Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ম্যানহাটানে মুনস্টোন || Sujan Dasgupta » Page 7

ম্যানহাটানে মুনস্টোন || Sujan Dasgupta

শৈলেন সাঁপুই অবশ্য ম্যানহাটানে থাকেন না, থাকেন কুইন্সে। সময় হাতে নিয়েই বেরিয়েছিলাম। কিন্তু পথে একেনবাবুর কফি তেষ্টা পাওয়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে সেই সাতটাই বাজল!
গ্লোব স্ট্রীটে ওপরে দোতলা একটা মাত্র। সদর দরজাটা খোলাই ছিল। ঢুকতেই একটা ছোট্ট ওয়েটিং রুম। ঘরটা ফাঁকা, রিসেপশানিস্ট ছাড়া আর একজনই শুধু বসে আছে। সেই লোকটির কাজ মিনিট দশেকের মধ্যে হয়ে যেতেই আমাদের ডাক পড়ল।
অফিসটা সত্যিই দেখার মত। মেহগনি কাঠের বিশাল একটা টেবিল, আর তার পাশে সাজানো মখমলের কুশন দেওয়া অ্যান্টিক চেয়ার, হার্ড উডের মেঝের ওপর একটা ইন্ডিয়ান কার্পেট পাতা। টেবিলের পেছনে কয়েকটা কাচের আলমারিতে নানান ধরণের কিউরিও সাজানো। ঘরের দুই কোণে কর্নার টেবিলে দুটো টিফানি শেড-এর ল্যাম্প। কিন্তু প্যানলের গাঢ় রং-এর জন্যে ঘরটা তাতে খুব একটা আলোকিত হয় নি। শৈলেন সাঁপুই দেখলাম একটু মোটা হয়েছেন। মুখ চোখেও বেশ একটা উজ্জ্বলতা। আবছা আলোয় গেরুয়া রঙের সিল্কের আলখাল্লা আর বিবেকানন্দ স্টাইলের পাগড়িতে ভদ্রলোককে বেশ অলৌকিক-অলৌকিক লাগছে। আমরা বসতেই শৈলেন সাঁপুই জিজ্ঞেস করলেম, “কফি চলবে তো?”
“আজ না, এক্ষুণি খেয়ে এলাম।” কথাটা বলে আমি একেনবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। “এঁর কথাই ফোনে আমি বলছিলাম। আপনার কাছে ভাগ্য জানতে চান।”
শৈলেন সাঁপুই মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললেন, “বেশ, বেশ গণনা নিশ্চয় হবে। চলুন, পেছনে আমার একটা প্রাইভেট অফিস আছে, সেখানে যাব। ব্যক্তিগত প্রশ্ন টশ্ন যদি থাকে…”
আমি বললাম, “তার কি দরকার, আমিই না হয় বাইরে যাচ্ছি।”
আমি উঠতে যাচ্ছিলাম, একেনবাবু বাধা দিলেন। “না স্যার না।“ তারপর শৈলেন সাঁপুইকে বললেন, “আসলে আপনার কথা প্রমথবাবু খুব বলছিলেন। আমি একটু পাজলড হয়ে গেলাম স্যার। দেশে অবশ্য ফরচুন নিয়ে অনেকেই…, কিন্তু তা বলে আমেরিকাতে, মানে আমি বলতে চাচ্ছি অ্যাস্ট্রলজি ব্যাপারটাকে আমি খুব সায়েন্টিফিক ভাবতাম না। কিন্তু এখানেও যখন এত ইন্টারেস্ট…সেই জন্যেই বাপিবাবুকে…।”
“টাইম আনলকড লাইফের কথা শুনেছেন?” শৈলেন সাঁপুই বক্কেশ্বরকে থামিয়ে বললেন।
“না স্যার।”
“সাধারণ মানুষরা টাইম-লকড জীবন যাপন করে। অর্থাৎ তারা সময়ের সঙ্গে বাঁধা। এই বন্ধন থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তাহলে পাস্ট, প্রেসেন্ট, ফিউচার – যখন যেখানে খুশি চলে যাওয়া সম্ভব। তার জন্যে দরকার ব্রেন ওয়েভকে সুপার লাইট স্পিডে মুভ করানো। সে-যুগে আমাদের যোগীরা সেটা পারতেন। এ যুগে আর সে সাধনা কজন করেছে?”
একেনবাবুর মুখ দেখে মনে হল উনি সাক্ষাৎ ভগবান দর্শন করছেন। “দাঁড়ান স্যার, আপনি কি … মাই গড!”
“প্রমাণ চান?” শৈলেন সাঁপুই স্মিত মুখে জানতে চাইলেন।
“না, না স্যার, কি যে বলেন!” একেনবাবু লজ্জা পেলেন।
“না, প্রমাণ ছাড়া কিচ্ছু অ্যাকসেপ্ট করবেন না,” শৈলেন সাঁপুই মাথা নাড়লেন। “আমি তো একটা ফোর-টোয়েন্টিও হতে পারি, পারি না?”
“ছি ছি স্যার লজ্জা দেবেন না।”
“এক থেকে দশের মধ্যে একটা সংখ্যা ভাবুন।” শৈলেন সাঁপুই প্রায় আদেশের সুরেই বললেন।
“কেন স্যার?”
“আঃ, ভাবুন না!”
“ভেবেছি স্যার।”
“কি সেটা?”
“চার।”
“আচ্ছা, এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান, আর বসার কুশনটা তুলে ফেলুন।”
একেনবাবু দেখলাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হুকুম মত কুশনটা উঠিয়ে ফেললেন।
“একটা কাগজ রয়েছে দেখেছেন?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“ওটা তুলুন আর পড়ে দেখুন তো কি লেখা আছে?”
“আনবিলিভেবল, ট্রুলি ট্রুলি অ্যামেজিং স্যার।” মাথা চুলকোতে চুলকোতে একেনবাবু আমার দিকে কাগজটা এগিয়ে দিলেন।
দেখলাম পরিষ্কার লেখা ‘চার’। সঙ্গে সঙ্গে আমার মিস্টার ইন্দ্রজালের কথা মনে পড়ল।
“এটা কিন্তু ম্যাজিক নয়। এখানে বসে নম্বরটা লিখে এক মুহূর্তে অতদূরে কাগজ পাচার করা কোনও ম্যাজিশিয়ানের কম্ম নয়।” শৈলেন সাঁপুই যেন আমাকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বললেন।
মাই গড, উনি কি সত্যিই অন্তর্যামী! একেনবাবু দেখি তখনও মাথা চুলকে চলেছেন।
শৈলেন সাঁপুই একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে ক্ষমাসুন্দর হাসি হেসে বললেন, “এ সিম্পল প্রসেস অফ ক্রসিং দ্য স্পিড অফ লাইট। আপনার কাছে যা ফিউচার, আমার কাছে তা পাস্ট।”
“তার মানে আপনি আগে থেকেই জানতেন, আমি কি ভাবব, কোথায় বসব…।”
শৈলেন সাঁপুই কথাটার কোনও উত্তর দিলেন না। ঘড়ির দিকে চট করে একবার তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এবার বলুন, ঠিক কি জানতে আপনি এসেছেন?”
“যা কিছু দুয়েকটা ফিউচার বলে দিন স্যার। বিশেষ করে যে-কাজের জন্যে এসেছি, সেটা হবে কিনা।”
“শৈলেন সাঁপুই কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চোখ বুজলেন।
“হ্যাঁ, হবে। তবে বাধা আসবে প্রচুর। এ-বছরটা আপনার একটু অশান্তিতে কাটবে, তারপর বছর পনেরো অতি শুভ সময়। পনেরোর মাথায় একটা ফাঁড়া আছে, কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠবেন। আয়ু বিরাশি বছর। আমৃত্যু স্বাস্থ্য ভালো থাকবে – ওই ফাঁড়ার সময়টুকু ছাড়া। টাকা পয়সা প্রচুর রোজগার করবেন, তবে ধরে রাখতে পারবেন না। একটা পলা আপনাকে আমি ধারণ করতে বলব। ওটা আপনাকে অনেক সাহায্য করবে। যত তাড়াতাড়ি পারেন ততোই ভালো, বিশেষ করে এই সময়টাতে।”
“পলা! পলা কোথায় পাব স্যার?”
“যাওয়ার পথে রিসেপশানিস্টকে বলে যাবেন। ও আনিয়ে রেখে দেবে।”
“জ্যাকসন হাইটসের ইন্ডিয়ান জুয়েলারির দোকানগুলোতে পাওয়া যাবে কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
পাবেন, তবে সব জায়গায় খাঁটি জিনিস পাবেন না। একটা দোকান অবশ্য সাজেস্ট করতে পারি।”
“বলুন স্যার,” একেনবাবু পকেট থেকে তড়িঘড়ি একটা ডায়রি বের করে বললেন, “একটা পেন…।”
শৈলেন সাঁপুই নিজের পেনটা দিয়ে বললেন, “চন্দন জুয়েলার্স, জ্যাকসন হাইটসেই সেভেন্টিয়েথ স্ট্রীটের ওপর।”
“ঠিকানা?”
আমি বললাম, “ওটুকু জানলেই হবে। ইন্ডিয়ান দোকানগুলো সব পাশাপাশি।”
“এক্স্যাক্টলি, তাড়াতাড়ি যান। দোকান হয়তো এখনও খোলা পেয়ে যবেন। আমার নাম বলবেন, তাহলে সুপার কোয়ালিটির ভালো জিনিস দেবে।“ বলে শৈলেন সাঁপুই উঠে দাঁড়ালেন।
আমি বুঝতে পারলাম শৈলেন সাঁপুই আমাদের আর সময় দিতে চান না। আফটার আল আনপেড কাস্টমার।
চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললাম, “অবিনাশকে মনে আছে আপনার?”
“বাঃ, মনে থাকবে না! কেমন আছেন উনি?”
“ও ইন্ডিয়াতে বেড়াতে গেছে। কিন্তু ওঁর মামা হঠাৎ সুইসাইড করেছেন। আর করেছেন আবার প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টে বেড়াতে এসে।”
“সে কি!” শৈলেন সাঁপুই খুব অবাক হলেন।
“খুব আননার্ভিং এক্সপিরিয়েন্স। প্রমথ তো ভীষণ আপসেট।”
“সে তো বুঝতেই পারছি, কবে ঘটল ব্যাপারটা?”
“এই তো গতকাল।”
শৈলেন সাঁপুই দুঃখিত হয়ে মাথা নাড়লেন। “অবিনাশকে আমার কন্ডোলেন্স জানাবেন।”
“ফিরে এলে জানাব।”
বেরোবার পথে একেনবাবু রিসেপশানিস্টকে জিজ্ঞেস করলেন, একটা পলা অর্ডার করলে কালকে সেটা আনিয়ে দিতে পারে কিনা।
“কাল হবে না, শুক্রবার আমাদের অফিস বন্ধ থাকে। হাউ অ্যাবাউট স্যাটারডে?”
“না, থাক।”

গাড়িতে উঠে একেনবাবুকে বললাম, “জ্যাকসন হাইটস এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। কিন্তু দোকান এখনও খোলা থাকবে কিনা জানি না। চেষ্টা করে দেখব নাকি?”
“আপ টু ইউ স্যার? আপনার অসুবিধা না হলেই হল।”
“নো প্রব্লেম,” বলে আমি কুইন্স বুলেভার্ডে টার্ন নিলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর একেনবাবু বললেন, “মিস্টার সাঁপুইয়ের অফিসটা খুব ইম্প্রেসিভ।”
প্রশ্ন নয় স্টেটমেন্ট। তাই জবাব দিলাম না।”
“ওঁর ঘরের কার্পেটটা খেয়াল করেছিলেন স্যার। কাশ্মীরের তৈরি, দারুন ইনট্রিকেট ডিসাইন। আমাদের দেশেই ওর দাম কম-সে-কম এক লাখ টাকা। এখানকার হিসেব অবশ্য জানি না।”
কার্পেটের দাম সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই নেই, তাই চুপ করে রইলাম।
“পিতলের বুদ্ধমূর্তি হয় টিবেট অথবা নেপাল থেকে আনা। ওর দামও ধরুন হাজার দশেক হবে।”
“আপনি বসে বসে এত সব লক্ষ করেছেন!”
“কি করব স্যার, আমার চোখ চলে যায়।”
“আচ্ছা বলুন তো ওঁর হাতঘড়িটা কি ছিল?” ওই একটা জিনিসই আমি লক্ষ করেছিলাম হাত বাড়িয়ে যখন একেনবাবুকে পেন দিচ্ছিলেন। নিতান্ত কদিন আগে মেসিজ-এ দামি ঘড়ির মধ্যে রোলেক্স-এর ওই ব্র্যান্ডটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম বলেই মনে ছিল।
“আপনি এবার আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন স্যার।” একেনবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন।
“আহা, বলুনই না।”
“মনে হল স্যার রোলেক্স। সেদিনই তো ওই ব্র্যান্ডটা দেখলাম স্যার মেসিজ-এ।”
“মাই গুডনেস, আপনি তো পেনটা নিতেই ব্যস্ত ছিলেন, তাও চোখে পড়েছে! আমি সত্যিই অবাক হলাম। “আর কি দেখলেন, বলুন।”
“এবার আপনি স্যার ঠাট্টা করছেন।”
জ্যাকসন হাইটসে পৌঁছে দেখি জুয়েলারি স্টরগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় জায়গাটা খুব নিরাপদ নয়, তাই বোধহয় খোলা রাখে না। ফিরব বলে গাড়ি ঘোরাচ্ছি, একেনবাবু বললেন, “আচ্ছা স্যার, মিস্টার প্যাটেল তো এদিকেই কোথাও থাকতেন, তাই না?”
“আপনি কি করে জানলেন?”
“প্রমথবাবু কাল বলছিলেন সেভেটিফিফথ স্ট্রীটে ওঁর অ্যাপার্টমেন্ট, তাই মনে হল।”
“ইউ আর রাইট। আর তিনটে স্ট্রীট পরেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স আছে, সেখানে থাকতেন।”
“একবার ওখানে থামবেন?”
আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন বলুন তো?”
“আমার মাথায় একটা খটকা লেগেছে – সেটা ক্লিয়ার করে নিতাম।”
“কি খটকা?”
“চলুন না স্যার?”
আরও নিশ্চয় একেনবাবুকে খোঁচাতে পারতাম, কিন্তু খোঁচালাম না। মিস্টার প্যাটলের বাড়িতে আমি আগে দুয়েকবার গেছি। দূরে নয়, কয়েক মিনিটের পথ। আমার অবশ্য জনতে ইচ্ছে করছিল একেনবাবুর খটকাটা ঠিক কি, আর কেনই বা একেনবাবু সেটা সাসপেন্সে রাখতে চান! তবে জিনিসটা এতোই মামুলি হবার সম্ভাবনা, খুব উৎকণ্ঠিত বোধ করলাম না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *