Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যদি খুন বলেন || Anish Deb

যদি খুন বলেন || Anish Deb

লোকটাকে আবার একই ভঙ্গিতে দেখা গেল।

রোজ সকালের মতো আজও বেরিয়ে এক বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়িটা থেকে। তারপর দরজা বন্ধ করেই রোজকার অভ্যেসে ঘুরে দাঁড়াল, দরজার নবটাকে মোচড় দিয়ে ঠেলে দেখল দরজা ঠিকঠাক বন্ধ হয়েছে কি না।

লোকটার দিকে সরাসরি না তাকিয়েও নরোত্তম বসাক তার প্রতিটি নড়াচড়া অনুভব করতে পারছিলেন। টেলিভিশনের পরদায় কোনও একক অভিনয় খুঁটিয়ে লক্ষ করার মতো সজাগ ছিল ওঁর চোখ।

প্রতিদিন ভোরবেলা নরোত্তম পায়চারি করতে বেরোন। নিতান্ত দুর্যোগ, ঝড়, বৃষ্টি না হলে ওঁর এই দৈনিক অভ্যাসের কোনও হেরফের হয় না। আজও তিনি বেরিয়েছেন সকালের সজীব বাতাসে বুকভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য।

লোকটা এবার সিঁড়ির ধাপ ভেঙে ঝটপট নেমে এল। রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল একটা কালো অ্যামবাসাডার। খাকি রঙের উর্দি পরা ড্রাইভার গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে। লোকটা উঠে বসতেই সেলাম ঠুকল অনায়াস তৎপরতায়।

কে এই ভদ্রলোক? নরোত্তম বসাক ভাবলেন। তাঁর জমিদারি ঢঙের বাড়ি, কেতাদুরস্ত বেশবাস, গাড়ি, উদ্ধত চলন-আচরণ ইত্যাদি দেখে মনে হয় ভদ্রলোক বেশ ক্ষমতাশালী, কোনও উঁচু পদে আছেন। কখনও-কখনও নরোত্তম ফুটপাথের ওপরে চলার গতি কমিয়ে দেন—নইলে ওই ভদ্রলোক যখন ঝটিতি সিঁড়ি ভেঙে গাড়ির দিকে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে যান তখন তাঁর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নরোত্তম হয়তো পড়ে যাবেন। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা হবে।

প্রতিদিন ভোরে চলার পথে অন্য যেসব মানুষ নরোত্তম দেখেন তারা প্রত্যেকেই সামান্য হেসে অথবা মাথা নেড়ে ওঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে। রোজ দেখা হতে-হতে পরস্পরের মুখগুলো চেনা হয়ে গেছে পরস্পরের কাছে। এই ঠাটবাটওয়ালা ভদ্রলোকের সঙ্গেও তেমনি। কিন্তু একমাত্র উনিই কোনওরকম সৌজন্য দেওয়া-নেওয়া করেন না নরোত্তমের সঙ্গে। না, তাতে নরোত্তমের দুঃখ অথবা অভিমান নেই। তিনি ভেবেছেন, ভদ্রলোকের অহংকারই হয়তো এই উপেক্ষার কারণ। অবশ্য তাঁর সঙ্গে ঠিকঠাক আলাপ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। কারণ, নরোত্তম কানে একেবারেই শুনতে পান না।

সেদিন সকালে নরোত্তম রোজকার পথের সামান্য অদল-বদল করলেন। প্রথমত সকালটার মধ্যে এক অপরূপ মুগ্ধতা ছিল। তার ওপরে আনচান করা বাতাস আর পুবের আকাশে সিঁদুর রঙের সদ্য-ওঠা সূর্য। খুশি ও উৎফুল্লতায় নিজেকে হারিয়ে ফেললেন নরোত্তম। ফুটপাথ ছেড়ে কাঁচা পথে নেমে পড়লেন। সবুজ ঘাস, ঝোপ ইত্যাদি পেরিয়ে আনমনা হেঁটে চললেন। লুকিয়ে কোথাও শিস দিচ্ছিল একটা বাগিচা বুলবুল। বসাকের বৃদ্ধ পা দুটো ওঁকে যেদিকে খুশি নিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে বহু রাস্তার কাটাকুটি পেরিয়ে, মাঠঘাটের সৌন্দর্যের তারিফ করতে-করতে নরোত্তম কখন যে গাছ-গাছালির জঙ্গলে ঢুকে পড়েছেন সেটা খেয়ালই করেননি।

শরতের এই সকাল মনে ক্রমাগত খুশি ছড়িয়ে দিচ্ছিল। শাল, দেবদারুর পাতায় ঠিকরে পড়ছে সকালের পবিত্র রশ্মি। এ ছাড়াও নানান ফুল-ফলের গাছ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। একটা গাছে ফলন্ত পেয়ারা দেখতে পেলেন বসাক। দেখে খিদে পেল। সবুজ কচি পেয়ারাপাতাগুলো রোদে ঝলমল করছে। অদ্ভুত আকর্ষণে গাছটার কাছে এগিয়ে এলেন। হাত বাড়িয়ে একটা পেয়ারা ছিঁড়ে নিয়ে কামড় বসালেন। সজীব ফলের স্বাদ খিদে আরও বাড়িয়ে দিল। উপোসি মানুষের মতো পেয়ারাটি শেষ করে ফেললেন। বাড়ি থেকে যে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছেন সে-কথা যেন ভুলেই গেলেন। একইসঙ্গে ওঁর বয়েস কমে যেতে লাগল দ্রুতগতিতে।

নরোত্তমের মনে হল পলকে বিশ বছরের ছোকরা হয়ে তিনি এক অভিযানে বেরিয়ে পড়েছেন। অথচ আসলে তিনি বাহাত্তুরে বুড়ো, রোজকার মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে আনন্দে পথ ভুলে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গেছেন। নরোত্তম থমকে দাঁড়লেন। না, ক্লান্তিতে নয়, বিস্ময় ও খুশিতে। চারপাশে তাকিয়ে সকালের রোদে গাছগাছালির চকচকে রূপ দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। মনে-মনে শরৎ ও বসন্তকালের মধ্যে তুলনাও করতে শুরু করলেন। ওঁর পায়ের তলায় একটা শুকনো ডাল শব্দ করে ভেঙে গেল। নানান পাখির কিচিরমিচির, কাঠবেড়ালির চপল ছুটোছুটি, গাছের পাতায় ছমছম শব্দ, সব কিছুই ঘটে যাচ্ছিল চারপাশে, কিন্তু নরোত্তম কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না। বয়েস বেড়ে চলার সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর শ্রবণ ক্ষমতা কমে এসেছে ধীর অথচ অনিবার্য গতিতে। অবশেষে গত বছরে ওঁর কান পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। ফলে অন্য ইন্দ্রিয়গুলো—চোখ, ত্বক, নাক ইত্যাদি ক্রমে-ক্রমে অনেক বেশি বিচক্ষণ ও ধারালো হয়ে উঠেছে। এখন সেই অবশিষ্ট ইন্দ্রিয়গুলোই সৌন্দর্যের অমৃত ওঁর হৃদয়ের গভীরে একটু-একটু করে পৌঁছে দিচ্ছিল।

নরোত্তম ভাবছিলেন, তিনি লোকালয় থেকে বহু দূরে চলে এসেছেন, জন-মানুষও নেই কাছাকাছি। কিন্তু আর-কয়েক পা এগোতেই অবাক হয়ে গেলেন। কিছুটা দূরে এক বিশাল পাঁচিল, এবং পাঁচিলের মাথায় দু-ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। অর্থাৎ, ঠাট্টা-রসিকতার ব্যাপার নয়, সত্যি-সত্যিই কেউ তার এলাকাটাকে নিরাপদে রাখতে চাইছে। না, এত সর্তকতার পর ‘প্রবেশ নিষেধ’ সাইনবোর্ডটা লাগানোর দরকার পড়ে না, এবং সেটা লাগানোও নেই পাঁচিলের কোথাও। নরোত্তম বসাক পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, বর্ষা অথবা গ্রীষ্মের সময় পাঁচিলটা এখান থেকে নজরে পড়ার কথা নয়। কারণ, পাঁচিলের যে-অংশটুকু দেখা যাচ্ছে গাছ-গাছালির পাতা-ডালপালার ঝাঁক তা নিশ্চয়ই পরিপাটি করে ঢেকে দেবে।

চোখের নজর সামান্য উঁচু করতেই পাঁচিল পেরিয়ে একটা বিশাল অট্টালিকার পিছনদিক দেখা গেল। বাড়িটা এমন নির্জন পাঁচিল ঘেরা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যে, জানলা-দরজায় পরদা টাঙানোর প্রয়োজন বোধ করেননি বাড়ি মালিক। সূর্যের সতেজ আলো ঠিকরে পড়ছে বাড়িটার গা থেকে। এবং সে-আলো ঢুকে পড়েছে প্রতিটি ঘরে। বিশেষ করে দোতলার তিনটে জানলা তো হলদে আলোয় একেবারে ঝলমল করছে। ফলে মাঝের জানলায় দাঁড়ানো পুরুষ ও মহিলাটিকে নরোত্তমের বেশ স্পষ্টই নজরে পড়েছে।

মানুষ দুজন নরোত্তম বসাককে দেখতে পায়নি। ওরা যেন কোনও নির্বাক চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রী, আর তার একমাত্র মুগ্ধ দর্শক নরোত্তম। না, নরোত্তম বসাক এ দুজন মানব-মানবীর গোপনতায় নির্লজ্জভাবে হানা দিতে চাননি। বরং তিনি কিছুটা ভয় পেলেন। কারণ, জানলার ফ্রেমে বাঁধানো দৃশ্যটা অপ্রত্যাশিত।

পুরুষটি মহিলাকে খুন করছে। তার সবল হাত দুটো ধাপে-ধাপে শক্তিশালী হয়ে মহিলার নরম গলায় চেপে বসছে।

নরোত্তম বসাক ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। একটা ঢিল কুড়িয়ে ছুড়ে মারলেন বাড়িটার দিকে। কিন্তু সেটা জানলা তো দূরের কথা, বাড়ি পর্যন্তই পৌঁছল না। তখন উত্তেজিত হয়ে পাঁচিলের কাছে ছুটে গেলেন। বৃদ্ধ শরীরে চেষ্টা করলেন পাঁচিল বেয়ে উঠতে। কিন্তু পাঁচিলের রুক্ষ গায়ে আঁচড়ানোই সার হল। হাত ছড়েও গেল কয়েক জায়গায়।

কোথায়—পাঁচিলের গায়ে দরজাটা কোথায়?

এবারে সেটার খোঁজে পাঁচিল বরাবর ছুটতে শুরু করলেন নরোত্তম। কিন্তু পাঁচিলটা যেন আর শেষ হতে চায় না। ক্রমে নরোত্তম হাঁপিয়ে পড়তে লাগলেন, ওঁকে ঘিরে জঙ্গল গাঢ় হতে লাগল। বাড়িটা যেন হারিয়ে যেতে লাগল দূর থেকে দূরে। ক্লান্ত শ্রান্ত নরোত্তম পথহারা হয়ে গেলেন। ছোটবেলায় অচেনা পথে ঘুরে পথ হারিয়ে ফেললে যেরকম ভয় পেতেন এখনও সেরকম একটা ভয় ওঁকে গ্রাস করতে লাগল।

ঝোপঝাড় ঠেলে পথ করে নিয়ে নরোত্তম এগোতে লাগলেন। ওঁর পাঞ্জাবি-পাজামা ডালপালার খোঁচা খেয়ে ছিঁড়ে গেল। উদভ্রান্ত অবস্থায় ওঁর চোখদুটো শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছে পথের ইশারা। বাঁ-পকেটে হাত দিয়ে সর্বক্ষণের সঙ্গী নোটবই ও একজোড়া পেনসিল অনুভব করলেন। যদি কোনও মানুষজনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তা হলে তারা হয়তো ওঁর বাড়ি ফেরার পথের হদিস লিখে দিতে পারবে।

পথ হারানোর আতঙ্কে তিনি ভুলেই গেলেন একটু আগে কোন দৃশ্য ওঁর চোখে ধরা পড়েছে। একইসঙ্গে উজ্জ্বল প্রকৃতির রূপসজ্জা ওঁর নজর আর অনুভূতির আড়ালে চলে গেছে। শুধু পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাটাই যেন শরীর-মন ছেয়ে আছে।

ইস, যদি নরোত্তম শুনতে পেতেন তা হলে এই গাছপালার জঙ্গল ভেদ করে ওঁর কানে হয়তো পৌঁছে যেত হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা গাড়ির গর্জন। কিংবা হয়তো কানে আসত কোনও দেহাতি মানুষ বা কাঠুরের কণ্ঠস্বর। যখন শোনার ক্ষমতা ছিল তখন কখনও ভাবেননি কান এতই দামি।

নিজেকে ধীরে-ধীরে সুস্থির করলেন। ভয়টা অল্প-অল্প করে কমতে লাগল। সূর্যের দিকে নজর রেখে দিকনির্ণয় করার চেষ্টা করতে লাগলেন। অবশেষে বহু পরিশ্রমের পর এসে পৌঁছলেন বড় রাস্তায়। ট্রাক, লরি, প্রাইভেট কার শোঁ-শোঁ শব্দে ছুটে যাচ্ছে। দু-একটা ছুটন্ত গাড়ি হাতের ইশারায় থামাতে চাইলেন। কিন্তু এক বৃদ্ধের প্রত্যাশাকে অপমান করে গাড়িগুলো একটুও গতি না কমিয়ে ছুটে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা বাস দেখা গেল। বসাক হাত তুলে ইশারা করতে স্টপেজ না হওয়া সত্ত্বেও থামল বাসটা। প্রায় ছুটে গিয়ে বাসে উঠলেন। পকেট থেকে পয়সা বের করে কন্ডাক্টরকে ভাড়া দেওয়ার সময় লক্ষ করলেন ওঁর শীর্ণ হাতের আরও শীর্ণ আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে। একটু আগে শরতের রমণীয় সকালে যে-ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছেন এ হয়তো তারই ফলাফল।

নিজের সঙ্গে ওঁর বিতর্ক শুরু হল। সত্যিই কি তিনি একটা খুন হতে দেখেছেন? ক্ষণিকের সংশয় ও দ্বিধা ঠেলে সরিয়ে নরোত্তম সিদ্ধান্তে এলেন, হ্যাঁ, খুনের দৃশ্যই দেখেছেন তিনি। লোকটা যে মেয়েটির ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকে গলা টিপে খুন করছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

মানুষের দেহই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফ্যালে। কথার চেয়েও শরীরের আচরণ অনেক বেশি করে গোপন মতলবের কথা ঘোষণা করে। অর্থাৎ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। কানে কালা হওয়ার পর থেকেই এই তথ্যটি নরোত্তম আবিষ্কার করেছেন। যতদিন কানে শোনার ক্ষমতা ছিল ততদিন তিনি শুধু মানুষজনের মুখের কথাই শুনেছেন—তাদের শরীরের নড়াচড়া হাবভাব তেমন খুঁটিয়ে লক্ষ করেননি। শ্রবণক্ষমতা হঠাৎ কমে যাওয়ার পরদিন থেকেই তিনি পর্যবেক্ষণে মন দিয়েছেন। তারপর যত দিন গেছে শ্রবণক্ষমতা আরও কমেছে, তবে একই হারে ধারালো হয়েছে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। নরোত্তম এখন জানেন, ঢিলেঢালা শরীর আর মাথা একপাশে ফেরানো থাকলে সেই মানুষ যতই আগ্রহ নিয়ে কথা বলুক না কেন, আসলে তার কোনও মনোযোগ নেই। মাথা যদি সামনে ঈষৎ ঝুঁকে থাকে, দেহ যদি সামান্য হেলে থাকে, তা হলে তার অর্থ আগ্রহ এবং কৌতূহল। আর আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণের অর্থ নিশ্চয়ই কাউকে বলে দিতে হবে না!

উচ্চারণ করা শব্দ অনেক সময় মিথ্যে কথা বলতে পারে, কিন্তু শরীর সবসময় সত্যি কথা বলে। হাতের আঙুল থাবার নখের মতো রাগে বেঁকে যায়। নরম ভঙ্গিতে একটা খোলা হাত যখন এগিয়ে আসে তখন সে ভালোবাসা বিনিময় করে। ঝুঁকে পড়া কাঁধ, ঝোঁকানো মাথার অর্থ ব্যর্থতা, হতাশা। শরীর হচ্ছে এমন একটা যন্ত্র যা কোনও মানুষের সত্যিকারের মনোভাব উদ্দেশ্য ইত্যাদি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়—তা সে মুখে যা-ই বলুক না কেন।

কান দুটো পুরোপুরি অকেজো হয়ে না পড়লে এসব খুঁটিনাটি লক্ষ করতেন না নরোত্তম। কানের ক্ষমতা নেই বলে এবং মানুষের কথাবার্তায় কোনও প্রতিক্রিয়া আর হয় না। সুতরাং নিতান্ত বাধ্য হয়েই পর্যবেক্ষণ চর্চায় মন দিয়েছেন। ওঁর এই নতুন গুণের খবর অনেকেই জানেন না—জানতে পারেননি। এইসব তথ্যের কথা হয়তো কোনওদিনই জানতে পারতেন না। হয়তো সারা জীবনটাই ওঁর এভাবে কেটে যেত—কিন্তু যায়নি। কানে কালা হওয়ার বিনিময়ে কে-ইবা এই নতুন বিদ্যা অর্জন করতে চায়! নিছক নিয়তি নরোত্তম বসাককে এই জ্ঞান লাভের সুযোগ করে দিয়েছে।

বাড়ি ফিরে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। সকালে বেরোনোর পর থেকে একের পর এক অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। ঘরের মধ্যে ছটফটেভাবে পায়চারি করতে শুরু করলেন। এই নিরিবিলি বাগানবাড়িতে তিনি একা থাকেন—সঙ্গী শুধু একটা কাজের লোক। প্রতি বছর শহর ছেড়ে এখানে বসবাস করার জন্য চলে আসেন নরোত্তম। থাকেন প্রায় চার-পাঁচ মাস। ছেলেমেয়েকে নিখুঁত সংসারী করে দিয়ে বিপত্নীক নরোত্তম বলতে গেলে একরকম বানপ্রস্থ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু এই নিরুত্তাপ শান্তিময় জীবনে হঠাৎ এক উপদ্রব এসে হাজির হল আজ।

কী করা যায় সেটাই ভাবতে লাগলেন। মেয়েটির খবর কি এর মধ্যেই জানাজানি হয়ে গেছে? আগামীকালের কাগজ খুঁটিয়ে দেখতে হবে। মরণাপন্ন মেয়েটিকে কোনওরকম সাহায্য করতে না পারায় মনে-মনে ভীষণ মুষড়ে পড়লেন নরোত্তম। ওঁর চোখের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটা, অথচ তিনি নিরুপায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখলেন শুধু!

তখুনি তাঁর পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ঘটনাটা যে-বাড়িতে ঘটেছে তার হদিস যে ওঁর অজানা। পুলিশকে সেখানে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাওয়া নরোত্তমের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বেশ ক’বছর ধরে এখানে এসে থাকছেন বটে, কিন্তু এই অঞ্চলের পথঘাট সবই ওঁর প্রায় অচেনা। নিত্যনৈমিত্তিক ছক বাঁধা পথটুকু ছাড়া আর কিছুই তেমন করে চেনা নেই।

সুতরাং, তখুনি পুলিশের কাছে না গিয়ে বুদ্ধিমানের কাজই হয়েছে। ওরা ওঁকে ভীমরতিগ্রস্ত এক বুড়ো ঠাউরে বসত। এ অঞ্চলের সব ক’টা বাগান-বাড়ির দরজায়-দরজায় ঘুরে তো আর লাশের সন্ধান করতে পারে না পুলিশ! বলতে পারে না, আপনার বাড়ির দোতলার পিছনদিকের একটা ঘরে আজ ভোরবেলায় হয়তো একটা খুন হয়েছে। আমরা সে-বিষয়ে খোঁজখবর করতে এসেছি।

তার চেয়ে অপেক্ষা করাই ভালো। কাল সকালে খবরের কাগজ দেখে তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।

সে-রাতে নরোত্তমের চোখে ঘুম এল না।

পরদিন একটু বেলার দিকে বাজারে রওনা হলেন তিনি। খবরের কাগজ সেখানেই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া কখনও খবরের কাগজ দেখেন না নরোত্তম। এখানে অবসর কাটাতে এসে দুনিয়ার খবরে ওঁর কোনও প্রয়োজন বা আগ্রহ নেই। কিন্তু আজকের কথা আলাদা।

কাগজওয়ালার কাছে সবরকম দৈনিক কাগজ সাজানো। ন’টা দশের ট্রেনে সব কাগজ পৌঁছয় এখানে। ঝুঁকে পড়ে নিজের প্রিয় কাগজটা তুলে নিলেন। কাগজওয়ালা কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিল। নরোত্তম তার নিয়মিত খদ্দের নন। হয়তো বিনিপয়সায় চট করে কাগজের হেডলাইনগুলো পড়ে নিতে চাইছেন। অনেকেই এরকম করে। কিন্তু সে আপত্তি বা প্রতিবাদ করার আগেই মাঝারি মাপের হেডিংটি নজরে পড়ে গেছে নরোত্তমের মহিলা খুন।

নরোত্তম তা হলে সত্যিই নিজের চোখে খুনের দৃশ্যটা দেখেছিলেন।

পকেট থেকে পয়সা বের করে কাগজের দাম মিটিয়ে দিলেন তিনি। কাগজওয়ালা একটু অবাক হয়েই দামটা নিল। নরোত্তম সেদিকে ভ্রূক্ষেপই করলেন না। কাগজটা ভাঁজ করে বগলদাবা করে দ্রুতপায়ে হাঁটা দিলেন বাড়ির দিকে। খুনের খবরটা খুঁটিয়ে পড়ার জন্য যেন আর তর সইছে না। চলতে-চলতেই ওঁর চোখ এপাশ-ওপাশ খুঁজতে লাগল। যদি কোনও যুতসই জায়গা পাওয়া যায়, তা হলে বাড়ি পৌঁছনো পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে হয় না। খবরটা আগেভাগেই পড়ে ফেলা যায়। এমনি করেই ওঁর অনুসন্ধানী নজরে একটা চায়ের দোকান ধরা পড়ল। সুতরাং আর একমুহূর্তও দেরি নয়। নরোত্তম সটান গিয়ে ঢুকে পড়লেন দোকানে। চাটাইয়ের দেওয়াল ঘেঁষে একটা ময়লা বেঞ্চি বেছে নিয়ে বসলেন। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে খবরের কাগজটা অতি সন্তর্পণে চোখের সামনে মেলে ধরলেন।

বত্রিশ বছর বয়েসি শ্রীমতী অলকানন্দা রায়কে গতকাল ওঁর শোওয়ার ঘরে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বেলা এগারোটার সময় রাঁধুনি মৃতদেহ আবিষ্কার করে। শোওয়ার ঘরের অবস্থা ছত্রখান ছিল বটে তবে কিছু খোয়া গেছে বলে এ পর্যন্ত জানা যায়নি। দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকার কোনও চিহ্নও পাওয়া যায়নি। মৃতার স্বামী প্রখ্যাত ব্যাবসায়ী শ্রীজিতেন্দ্রনাথ রায়কে ওঁর অফিসে দুঃসংবাদটি জানানো হয়। খবরটা শোনামাত্রই তিনি শোকে ভেঙে পড়েন। বাড়িতে শ্রীমতী রায় একাই ছিলেন। সকাল সাড়ে ছ’টায় তাঁর স্বামী কাজে বেরিয়ে যান। তারপর লেখা রয়েছে শ্রীমতী রায়ের পরিকল্পনায় তৈরি বিভিন্ন সমিতির কথা, তাঁর দান-ধ্যানের কথা। বোঝা গেল, শ্রীমতী রায় এ-অঞ্চলে বেশ সুখ্যাত মহিলা ছিলেন।

নরোত্তম ভাবতে লাগলেন, এখন কী করা যায়। বয় চা দিয়ে গিয়েছিল, সেটা টেবিলের ওপরে জুড়িয়ে যাচ্ছিল। ওঁর সেদিকে কোনও খেয়াল ছিল না। শুধু শূন্য দৃষ্টিতে হাতের খবরের কাগজের দিকে তাকিয়েছিলেন।

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সমস্ত ঘটনাগুলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বারবার ভাবতে লাগলেন নরোত্তম। যেন একই ফিলম বারবার দেখছেন। অবশেষে ওঁর মনে হল, এই মুহূর্তে ওঁর পুলিশে যাওয়া উচিত। উচিত পুলিশকে সব খুলে বলা, যাতে তারা অনুসন্ধান করে মিসেস রায়ের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারে।

মনকে বেশি বোঝাতে হল না। নরোত্তম বসাক সঙ্গে-সঙ্গেই রওনা হলেন থানার দিকে। সামনে যে-সেপাইটিকে পেলেন তাকে বললেন, যে, মিসেস রায়ের খুনের ব্যাপারে তিনি একজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চান। আরও জানালেন যে, তিনি কানে শুনতে পান না, এবং একইসঙ্গে প্যাড ও পেনসিল এগিয়ে দিলেন লোকটির দিকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেপাইটির কথা বলা বন্ধ করা গেল না। তার ঠোঁট সমানে নড়তে লাগল, এবং নরোত্তম তার কথা একটিও বুঝতে পারলেন না বটে, কিন্তু লোকটির অঙ্গভঙ্গি নড়াচড়া সব বলে দিল। সেপাইটি হাত উঁচিয়ে তালু দেখাল নরোত্তমকে—অর্থাৎ, ওঁকে অপেক্ষা করতে হবে। তারপর সে উঠে ভেতরে গেল। মিনিটটাক পরে একজন অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। নতুন ভদ্রলোকের ইশারা খুব সহজেই বোধগম্য হল নরোত্তমের—ওঁকে পাশের একটি ঘরে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলেন অফিসার।

নতুন ভদ্রলোক মনোযোগের সঙ্গে নরোত্তম বসাকের সব কথা শুনলেন। তারপর উত্তেজিতভাবে কতকগুলো টুকরো কাগজে দ্রুত হাতে কীসব লিখতে লাগলেন। লেখা হয়ে গেলে কাগজগুলো তিনি এগিয়ে দিলেন নরোত্তম বসাকের দিকে। নরোত্তম সেগুলোতে একটার-পর-একটা নজর বোলাতে লাগলেন—যেন পরীক্ষার খাতা দেখছেন। আসলে কাগজগুলো প্রশ্নমালা।

‘সেই লোকটিকে যখন আপনি মহিলাটির ওপরে ঝুঁকে থাকতে দেখেন তখন ক’টা বাজে মনে আছে?’

‘না, মনে নেই। আমার হাতের ঘড়ি ছিল না। তা ছাড়া পথ হারিয়ে কতক্ষণ যে এদিক-ওদিক ঘুরেছি বলতে পারি না।’

‘লোকটাকে মুখ দেখতে পেয়েছিলেন আপনি?’

‘না।’ নরোত্তম জবাব দিলেন, ‘তার পিঠটা ফেরানো ছিল আমার দিকে।’

‘লোকটার আবার দেখলে আপনি চিনতে পারবেন?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নরোত্তম বসাক। তারপর মৃদু গলায় বলতে লাগলেন, ‘লোকটার ভঙ্গিটাই শুধু আমার মনে আছে। ঠিক কাউকে খুন করার ভঙ্গি—কোন খুনির ভঙ্গি। নৃশংস। ভয়ানক। তার মাথায় কয়েকটা পাকা চুলও ছিল। সেগুলো সূর্যের আলোয় রূপোর তারের মতো চিকচিক করছিল। গায়ে ছিল একটা সাদা জামা—ফুলশার্ট। আর ডানহাতে ছিল একটা সোনার আংটি। সেটা আলো পড়ে ঝিলিক মারছিল।’

পুলিশ অফিসার হতাশা ও ব্যর্থতায় এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন। নাঃ, নরোত্তম দরকারি কোনও সূত্র দিতে পারেননি।

নরোত্তম বললেন, ‘লোকটার ভঙ্গি দেখেই আমি সব বুঝে গেছি। কানে শোনার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি শুধু সবার নড়াচড়া অঙ্গভঙ্গি খুঁটিয়ে দেখি। ওগুলো দেখে আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। লোকটার শরীর যেভাবে ঝুঁকে ছিল, তাতে সে-ই যে মিসেস রায়ের মার্ডারার এ আমি হলফ করে বলতে পারি।’

অফিসার আবার মাথা নাড়লেন। তারপর কথা বলতে শুরু করলেন। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে একটা কাগজে লিখে নরোত্তমকে ধন্যবাদ জানালেন, নাম ও পুরো ঠিকানা রেখে যেতে অনুরোধ করলেন, প্রয়োজনে পুলিশ যে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবে এ-কথাও জানালেন।

নরোত্তম ওঠার আগে অফিসারের নাম জানতে চাইলেন। তখন অফিসার একটু আগে লেখা একটা কাগজ টেনে নিয়ে তারই এক কোনায় লিখে দিলেন: গোবিন্দ সমাজপতি।

নরোত্তম বসাক আপন মনেই বারকয়েক মাথা নেড়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলেন। নিজেকে এখন বেশ হালকা লাগছিল।

পরপর কয়েকদিন নিয়ম করে খবরের কাগজ কিনলেন নরোত্তম। না, মিসেস রায়ের খুনের বিষয়ে আর কোনও নতুন খবর বেরোয়নি। তা হলে এই খুনটাও পুলিশ-দপ্তরে ‘আনসলভড’ ফাইলে জায়গা নেবে! নরোত্তম মনে-মনে ভীষণ আপশোস করছিলেন। ওঁর চোখের সামনে গোটা দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল অথচ তিনি কিছুই করতে পারলেন না। এমনকী পুলিশকে যেসব খবর তিনি দিলেন তা থেকেও কোনও সূত্র পেল না ওরা। খবরের কাগজে যখন পুলিশি তদন্তের উল্লেখ নেই তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, পুলিশ আশা জাগানোর মতো কোনও সূত্র পায়নি।

রোজই ভোরবেলা ছক বাঁধা পথে পায়চারি করতে-করতে নরোত্তম জানলার ফ্রেমে আঁটা দৃশ্যটার কথা ভাবেন। আর ভাবেন আজই হয়তো গোবিন্দ সমাজপতি নতুন কোনও সূত্র খোঁজার আশায় ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। কিন্তু কার্যত যখন তা ঘটে না, তখন ভাবেন সমাজপতি হয়তো ওঁর কথাগুলোকে ভীমরতি ধরা বাহাত্তুরে বুড়োর কচকচি ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে। কিংবা রোজই হয়তো থানায় এ জাতীয় কিছু উলটোপালটা সাক্ষী গিয়ে হাজির হয়। সুতরাং, গোবিন্দ সমাজপতিকে দোষ দেওয়া যায় না। দরকার পড়লে তিনি নিশ্চয়ই নরোত্তম বসাকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

কেমন যেন অদ্ভুতভাবেই মিসেস রায়কে খুব আপনার জন বলে ভাবতে শুরু করলেন নরোত্তম। একইসঙ্গে ওঁর মনে হতে লাগল, অলকানন্দা রায়ের অকালমৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। ইস, খুনটা তিনি রুখতে পারলেন না। ওঁর জায়গায় জোয়ান কোনও সুস্থ মানুষ হলে নিশ্চয়ই সেটা আটকাতে পারত। মিসেস রায়কে চেনেন না নরোত্তম, কোনওদিন দেখেনওনি। কিন্তু যখন দেখলেন, তখন ওঁর অন্তিম মুহূর্ত। শ্বাসরোধ করে ওঁর জীবনীশক্তিকে তখন তিলে-তিলে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। মিসেস রায়ের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে কিছুটা শান্তি পেতেন নরোত্তম। কিন্তু কার কথাই বা উনি জানেন, একমাত্র ওঁর স্বামী জিতেন্দ্রনাথ রায় ছাড়া। কাগজেই ওঁর স্বামীর নামটা নরোত্তম পড়েছেন। তা ছাড়া এ-অঞ্চলে ওঁর প্রতিপত্তির কথাও শুনেছেন লোকমুখে। সুতরাং জিতেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য নরোত্তম বসাকের মনটা আকুল হয়ে উঠল।

ঠিক দশদিন পরে জিতেন্দ্রনাথ রায়ের আধুনিক ঢঙে তৈরি ঝকঝকে অফিসে নরোত্তম বসাককে দেখা গেল।

পুরু কার্পেটে গোড়ালি ডুবে যাচ্ছে, এয়ার কন্ডিশনারের মিহি গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। মনেই হয় না কোনও আধা-শহরের অফিসবাড়ি। একটা টেবিলের ওপরে সুদৃশ্য টবে সাজানো রজনীগন্ধা ও গোলাপগুচ্ছ। টেবিলের ওপিঠে বসে আছে এক সুন্দরী যুবতী। তার রংচঙে প্রসাধন দেখে মনে হয় কোনও নাটক কিংবা সিনেমায় অভিনয় করার জন্য সে এক পায়ে খাড়া।

নরোত্তম বসাক মেয়েটিকে নিজের নাম বললেন। তারপর জানালেন তিনি জিতেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে চান।

উত্তরে মেয়েটি কী যেন বলল। তখন নরোত্তম বাধ্য হয়ে বললেন যে, তিনি কানে শুনতে পান না। কথাগুলো যদি ও কাগজে লিখে ওঁকে জানায় তা হলে ভালো হয়। মেয়েটি নরোত্তমের সাদা প্যাডের দিকে হাত না বাড়িয়ে নিজের ড্রয়ার থেকে একটা সাদা কাগজ বের করল। তারপর লিখল ‘মিস্টার রায় কারও সঙ্গে দেখা করছেন না।’

‘কিন্তু আমাকে যে দেখা করতেই হবে। ভীষণ জরুরি!’ নরোত্তম একান্ত আগ্রহের ঢঙে বললেন।

‘কেন?’ মেয়েটি লিখল।

প্রশ্নটা ছোটই। তবে সেটা লেখা হয়েছে খবরের কাগজের হেডিংয়ের হরফে, আর তাতে দু-দুবার গাঢ় দাগ টেনে আন্ডারলাইন করা হয়েছে।

‘দয়া করে ওঁকে বলুন আমি ওঁর স্ত্রীর খুনের ব্যাপারে কয়েকটা জরুরি কথা জানাতে চাই। খুনটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। বিশ্বাস করুন।’

‘তা হলে পুলিশে যান,’ মেয়েটি আবার লিখল, ‘মিস্টার রায় স্ত্রীর শোকে ভীষণ মুষড়ে পড়েছেন। কারও সঙ্গেই দেখা করছেন না।’

নরোত্তম বসাক বললেন, ‘ওনাকে একবার আমার কথা বলুন। উনি নিশ্চয়ই দেখা করবেন।’

‘মিস্টার রায় এখন অফিসে নেই,’ অধৈর্য ঢঙে মেয়েটি লিখল। কিন্তু লেখা কাগজটা সে এমনভাবে বসাকের দিকে এগিয়ে ধরল যে, তাতে ওর অধৈর্য ভাবটা পাঁচগুণ বেশি প্রকাশ পেল।

‘ঠিক আছে। আমি তা হলে ওঁর জন্যে অপেক্ষাই করছি।’ কথাটা বলে নরোত্তম কাঠের প্যানেল দেওয়া দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলেন। কালো চামড়ায় মোড়া একটা নরম সোফায় গা ঢেলে দিলেন। সোফায় বসতেই ওঁর শরীরটা যেন ডুবে যেতে লাগল। নরোত্তম লক্ষ করলেন, মেয়েটি ওঁর দিকে কঠিন চোখে চেয়ে আছে। পরক্ষণেই সে হাতের ইশারায় অফিসের সদর দরজাটা দেখাতে লাগল অর্থাৎ; আপনি চলে যান। কিন্তু নরোত্তম সে-ইশারা স্রেফ না দেখার ভান করে নির্বিকারভাবে বসে রইলেন। মেয়েটি তীক্ষ্ন রুক্ষ চোখে অনেকক্ষণ ওঁর দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু বসাক সে দৃষ্টি গ্রাহ্যই করলেন না—অন্তত গ্রাহ্য না করার ভান করলেন। অবশেষে মেয়েটি বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে সামনে রাখা টাইপমেশিনে মনোযোগ দিল।

বসে-বসে উথালপাথাল ভাবতে লাগলেন নরোত্তম। সত্যি-সত্যি তিনি কি দেখা করতে চেয়েছিলেন জিতেন্দ্রনাথের সঙ্গে? কোনও সুস্থ মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ওঁর পক্ষে রীতিমতো অস্বস্তিকর। অন্তত ওঁর পক্ষে না হলেও সুস্থ মানুষটির পক্ষে তো বটেই কারণ, নরোত্তম বসাকের কথা তাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয় এবং উত্তর দেওয়ার সময় তাদের কষ্ট করে লিখে জানাতে হয় কথাগুলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে ওঁর হঠাৎই মনে হল, মিস্টার রায় হয়তো ভালো করেই জানেন ওঁর স্ত্রীকে কে হত্যা করেছে। স্বামী অফিসে বেরোনোর পর থেকে সারাটা দিন মিসেস রায় একাই কাটাতেন। হয়তো সেই ফাঁকে ওঁর কোনও ভালোবাসার মানুষ জুটে গিয়েছিল। প্রায়ই সে হয়তো মিসেস রায়ের সঙ্গে গোপনে দেখা করতে আসত। দিনে-দিনে সে হয়তো জিতেন্দ্রনাথের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ছিল। অলকানন্দাকে সে আর কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাইছিল না। পরিণতিতে কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে ঘটে গেছে ক্রোধ ও উত্তেজনার বিস্ফোরণ। মিসেস রায় নিহত হয়েছেন। সুতরাং নরোত্তম এখন ভালোমন্দ যা-ই বলুন না কেন, তাতে মিস্টার রায়ের দুঃখ শুধু বেড়েই যাবে—কমবে না। পুলিশি তদন্তে শুধু কলঙ্ক-কথা প্রকাশিত হবে।

অতএব জিতেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসার কোনও মানেই হয় না, নরোত্তম মনে-মনে ভাবলেন। এখুনি এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।

নরোত্তম উঠে দাঁড়ালেন। ভাবলেন, মেয়েটিকে কি বলা উচিত যে, তিনি মিস্টার রায়ের সঙ্গে আর দেখা করতে চান না? নাঃ, বরং চুপচাপ অফিস ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালো—হয়তো মেয়েটির নজরই পড়বে না এদিকে।

কিন্তু নরোত্তম ইতস্তত করে দরজার দিকে পা বাড়াতেই জনৈক বিশাল চেহারার পুরুষ দরজায় হাজির হলেন। বলিষ্ঠ দ্রুত পা ফেলে তিনি এগিয়ে গেলেন রিসেপশনিস্ট যুবতীর দিকে। মেয়েটি একগোছা চিঠিপত্র ওঁর হাতে দিল। তারপর ভদ্রলোক একইরকম ব্যস্ততায় একটা পালিশ করা কাঠের দরজার দিকে এগিয়ে চললেন। দরজার ওপরে পেতলের ফলকে লেখা জিতেন্দ্রনাথ রায়।

মেয়েটি হঠাৎ একটুকরো কাগজ হাতে তড়িঘড়ি এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। কাগজটায় একপলক নজর বুলিয়েই দুজনে চোখ ফিরিয়ে তাকাল বিব্রত নরোত্তম বসাকের দিকে। নরোত্তমের পায়ের নীচে নরম কার্পেট যেন তলিয়ে যেতে লাগল, বেরোনোর দরজাটা যেন মুহূর্তে সরে গেল বহু-বহু দূরে। তবুও বেশ কষ্ট করে নরোত্তম মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তুললেন, পায়ে-পায়ে এগিয়ে চললেন দরজার দিকে। তারপর একসময় দরজার বাইরে।

রাস্তায় পা দিয়ে নরোত্তমের হঠাৎই খেয়াল হল একটু আগে দেখা পুরুষটির মাথায় কয়েকটা রুপোলি চুল চিকচিক করছিল, আর তার ডানহাতের আঙুলে একটা বড় সোনার আংটি।

ধীরে-ধীরে বাড়ির দিকে রওনা হলেন নরোত্তম। আবহাওয়া আজ ভীষণ সুন্দর, কিন্তু সেসব ওঁর নজরেই পড়ল না। ভীষণ পরিশ্রান্ত ক্লান্ত লাগছিল। চলার পথে একটা ছোট পার্কে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলেন। ভাবতে লাগলেন নিজের অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপের কথা। কী দরকার ছিল মিস্টার রায়ের অফিসে যাওয়ার! কী দরকার ছিল জঙ্গলে পথ হারিয়ে খুনের দৃশ্যটা দেখে ফেলার? নিজের ওপরে ধিক্কার ও বিরক্তি এল নরোত্তমের।

নিজের বোকামির কথা ভাবতে-ভাবতে বাড়ির কাছে পৌঁছলেন এবং পৌঁছেই অবাক হলেন।

একটা কালো অ্যামবাসাডার ওঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে।

নরোত্তম যে-জায়গায় বাস করেন সেটা এ-অঞ্চলের খুব বিলাসী এলাকা নয়। এদিকটায় তেমন একটা গাড়ি চোখে পড়ে না। সুতরাং, এই মুহূর্তে, ওঁর বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকাটা নিতান্ত অবাক করে দেওয়া ঘটনা।

পরমুহূর্তেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে যে-লোকটি প্রায় ছুটে এল নরোত্তম বসাকের দিকে তাকে দেখে আরও শতগুণ অবাক হলেন নরোত্তম।

অঙ্গভঙ্গিশাস্ত্রে নরোত্তমের পারদর্শিতা ওঁকে জানিয়ে দিল, আগন্তুক এত উত্তেজিত যে হয়তো ওঁকে আক্রমণ করে বসতে পারে। লোকটা চিৎকার করে কথা বলছে—কারণ, তার ঠোঁট নড়ছে সেই ভঙ্গিতে, একইসঙ্গে সে ক্ষিপ্তভাবে হাত-পা ছুড়ছে।

বসাক লোকটিকে চেনেন।

প্রতিদিন সকালে পায়চারি করতে বেরিয়ে এই লোকটিকেই তিনি ব্যস্তভাবে দরজায় তালা দিয়ে কালো অ্যামবাসাডারে উঠে বসতে দেখেন।

আমি আপনাকে চিনি। রোজই দেখি। কিন্তু কোনওদিন ভাবিনি আপনি আমার বাড়িতে আসবেন। মনে-মনে এই কথাগুলো বলতে চাইলেন নরোত্তম।

মুখে একটাও শব্দও উচ্চারণ করেননি নরোত্তম। শুধু নিজেকে সতর্ক করলেন, এখন না বোকার মতো কোনও কথা বলে বসেন। বিভ্রান্তের মতো এলোমেলোভাবে পকেট হাতড়ে প্যাড ও পেনসিল বের করলেন। সে-দুটো বাড়িয়ে ধরলেন আগন্তুকের দিকে।

আমতা-আমতা করে সংকোচের সুরে বললেন নরোত্তম, ‘ইয়ে…মানে আমি কানে শুনতে পাই না। আপনি কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার নাম নরোত্তম বসাক। আপনি কি আমাকেই খুঁজছেন? মানে, মনে হচ্ছে কিছু একটা বিপদে পড়েছেন…। কী ব্যাপার? আমি কি কোনওরকম হেলপ করতে পারি?’

লোকটা প্যাড-পেনসিল একরকম ছিনিয়েই নিল নরোত্তমের হাত থেকে। গাড়ির বনেটের ওপরে ভর রেখে কী যেন লিখতে গেল, কিন্তু তখুনি প্যাডটা ফসকে পড়ে গেল ফুটপাথে। সেটা ঝুঁকে পড়ে তাকে তুলতে হল।

ব্যাপার-স্যাপার দেখে নরোত্তম শান্ত গলায় বললেন, ‘আসুন, আমার ঘরে আসুন। বসে ধীরে সুস্থে কথা বলা যাবে।’

লোকটা তাড়াহুড়ো করে কী যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর বসাককে অনুসরণ করে ঘরে ঢুকল।

ছোট একটা টেবিলকে মাঝখানে রেখে দুজনে দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসলেন। একটা জানলা দিয়ে বিকেলের মরা রোদ ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আগন্তুক ক্ষিপ্র হাতে প্যাডের কাগজে পেনসিল চালাতে লাগলেন। মনে হল তার সমস্ত ক্রোধ এবং উত্তেজনা হাত বেয়ে এসে উপচে পড়ছে প্যাডের ওপর। লেখা অক্ষরগুলো মাপে এত বড় যে, একটা পাতায় সাত-আটটা শব্দের বেশি ধরছে না। লেখার শেষে প্রথম পাতাটা ভদ্রলোক গুঁজে দিলেন নরোত্তমের নাকের ডগায়। শব্দগুলো পাঠ করে নরোত্তম একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন।

‘বেহায়ার মতো পরের ব্যাপারে নাক গলানোটা বন্ধ করবেন।’

প্রথম পাতা পড়ার আকস্মিক ধাক্কাটা সামলে উঠতে না উঠতে দ্বিতীয় পাতাটা ঝটিতি এসে গেল নরোত্তম বসাকের চোখের সামনে।

‘জিতেন অলকাকে ভালোবাসত। ওর মৃত্যুতে জিতেন ভীষণ…।’

আর-একটা পাতা এগিয়ে এল।

‘শক পেয়েছে। গত পরশু ও আত্মহত্যা…।’

আবার একটা নতুন পাতা।

‘করার চেষ্টা করেছিল।’

স্লিপের পর স্লিপ আসতে লাগল। ভদ্রলোকের বক্তব্য যেন আর শেষই হতে চায় না।

নরোত্তম এক-একটা পাতা পড়ে ওঠার আগেই নতুন-নতুন পাতা এসে হাজির হতে লাগল। তবে প্রতিটি শব্দেই যে তীব্র ঘৃণা, অভিযোগ, সাফাই, আর শাসানি লুকিয়ে রয়েছে সেটা বুঝতে নরোত্তমের কোনও অসুবিধে হল না।

‘আপনার আজগুবি গপপো পুলিশ আমাদের বলেছে। জিতেন আর অলকার ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না। অলকার বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত জিতেনের নামে পাগল। আমি সম্পর্কে অলকার একরকম মামা হই। তা ছাড়া জিতেন আমার ক্লায়েন্ট। ওদের পরিবারের মুখে কেউ কাদা ছোড়ার চেষ্টা করলে আমাকে তার মোকাবিলা করতেই হবে। আপনার কি মশাই ভীমরতি ধরেছে? আপনি সেদিন যা দেখেছেন তা হল জিতেন অলকাকে আদর করছিল। অফিসে বেরোনোর আগে রোজই তাই করত। সেদিন হঠাৎ আপনি দেখে ফেলেছেন। আপনি এতই নোংরা চরিত্রের লোক যে, এটা নিয়ে জিতেনকে আজ ব্ল্যাকমেল করতে গিয়েছিলেন? রিসেপশনিস্ট মিস সরকার সাক্ষী আছেন। আপনি যদি এ নিয়ে বেশি প্যাঁচ খেলার চেষ্টা করেন তা হলে সোজা ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়ব বলে রাখছি। মানহানি—ব্ল্যাকমেল—মিথ্যে সাক্ষী—সবকিছু নিয়ে একেবারে ফাঁসিয়ে দেব।’

প্রতিটি শব্দ যেন এক-একটা গুলির মতো। নরোত্তম বসাক আকস্মিক আঘাতে-আঘাতে রীতিমতো বেসামাল হয়ে পড়লেন। তবু অতি কষ্টে চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলেন। আগন্তুক তখন তার লেখা থামিয়েছে, কিন্তু রাগে চোখ-মুখ ফেটে পড়ছে।

‘আপনার নামটা জানতে পারি?’ নরোত্তম প্রশ্ন করলেন ক্ষীণ কণ্ঠে।

লোকটি ঝটপট পেনসিলের আঁচড় টেনে একটি স্লিপ বাড়িয়ে দিল ওঁর দিকে।

পথিক চট্টোপাধ্যায়।

আশ্চর্য হলেন নরোত্তম। কারণ, নামটা ওঁর বেশ জানা। এবং শুধু ওঁর নয়, এ-অঞ্চলের প্রায় সকলেই পথিক চট্টোপাধ্যায়ের নাম জানে। ভদ্রলোক একজন প্রাক্তন এম.এল.এ.। গত ইলেকশানে হেরে গেছেন। তবে বেশ প্রভাবশালী এবং প্রতাপশালী ব্যক্তি।

পথিক চট্টোপাধ্যায়কে দেখে ওঁর সম্পর্কে যেসব মতামত বা অভিমত নরোত্তম খাড়া করেছিলেন সেগুলো সবই প্রায় মিলে গেছে। এই মিলে যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ তৃপ্তি দিল। ভদ্রলোকের কথাবার্তায় কেমন একটা আহত অহংকারবোধ ছায়া ফেলেছে। এর কারণ হয়তো এককালে তিনি বহু আলোচিত পুরুষ ছিলেন, এখন গ্রিনরুমই হল ওঁর আবাসস্থল। মঞ্চে ওঁর কোনও ভূমিকা নেই।

নরোত্তম কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললেন, ‘যদি একটু ধৈর্য ধরে শোনেন তা হলে আপনাকে সব খুলে বলতে পারি মিসেস রায়ের খুনের ব্যাপারে মিছিমিছি সাধ করে আমি নাক গলাইনি—।’

না, পথিক ওঁকে ধমক দিয়ে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন না। বরং সব শুনতে লাগলেন। আর একটানা বলে যেতে লাগলেন নরোত্তম।

কথাগুলো পথিক শুনছিলেন: তবে তেমন একটা মনোযোগ দিচ্ছিলেন না। কিন্তু যে-মুহূর্তে নরোত্তম খুনের ভাবভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে কথা শুরু করলেন তক্ষুনি কাগজ-পেনসিল টেনে নিয়ে পথিক খসখস করে লিখেলেন ‘খুনের ভঙ্গি! হুঁঃ! যতসব গাঁজাখুরি তাপ্পি!’

একজন প্রাক্তন এম.এল.এ-র শব্দচয়নের পছন্দ দেখে নরোত্তম বেশ অবাক এবং আহত হলেন। কিন্তু পথিক তখনও টেবিলে ঝুঁকে পড়ে লিখে চলেছেন: ‘আপনাকে এই শেষবারের মতো বলছি, যদি বাকি জীবনটা ঘানি ঘোরাতে না চান তা হলে জিতেনের ব্যাপারে আর নাক গলাবেন না।’

ব্যস, তৎক্ষণাৎ আসন ছেড়ে কোনওরকম সৌজন্যসূচক বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে ঝড়ের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন পথিক চট্টোপাধ্যায়। একটু পরেই বাইরে গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার শব্দ শোনা গেল।

তখন সন্ধের আঁচল ধীরে-ধীরে বিছিয়ে পড়ছে পৃথিবীর ওপরে।

সন্ধে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে একসময় আঁধার নেমে এল। স্থবিরের মতো একইভাবে চেয়ারে বসে রইলেন নরোত্তম। এক বিচিত্র লজ্জা ওঁকে পরতে-পরতে জড়িয়ে ধরতে লাগল।

পথিকের এত রাগারাগি ওঁর পছন্দ হয়নি—কিন্তু বারবার ওর মনে হতে লাগল সেজন্য তিনি নিজেই দায়ী। নিজের চোখে তিনি একটা খুন হতে দেখেছেন, এ-কথাটা কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়নি! যদি এই খুন নিয়ে কোনও মামলা হয়, তা হলে সে মামলায় ওঁর সাক্ষ্য যে ধোপে টিকবে না তাতে নরোত্তমের কোনও সন্দেহ নেই। ভীমরতি ধরা সত্তর বছরের এক বুড়োর কথার কে কানাকড়ি দাম দেবে! তা ছাড়া, একজন পুরুষ একজন মহিলার ওপরে ঝুঁকে পড়েছে এটা একঝলক দেখেই কি সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পুরুষটি মহিলাটিকে খুন করছিল? কানে কালা হলেই কি কোনও মানুষ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবভঙ্গি বা অভিব্যক্তি জলের মতন ব্যাখ্যা করে ফেলতে পারে? নরোত্তম এই মুহূর্তে নিজেই নিজের বিপক্ষে রায় দিলেন। সত্যি, কী বোকার মতোই না তিনি ভেবেছেন, কানে কালা হয়ে ওঁর মধ্যে নতুন এক ক্ষমতা জন্ম নিয়েছে।

ভাবতে-ভাবতে সময় যতই কাটতে লাগল নরোত্তম বসাক ততই নিশ্চিত হতে লাগলেন যে, ওঁর সমস্ত অনুমানই আজগুবি, উদ্ভট কল্পনা—যে-লোকটিকে তিনি ভেবেছেন হতাশায় ঝুঁকে আছে সে হয়তো আসলে ঝুঁকে পড়ে পেট চেপে হাসিতে ফেটে পড়ছে। যে-লোকটি ছটফটে উড়ু-উড়ু পা ফেলে হেঁটে চলেছে, নরোত্তম ভাবলেন সে কোনও খুশির খবর দিতে অথবা নিতে চলেছে কারও কাছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, না, লোকটা হয়তো নিজের হতাশা ও দুঃখ ঢেকে ওইরকম লোকদেখানো চালে হেঁটে চলেছে। চলার পথে নরোত্তম যখন কোনও বালককে হাসি মুখে হাতে হাত ঘষতে দেখেন তখন ভাবেন সে বোধহয় নিজের খুশির জগতে আপনমনেই বাহবা কুড়োচ্ছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ছেলেটি হয়তো প্রতিবেশীর পোষা কুকুরটিকে লাঠিপেটা করতে পেরে বেজায় খুশি হয়েছে।

নাঃ, নরোত্তমের শব্দহীন দুনিয়ার যে-যে নিয়ম কানুনগুলো ধীরে-ধীরে তিলে-তিলে গড়ে উঠেছিল সেগুলো আজ পথিকের তিরস্কারে কাচের মিনারের মতো ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়েছে।

চারিদিক কেমন ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকল নরোত্তম বসাকের কাছে। একবার মনে হল, তিনি শহরের বাড়িতেই ফিরে যাবেন—ঢের হয়েছে, এখানে আর নয়। অথচ এখানে যে-সুখ ও প্রশান্তি তিনি পেয়ে থাকেন তার তুলনা কোথায়! শুধু একবারই যা—।

হঠাৎই খুশি হয়ে উঠলেন নরোত্তম। পথিক ওঁর অন্তত একটা বিরাট উপকার করেছেন। একটা কাল্পনিক পথ থেকে সরিয়ে এনে ওঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বাস্তবের সঠিক পথে। মানুষের আচার-আচরণ কিংবা ভাবভঙ্গি সবসময়েই বিভ্রান্তিকর। না, এখন আর কোনও সন্দেহ নেই নরোত্তমের মনে।

গোবিন্দ সমাজপতি হয়তো ঠিক এই কারণেই আর কোনও খবর দেননি নরোত্তমকে। তদন্ত করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছেন সমাজপতি। প্রথম ধাক্কা হয়তো জিতেন্দ্রনাথ, দ্বিতীয় ধাক্কা পথিক, এবং তৃতীয় ধাক্কা নরোত্তমের বৃদ্ধ বয়েস। ছিঃ, ভালোবাসার আলিঙ্গনকে তিনি ভেবেছেন খুনির সর্বনাশা আক্রমণ! কী লজ্জা, কী লজ্জা!

নরোত্তম জোর করে মনটাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন অন্য কোনও প্রসঙ্গে। অলকানন্দা রায়ের খুনের ঘটনা ওঁকে আমূল ভুলে যেতে হবে। বরং তার চেয়ে ভাবা যাক চড়ুইপাখি বছরে ক’বার ডিম পাড়ে, কীভাবে লালনপালন করে তার বাচ্চাদের।

আবহাওয়া সেই খুনের দিন থেকেই সেজেগুজে সুন্দর হতে শুরু করেছে। আজকের দিনটা দেখে মনে হয় তার সাজগোজ এখনও শেষ হয়নি। নিয়মিতভাবেই ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েন নরোত্তম। তবে ভুল করেও রায়বাংলোর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। যে-ভুল একবার হয়ে গেছে তা জেনেশুনে দ্বিতীয়বার করার কোনও মানে হয় না।

মাস-ছয়েক এইভাবেই কেটে গেল। তারপর একটা ঘটনা ঘটল।

জিতেন্দ্রনাথ বিয়ে করলেন দ্বিতীয়বার। একটা মাঝারি মাপের উৎসবও হল। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন হাজির হলেন উৎসব-বাড়িতে। খুশি হয়তো সকলেই হয়েছেন, তবে নিমন্ত্রিতদের কয়েকজন মন্তব্য করলেন, অলকার মৃত্যুর পর এত সাততাড়াতাড়ি জিতেন্দ্রনাথ বিয়ে না করলেই পারতেন। কিন্তু পথিক চট্টোপাধ্যায় বা অলকানন্দার বাড়ির তরফ থেকে কোনওরকম অনিচ্ছার বা অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। বরং এই দ্রুত বিবাহের এরকম একটা ব্যাখ্যাও শোনা গেল যে, অলকানন্দাকে জিতেন্দ্রনাথ এত ভালোবাসতেন যে, ওঁর জায়গা একেবারে শূন্য রাখতে তিনি অসহ্য কষ্ট পাচ্ছিলেন। সুতরাং দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা জিতেন্দ্রনাথ ও অলকানন্দার গভীর ভালোবাসাকেই সমর্থন করল।

টুকরো-টুকরো খবর নরোত্তমের কানে আসতে লাগল। সেগুলো জোড়া দিয়ে ঘটনা প্রবাহের কাঠামো তৈরি করতে লাগলেন তিনি।

এরপরে জানা গেল জিতেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিবাহটি প্রেমঘটিত। কথাটা কানে আসামাত্র অবাক হলেন নরোত্তম। এমনিতে সারাটা দিন ওঁর অলসভাবেই কাটে। সুতরাং ইচ্ছে না থাকলেও সংগ্রহ করা খবরগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করার কাজটা অজান্তেই ঘটে যায়। নরোত্তম বসাককে আরও যে খবরটা অবাক করল সেটা হল জিতেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় স্ত্রী দিল্লির বাসিন্দা। হাজার-দেড়হাজার মাইল দূরের একটা মেয়ের সঙ্গে কী করে জিতেন্দ্রনাথের প্রণয় ঘটল সেটা ভেবে বেশ অবাক হলেন নরোত্তম। অবশ্য এটা ঠিক যে, ব্যাবসার কাজে জিতেন্দ্রনাথকে দিল্লিতে প্রায়ই যেতে হত। কিন্তু মাত্র দু-মাসের মধ্যে পরিচয় প্রণয় বিবাহ…নাঃ, এসব উলটোপালটা ভাবা ঠিক হচ্ছে না। নিজেকে প্রায় ধমকই লাগালেন নরোত্তম। কারও ক্ষেত্রে দু-মাস লাগে, কারও বা দু-দশ বছর। এ জাতীয় জিনিসের আবার নির্দিষ্ট সময় বাঁধা আছে নাকি!

ব্যাবসার কাজে দিল্লি গেলে জিতেন্দ্রনাথ বরাবরই প্রচুর টাকা খরচ করে আসতেন। এ-খবরটা জানতেন একমাত্র জিতেন্দ্রনাথের পারসোনাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এই বেহিসেবি খরচের ফলে ওঁর ব্যবসা কিছুটা টলোমলো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন আর কোনও ভয় নেই। অলকানন্দার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রচুর সম্পত্তি জিতেন্দ্রনাথের টালমাটাল ব্যাবসাকে সুস্থির করবে। তা ছাড়া দিল্লিতে ব্যাবসার কাজ গুটিয়ে নেওয়ায় এখন জিতেন্দ্রনাথকে সেখানে আর ট্যুরে যেতে হয় না ফলে ওদিকটায় অর্থের অপচয় একেবারেই কমে গেছে।

এই খরচগুলো আর কেউ যেমন জানে না, তেমনি নরোত্তমও জানতেন না। জানলে পরে আবার কিছুটা অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। দুশ্চিন্তা উড়ে এসে জুড়ে বসত মাথায়।

নরোত্তমের নিয়মিত জীবনযাত্রা আবার সুশৃঙ্খল হয়ে পড়ল।

অলকানন্দা রায়ের খুনের ঘটনা একরকম ভুলেই গেছেন নরোত্তম। এখন তিনি গোবিন্দ সমাজপতি, জিতেন্দ্রনাথ রায়, পথিক চট্টোপাধ্যায়—সবাইকেই ভুলে যেতে চান। বিশেষ করে পথিকের ভয়ে তিনি সর্বদা বিব্রত থাকেন। কোনদিন হুট করে না ওঁকে শাসাতে চলে আসেন!

প্রথমটায় নরোত্তম ঠিক করেছিলেন ভোরবেলা চলার পথে পথিক চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির রাস্তাটা এড়িয়ে চলবেন। কিন্তু পথটার সৌন্দর্য এত অপরূপ যে, সে-দৃশ্যকে হারাতে মন চায় না। সুতরাং, নরোত্তম শেষ পর্যন্ত একটা উপায় খুঁজে বের করলেন। তিনি ঠিক করলেন, অনেক বেলার দিকে ওই পথে হাজির হবেন তিনি। তা হল পথিকের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।

এইভাবে রোজকার নিয়মের ছক সামান্য অদলবদল করে নিলেন নরোত্তম।

হঠাৎই একদিন চলার পথে পথিক চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে পেলেন। তবে শুধু পথিক নয়, সঙ্গে রয়েছেন জিতেন্দ্রনাথ।

নরোত্তম থমকে দাঁড়ালেন। বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। একেবারে জোড়া বাঘের মুখোমুখি। এখুনি কী উলটোদিকে হাঁটা দেবেন। নাকি রাস্তা পেরিয়ে চলে যাবেন অপর ফুটপাথে?

দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে নরোত্তম সিদ্ধান্ত নিতে ব্যস্ত ছিলেন, তবে ওঁর চোখ সামনের খুঁটিনাটি দৃশ্যগুলো অভ্যাসবশে জরিপ করে নিচ্ছিল।

পথিক চট্টোপাধ্যায়ের হাত-পা নাড়া এবং কথাবার্তা বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে তিনি অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত। মাঝে-মাঝে ব্যঙ্গের হাসিও খেলে যাচ্ছে পথিকের ঠোঁটে। যেন জিতেন্দ্রনাথকে বেশ বাগে পেয়েছেন তিনি। ওদিকে জিতেন্দ্রনাথ চোখ ছোট করে ঠোঁট কামড়ে রয়েছেন। পথিকের কোনও কথাই ওঁর কানে ঢুকছে না। যেন অন্য কোনও মতলব ভাঁজছেন।

হঠাৎই নরোত্তম খেয়াল করলেন, তিনি আবার সেই পুরোনো তত্ত্বের ওপরে ভিত্তি করে আকাশকুসুম কল্পনা করতে শুরু করেছেন। ভাবভঙ্গি আচার আচরণ ইত্যাদির নীরব ভাষা আঁচ করতে চেষ্টা করছেন। নাঃ, এসব উদ্ভট কল্পনার কোনও মানেও হয় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উলটোদিকের পথ ধরলেন নরোত্তম। ভুল, ভুল, সব ভুল! যে-মানুষ কানে শুনতে পায় সে হয়তো বলবে পথিক আর জিতেন্দ্রনাথ কোনও ব্যাবসায়িক আলোচনা করছেন।

বাড়ি ফেরার পথে ক্লান্তভাবে হাঁটছিলেন নরোত্তম। ভাবছিলেন, এবারে ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যাবেন কিনা। কিন্তু সেখানেও কী সুখ কিংবা স্বস্তি আছে!

সুখ-শান্তি ইত্যাদির ব্যাপারে ভাবতে-ভাবতে নরোত্তম বাড়ি পৌঁছে গেলেন। এবং ঠিক করলেন, পরদিন থেকে তিনি পথিকের উলটোদিকের ফুটপাথ ধরে নির্বিঘ্নে চলে যাবেন। ওই পথের আকর্ষণ কিছুতেই ওঁর মতো সৌন্দর্যলোভী বৃদ্ধকে মুক্তি দিচ্ছে না।

নরোত্তমের নতুন পরিকল্পনাতেও খুঁত থেকে গিয়েছিল।

পথিক ও জিতেন্দ্রনাথকে দেখার ঠিক পাঁচদিন পর একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলেন নরোত্তম। যথারীতি উলটোদিকের ফুটপাথ ধরে ধীরেসুস্থে এগোচ্ছিলেন। পথিক চট্টোপাধ্যায়ের প্রাসাদপ্রতিম অট্টালিকাটি পেরিয়ে যাওয়ার সময় নিছকই কৌতূহলে বাড়িটার দিকে ঘাড় ফেরালেন তিনি। এবং তখনই দৃশ্যটা ওঁর নজরে পড়ল।

দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে পথিক পাগলের মতো হাত নেড়ে নরোত্তম বসাককে ডাকছেন।

না, ঠিক হাত নেড়ে ডাকছেন তা বোধহয় বলা যায় না। পথিক যে কী করছেন তা বলা মুশকিল। না, ভাবভঙ্গি দেখে মানুষের মনের কথা আঁচ করার অপচেষ্টা ছেড়ে দিয়েছেন নরোত্তম।

পথিক নিশ্চয়ই হাত নেড়ে ডাকছেন। হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই।

নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বারবার অবাক হলেন নরোত্তম। তারপর চোখ ছোট করে আরও তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দেখলেন। কী বলতে চাইছেন পথিক? মাসকয়েক আগে হলেও নরোত্তম বলতেন ভদ্রলোক সাহায্যের আশায় চিৎকার করছেন, আকুল কণ্ঠে ওঁকে ডাকছেন, ওঁর ভঙ্গিটা যেন জলে ডুবে যাওয়া অসহায় মানুষের মতো, যেন খড়কুটো পেলেই আঁকড়ে ধরবেন।

কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, নরোত্তমের পক্ষে বলা সম্ভব নয় পথিক আসলে ঠিক কী বলতে চাইছেন।

পরক্ষণেই পথিকের মুখ বিকৃত হল। উনি কী কোনও বাচ্চাকাচ্চার সঙ্গে মুখভঙ্গি করে ছেলেখেলা করছেন? নিশ্চয়ই তা-ই হবে। কোনও ছোট ছেলে কিংবা মেয়েকে মুখ বেঁকিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছেন পথিক। বাঃ, বেশ আমুদে লোক তো! নরোত্তম মজা পেলেন।

পথিক এবার ডানহাত বাড়িয়ে জানলার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরেছেন। ঘরের ভেতরে ঝুঁকে পড়েছেন সামান্য। হয়তো ওঁর হাত থেকে কিছু একটা পড়ে গেছে—সেটাই ঝুঁকে পড়ে তুলছেন তিনি।

পলকের জন্য হঠাৎই নরোত্তমের মনে হল পথিক চট্টোপাধ্যায় বিপদে পড়েছেন। একবার ভাবলেন, ছুটে গিয়ে ওঁকে সাহায্য করেন, কিন্তু পথিকের বাড়িতে নিশ্চয়ই লোকজন চাকরবাকর আছে। সেখানে নরোত্তম হুট করে গিয়ে হাজির হলে শেষ পর্যন্ত হয়তো পথিকের কাছেই ধাতানি খেতে হবে। একে তো অলকানন্দা রায়ের খুনের ব্যাপারে জড়িয়ে খুব একচোট নাকাল হতে হয়েছে নরোত্তমকে, তারপর…।

তবু নরোত্তমের মনটা খচখচ করতে লাগল। এ-পথে আর কেউ এলে তিনি তাঁকে বলবেন ব্যাপারটা একটু খোঁজখবর করে দেখতে।

নরোত্তম অপেক্ষা করতে লাগলেন, কিন্তু কেউ এল না। তখন আবার তাকালেন জানলার দিকে।

জানলায় কেউ নেই! জানলার ফ্রেম থেকে পথিক অদৃশ্য হয়ে গেছেন। জানলা এখন শূন্য, হা-হা করছে। সবকিছু আবার ঠিকঠাক হয়ে গেছে।

নরোত্তম বসাকের বেড়ানো একসময় শেষ হল। এরপর সাতদিন তিনি বাড়ি থেকে বেরোলেন না। শরতের একটানা অকালবৃষ্টি ওঁকে ঘরকুনো করে রাখল। কাজের লোকটি প্রয়োজনে বেরিয়ে দোকানপাট সেরে দিল। সুতরাং, স্থানীয় খবরগুলো নরোত্তম পাননি। খবরের কাগজও দেখা হয়নি ওঁর।

সুতরাং, তিনি জানতে পারলেন না পথিক চট্টোপাধ্যায় মারা গেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে কন্টিনেন্ট ট্যুরে বেরোবেন বলে ঠিক করেছিলেন পথিক। সেই কারণে কিছুদিন ধরে প্র্যাকটিসে বেরোনোও বন্ধ রেখেছিলেন। ঘটনার, অথবা দুর্ঘটনার, দিন বাড়িতে তিনি একা ছিলেন। স্ত্রী বেরিয়েছিলেন বিশ্বভ্রমণ উপলক্ষ্যে শেষ মুহূর্তে কিছু কেনাকাটা সারতে। পথিক জানতেন যে, ওঁর হার্টের অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু দুনিয়া চষে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে তিনি একটা ভারী ট্রাঙ্ক টেনে সরাতে গিয়েছিলেন।

অত্যাধিক পরিশ্রমে পথিক হার্টফেল করে মারা যান। অথচ যে-ট্যাবলেট খেলে ওঁর প্রাণ বাঁচত সেটা প্রায় হাতের নাগালেই ছিল।

এই দুর্ঘটনায় অত্যন্ত বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করে মিসেস চট্টোপাধ্যায়কে আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েছেন প্রখ্যাত ব্যাবসায়ী শ্রীজিতেন্দ্রনাথ রায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress