকে বলল—স্পিনোলা, ভাইকিংদের কথা আপনি জানেন?
—হ্যাঁ, মহামান্য রাজা। এরা খুব দুঃসাহসী। জাহাজ চালনায় কোনো জাতিই এদের সমকক্ষ নয়। তবে এদের দুর্নামও আছে জাহাজ লুণ্ঠনকারী বলে-স্পিনোলা বলল।
হ্যারি বলল মহামান্য রাজা—শৌর্যেবীর্যে আমাদের সঙ্গে যারা পেরে ওঠেনি তারাই আমাদের দুর্নাম দেয় একটু থেমে হ্যারি বলল—আমরা বীরের জাতি। বীরত্বকে মানবিকতাকে বিশ্ববাসীর ভ্রাতৃত্ববোধকে শ্রদ্ধা করি—হ্যারি ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল—এর নাম ফ্রান্সিস, আমার বাল্যবন্ধু। ফ্রান্সিস অনেক রহস্যের সমাধান করেছে। শুধু সাহসে ভর করে অনেক মহামূল্যবান গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করেছে। ফ্রান্সিস আপনাকে কিছু বলতে চায় স্পেনীয় ভাষায়। আপনিও ঔ ভাষায় আপনার বক্তব্য বলুন।
—বেশ, রাজা তারপর ফ্রান্সিসকে বলল—তোমরা এখানে এসেছ কেন? ফ্রান্সিস বলল—মহামান্য রাজা—আমরা দূর দূরে দেশে ঘুরে বেড়াই। কোনো গুপ্ত ধনভাণ্ডার বা নিখোঁজ মূল্যবান কিছুর সংবাদ পেলে আমরা তা উদ্ধার করি—ফ্রান্সিস বলল।
স্পিনোলা হেসে বলল—তারপর সেসব লুকিয়ে চুরিয়ে দেশে পাচার করো।
—খুবই দুঃখ পেলাম মাননীয় স্পিনোলা। সৎ, নির্লোভ মানুষও যে পৃথিবীতে আছে, এটা বোধহয় আপনি বিশ্বাস করেন না, ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।
স্পিনোলা হো হো করে হেসে উঠলেন। শূন্যে ডানাহাতটা ঘুরিয়ে ফ্রান্সিসের কথাটা উড়িয়ে দিলেন। ফ্রান্সিস বলল—যাকগে, আমার একটা নিবেদন আছে।
-বলো—রাজা বলল।
—মহামান্য রাজা—ফ্রান্সিস বলতে লাগল—দোনিয়ার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে সাত সোনার যোদ্ধামূর্তির কথা শুনেছি। পরে আরো কিছু জানতে হবে। দোনিয়া দীর্ঘ ছ’মাস আপ্রাণ চেষ্টা করেও সেই মূর্তিগুলো জলের তলা থেকে উদ্ধার করতে পারেন নি। আমার মনে হয়—প্রায় দুশো বছর আগে ডুবে যাওয়া ঔ মূর্তিগুলি শুধুমাত্র কয়েকটা স, বঁড়শি ডুবিয়ে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অন্য কোনো সূত্র চাই।
—কোন্ সূত্র? স্পিনোলা বললেন।
—সেটা আমি এখুনি বলতে পারছি না। তার জন্যে আমার সময় প্রয়োজন।
রাজা বলল—তুমি কি সেই চেষ্টা করতে চাও নাকি?
—তাহলে তো ভালোই হয়-স্পিনোলা বললেন।
—মহামান্য রাজা আপনি অনুমতি না দিলে তা হবে না, ফ্রান্সিস বলল।
—ধরো আমি অনুমতি দিলাম-রাজা বলল।
—তাহলে আমি আমার স্ত্রী ও কয়েকজন বীর বন্ধুকে নিয়ে সেই মূর্তিগুলোর সন্ধান চালাবো।
—মূর্তিগুলোর মোট মূল্য কত জানো? স্পিনোলা বলল।
—আমি সেসব জানা নিষ্প্রয়োজন মনে করি। কারণ মূর্তিগুলো উদ্ধার করতে পারলে আমি সব মহামান্য রাজাকেই দেব। কারণ সেসব এই দেশের রাজার সম্পত্তি।
—তোমরা তো পারিশ্রমিক চাইবে-স্পিনোলা বললেন।
—একটি স্বর্ণমুদ্রাও চাইবো না—ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে বলল।
স্পিনোলা বেশ অবাক হয়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কত কষ্ট করে এত মূল্যবান মূর্তিগুলি উদ্ধার করবে অথচ একটা স্বর্ণমুদ্রাও নেবে না, এরকম বোকা লোক আছে না কি? ফ্রান্সিস বলল—তবে দোনিয়া তো আমাদের সঙ্গে থাকবেন। তিনি আপনাদেরই দেশবাসী। তিনি নিশ্চই কিছু পারিশ্রমিক চাইতে পারেন।
—দোনিয়া সোনার মূর্তিগুলির সমমূল্যের অর্থ চেয়েছিলেন। আমি দেবনা-রাজা বলল।
ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে। দোনিয়ার হয়ে আমি বলছি—আমরা তো কিছু নেব না শুধু দোনিয়াকে আপনার সমমূল্যের চারভাগের এক ভাগ অর্থ দেবেন, দোনিয়া তাতেই সম্মত হবেন।
স্পিনোলা নিজের আসন থেকে উঠে রাজার কাছে গেলেন। দু’জনের চাপা গলায় কি কথাবার্তা হলো। স্পিনোলা নিজের আসনে ফিরে এলেন। রাজা বলল—ঠিক আছে। আমিও এই প্রস্তাবে সম্মত
স্পিনোলা বললেন—দোনিয়া, আপনি পরে বেঁকে বসবেন না তো?
ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল—মান্যবর স্পিনোল, আমরা কিন্তু এখনও অন্ধকারে। মূর্তিগুলো জলের তলায় কোথায় আছে আমরা এখনো তার বিন্দুবিসর্গও জানি না। উদ্ধার করা তো অনেক পরের কথা।
রাজা ও স্পিনোলা ফ্রান্সিসের কথা শুনে বেশ বিব্রত হলো। স্পিনোলা একটু কেশে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। মহামান্য রাজা এই প্রস্তাবে তার সম্মতির কথা তো আগেই জানিয়েছেন। এখন কথা হলো আপনারা কীভাবে সন্ধান চালাবেন।
—সে সব আমরা ভেবে স্থির করবো—ফ্রান্সিস বলতে লাগলো—শুধু মহামান্য রাজাকে অনুরোধ, আপনি আমাদের একটা বেশ শক্তপোক্ত নৌকা দেবেন। আমার স্ত্রী আমাদের জাহাজেই থাকবেন। শুধু সন্ধান চালাবার সময়ে আমাদের সঙ্গে থাকবেন। দোনিয়া সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আমরা এই নুরাঘিতেই থাকবো। আর সারাদিন যতক্ষণ সম্ভব খোঁজখুঁজি করব। তবে রাতে নয়, দোনিয়া রাতের অন্ধকারে গোপনে—সন্ধানের কাজ চালিয়েছিলেন। সেইজন্যই ব্যর্থ হয়েছেন।
-–তুমি কি মনে করো তুমি পারবে? স্পিনোলা বললেন।
—আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তবে এখন না সব জেনে দেখে শুনে তবেই আমি বলতে পারবো, এটা সম্ভব কিনা—ফ্রান্সিস বলল।
—ঠিক আছে। দেখা যাক-স্পিনোলা মাথা ওঠানামা করে বলল।
ফ্রান্সিস এবার রাজাকে বলল—মহামান্য রাজা। আর একটি অনুরোধ—আপনি হুকুম জারি করে দিন আমাদের স্বাধীন চলাফেরায় কেউ যেন বাধা না দেয়।
—বেশ, হুকুম জারি করা হবে—রাজা বলল। তারপর একটু ভেবে বলল—আমি তো এখানে আর বেশিদিন থাকতে পারবো না। আমাকে রাজধানীতে ফিরে যেতে হবে। তাই বলছিলাম-মূর্তিগুলো খুঁজে উদ্ধার করতে কতদিন লাগবে?
—আমি দিন সাতেক সব দেখেশুনে মোটামুটি কতদিন লাগবে, তা আপনাকে বলতে পারবো–ফ্রান্সিস বলল।
—বেশ। তোমরা এবার যেতে পারো—রাজা বলল।
ফ্রান্সিসরা মাথা একটু নুইয়ে রাজাকে সম্মান জানিয়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে এলো। দেখল, রাজপ্রাসাদের সামনে মোটামুটি সমতল উপত্যকাটা ঘাসে ঢাকা। সেখানে উষ্ণীষ বর্ম পরে কোমরে তলোয়ার খুঁজে প্রায় পঁচিশ-তিরিশজন সৈন্য কুচকাওয়াজ করছে। ফ্রান্সিস বুঝল, গ্রীক সৈন্যদের শিক্ষাদীক্ষা-রণকৌশল এখনকার সব রাজারাই গ্রহণ করেছে। ও ভাবল দেশে ফিরে গিয়ে ওদের রাজাকে এইভাবেই সৈন্যদের যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত করে তুলতে বলবে।
সেনাপতি সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখছিল। ফ্রান্সিস দোনিয়াদের দেখে এগিয়ে এসে। বলল-দোনিয়া, আপনাদের জন্যে এই নুরাঘিতেই একটা ঘর নির্দিষ্ট করেছি। আপনারা ওখানেই থাকবেন।
নুরাঘির সদর দরজার কাছে এলো সবাই। ফ্রান্সিস বলল—দোনিয়া, আপনি আপনার সঙ্গীদের নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে বলুন। এখন থেকে আমরাই সঙ্গী। দোনিয়া তার সঙ্গ ীদের বলল ভাই, তোমরা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছ। এবার তোমরা ঘরে যাও। এই বিদেশি বন্ধুরা এখন থেকে আমাকে সাহায্য করবে। দেখি, মূর্তিগুলো উদ্ধার করতে পারি কিনা-বলে দোনিয়া ডান হাতটা বাড়াল। সঙ্গী দু’জন তার হাতটা ধরে একটু মাথা নামিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে গেল।
সবাই নুরাঘিতে ঢুকল। সেনাপতির নির্দেশে একজন সৈন্য ওদরে নিয়ে চলল। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে সবাই ওপরে উঠল। বাঁদিকে একটা ছোট ঘর। সৈন্যটি ঘরটা দেখিয়ে বলল—আপনারা এই ঘরে থাকবেন বলে সৈন্যটি চলে গেল।
ঘরে ঢুকল সবাই। মেঝেয় কয়েকটা কাঠের তক্তার ওপর দড়ি পেঁচিয়ে বাঁধা বিছানা মতো। ওপরে মোটা কাপড় পাতা। ফ্রান্সিস বাঁদিকের গরাদ-আঁটা প্রায় চৌকোনো ছোট জানালাটা দিয়ে তাকাল। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। খাঁড়ি, সমুদ্র খাঁড়ির মুখে রাজার জাহাজ।
ওদের জাহাজটা অবশ্য দেখা যাচ্ছেনা। সমুদ্রের জোর হাওয়া ঢুকছে ঘরটায়।
ফ্রান্সিস ফিরে দাঁড়াল। ততক্ষণে বিছানায় দোনিয়া আর হ্যারি বসে পড়েছে। ফ্রান্সিস ও এসে বসল। তারপর শুয়ে পড়ল। মাথার পেছনে দু’হাত রেখে পাথরের ছাদ দেখতে লাগল। ঘরটা ছোট কিন্তু তিনজনের পক্ষে খুব ছোট নয়। ফ্রান্সিস সমুদ্রের দিকে জানালাটার দিকে তাকাল। তখনই নজরে পড়ল—জানালাটার পাশে পাথুরে দেয়ালে বেশ অস্পষ্ট কি যেন লেখা। সব বিষয়েই ফ্রান্সিসের খুব কৌতূহল। ও তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। জানালার ধারে গেল। পাথুরে দেয়ালের অস্পষ্ট লেখাগুলো দেখতে দেখতে বলল—দোনিয়া, এখানে কি কিছু লেখা আছে?
দোনিয়া হেসে বলল—সংগীত, সুর, এসব সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকলে বুঝতেন ওগুলো স্বরলিপি।
—গানের? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
—না, সুরের। একটু চুপ করে থেকে দোনিয়া বলল—এখানকার রাজপ্রাসাদের মাটির নীচের ঘরে ভেড়ার চামড়ার প্রাচীন ল্যাতিন ভাষায় লেখা কিছু ভেঁড়াখোরা গ্রন্থ পেয়েছিলাম। সেসব খুব সম্ভব এই প্রাসাদযিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন সেই রাজা ফ্রেডারিক যত্ন করে সংরক্ষণ করেছিলেন। রাজা ফ্রেডারিক সংগীতবোদ্ধ ছিলেন। সুর-সঙ্গীত ভালোবাসতেন। নিজেও গ্রীক দেশীয় বীণা বাজাতে পারতেন। সেই ছিন্ন গ্রন্থগুলি থেকে সার্দিনিয়ার প্রাচীন ইতিহাসের অনেক তথ্য পেয়েছিলাম।
দোনিয়া থামল। ফ্রান্সিস বলল কিন্তু এই দেয়াল লেখা স্বরলিপিগুলি কার লেখা?
দানিয়া বলল—বলছি, রাজা ফ্রেডারিক এই সাসারিতে খুব প্রাচীন একটা ব্রোঞ্জের সৈন্যমূর্তি পেয়েছিলেন। অনেক ভেবে ঐ রকম সাতটি সুর বাজে এরকম সাতটি সৈন্যমূর্তি তৈরি করিয়েছিলেন পিসার এক কর্মকারকে দিয়ে। তাই ওটা ছিল বড়ো আর নিখাদ সোনার মূর্তি। পঞ্চম সুরধ্বনিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
—তাহলে ঐ সৈন্যমূর্তিগুলোই আমরা খুঁজে বের করবো? হ্যারি জানতে চাইল।
—হ্যাঁ। দোনিয়া বলল—সাতটি সুর বেজে ওঠে এরকম সেই মূর্তিগুলো ওপরের গির্জায় রাখলেন। সেগুলো বাজাবার জন্যে জেনোয়া থেকে এক বাদ্যকরকে এনেছিলেন। বাদ্যকর প্রথম প্রথম নাকি ভালো বাজাতে পারতেন না। আস্তে আস্তে সেই বাদ্যকর অপূর্ব সুরমূৰ্ছনা সৃষ্টি করতে শিখলেন—দোনিয়া থামল। তারপর বলল—দেয়ালে লেখা ঐ স্বরলিপি সেই বাদ্যকরের।
—বলেন কি? এ তো অনেকদিন আগের কথা—ফ্রান্সিস বলল।
—হ্যাঁ, আরো শুনলে আশ্চর্য হবেন। সেই বাদ্যকর ছিলেন অন্ধ—দোনিয়া বলল। ফ্রান্সিস, হ্যারি দু’জনেই চমকে দু’জনের মুখের দিকে তাকাল। দু’জনেই নির্বাক তাকিয়ে রইলো দেয়ালের গায়ে লেখা বেশ অস্পষ্ট স্বরলিপিগুলোর দিকে।
—সেই বাদ্যকর এই ঘরেই থাকতেন, সোনিয়া বলল।
ফ্রান্সিস হ্যারির চোখে মুখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর।
.
বিকেল হয়ে এলো। ওরা তিনজনেই বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করছিল। হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস এখন কি করবে?
—আমাদের জাহাজে যাবো। বন্ধুদের তো বোঝাতে হবে সৈন্যমূর্তির কথা, সেগুলো উদ্ধারের কথা। তার জন্যে এখানে তো থাকতে হবে—ফ্রান্সিস বলল।
—রাজকুমারী মারিয়া, বন্ধুরা রাজি হয় কিনা দেখো—হ্যারি বলল।
—হুঁ। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর দোনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল—দোনিয়া আপনিও আমাদের জাহাজে আসুন। আজ রাতটা জাহাজে থাকবো আমরা। কাল সকাল থেকে কাজে নামবো।
—বেশ চলুন—দোনিয়া রাজি হলো।
তিনজনে নুরাঘি থেকে বেরিয়ে এলো। সামনের পাথরের ঘাটে দেখল একটা সুন্দর নৌকো বাঁধা। দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল—এটা কাল রাতের সেই রাজার নৌকো। রাতের অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় নি। এখন দেখল নৌকার দু’পাশে ছ’ইঞ্চি লোহা দিয়ে বাঁধানো। দু’কোণায় দুটো শক্ত দাঁড়। নৌকোর গলুইয়ের ওপর দামি কাঠের আচ্ছাদন। ওপরে ঘাসের গদি পাতা। শৌখিন নৌকো, তবে বেশ।
একজন সৈন্য এগিয়ে এলো। দোনিয়াকে বলল—মহামান্য রাজা এই নৌকোটা আপনাদের ব্যবহারের জন্যে দিয়েছেন।
ফ্রান্সিস নিজেদের নৌকোটা খুঁজল। দেখল একটু দূরে ওদের নৌকোটা আর দোনিয়ার নৌকোটা পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি, আমাদের নৌকোটা তুমি নিয়ে এসো। আমাদের অনেক সুখদুঃখের সঙ্গী এই নৌকোটা। নতুন নৌকো পেয়ে এটাকে তো ভুলে যেতে পারি না।
সবাই ঘাটে নামল। ফ্রান্সিস রাজার নৌকোটায় উঠল। হ্যারি ওদের নৌকোন। দোনিয়া তার নৌকোয়। দোনিয়ার নৌকোয় রয়েছে তার সেই বড় বড় বঁড়শিবাঁধা লম্বা দড়িটা।
ওরা নৌকো বেয়ে চলল খাঁড়ির মুখের দিকে। একটু পরই ওর রাজার জাহাজের পাশ দিয়ে এসে সমুদ্রে পড়ল। নৌকোগুলো চালাল ওদের জাহাজ লক্ষ্য করে।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে তখন। পশ্চিম আকাশ লালে লাল। মধ্য আকাশে অস্তগামী সূর্যের আলো পড়েছে হালকা মেঘগুলোয়। মনে হচ্ছে যেন পাহাড়, বন, নদীর ছবি। নৌকো বাইতে বাইতে আকাশে এই রঙের খেলা দেখছিল ফ্রান্সিস হঠাই ওর মনটা ভারী হয়ে উঠল। দেশের কথা বাড়ির কথা মনে পড়ল। বাড়িতে থাকলে এসময় ও বাগানের শ্বেতপাথরের আসনটায় এসে বসে। মনে পড়ল কতদিন মা’র সঙ্গে ঐ আসনে বসে আকাশে তারা ফুটে উঠতে দেখেছে। অবশ্য শীতের দেশ ওদের সবসময় আকাশে তারা দেখা যায় না। তাই যেদিন আকাশ পরিষ্কার থাকে তারা দেখা যায়, সেদিন ফ্রান্সিসের খুব আনন্দ হতো। মা হেসে বলতো—দ্যা—আজ আমি তোর পাশে আছি—তাই তারা দেখতে পেলি। জানিস্ এই পৃথিবীতে যারা মানুষের উপকার করে,সব মানুষকেই ভালোবাসে, কাউকে দুঃখ দেয় না, কারো ক্ষতি করে না, তারা মৃত্যুর পর আকাশের এক-একটি তারা হয়ে যায়।
ফ্রান্সিস আকাশের দিকে আবার তাকাল। অন্ধকার হয়ে আসছে আকাশ। তারা ফুটতে শুরু করল। ফ্রান্সিসের দাঁড় বাওয়া হাত থেমে গেল। হারি, দোনিয়া নৌকো অনেকটা এগিয়ে গেছে তখন। ফ্রান্সিসের কি হলো। নৌকোয় উঠে দাঁড়াল—আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো –মা—কোন তারাটা তুমি? মা-।
সমুদ্রের বাতাসের শব্দ ঢেউয়ের শব্দের মধ্যেও হ্যারি ফ্রান্সিসের গলার শব্দ চিনল। সঙ্গে-সঙ্গে নৌকোয় উঠে পেছন ফিরে চিৎকার করে ডাকল—ফ্রান্সিস
তখন ফ্রান্সিস ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছে। দু’হাতে মুখ ঢেকেছে। হ্যারি ভীষণ চিন্তায় পড়ল। কি হলো ফ্রান্সিসের ও নৌকো ঘোরাল। ফ্রান্সিসের নৌকোর কাছে এসে দেখল, ফ্রান্সিস দু’হাতে মুখ ঢেকে নৌকোয় বসে আছে। হ্যারি তাড়াতাড়ি ফ্রান্সিসের নৌকোয় উঠতে গেল। কিন্তু হ্যারি শরীরের দিক থেকে বরাবরই দুর্বল। ও প্রায় সমুদ্রের জলে পড়ে যাচ্ছিল। ফ্রান্সিসের নজরে পড়ল সেটা। ও দ্রুত উঠে হ্যারিকে জড়িয়ে ধরল। হ্যারি বলল,ফ্রান্সিস, তুমি কাঁদছিলে?
—হ্যারি মা’র কথা মনে পড়ল হঠাৎ।
ফ্রান্সিস আস্তে বলল। হারি জোরে ফ্রান্সিসকে বুকে চেপে ধরল। ওর চোখেও তখন জল।
দোনিয়াও নৌকো চালিয়ে ফিরে এলো। অল্প আলোয় দুই বন্ধুকে কাঁদতে দেখল। দোনিয়া কিছুই বুঝে উঠতে পারলোনা। ফ্রান্সিস বলল হ্যারিকে—তুমি আমার নৌকোতেই থাকো। আমাদের নৌকোটা পেছনে বেঁধে নিচ্ছি।
আবার তিনটে নৌকো চলল ফ্রান্সিসদের জাহাজের দিকে। দোনিয়া ফ্রান্সিসকে বলল সত্যি—আপনাদের বন্ধুত্বের গভীরতা অনুভব করে আমি আশ্চর্য হলাম। ফ্রান্সিস ও হ্যারি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল শুধু। জাহাজের কাছাকাছি আসতে দেখল মারিয়া ভাইকিং বন্ধুরা জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে ফ্রান্সিসদের আসতে দেখে বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল –ও—হো হো হো। মারিয়া হাসতে হাসতে হাতের রুমাল তুলে নাড়তে লাগল।
মারিয়া সকাল থেকেই জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল দুপুরে একবার খেতে গেছে শুধু। বিস্কোরা বারবার এসে বলেছে রাজকুমারী এভাবে রোদে দাঁড়াবেন থাকবেন না। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন।
মারিয়া কোনো কথাই শোনেনি। অনড় দাঁড়িয়ে থেকেছে রেলিং ধরে।
ফ্রান্সিসরা জাহাজের ডেক-এ আসতেই বন্ধুরা ওদের দুজনকে জড়িয়ে ধরল। মারিয়া হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস দোনিয়াকে দেখিয়ে বলল, মারিয়া, ইনি দোনিয়া। এই সার্দিনিয়ার এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। দোনিয়ার মতো এমন উদার হৃদয়ের মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি—এবার দোনিয়াকে বলল,ইনি মারিয়া। আমাদের দেশের রাজকুমারী। আমার স্ত্রী
দোনিয়া হেসে মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানাল। বলল—রাজকুমারী। আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি আপনি অনেকদিন জাহাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমি আমার অভিজ্ঞতায় এমন কোনো রাজকুমারী দেখি নি যিনি রাজপ্রাসাদের বিলাসবহুল্যের সুখের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে এভাবে জাহাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
মারিয়া একটু হেসে বলল—এই জাহাজের জীবন শুধু দুঃখ-কষ্টেরই নয়। কত নাম জানা দেশের কতরকম মানুষের সংস্পর্শে এসে যে অভিজ্ঞতা লাভ তা যেমন আনন্দের। তেমনি রোমাঞ্চকরও। ফ্রান্সিস এইজীবন ভালোবাসে। তাই আমিও এই জীবন ভালোবাসি।
দোনিয়া খুশির হাসি হেসে মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিস মারিয়া আর দোনিয়াকে নিয়ে নীচে নামবার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে তখনই হ্যারি ছুটে এলো। বলল ফ্রান্সিস,আমাদের কি হয়েছিল মোটামুটি বন্ধুদের এ বলেছি। কিন্তু ওরা বারবারই জানতে চাইছে জাহাজ এখন দেশের দিকে চালানো হবে কিনা।
ফ্রান্সিস একটু ভেবে বলল, এই আনন্দের মুহূর্তে কিছু বলবো না। তুমি সবাইকে রাতে? খাওয়াদাওয়ার পর ডেক-এ আসতে বলল।
ফ্রান্সিস মারিয়া আর দোনিয়াকে নিয়ে কেবিনঘরের দিকে চলল। ওদিকে বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। প্রায় সবারই এক কথা আর নয়। এবার দেশের দিকে জাহাজ চালাতে হবে। আমরা অনেকদিন দেশছাড়া। শুধু বিস্কো, শাঙ্কো কোনো কথা বলল না। ওদের এক চিন্তা—ফ্রান্সিস এখন কি করবো? দেশে ফেরার জন্যে পাগল এই বন্ধুদের কি ফ্রান্সিস শান্ত করতে পারবে?
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর ভাইকিং বন্ধুরা জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। পরস্পর ওরা মুদৃস্বরে কথাবার্তা বলছে, তখনই মারিয়া আর হ্যারিকে নিয়ে ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে এলো। বন্ধুদের কথাবার্তা থেমে গেল। নিস্তব্ধ চারদিক। শুধু সমুদ্রের হাওয়ার শ-শ শব্দ। ঢেউ জাহাজের গায়ে ভেঙে পড়ার মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।
আজকে চাঁদের আলো অনেকটা উজ্জ্বল। আলো পড়েছে সমুদ্রে জাহাজে ভাইকিংদের মাথায় গায়ে। ফ্রান্সিস তাকিয়ে দেখল এসব। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, ভাইসব—আমি ভালো করেই জানি মাতৃভূমির টান নাড়ির টান। তবু বলবো মাতৃভূমির নিশ্চিন্ত সুখী অলসের জীবন আমাকে কোনোদিন টানে নি। ঐ জীবনকে আমি বেঁচে থাকা বলে মানি না—ফ্রান্সিস থামল।
তারপর আস্তে-আস্তে সব ঘটনা বলল। সার্দিনিয়ার অতীত ইতিহাস, সোনিয়া, রাজা এনজিও, স্পিনোলা, সাত মূল্যবান সৈন্যমূর্তি আর সেসব উদ্ধারের সঙ্কল্প সবই বলল। তারপর বলল—কাজেই আমাদের এখানে অপেক্ষা করতেই হবে।
ফ্রান্সিস থামল। একজন ভাইকিং বন্ধু বলল ফ্রান্সিস। আমাদের এখানে কতদিন থাকতে হবে?
ফ্রান্সিস বলল—তা তো এখনই বলতে পারবো না। সব দেখেশুনে যদি মনে করি খাঁড়ির জলে তলিয়ে যাওয়া মূর্তিগুলো উদ্ধার করতে পারবে, তাহলেই আমরা এখানে থাকবো। আমাদের দিন পাঁচ-সাতেক সময় দাও। এর মধ্যে যদি বুঝি মূর্তি উদ্ধার করা অসম্ভব, তাহলে সেইদিনই জাহাজ দেশের দিকে চালাবো।
ফ্রান্সিস থামতেই ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। মারিয়া ফ্রান্সিসকে মৃদুস্বরে বলল মূর্তি উদ্ধার হোক বা না হোক আমি তোমার সঙ্গেই থাকবো।
ফ্রান্সিস অল্প হেসে বলল, মারিয়া ঠিক এই কথাটাই আমি এতদিন তোমার কাছ। থেকে আশা করছি।
তখনও ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন চলছে। হঠাৎ হ্যারি গলা চড়িয়ে বলে উঠল –ভাইসব।
আস্তে আস্তে গুঞ্জন থামল। হ্যারি বলল-ফ্রান্সিসের সঙ্কল্পের কথা তোমরা শুনেছো। যদি এর পরেও তোমরা দেশে ফিরে যেতে চাও—যেতে পারো।
আমি ফ্রান্সিস আর মারিয়া এখুনি নৌকোয় চড়ে সাসারিতে চলে যাবো। বললো, তোমরা থাকবে কি চলে যাবে?
শাঙ্কো আর বিস্কো একসঙ্গে বলে উঠল—আমরা ফ্রান্সিসের সঙ্গে থাকবো। একটুক্ষণের নীরবতা। পরক্ষণই চিৎকার করে বন্ধু বলে উঠল—আমরা ফ্রান্সিসকে ফেলে যাবো না। এবার সবাই একসঙ্গে বলে উঠল—ও হো-হো-হো। মারিয়া বুঝতে পারল—ফ্রান্সিসকে ওর বন্ধুরা কত ভালোবাসে। ও হেসে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস ও ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বন্ধুদের সংকল্পের ধ্বনি স্তিমিত হলে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল—আমরা কাল সকালে সাসারিতে যাবো। থাকবো ঐ নুরাঘিটায়। দিনের বেলা খাঁড়ির জলে খোঁজ করবো জলের তলায় ডুবে যাওয়া নৌকোটা আর মূর্তিগুলো। কয়েকদিন ধরে খাঁড়ির দু’ধারেও খোঁজ চালাবো। তার মধ্যে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেতেও পারি, যার সাহায্যে নিখোঁজ মূর্তিগুলো উদ্ধার করতে পারবো। কাজেই কয়েকদিন না কাটলে আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবো না। দিন কয়েক পরে আমি জাহাজে এসে। জানাবো—মূর্তিগুলো উদ্ধার করা সম্ভব কিনা। যদি বুঝি সম্ভব নয়—আমরা দেশের দিকে জাহাজ চালাবো।
ফ্রান্সিস থামলো। বন্ধুরা আবার ধ্বনি তুললাম—ও-হো-হো-হো। সভা ভেঙে গেল। বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে অনেকেই নেমে গেল নিজের নিজের কেবিনঘরে যাওয়ার জন্যে। অন্য বন্ধুরা জাহজের ডেক-এ শুয়ে পড়ল, কেউ কেউ বসে রইল। ফ্রান্সিস আর মারিয়া নিজেদের কেবিনঘরে চলে এলো।
পরদিন সকালের খাবার খাচ্ছে ফ্রান্সিস কেবিনঘরে বসে। মারিয়ার খাওয়া হয়ে গেছে। হ্যারি ও খাওয়া সেরে। বলল “ফ্রান্সিস, তোমার সঙ্গে কে কে? ফ্রান্সিস খেতে খেতে বলল, মারিয়া তুমি আর বিস্কো।
হ্যারি বলল শাঙ্কো আমাকে বারবার বলল ওকে যেন তুমি সঙ্গে নিয়ে যাও।
হ্যারির কথা শেষ হতেই দোনিয়াকে নিয়ে শাঙ্কো ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিস বলল,—শাঙ্কো, তুমি তীর ছুঁড়তে ওস্তাদ। নিখুঁত তোমার নিশানা। কিন্তু আমরা তো লড়াই করতে যাচ্ছি না। কাজেই তোমার বদলে বিস্কোকে নিয়ে যাবো। জাহাজ পাহারার দায়িত্বে থাকবে তুমি।
শাঙ্কো একটুক্ষণ মাথা গোঁজ করে থেকে বলল—ফ্রান্সিস তোমার মত তো মানতেই হবে। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোমাদের সঙ্গে যাওয়ার।
—না শাঙ্কো।
—আমি সবদিক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি দুঃখ করো না।
ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো আর কোনো কথা বলল না।
খাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। ও আরমারিয়া আগে থেকেই পোশাকটোশাক পরে তৈরি হয়ে ছিল। সবাই সিঁড়ি বেয়ে ডেক-এ উঠে এলো। বিস্কোও তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল। ওর কোমরে তলোয়ার গোঁজা দেখে ফ্রান্সিস বলল—বিস্কো, তলোয়ার রেখে যাও। আমরা তো এখন লড়াই করতে যাচ্ছি না। বিস্কো কোমর থেকে তোয়ার খুলে একজন বন্ধুর হাতে দিল।
হালের কাছ থেকে দড়ির মই নামিয়ে দেওয়া হলো। ফ্রান্সিসরা একে একে নেমে এলো। দোনিয়ার নৌকোয় ফ্রান্সিস আর দোনিয়া বসল। রাজার নৌকোটায় বসল হ্যারি, মারিয়া আর বিস্কো। নৌকোর বাঁধন খুলে ফ্রান্সিসরা নৌকো বেয়ে চলল খাড়ির দিকে। এ সমুদ্র আজ খুব শান্ত নয়। এলোমেলো জোর হাওয়া ছুটছে, ঢেউ উঠছে। ঢেউয়ের দোলায়—দোল খেতে খেতে নৌকো দু’টো চলল খাড়ির দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজার জাহাজের কাছে এলো ওরা। মারিয়া বলে উঠলো, দেখেছো
—কি সুন্দর জাহাজ! হ্যারি বলল—রাজকুমারী ওটা সার্দিনিয়ার রাজা এনজিওর জাহাজ। জাহাজের রেলিং-এর কাছে তখন সৈন্যরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে ফ্রান্সিসদের, বিশেষ করে মারিয়াকে। ওরা বুঝে উঠতে পারল না এরকম পোশাক পরা লোকগুলো আর মেয়েটি কোন্ দেশের?
রাজার জাহাজ ছাড়িয়ে নৌকো দু’টো খাঁড়িতে ঢুকল। ফ্রান্সিস ডাকল—দোনিয়া?
দোনিয়া নৌকোর মাঝখানে চুপ করে বসেছিল। দাঁড় বাইছিল ফ্রান্সিস দোনিয়া ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল—আপনি কিভাবে এই অদ্ভুত বঁড়শিগুলো দিয়ে মূর্তিগুলো খুঁজতেন?
দোনিয়া নৌকোর মাঝখানে গোল করে রাখা দড়িরমুখটা বের করল। বড়বড় বঁড়শিগুলো ঐ মুখে বাঁধা। দোনিয়া বঁড়শিটা জলে নামাল। দড়ি ছাড়তে লাগল। একটু পরেই দড়ি ছাড়া বন্ধ করল। তার মানে বঁড়শিগুলো মাটি ছুঁয়েছে। ফ্রান্সিস দড়ি ছাড়ার সময় হিসেব করে বুঝল—খাঁড়িটার জল খুব গভীর নয়। ফ্রান্সিস নৌকো বেয়ে চলল। দোনিয়াও বঁড়শির দড়ি টেনে নিয়ে চলল। তার মানে জলের নীচের মাটির ওপর দিয়ে বঁড়শিগুলো চলেছে। ফ্রান্সিস বুঝল—ব্যাপারটা। ও বলল—দোনিয়া, আপনি দাঁড়ে বসুন, আমি বঁড়শি টানছি। ওরা জায়গা বদল করল। ফ্রান্সিস বঁড়শি টেনে টেনে চলল। হঠাৎ কিসে লেগে বঁড়শিট আটকে গেল। ফ্রান্সিস দড়িতে জোর ঝুঁকুনি দিল তিন চারবার। বঁড়শি আটকে রইল। ফ্রান্সিস দড়িটা ধরে টানতে লাগল। বঁড়শিতে আটকে কি যেন উঠে আসছে। টেনে টেনে ফ্রান্সিস বঁড়শিগুলো জলের ওপরে তুলল। দেখল একটা বঁড়শিতে লম্বা জাহাজবাঁধা কাছি আটকে আছে। কালো কাদায় কাছিটা মাখামাখি হয়ে আছে। ফ্রান্সিস একটু হেসে জোরে একটা হ্যাঁচ কা টান দিতেই জলেপচা কাছিটা ছিঁড়ে গিয়ে জলে ডুবে গেল। ফ্রান্সিস বঁড়শিগুলো জলে ফেলে আবার টেনে নিয়ে চলল। কিছুটা আসতেই আবার বঁড়শিগুলো কিসে আটকাল। আবার ফ্রান্সিস দড়ি টেনে তুলতে লাগল। জলের ওপর উঠলে দেখা গেল বঁড়শিতে সমুদ্রের শ্যাওলা জড়ানো ঝুপড়ি ছোট গাছমতো। আশ্চর্য! তাতে কয়েকটা লাল হলুদ ফুল। রঙটা অবশ্য মরা মরা। তবু সমুদ্রের নীচে এরকম ক্ষুদে ফুলের গাছ! আশ্চর্য বৈকি! দোনিয়া হেসে বলল-সমুদ্রের নীচেমাটিতে কাদায় নাকি এরকম ফুল-ফোঁটানো ক্ষুদে গুল্ম আছে। মনে হয় কে যেন ফুলের বাগান করে রেখেছে।
—আপনি দেখেছেন? ফ্রান্সিস বলল। দোনিয়া একইভাবে হেসে মাথা নেড়ে বলল—না। আমার সব বই পাঠ করে পাওয়া বিদ্যে।
নৌকো দু’টো নুরাঘির কাছে এলো। ফ্রান্সিস আরো কয়েকবার বঁড়শি ফেলল। কিন্তু কোনোকিছুতে আটকালো না। ফ্রান্সিস বলল—দোনিয়া। এই বঁড়শিগুলো দিয়ে কি মূর্তিগুলোর হদিশ করা যাবে এত বড় খাঁড়ির জলে?
—এছাড়া আর কোনো উপায় তো এখনও ভাবতে পারিনি। তবে একটা ব্যাপার কি জানেন—সাত-সাতটা মূর্তি। নিশ্চয়ই একসঙ্গে জড়িয়ে নীচের মাটিতে পড়ে নেই। বরং নৌকাডুবির সময় ছড়িয়ে পড়েছে। অন্তত একটা মূর্তিরও হদিশ পাই যদি বাকি ক’টাও কাছাকাছিই পাবো।
ফ্রান্সিস একটু ভেবে বলল-আপনার কথাটায় যুক্তি আছে। তবে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তল্লাসি চালাতে হবে। সেটা কি শরীরে সইবে? দোনিয়া কোনো কথা না বলে মথা ওঠা-নামা করল।
খাঁড়ি পার হয়ে নৌকো দু’টো নুরঘির সামনের ঘাটে এসে লাগল। ফ্রান্সিসরা নামল সবাই। ঘাটে নৌকো বেঁধে সবাই নুরাঘিটায় ঢুকল। মারিয়া তো আগে এখানে আসে নি। ও অবাক হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওরা ওপরে উঠল। নিজেদের ঘরটায় ঢুকল। মারিয়া জানালা দিয়ে বাইরের খাড়ি সমুদ্র দেখতে লাগল। বিস্কো বসল না, ও মারিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। হ্যারি, দোনিয়া বসে রইল। ফ্রান্সিস দু’হাতে মাথা রেখে শুয়ে রইল। অনেক চিন্তা। কিভাবে মূর্তি উদ্ধারের কাজ শুরু করবে, তাও ভাবতে লাগল।
দুপুরে খাবারদাবার নিয়ে সাধারণ পোশাক পরা দু’জন সৈন্য ঘরে ঢুকল। চীনে মাটির থালায় গোল করে কাটা রুটি, মাংসের ঝোল তরিতরকারির, স্যুপ। ফ্রান্সিসরা খেতে লাগল। খেতে-খেতে ফ্রান্সিসের হঠাৎ মনে হলো—সৈন্যমূর্তিগুলো দেখতে কেমন, তা-তো জানা হয়নি। ভাবল, দুশো বছর আগেকার কথা। কাজেই নিজের চোখে দেখেছে এমন লোক পাওয়া অসম্ভব। তবু খেতে-খেতে দোনিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি কি জানেন ঐ সৈন্যমূর্তিগুলো দেখতে কেমন ছিল?
—ওপরের ঘরটা হচ্ছে গির্জা। রাজা ফেডারক ঐ গির্জাটা তৈরি করিয়েছিলেন। ওখানে গেলে একটা ছোট্ট সৈন্যমূর্তি দেখতে পাবেন। ব্রোঞ্জে তৈরি। ওটা ফ্রেডারক নিজেই তৈরি করেছিলেন। তারপর পিসার এক কর্মকারকে নমুনা হিসেবে ওটা দিয়েছিলেন। ঐ মূর্তিটার মতোই সোনার সাতটি মূর্তি সেই কর্মকার গড়িয়ে দিয়েছিল। রাজা ফ্রেডারিক মূর্তিগুলো বাজিয়ে-বাজিয়ে সাতটা সুরধ্বনির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। তার নির্দেশেই কর্মকার কাজ করেছিল। মূর্তি তৈরি শেষ হলে গির্জায় এনে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। ওপরে গির্জায় গেলে ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলি আর সবই দেখতে পাবেন। দোনিয়া বলল ততক্ষণে ফ্রান্সিসের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ও তাড়াতাড়ি কাঠের পাত্র থেকে জল খেয়ে হাত-মুখ ধুয়ে উঠে। বলল, চলুন।
আর সবাই অবাক। তখনো কারও খাওয়া হয় নি। মারিয়া বলল—আরে বাবা—আগে খেয়ে নাও তো।
ফ্রান্সিস সে কথায় কান দিল না। বলল—দোনিয়া চলুন। দোনিয়া খেতে খেতে হেসে বলল,—ঠিক আছে, আপনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে গির্জাটা দেখতে থাকুন আমরা যাচ্ছি।
ফ্রান্সিস আর কোনো কথা না বলে দ্রুতপায়ে ঘরের বাইরে এলো। দেখল এখানেও একটা বড় গোল ঘর। পাথরের মেঝের এখানে-ওখানে শুকনো ঘাসপাতা বিছানা। প্রায় পনেরো-কুড়িজন সৈন্য সাধারণ পোশাকে শুয়ে বসে আছে। এই ঘরেই বোধহয় সুলতান মুজাহিদের রাজসভা বসতো। ডানহাতে দেখল ওপরে ওঠার সিঁড়ি। ও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। এই সিঁড়ির পাথরের ধাপগুলো অনেক মসৃণ। ওপরের ঘরে উঠে দেখল ঘরটা গোল। কিন্তু খুব বড় নয়। গরাদ বসানো কয়কটা জানালা দিয়ে আলো আসছে। সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখল সামনে একটা কাঠের বেদী। তার ওপর ক্রুশবিদ্ধ যীশুর কাঠের মূর্তি। চেস্টনাট কাঠ কুঁদে-কুঁদে তৈরি। বড় সুন্দর মূর্তিটি। বেদীতে সার দিয়ে মোমবাতি বসানো। কোনোটাই জ্বলছে না। সমুদ্রের হওয়ায় নিভে গেছে বোধহয়। শুধু একটা হলুদ রঙের মোটা বেশ বড় মোমবাতি জ্বলছে। বেদীটা থেকে কয়েক হাত সামনে দু’টো গোল কাঠের খুঁটিমতো পোঁতা। খুঁটিতে একটা রূপোর তার টানা দিয়ে বাঁধা। তাতে কয়েকটি রূপোর ছোট ছোট শেকল ঝুলছে। ফ্রান্সিস গুণে দেখল সাতটা শেকল। মাঝখানের শেকলটা বড় আর মোটা। ফ্রান্সিস এটার কারণ বুঝল না। গির্জা চারদিক বেশ পরিষ্কার।
—কি? দেখলেন সব? পেছনে দোনিয়ার কথা শুনে ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, মারিয়া, হ্যারি, বিস্কোও এসেছে। ফ্রান্সিস সেই ঝোলা শোকলগুলো দেখিয়ে বলল—দোনিয়া, এখানে নিশ্চয়ই কিছু ঝোল্লানো থাকতো।
—ঠিক ধরেছেন। নিখোঁজ সৈন্যমূর্তিগুলো ঝোলানো থাকতো—দোনিয়া বলল। তারপর বাঁদিকে পাথরের একটা তাকের দিকে যেতে যেতে বলল —এখানে আসুন। সবাই পাথরের তাকটার কাছে এসে দাঁড়াল। তাকের ওপর একটা ইঞ্চি ছয়েক মূর্তি রাখা। ব্রোঞ্জের মূর্তি, কালচে রঙ এখন। দোনিয়া মূর্তিটা দেখিয়ে বলল—রাজা ফ্রেডারিক এই মূর্তিটা ব্রোঞ্জে ঢালাই করে নিজে গড়েছিলেন। বলা হয়—জমিতে চাষ করার সময় পাদ্রিয়া নামে জায়াগায় একজন কৃষক প্রাচীন একটা সৈন্যমূর্তি পেয়েছিল। তবে সেটা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। রাজা ফ্রেডারিক নাকি সেই মূর্তিটির আদলে এইমূর্তিটি গড়েছিলেন। তারপরের কথা তো বলেছি।
ফ্রান্সিস খুব আগ্রহের সঙ্গে মূর্তিটা দেখতে লাগল। সৈন্যমূর্তিটা দেখতে একরকম মারিয়াই প্রথম বলল—সৈন্যটির মাথায় বাঁকমতো কি ওটা?
—শিরস্ত্রাণ।—সিং এর মতো দেখতে। হয়তো সেসময় যোদ্ধারা এরকম শিং-এর মতো শিরস্ত্রাণ পরতো দোনিয়া বলল।
হ্যারি বলল—এর আদলে যেসব সোনার মূর্তিগড়া হয়েছিল সেগুলো কিএর চেয়ে বড় ছিল?
—হ্যাঁ, প্রায় এক ফুট। পঞ্চম মূর্তিটা
ছিল উচ্চতায় চার ফুট, সবচেয়ে বড়।
দোনিয়া বলল। তারপর পাথরের তাকাটার বাঁপাশ থেকে দুটো রূপোর হাতমতো বের করে বলল এই দুটো দিয়ে ঘা দিয়ে দিয়ে বাদ্যকর সুরধ্বনি তুলতেন। হাতমতো জিনিসটা রেখে দিয়ে বলল—ফ্রান্সিস, মূর্তিটার সিং দুটো লক্ষ্য করুন। দেখুন সিং দুটো পরস্পর গায়ে-গায়ে লেগে আছে। যে রূপোর শেকলগুলো ঝুলছে দেখে এলেন সেগুলোর নীচের কড়ার সঙ্গে ঐ সিং-এর জোড়া জায়গাটা আটকে দেওয়া ছিল। একটু থেমে দোনিয়া বলল—এবার চলুন ঝুলন্ত শেকলগুলো দেখতে।
সেই খুঁটিতে ঝোলানো শেকলগুলোর কাছে এসে দোনিয়া বলল—দেখুন সাতটা শেকলে সাতটা যোদ্ধামূর্তি ঝুলতো। লক্ষ্য করুন—পঞ্চম শেকলটা মোটা আর বড়। ওটাতেই ঝুলতো সবচেয়ে বড় মূর্তিটা। ফ্রান্সিসরা বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখতে লাগল ঐ খুঁটি দুটো, ঝুলন্ত শেকলগুলো। মারিয়া ছোট থেকেই রাজপ্রাসাদের নৃত্য-গীতিশালায় নানা ঐক্যবাদনের অনুষ্ঠান শুনেছে। ও সহজেই কল্পনা করে নিতে পারল দুশ বছর আগেকার সেই পরিবেশ –ঐ শেকলগুলোয় ঝুলছে সাতটি যযাদ্ধামূর্তি। ভোরের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে বাইরের ছোট ছোট পাহাড়ে-উপত্যকায়, সমতলে মাটিতে ঘাসে আর এখানে এক অন্ধ বাদ্যকর মূর্তিগুলোতে ঘা দিয়ে দিয়ে গড়ে তুলেছে সপ্তসুরের এক স্বর্গীয় পরিবেশ। ফ্রান্সিসরা আস্তে-আস্তে সিঁড়ির দিকে চলল। মারিয়া তখনও দাঁড়িয়ে আত্মমগ্ন। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ডাকল-মারিয়া, এসো।
মারিয়া একটু চমকে ফিরে তাকাল ফ্রান্সিসদের দিকে। তারপর স্বপ্নবিষ্টের মতো যেন এলো নামবার সিঁড়ির কাছে। সবাই নেমে এলো।
পরদিন সকাল থেকেইফ্রান্সিসরা কাজে নেমে পড়ল। দোনিয়ার সঙ্গে বসল ফ্রান্সিসরাজার নৌকোটায় বসল হ্যারি, মারিয়া আর বিস্কো।
দোনিয়া ওর বঁড়শি টেনে চলল। দোনিয়া ক্লান্ত হয়ে পড়লে ফ্রান্সিস বঁড়শি টেনে চলল। দুপুরে নুরাঘিতে এসে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়া, বঁড়শি টানা। কিন্তু যোদ্ধামূর্তিগুলোর কোনো হদিশই পাওয়া গেল না। বিকেলে বিস্কো রাজার নৌকোয়
মারিয়াকে নিয়ে জাহাজে রেখে আসে। সকালে আবার গিয়ে মারিয়াকে নিয়ে আসে।
দু’দিন কাটল। কিন্তু একটা যোদ্ধামূর্তি উদ্ধার করা গেল না। দোনিয়ার তৈরি বঁড়শিতে উঠল জাহাজের কাদা ল্যাপটানো ভাঙা-নোঙর, জলেপচা হাতল, জংধরা ঢাল। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল একটা জেলে নৌকো হঠাৎ ঝুঁকেপড়া পাথরে চাঁইয়ের আড়ালে ঘুরছে। নৌকোটায় একজন জেলে। ফ্রান্সিস বুঝল স্পিনোলার ব্যবস্থা এটা। ওদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
সেদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে নৌকোয় এলো ওরা। চলল বঁড়শি টেনে টেনে খোঁজা। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল। এতবিস্তৃত খড়ি। গভীরতা কম হলেও এভাবে খুঁজে বের করা কি সম্ভব? হঠাৎ ফ্রান্সিস দেখল উত্তর দিকের ধসেপড়া নুরাঘিটার নীচে অনেকটা চৌকোণো একটা গহ্বরমতো। ফ্রান্সিস দোনিয়াকে ঐ জায়গাটা দেখিয়ে বলল—ওটা কি?
দোনিয়া বলল—ওটা বোধহয় নুরাঘিটায় ওঠার কোনো গোপন পথ ছিল। এখন তোনুরাঘিটার এপাশ ধসে পড়েছে। পথটাও পাথরে আটকে গেছে বোধহয়। ঐ গহ্বরমতো জায়গাটায় আমরা আমাদের নৌকোটা ভোর হবার আগেই লুকিয়ে রাখতাম।
ফ্রান্সিস বলল—চলুন না ঐ গোপনপথটার অবস্থা দেখে আসি।
—জায়গাটা অন্ধকার আর ভীষণ পেছল পাথরের ধাপগুলো। দোনিয়া বলল।
–ঠিক আছে। দেখা যাক একবার-ফ্রান্সিস বলল। তারপর নৌকোয় উঠে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বিস্কোকে ডাকল—বিস্কো—
বিস্কো ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস আঙুল তুলে ঐ গহ্বরমতো জায়গাটা দেখিয়ে বলল—ঐখানে যাবো আমরা। তোমরা আমাদের পেছনে এসো।
গহ্বরমতো জায়গাটায় পৌঁছল ওরা। ওটার ছাদমতো ওপরটা বেশ উঁচুতে। নৌকো দুটো ঢুকে গেল। বেশ অন্ধকার ভেতরটা, অন্ধকারটা একটু সয়ে আসতে ফ্রান্সিস দেখল জলের ধারেই পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে। ফ্রান্সিস প্রায় অন্ধকারে নৌকো থেকে পাথরের সিঁড়িতে পা রাখল। শরীরে একটু ঝাঁকুনি, সাবধানে সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াল। সত্যি—কাদা ল্যাপটানো সিঁড়িটা ভীষণ দূরে পেছল। পেছনে নৌকো থেকে মারিয়া অস্ফুটস্বরে বলল—সাবধান।
ফ্রান্সিস মৃদু হাসল। শুধু ডানহাতটা তুলে নাড়ল। তারপর পা টিপে টিপে একটা একটা করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কয়েকটা সিঁড়ি উঠতেই বুঝল জলকাদা আর নেই। কিন্তু ভেজাভেজা সিঁড়িগুলো। বুঝল, জোয়ারের সময় এর বেশি সমুদ্রের জল ওঠে না। আরো ক’টা সিঁড়ি উঠল। আর ওঠা যাবে না। চৌকোনো পাথর গড়িয়ে পড়ে সিঁড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল শাঁদিকে ভেঙে পড়া পাথরের দেয়ালের বড় ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো পড়েছে। ওখানে অন্ধকারে নেই। কিন্তু ওখানে পৌঁছতে হলে এই চৌকোনো পাথরের স্তূপ পার হতে হবে। নীচে থেকে হ্যারির ডাক শোনা গেল—ফ্রান্সিস ?
গহ্বরমতো জায়গাটায় পাথুরে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ডাকটা জোরালো শোনালো। ফ্রান্সিস ও চেঁচিয়ে বলল—ভয় নেই—আমি নিরাপদ।
তারপর ফ্রান্সিস গড়িয়ে পড়া চৌকোনো পাথরগুলো ভালো করে দেখে হিসেব করতে লাগল। পাঁচ-ছ’টা পাথর সরাতে পারলেই সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যাবে।
এবার ফ্রান্সিস সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। পেছল সিঁড়ি পর্যন্ত নামল না। ওখান থেকেই বলল হ্যারি, বিস্কোকে উঠে আসতে বলল, তোমরা নেমো না। প্রথম তিন চারটে সিঁড়ি ভীষণ পেছল।
একটু পরেই বিস্কো উঠে এলো। ও বেশ হাঁপাচ্ছে। কাছে এসে বলল, কি ব্যাপার?
-এসো আমার সঙ্গে ফ্রান্সিস সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কয়েকটা সিঁড়ি উঠে ফ্রান্সিস পাথরের স্তূপ দেখাল। বলল—ঐ পাথরগুলো সরাতে হবে। বেশি না, পাঁচ ছটা সরাতে পারলেই সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যাবে। এবার দুজনে মিলে প্রথম চৌকোনা পাথরটা ধরে ঠেলতে লাগল। নুরাঘির ভাঙা দেয়ালের পাথর, খুব ভারী নয়। আস্তে আস্তে ধরে ধরে পাথরগুলো সরিয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে পেতে দিল। ফ্রান্সিস পা ফেলে দেখল সমান পাথরগুলো নড়ছে না। শুকনো পাথর। উঠতে সুবিধেই হলো। ফ্রান্সিস ডাকল—বিস্কো উঠে এসো।
বিস্কো উঠে এলো। আবার দেখল এখানে বাঁ পাশের দেয়াল ভেঙে বিরাট হাঁ হয়ে গেছে। রোদ পড়ে জায়গাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ওখানে পৌঁছে ফ্রান্সিস দেখল ওপরের দিকেও সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ দেখা যাচ্ছে। তারপর পাথরের স্তূপ। ঐ জায়গাটা ধস নেমে সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। আর ওঠা সম্ভব নয়।
ফ্রান্সিস বাঁ দিকের ভাঙা খোঁদলটা দিয়ে দেখল সম্পূর্ণ খাঁড়িটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাঁদিকে অটুট নুরাঘিটা। খাঁড়ির মুখে রাজার জাহাজ। দূরে দূরে জেলেদের নৌকো। আরো দূরে ওদের জাহাজটা। সমুদ্রে আজ অনেক শান্ত। সাদারঙের সামুদ্রিক পাখিগুলো মাথার ওপর পাক খেয়ে উড়ছে। পাখির তীক্ষ্ণ ডাক মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। বিস্কো এসে ওর পাশে দাঁড়াল। বিস্কোও বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে। তারপর বলল—কি করবে এখন?
—নেমে যাবো, চলো। দোনিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলবো—ফ্রান্সিস বলল।
দু’জনে আবার নামতে লাগল। শুকনো আর ভেজা সিঁড়ির ধাপ দিয়ে নামতে অসুবিধে হলো না। কিন্তু একেবারে নীচের ভীষণ পেছল সিঁড়িগুলো দিয়ে সাবধানে নামলো।
দু’জনে নৌকোয় উঠল। হ্যারি জিজ্ঞেস করল—কি দেখলে ওপরে?
—ধস নেমে ভেঙেপড়া নুরাঘিটা দেখলাম। ভাঙা পাথরটাথর সিঁড়ি এসব ফ্রান্সিস বলল।
বেশ অন্ধকার সুড়ঙ্গটা থেকে ওরা নৌকো চালিয়ে বেরিয়ে এলো। নৌকোর দাঁড় টানতে টানতে ফ্রান্সিস বলল—দোনিয়া, আমার কেমন মনে হচ্ছে মুবারক এখানে পরে এসেছিল আর একাই চেষ্টা করেছিল যোদ্ধামূর্তিগুলো উদ্ধার করতে
—একা কেন? কয়েকজন সঙ্গী নিয়েও তো আসতে পারতো—দোনিয়া বলল।
ফ্রান্সিস বলল—না, আপনার মতো মুবারককেও একাই এই খাঁড়ির নীচে খুঁজতে হয়েছে। কিভাবেমুবারক খুঁজেছিল বলতে পারবো না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস নৌকোটা কোথায় ডুবে গিয়েছিল, মুবারক সেটা জানতো।
—সেই চিঠিটায় কিন্তু সেই ইঙ্গিতটা নেই। দোনিয়া বলল।
ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ ভেবে। তারপর বলল—আচ্ছা যেখানে নৌকো থেকে মুবারক জলে ঝাঁপ দিচ্ছে সেই জায়গাটা একবার বলুন তো। আপনার তো মুখস্থ।
দোনিয়া একটু ভেবে নিয়ে বলল—“জাহাজর সঙ্গে বাঁধা দড়ি ছিঁড়িয়া গেল। সেই সঙ্গে ঝড়ের প্রবল ধাক্কায় আমাদের নৌকা কাত হইয়া ডুবতে লাগিল। নৌকায় আমার একমাত্র সঙ্গীটিকে বার বার ডাকিয়াও কোনো সাড়া পইলাম না। আমি আর কালবিলম্ব না করিয়া অন্ধকারে ঝড়বিক্ষুদ্ধ খাঁড়ির জলে ঝাপাইয়া পড়িলাম। আজ আর জানি না কিভাবে আমি তীরে আসিয়া পৌঁছইয়াছিলাম।
দোনিয়া থামতেই ফ্রান্সিস বলল—দেখুন, আমার কেমন বিশ্বাস জলে ঝাপিয়া পড়বার সময় মুবারক নিশ্চয়ই কিছু দেখেছিল।
—কিন্তু ঐ ঝড়জলের মধ্যে ঐ অন্ধকারে মুবারক কি কিছু দেখতে পেয়েছিল? দোনিয়া বলল।
—মনে রাখবেন,ঝড় এলে মেঘে বিদ্যুৎ চমকাবেই। ঝড় থামার যাবার পর কিছুক্ষণ হলেও বিদ্যুৎ চমকায়। আমার জাহাজী জীবনের অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে-ফ্রান্সিস বলল। দোনিয়া বলল—হ্যাঁ? জাহাজে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ান আপনারা। কাজেই আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। তবুবলি-মুবারক কিন্তু বিদ্যুৎ চমকানোর কথা কোথাও লেখে নি।
—এটাই আমার কাছে একটু অস্বাভাবিক লাগছে। মুবারক ঝড়ের বর্ণনা করেছেন সুন্দর। সব ঘটনার বর্ণনাই বাস্তব। কিন্তু বিদ্যুৎ চমকানো আর বাজ পড়ার কথাটা বাদ দিয়েছে কেন, বুঝলাম না।
ফ্রান্সিস বলল। দোনিয়া একটু ভেবে নিয়ে মাথা উঠানামা করে বলল—কথাটা ভাববার মতো।
—আচ্ছা, আরবিতে লেখা ঐ চিঠিটা কি আপনার কাছে? ফ্রান্সিস বলল।
—হ্যাঁ আছে—দোনিয়া বলল।
—কোথায় আছে? পিসায়? ফ্রান্সিস সাগ্রহে বলল।
—না, এখানেই আছে, দোনিয়া বলল।
—আমাকে একটু দেখাবেন? অবশ্য আমি আরবি ভাষার আ-ও জানি না। ওটা আপনিই আমার সামনে ভালো করে পড়বেন। লক্ষ্য রাখবেন শুধু ঝড়ের বর্ণনায় জায়গাটা এবং ঝাঁপিয়ে পড়ার বর্ণনাটা—ফ্রান্সিস বলল।
—এ চিঠিটা এতবার পড়েছি-নাঃ আমি হুবহু চিঠিটাই আপনাকে বলেছি। দোনিয়া বলল।—তবু একবার চিঠিটা আমাকে দেখান দিন আমার অনুরোধ, ফ্রান্সিস—বলল।
দোনিয়া মাথা নিচু করে ভাবলো একটুক্ষণ। তারপর মাথা তুলে বলল,—বেশ চলুন, দেখুন চেষ্টা করে চিঠিটা থেকে কোনো সূত্র পান কিনা।
—তাহলে কোথায় নামতে হবে আমাদের? ফ্রান্সিস জানতে চাইল। দোনিয়া খাঁড়ির ডানদিকের একটা ঢালু পাড় আঙুল তুলে দেখিয়ে। বলল ওখানে নেমে আমাদের যেতে হবে।
ফ্রান্সিস দাঁড় বাওয়া থামিয়ে পেছনে নৌকায় হ্যারি দের দিকে চেঁচিয়ে বলল—হ্যারি, নৌকো নিয়ে আমাদের পেছনে-পেছনে এসো।
ঘাটের মতো ঢালু জায়গাটায় ফ্রান্সিসদের নৌকো দুটো লাগল। এখানে ঢালু পাড়টায় পাথর বেশি নেই। সবাই নামল নৌকা থেকে। ঢালু পাড় দিয়ে উঠছে ওরা তখন দেখল দু’টো জেলেদের নৌকো উপুড় করে রাখা। বোধ হয় মেরামতি রঙ করার জন্যে। পাড় ছাড়াতেই একটু দূরে কয়েকটা চেস্টনাট গাছের নীচে জেলেদের পাথর সাজিয়ে তৈরি বাড়ি দেখা গেল। ওপরের ছাউনি শুকনো ঘাসের।
সবাই বাড়িগুলোর সামনে এলো। বাড়িগুলো থেকে জেলেবৌ, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ওদের দেখতে লাগল। সমর্থ পুরুষরা তো মাছ ধরতে চলে গেছে। দুটো ঘরের সামনে এসে দোনিয়া দাঁড়াল। বাঁদিকের ঘরটা থেকে একজন বুড়ি বেরিয়ে এলো। চোখ কুঁচকে। দোনিয়াকে দেখে দাঁত ফোলা মুখে হাসল। দোনিয়াও হাসল। কি বলল যেন। তারপর পাশের চ্যালাকাঠের দরজা বসানো ঘরটা খুলে ঢুকল। ফ্রান্সিস ঢুকল শুধু। ছোটঘর। হ্যারি রা বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস দেখল একটা ঘাসের বিছানামতো পাতা। বিছানায় কম্বলের মতো মোটা কাপড় পাতা। ঘাস পাকিয়ে একটা বালিশমতোও করা হয়েছে। বিছানার ওপাশে একটা ওক কাঠের লম্বা বাক্স। তাতে লতাপাতা আঁকা রূপোর গিল্টি। বাক্সটার দিকে যেতে যেতে দোনিয়া বলল—এটাই আমার আস্তানা।
বাক্সের ডালা খুলে দোনিয়া কিছু শৌখিন পোশাকপত্র আরো কিসব সরিয়ে কয়েকটা পার্চমেন্ট কাগজ তুলে নিল। সেগুলো দেখে নিয়ে একটা কাগজ হাতে নিয়ে। বাকিগুলো রেখে দিল। বাক্স বন্ধ করে বলল—এখানে আলো কম, পড়া যাবে না, বাইরে চলুন।
বাইরে একটা চেস্টনাট গাছের নীচে একটা লম্বাটে পাথরে এসে বসল দোনিয়া। মারিয়া,হারি বসল। বিস্কোদাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস দোনিয়ার সমানে দাঁড়িয়ে রইল। হ্যারি আস্তে বলল, ফ্রান্সিস ঐ কাগজটা কি?
ফ্রান্সিস বলল—মুবারকের চিঠি।
—বলো কি? হ্যারি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কাগজটার দিকে। মারিয়া আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না। গলা নামিয়ে হ্যারিকে বলল-কি ব্যাপার বলো তো? হ্যারি বিস্কোকেও ইঙ্গিতে ডাকল। তারপর নীচু স্বরে সমস্ত ঘটনা বলতে লাগল।
দোনিয়া কাগজটা ফ্রান্সিসকে তুলে। দেখিয়ে বলল—এটাই হলো মুবারকের, ফ্রান্সিস ভালো করে দেখল কাগজটা। হরফ দেখে বুঝল আরবি ভাষা। এত পুরোনো কাগজ। হলুদ হয়ে গেছে। কাগজগুলো এত অস্পষ্ট হয়ে গেছে যে ভালো করে বোঝাই যায় না।
এবার আপনি চিঠিটা ভালো করে পড়ুন তো। দেখুন তো কোনো কথা বা পংক্তি কি আপনি বাদ দিয়ে বলেছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।
দোনিয়া চিঠিটা মনে মনে পড়তে লাগল। পড়া শেষ করে মাথা নাড়ল। বলল—নাঃ, চিঠিটা হুবহু বলেছি আমি।
ফ্রান্সিস ভাবল কিছুক্ষণ, কিছু বলল না। হ্যারির ততক্ষণে নিখোঁজ যোদ্ধামূর্তির গল্পটা বলা শেষ হয়ে গেছে। হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস কি ভাবছো?
—জানো হ্যারি, আমার কেমন মনে হচ্ছে চিঠিটায় নিশ্চয়ই কিছু লেখা বাদ গেছে, ফ্রান্সিস বলল। এবার ফ্রান্সিস দোনিয়াকে বলল—দোনিয়া—আপনি এই চিঠিটা ছাড়া আর কিছু কি ঐ গ্রন্থটাতে পান নি?
—দোনিয়া একটু ভেবে নিয়ে বলল—না—জ্যোতিষ বিদ্যার মোটা বই। তখন তো গ্রন্থটা পড়ার দিকেই সমস্ত মনপ্রাণ। হঠাৎ এই চিঠিটা পেয়েছিলাম। তখন আর বইপড়ার দিকেমন থাকেনি। চিঠিটা বেশ কষ্ট করে পড়েই বুঝতে পারলাম সোনার যোদ্ধামূর্তিগুলো মুজাহিদ দেশে নিয়ে যেতে পারে নি। মূর্তিগুলো আছে আসারির এই ক্যালে মানে খাঁড়ির জলের নীচে। একটু থেমে দোনিয়া বলল—
—বেশ কিছুদিন এই চিন্তাটাই আমাকে পেয়ে বসল। পরে আর এ অভিজাত—ভদ্রলোকের বাড়ি যাইনি। বইটাও অর পড়া হয়নি—ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল। আমার মনে হয় ঐ বইয়ে আরো কিছু সূত্র পাওয়া যাবে।
—এটা তখন ভাবি নি, ধরেই নিয়েছিলাম এই চিঠির ভিত্তিতেই নিখোঁজ মূর্তিগুলো উদ্ধার করতে পারবো। কিন্তু এখন বুঝছি—এতবড় খাঁড়িতে ওসব আদৌ খুঁজে পাবো কিনা—দোনিয়া বলল।
—আমি তো সেকথা আপনাকে আগেই বলেছি—ফ্রান্সিস বলল।
—আচ্ছা—হ্যারি বলল—আপনি তো চিঠিটা পিসা নগরের একজন অভিজাত ভদ্রলোকের বাড়িতে পেয়েছিলেন?
—হ্যাঁ, দোনিয়ার মাথা ওঠানামা করে বলল।
—ওখানে আমাদের নিয়ে যেতে পারবেন? হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস বলল—আমিও তাই বলছিলাম। ওখানে খোঁজখুঁজি করতে পারলে হয়তো অন্য আরও সূত্রও পেতে পারি।
—এটা আপনাদের অনুমান—তাই কিনা—দোনিয়া বলল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল—তা ঠিক। তবে এখন পর্যন্ত আমরা মুবারকের চিঠি থেকে শুধু এইটুকু জানলাম যে সোনারমূর্তিগুলো এইখাড়ির জলের নীচেই কোথাও আছে। এই একটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এখন প্রশ্ন—এতবড় খাঁড়ির কোথায় সেই নৌকোটা ডুবে গিয়েছিল। খাঁড়িটার জলের গভীরতা বেশি নয়। আপনার ঐ বড়শিগুলো ফেলে ফেলে টেনেটেনে খোঁজা যায় ঠিকই কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব? দিনের পর দিন এত কষ্ট করে খুঁজেও যে নিখোঁজ মূর্তি গুলো পাবো, সেটা অনিশ্চিত। কাজেই মুবারকের চিঠিটা যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেখানে একটু খোঁজাখুঁজি করতেইহবে। যদি কিছু পাওয়া যায় বা হদিশ করা যায়। দোনিয়া একটু ভাবল, তারপর বলল—বেশ, তবে তো আপনাদের পিসায় যেতে হবে।
—তা তো যেতেই হবে—হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে। আপনারা কবে কিভাবে যাবেন ভেবে দেখুন—দোনিয়া বলল।
—সেটা আমরা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবো। ফ্রান্সিস বলল।
নৌকোয় উঠে ফ্রান্সিস বলল—মারিয়া—আমরা আমাদের জাহাজে যাবো। মারিয়া একটু আশ্চর্য হয়েই বলল
—আজকে খোঁজাখুঁজি করবে না? ফ্রান্সিস বলল—না, আমাদের পিসা যেতে হবে।
—সে তো মূল ভূখন্ডে, মারিয়া বলল।
—হ্যাঁ সেখানেই যেতে হবে—হ্যারি বলল।
—কিন্তু তাতে তো আরো সময় নষ্ট হবে—বিস্কো বলল।
—না হয়তো এই সময়টা খুবই কাজে লাগবে—ফ্রান্সিস বলল।
—সেটা তাহলে বন্ধুদের বুঝিয়ে বললা—বিস্কো বলল।
—সেইজন্যেই আমাদের জাহাজে যাচ্ছি, দেখি সব বলে—ফ্রান্সিস বলল।
এবার ফ্রান্সিসদের নিয়ে নৌকোগুলো চলল ওদের জাহাজের দিকে। নৌকোর দাঁড় টেনে বিস্কো বলল-রাজকুমারী, এসব জায়গায় দেখছি গরম খুব বেশি না।
মারিয়া বলল—এটা ভূমধ্যসাগর অঞ্চল, ঠান্ডা গরম কোনোটাই বেশি নয়।
জাহাজে উঠে ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—সবাইকে ডেক-এ আসতে বলো।
ভাইকিং বন্ধুদের সবাইকে খবর দিল হ্যারি কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাইকিং বন্ধুরা জাহাজের ডেক-এ এসে জড়ো হল। ওরা ভেবে পাচ্ছিল না ফ্রান্সিস হঠাৎ এভাবে ওদের ডাকলো কেন ফ্রান্সিস বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল—ভাইসব, আমরা নিখোঁজ মূর্তিগুলো উদ্ধারের জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছি। এখন একটা বিশেষ প্রয়োজনে আমাদের পিসায় যেতে হবে। যে কাজে যাচ্ছি তা হোক বা না হোক কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা ফিরে আসব। আমাদের সঙ্গে বন্ধু দোনিয়াও থাকবেন।
ফ্রান্সিস থামলো। ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। ওরা অনেকেই ভেবেছিল ফ্রান্সিস দেশের দিকে যাত্রার কথা বলবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আরো কয়েকদিন দেরি হবে। শুধু তাই নয়, ফ্রান্সিস তো এখনও যোদ্ধামূর্তিগুলোর হদিশই করতে পারে নি।
ফ্রান্সিস আবার বলতে শুরু করল–ভাইসব তোমরা অধৈর্য হয়ো না। পিসা থেকে ফিরে এসে যা বলার আমি বলবো।
ফ্রান্সিস থামলো। সভা ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস নিজের কেবিনঘরের দিকে চলল। পেছনে মারিয়া, হ্যারি, দোনিয়াও চলল।
কেবিনঘরে এসেফ্রান্সিসরা বসল। ফ্রান্সিস বলল—পিসা যেতে হলে আমাদের আজকেই জাহজ ছাড়তে হবে। দেরি করা চলবেনা। তার আগে রাজা এনজিওকে খবর পাঠাতে হবে।
এবার ফ্রান্সিস দোনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল—আপনি রাজা এনজিওকে খবরটা জানাবার ব্যবস্থা করুন। জানাবেন, দিন কয়েকের জন্যে আমরা পিসায় যাচ্ছি, রাজা প্রথম ফ্রেডারিকের সময়কার কিছু খবরাখবর জোগাড় করতে। ব্যস, আর কিছু নয়। ফিরে এসে আবার সন্ধানকার্য চালাবো।
দোনিয়া বলল—বেশ—আমি যাচ্ছি।
—তাহলে ফ্রান্সিস-দোনিয়া ফিরে এলেই আমরা জাহাজ ছাড়বো? হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিসের মাথা ওঠানামা করল। মারিয়া আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। বলল—আচ্ছা দোনিয়া পিসা খুব সুন্দর নগর তাইনা?
দোনিয়া হেসে বলল—হ্যাঁ রাজকুমারী। এখন তো নানা চিন্তা মাথায়। পরে আপনাকে পিসা, জেনিয়া এসব জায়গা সম্বন্ধে বলবো। আপনার শুনতে ভালো লাগবে।
দোনিয়া কেবিন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একটু পরেই নৌকোয় উঠে দাঁড় টানতে টানতে দূরের নুরাঘিটার দিকে চলল। দোনিয়া চলে যেতেই মারিয়া জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। রেলিঙ ধরে তাকিয়ে রইল দূরের নুরাঘিটার দিকে, কখন দোনিয়া ফিরে আসবে। পিসা নগরের কথা ও শুনেছে। না জানি কত বড় নগর, কত লোকজন কেমন তাদের জীবনযাত্রা পোশাক-পরিচ্ছদ।
বিকেল হলো। কিছু পরেই পশ্চিমের আকাশ লালচে হয়ে উঠল। কিছুটা নিস্তেজ লাল সূর্য সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় নেমে এসে তারপর ডুবে গেল। আস্তে আস্তে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগল।
ঐ স্বল্প অন্ধকারে মারিয়া দেখল দোনিয়া নৌকো চালিয়ে আসছে। মারিয়া খবরটা দিতে নিজের কেবিনঘরের দিকে ছুটল। কেবিনঘরে ঢুকে দেখল—ফ্রান্সিস আধশোয়া হয়ে গভীরভাবে কিছু ভাবছে। হ্যারি নিপ বসে আছে। মারিয়া বলে উঠল—দোনিয়া আসছে।
ফ্রান্সিস উঠে বসল। কিছুক্ষণ পরে দোনিয়া ঢুকল। বলল—রাজা এনজিওকে বললাম। রাজা আপত্তি কিছু করল না। তবে বারবার বলল যে সে মাসারিতে বেশিদিন থাকতে পারবে না। পিসা থেকে ফিরেই আমরা যেন জোর তল্লাশী চালাই।
—ঠিক আছে—ফ্রান্সিস বলল।
তারপর দোনিয়াকে বলল—বলুন তো পিসা কীভাবে যাবো?
—আপনাদের জাহাজে চড়েই যেতে পারবেন। দোনিয়া বলল।
—কিন্তু আমি ভাবছি ফ্রান্সিস বলল—এতজন বন্ধুকে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। আমরা তো লড়াই করতে যাচ্ছিনা। আমরা চারজন হলেই হবে। মারিয়া ম্যারি, আপনি আরআমি।
—কিন্তু নৌকোয় চড়ে কি যাওয়া যাবে? হ্যারি বলল।
—দোনিয়া কি বলেন? ফ্রান্সিস দোনিয়ার দিকে তাকাল।
—তিনটে নৌকো তো আছে। নৌকোগুলোয় চড়ে যাওয়া অসম্ভব মনে করি না। তবে আপনাদের রাজকুমারীও তো যাবেন। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ—এসব সহ্য করতে পারবেন না। সমুদ্রপথ তো কম দূর হয়। তা ছাড়া কিছু এলাকা আছে যেখানে ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা ওৎ পেতে থাকে। সেক্ষেত্রে দল বেঁধে জাহাজে চড়ে যাওয়াই নিরাপদ। ফ্রান্সিস হ্যারি দু’জনেই ভাবলো সোনিয়ার কথাগুলো।
হ্যারিই বলল—জাহাজেই চলো ফ্রান্সিস সময়ও কম লাগবে।
—বেশ তুমি সবাইকে বলো তৈরি হতে—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাত্রা শুরু করবো। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি চলে গেল সবাইকে খবর দিতে—জাহাজ ছাড়ার জন্যে তৈরি হতে।
একটু রাত হতেই ঘরঘর শব্দে নোঙর তোলা হল। চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। বাতাসও বেগবান। সব পাল খুলে দেওয়া হল। সমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউয়ের গায়ে চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি। ঢেউ ভেঙে জাহাজ চলল।
ফ্রান্সিস দোনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ডেক-এ উঠে এলো। জাহাজ চালক ফ্লাইজারের কাছে এলো দু’জনে। চালক ফ্লাইজারকে ফ্রান্সিস বলল—দোনিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী জাহাজ চালাও। উনি এই অঞ্চলের মানুষ এসব এলাকা ভালোভাবেই চেনেন। দোনিয়া এগিয়ে এসে ফ্লাইজারকে কিছু নির্দেশ দিল। তারপর বলল—ভাই তোমার কোনো অসুবিধে হলে আমাকে বলো।
ফ্লাইজার হেসে মাথা ঝাঁকাল। কয়েকদিনের মধ্যেই ফ্রান্সিসদের জাহাজ মূলভূখণ্ডের কাছে এলো। সমুদ্রপথে ঝড়বৃষ্টি বা ঘন কুয়াশার পাল্লায় পড়তে হলো না।
বিকেলের পড়ন্ত আলোয় পিসা নগরের বন্দর দূর থেকে দেখা গেল। অনেক জাহাজ ঘাটে নোঙর করা। কত দেশের পতাকা উড়ছে জাহাজগুলোর মাথায়। জাহাজী মানুষ মোটরবাইকদের ভীড়। নগরবাসী দু’চারজন শৌখিন লোকও দেখা গেল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ বন্দরে ভিড়ল। কাঠের পাটাতন ফেলা হলো। ফ্রান্সিসের বন্ধুদের আর তর সইছিল না। ছোট ছোট দল বেঁধে দু’দল নেমে গেল পিসা নগর ঘুরে বেড়িয়ে দেখার জন্যে। ফ্রান্সিস আগেই বন্ধুদের বলে দিয়েছিল ইচ্ছে করলে ওরা নগরে ঘুরে আসতে পারে। কতদিন পরে এরকম চোখ ধাঁধানো নগরে এলো ওরা।
কিছু পরে দোনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস, হ্যারি আর মারিয়া নেমে এলো। বন্দর এলাকায় লোকজনের বেশ ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিসরা বড় রাস্তায় এল। বেশ চওড়া পাথর বাঁধানো রাস্তা সুবেশ পুরুষ, মহিলারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাথর, লোহা, কাঠ দিয়ে তৈরি সুন্দর বাড়িঘরদোর। কয়েকটা অট্টালিকা বড় ছোট দোকানপাট। ক্রেতাসাধারণের ভিড়। ঘোড়ায় টানা সুদৃশ্য গাড়ি রাস্তায় চলছে। তাতে অভিজাতশ্রেণীর স্ত্রী-পুরুষ বসে। স্ত্রীলোকদের পোশাকও জমকালো।
দোনিয়া একটা গাড়িভাড়া করল। দু’মুখো আসনে ফ্রান্সিসরা মুখোমুখি বসল। গাড়ি চলল। পাথর বাঁধানো রাস্তায় ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ উঠল-টক-টক-টক্স—
কতদিন পরে এতবড়নগর দেখে সুন্দর পোশাক পরা পুরুষ-মহিলাদের দেখে মারিয়ার খুব ভালো লাগল। আবার মনটা খারাপও হলো নিজের দামি পোশাকটার ছেঁড়াখোরা সেলাই করা চেহারা দেখে। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে দেখল ফ্রান্সিস নগরের লোকজন বাড়িঘর কিছুই দেখছেনা। সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে। নিজের চিন্তায় বিভোর। ফ্রান্সিস, হ্যারির গায়ের পোশাকের অবস্থাও বেশ খারাপ। লিও দেখা যাচ্ছে। মারিয়ার কেমন অস্বস্তি হতে লাগল কিন্তু কথাটা ও ফ্রান্সিসকে বলতে সাহস পেল না।
গাড়ি চলল। একসময় একটা সাদারঙের গির্জার পাশ দিয়ে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকল। কিছুটা যেতে দোনিয়ার নির্দেশে একটা বাড়ির পাথরের দেউড়ির সামনে থামল। ফ্রান্সিসরা নামল। দেউড়ির দরজা দামি কাঠের। কতরকম বিচিত্র রঙিন নকশা দরজায়। আধ ভেজানো দরজা ঠেলে দোনিয়া প্রথম ঢুকল। পেছনে ফ্রান্সিসরা ছোট ছোট রঙিন বাঁধানো পথটা একটা দরজার সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। দুপাশে বেশ সযত্নে তৈরি বাগান। নানা গাছে, বাগানে নানারঙের ফুল ফুটে আছে। ফুলের গন্ধ আসছে বাগান থেকে।
দোনিয়া এগিয়ে গিয়ে দরজায় মৃদু টোকা দিতে দরজা খুলে গেল। দেখা গেল একজন। কাফ্রি যুবক দাঁড়িয়ে আছে। দোনিয়াকে দেখে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল। দোনিয়া জিজ্ঞেস করল, নোবাইল আছেন কি না? কাফ্রি যুবকটি মাথা একটু কাত করে আসতে ইঙ্গিত করল। কাফ্রি যুবকটি ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল। মারিয়া অবাক হয়েই চারিদিকে তাকাতে তাকাতে চলল। মারিয়া তো রাজপ্রাসাদেই মানুষ। কিন্তু এ বাড়ির দেয়ালচিত্র, মেঝেয় বিচিত্র রঙের নকশা করা গালিচা পাতা কারুকাজ করা দরজা-জানালা দেখে বুঝল-এত রঙ এত সাজসজ্জা ওদের প্রাসাদেও নেই।
ডানদিকের একটা খোলা দরজার সামনে যুবকটি দাঁড়িয়ে পড়ল। দোনিয়া ফ্রান্সিসদের ঢুকতে ইঙ্গিত করে নিজেও ঢুকল।
ফ্রান্সিসরা একটি সুসজ্জিত ঘরে ঢুকল। একটা লম্বাটে কাঠের আসনে একজন সাদা দাড়ি-গোঁফওয়ালা ভদ্রলোক বসেছিলেন। আসনে পাখির পালক তৈরি ঝালোরওয়ালা গদিমত। হাতে ধরা একটা লম্বাটে কাগজ পড়ছিলেন। ফ্রান্সিসরা ঢুকতেই ভদ্রলোক কাগজটা পাকিয়ে রেখে একটু দ্রুতই এগিয়ে এলেন দোনিয়ার দিকে। হেসে দোনিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন। দোনিয়া ফ্রান্সিসকে বলল—ইনি নোবাইল শুধু ধনী বা অভিজাত নন বিদ্বানও ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বলল—এঁরা আমার পরম বন্ধু। জাতিতে ভাইকিং।
নোবাইল হেসে এগিয়ে এলেন। ফ্রান্সিস হ্যারিকে জড়িয়ে ধরলেন। মারিয়াকে দেখিয়ে দোনিয়া বলল—ইনি ওঁদের দেশের রাজকুমরী।
নোবাইল সঙ্গে সঙ্গে মাথা বেশ কিছুটা নামিয়ে ডান হাত বাড়ালেন। মারিয়া অভিজাত রীতি অনুযায়ী তার হাতে হাত রাখল। নোবাইল মারিয়ার হাতে আলতো চুমু খেলেন। স্পেনীয় ভাষায় বললেন—আপনাদের শৌর্যবীর্যের কাহিনী আমরা শুনেছি। তবে এই প্রথম পরিচিত হবার সৌভাগ্য হলো।
-–কি যে বলেন—মারিয়া হেসে বলল—আপনারা সম্পদে, জ্ঞানে, গরিমায় আমাদের চেয়ে অনেক ওপরে।
নোবাইল একটু মাথা ঝুঁকিয়ে হাসল। কোনো কথা বলল না। দোনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন—দোনিয়া, আপনি তো জেলে, চাষীদের মধ্যে থাকতেভালোবাসেন, আমাদের এড়িয়ে চলেন। হঠাৎ আমাদের কথা মনে পড়ল।
—কারণ আছে। আপনার গ্রন্থাগারে একটু পড়াশুনো করবো।
—বেশ তো, চলুন-নোবাইল ঘর থেকে বেরিয়ে ডানদিকে চললেন। ফ্রান্সিসরাও পেছনে পেছনে চলল। কাফ্রি যুবকটি তখন আসছিল। নোবাইল মৃদুস্বরে তাকে কি বললেন। তারপর দোনিয়াকে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন—আপনি অন্দরে আমার স্ত্রীর কাছে চলুন।
মারিয়া একবার নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে। অস্বস্তিবোধ করল। কিন্তু ভদ্রলোক যেভাবে বলছেন, না যাওয়াটা অভিজাতমহলের রীতিতে ভালো দেখায় না। মারিয়া নোবাইলের সঙ্গে অন্দরমহলের দিকে চলল।
দোনিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সিসরা গ্রন্থাগারে ঢুকল। দেখল, মোটা কাঠের পাটাতনের ওপর চামড়া বাঁধানো বেশ কিছু বড় বড় গ্রন্থ। একপাশে কাঠের আসনের সামনের চৌকোনো কাঠের ওপর রূপোর দোয়াতদানি, পালকের কলম। কিছু পার্চমেনট কাগজও রাখা আছে।
দোনিয়া এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে একটা তাকের কাছে গেল। একটা মোটা গ্রন্থ তুলে নিল। গ্রন্থটির মলাটে হাতে আঁকা গ্রহ-নক্ষত্রের ছবি। মলাট উল্টেপাতা বের করল। কালির। লেখা শুকিয়ে বেশ অস্পষ্ট হয়ে গেছে। দেখল গ্রন্থটি আরবী ভাষায় হাতে লেখা। গ্রন্থটির ভারী পাতা পেছন থেকে আস্তে আস্তে ওল্টাতে একটা পাতার কাছে এসে দোনিয়া বলল মুবারকের চিঠিটা এখানেই গোঁজা ছিল। জানি না কি করে সেই চিঠিটা এখানে এলো।
হ্যারি, ফ্রান্সিস দু’জনেই পাতাটা দেখতে লাগল। সবাই আরবী ভাষায় লেখা। হ্যারি বলল—দোনিয়া দেখুন তো এই পাতাগুলোয় কি বিষয়ে লেখা আছে।
দোনিয়া পাতাটা উল্টেপাল্টেবলল—জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়েই লেখা, অন্য কিছু নয়।
ফ্রান্সিস চুপ করে ঘরে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর দোনিয়ার কাছে এসে বলল—আচ্ছা এখানকার সব গ্রন্থই কি আপনি পড়েছেন?
—না-না, ইচ্ছে ছিল পড়বার। কারণ গ্রীক আর আরবী ভাষায় হাতে লেখা গ্রন্থগুলি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আগ্রহ ছিল। কিন্তু ঐ চিঠিটা পাওয়ার পর আমি মূর্তি উদ্ধারের কথাটাই ভাবলাম। নিজের জন্যে নয়, গরিব জেলে চাষীদের ভালোর জন্যই ঐ মূর্তিগুলোর বিনিময়ে অর্থসংগ্রহ করবো বলে। আসলে এই চিন্তাটাই এত পেয়ে বসল যে আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না-দোনিয়া হেসে বলল।
ফ্রান্সিস বলল—সন্দেহ নেই আপনার উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। অবশ্য সিপনোলার মতো মানুষেরা সেটা বুঝবে না।
একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল—আমার কিন্তু কেমন মনে হচ্ছে—চিঠিটা অসম্পূর্ণ। একটা কিছু বর্ণনা এর মধ্যে বাদ গেছে।
—তাহলে কি বলতে চাও চিঠিটার অন্য একটা নকল আছে? হ্যারি বলল।
-হ্যাঁ, মুবারক নিশ্চয়ই কোনো খসড়া মতো করেছিল। সেখান থেকে দেখে দেখে ভালোভাবে লিখতে গিয়ে কোনো অংশ বাদ পড়ে গেছে। মুবারক আর মিলিয়ে দেখে নি—ফ্রান্সিস বলল।
সোনিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—প্রায় দুশো বছর আগের কথা। এখন কি ওসবের কোনো হদিশ করা যাবে?
ফ্রান্সিস চিন্তা করে বলল—তা ঠিক, তবে—
হঠাৎ থেমে ফ্রান্সিস বলে উঠল—আচ্ছা আপনি কি সমস্ত গ্রন্থটাই পড়েছিলেন?
দোনিয়া মাথা নেড়ে বলল না—।
চিঠিটা পাওয়ার পর আর পড়তে পারি না। ফ্রান্সিস বলল—তাহলে এবার পড়ুন তো। খুব সয় লাগবে কি?
—না-না, আরবী আমি আমার মাতৃভাষার মতোই পড়তে পারি—দোনিয়া বলল।
তখনই নোবাইল ঘরে ঢুকে বললেন—আপনাদের অসুবিধে ঘটালাম না তো?
দোনিয়া হেসে বলল-না-না-।
—ঠিক আছে, আপনারা কিন্তু আমার অতিথি। দুপুরের খাওয়াটা এখানেই খেয়ে যাবেন। নোবাইল বললেন।
ফ্রান্সিস, হ্যারি এখানকার রীতি অনুযায়ী একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বলল—এতে আমরা সম্মানিত বোধ করবো।
নোবাইল হেসে বললেন—আপনাদের রাজকুমারী আবার লো ল্যাতিন জানেন না। আমাকে গিয়ে তাকে আবার সাহায্য করতে হবে। নইলে অন্দরমহলের মহিলাদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি যাচ্ছি—
নোবাইল চলে গেলেন। দোনিয়া আসনে বসে গ্রন্থটি পড়তে লাগলেন। হ্যারি পাশে বসল। ফ্রান্সিস ঘুরে-ঘুরে পায়চারি করতে লাগল। আবার দাঁড়িয়ে পড়তে লাগল। দোনিয়া ডান থেকে বাঁদিকে পাতা উল্টিয়ে পড়তে লাগল।
হঠাৎ দোনিয়া বলে উঠল—এটা কি? বলে ঝুঁকে পড়ল গ্রন্থটির ওপর। পাশে বসা হ্যারি ও ঝুঁকল। একটা মোটা পাতা দেখিয়ে দোনিয়া বলল—এটাতে এত কাটাকুটি—জড়ানো লেখা, গায়ে গায়ে লেখা—মানে খুব দ্রুত কিছু লেখা। সেইজন্যেই এত কাটাকুটি।
—জ্যোতিষশাস্ত্রের বিষয়ে কিছু লেখা?
—উঁহু, অন্য হাতের লেখা, ভালো করে পড়তেই পারছি না, দোনিয়া বলল।
—কষ্ট করে হলেও পড়তে থাকুন, হ্যারি বলল।
দোনিয়া এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে বলল—ফ্রান্সিস মবারকের লেখা সেই চিঠির দু’একটা পুংক্তি পড়তে পারছি। কোনো সম্বোধন নেই—নীচে লেখকের নামও নেই।
—তার মানে আপনার কাছে মুবারকের যে চিঠিটা আছে এটা তারই খসড়া। ফ্রান্সিস বলে উঠল।
—বোঝা যাচ্ছে, ভুলেই হোক বা যেভাবেই হোক, খসড়াটা গ্রন্থটার সঙ্গে সেলাই করে বাঁধিয়ে ফেলা হয়েছে, হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস মাথার চুলে আঙ্গুল চালাল। বেশ উত্তেজিত গলায় বলল—এবার খসড়াটা সম্পূর্ণ ভালো করে পড়ুন।
দোনিয়া বলল—উঁহু, পড়তে হবে না। শব্দগুলো ধরে ধরে যে জায়গাগুলো পড়া যাচ্ছে না সেগুলো বুঝে নিয়ে লিখতে হবে।
দোনিয়া গ্রন্থটি নিয়ে বসার জায়গায় গেল। সাজিয়ে রাখা একটা পার্চমেন্ট কাগজ টেনে নিল। রূপোর দোয়াতে কলম চুবিয়ে নিয়ে খসড়াটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে থেমে থেমে লিখতে লাগল।
ফ্রান্সিস অনড় দাঁড়িয়ে রইল। হ্যারি ও আর বসে না থেকে উঠে দাঁড়াল।
এসময় মারিয়া ঘরে ঢুকল, পেছনে সেই কাফ্রি যুবকটি। মারিয়া হেসে বলল, এই যে পড়ুয়ারা—গৃহকত্রী তোমাদের খেতে ডাকছেন।
ফ্রান্সিস অনড়। কোনো কথা বলল না। হ্যারি বলল—একটু পরে যাচ্ছি।
দোনিয়া মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল—অনেক সময় লাগবে, চলুন খেয়ে আসা যাক।
দোনিয়া দরজার দিকে চলল। অগত্যা হারি আর ফ্রান্সিসকেও এগোতে হলো। মারিয়াও চলল। ফ্রান্সিসের গম্ভীর মুখ দেখে এতক্ষণে বুঝল ফ্রান্সিসরা সেই চিঠির ব্যাপারে নিশ্চই নতুন কোনো সূত্র পেয়েছে। কিন্তু এই নিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। ও জানে ফ্রান্সিস সময়মতে সব বলবে।
সবাই খাবার ঘরে ঢুকল। লম্বাটে ঘর পাথরের দেয়ালে এখানে-ওখানে নানা রঙের ছবি আঁকা। কোথাও নানা রঙের নকশা আঁকা। মারিয়া, দোনিয়া আগে দেখেছে। কিন্তু হ্যারি, ফ্রান্সিস দেখে নি। হ্যারি বেশ বোকার মতোই চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ছবিগুলো যীশুর জীবনের কয়েকটা ঘটনা নিয়ে আঁকা। ফ্রান্সিস কিন্তু কোনোদিকে তাকিয়ে না দেখে ও সোজা খাবার টেবিলের দিকে চলল।
নোবাইল তার স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে খাবার টেবিলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেন। ফ্রান্সিসরা এলে তারা বসলেন ওক কাঠের গদিওয়ালা চেয়ারে। ফ্রান্সিসরাও বসল। একটুক্ষণ পরস্পরকে পরিচিত করবার নিয়ম মানা হল। টেবিল ছাড়া ছাড়া রঙিন ফুলতোলা সাদা ধপধপে ঢাকনা। খাওয়ার বাসনপত্র ছুরি, কাঁটা চামচ রূপোর। পরিষ্কার ঝকঝকে। রাঁধুনি বুড়ি খাবার নিয়ে ঢুকল। পেছনে একটি অল্পবয়সী মেয়ে। নোবাইল নিজের মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
রূপোর থালায় খাবার পরিবেশন করল রাঁধুনি বুড়ি। তদারক করল নোবাইলের মেয়ে। খেতে খেতে কথাবার্তা চলল। নোবাইল দোনিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন—আপনাদের পড়াশুনো কতদূর এগোল?
—মনে হচ্ছে বিকেল নাগাদ প্রয়োজনীয় তথ্যটা পেয়ে যাবো—দোনিয়া বলল।
—আজকে থাকবেন তো? নোবাইলের স্ত্রী বললেন।
—উঁহু—এই ভাইকিং বন্ধুদের সঙ্গে এসেছি। ওঁদের সঙ্গেই থাকতে হবে, ওঁদের জাহাজেই থাকবো—দোনিয়া বলল।
ফ্রান্সিস চুপচাপ খেয়ে নিল। একটু তাড়াতাড়ি খেলো, মাথায় চিন্তা তো রয়েইছে। তার ওপর এই জাঁকজমক এই দামি ঝকঝকে বাসনপত্র টেবিল ঢাকনা আর ধনী পরিবারের সামনে—এসব ভালো লাগছিল না। খাওয়া হয়ে গেছে অথচ অভিজাত মহলের ভদ্রতা। উঠে যেতেও পারছে না। একটু ভেবে ফ্রান্সিস নোবাইল ও তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো-যদি অনুমতি করেন তাহলে আমি উঠি।
নোবাইলের স্ত্রী কথাটা না বুঝেও অনুমান করলেন। বললেন—আপনি তো প্রায় কিছুই খেলেন না।
লো লাতিন ভাষা। হ্যারি বুঝিয়ে দিলে ফ্রান্সিস হেসে বলল—মানে খুব একটা খিদে নেই। আমাকে মাফ করবেন।
নোবাইল কোনো কথা না বলে মাথা কাত করে সম্মতি জানাল।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে উঠে। চলল গ্রন্থাগারের দিকে। গ্রন্থাগারে ঢুকে ও লেখার আসনের কাছে এলো। দোনিয়া যতটুকু লিখেছে দেখল, বুঝল না কিছুই। মোটা কাঠের তাকে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে।
কিছু পরে দোনিয়ার সঙ্গে হ্যারি আর মারিয়া এলো। দোনিয়া নিজের কাজে মন দিল। ফ্রান্সিস একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল। হ্যারি দোনিয়ার পাশে বসল। মারিয়া একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণে মারিয়ার দিকে ফ্রান্সিসের চোখ পড়ল। ফ্রান্সিস কাছে এসে বলল—মারিয়া আমার কেমন মনে হয়েছিল মুবারকের চিঠিটা অসম্পূর্ণ। এবার মুবারকের চিঠির একটা খসড়া পাওয়া গেছে। দোনিয়া সেই কাটাকুটি করা খসড়াটা পরিষ্কার করে লিখছে। এখন দেখা যাক খসড়াটায় কি ছিল।
—সবটাই তো তোমার অনুমান—মারিয়া বলল।
—তা ঠিক। তবে খসড়াটা পাওয়া গেছে আর সেটা এখানেই পাওয়া গেছে—কাজেই আমার অনুমান কিছুটা মিলেছে। এখন বাকিটুকু।
ফ্রান্সিস কথাটা বলে আবার কাঠের তাকে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। গ্রন্থাগার নিস্তব্ধ। কেউ কোনো কথা বলছে না। দোনিয়া নিজের কাজ করে যাচ্ছে। সময় বয়ে চলেছে। হঠাৎ দোনিয়া আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লেখা কাগজটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল—ফ্রান্সিস আপনার অনুমান সত্যি!
ফ্রান্সিস প্রায় লাফ দিয়ে দোনিয়ার কাছে এলো। বলল-কি ব্যাপার বলুন তো। হ্যারি ও উঠে দাঁড়াল। মারিয়া দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল। চিঠিটাই তো আমার মুখস্থ। সেই চিঠিতে এই কটা পঙক্তি ছুট পড়েছে অর্থাৎ বাদ গেছে।
—সেই পঙক্তিটি বলুন। অধীর আগ্রহে ফ্রান্সিস বলে উঠল। কাগজটা দেখে দেখে দোনিয়া পড়ল—জলে ঝাপাইয়া পড়িবার মুহূর্তে বিদ্যুতের আলোয় বৃষ্টিধারার মধ্যে দিয়ে এক ঝলক ঝাপসা দেখিলাম হাত তিরিশেক দূরে কালো পাথরের বৃষ্টিভেজা দেয়াল মতো।
পড়া শেষ হতেই ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠে। বলল—দেখুন, বলেছিলাম কিনা।
—কিন্তু দেয়াল বলতে কোনো দেয়াল বোঝাচ্ছে? দোনিয়া বলল।
—কেন? ঐ দক্ষিণ দিকের ভাঙা নুরাঘিটার দেয়ালটা—ফ্রান্সিস বলল।
—কিন্তু দক্ষিণ দিকটা মানে খাঁড়ির দিকটা তো প্রায় ধ্বসংস্তূপ—দোনিয়া বলল।
—ভুলে যাবেন না ঘটনাটা দুশো বছর আগেকার। আর ঐ নুরাঘিটা নিশ্চয়ই অটুট অভগ্ন ছিল—ফ্রান্সিস বলল।
—তাহলে—দোনিয়াকে কথাটা বলতে দিল না ফ্রান্সিস নিজেই বলে উঠল—ঐ ভাঙা নুরাঘিটার হাত তিরিশেক দূরে মূর্তিশুদ্ধ নৌকোটা ডুবে গিয়েছিল। এখন আর অতবড় খাঁড়িটার তলায় খুঁজতে হবে না। অল্প জায়গাটা তো পেয়ে গেলাম। এবার আমাদের চেষ্টা পরিশ্রম। এবার হ্যারি বলল—তাহলে ফ্রান্সিস এখন কি করবে?
—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সার্দিনিয়া ফিরে যাবো-ফ্রান্সিস বলল। তারপর সোনিয়াকে বলল—আপনি নোবাইলকে বলুন—আমরা এখন জাহাজে ফিরে যাবো।
দোনিয়া চলে গেল। আসন থেকে ফ্রান্সিস লেখা কাগজটা তুলে মারিয়াকে দিল। বলল—এটা যত্ন করে কেবিনঘরে রেখে দিও। মারিয়া চিঠির কাগজটা নিল।
বিদায় নেবার সময় হলো। ফ্রান্সিসরা বাড়ির বাইরে এলো। পেছনে নোবাইল, তার স্ত্রীও এলেন। নোবাইল বারবারই বললেন—অতদূর দেশ থেকে আপনারা এসেছেন। আপনাদের সঙ্গে ভালো করে কথাই বলা হলো না। অনুরোধ রইল—দেশে ফেরার আগে একবার এখানে আসবেন।
ফ্রান্সিস হেসে মাথা একটু ঝুঁকিয়ে সম্মান জানিয়ে বলল—আপনার আপ্যায়ন আমরা ভুলবো না। কয়েকদিন থাকতে পারলে আমাদের বিশেষ করে রাজকুমারী মারিয়ার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু বিশেষ একটা প্রয়োজনে আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরতে হবে।
—না না, আপনাদের দেরি করিয়ে দেওয়া উচিত হবে না—নোবাইল বলল। ফ্রান্সিস চিলতে পথটা ধরে দেউড়ির কাছে এসে দেখল—দরজা খুলে দিয়ে সেই যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস যুবকটির পিঠে হাত রেখে মাথা কাত করে বোঝাল ওরা যাচ্ছে। কাফ্রি যুকটি এতক্ষণে হাসল। ঝকঝকে দাঁত ওর। মাথা একটু ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল।
ফ্রান্সিসরা বড় রাস্তায় এলো। দোনিয়ায় এদিক-ওদিক ঘুরে একটা ভাড়াগাড়ি নিয়ে এলো। ফ্রান্সিসরা গাড়িতে উঠে চলল জাহাজঘাটার দিকে।
পিসা নগরের বড় বড় রাস্তা বড় বড় অট্টালিকা, সুবেশ নারীপুরুষদের দেখে মারিয়া যেন আপনমনেই বলল—কটা দিন থাকা যেত না?
পাশে-বসা ফ্রান্সিস হেসে বলল—মারিয়া, তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু মূর্তি উদ্ধার ছাড়া আমি এখন আর কিছুই ভাবতে পারছি না।
বিকেল নাগাদ ফ্রান্সিসরা জাহাজঘাটায় এলো। ভাইকিং বন্ধুরা সবাই তখনও ফেরেনি। ফ্রান্সিসের চিন্তা হলো। ও চাইছিল তাড়াতাড়ি সার্দিনিয়া ফিরে যেতে। অনেক কাজ বাকি। এত চিন্তাভাবনা করে সূত্র যখন একটা পাওয়া গেছে, দেখা যাক পরীক্ষা করে। কিন্তু বন্ধুরা কতদিন পরে পিসার মতো একটা জমকালো নগর দেখছে। ওদের তো সাধ হচ্ছে ঘুরে বেড়াতে। একটু আনন্দ ফুর্তি তো করবেই।
অগত্যা কেবিনঘরে ফিরে ফ্রান্সিস কাঠের দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসল। বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
মারিয়া জাহাজের রেলিং ধরে পিসার জাহাজঘাটায় লোকজন দেখতে লাগল।
সন্ধের সময় বন্ধুরা দু’জন চারজন দল মিলে ফিরে আসতে লাগল।
হ্যারি এলো ফ্রান্সিসের কাছে। বলল—সবাই তো আরো দু’একদিন এখানে থাকতে চাইছে। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল—অসম্ভব। সবাই ফিরলেই জাহাজ ছাড়তে হবে।
রাতের খাওয়াদাওয়ার আগেইসব ভাইকিং বন্ধুরা ফিরে এলো। ফ্রান্সিসের কথা শুনল সবাই। উপায় নেই, ফ্রান্সিস বলেছে। কাজেইখুবইচ্ছে থাকলেও এইনগরে আর থাকা যাবেনা।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হতে ঘর ঘর শব্দে নোঙর তোলা হলো। বাতাসের তেমন জোর নেই। পাল খাটানো হলো। সব পালগুলো। কিন্তু জাহাজ ধীরে চলল! ফ্রান্সিস তখন ডেক-এ উঠে এসেছে। বুঝল, জাহাজের গতি বাড়াতে হবে। ও বিস্কোকে ডেকে বলল—দাঁড় বাইতে বলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের সার্দিনিয়া পৌঁছাতে হবে।
সারারাত জাহাজ চলল। কিন্তু বাতাসের জোর বাড়ল না। দাঁড় টেনে যতটা জোরে চলার চলল। মাস্তুলের মাথায় নজরদার পেড্রো চারদিকে নজর রাখতে লাগল। বলা যায়
-জলদস্যুদের পাল্লায় পড়তে হতে পারে। আগে থেকে বুঝতে পারলে সাবধান হওয়া যাবে। তাছাড়া দোনিয়া বলছে এই অঞ্চলে ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের অস্তানা আছে। কাজেই চারদিকে নজর রাখা—আগে থেকে সাবধান থাকা।
পূর্ব আকাশে রঙ ফিরতে লাগল। লাল হয়ে উঠল। একটু পরেই সূর্য উঠল। সকালের নরম আলো সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর ছড়ালো। ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে লাগল। কিন্তু হাওয়ার জোর বাড়ল না।
হঠাৎ পেড্রোর নজরে পড়ল পূর্বদিকে বেশ দূরে একটা নৌকো ভাসছে। পেড্রো ভালোভাবে চোখ কুঁচকে দেখতে লাগল। নৌকোটার একটা ধার ভাঙা। সেদিকে দু’পা ছড়িয়ে একটা মানুষ নৌকোর গলুইয়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মা মেরিও জানে না মরে গেছে না বেঁচে আছে।
পেড্রো মাস্তুল থেকে নেমে এলো। ডেক-এ শুয়ে থাকা কয়েকজন ভাইকিংদের মধ্যে দু’একজন মাত্র উঠে বসেছে। পেড্রা তাদের ভাঙা নৌকো আর মানুষটার কথা বলল। ওরা রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। ঘুম ভেঙে আরো কয়েকজন এসে ভিড় করে দাঁড়াল। পেড্রো এবার ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। সব শুনে ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে এলো। ততক্ষণে হ্যারি, বিস্কোরাও খবর পেয়ে ডেক-এ উঠে এলো।
সবাই তাকিয়ে রইল আধাভাঙা নৌকোটার দিকে। একটুক্ষণ তাকিয়ে দেখে নিয়ে ফ্রান্সিস জাহাজচালক ফ্লাইজারের কাছে এলো। ফ্লাইজারকে দূরের আধাভাঙা নৌকোটার দিকে জাহাজ চালাতে বলল। নৌকোটায় একজন মানুষ আছে, ওকে বাঁচাতে হবে।
ফ্লাইজার জাহাজের মুখ ঘোরাল। জাহজ চলল ঐ আধভাঙা নৌকোটার দিকে। কাছাকাছি এলো ফ্রান্সিসরা জাহাজ থেকে দেখল যে নৌকোর একটা ধার ওপরের দিকে হাত দুয়েক ভেঙে গেছে। তবে নৌকোয় জল ওঠে নি, তাই ডুবে যায় নি। ঢোলা হাতা সবুজে রঙের জোব্বামতো গায়ে একটা লোক গলুইয়ে অসাড় পড়ে আছে। সর্বাঙ্গ জলে ভেজা।
ফ্রান্সিস বিস্কোকে বলল—কি ব্যাপার দেখতে। বিস্কো দড়ির মইটা জাহাজ থেকে নৌকোটার কাছে ফেলল। মই বেয়ে নৌকোটার ওপর নেমে এলো। ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলছে নৌকোটা। ঐ দুলুনির মধ্যেই বিস্কো লোকটার নাকের সামনে হাত রাখল। ক্ষীণ শ্বাসপ্রশ্বাস বইছে। বসে পড়ে বুকে কান ঠেকাল। মৃদু ধ ধ শব্দ। বিস্কো উঠে দাঁড়াল। রেলিঙের ধারে দাঁড়ানো ফ্রান্সিসদের হাতের ইঙ্গিতে বোঝাল—লোকটা বেঁচে আছে, দড়ির জালমতো ফেলতে বলল।
জাহাজ থেকে সেটা নামিয়ে দেওয়া হলো। বিস্কো দেশ কসরৎ করে লোকটাকে তুলে জালে বসিয়ে দিল। জাহাজ থেকে ভাইকিংরা ওটা ধরে টেনে টেনে তুলতে লাগল। বিস্কো দড়ির মই বেয়ে উঠে এলো।
লোকটাকে প্রথমে ডেক-এর ওপর শুইয়ে দেওয়া হলো। তখনও লোকটা চোখ বুজে রয়েছে। তারপর কয়েকজন মিলে ওকে কেবিনঘরে নিয়ে গেল। ভেজা পোশাক ছাড়িয়ে শুকনো পোশাক পরানো হলো। বৈদ্যি ভেন লোকটার কপালে গলায় নীলমতো মলম মাখিয়ে দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে টিপতে লাগল।
একটু পরে একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোকটা চোখ মেলে তাকাল। ভেন মুখ নীচু করে স্পেনীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করল—তুমি কে? কি হয়েছিল তোমার?
লোকটা তাকিয়েই রইল। তারমানে ভাষা বোঝেনি। এবারহ্যারি থেমে থেমে লো লাতিন ভাষায় একইকথা জিজ্ঞেস করল। এবার লো লাতিন ভাষায় লোকটা বলল—জাহাজডুবি।
ফ্রান্সিস ভেনকে বলল—দেখো তো, অসুখটা কেমন?
মারাত্মক কিছু না। অনাহার জল তেষ্টায় কাহিল হয়ে পড়েছে।
ফ্রান্সিস, হ্যারির দিকে তাকাল। বলল ওর খাওয়া-দাওয়া বিশ্রামের ব্যবস্থা করো, পরে শুনবো সব।
ভেন-এর ওষুধ খেয়ে দুপুরে খেয়েদেয়েই ইগনোতি সন্ধের আগেই অনেকটা সুস্থ, হলো। হ্যারি ইগনোতির সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানতে পারল—রাতের ঘন কুয়াশার মধ্যে ওদের জাহাজ একটা ডুবো পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গিয়েছিল। ও নিজে একটা ধাক্কা খেয়ে আধভাঙা নৌকোয় চড়ে। কোনোরকমে সমুদ্রে ভেসে পড়েছিল। কতদিন নৌকোয় ছিল, সেটা ইগনোতির মনে নেই।
রাতে খাওয়াদওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়েছে। বিকেল থেকেই বাতাসের জোর বেড়েছে। দাঁড় বাইতে হচ্ছেনা। যে কেবিনঘরে ইগনোতিকে রাখা হয়েছিল সেই কেবিনঘরে চারজন ভাইকিং ছিল। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ কেবিনঘরের দরজায় ঠক্ করে শব্দ হতে একজন ভাইকিং-এর ঘুম ভেঙে গেল। দেখল অন্ধকারে ইগনোতি দরজা বন্ধ করছে। তারপর বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। একবার ভাইকিংটি ভাবল ইগনোতিকে জিজ্ঞেস করে ও বাইরে গিয়েছিল কিনা। কিন্তু ইগনোতি তো ওর ভাষা বুঝবে না। কাজেই ভাইকিংটি পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোর হলো। সকালের খাওয়াদাওয়া চলছে তখনই রাঁধুনি ভাইকিংটি খাবার জলের পিপের ঢাকানা খুলে দেখল জল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পরপর সাজানো চারটে পিপের একটিতে কম জল ছিল। ও বুঝে উঠতে পারল না জল এত কমে গেল কি করে। রান্নার জায়গার পাশে যেখানে জলের পিপেগুলো রাখা হয়, সেখানে দেখা গেল জায়গাটা জলময় হয়ে গেছে। এত জল নষ্ট হলো কি করে? রাঁধুনি ভাইকিং ওর সাহায্যকারী ভাইকিং বন্ধুকে বলল সেকথা। দুজনেই অবশিষ্ট জলের পরিমাণ দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। দু’জনে পিপেগুলো তুলে ঘুরিয়ে দেখল—পিপেগুলোয় ফুটো হয় নি। অথচ এত জল পড়ে গেল কি করে? ওরা ভেবে পেল না কি করে হল এটা।
রাঁধুনি ছুটল ফ্রান্সিসের কাছে। সকালের খাওয়ার পর সবাই তখন জল খেতে চাইছে। রাঁধুনির সাহায্যকারী একটা পিপে থেকে সবাইকে জল দিল। পিপেটা প্রায় খালি হয়ে গেল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে রান্নাঘরে এলো। পিপের ঢাকানা খুলে জলের পরিমাণ দেখল। চিন্তায় পড়ল ফ্রান্সিস এখন খাবার জলে টান পড়লে তো বিপদে পড়তে হবে। এতজনের প্রয়োজনীয় জল এখন কোথায় পাওয়া যাবে? ফ্রান্সিস বাঁধুনিকে বলল—পিপের ফাটা জায়গা দিয়ে চুঁইয়ে জল পড়ে যায় নি তো।
রাঁধুনি বলল-না। কোথাও ফাটা চোখে পড়েনি। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি দোনিয়ার কাছে এলো। খাবর জলের সঙ্কটের কথা বলল। সব শুনে দোনিয়া বলল—এই অঞ্চলটা আমার ঠিক পরিচিত নয়। তবে আমরা বোধহয় কর্সিকা দ্বীপের কাছে এসেছি।
—কর্সিকা দ্বীপের কোনদিকে পড়বে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
—বাঁ দিকে, দোনিয়া বলল—উত্তর কর্সিয়ার থামতে পারলে হয়তো খাবার জল পাওয়া যাবে।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। জাহাজচালক ফ্লাইজারকে এসে বলল-বা দিক মানে পূর্বদিকে জাহাজ চালাও। কালকের মধ্যে যে করে হোক কর্সিকার উত্তরে কোথাও পৌঁছাতে হবে।
—যা জল আছে তাতে আর কটা দিন যাবে না? ফ্লাইজার বলল।
—জলের তেষ্টা নিয়ে ক’দিন কাটানো যায় বলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জল জোগাড় করতে হবে—হ্যারি বলল।
—ঠিক আছে—ফ্লাইজার বলল। তারপর দু’তিনজন ভাইকিং বন্ধুকে ডেকে বলল—পাল ঘোরাও, জাহাজ বাঁদিকে ঘুরবে।
বন্ধুরা মাস্তুল বেয়ে পাল খাটানোর কাঠের টানায় উঠে দড়ি টেনে পাল ঘোরানোর কাজে লাগল। ফ্লাইজার ততক্ষণে শক্ত হাতে হুইল ঘোরাতে লাগল। আস্তে-আস্তে জাহাজের মুখ পুবমুখে হলো।
ফ্রান্সিস দড়িতে ধরে পা রেখে মাস্তুলের কিছুটা ওপরে উঠে। চেঁচিয়ে ডাকল-পেড্রো।
পেড্রো নীচের দিকে তাকাতে। ফ্রান্সিস বলল-ডাঙা দেখলেই বলবে।
পেড্রো চেঁচিয়ে বলল—ঠিক আছে।
ফ্রান্সিস মাস্তুল বেয়ে নেমে এলো। হ্যারি বলল—দাঁড় টানতে হবে। এখন গতি অনেক বাড়াতে হবে।
—তা’ ঠিক, কিন্তু হ্যারি-বন্ধুরা যারা দাঁড় টানবে তারা অল্পক্ষণের মধ্যে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে। বারবার জল খেতে চাইবে। বেশি জলের চাহিদা মেটাতে এই জলটুকুও ফুরিয়ে যাবে—ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে বলল—সত্যি এটা আমি ভাবিনি।
—কাজেই গতি বাড়াবার প্রশ্ন নেই। এখন বাতাসই ভরসা। ফ্রান্সিস বলল।
এবার হঠাই ফ্রান্সিসের মনে হলো—আচ্ছা ইগনোতিকে জিজ্ঞেস করে এলাকার কোথায় জল পাওয়া যাবে তার হদিশ করা যায় কিনা।
ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি চলো তো, ইগনোতিকে জিজ্ঞেস করা যাক ও কোনোভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে কিনা।
দু’জনেইগনোতিকে যে কেবিনঘরে রাখা হয়েছে সেই ঘরে এলো। দেখল—ইগনোতি অনেক সুস্থ এখন। তবে কথাবর্তা বলছে না। কার সঙ্গেই বা কথা বলবে। ওর কথা তো কেউ বুঝবে না। হ্যারিইগনোতিকে জিজ্ঞেস করল—আচ্ছা ইগনোতি—আমরা কি কর্সিক দ্বীপের কাছাকাছি এসেছি?
—তা তো ঠিক বলতে পারবো না তবে কর্সিকা দ্বীপের উত্তর দিকটা আমি মোটামুটি চিনি। এখানে আমি অনেকবার ব্যবসার ব্যাপারে এসেছি।
—তরে তো এখানে কোথায় জল পাওয়া যাবে তাও তুমি জানো? হ্যারি বলল।
—হ্যাঁ, জানি-ইগনোতি বলল।
হ্যারি কথাগুলো ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিস বলল—তাহলে এখন আমাদের কর্সিকা দ্বীপের উত্তরে পৌঁছুতে হবে।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। জলের পরিমাণ আরো কমে গেল।
ফ্রান্সিসের চিন্তা বাড়ল। ওদিকে কোনোরকমে খাওয়াদাওয়া সেরেই পেড্রো মাস্তুলেরওপরে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়েছে। নজর রাখছে চারদিকে যদি ডাঙার দেখা পাওয়া যায়।
সন্ধে হয়ে এলো। অন্ধকার তেমন ঘন নয়। একটু পরেই পূর্ব দিগন্তের দিকে অনুজ্জ্বল চাঁদটা উজ্জ্বল হতে লাগল। চাঁদের আলো ছড়ালো সমুদ্রের বুকে।
জাহাজ চলেছে। তখনও ডাঙার দেখা নেই।
রাতের খাওয়াদাওয়ার সময় হলো। এবার জলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কথা ফ্রান্সিস সবাইকে জানাবে ভাবল। হ্যারিকে বলল সে কথা। হ্যারি বলল-তাহলে কি সবাইকে ডেক-এ আসতে বলবো?
ফ্রান্সিস বলল—বেশ—সবাইকেই তো সমস্যাটার কথাটা জানাতে হবে।
হ্যারি সবইকে খবর দিল। আস্তে আস্তে ভাইকিং বন্ধুরা এসে ডেক-এ জড়ো হলো। ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে উঠে এলো ডেক-এ। বন্ধুরা তখনও পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিল ফ্রান্সিস আর হ্যারি আসতেই চুপ করলো সবাই। ফ্রান্সিস বলতে লাগল—ভাইসব, তোমরা এরমধ্যেই নিশ্চয়ই জেনেছো যে জাহাজে জলাভাব দেখা দিয়েছে। কিভাবে জল এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল আমরা জানি না। যাহোক—সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি জল যতটা সম্ভব কম খাবে। যেটুকু জল আছে তাতে যে কটা দিন সম্ভব চালাতে হবে। এই কষ্টটুকু সবাইকে স্বীকার করে নিতে হবে। ফ্রান্সিস থামল।
বন্ধুদের একজন বলল—কিন্তু জল না খেয়ে আমাদের কতদিন আর চলবে।
ফ্রান্সিস বলল—আমরা জেনেছি যে কর্সিকা দ্বীপ কাছেই। ওখানে পৌঁছতে পারলে আমরা জল সংগ্রহ করতে পারবো। ততক্ষণ পর্যন্ত বুক দিয়ে তোমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হবে। জলতৃষ্ণা সহ্য করতে হবে। বন্ধুরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল-ও-হো-হো। সভা ভেঙে গেল।
রাতের খাওয়াদাওয়ার পর সব ভাইকিং বন্ধুরাই অল্প করে জল খেল। কেউ কেউ খেল না। রাত বাড়তে লাগল। সব ভাইকিং বন্ধুরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। ও কেবিনঘরের বিছানায় এই শুয়ে পড়ছে পরক্ষণেই উঠে পড়ছে। ডেক-এ উঠে আসছে, পূর্বদিকে তাকিয়ে থাকছে। মারিয়া লক্ষ্য করল সেটা। ডেক থেকে ফ্রান্সিস ফিরে আসতে মারিয়া জিজ্ঞেস করল—বারবার উঠে পড়ছ কেন।
ফ্রান্সিস বলল—জানো তো জাহাজে পানীয় জল ফুরিয়ে আসছে। ডাঙায় পৌঁছাতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
তখনই পেড্রো চেঁচিয়ে বলে উঠল—ডাঙা—ডাঙা, দেখা যাচ্ছে। ডেক-এ শুয়ে থাকা কয়েকজন ভাইকিং-এর কানে গেল কথাটা। ওরা রেলিঙের ধারে এলো। দেখল, চাঁদের কুয়াশার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট উঁচু-নীচু ডাঙা দেখা যাচ্ছে।
একজন ভাইকিং ছুটল ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। খবর পেয়েই ফ্রান্সিস হ্যারিকে গিয়ে ডেকে তুলল। চিন্তায় হ্যারি রও ঠিক ঘুম আসছিল না। দু’জনেই ডেক-এ উঠে এলো। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখল উঁচু-নিচু ডাঙা। কিন্তু জাহাজ কোথায় ভেড়ানো হবে জলের হদিশ কোথায় পাওয়া যাবে? ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল সেকথা। হ্যারি বলল—এখন ইগনোতির সাহায্য নিতে হবে। ওকে ডেকে আনছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হ্যারি ইগনোতিকে ডেকে নিয়ে এলো। হ্যারি বলল—ইগনোতি, ঠিক কোন্ জায়গাটায় নামলে আমরা খাবার জলের হদিশ পাবো? তুমি চিনে নিয়ে ঠিক
জায়গাটা বের করতে পারবে?
ইগনোতি তীরভূমির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল—আরো কাছে যেতে হবে। জাহাজটা আস্তে আস্তে তীরভূমির অনেকটা কাছে চলে এলো। ইগনোতি তীরভূমির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল—ঐ যে টিলার মাথায়, ঝাঁকড়া গাছের জঙ্গল ওখানটায় নামতে হবে। ওখান থেকে কিছুটা গেলেই ছোট পাহাড়ি ঢল। ওখানে একটা ঝর্ণও আছে।
হ্যারি কথাটা ফ্রান্সিসকে বুঝিয়ে বলল।
জাহাজটা ততক্ষণে টিলার কাছাকাছি এসেছে। জাহাজ আর যেতে পারবে না। ফ্লইজার ততক্ষণে জাহাজ থামিয়েছে। ফ্লাইজারের কাছে এলো ফ্রান্সিস বলল—জাহাজ কি তীরে ভেড়ানো যাবেনা?
ফ্লাইজার বলল—এখানে জলের গভীরতা নেই। মাটিতে জাহাজ আটকে গেলেই বিপদে পড়তে হবে।
ফ্রান্সিস এসে হ্যারিকে বলল—জাহাজ আর যাবেনা। নৌকোর পিপে নিয়ে জল আনতে যেতে হবে। তুমি ইগনোতিকে সেকথা বলো। হ্যারিই ইগনোতিকে কথাটা ব। তারপর বলল—আমরা নৌকোয় চড়ে জল আনতে যাবো। তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারবে?
ইগনোতি মাথা কাত করে জানালো পারবে। তারপর জাহাজটা যখন টিলার কাছে এলো তখন ইগনোতি হাত দিয়ে একটা জংলা গাছের মাথা দেখাল।
এবার তিনটে পিপে একটা নৌকোয় তোলা হলো। অন্য পিপেটায় এখনও সামান্য জল রয়েছে। কষ্ট করে হলেও দু’একটা দিন তো যাবে। ওটা আর ওরা নেবে না ঠিক করল।
যখন ফ্রান্সিস, শাঙ্কো আর হ্যারি ওদের নৌকোয় নামতে যাবে, তখনই দোনিয়া এলো। দোনিয়া ইগনোতিকে আশ্রয় নেবার ব্যাপারটা জানতো না। তাই ইগনোতিকে ফ্রান্সিসদের সঙ্গী হতে দেখে দোনিয়া ফ্রান্সিসকে ইগনোতির কথা জিজ্ঞেস করল। ফ্রান্সিস ইগনোতির জাহাজডুবি হয়ে এসে ওদের জাহাজ আশ্রয় নেওয়ার কথা বলল। দোনিয়া এবার ইগনোতির দিকে তাকাল। দেখল—এখানকার চাষিদের মতোই ওর পোশাক। দোনিয়া ইগনোতির সঙ্গে কথা বলতে লাগল। একটু আঞ্চলিক ভাষার মিশেল থাকায় হ্যারি ঠিক বুঝল না। দোনিয়া কথা শেষ করে ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল—লোকটার কথাবার্তা শুনলাম। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে—লোকটা ঠিক কথা বলছে না। আপনাদের বিপদ হতে পারে।
উপায় নেই দোনিয়া। জাহাজের এতগুলো মানুষের তো খাবার জল চাই। এই অচেনা অজানা জায়গায় কোথায় খুঁজে পাবো জল। একমাত্র ইগনোতিই পারে ঠিক জলের সন্ধান দিতে—ফ্রান্সিস বলল।
দোনিয়া শুধু বলল সাবধানে থাকবেন। পিপে বসানো নৌকোটায় শাঙ্কো উঠল। অন্য নৌকোটায় ফ্রান্সিস আর হ্যারি দাঁড় টেনে চলল ওরা। তখন চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। ঢেউয়ের ওপর চাঁদের আলো চিকচিক্ করছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
তীরের কাছাকাছি একটা জায়গা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে ইগনোতি বলল—ঐ জায়গায় নামতে হবে। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল সেকথা। ফ্রান্সিস সেই ঢালু জায়গাটায় নৌকো লাগিয়ে। নামল তিনজনে। বেশ ভেজা কাদামাটি। জোয়ারের সময় বোধহয় ডুবে যায়। কাদার ওপর দিয়ে চলল তিনজনে। ফ্রান্সিস ঠিকই করেছিল আগে জলের জায়গাটার হদিশ করবে। তারপর ফিরে এসে পিপেগুলো নিয়ে যাবে।
কাদায় পা ডুবে যেতে লাগল। একটু এগোতেই আর কাদা নেই, শক্ত জমি। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল ওখান থেকে একটা সরু পায়ে চলা পথের মতো, তার মানে এই পথটা দিয়ে লোকজনের যাতায়াত আছে।
একটু এগিয়েই গাছপালার জঙ্গল। অবশ্য পথটা দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। চলল ওরা। উত্রাই পড়ল। ফ্রান্সিস ভাবল—তার মানে এখানে পাহাড়-টাহাড় মতো আছে। পাহাড়ি এলাকায় ঝর্ণার জল পাওয়া যাবে।
উৎরাই শেষ হতেই দেখা গেল একটা পাথরের লম্বাটে ঘর। ঘরের গরাদ দেওয়া জানালায় আলোর আভাস নেই। ফ্রান্সিস ঠিক বুঝল না জায়গাটা বসতি এলাকা কিনা। একটাই মাত্র ঘর। ওরা ঘরের কাছকাছি আসতেই হঠাৎ ঐ ঘরটা থেকে দ্রুতপায়ে কারা ছুটে আসতে লাগল। ফ্রান্সিসরা নিরস্ত্র অবস্থায় এসেছিল। জল খুঁজতে সঙ্গে তলোয়ার আনা প্রয়োজন মনে করে নি। শাঙ্কো বিপদ আঁচ করে সঙ্গে সঙ্গে জামার গলার মধ্যে বড় ছোরাটা কোমর থেকে খুলে ভেতরে ঢুকিয়ে রাখল।
লোকগুলো তখন অনেক কাছে এসে পড়েছে। চাঁদের আলোয় ওদের হাতের খোলা তলোয়ার যেন ঝলসে উঠছে। ফ্রান্সিসের মনে পড়ল দোনিয়ার কথা। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। ফ্রান্সিস চাপাগলায় বলল-কেউ বাধা দিওনা।
লোকগুলো মূরজাতীয়, কাফ্রিও আছে। বিশাল বলিষ্ঠ শরীর। হ্যারি চিৎকার করে লো ল্যাতিন ভাষায় বলল—আমরা লড়াই চাইনা, আমরা নিরস্ত্র। ওদিকে ইগনোতিকে দেখা গেল নিশ্চিন্তে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। যোদ্ধার দল তখন ফ্রান্সিসদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ইগনোতি ওদের কি বলল। যোদ্ধার দল তলোয়ার নামাল। তারপর ফ্রান্সিসদের পেছনে এসে ঘিরে দাঁড়াল। একজন যোদ্ধা তলোয়ার উঁচিয়ে ওদের সেই পাথরের বাড়ির দিকে যেতে ইঙ্গিত করল।
ফ্রান্সিসদের ঘিরে নিয়ে চলল সবাই। এবার ইগনোতির দিকে ফ্রান্সিসের নজর পড়ল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—ইগনোতিকে বলো তো, ও এই অমানবিক কাজটা করল কেন?
হ্যারি কথাটা ইগনোতিকে বলল। ইগনোতি কথাটার খুব একটা গুরুত্ব দিল না। আসলে ওর মতলব তো হাসিল হয়েছে। ওর কাজই হলো ওদের দাস ব্যবসায়ীদের কাছে লোকজন ধরে আনা। তারজন্যে ও মূল্য পায়। সেইজন্যেই এভাবে ও মানুষ ধরার জাল ফাঁদে।
ফ্রান্সিসদের সেই ঘরে ঢোকানো হলো। দেখা গেল অনেক যোদ্ধা ঘরটায় শুয়ে-বসে আছে। এককোণে কাপড় ঢাকা গদীমতো। একজন বেশ বলিষ্ঠ লোক শুয়ে আছে। ফ্রান্সিসদের দেখেই লোকটা উঠে বসল। যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে লো লাতিন ভাষায় বলল—ভালো শিকার ধরেছিস। চড়া দামে বিকোবে। বলল-তোর পাওনা নিয়ে যাস। ইগনোতি দাঁত বের করে হাসল।
তলোয়ারের ডগা দিয়ে একরকম ঠেলেঠুলে রক্ষীর দল ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল ঘরটার বাইরে। ঘরটার বাইরে আসতেই দেখা গেল কাঠের মোটা খুঁটি পুঁতে মোটা লোহার জাল মতো। তার মধ্যে দিয়ে হাত গলে যাবে মাথা গলবে না।
অন্ধকারে পশুর খাঁচার মতো লাগছে দেখতে। একজন রক্ষী গিয়ে দু’দিকের দুটো তালা খুলে ফেলল। ফ্রান্সিসদের ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। দড়ি দিয়ে লোহার সঙ্গে ফ্রান্সিসদের হাত বেঁধে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
এতক্ষণে ফ্রান্সিস ভেতরটা দেখল। অন্তত জনা দশ-পনেরো লোক ওদের মতোই বন্দি অবস্থায় বসে আছেনয়তো লোহার খুঁটির ওপর এলিয়ে পড়ে আছে। তাদের গায়ে শতছিন্ন পোশাক। তবে অধিকাংশই সুস্থদেহী। কারণটা ফ্রান্সিস অনুমান করল। ঐ বলিষ্ঠ লোকটা দাস ব্যবসায়ী। সুস্থ দাস ভালো দামে বিক্রি হবে। কাজেই সুস্থ রাখা চাই। কিছু বন্দি আবার রোগাক্রান্ত। বোঝাই যাচ্ছে ভয়ানক অসুস্থ। অন্ধকারে এক নরকের মতো দৃশ্য। পায়ের নীচে মাটি লালচে। বন্দিদের পায়ের চাপে ধুলোটে।
ফ্রান্সিসরা বসে পড়ল। বন্দিরা কাছাকাছি দেশগুলোর লোক, কাফ্রিও আছে। সংখ্যায় তারাই বেশি। ফ্রান্সিস অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝল পাহারাদারের সংখ্যা অন্তত ছ’সাতজন। বোধহয় আগে কিছু বন্দি পালিয়েছিল। তাই এত কড়াকড়ি।
ওদিকে তার এক চিন্তা। জাহাজে পানীয় জল ফুরিয়ে এসেছে। ওরা তে পিপে ভরে জল নিয়ে যেতে পারলনা। কালকে থেকেই হয়তো নির্জলা কাটাতে হবে ওদের। এতগুলো মানুষ জন্তুজানোয়ারের মত শুয়ে-বসে আছে। কেউ কথা বলছে না মৃতদেহের স্তূপ যেন নিস্তব্ধ চারদিক।
—শাঙ্কো মৃদুস্বরে বলল—ফ্রান্সিস ছোরা লুকিয়ে রেখেছি। কি করবে?
দাঁড়াও—কালকের দিনটা দেখি। কত লোকজন এদের-সেটা এখনও বুঝতে পারছি না। এখানে আমরা সবাই তো নিরস্ত্র। ওদের সংখ্যাটা কত, অস্ত্রশস্ত্র কেমন সেটা আগে আঁচ করে নি। তারপর পালাবার ছক কষবো—ফ্রান্সিস বলল।
ভোর হলো। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। অনেক বন্দিই তখন ঘুম ভেঙে বসেছে। কেউ লোহার খুঁটিতে কাঁধ রেখে মুখ ঝুঁকিয়ে ঘুমিয়ে আছে তখনও।
সকালের আলো পড়ল বন্দিশালায়। এবার স্পষ্ট দেখা গেল বন্দিশালার নারকীয় পরিবেশ। কারো গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া জামা, অনেকেরই খালি গা—শুধুমাত্র কৌপিনের মতো কোমর পরা কাপড়ের টুকরো।
শাঙ্কোর পাশেই শুয়েছিল একটা বিশাল চেহারার কাফ্রি। সে ঘুম ভেঙে উঠে বসল। বিরাট এক হাই তুলল। তারপর শাঙ্কোকে নতুন মানুষ দেখে জিজ্ঞেস করল-জালে ধরা পড়লে কী করে?
কথাটা বুঝল না শাঙ্কো। আঙ্গুল দিয়ে হ্যারিকে দেখাল। লোকটা হাসল। এবার হ্যারিকে লোল্যানি ভাষায় জিজ্ঞেস করল—কোথাকার লোক তোমরা? এক নরক কুন্ডে এসে জুটলে কী কবে?
কথাটা আঞ্চলিক ভাষা মেশানো। তবে হ্যারি মোটামুটি বুঝল, বলল যে ওরা ভাইকিং জাহাজে জলাভাব—ইগনোতি জলের হদিশ দিতে ওদের নিয়ে এসেছিল। ইগনোতি নামটা শুনে লোকটার মুখ কঠিন হলো। কপালের শিরা ফুটে উঠল। বলল ইগনোতি একটা নরকের কীট। সুযোগ পেলে ওটাকে আমি হাতের কাছে যা পাবো, তাই দিয়ে হত্যা করবো।
-ইগনোতিরই তাহলে এই জঘন্য কাজ? হ্যারি বলল।
—হ্যাঁ। এই দরিয়া দিয়ে যেসব জাহাজ যাতায়াত করে ও মাঝেমাঝেই জাহাজডুবির গল্প ফেঁদে সেইসব জাহাজে আশ্রয় নেয়। অসহায় মুমূষু মানুষকে দেখে লোকের তো করুণা হবেই। ওরা ওকে জাহাজে তুলে নেয়। এটাই হল ইগনোতির আসল কাজ। গোপনে। ও জাহাজের মজুত জলভান্ডার থেকে জল ফেলে দেয়। তখন জাহাজটিতে জলের হাহাকার পড়ে যায়। তখন ও পরামর্শ দেয় কাছেই জল পাওয়া যাবে। সেই জলের হদিশ ও জানে। ওকে বিশ্বাস করে ওর দেখানো পথ দিয়ে নাবিকেরা আসে আর এই ক্রীতদাস ব্যবসায়ী সেসব লোককে এখানে বন্দি করে রাখে আর ক্রীতদাস কেনাবেচার বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। ততদিন পর্যন্ত এই বন্দিদের দেখাশুনো করে—যাতে মরে না যায়, তার ব্যবস্থা করে। মরে গেলেই তো ক্ষতি। আমাদেরও সেভাবেই আনা হয়েছে এখানে।
হ্যারি কথাগুলো ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিসের মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। কি সাংঘাতিক ইগনোতি লোকটা। ক্রুদ্ধস্বরে বলল—ওটাকে কায়দায় পেলে আমি নিকেশ করবো।
একটু পরেই সকালের খাবার আনা হলো। একজন পাহারাদার ঠং-ঠুং শব্দে লোহার দরজা খুলে দিল। বন্দিরা উঠে বসল। অনেকে আগে থেকে বসেও ছিল।
একজন রক্ষী একরকমের লম্বা পাতা ধুলোভরা মেঝেয় পেতে দিয়ে গেল। অন্যজন গোল করে কাটা রুটি পাতায় দিল। অন্যজন দিয়ে গেল আলু, আনাজপাতা মেশানো ঝোলমতো। দু’হাত বাঁধা অবস্থাতেই বন্দিরা দু’হাতের মুঠো দিয়ে রুটি খেতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল সেটা। বুঝল বন্দিরা এভাবে খেতেই অভ্যস্ত। কিন্তু ফ্রান্সিসের এটা সহ্য হলো না। ও দু’পায়ে পাতাসুদ্ধ খাবার ছিটকে ফেলল। একজন রক্ষী তেড়ে এলো। ফ্রান্সিস লোহার খুঁটিতে বাঁধা হাত নিয়েও উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল—আমরা কি জানোয়ার? জানোয়ারের মতো খাবার খাবো?
রক্ষীটা ফ্রান্সিসের কথা বুঝল না কিন্তু ওর এই উগ্রমূর্তি দেখে একটু থমকাল। বুঝে উঠতে পারলো না কি করবে। ফ্রান্সিস রুখে দাঁড়াতে হ্যারি আর শাঙ্কোও উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল-ও-হো-হো। দেখাদেখি অন্য বন্দিরাও চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করল। রক্ষীরা বেশ ভয় পেয়ে গেল।
দাসব্যবসায়ী বোধহয় ফ্রান্সিসের চ্যাঁচামেচি শুনেই সেই বলিষ্ঠদেহী লোহার জালঘেরা জায়গাটায় এলো। বলল-কি হয়েছে?
রক্ষীরা ফ্রান্সিসদের বিরুদ্ধতার কথা বলল। লোকটা একটু ভেবে। বলল—ঠিক আছে—একজন করে হাত খুলে দিয়ে খেতে দিবি। আর অন্য রক্ষীরা তলোয়ার হাতে পাহারায় থাকবি—কথাটা বলে চলে গেল। এবার এক একজন বন্দিকে হাতের দড়ি খুলে খুলে খেতে দেওয়া হলো। ফ্রান্সিস এবার খেলো। এই খাওয়ার ব্যবস্থায় বেশ দেরি হলো। সবার খাওয়া হলে এককোণের একটা বড় পিপে থেকে কাঠের পাত্রে জল ভরে এনে জল খাওয়ানো হলো। অন্য রক্ষীটি প্রত্যেকের হাত খাওয়া হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই দড়ি বেঁধে দিতে লাগল।
দরজার দুটো তালা বন্ধ করে দিয়ে রক্ষীরা চলে গেল। সময় কাটতে লাগল। ফ্রান্সিসের মাথায় চিন্তা। যখন জল খাচ্ছিল তখনই মনে পড়ছিল—মারিয়া আর বন্ধুদের তৃষ্ণার্ত মুখের কথা। তৃষ্ণার্ত হওয়া সত্ত্বেও সামান্য জল খেল।
—পাশে আধশোয়া হ্যারি বলল-কি করবে ফ্রান্সিস ?
—রাত নামার জন্যে অপেক্ষা করছি-ফ্রান্সিস বলল।
—রাতে তো পাহারাদার সৈন্যদের সংখ্যা বাড়ে—হ্যারি বলল।
—দেখি সন্ধের পর ক’জন থাকে—ফ্রান্সিস বলল।
দুপুরে সকালের খাওয়ার মতোই ফ্রান্সিসরা একে একে খোলা হাতে খেলো। বড় আকারের রুটি আর আলু আর কিসব সবজি মেশানো পাখির মাংস। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বেশ আইহলো—সুস্বাদু রুটি। কেক-এর মতো স্বাদ। ঝোলও তাই, মাংসের পরিমাণও বেশি। খেতে খেতে ফ্রান্সিস মৃদু হাসল ক্রীতদাস কেনাবেচার হাটে বিক্রি করতে গেলে সুস্থ আর বলশালী মানুষদের দাম বেশি পাওয়া যাবে। তাই এত সুখাদ্যের আয়োজন।
সন্ধের আগেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। সূর্যাস্তের আগেই অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। কেমন একটা ঠান্ডা হাওয়া সমুদ্রের দিকে থেকে ছুটে এলো। ফ্রান্সিস লোহার খুঁটিটায় শরীরের ভর রেখে কিভাবে অক্ষত অবস্থায় পালানো যায়, তাই চোখ বুজে ভাবছিল। সমুদ্রের দিক থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগতেই ওর তন্দ্রা ছুটে গেল বিদ্যুতের ঝলকে চোখ ঝলসানো আলোয় ও চমকে উঠল। আকাশের দিকে তাকাল। দেখল পশ্চিম আকাশ থেকে মেঘ উঠে আসছে। অল্পক্ষণের মধ্যে চারদিক ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। তারপরই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। পরক্ষণেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। ফ্রান্সিস খুশিতে উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল—হ্যারি—এই বৃষ্টি যীশুর আশীর্বাদ।
হ্যারি ঠিক বুঝল না। বলল—একথা বলছো কেন?
—ভেবে দেখো—এই বৃষ্টি আমাদের জাহাজের ওপরও পড়ছে। সমুদ্রে বৃষ্টির জল ধরে রাখাটা নতুন কিছু নয়। বিস্কো ওরা নিশ্চয়ই জল ধরে রাখবে। তাতে সকলের সবটা তেষ্টা মিটবে না। কিন্তু অন্তত কালকের দিনটা তো চালাতে পারবে।
হ্যারি বলল—সত্যি একথাটা আমি ভাবিনি তো—
—এবার পালানো-ফ্রান্সিস বলল। অন্ধকার আকাশেমুহূমুর্হবিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। সেইসঙ্গে বাজপড়ার প্রচন্ড শব্দ। লোহার জালঘেরা সেই বন্দিশালার ওপর তো কোনো ছাউনি নেই। ফ্রান্সিসরা ও অন্য বন্দিরা প্রবল বৃষ্টিধারায় ভিজতে লাগল। বৃষ্টিতে এরকম জানোয়ারের মতো ভিজতে ভিজতেও কিন্তু ফ্রান্সিসের মন আনন্দে ভরে উঠল। একেবারে স্নান করার মতো ভিজে গেছে। ভিজতে ভিজতে এখন শীত শীত করতে লাগল। তবু মনে আনন্দ-মারিয়া আর বন্ধুদের জল খাওয়ার সমস্যা তো আপাতত মিটলো।
বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি চলল। তারপর আস্তে আস্তে থেমে গেল। পায়ে লালচে মাটি কাদার তাল হয়ে গেল। সেই কাদার মধ্যেই অনেকে গা এলিয়ে দিয়েছে। বাকিরা বসে আছে। মুখে লালচে কাদার ছিটে। গায়ে-পায়ে কাদা লেপ্টে আছে। জন্তু জানোয়ারের মতো দশা মানুষগুলোর, জল কাদায় ছপাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে কেউ কেউ এদিক-ওদিক চলাফেরা করছে। পরিচিতদের সঙ্গে মৃদুস্বরে কথা বলছে।
এই দৃশ্যের নির্মমতায় ফ্রান্সিস নিজেকে সংযত করতে পারল। গভীর দুঃখে, বেদনায় আবার ভীষণ রাগে ওর দু’চোখ ভিজে উঠল। ও মনে মনে স্থির করে ফেলল এই নির্মমতার শোধ ও নেবে। প্রয়োজনে এদের হত্যা করবে। হাতের কাছে পেলে কাউকে রেহাই দেবে না।
রাত হচ্ছে। রাতের খাবার দেবার সময়ই পালাতে হবে—ফ্রান্সিস ভাবল। আস্তে ডাকল—শাঙ্কো।
শাঙ্কো ওর দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল—এগিয়ে এসো।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাঁধের ওপর মাথা রাখল। ফ্রান্সিস বাঁধা দু’হাত শাঙ্কোর পোশাকের ঢোলা গলা দিয়ে ঢোকাল। ছোরাটা তুলে আনল। তরপর দু’থাবায় ছোরাটা ধরে শাঙ্কোর হাত বাঁধা দড়িতে ঘষে ঘষে দড়িটা কেটে ফেলল।
ফ্রান্সিস অপেক্ষা করতে লাগল রাতের খাবার দেবার সময়ের জন্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাতের খাবার দিতে তিনজন পাহারাদার এলো। ঢং ঢং শব্দে লোহার দরজা খুলল। ফ্রান্সিস নজর রাখল পেছনের দিকে। না, কোনো সশস্ত্র রক্ষী নেই। লক্ষ্য করল—মাঝের পাহারাদারটা বেশ লম্বাচওড়া, বলশালী। বাকি দুটোর সাধারণ শরীর। চাপা গলায় ফ্রান্সিস বলল—আমি মাঝেরটা, শাঙ্কো বাঁ দিকেরটা, হ্যারি ডানদিকেরটা—একসঙ্গে। গলা চেপে-টুঁ-শব্দটি যেন না করতে পারে। পাহারাদারদের একজনের হাতে জ্বলন্ত মশাল। সে ওটা দরজার একটা লোহার আংটায় বসিয়ে দিল।
ফ্রান্সিসরা তিনটে লোহার দন্ড ধরে রাখার ভান করে রইল। তিন পাহারাদারের মধ্যেরটির হাতে ছিল কাঠের বড় থালাটা, তাতে খাবার। সে উবু হয়ে থালাটা রাখতে যাবে, তখনই ফ্রান্সিস বিদ্যুৎবেগে লোকটার থুতনিতে প্রচন্ড জোরে লাথি চালাল। জল কাদা ছিটকোল। লোকটা লাথির মারে চিত হয়ে জলকাদার মধ্যে ছিটকে পড়ল যেন। ততক্ষণে শাঙ্কো আর হ্যারি ও বাকি দুজনের গলা চেপে ধরেছে যাতে টু শব্দটিও না করতে পারে। পাহারাদার দু’জনেই ঝটকাচ্ছে গলার চাপ মুক্ত করতে। শাঙ্কো ঠিক চেপে ধরে আছে। কিন্তু হ্যারি তো বরাবরই দুর্বল শরীরের। কোনোরকমে চেপে ধরে আছে। বন্দিশালার লোহার দরজার মাথায় মশাল জ্বলছে। তারই আলোয় দেখা গেল ফ্রান্সিস সেই বলশালী লোকটাকে শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে গলা চেপে ধরে আছে। লোকটা দুহাতে ফ্রান্সিসের দু’হাত চেপে গলার চাপ কমাবার চেষ্টা করছে। জলে, কাদায়, সবারই শরীরে তখন লালচে কাদামাটির আস্তরণ।
ঠিক তখনই তিনজন সশস্ত্র রক্ষী বন্দিশালার কাছে এলো। হয়তো রাতে পাহারা দেবে বলে। মশালের আলোয় ফ্রান্সিসদের ঝটাপটি দেখে থমকে দাঁড়াল। তারপরই কোমর থেকে তলোয়ার খুলে নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ছুটে এলো। ফ্রান্সিস এক লাফে উঠে দাঁড়াল। তারপর প্রথমে ছুটে আসা রক্ষীটার দিকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে গিয়ে রক্ষীটা কিছু বোঝবার আগেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কুঁক করে মুখে শব্দ তুলে ছিটকে গিয়ে জলকাদায় মুখ থুবড়ে পড়ল। ওর হাত থেকে তলোয়ারটা ছিটকে গেল। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় জলকাদা থেকে তলোয়ারটা তুলে নিল। তারপরই ঘুরে দাঁড়াল থমকে দাঁড়িয়ে পড়া দু’টির দিকে। মশালের আলোয় ফ্রান্সিসের জলকাদা মাখা রুদ্রমূর্তি দেখে রক্ষী দু’জন ভয় পেল ঠিকই কিন্তু ওরাও তো এরকম তলোয়ারের লড়াই অনেক লড়েছে। দুজনই একসঙ্গে ফ্রান্সিসের দিকে লাফিয়ে এলো। একজন তলোয়ার চালাল ফ্রান্সিসের গলা লক্ষ্য করে। ফ্রান্সিস দ্রুত মাথা নামিয়েই ঐ রক্ষীটার বুকে তলোয়ার বিঁধিয়ে দিল। অন্যটা এগিয়ে আসতেই ফ্রান্সিস প্রচন্ড জোরে ওর তলোয়ারে নিজের তলোয়ারের ঘা মারলো। রক্ষীটির হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘাড়ে তলোয়ারের বাঁট দিয়ে ঘা মারল। লোকটা জলকদার মধ্যে ঝন্ শব্দ তুলে পড়ে গেল। জল, কাদা ছিটকালো। কাদায় চোখ ঢেকে গেল রক্ষীটির। ওদিকে শাঙ্কো যেটাকে গলা চেপে ধরেছিল সেটার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বেরোচ্ছিল না। কিন্তু হ্যারি যেটাকে চেপে ধরেছিল সেটার মুখ দিয়ে তখনও গোঁ গোঁ শব্দ বেরোচ্ছিল। উপায় নেই ফ্রান্সিস ভাবল। এটাকে নিকেশ করতেই হবে। তলোয়ার চালিয়ে করলোও তাই। ফ্রান্সিস দুতিনপা দ্রুত এগিয়ে শাঙ্কোকে বলল—ছেড়ে দাও। শাঙ্কো রক্ষীটার গলা ছেড়ে দিল। রক্ষীটা তখন মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে। ওর গলায় তলোয়ারের ফলাটা ঠেকিয়ে ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি, ওকে বলো তো টু শব্দটি করলে ওকে মেরে ফেলব। হ্যারি তখন হাঁপাচ্ছে। মুখ নীচু করে লোকটার কানের কাছে হ্যারি লো লাতিন ভাষায় বলল—একেবারে শব্দ করবেনা। শব্দ করলেই তোমাকে মেরে ফেলা হবে। রক্ষীটি হ্যারির কথা বুঝল। ফ্রান্সিস তলোয়ার নাচিয়ে ওকে উঠে বসতে বলল। রক্ষীটি উঠে বসল। ফ্রান্সিস আবার তলোয়ার নাচিয়ে উঠে দাঁড়াতে বলল। রক্ষীটি হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। ওর পিঠে তলোয়ার ঠেকিয়ে ফ্রান্সিস বলল—শাঙ্কো, সব বন্দিদের দড়ি কেটে দাও! তাড়াতাড়ি, ফ্রান্সিস তলোয়ারের বাঁট দিয়ে রক্ষীটার মাথায় আঘাত করতে রক্ষীটা অজ্ঞান হয়ে গেল।
ওদিকে অন্য বন্দিরা সবাই লোহার ডান্ডায় ভর রেখে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিসদের কান্ড দেখছিল। শাঙ্কো ছুটে গিয়ে একে একে বন্দিদের হাত বাঁধা দড়ি কেটে দিতে লাগল। বন্দিরা ছাড়া পেয়ে জলকাদা ভেঙে খোলা লোহার দরজা দিয়ে মুহূর্তে উধাও।
ফ্রান্সিসরা ছুটে বাইরের অন্ধকারে এসে পড়ল। এবার চিন্তা কোথায় পিপেসুদ্ধ নৌকো তিনটি বেঁধে রেখে এসেছিল। আকাশে তখনও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বিদ্যুতের আলোয় দেখল ওরা পাথরের লম্বাটে ঘরটার কোণার দিকে এসেছে আর তখনই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বিদ্যুতের আলোয় দেখল ওরা পাথরের লম্বাটে ঘরটার কোণের দিকে এসেছে। আর তখনই দেখল লম্বাটে ঘরটা থেকে কে যেন বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিসরা দ্রুত গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিল। লোকটা কাছাকাছি এসেছে তখন। ইগনোতি। বন্দিশালার দিকেই যাচ্ছে। ফ্রান্সিস ফিসফিস্ করে ডাকল শাঙ্কো’শাঙ্কো মাটিতে উবু হয়ে বসল। তারপর বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গিয়ে পেছন থেকে হাত দিয়ে ইগনোতির মুখ চেপে ধরে ওর পিঠে ছোরাটা আমূল ঢুকিয়ে দিল। ইগনোতির মুখে শব্দ উঠল-ঘর। শাঙ্কো ইগনোতিকে একটুক্ষণ ধরে তারপর ছেড়ে দিল। ইগনোতি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। দু’একবার নড়ে ওর শরীরটা তারপর স্থির হয়ে গেল।
ফ্রান্সিস আগে আগে ছুটল। পেছনে হ্যারি আর শাঙ্কো। ফ্রান্সিসের লক্ষ্য সমুদ্রের ধার যাওয়া। নৌকো থেকে নেমে ওরা বেশিদূর আসে নি। কাজেই বুঝে নিতে অসুবিধে হবে না। অন্ধকারে যতটা দেখে সম্ভব ওরা দু’টো চড়াই পার হলো। তখনই ফ্রান্সিসের গায়ে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া লাগল। ফ্রান্সিসরা সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। সমুদ্রের সঙ্গে ওদের নাড়ি যোগ। ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগতেই বুঝল—সমুদ্র কাছেই। বিদ্যুৎ চমকাল। দেখা গেল গাছগাছালি পাতলা হয়ে এসেছে। আর একটা উবাইতে উঠতেই কানে এল সমুদ্রের মৃদু গর্জন।
ফ্রান্সিস বলে উঠল—এসে গেছি।
সমুদ্রের ধারে পৌঁছল ওরা। অন্ধকারে চারদিকে নজর চালাল। তখনই বিদ্যুৎ চমকাল। দেখা গেল ডানদিকে হাত পঞ্চশেক দূরে ওদের নৌকো তিনটে ঢেউয়ের দোলায় দুলছে। হঠাৎ তীরভূমির দিকে শোনা গেল রক্ষীদের চিৎকার করে ডাকাডাকি, হৈ-হল্লা ঝোঁপঝাড় ভাঙার শব্দ, ওরা এতক্ষণে জেনেছে পেরেছে বন্দিরা পালিয়ে গেছে।
আর একমুহূর্তে অপেক্ষা না করে ফ্রান্সিসরা অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে নৌকোগুলোর দিকে ছুটল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি প্রায় লাফ দিয়ে নৌকোয় উঠে পড়ল। গাছের গোড়ার সঙ্গে বাঁধা দড়ি তিনটে শাঙ্কো দ্রুত ছোরা দিয়ে কেটে ফেলল। সেই দড়ি তিনটে নৌকোর সঙ্গে তাড়াতাড়ি বেঁধে ফেলে লাফিয়ে নৌকোয় উঠল। অন্ধকারে দূরে ওদের জাহাজটা আবছা ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে। দাঁড় তুলে নিল ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো। নৌকো চালাল ওদের জাহাজ লক্ষ্য করে। ততক্ষণে সমুদ্রতীরে পৌঁছে গেছে রক্ষীর দল। হৈ-হল্লা করছে। কিন্তু ওখানে ওদের কোনো নৌকো বাঁধা নেই।
অন্ধকার সমুদ্রের ওপর দিয়ে নৌকোগুলো চলল জাহজের দিকে। আকাশে এখনও থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
জাহাজের ডেক-এ মারিয়া ঠায় দাঁড়িয়েছিল। বিস্কোরাও কয়েকজন ছিল। ফ্রান্সিসদের নৌকোগুলো অস্পষ্ট দেখল ওরা। চিৎকার করে উঠল-ও-হো-হো।
আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসদের নৌকোগুলো এসে জাহাজের গায়ে লাগল। দড়ির সিঁড়ি ফেলা হলো। ওরা একে একে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। মারিয়া ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এলো। বলল—জল এনেছো?
ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিসদের জলকাদমাখা চেহারা দেখেই মারিয়া, বিস্কোরা বুঝেছিল—কিছু একটা হয়েছে। ফ্রান্সিস এবার বিস্কোর দিকে তাকাল। বলল-বিস্কো বৃষ্টির জল কিছু জমাতে পেরেছো?
বিস্কো বলল সে আর বলতে। সবাই মিলে প্রায় আধ পিপে জমিয়েছি। জাহাজ ছাড়ো! এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না।
—তাহলে আর দেরি না।
—এই জলটুকু থাকতে থাকতে জলসংগ্রহ করতে হবে-ফ্রান্সিস বলল।
কয়েকজন ভাইকিং ছুটে গেল নোঙর তুলতে জাহাজে পাল খাটাতে। ওদিকে হ্যারি তখন বন্ধুদের সব ঘটনা বলছে। দোনিয়া তখনই ডেক-এ উঠে এলো। হ্যারির কথাবার্তা শুনেই বুঝল, ওরা জল পায় নি। ফ্রান্সিস এবার দোনিয়াকে জিজ্ঞেস করল—আপনি তো এই এলাকা মোটামুটি চেনেন। জল কোথায় পাবো বলতে পারেন?
দেখুন, কাছাকাছি একটা বন্দরমতো আছে। ওখানে একটা কূপ আছে। অনেক জাহাজই ওখানে থেমে প্রয়োজনীয় জল নেয়। কিন্তু সেটা এখন কতদূর, আমি সঠিক বলতে পরবো তবে সমুদ্রের তীরের ধারে ধারে জাহাজ দক্ষিণমুখে চালালে ছোট্ট বন্দরটা পাওয়া যাবে।
ফ্রান্সিস জাহাজচালক ফ্লাইজারের কাছে গেল। দোনিয়ার কথাবার্তা বলল। ফ্লাইজার মাথা ওঠানামা করল। তার মানে ও নির্দেশটা বুঝল। তীরভূমির যতটা সম্ভব কাছাকাছি দূরত্ব রেখে জাহাজ চালাতে লাগল।
ফিরে এসে দোনিয়াকে বলল—ঐ ছোট্ট বন্দরটার কোনো নিশানা দিতে পারেন।
-হ্যাঁ, সমুদ্র থেকেই একটা ডাঙা নুরাঘির মাথা কালো রঙের দেখা যায়।
দোনিয়াও ফ্রান্সিসের পাশেই দাঁড়িয়েছিল নজরদার পেড্রো। কথাটা শুনে পেড্রো দড়িদড়া ধরে মাস্তুল বেয়ে নিজের জায়গায় উঠে গেল। হ্যারি, শাঙ্কো ততক্ষণে স্নান করে গায়ের, মুখের শুকিয়ে আসা কাদা ধুতে গেল। ফ্রান্সিস ও চলে গেল স্নান করে গায়ের কাদা ধুতে।
জাহাজ চলল। তখন আকাশের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই পুব আকাশে লাল আলো ছড়িয়ে সূর্য উঠল। সূর্য তখন মাথার ওপর উঠে এসেছে। তখনও ডাঙা নুরাঘিটা নজরদার পেড্রোর চোখে পড়ল না।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই দেখা গেল ধরে রাখা বৃষ্টির জল প্রায় শেষ। ফ্রান্সিসের নির্দেশে দুপুরের খাওয়ার সময় জল খুব হিসেব করে খেল সবাই। মারিয়া কিন্তু এক ফোঁটা জলও খেল না। ফ্রান্সিস শুনল সেটা, কিন্তু কিছু বলল না।
জাহাজ চলেছে। পেড্রো নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ডাঙা নুরাঘির মাথার দেখা নেই। সারারাত জাহাজ চলল। ফ্রান্সিস প্রায় সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাল। মারিয়ারও একঅবস্থা। কেউ কোনো কথা বলল না। ভাইকিং বন্ধুরা জলতৃষ্ণা নিয়েও কেউ ঘুমোল, কেউ ঘুমোল না।
ভোর হলো। বৃষ্টির ধরে রাখা জল কতটা আছে, তা দেখবার জন্যে ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে তখনই হ্যারি ঢুকল। বলল—ফ্রান্সিস কি করবে?
—জল শেষ, এই তো, ফ্রান্সিস বলল
—খুব সামান্য তলানি আছে, হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল। মাথা তুলে বলল—বন্ধুদের মধ্যে যারা একটু দুর্বল, যারা জলতৃষ্ণা সহ্য করতে পারবে, একমাত্র তারাই অল্প জল খেতে পাবে। আর কেউ জল খাবেনা। সবাইকে বলে দাও।
—কিন্তু কার জলের খুবই প্রয়োজন মানে অসুখে মৃতপ্রায় হলে যেমন হয় সেটা বুঝবে কি করে? হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল—বৈদ্যি ভেনকে ডাকো তো।
হ্যারি কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মারিয়া বলে উঠল—জল সংগ্রহ করা না পর্যন্ত আমি একফোঁটা জলও খাবো না।
—ধরো দিন সাতেকের আগে জল পাওয়া গেল না। সেই সাতদিন পারবে জল না খেয়ে থাকতে? ফ্রান্সিস বলল।
—নিশ্চয়ই পারবো, মারিয়া গলায় বেশ জোর দিয়ে বলল।
তখনই ভেন কেবিনঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিস বলল—ভেন তুমি তো সব শুনেছো।
ভেনই ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে বয়স্ক। চুলে দাড়িতে পাক ধরেছে। সে মাথা ওঠানামা করল। অর্থাৎ সবই জানে সে। ফ্রান্সিস বলল, শুধু তুমিই যাকে জল খাওয়াতে বলবে, তাকেই এই সামান্য জল থেকে জল খেতে দেওয়া হবে। কারণ তুমিই ঠিক বুঝবে কাকে জল খাওয়ানো প্রয়োজন।
ভেন কোনো কথা বলল না। শুধু আবার মাথা ওঠানামা করল। বুঝল বড় কঠিন দায়িত্ব চাপলো ওর ওপর। সকালের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। কমবেশি তৃষ্ণার্ত সকলেই। তবু কেউ জল খেল না।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার সময় বোঝা গেল জল না খেয়ে থাকার প্রতিক্রিয়া কী? বেশ কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়ল। এই অঞ্চলে রোদের তাপ প্রখর নয়। তবু দিনের গরম তো। জলের তৃষ্ণা তো হবেই আর সময়ের সঙ্গে তা তো বাড়বেই। কিন্তু সহ্য করার ক্ষমতা তো সবার সমান নয়। ভেন অসুস্থদের চোখ জিভ পরীক্ষা করছে। তখনই ফ্রান্সিস এলো। বলল—ভেন, অন্য কোনোভাবে জলতেষ্টা সামান্য হলেও মেটানো সম্ভব?
ভেন মাথা নাড়ল। তারপর বিস্কোর দিকে তাকাল। বিস্কোর হাতে কাঠের লম্বা চোঙমতো। তাতেই বৃষ্টির শেষ জলটুকু রাখা হয়েছে। ভেন-এর নির্দেশে কয়েকজনকে অল্প জল খাওয়ানো হলো।
বিকেল থেকেই আরো অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ল। কেবিনঘরে ডেক এর এখানে ওখানে তারা শুয়ে পড়ে রইল। মারিয়া, হ্যারি, শাঙ্কোও শুয়ে পড়ে রইল। শুধু ফ্রান্সিস ডেক-এর ওপর চুপ করে বসে রইল। মাঝেমাঝেই তাকাতে লাগল আকাশের দিকে যদি মেঘের দেখা পাওয়া যায়। বিস্কো ভেন-এর নির্দেশমতো অসুস্থদের এক ফোঁটা দুফোঁটা করে জল খাইয়ে দিতে লাগল।
নজরদার পেড্রোকে ডাকবার জন্যে ভেন বিস্কোকে বলল। বিস্কো মাস্তুলের মাথার। দিকে তাকিয়ে ডাকল—পেড্রো, নেমে এসো। গলা চড়িয়েই ডাকতে গেল কিন্তু বিস্কোর। গলা দিয়ে জোর শব্দ বেরুলো না। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিস্কো হাত ধরা জলের চোঙটা ভেনের হাতে দিয়ে বেশ কষ্ট করে দড়ির মই বেয়ে বেশ কিছুটা আস্তে আস্তে উঠল। বেশি তাড়াতাড়ি করতে গেলে পরিশ্রম হবে। জলের ষ্টো বেড়ে যাবে। ওখানে থেকেই ভাঙা গলায় ডাকল—পেড্রো।
পেড্রো শুনল ডাকটা। নীচের দিকে তাকাল। দেখল ডেক-এর ওপর অনেক বন্ধু চুপচাপ শুয়ে আছে। ভাগ্য ভালো রোদের তেজ কম, বাতাসও জোরে বইছে। তাই জলতৃষ্ণা কাতর ভাইকিংরা ডেক-এ শুয়ে একটু স্বস্তি পাচ্ছে।
পেড্রো এবার উঠল। আস্তে আস্তে দড়ির মইদড়ি ধরে নামতে লাগল। বিস্কোও নেমে এলো। পেড্রো ডেক-এ এসে দাঁড়াল। ভেন ওকে মুখ হাঁ করতে ইঙ্গিত করল। পেড্রো মুখ হাঁ করল। ভেন কিছুটা বেশিই জল ওর মুখে ঢেলে দিল। পেড্রো জল খেয়ে আবার চলল ই নিজের জায়গায়, মাস্তুলের মাথায়।
সূর্য অস্ত গেল। হালকা অন্ধকার নেমে এলো। একটু পরেই পূর্ব দিগন্তে চাঁদ উঠল। চাঁদের আলো ছড়ালো সমুদ্রের জলে। চাঁদের আলো খুব উজ্জ্বল না হলেও সমুদ্রের তীরের গাছপালা টিলা এসব দেখা যাচ্ছিল।
পেড্রো সামনে তাকিয়ে আছে সেইদিকে। যেন চোখে পলক পড়ছে না। দোনিয়া বলেছিল—একটা কালো রঙের ভাঙা নুরাঘির মাথা দেখা যাবে। ওখানেই ছোট্ট বন্দরমতো। কুয়োর জল পাওয়া যাবে ওখানে।
হঠাই পেড্রো চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় দেখল—কয়েকটা গাছের মাথা ছাড়িয়ে কালো উঁচু গোল দেয়ালমতো। পেড্রো তখনও দমবন্ধ করে তাকিয়ে আছে। জাহাজ আরো এগিয়ে যেতেই পেড্রো দেখল ভাঙা নুরাঘিটা। ও চিৎকার করে উঠল—ভাঙা নুরাঘি ভাঙা নুরাঘি। গলায় সেই জোর নেই। তবু কথা তো বেরিয়ে এলো গলা থেকে। অস্পষ্ট হলেও ফ্রান্সিসের কানে গেল কথাটা। ও বেশ দুর্বল শরীর নিয়েও দ্রুত উঠে দাঁড়াল। বোধহয় একা ফ্রান্সিস ই বারবার মেঘ দেখার আশায় আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল আর কান খাড়া রাখছিল যদি পেড্রো কিছু বলে।
ফ্রান্সিস যতটা সম্ভব দ্রুত রেলিঙের দিকে ছুটল। রেলিঙে ভর দিয়ে তীরভূমির দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট দেখল নুরাঘির ভাঙা মাথা। পেড্রো তখনও একনাগাড়ে ভাঙা গলায় বলে চলেছে নুরাঘি-ভাঙানুরাঘি। ডেক-এ শুয়ে থাকা ভাইকিংরা ততক্ষণে অনেকেই উঠে পড়েছে। তারাও রেলিঙের ধারে এসে ভিড় করে দাঁড়াল। শাঙ্কোও উঠে এলো! ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে দেখে বলল—শিগগির দোনিয়াকে ডাকো, জলদি। . একটু পরেই শাঙ্কো দোনিয়াকে নিয়ে ডেক-এ উঠে এলো। দোনিয়া ফ্রান্সিসের কাছে এলো। ফ্রান্সিস আঙ্গুল তুলে ভাঙা নুরাঘিটা দেখাল। দোনিয়া একটুক্ষণ টেনে নিয়ে হা, ওটার সামনেই একটা ছোট্ট জাহাজঘাটা মতো আছে।
জাহাজ চলল। ভাঙা নুরাঘিটার কাছাকাছি আসতেই এবার চাঁদের আলোয় অনেকটা স্পষ্ট দেখা গেল—ঘাটে একটা মালবাহী জাহাজ নোঙর করা আছে।
ফ্রান্সিসদের জাহাজটা আস্তে আস্তে জাহাজঘাটায় ভিড়ল। একটা সুবিধে হলো যে নৌকোয় চড়ে গিয়ে পিপেয় ভরে জল আনতে হবে না।
জাহাজঘাটার খুব কাছেই আনা গেল ফ্রান্সিসদের জাহাজটাকে। কাঠের পাটাতন ফেলা হলো। জলের জায়গায় আসা গেছে এই কথাটা এর মধ্যেই সব ভাইকিংদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। মারিয়াও পেল খবরটা। বেশ দুর্বল শরীর নিয়েও মারিয়া ডেক-এ উঠে এলো।
এবার কারা জল আনতে যাবে, তাই নিয়ে ফ্রান্সিসকে ভাবতে হলো। হ্যারিকে নেওয়া যাবে না। হ্যারি তো বরাবরই দুর্বল। তারপরও জল নিতে না পেরে আরো কাহিল হয়ে পড়েছে। বিস্কোর দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলল—তুমি শাঙ্কো আরো কয়েকজন সুস্থ সঙ্গ নাও আর জলের চারটে পিপেই নিয়ে এসো। যতটা সম্ভব জল নেব। আমি দোনিয়াকে নিয়ে জলের খোঁজে যাচ্ছি। তোমরা পেছনে এসো।
পাটাতনে হেঁটে গিয়ে কিছুটা জলকাদা পার হয়ে দু’জনে উঁচু পাড়ে উঠল। দু’ধারে এদিকে-ওদিকে কিছু পাথরের বাড়িঘর। চাঁদের আলোয় পাথর ছড়িয়ে থাকা ধুলোটে পথ দিয়ে দু’জনে চলল। একটু এগোতেই কিছু গাছগাছালির পরেই একটা টিলার মতো। তার মা নীচেই ছড়ানো বড়ো পাথর। দোনিয়াই এতক্ষণ আগে আগে যাচ্ছিল। দোনিয়া সেই কাঠের লম্বা চোঙটা নিয়ে এসেছিল। কারণ ও জানতো জল তোলার জন্যে এটা লাগবে।
দোনিয়া দু’টো চ্যাপ্টা পাথর খণ্ডের ওপর দু’পা রেখে নিচু হলো। ফ্রান্সিস দেখল পাথর খণ্ড দু’টোতে মাঝখানটায় গর্ত। চাঁদের আলোয় বোঝা গেল না কতটা গভীর। সোনিয়া কাঠের চোঙটা নামাল। ছলাৎ-জলের শব্দ উঠল। দোনিয়া কাঠের চোঙ ভরে জল তুলে। ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে দিল। গত প্রায় দিন তিনেকের মধ্যে ফ্রান্সিস খুব সামান্য জলই খেয়েছে। সেই তৃষ্ণার জল সামনে। তবু ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল—না, আপনি খান।
দোনিয়াও তৃষ্ণাকাতর মুখে ম্লান হাসল। বলল-যে কারণে আপনি জল খেতে চাইছেন না একই কারণে আমিও খাবো না। তবে জল দিয়ে চোখ-মুখটা ধুয়ে নিন। এটা করা খুবই প্রয়োজন।
ফ্রান্সিস আপত্তি করল না। দু’জনেই ঐ জলে হাতমুখ চোখে জলের ঝাপ্টা দিল। আঃ কি ঠাণ্ডা জল। কি শান্তি।
তখন পিপে নিয়ে ক্লান্ত পায়ে শাঙ্কোরা এলো। ওরা একটু দূর থেকে ফ্রান্সিস আর দোনিয়ার মুখ ধোয়া দেখল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল-ও—হো-হো, কিন্তু সকলের গলাই তো শুকিয়ে কাঠ। তেমন জোরালো শব্দ গলা দিয়ে বেরলো না।
ওরা এবার প্রায় ছুটে এলো পিপেগুলো নিয়ে। একজন ভাইকিং বন্ধু দোনিয়ার হাত থেকে কাঠের চোঙটা প্রায় টেনে নিল। ফ্রান্সিস বাধা দিতে গিয়েও দিল না। ওখান থেকে সরে দাঁড়াল। শাঙ্কো দেখল সেটা। ভাবল ফ্রান্সিস যখন মানা করছেনা তখন জল না খেয়ে উপায় কি। ওদিকে বন্ধুরা সব জল তুলে খেতে শুরু করেছে। তখন ওদের আনন্দ দেখে কে। জল খাওয়া মাথায়, গায়ে ঢালা হৈ চৈ চলল। শাঙ্কোও প্রায় এক চোঙ জল খেয়ে ফেলল চো চো করে।
এতক্ষণে ফ্রান্সিস বলল—এবার পিপেগুলো ভরে ফেল। জাহাজে যে তৃষ্ণার্ত বন্ধুরা রয়েছে তাদের ভুলে যেও না। ভাইকিংদের হৈ, হল্লা এবার বন্ধ হলো। পিপে এনে এনে জল ভরতে লাগল। যখন সবগুলো পিপেয় জল ভরা শেষ হলো, তখন সবাই হাত লাগাল। ধরাধরি করে চাঁদের আলোয় পথ দেখে দেখে চলল জাহাজের দিকে। সবার পেছনে ফ্রান্সিস আর দোনিয়া।
পাতা পাটাতন দিয়ে পিপেগুলো ধরে ধরে নিয়ে সবাই জাহাজের ডেক-এ উঠল। শাঙ্কো এতক্ষণে একটু গলা চড়িয়ে বলতে পারলসবাই এসো, জল এনেছি। তৃষ্ণায় কাতর বন্ধুরা ছুটে এলো। কাঠের চোঙে জল ভরে শাঙ্কো সবাইকে জল খাওয়াতে লাগল। আনন্দের হৈ হল্লা শুরু হল। সেইশব্দ কেবিনঘরে গিয়েও পৌঁছল। মারিয়া আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে চলল ডেক-এ ওঠার সিঁড়ির দিকে। হ্যারি তার আগেই উঠে এসেছে। ফ্রান্সিস আর দোনিয়া একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হ্যারি আর বিস্কো এসে ওদের কাছে দাঁড়াল। মারিয়া তখনই এলো।
ভাইকিং বন্ধুরা কাঠের চোঙটায় জল ভরে মারিয়ার কাছে এলো। মারিয়া ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস হেসে বলল—আমরাও খাচ্ছি, তুমি খাও।
মারিয়া চোঙটা থেকে আস্তে আস্তে খেতে লাগল। শুকনো গলা দিয়ে জল যেন, নামতে চায় না। খুব বেশি জল মারিয়া প্রথমেই খেতে পারল না। এবার ফ্রান্সিস, দোনিয়া।, আর বিস্কো জল খেল। মারিয়া আবার জল খেল। অল্প জল হাতে নিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে নিল। ততক্ষণে ভাইকিংদের আনেন্দে হৈ-হল্লা থেমে গেছে।
এবার জলের পিপেগুলো বেশ কয়েকজন ধরে ধরে নিয়ে চলল রান্না ঘরের পাশে রেখে দেওয়ার জন্যে।
রাতের খাওয়া শেষ হতেই ঘর ঘর শব্দে নোঙর তোলা হলো। পাটাতন তুলে ফেলা হলো। নোঙরের দড়ি আলগা হতেই জাহাজ তীরভূমি থেকে সরে আসতে লাগল। দোনিয়াকে নিয়ে ফ্রান্সিস জাহাজ চালক ফ্লাইজারের কাছে এলো। দোনিয়ার নির্দেশমতো ফ্লাইজার জাহাজ চালাতে লাগল সরাসরি বন্দরের উদ্দেশ্যে।
জোর বাতাস, জাহাজের পালগুলো ফুলে উঠল। সমুদ্রে উঁচু ঢেউ উঠছে না। ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় চাঁদের আলো চিক্ চিক্ করছে। ভাইকিং বন্ধুরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গেল। দাঁড় টানার আর দরকার নেই। তৃষ্ণার জল পেয়ে এখন সবাই মোটামুটি সুস্থ। তার ওপর দাঁড় টানার পরিশ্রম থেকেও মুক্তি পেয়েছে।
জাহাজ চলল। পথে ঝড়বৃষ্টির পাল্লায় পড়তে হয় নি। শুধু এক সকালে ঘন কুয়াশায় দিগভ্রম হবার উপক্রম হয়েছিল। সোনিয়া দিক ঠিক করে চালক ফ্লাইজারকে জাহাজ চালাবার নির্দেশ দিয়েছিল। দু’দিন পরেই ফ্রান্সিসদের জাহাজ সার্দিনিয়া দ্বীপের কাছে এলো। সমুদ্রতীরের কাছ দিয়ে জাহাজ চলতে লাগল।
পরদিন বিকেলের দিকেদূর থেকে সাসারিবন্দর দেখা গেল। দুটো মালবাহী জাহাজ নোঙরকরা ছিল। রাজা এনজিওর শৌখিন জাহাজটার কাছে ফ্রান্সিসদের জাহাজ ভিড়ল। নোঙরকরা হলো।
ফ্রান্সিস আর দেরি করতে চাইছিল না। অনেক কষ্টে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া গেছে। এই সূত্রে নির্ভর করেই সোনার যোদ্ধামূর্তিগুলো উদ্ধার করতে হবে।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—দোনিয়া আর শাঙ্কোকে খবর দাও। আমরা এখুনি নুরাঘির ঘরটায় যাবো, রাতে থাকবো। কাল সকাল থেকেই অনুসন্ধান চালাবো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো নৌকোয় চড়ে ফ্রান্সিসরা নুরাঘিটায় এলো। ফ্রান্সিস নিজেদের ঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথার পেছনে দু’হাত রেখে চোখ বুজে রইল। হ্যারি দক্ষিণের জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অস্তগামী সূর্যের আলো পড়েছে খাঁড়ির জলে। ছোট ছোট ঢেউ তোলা জল কেমন লালচে হয়ে উঠেছে। এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে নি। দোনিয়া চুপ করে বসেছিল। ভাবছিল—ফ্রান্সিস একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়েছে। কিন্তু ঐ সূত্রের ওপর নির্ভর করে কি যোদ্ধামূর্তিগুলো উদ্ধার করা যাবে? দোনিয়ার মনের কথা যেন ফ্রান্সিস বুঝতে পারল। বলল—দোনিয়া, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঐ ভাঙা নুরাঘিটার হাত তিরিশেক দূরে নৌকোটা ডুবেছিল। কাজেই ঐ জায়গাটাকে কেন্দ্র করেই আমাদের তল্লাশি চালাতে হবে।
—কিন্তু সেই এলাকাটাও নেহাৎ ছোট নয়—দোনিয়া বলল।
—ঠিক, আস্তে আস্তে ঠিক জায়গাটার হদিশ পাবো—ফ্রান্সিস বলল।
ওদের কথাবার্তা শুনে হ্যারি এসে বিছানায় বসে বলল—আচ্ছা দোনিয়া,ঐ নুরাঘিটায় ধস নেমেছিল কবে?
—সঠিক সময়টা আমি কোথাও পাইনি। তবে অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য থেকে হিসেব করে একটা আন্দাজ করা যায়—দোনিয়া বলল।
আন্দাজ করেই বলুন না—ফ্রান্সিস বলল।
—মানে ঐ নুরাঘির ধস নামার ব্যাপারটা নৌকোডুবিটার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে এটা আমি কোনোদিন ভাবি নি—দোনিয়া বলল।
—এবার তো ভাবতেই হবে। হ্যারি বলল।
দোনিয়া আর কোনো কথা না বলে চুপ করে মাথা একটু ঝুঁকে হিসেবটা করতে লাগল। ফ্রান্সিস হ্যারি ও চুপ করে রইল।
সন্ধে হলো। ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। একজন সৈন্য এসে দেয়ালের পাথরের খাঁজে বসানো মশালটা জ্বেলে দিয়ে গেল।
একসময় দোনিয়া বলল যতদুর হিসেবে পাচ্ছি তাতে ঐ নুরাঘির ধস নেমেছিল মুজাহিদ যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যাবার পরে।
—কতদিন পরে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
—তাতে সঠিক বলতে পারবো না—দোনিয়া মাথা নেড়ে বলল।
হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস তোমার কি মনে হয় মুবারক যোদ্ধামূর্তি উদ্ধার করতে এসেছিল?
ফ্রান্সিস গলায় বেশ জোর দিয়ে বলল—নিশ্চয়ই এসেছিল।
তারপর বলল—আমার মনে হয় মুবারক বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে নি। মুবারক একাই এসেছিল আর দিনে নয়, রাতে সন্ধান চালিয়েছিল।
—রাতে কেন—দোনিয়া বলল।
—দিনে সন্ধানের কাজ চালাতে গেলে সহজেই এখানকার লোকেদের চোখে, বিশেষ করে সমুদ্রে যারা মাছ ধরে সেই জেলেদের নজর পড়ে যেত। তাছাড়া ভুলে যাবেন না, মুবারক বিদেশি ছিল আরবি ছিল ওর মাতৃভাষা—হ্যারি বলল।
—হুঁ কথাটা ঠিক, দোনিয়া আপনমনে বলল। কেউ কোনো কথা বলল না।
রাতের খাওয়াদাওয়ার তখনও কিছু দেরি। সেনাপতি ঘরে ঢুকে। দোনিয়াকে বলল—মহামান্য রাজা আপনদের কাল সকালে দেখা করতে বলেছেন।
দোনিয়া মাথা কাত করে বলল—বেশ যাবো।
এবার চলে যেতে গিয়েও সেনাপতি ঘুরে দাঁড়িয়ে। বলল—আর একটা কথা। শুনলাম, আপনারা আজকে ঐ ধসে পড়া নুরাঘিটায় নাকি উঠেছিলেন।
—হ্যাঁ, খোঁজ করতে উঠেছিলাম। হ্যারি বলল।
—ভালো করেন নি। মহামান্য রাজার জাহাজ থেকে আমাদের সৈন্যরা দেখেছে, এখানকার জেলেরাও দেখেছে। এখনও ঐ নুরাঘির মাথা থেকে ধস নামে। আপনারা বিপদে পড়তে পারেন সেনাপতি বলল।
হ্যারি ফ্রান্সিসকে কথাটা বুঝিয়ে বলল। ফ্রান্সিস বলল—বলল যে আমরা এখন থেকে সাবধান হবো। তবে নুরার্থিটায় আর তার ধারে-কাছে খোঁজ করতেই হবে।
হ্যারি বলল সেকথা।
সে,আপনাদের দায়িত্ব! আমার সাবধান করার করে গেলাম—কথাটা বলে সেনাপতি চলে গেল।
পরদিন ফ্রান্সিসদের সকালের খাওয়া শেষ হতে সেনাপতি এলো। ওরা সেনাপতির সঙ্গে সাসারির রাজপ্রাসাদের দিকে চলল।
রাজা এনজিও সিংহাসনে বসে আছেন। বাঁপাশের আসনে স্পিনোলা বসে। রাজা এনজিও দোনিয়াকে বললেন-যোদ্ধামূর্তিগুলোর কোনো হদিশ পেলেন?
দোনিয়া বলল যা বলার ফ্রান্সিস বলবেন।
ফ্রান্সিস একটু এগিয়ে বলল—মান্যবর রাজা আমরা একটু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়েছি। তার ওপর নির্ভর করেই আমরা সন্ধানকার্য চালাবো।
—সেই গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটা কি? স্পিনোলা কুটিলদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
ফ্রান্সিস সাবধান হলো। বলল—সেটা যথাসময় বলবো। তবে সবটাই এখনো অনুমানের পর্যায় আছে। কয়েকটা দিন সন্ধান চালিয়ে তবেই যাচাই করতে পারবো।
—কতদিন লাগবে?আমাকে তো রাজধানীতে ফিরে যেতে হবে—রাজা এনজিও বলল।
—কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক করে উদ্ধার করতে পারবো কিনা সেটা বলতে পারবো ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে, চেষ্টা চালিয়ে যান। তবে মহামান্য রাজাকে আমি বলেছি—আপনারা মিছিমিছি খাটাখাটুনি করেছেন। সেই মূল্যবান মূর্তিগুলো মুজাহিত তার রাজ্যে নিয়ে গিয়েছে—স্পিনোলা বলল।
—হয়তো আপনার অনুমান সত্য, তবে আমার কিন্তু স্থির বিশ্বাস মূর্তিগুলো এই খাঁড়ির জলের নীচেই আছে—ফ্রান্সিস বলল।
—হুঁ—স্পিনোলা আর কোনো কথা বলল না।
-আপনারা এবার যেতে পারেন। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করুন। রাজা এনজিও বলল।
—আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি—দোনিয়া বলল। সবাই মাথা নুইয়ে রাজাকে সম্মান জানিয়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে চলে এলো।
বিস্কো সকালেই মারিয়াকে আনতে চলে গিয়েছিল। ফ্রান্সিসরা নুরাঘির ঘাটে এসে দেখল—রাজার নৌকোয় বিস্কো, মারিয়া বসে আছে। হ্যারি সেই নৌকোয় উঠল। দোনিয়ার নৌকোয় উঠল ফ্রান্সিস আর মারিয়া। সামনে ফ্রান্সিসদের নৌকো। নৌকো চলল ভাঙা নুরাঘিটার দিকে।
কাছাকাছি যখন নৌকো পৌঁছল তখন অনেকটা চৌকোনো আকারের সেই সুড়ঙ্গটা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল—দোনিয়া, এই গোপন পথটা মুবারক যেভাবেই হোক খুঁজে বের করেছিল। এখানেই মুবারক নৌকোর সঙ্গে নিজেকেও লুকিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন এটার মুখে পাথুরে দেয়াল ছিল নিশ্চয়ই। গোপন পথটা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার জন্যে। ধস নামার সময় সেই দেয়ালটা ভেঙে পড়েছিল। লক্ষ্য করুন সুড়ঙ্গের মুখটার চারপাশের পাথরগুলো ভাঙা।
-বুঝলাম, কিন্তু নুরাঘিটার ধস নেমেছিল মুবারক এখানে আসার আগে না পরে? দোনিয়া বলল।
—আমার মনে হয় তার আগে—ফ্রান্সিস বলল।
দু’টো নৌকোই সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকল। এখানে অন্ধকার, সুড়ঙ্গপথে যেটুকু সামান্য আলো আসছে। অন্ধকারটা চোখে স’য়ে আসতে ফ্রান্সিস নৌকো থেকে সেই প্যাঁচপেচে পেছল কাদাভরা পাথরের সিঁড়িতে পা রাখল। বলল—বিস্কো তুমি আমার পেছনে এসো। কিন্তু সাবধান, ভীষণ পেছল, পা টিপেটিপে এসো।
বিস্কোও নামছে তখনই মারিয়া বলল—বিস্কো বলেছে সেনাপতি নাকি এই নুরাঘিতে উঠতে মানা করেছে।
অন্ধকার সিঁড়ি থেকে ফ্রান্সিস বলল—উপায় নেই, তবে ভয় নেই। আমরা সাবধান থাকবো। অন্ধকার সুড়ঙ্গে ফ্রান্সিসের কথাগুলো বেশ জোরালো শোনালো।
অন্ধকারে ফ্রান্সিস পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। তখনই ভাবল, ভুল হয়েছে, একটা মশাল আনতে হতো। পাঁচ-সাতটা সিঁড়ির পরেই আর জলকাদা নেই। শুকনো পাথর সিঁড়িতে আগেই পেতেছিল। নিশ্চিন্তে উঠতে লাগল।
চত্বরমতো জায়গাটায় আসতেই বাঁ দিকের বিরাট খোদল দিয়ে আলো আসছে দেখল। এখানটায় বেশি অন্ধকার নেই।
ফ্রান্সিস সারাক্ষণ কান খাড়া রাখছিল। যদি কোনো পাথর পড়ার শব্দ শোনে, সাবধান হতে পারবে। চত্বরটার পরে সিঁড়িটায় উঠতে যাবে তখনই ফ্রান্সিসের কানে এলো খুব মৃদু পাথর ঘষণির শব্দ। সঙ্গে-সঙ্গে ও পাশের পাথুরে দেয়ালে শরীরটা লেপ্টে দাঁড়াল আর গলা চড়িয়ে বলল—বিস্কো, ধস সাবধান।
বিস্কোও দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সত্যিই ওপর থেকে বেশ কয়েকটা পাথর ঠকঠক শব্দ তুলে সিঁড়ির ওপর দিয়ে ধসে পড়ল, ছোট চত্বরটার ওপর। ফ্রান্সিসের গা ঘেঁষেই পাথরের বড় বড় চৌকোনো টুকরোগুলো গড়িয়ে পড়ল। একটা পাথর বিস্কোর পায়ের পাতায় প্রায় গড়িয়ে পড়েছিল। বিস্কো দ্রুত পা সরিয়ে নিল। ধুলো উড়ল।
ধস থামতে ফ্রান্সিস পাথর ডিঙিয়ে ছোট চত্বরটায় নামতে যাবে, তখনই ঐ অল্প আলোয় দেখল দু’টো পাথরের মধ্যে চৌকোনো মতো কি যেন আটকে আছে। ফ্রান্সিস নিচু হয়ে দেখেও বুঝল না জিনিসটা কি? ও হাত বাড়িয়ে দু’টো পাথরের জোড় থেকে জিনিসটা টেনে খুলে আনল। সামান্য আলোয় দেখল চৌকোনো মতো কি যেন। তামা বা পেতলের পাতের মতো জিনিসটার ওপর থেকে ধুলোবালি ময়লা হাত দিয়ে মুছে ফেলতেই বুঝল—পেতল-তামা নয়, সোনা আর তাতে গোল গোল কাজ করা।
ওদিকে নৌকো থেকে হ্যারি, মারিয়া ধস নামার শব্দ শুনে তখন ফ্রান্সিস, বিস্কোকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। বিস্কো চেঁচিয়ে বলল—ভয় নেই, আমরা নিরাপদ।
সোনার জিনিসটায় কিছু কিছু কাজ করা আছে। ফ্রান্সিস দ্রুত ভাবতে লাগল—সোনার এই জিনিসটা কী হতে পারে। হঠাৎ ওর মনে পড়ল গির্জায় দেখা সেই ব্রোঞ্জের ছোটো যোদ্ধামূর্তির কথা। মূর্তিটার বাঁ হাতে ঠিক এমনি একটা ঢাল ছিল। তাহলে কি নিখোঁজ একটি যোদ্ধামূর্তির ঢাল এটা? ফ্রান্সিস চমকে উঠল। তাহলে মুবারক কি একটা মূর্তি উদ্ধার করতে পেরেছিল? ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল না। ঢালটা কোমরে গুঁজে দ্রুত সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল—বিস্কো, নামবো চলো।
পেছল সিঁড়িগুলো সাবধানে পার হয়ে নৌকোয় উঠল দু’জনে।
নৌকো ছেড়ে দিয়ে ফ্রান্সিস বলল—দোনিয়া, যোদ্ধামূর্তির একটা ভাঙা ঢাল আমি পেয়েছি।
দোনিয়া ভীষণ চমকে উঠে বলল—সত্যি?
ততক্ষণে নৌকো সুড়ঙ্গটার বাইরে চলে এসেছে। ফ্রান্সিস কোমরে গুঁজে রাখা ভাঙা ঢালটা বের করল। উজ্জ্বল রোদে দেখল, ওটা ঢালই। দোনিয়া হাত বাড়িয়ে ঢালটা নিলো। দেখে বলল—আপনার অনুমান ঠিক, এটা সৈন্য মূর্তির ভাঙা ঢাল।
—তার মানে আস্ত মূর্তিটা তাহলে যেখানে ঢালটা পেয়েছি সেখানেই কোথাও পাথরের নীচে চাপা পড়ে আছে—ফ্রান্সিস বলল।
দোনিয়া একটু ভেবে বলল—তারমানে অন্তত একটা মূর্তি মুবারক উদ্ধার করতে পেরেছিল। কিন্তু কোনো কারণে সেটা ফেলে যেতে হয়েছে আর ঐ মূর্তিটা ওখানেই পাওয়া যাবে।
ফ্রান্সিস দোনিয়ার হাত থেকে ঢালটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভাবল—ঢালটা উঁচুতে তুলে মারিয়া হ্যারি আর বিস্কোকে দেখাবে। দোনিয়া দ্রুত চারদিকে তাকাল। দেখল, খাঁড়ির পুবপারে একটা নৌকো ভাসছে। নৌকোর দু’জন জেলে ফ্রান্সিসের দিকেই তাকিয়ে আছে। দোনিয়া চাপাস্বরে বলে উঠল –ফ্রান্সিস, ঢালটা লুকোও নজরদারি চলছে।
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হ’ল। আলগোছে ঢালটা হাত থেকে ছেড়ে দিল। নৌকোর গলুইয়ে পড়ল এটা। হ্যারি ওদের নৌকো থেকে গলা চড়িয়ে বলল—কি বলছিলে ফ্রান্সিস ?
ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে গলা চড়িয়ে বলল—কিছু না।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে দাঁড় টানতে লাগল। নৌকো দু’টো লল নুরাঘির ঘাটের দিকে। সারা নৌকাপথে ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না। ঘাটে নৌকো দুটো এসে লাগল। তার আগেই ফ্রান্সিস সোনার ঢালটা নৌকোর গলুই থেকে তুলে কোমরে গুঁজে নিয়েছিল। নুরাঘিতে ঢোকার মুখে সদর দেউড়িতে সেনাপতির সঙ্গে দেখা। সেনাপতি দোনিয়াকে বলল—হদিশ পেলেন কিছু?
তল্লাসি চালাচ্ছি দেখা যাক। দোনিয়া বলল।
একেবারে ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল—হ্যারি একটা যোদ্ধামূর্তির ভাঙা ঢাল পেয়েছি। সোনার ঢাল।
হ্যারি চমকে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। মারিয়া চেঁচিয়ে উঠলো-বলো কি?
তখনই দু’জন সৈন্য ওদের দুপুরের খাবার নিয়ে ঢুকল। ফ্রান্সিস চোখের ইশারায় হ্যারি আর মারিয়াকে চুপ করে থাকতে বলল। সবাই বিছানায় বসে খেতে লাগল। খাওয়া শেষ হ’ল। সৈন্য দু’জন এঁটো থালা চিনামাটির বাটি নিয়ে চলে গেল।
এবার ফ্রান্সিস কোমর থেকে ভাঙা ঢালটা নিয়ে মারিয়ার হাতে দিল। মারিয়া খুশিতে আত্মহারা তখন। হ্যারি আর বিস্কো ঝুঁকে পড়ে সোনার ঢালটা দেখতে লাগল।
ফ্রান্সিস এসময় যা করে তাই করল। দু’হাতের তালু মাথার নীচে রেখে শুয়ে পড়ল। দোনিয়াও ওর পাশে আধশোয়া হলো। ফ্রান্সিসের মাথায় তখন অনেক চিন্তা। সেই চিন্তার কথাই বলবার জন্যে ডাকল—দোনিয়া।
—বলুন—দোনিয়া ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাল।
-দেখুন, আমার মনে হয় মুবারক একাই মূর্তিগুলো জলের তলা থেকে উদ্ধার » করতে এসেছিল ফ্রান্সিস বলল।
—আমারও তাই মনে হয়—দোনিয়া বলল কিন্তু ক’টা মূর্তি মুবারক উদ্ধার করতে পেরেছিল, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।
ফ্রান্সিস বলল—আজ থাক, বিকেল হয়ে গেলে খোঁজা যাবে না। কালকে সকালে গিয়েই যে জায়গায় ঢালটা পেয়েছি সেখানে ভালো করে খুজতে হবে। মারিয়া হ্যারি নৌকোয় থাকবে। আমরা তিনজন উঠে পাথর সরিয়ে খুঁজবো।
—হুঁ সাবধানে খুঁজতে হবে। আজকেও তো ধস নেমেছিল। আমরা নীচে থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনেছি, দোনিয়া বলল।
ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না। চোখ বুজে শুয়ে রইল। মারিয়া ঢালটা হ্যারির হাতে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে গির্জাঘরের দিকে চলল। গির্জায় ঢুকে যে কুলুঙ্গিতে ব্রোঞ্জের যে ছোট্ট মূর্তিটা ছিল সেটার কাছে গেল। মূর্তির ঢালটার কারুকাজের সঙ্গে সোনার ঢালটার কারুকাজ মিলিয়ে। বুঝল—হুঁবহু এক। শুধু সোনার ঢালটা আকারে বড়ো। ঘরে ঢুকে বলল, ফ্রান্সিস—ব্রোঞ্জের মূর্তির ঢালের সঙ্গে মিলে গেছে। হুবহু এক, একইরকম কাজ।
ফ্রান্সিস চোখ না খুলেই মৃদু হেসে মাথা নাড়ল।
পরদিন সকালের খাবার খেয়েই নৌকায় চড়ে ফ্রান্সিসরা ভাঙা নুরাঘির দিকে চলল। অন্ধকারমতো সুড়ঙ্গটায় ঢুকল। নৌকো ভেড়াল পাথরের সিঁড়ির ধারে।
ফ্রান্সিস, বিস্কো আর দোনিয়া পেছল সিঁড়িতে নামল। ফ্রান্সিসের নির্দেশমতো বিস্কো আগেই একটা মশাল এনে নৌকোয় রেখেছিল। কোমরে গুঁজে এনেছিল লোহার টুকরো আর চকমকি পাথর। বিস্কোমশালটা তুলে ফ্রান্সিসকে দিল। তারপর চকমকি ঠুকে মশালটায় আগুন ধরাল। এবার মশালটা হাতে নিয়ে ভীষণ পেছল সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে উঠতে লাগল। মশালের আলোয় সিঁড়ির ধাপগুলো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। তিনজনে সাবধানে উঠতে লাগল সেই কাদা ল্যাপটানো সিঁড়িগুলো দিয়ে। পেছল সিঁড়ি শেষ। এবার ওঠাটা সহজ হলো। ফ্রান্সিস উঠতে বলল—বিস্কো দোনিয়া কান খাড়া রাখুন। পাথরের সামান্য নড়াচড়ার শব্দ হলেই দাঁড়িয়ে পড়বেন দেয়াল ঘেঁছে।
আস্তে আস্তে তিনজনেই সেই বাঁ দিকের বিরাট খোঁদলের পাশে ছোট্ট চত্বরটায় এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস যে পাথর দু’টোর মাঝখানে আটকে-থাকা সোনার ভাঙা ঢালটা দেখেছিল, সেখানটা ভালো করে দেখতে লাগল। ওখানটায় পাথরের স্তূপ যেন। কিছুক্ষণ দেখেটেখে ফ্রান্সিস বলল—বিস্কো, মশালটা একটু ওপরে পাথরের খোঁজ বসিয়ে দাও।
বিস্কো কয়েকটা ধসে—পড়া পাথর ডিঙিয়ে একটা পাথরের খাঁজ বের করে। জুলন্ত মশালটা বসিয়ে দিল। জায়গাটা বেশ স্পষ্টই দেখা গেল।
একটু পরে ফ্রান্সিস বলল, বিস্কো পাথরের চৌকোনো খণ্ডগুলো আস্তে আস্তে সরাতে হবে। দোনিয়া, আপনিও হাত লাগান। তিনজনে মিলে আস্তে আস্তে সাবধানে পাথরগুলো সরিয়ে চত্বরের একপাশে রাখতে লাগল। পাথরগুলো ভারী, তিনজনেরই যথেষ্ট পরিশ্রম হ’তে লাগল। হাঁপাতে লাগল তিনজনেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা অনেকটা পরিস্কার হলো। কিন্তু কোনো যোদ্ধামূর্তির হদিশ পাওয়া গেল না। ফ্রান্সিস বলল—বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক।
তিনজনেই সিঁড়িগুলোয় বসল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর ফ্রান্সিস ই প্রথম উঠল। ওপরের সিঁড়ি যতটা পরিষ্কার হয়েছে, ততটা পর্যন্ত উঠল। তারপর কয়েকটা পাথর ডিঙিয়ে ওপরে একটা কাত হয়ে থাকা পাথরে পা রাখতেই ওখানে পাথরগুলো নাড়া খেল। আশেপাশের কয়েকটা পাথর গড়িয়ে গেল। ফ্রান্সিস ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে গিয়ে কোনরকমে উঠে দাঁড়াল। গড়ানো পাথর ডিঙিয়ে আসতে গিয়ে হঠাৎ দেখল পাথরের জটলার নীচে সিঁড়িতে কি যেন পড়ে রয়েছে। জায়গাটা অন্ধকার, মশালের আলো পৌঁছোয় নি। ওদিকে পায়ের নীচে পাথর গড়িছে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস পা রাখতে পারছেনা। ও দ্রুত একটা গড়ানো পাথরে ভর রেখে লাফ দিয়ে নীচের দুটো সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে পরিষ্কার সিঁড়িতে নেমে এলো। তখনও হাঁপাচ্ছে ফ্রান্সিস একটু দম নিয়ে ফ্রান্সিস আঙুল দিয়ে ওপরটা দেখিয়ে বলল—বিস্কো, ওখানের সিঁড়িতে একটা কিছু নজর পড়ল। ঐ পর্যন্ত পাথরগুলো সরাতে। হাত লাগাও।
তিনজনে আবার পাথর নামিয়ে আনতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সিঁড়ির সেই ধাপটা দেখা গেল। ফ্রান্সিস দ্রুত পায়ে উঠে এলো। এবার ভালোভাবেই দেখল ধুলো পাথরের কুচির নীচে কি যেন কিছুটা বেরিয়ে আছে। ফ্রান্সিস নুয়ে পড়ে ধুলো পাথরকুচি সরিয়ে ওটা টান দিতেই দেখল—সিংওয়ালা শিরস্ত্রাণ। সবটা বের করতেই দেখল সোনার যোদ্ধামূর্তি। ব্রোঞ্জের মূর্তিটার তিনগুণ। মূর্তির সোনার গা-টায় কেমন কালচে, ছোপ ছোপ। অনেকদিনের বৃষ্টি ধুলোবালিতে সোনালি রংটা যেন ঢাকা পড়ে গেছে। ফ্রান্সিস মূর্তিটা হাত দিয়ে তুলতে গিয়ে দেখল ঠিক শিং-এর জোড়াটায় দড়িবাঁধা। মূর্তি কিছুটা তুলতে বাঁধা দড়িটাও উঠল কয়েক হাত। তবে বৃষ্টির জলে পচে কালো হয়ে যাওয়া দড়িটা একটানেই ছিঁড়ে গেল। ফ্রান্সিস বুঝল মুবারক দড়ি বেঁধেইমূর্তিটা জলের তলা থেকে তুলেছিল। ও শ্যেন দৃষ্টিতে কাছাকাছি পাথরের নীচে তাকাতে লাগল। নাঃ—আর কোনো মূর্তি নেই।
নীচে থেকে বিস্কো চেঁচিয়ে বলল—কি হলো ফ্রান্সিস ?
ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়িয়ে মূর্তিটা উঁচু করে ধরল। বিস্কো আনন্দে চিৎকার করে উঠল—ও—হো—হো—হো। দোনিয়াও হাসল। নীচে নৌকোয়-বসা মারিয়া আর হ্যারির কানে ভাইকিংদের এই উল্লাসধ্বনির শব্দ গিয়ে পৌঁছল। হ্যারি হেসে বলল—রাজকুমারী, ফ্রান্সিস নিশ্চয়ই মূর্তিগুলোর হদিশ পেয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে বিস্কো মশাল হাতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। পেছনে ফ্রান্সিস আর দোনিয়া। ওদের ভাগ্য ভালো আজ আর ধস নামেনি।
ফ্রান্সিস নৌকোয় ওঠার আগে হাত বাড়িয়ে মূর্তিটা মারিয়ার হাতে দিল। মারিয়া মূর্তিটা হাতে নিয়ে খুশিতে হেসে উঠল। তখনই লক্ষ্য করল মূর্তিটার হাতের ঢালটা নেই। তার মানে আস্ত মূর্তি একটাই। মারিয়া গায়ের পোশাকের কাপড় দিয়ে মুর্তিটার গায়ে ঘষে দিল। মশালের আলোয় সোনালি রং একটু ঝিকিয়ে উঠল। হ্যারি বলল রাজকুমারী, সুড়ঙ্গের বাইরে যাবার আগে মূর্তিটা পোশাকে লুকিয়ে রাখুন।
মারিয়া তাই করল। মশাল জলে চুবিয়ে নিভিয়ে বিস্কো এসে নৌকোয় উঠল। দু’টো নৌকোই সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে খাঁড়ির জলে এসে। চলল নুরাঘির দিকে।
নুরাঘিরসদর দেউড়িতে আজও সেনাপতি দাঁড়িয়েছিল। দোনিয়াকে বলল—কতদূর এগোলেন?
-আর কয়েকটা দিন যাক—দোনিয়া বলল।
ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস যথারীতি মাথার পেছনে দু’হাতের তালু রেখে শুয়ে পড়ল। সবাই মূর্তিটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। দোনিয়াও দেখল,তারপর হাঁটুর ওপর দু’হাত আড়াআড়ি রেখে মাথা গুঁজে রইল। খাওয়ার সময় হয়েছে বুঝে মারিয়া মূর্তিটা বিছানার কোণে নীচে ঢুকিয়ে রাখল। ঢালটাও ওখানেই রেখেছিল।
খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিস আর শুয়ে পড়ল না। দোনিয়া বিছানায় আধশোওয়া হলো। হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস এবার কি করবে?
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল—দেখো, আমার মনে হয় মুবারক ঐ একটা মূর্তিই দড়ি বেঁধে তুলতে পেরেছিল। আরগুলো তুলতে পারেনি।
দোনিয়া বলল—কি করে বুঝলেন যে বাকিগুলো তুলতে পারেনি?
—আমার এটা অনুমান। ব্যাপারটা এই রকম ঘটেছিল।
—মুবারক একাই এখানে এসেছিল। তখন নুরাঘিটায় ধস নামেনি। মুবারক গোপন পথটা দিয়ে নুরাঘির ওপরের দিকে ছোট চত্বরটায় আশ্রয় নিয়েছিল। মুবারক নৌকোর সাহায্য নেয় নি। কারণ ও ঠিক জায়গাটা বুঝতে পেরেছিল। ও পাথুরে দেয়ালের কথা যে চিঠিতে লিখে কেটে দিয়েছিল, সেটা ছিল সুড়ঙ্গের সামনের দেয়ালটা—ফ্রান্সিস থামল।
তারপর ভেবে নিয়ে বলতে লাগল –মুবারক দিনের বেলা সুড়ঙ্গটি দিয়ে জলে সাঁতরে খাড়ির জলে আসতো। তারপর চারদিকে কোনো জেলেদের নৌকো বা জাহাজ যখন দেখতো না তখন নিশ্চিন্ত হয় নিঃশব্দে সাঁতরে দেয়াল থেকে দূরত্ব আন্দাজ করে জলে ডুব দিতো। জলের নীচে মাটিতে কাদায় ডুবে যাওয়া নৌকোটা খুঁজতো। এইভাবে দিনের পর দিন খুঁজেমুবারক একটা মূর্তি পেয়েছিল। সেটাতে দড়ি বেঁধে সুড়ঙ্গের অন্ধকার থেকে দড়ি টেনে মূর্তিটা নিয়ে এসেছিল।
—অন্য মূর্তিগুলো দেখেছিল কি? দোনিয়া বলল।
—হয়তো দেখেছিল, কিন্তু জলে ডুব দিয়ে মূর্তিতে দড়ি বাঁধতে যেটুকু দমের দরকার তাতে একটা মূর্তিতেইদড়ি বাঁধা সম্ভব। যা হোক যে কারণেই হোক বা কোনো জেলেনৌকো বা জাহাজ এসে পড়েছিল বলেই হোক মুবারক আর জলে নামে নি—ফ্রান্সিস থামল।
-–তারপর মুবারক কি আর মূর্তি তুলতে পারে নি? হ্যারি বলল।
—না পারেনি-কারণ মূর্তিটা মুবারকনুরাঘির ওপরে ঐ ছোট চত্বরটার কাছে রেখেছিল এবং সেই রাতেই নুরাঘিতে ধস নেমেছিল। মুবারক নিজেকে বাঁচাবার মতো সময় পায়নি। ধসের পাথর ধুলোবালির সঙ্গে সে ছিটকে পড়েছিল খাঁড়িরজলে। মুবারকমারা গিয়েছিল এবং হঠাই। শুধুমূর্তিটাই থেকে গেল। তবে অটুট নয়। ধসের পাথরের ধাক্কায় মূর্তির হাতের ঢাল ভেঙে গড়িয়ে পড়েছিল। ওটাই আমার প্রথমে পেয়েছিলাম—ফ্রান্সিস থামল।
সকলেই চুপ করে রইল। একসময় দোনিয়া বলল তাহলে বাকি মূর্তিগুলো এবং সবচেয়ে বড় মূর্তিটা সবই এখানে জলের নীচেই আছে?
—হ্যাঁ, আমার এটাই অনুমান—ফ্রান্সিস বলল—তবে আজকে নয়—কালকে একটু বেলার কড়া রোদের সময় সুড়ঙ্গ থেকে জলে নামবো। তারপর জলের নীচে যতটা সম্ভব দেখে বুঝতে পারবো। চড়া রোদে জলের নীচে অনেকটা দেখা যাবে।
পরের দিন একটু বেলায় ফ্রান্সিসরা নৌকো নিয়ে ভাঙা নুরাঘির সুড়ঙ্গমতো মুখটার কাছে এলো৷ ফ্রান্সিস অনেকটা নিঃশ্বাস নিয়ে জলে ডুব দিল। নীচেহাত দশেক নামতেই দেখল ভাঙা নুরাঘিটার পাথর ছড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস দিকঠিক রেখে খাঁড়ির মাঝখানের দিকে চলল। হিসেব করে হাত কুড়ি আসার আগেই ওরদম ফুরিয়ে এলো। হাতে-পায়ে জল ঠেলে ও জলের ওপর উঠল। দোনিয়া আশ্চর্য হয়ে বলল—ফ্রান্সিস এতক্ষণ জলে ডুবে থাকতে পারে?
হ্যারি হেসে বলল—ফ্রান্সিস মুক্তো শিকারীদের সঙ্গে থেকে জলের নীচে অনেকক্ষণ ডুবে থাকার কায়দাকানুন শিখেছে।
ফ্রান্সিস আবার ডুব দিল। জল এখানে ততটা ঘোলা নয়, রোদেরও তেজ আছে। দেখল—নুরাঘির ভাঙা পাথরগুলো এতদূর পর্যন্ত আসেনি। ফ্রান্সিস জায়গাটায় একবার চক্কর দিয়ে জলের ওপরে উঠল। এবার সুড়ঙ্গটার দিকে তাকাল। সুড়ঙ্গটার সমান্তরালে সরে এলো। তারপর হিসেব করে হাত দশেক স’রে একটা দূরত্ব আন্দাজ করে ডুব দিল।
দ্রুত জল দু’হাত পায়ে ঠেলে নেমে এলো তলে মাটি, পাথরকুচি, কাদার কাছে। বাইরের উজ্জ্বল রোদ এখানে অল্পই পৌঁছেছে। একটা চক্কর দিতেই কেমন ঝাপসা দেখল কাদামাটিতে একটা বড় নৌকোর লোহার খাঁচা অনেকটা গেঁথে আছে। লোহার খাঁচাটা হদে কালো জং ধরা। নৌকোর কাঠ পচে গিয়ে কাদার সঙ্গে মিশে গেছে। হঠাৎ ফ্রান্সিসের অস্পষ্ট নজরে পড়ল লোহার খাঁচার পাশে, কাদায় কি যেন উঁচু হয়ে আছে। ফ্রান্সিস ওটা ধরে টানতেই উঠে এলো। আর একটা সোনার যোদ্ধামূর্তি। দম শেষ হয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস বুঝল ভারী মূর্তিটা এক হাতে নিয়ে জল ঠেলে ওঠা যাবে না। ও মূর্তিটা রেখে হাতে পায়ে জল ঠেলে দ্রুত ওপরে উঠে দেখল হাত কুড়ি দূরে দোনিয়ার নৌকো। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকল—দোনিয়া।
দোনিয়া ওর দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস হাত নেড়ে ডেকে বলল—এখানে আসুন।
দোনিয়া দাঁড় টেনে নৌকোটা ফ্রান্সিসের কাছে নিয়ে এলো। ফ্রান্সিস বলল—ঠিক এখানে নৌকোটা রাখুন, আপনার দড়ি বাঁধা বঁড়শিটা দিন। দোনিয়া নৌকোর গলুই থেকে বঁড়শি তুলে ফ্রান্সিসের হাতে দিল। বঁড়শি ঝুলিয়ে রেখে ফ্রান্সিস কিছুটা দড়ি কোমরে পেঁচিয়ে নিল। তারপর বলল—দড়ি ধরে দুটো হ্যাঁচকা টান দিলেই আপনি দড়ি টানতে শুরু করবেন।
কথাটা বলে বেশ দম নিয়ে ফ্রান্সিস ডুব দিল। যখন হাতে পায়ে জল ঠেলে নামছে তখন ও ভাবল—ঐ মূর্তিটা মুবারক হয়তো মাটি কাদা থেকে তুলে রেখে এসেছিল যে পরে রাতে দড়ি বেঁধে তুলবে বলে। দুর্ভাগ্য মুবারকের, তার সুযোগ আর ওর জীবনে এলো না।
ফ্রান্সিস মূর্তিটার কাছে পৌঁছল। কোমর থেকেদড়ি খুলল। মাথার সিং-এ মতো শিরস্ত্রা মাঝখানে বঁড়শিটা আটকে ও দড়িতে দুটো হ্যাঁচকা টান দিল। দোনিয়া দড়ি টানতে লাগল। মূর্তির প্রায় সঙ্গে ফ্রান্সিস জলের ওপর দিকে উঠতে লাগল। জল থেকে যখন মাথা তুলল তখন দেখল বঁড়শিতে ঝোলা অবস্থায় মূর্তিটার দিকে দোনিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হ্যারি, মারিয়া দেখল সেটা। ওরা ওদের নৌকো চালিয়ে দোনিয়ার নৌকোর কাছে এলো। ওরাও দেখতে লাগল মূর্তিটা। মারিয়া হাত বাড়িয়ে বঁড়শি থেকে মূর্তিটা খুলে নিয়ে নৌকোর মধ্যে রাখল। ফ্রান্সিস রাজার নৌকোটাতে উঠল। পাটাতনের ওপর শুয়ে পড়ল। হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল। অসহ্য ক্লান্তিতে শরীর নাড়াতে পারছে না। মারিয়া, হ্যারি দু’জনেই ফ্রান্সিসের কাছে সরে এলো। মারিয়া নিজের ঢোলা ঘেরের পোশাক পায়ের কাছে বেশ কিছুটা ছিঁড়ে ফেলল। ফ্রান্সিসের চোখ, মুখ, হাত, পা ঐ টুকরো কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিতে লাগল।
আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো। বলল—জানো হ্যারি, নুরাঘির পাথর ভেতরে বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। ভাগ্যি ভালো তারপরে কাদার মধ্যে মুবারকের নৌকোটা গেঁথে আছে। অন্য মূর্তিগুলো ওখানেই ছড়িয়ে আছে। যদি ওগুলো নুরাঘির ভাঙা পাথরে ভাঙা পাথরের নীচে চাপা পড়তো, তাহলে ওগুলো আর উদ্ধর করা যেতো কি না সন্দেহ
—তুমি অন্য মূর্তিগুলো দেখেছো? হ্যারি বলল।
—না, তবে ওখানেই ছড়িয়ে আছে। বেশ খোঁজখুঁজি করতে হবে আর কি। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া বলল—আজকে আর তুমি নেবো না, বিস্কো নামুক। বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে উঠে দোনিয়ার নৌকোয় লাফিয়ে উঠল। ফ্রান্সিসের মতো বঁড়শিবাঁধা দড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে নিয়ে জলে ঝাঁপ দিল।
বিস্কো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতে পায়ে জল ঠেলে নীচে নেমে এলো। এখানে আলো বেশ কম। সেটুকু আলোতেই বিস্কো পাথরকুচি মেশা কাদামাটির ওপর দাঁড়াল। ভাঙা নৌকোর লোহার জংধরা খাঁচটার ধারে নীচু হয়ে কাদামাটি সরাতে লাগল। হঠাৎই কি একটা হাতে ঠেকল। জোরে হঁচকা টান দিতেই একটা কাদামাখা পেতলের সুন্দর কারুকাজ করা ভাঙা বর্শা উঠে এলো। বিস্কোওটা ফেলে দিল। আবার কাদামাটি সরাতে লাগল। কিন্তু দম ফুরিয়ে আসছে। বিস্কো কাদামাটিতে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে জল ঠেলে উঠতে লাগল। যখন জলের মধ্যে পরিষ্কার আলোর আভাস পেল তখন ওর দম প্রায় শেষ। জলে জোরে পা চালিয়েও এক ধাক্কায় জলের ওপর উঠে এলো। ভুস করে উঠেই ও হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল।
ফ্রান্সিস দেখল সেটা। বুঝল আর একটু দেরি হলে বিস্কোর প্রাণসংশয় হত। ও চেঁচিয়ে বলল—বিস্কো উঠে এসো। একটু বিশ্রাম নিয়ে আমি নামছি।
বিস্কোরা তো জাতিতে ভাইকিং। যেমন দুঃসাহসী, তেমনি একরোখা। বিস্কো নৌকোয় উঠে এলো না। হাত দিয়ে জল ঠেলে একটুক্ষণ দম নিয়ে তারপর আবার ডুব দিল। বিস্কোর কপাল ভালো। দু’হাত দিয়ে তিন চারবার কাদা সরাতেই হাতে ঠেকল একটা যোদ্ধামূর্তি। কাদামাখা যোদ্ধামূর্তিটা টেনে তুলেই বঁড়শিতে আটকাল। তারপর জলের ওপর উঠে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—দোনিয়া, দড়ি টানুন।
দোনিয়া তৈরিই ছিল। দড়ি টানতে লাগল। লেপ্টে থাকা কাদা নিয়ে মূর্তিটা উঠে এলো। দোনিয়া মূর্তিটা বঁড়শি থেকে খুলে নিয়ে নৌকোয় রাখল। দেখল হুবহু আগের মূর্তিগুলোর মতোই। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল-বিস্কো আজ থাক। আবার কালকে নামা যাবে। একদিনে সব মূর্তি তোলা যাবে না। নৌকোয় উঠে এসো।
বিস্কো রাজার নৌকোয় উঠে এলো। মখাঁকরোঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে নৌকোদুটো চলল নুরাঘির ঘাটের দিকে। দুটো নৌকোই পাশাপাশি চলল। দোনিয়া ডাকল –ফ্রান্সিস
ফ্রান্সিস বলল—বলুন।
—ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখুন। নজরদাররা ঠিক বুঝেছে আর আমরা যে সোনার মূর্তি উদ্ধার করেছি, সেটা সবাই জেনে গেছে, সোনিয়া বলল।
সত্যিই তাই। দূর থেকেই ফ্রান্সিসরা দেখলো ঘাটে অনেক লোক জমে গেছে।
আস্তে আস্তে নৌকো দুটি ঘাটে লাগল। দেখা গেল সৈন্যরা তো আছেই আশেপাশের বসতি থেকেও অনেক লোক এসেছে। বৌ-মেয়েরা, বুড়োবুড়ি আর বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল। এখানে সকলেইজানে মুজাহিদ যোদ্ধামূর্তিগুলো চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো যে এই খাঁড়ির জলের নীচেই পড়েছিল এটা কেউ ভাবতেও পারে নি।
ফ্রান্সিস নৌকায় উঠে দাঁড়িয়ে বিস্কোকে বলল—বিস্কো মূর্তিদুটো উঁচু করে তুলে সবাইকে দেখাও। বিস্কো মূর্তিদুটি দু’হাতে তুলে সবাইকে দেখাতে লাগল। ঘাটে অত লোক। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। সকলেই অবাক হয়ে সেই মূর্তিদুটো দেখতে লাগল। উজ্জ্বল রোদ পড়েছে মূর্তিদুটোয় কাদামাটিতে ময়লা মূর্তির গায়ে এখানে-ওখানে সোনালি রঙটা দেখা গেল। বিস্ময়ভাব কেটে গেলে জমায়েত লোকেদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। তারপর আনন্দোল্লাস শুরু হ’ল নৌকো থেকে নামল সবাই। সেনাপতি দোনিয়ার কাছে এসে বলল—মহামান্য রাজা আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। হ্যারি বলল—আমাদের এখনও খাওয়া হয় নি।
দুই বন্ধুর গায়ের পোশাক ভেজা।
—ওসব জানি না। মহামান্য রাজা আপনাদের এক্ষুনি যেতে বলেছেন।
সেনাপতি গলায় বেশ জোর দিয়ে বলল। হ্যারি কথাটা ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে বলল—দুটো মূর্তিই নিয়ে চলো।
মূর্তিতে বিস্কো আগে চলল। সেনাপতি দু’একবার মূর্তিদুটোর দিকে বেশ লোভাতুরদৃষ্টিতে তাকাল। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল সেটা। বলল—বিস্কো, মূর্তিদুটো সেনাপতির হাতে দাও।
বিস্কো তাই করল। গোমড়ামুখো সেনাপতি মূর্তিদুটো হাতে নিয়ে খুশিতে আটখানা। সবকটা দাঁত বের করে হাসতে লাগল যেন সেই জলের তলা থেকে মূর্তিদুটো উদ্ধার করেছে। সেনাপতি মূর্তিদুটো দুহাতে উঁচু করে তুলে হাঁটতে লাগল। পেছনে লোকের জটলাও চলল। হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে পড়ল ভাঙা মূর্তিটা ওদের ঘরে রয়েছে। বিস্কোকে বলল—বিস্কো, আমাদের আস্তানা থেকে ভাঙা মূর্তিটা নিয়ে এসো।
সঙ্গে সঙ্গে মারিয়া ফিস ফিস করে বলল—ওটা থাক না।
ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকাল। তারপর বলল—মারিয়া, মূর্তিটা রাজা এনজিওর সম্পত্তি। ওটার ওপর আমাদের কোনো অধিকার নেই।
—কি সুন্দর মূর্তিটা! মারিয়া যেন আপন মনে বলল।
—উপায় নেই, ফিরিয়ে দিতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া কয়েক পা দ্রুত হেঁটে গেল। ফ্রান্সিস বুঝল, মারিয়া মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। ও মৃদু হেসে হাঁটতে লাগল।
রাজ এনজিও সিংহাসনেই বসে ছিল। মাথায় মুকুট গায়ে রাজকীয় পোশাক নেই। হাল্কা হলুদ রঙের একটা জোব্বামতো গায়ে। জোব্বায় সোনালি রূপোলি সুতোর কাজ করা। বাঁ দিকের ডানদিকের দুটো আসনে স্পিনোলা আর স্পিনোলারই সঙ্গী একজন
অমত্য বসে আছেন।
সেনাপতি মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়েই মূর্তিদুটো দু’হাতে তুলে ধরল। তারপর সিংহাসনের কাছে গিয়ে একটি মূর্তি রাজাকে অন্যটি স্পিনোলাকে দিল। তখন বিস্কো এসে দাঁড়িয়েছে। সেনাপতি বিস্কোর হাত থেকে ভাঙা মূর্তিটা নিয়ে অমাত্যকে দিল।
তিনজনই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। এত সহজে মূর্তিগুলো উদ্ধার করা হবে আর তাদের হাতে আসবে, এটা বোধহয় তারা কল্পনাও করেন নি। রাজা এনজিও আনন্দে সিংহাসন থেকে উঠে পঁড়িয়ে মূর্তিটা দু’হাতে উঁচু করে তুললাম। মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রাজা হাসতে লাগল। রাজা এনজিও সিংহাসনে আবার বসতে স্পিনোলা ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন—কিন্তু সবচেয়ে বড় পঞ্চম মূর্তিটা কোথায়?
ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল—ওটা এখনও জলের নীচেই আছে।
ঠিক আছে—স্পিনোলা এবার রাজাকে বললেন—মহামান্য রাজা। বাকি মূর্তিগুলো আমাদের নৌসেনা বাহিনীর বাছাই করা কয়েকজন সৈন্য তুলবে। আপনি কী বলেন?
—বেশ তো-তবে আমার তাড়াতাড়ি চাই, রাজা বলল।
ফ্রান্সিস বুঝল স্পিনোলার মতলব ভালো নয়। নিজেরা বাকিমূর্তি গুনে দোনিয়ার সমমূল্যের চারভাগের এক ভাগ অর্থ পাওয়ার দাবিটা নস্যাৎ করে দেবেন স্পিনোলা। ফ্রান্সিস রাজার দিকে তাকিয়ে বলল—মান্যবর রাজা দোনিয়ার কিন্তু একটা শর্ত ছিল।
—কি শর্ত বলুন তো? রাজা একটু আশ্চর্য হয়ে বলল।
মূর্তিগুলো উদ্ধার করা হ’ল সেসবের সমমূল্যের অর্থের চারভাগের একভাগ দোনিয়ার প্রাপ্য হবে—ফ্রান্সিস বলল।
—কই আমি তো মনে করতে পারছি না, রাজা বলল।
ফ্রান্সিস স্পিনোলার দিকে তাকাল। বলল—স্পিনোলা সেদিন আপনার এই শর্তে দোনিয়াকে এবং আমাদের দিনের বেলা অনুসন্ধানের কাজ চালাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। বোধহয় আপনার মনে আছে?
স্পিনোলা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো “ঠিক আছে—ওসব পরে ভাবা যাবে।
ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে বলল—না—ঐ শর্তের ফয়েসালা এখনই করতে হবে। স্পিনোলা ফ্রান্সিসের দৃপ্তভঙ্গী লক্ষ্য করল। তিনি যথেষ্ট কুবুদ্ধি ধরেন, বুঝলেন, ফ্রান্সিসদের সাহায্য ছাড়া বাকি মূর্তিগুলো উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কারণ ফ্রান্সিসরাই সঠিক জানে বাকি মূর্তিগুলো কোথায়। এখনই শর্ত অস্বীকার করলে এই বিদেশির ওদের জাহাজ দোনিয়াকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। ওদের এক্ষুনি বন্দি করা যেতে পারে কিন্তু তাহলে উদ্ধারের কাজ পিছিয়ে যাবে। স্পিনোলা একটু গম্ভীর স্বরে বললেন—রাজা এনজিও শর্ত রক্ষা করবেন। কিন্তু উদ্ধারকার্যে আপনাদের সাহায্য করতে হবে।
—বেশ—আমরা রাজি, ফ্রান্সিস বলল।
রাজা, অমাত্য দু’জন উঠে দাঁড়াল। স্পিনোলা ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল—কাল সকালে উদ্ধারের কাজ শুরু করবে আমাদের সৈন্যরা। আপনাদেরও সঙ্গে থাকতে হবে। রাজা স্পিনোলা ও অমাত্যকে নিয়ে অন্দরমহলের দিকে চলল।
—ফ্রান্সিসরাও রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলো। ওরা তখন খুবই ক্ষুধার্ত। ওদের স্নান-খাওয়া হয়নি। ফ্রান্সিস বিস্কোর অবশ্য পোশাক পরেই স্নান হয়ে গেছে।
পরের দিন রাজা এনজিওর জাহাজ বাঁধা নৌকোটা চড়ে তিনজন সৈন্য এলো। ফ্রান্সিসরা রাজার অন্য নৌকোটা আর দোনিয়ার নৌকোটায় চড়ে এলো সেই নির্দিষ্ট জায়গাটায়। তিনটে নৌকো সেই জায়গায় একত্র হল। একজন সৈন্য নৌকোয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল—দোনিয়া, কোথায় ডুব দিতে হবে?
দোনিয়া আঙুল তুলে জায়গাটা দেখাল। সৈন্যটা অতি উৎসাহে তখনই জলে ঝাঁপ দিল।
সময় কাটতে লাগল। সবাই নৌকো থেকে ঐ জায়গায় জলের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সৈন্যটির ওঠার নাম নেই। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি, এতক্ষণ আমিই জলের নীচে থাকতে পারি না। সৈন্যটি অনভ্যস্ত নিশ্চয়ই। একটা ভুল সৈন্যটা করেছেই। মূর্তি খুঁজে পেয়ে নিশ্চয়ই এক হাতে নিয়ে উঠে আসছিল। বোকামি আর কাকে বলে। শুধু এক খোলা হাতে জল ঠেলে দ্রুত ওপরে ওঠা যায় না। নৌবাহিনীর সৈন্য। সমুদ্রের ভারী জল সম্বন্ধে এটুকু অভিজ্ঞতা তো থাকা উচিত।
দোনিয়া বলল,—সোনার মূর্তি উদ্ধার করছে—এই উত্তেজনায় সৈন্যটি সাবধানতার কথা গুলিয়ে ফেলেছে।
বাকিদু’জন সৈন্য পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। একজন ডুবে যাওয়া সৈন্যটার নাম ধরে ডাকল। পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝে চুপ করে গেল।
বেশ সময় কাটল। বোঝা গেল যে কারণেই হোক সৈন্যটি আর বেঁচে নেই।
তখনই দেখা গেল রাজার জাহাজটা আস্তে আস্তে এদিকে আসছে। কাছে এলে দেখা গেল সেনাপতি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সৈন্যদের একজন গলা চড়িয়ে সেনাপতিকে একজন সৈন্য কিভাবে মারা গেছে সেটা জানাল।
সেনাপতি সব শুনে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা বলেছিলেন এ খোঁজ চালাবার জন্যে আপনারা সৈন্যদের সাহায্য করবেন। ফ্রান্সিস বলল, সৈন্যটি তো আমাদের কোনো সাহায্য চায়নি। ও জানতে চেয়েছিল, কোথায় ডুব দেবে। আমরা তা দেখিয়ে দিয়েছি।
—যাক গে সেনাপতি বলল এবার সাহায্য করুন।
ফ্রান্সিস নৌকোয় উঠে দাঁড়াল। সৈন্য দু’জনের দিকে তাকাল। হ্যারিকে বলল, হ্যারি—আমি তো ওদের ভাষা জানি না। তুমি বুঝিয়ে বলো আমি যেভাবে নামছি সেভাবে ওদের নামতে হবে। মূর্তি ফেলে সেটা এই বঁড়শির একটাতে আটকে দিয়ে কোমরের দড়ি খুলে ওপরে উঠে আসতে হবে। হ্যারি লো লাতিন ভাষায় সৈন্য দু’জনকে সব বুঝিয়ে বলল। ফ্রান্সিস দোনিয়ার দড়িবাঁধা বঁড়শিগুলো ঝুলিয়ে নিয়ে কিছুটা দড়ি কোমরে পেঁচিয়ে নিল। তারপর জলে ঝাঁপ দিল।
জলের নীচে ভাঙা নৌকোর লোহার খাঁচাটার পাশে কাদা মাটিতে একটা বঁড়শি দিয়ে খুচিয়ে দ্রুত কাদামাটি সরাতেই দুটো মূর্তি পাশাপাশি পেল। জলে কয়েক পাক খেয়ে কোমরে পাক দেওয়া দড়ি খুলল। মূর্তি দু’টোয় দুটো বঁড়শি আটকে দড়িতে দু’টো হ্যাঁচকা টান দিল। দোনিয়া নৌকো থেকে দড়ি টানতে লাগল। মূর্তিদুটো জলের উপরে উঠে এলো। ফ্রান্সিস ও ভু করে ভেসে উঠল। সেনাপতি একজন সৈন্যকে বলল—মূর্তিদুটো তোমাদের নৌকোয় রাখো।
সৈন্যটি হাত-বড়িয়ে বঁড়শি থেকে মূর্তিদুটো খুলে নিজেদের নৌকোয় রাখল। অন্য সৈন্যটি এবার দোনিয়ার হাত থেকে বঁড়শি বাঁধা দড়িটা কোমরে জড়িয়ে জলে ঝাঁপ দিল। যেমন ফ্রান্সিস দেখিয়ে দিয়েছিল।
সবাই জলের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরেই দোনিয়া হাত ধরে দড়িতে দুটো হ্যাঁচকা টান দিল। দোনিয়া দড়ি টানতে লাগল। একটি মূর্তি উঠে এলো। সৈন্যটা জলে ভেসে উঠল। খুশিতে ও হাসছে তখন। মূর্তিটি রাজার নৌকোয় রাখা হলো।
ছ’টা মূর্তি উদ্ধার হলো। এবার সবচেয়ে বড়ো আর সবচেয়ে মূল্যবান মূর্তিটি উদ্ধার করতে হবে। সেনাপতিকে দেখা গেল খুব উৎসাহী। অন্য সৈন্যটিকে হাত-পা নেড়ে কি সব বলে উৎসাহিত করল। সৈন্যটি দড়ি পেঁচিয়ে নিয়ে জলে ঝাঁপ দিল।
সকলেই জলের দিকে তাকিয়ে আছে। সকলেই ভাবছে বড় মূর্তিটি কি সৈন্যটি উদ্ধার করতে পারবে? জলে কয়েকটা বুদ্বুদ উঠে ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস সেদিকে তাকাল। ও নিশ্চিত জানে সৈন্যটি পারবে না। অন্য মূর্তিগুলো ভাঙা নৌকোর লোহার খাঁচাটার আশেপাশে ছিটকে পড়েছে। তাই পাওয়া গেল। বড় মূর্তিটা নিশ্চয়ই ওগুলোর তুলনায় ভারী ছিল। ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা কম। তবু জায়গাটা ভালো করেনা দেখে এখনই কিছু বলা যাবেনা। তবে সৈন্যটি যে এত অল্প সময়ে খুঁজে বের করতে পারবে না, এটা ঠিক।
কিছু পরেই সৈন্যটি ভুস করে জলের ওপর মাথা তুলল। হাঁপাতে হাঁপাতে দু’হাত নাড়িয়ে জানাল বড় মূর্তিটার হদিশ ও পায়নি।
সেনাপতির উৎসাহে তবু ভাটা পড়ল না। সেনাপতি দোনিয়ার হাত থেকে দড়িটা নিজে নিল। অন্য সৈন্যটিকে নামতে ইঙ্গিত করল। বোবচারার তখনও হাঁপভাবটা যায়নি কিন্তু সেনাপতির হুকুম। সৈন্যটি দড়ি কোমরে পেঁচিয়ে ঝাঁপ দিল।
আবার সবার আগ্রহ উৎকণ্ঠা। কি হয়? কিছুক্ষণ সময় কাটল। সৈন্যটি আস্তে আস্তে জল থেকে মাথা তুলল। ও তখন সমস্ত শরীর ছেড়ে দিয়েছে অসহ্য ক্লান্তিতে। নৌকোর সৈন্যটি বেশ কসরৎ করে হাত বাড়িয়ে ওকে নৌকোয় তুলে নিল।
সেনাপতির এখন আর সেই উৎসাহ নেই। মনে করেছিল গৌরব ও একই নেবে। সেটা হলো না। সেনাপতি এবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল—আমার সৈন্যদের একটু বিশ্রাম দরকার। আপনারা এবার নামলে ভালো হয়।
হ্যারি কথাটা ফ্রান্সিসকে বুঝিয়ে বলল। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। মারিয়া ভীতস্বরে বলল।—এক্ষুণি আবার নামছো?
ফ্রান্সিস হেসে বলল—কি করি। আমি ছাড়া কেউ পারবে না। যদি আমার কথা সত্য হয় তাহলে বেশিক্ষণ লাগবে না।
ফ্রান্সিস জলে ঝাঁপ দিয়ে জলের নীচে দ্রুত নেমে এলো। ঠিক জংধরা নৌকোর খাঁচাটার মাঝখানে নামল। বঁড়শি দিয়ে দ্রুত নৌকোর মাঝখানটা খুঁড়তে লাগল। পচা কাঠকাদা তুলে সরাতে লাগল। কিন্তু মূর্তির হদিশ নেই। পচা কাঠের টুকরো আর কাদায়ও জায়গার জলটা কালো হয়ে গেল। দম ফুরিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল নাত জলের ওপরে উঠে এলো। সবাই হতাশ হলো। হারি বুঝল ফ্রান্সিস যখন বিফল হলো তখন বড়মূর্তি উদ্ধার করা সহজ হবেনা।
ফ্রান্সিস জল থেকে উঠল না। জলের ওপর মুখ তুলে হাঁপাতে লাগল। একটু পরে বলল—বিস্কো তুমিও নামো। একা হবে না।
বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস বলল—আমি আঙুল দিয়ে যে জায়গাটা দেখিয়ে দেবো, সেই জায়গাটাই খুঁড়বে।
ফ্রান্সিস ঠিক করল একটা বঁড়শি খুলে বিস্কোকে দেবে কাদামাটি খোঁড়ার জন্যে, কিন্তু বঁড়শিগুলো এত শক্ত করে বাঁধা যে দড়িনা কেটে খোলা যাবেনা। শাঙ্কোর কোমরে সবসময় ছোরা থাকে। বিস্কোর তো ছোরা নেই। ফ্রান্সিস বঁড়শিগুলো জলের ওপর তুলে সেনাপতির নৌকোয় রাখল। বলল—আপনার তলোয়ার দিয়ে একটা বঁড়শিদড়ি কেটে খুলে দিন।
সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে রূপোর ওপর মীনে করা তলোয়ারের বাঁট ধরে এক টানে তলোয়ার বের করল। ধারালো তলোয়ারের দুটো পোঁচেই দড়ি কেটে গেল। একটা বঁড়শি খুলে এলো। বিস্কো নিল ওটা।
এবার দুজনেই ডুব দিল। নৌকোর খাঁচাটার মাঝখানটায় দাঁড়াল দু’জন। ফ্রান্সিস ঠিক নৌকোর মাঝখানটা আঙুল টেনে দেখাল। দুজনেই মাঝখানটা দ্রুতহাতে খুঁড়তে লাগল। পচা কাঠ, কাদাটে জল ছড়িয়ে পড়তে লাগল। একটা চৌকোনো মতো কাঠের পাটাতনের কোণায় হঠাৎ বিস্কোর বঁড়শিটা আটকে গেল। বিস্কো জোরে একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই পচা কাঠ ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। কাদাজলের মধ্যে দিয়ে বিস্কো দেখল বড় মূর্তিটা কাত হয়ে আছে। ফ্রান্সিস ঠিক পেছনেই দ্রুতহাতে খুঁড়ছে। বিস্কো ফ্রান্সিসের গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিল। ফ্রান্সিস মুখ তুলে তাকাল। বিস্কো আঙুল দিয়ে মূর্তিটা দেখাল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে জলের ওপর দিকে আঙুল তুলে বিস্কোকে উঠে যেতে বলল। বিস্কো বুঝতে পারছিল দম ফুরিয়ে আসছে। ও হাতের বড়শিটা ফেলে দিয়ে দ্রুত হাতে পায়ে জল ঠেলে ওপরে উঠতে লাগল। ফ্রান্সিসের দম বেশি। একটা বঁড়শি মূর্তিটার শিংওয়ালা শিরস্ত্রাণের মাঝখানে আটকে দাঁড়িয়ে দু’টো হ্যাঁচকা টান দিল। দড়িটা একজন সৈন্য ধরে ছিল। টান লাগতে ও সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বলল সেকথা। নিয়ম না জানলেও সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে দড়িটা ধরে টেনে দিল। দেখল বেশ ভারী। সেনাপতি হেসে উঠল। সৈন্য দু’জনকে দড়ি ধরে টানতে বলল। তিনজনে দড়ি ধরে এসসঙ্গে টানল। নৌকোর একপাশের তিনজন। দাঁড়িয়ে তখন। নিচু হয়ে জোর দিয়ে আবার টানতেই ভারসাম্য হারিয়ে নৌকোটা উল্টে গেল। তিনজনেই জলে পড়ে গেল। সেনাপতির হাত থেকে দড়িও ছিটকে গেল।
ফ্রান্সিস তখনই জল থেকে ভুস করে মুখ তুলল। উল্টোনো নৌকো আর সেনাপতি ও সৈন্য দু’জনকে জলে ভেসে থাকতে দেখে বুঝল কি হয়েছে। প্রবল উত্তেজনায় উৎসাহে ভারসাম্যের কথা ভাবতেও পারে নি সেনাপতি। তাই যা হবার তাই হয়েছে। নৌকো উল্টে গেছে। ফ্রান্সিস হাত ঘুরিয়ে হতাশার ভঙ্গী করল। ওদিকে দু’জন সৈন্য মিলে ঠেলে নৌকোটা সোজা করেছে। নিজেরা নৌকোয় উঠেভুড়িওয়ালা সেনাপতিকে কোনোরকমে টেনে নৌকোয় তুলল। সেনাপতি নৌকোর পাটাতনে শুয়ে চিৎ হয়ে হাঁপাতে লাগল। ওর মধ্যেই একবার কাত হয়ে দোনিয়াকে বলল জিজ্ঞেস করুন বড়মূর্তিটা পেয়েছে কিনা।
দোনিয়া ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করল, কথাটা। ফ্রান্সিস বলল—হ্যাঁ, মূর্তির শিংওয়ালা শিরস্ত্রাণে বঁড়শিটা ভালো করেই এঁটে লাগিয়ে এসেছি।
এবার সেনাপতি মশাইকে বলুন জলের নীচে থেকে ছিটকে পড়া দড়িটা নিয়ে আসতে। দোনিয়া সেনাপতিকে ডেকে বলল সেকথা। সেনাপতি কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে তার সৈন্য দু’জনকে জলে ডুবে দড়ির মাথাটা ধরে নিয়ে আসতে বলল। ভীষণ ক্লান্ত সৈন্য দু’জন বোধহয় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে চাইল। সেনাপতি তড়াক করে উঠে। বসল। কোমরে তালোয়ারের বাঁটে হাত রাখল। সৈন্য দু’জন আর কোনো কথা না বলে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস দোনিয়ার নৌকোয় উঠে এলো।
কিছু পরেই সৈন্য দুজন দড়িটার মাথাটা ধরে উঠে এলো। সেনাপতির নৌকোয় উঠল ওরা। ফ্রান্সিস দোনিয়াকে বলল—হারিদের নৌকোয় চলুন। দোনিয়াকে নিয়ে ফ্রান্সিস হ্যারি দের নৌকোয় উঠল। সেনাপতিকে ইঙ্গিতে তাদের নৌকোটা কাছে আনতে বলল। দু’টো নৌকো কাছাকাছি এলো। এবার ফ্রান্সিসের নির্দেশে মারিয়া, হ্যারি আর দোনিয়া নৌকোটার একপাশে বসল। ওপাশে নৌকো বেশ কাত হলো। অন্য পাশে দাঁড়াল বিস্কো। ফ্রান্সিস সেনাপতির নৌকোয় উঠল। সেনাপতি ও সৈন্য দু’জনকে ইঙ্গিতে নৌকোর একধারে বসাল। নৌকো ওদিক কাত হ’ল। আর একপাশে ফ্রান্সিস নিজে দাঁড়াল। সেনাপতির হাত থেকে দড়ির মুখটা নিল। এবার দু’নৌকোয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস আর বিস্কো দড়ি ধরে একসঙ্গে টানতে লাগল। নৌকো দু’টো আর একপাশে কাতহ’য়ে রইল না। দুলতে থাকলেও সোজা রইল নৌকোদুটো ভারসাম্য ঠক থাকার জন্যে।
একসময় বঁড়শিতে গাঁথা বড়মূর্তিটা উঠে এলো। মূর্ডিার গায়ে খুব কাদামাটি ময়লা লেগে নেই। তাই সোনার রঙটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বঁড়শিতে গাঁথা মূর্টিার দিকে। উজ্জ্বল ঝকঝকে রোদ পড়েছে মূক্টিায়। সামান্য ঝিকিয়ে উঠছে মূর্টিার এখানে ওখানে। এই দেখে সেনাপতির আর সবুর সইল না। সে লাফিয়ে উঠতে গেল। নৌকো টাল গেল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে আঙুল দেখিয়ে সেনাপতিকে বসতে বলল। সেনাপতি বাধ্য ছেলের মতো বসে পড়ল। মূর্তিটা সেনাপতির নৌকোয় রেখে ফ্রান্সিস দড়িটা খুলে নিল। সৈন্যদুজন নৌকোয় দড়িটা নাচতে লাগল। সেনাপতি মূর্তিটার দিকে চেয়ে হাসতে লাগল—হা হা।
তিনটে নৌকো ফিরে চলল নুরাঘির ঘাটের দিকে। কালকের চেয়েও আজকে ভিড় আরো বেশি। দুরদুরান্ত থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চাষিরাও এসেছে। জেলে পরিবারের লোকেরা তো আছেই। সৈন্যরাও ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। নৌকোগুলো ঘাটে ভিড়ল। বড় মূর্তিটা সৈন্য দু’জন ধরে নিয়ে নৌকো থেকে নামল। এগিয়ে চলল রাজবাড়ির দিকে। ঠিক পেছনেই সেনাপতি। দু’হাত দুটো মূর্তি ঝুলিয়ে।
ফ্রান্সিসরা চলল নুরাঘির সদর দেউড়ির দিকে। দেউড়ির কাছাকাছি আসতেই একজন সৈন্য ছুটতে ছুটতে দোনিয়ার সামনে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–মহামান্য রাজা আপনাকে ডেকেছেন।
দোনিয়া ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর সৈন্যটির সঙ্গে রাজপ্রাসাদের দিকে গেল।
নিজেদের ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস বিস্কো নিজেদের ভেজা পোশাক ছেড়ে মারিয়া ওদের জন্যে যে পোশাক নিয়ে এসেছিল, সেই শুকনো পোশাক পরল। কিছু পরেই দুজন ওদের জন্যে খাবার নিয়ে এলো। ওরা খেতে বসল। কেউ কোনো কথা বলল না।
খাওয়া শেষ হলো এতক্ষণে হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস, এখন তো আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। চলো জাহাজে ফিরে যাই।
ফ্রান্সিস একটু আধশোয়া হয়ে ছিল। উঠে দাঁড়াল। দেয়াল লেখা সেই অস্পষ্ট স্বরলিপির দিকে তাকাল একবার। ততক্ষণে হ্যারি রাও উঠে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সিস ঘরের দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল—চলো।
নুরাঘির বাইরে ঘাটের কাছে এলো ওরা। মারিয়া বলল—রাজা এনজিওর সঙ্গে একবার দেখা করবে না?
—কি দরকার। রাজার স্বার্থোদ্ধার হয়ে গেছে। এখন আমাদের হয়তো চিনতেই পারবেন না—ফ্রান্সিস বলল।
ওরা ওদের নৌকোয় উঠতে যাবে, দেখল দোনিয়া ছুটে আসছে। কাছে এসে দোনিয়া বলল—আপনারা চলে যাচ্ছেন?
হ্যারি হেসে বলল—হ্যাঁ, জাহাজে ফিরে যাচ্ছি।
—মূর্তিগুলো হাতে পেয়ে রাজা এনজিও, স্পিনোলা, অমাত্যরা খুব খুশি তাই না? মারিয়া হেসে বলল।
দোনিয়া হেসে বলল—খুশি বলে খুশি! নাচানাচি শুধু বাকি।
একটু হেসে দোনিয়া বলল, স্পিনোলা বার বার রাজা এনজিওকে বলছিল মূর্তিগুলো রাজধানী কাগলিয়ারিতে নিয়ে যেতে। কিন্তু আশ্চর্য! রাজা এনজিও সম্মত হলো না। বলল—আমাদের পূর্বপুরুষ রাজা ফ্রেডারিক যে গির্জায় যে ভাবে এই মূর্তিগুলো যে কারণে ঝুলিয়ে রোখছিলেন সেখানেই মূর্তিগুলো থাকবে। স্পিনোলা যুক্তি দেখাল মূর্তিগুলো এখানে বাজাবার মতো কোনো বাদ্যকর নেই। অমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম—সেইদুশো বছর আগের মতো প্রতিদিন ভোরবেলা মূর্তিগুলো বাজিয়ে সুর তোলার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিলাম।
এবার হ্যারি বলল সত্যিই আপনাকে প্রশংসা করতেই হয়।
দোনিয়া ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল—ফ্রান্সিসের চেয়ে বেশি প্রশংসা পাবার যোগ্য আমি নই। কথাটা বলে দোনিয়া ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। আবেগে ওর শরীর কাঁপতে লাগল। দু’চোখ জলে ভিজে উঠল। ফ্রান্সিস একটু হেসে নিজেকে আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিল।
নৌকোয় গিয়ে উঠল সবাই। বিস্কো দাঁড় বাইতে লাগল। নৌকো চলল ওদের জাহাজের দিকে। জাহাজে উঠইে সব ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে এলো। ফ্রান্সিসদের ঘিরে হৈহৈ করতে লাগল। ওর মধ্যে বিস্কো গলা চাড়িয়ে বলল ভাইসব ফ্রান্সিসের নেতৃত্বে আমরা জলের তলা থেকে নিখোঁজ সব যোদ্ধামূর্তিগুলো উদ্ধার করেছি। সব বন্ধুরা একসঙ্গে ধ্বনি তুলল—ও হো-হো-হো।
খুব ভোরে ফ্রান্সিসের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। শুকনো সুন্দর সুরধ্বনি। দূর থেকে আসছে সেই সুরধ্বনি। মারিয়ারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মারিয়াও কান পেতে শুনছিল ঐ সুরলহরী। ফ্রান্সিস দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল—মারিয়া চলো নুরাঘির ঐ গির্জাটায়। দোনিয়াই ঐ বাজনা বাজাচ্ছে।
দু’জনে জাহাজে বাঁধা নৌকোটা খুলল। ফ্রান্সিস দাঁড় বইতে লাগল। তখনই পুর্ব আকাশে লাল রঙের ছোপ লাগল। একটু পরে সূর্য উঠল। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া। খাঁড়ির জলে নুরাঘি দুটোয় ছড়িয়ে পড়া ভোরের নরম আলো সমুদ্রের পাখির ডাক—সমস্ত পরিবেশটা যেন মায়াময় হয়ে উঠল।
ওরা যখন নুরাঘির গির্জাটায় ঢুকল তখন দেখল গির্জাটায় কিছু জেলে চাষি জড়ো হয়েছে। দোনিয়া রূপোর হাতাটা মূর্তিগুলোর গায়ে ঠুকে ঠুকে সুরমূৰ্ছনা তুলছে। ফ্রান্সিস, মারিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে সেই সুরমূর্ঘনা শুনতে লাগল।
একসময় বাজনা থামিয়ে দোনিয়া পিছু ফিরে তাকাল। দেখল,ফ্রান্সিস আরমারিয়াকে। ছুটে এসে ফ্রান্সিসের নহাজ্জা দুহাতে জড়িয়ে ধরল। মারিয়া বলল—আপনি একদিনেই বেশ সুন্দর বাজাচ্ছেন।
দোনিয়া হেসে বলল—ছেলেবেলায় আমার এক কাকা আমাকে গ্রীসীয় বীণা বাজাতে শিখিয়েছিলেন। আমিও শিখেছিলাম। সেই সুরজ্ঞানটাই আজ কাজে লেগে গেল।
মারিয়া হেসে বলল, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি
—নিশ্চয়ই—বলুন। দোনিয়া বলল।
—তৃতীয় সুরধ্বনিটা কিন্তু একটু বেসুরো লাগছে, মারিয়া হেসে বলল।
দোনিয়া সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝুঁকিয়ে মারিয়াকে সম্মান জানিয়ে বলল—রাজকুমারী—আপনার সুরজ্ঞানের প্রশংসা করছি। তৃতীয় মূর্তিটা হচ্ছে সেই ঢাল-ভাঙা মূর্তিটা। তাই বেসুরো ধনি তুলছে। স্বর্ণকারকে দিয়ে ঢালটা লাগিয়ে নিলেই শুদ্ধসুর বেরোবে।
—রাজা এনজিও কি আপনাকে অর্থমূল্য দেবেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
—এখনো আমি চাই নি। ভেবেছি, আর চাইব না। এখানেই আমি বাদ্যকর হয়ে সারাজীবন থাকবো। প্রতিভভারে এই বাজনা বাজাবো। সেই অন্ধ বাদ্যকরের স্বরলিপি থেকে সুর উদ্ধার করবো। দু’শো বছর আগে যেমন দূর-দূর দেশ থেকে মানুষ ছুটে আসতো এই বাজনা শোনার জন্যে, আমিও এমন বাজানো শিখবো যে তেমনি মানুষজন ছুটে আসবে আমার বাজনা শুনতে। বদলে কিছু অর্থদান চাইবো। সেই অর্থ আমি ব্যয় করবো সার্দিনিয়ার দরিদ্র চাষি-জেলেদের কল্যাণে।
ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল—দোনিয়া, আপনার মতো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলেই বোঝা যায় পৃথিবী কত সুন্দর, মানুষ কত ভালো আর জীবন কত আনন্দের।
ফ্রান্সিস, মারিয়া ঘাটে এসে নৌকোয় উঠল। নৌকো চালাতে চালাতে চারদিকে উজ্জ্বল রোদে হেসে-ওঠা প্রকৃতিকে দেখতে দেখতে ফ্রান্সিস হেসে ডাকল—মারিয়া মারিয়া ওর দিকে তাকাল।
—আমার হাত এবারও শূন্য। মূল্যবান কিছুই নেই। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া আবেগআপ্লুতস্বরে বলে উঠল “আজ আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না।
মারিয়ার কথা শুনে ফ্রান্সিস খুব খুশি হয়ে হাসল।
কোনোকথা না বলে ওদের জাহাজের দিকে নৌকো চালাতেলাগল। এই আনন্দের অনুভূতি ফ্রান্সিস ওর সমস্ত দেহমন দিয়ে অনুভব করতে লাগল। নৌকো চলল ওদের জাহাজের দিকে।