সুধীর মৈত্রের কথায় যুক্তি আছে
সুধীর মৈত্রের কথায় যুক্তি আছে। যা তিনি দেখেননি, যা আদৌ ছিল কিনা তার কোনও প্রমাণ নেই, সেটা সাধারণ না অসাধারণ, তা নিয়ে তিনি গবেষণা করতে রাজি নন। ঠিক কথা। কিন্তু জিনিসটি যে অসাধারণ, তা রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড অনুমান করেছিলেন বলেই এত বছর বাদে তাঁর নাতনি ভারতবর্ষে এসে হাজির হয়েছে। তারিণী সেনের হাত কেটে ফেলে অত্যাচার করেও তো ভদ্রলোক মূর্তিটাকে পাননি। সরকারি ক্ষমতা তাঁর হাতে ছিল, তা সত্ত্বেও বিফল হয়েছিলেন তিনি। এত বছর পরে ডরোথি কী করে বুঝল যে সে সফল হবে? আর ডরোথি তো এখন একা নয়। দু-দুবার এদেশে এসে ভালই সঙ্গী জোগাড় করতে পেরেছে। তিস্তা ভবনের দিকে যেতে-যেতে এই সব ভাবছিল অর্জুন।
ডরোথি তৈরি ছিল। বলল, আমাদের যেতে দেরি হয়ে গেল না তো?
অর্জুন ঘড়ি দেখল। এখন তিনটে বাজে। বলল, না। সন্ধের মধ্যে ফিরে আসতে পারব।
মেয়েটা সাবলীলভাবে মোটরবাইকের পেছনে উঠে বসল। ওর মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে না যে, ওর দাদুর হয়ে ক্ষমা চাইতে নয়, স্রেফ মূর্তির লোভে এ-দেশে আছে। বেশ চমৎকার অভিনয় করতে পারে মেয়েটা। তিস্তা ব্রিজের ওপর এসে অর্জুনের ইচ্ছে করছিল ডরোথির সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
পূর্বদহে যখন ওরা পৌঁছল তখনও মাটিতে হালকা রোদ। চারধার ঝরঝরে। বাইক থেকে নেমেই দেখল ডাক্তারবাবু মন্দিরের চত্বরে দাঁড়িয়ে আছেন। ওদের দেখে এগিয়ে এলেন তিনি। অর্জুন বলল, ডরোথি আবার এল দেখা করতে। ক্ষমা চাইতে। কথাগুলো ইচ্ছে করেই সে ইংরেজিতে বলল। ডরোথি তখন মন্দিরের পূর্ব দিকে পুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে। সংস্কার হয়নি অনেককাল। পানায় ঢেকে গেছে এতকালের পদ্মদিঘি।
ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়েই তারিণী সেনের বাড়িতে এল। তারিণী সেন এখনও ঘুমোচ্ছন। ওষুধে ভাল কাজ হয়েছে। হঠাৎ ডরোথি জিজ্ঞেস করল, উনি এবাড়িতে কতদিন আছেন?
আজ দ্বিতীয়া বৃদ্ধাকে দেখতে পেল অর্জুন। ওঁর বয়স হয়েছে তবে প্রথমার মতো নয়। ডাক্তারবাবু তাঁকে প্রশ্ন করলেন ডরোথির হয়ে। দ্বিতীয়া বললেন, হিসেব নেই।
এর আগে ওঁর বাড়ি ছিল কোথায়? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আগে তো জঙ্গলে ঘুরত। এই বাড়িতে ওর বাপও থাকত।
তথ্যটা ডরোথিকে জানিয়ে দিল অর্জুন।
ইতিমধ্যে প্রথমা তারিণী সেনকে ঘুম থেকে তুলে বাইরে নিয়ে এসেছেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন এখন? জ্বর ছেড়েছে?
ভগবান নিচ্ছে না, তাই যেতে পারছি না। এটাকে কি থাকা বলে! গলার স্বর এখনও মিনমিনে। ডাক্তারবাবু বললেন, আমি উঠি। পেশেন্ট আসবে। যাওয়ার সময় দয়া করে যদি আসেন!
অর্জুন নিঃশব্দে মাথা নাড়তে ভদ্রলোক চলে গেলেন।
ডরোথি বলল, ওঁকে বলো যে, আমি দাদুর হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
অনেক কষ্টে হাসি চেপে অর্জুন সেকথা তারিণী সেনকে জানিয়ে দিল।
হঠাৎ তারিণী সেন নিজের হাত দুটো ডরোথির দিকে তুলে ধরলেন, এ দুটো ফিরে পাব?
ডরোথি জিজ্ঞেস করল, উনি কী বলছেন?
অর্জুন দোভাষীর কাজ করতে লাগল। ডরোথি বলল, একথা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
কারণ, তোমার দাদু আমাকে সারাজীবনের জন্যে ঠুঁটো করে গেছেন।
অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি না।
তারিণী সেন হাসল, কবরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, উত্তর পেয়ে যাবে।
আপনি কী অন্যায় করেছেন, যাতে তিনি এত বড় শাস্তি দিতে বাধ্য হয়েছেন?
অর্জুন বাধ্য হয়েছেন শব্দ দুটো শুনে মজা পেল। ডরোথি তার দাদুকে বাঁচাতে চাইছে।
তারিণী সেন বললেন, ওই যে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম কমলাবাবুকে। নইলে মানুষটা মরেই যেত। সেই ব্যাপারটাকে অপরাধ বলে মনে করলেন গোরাসাহেব। বললেন, হাত কেটে ফেলবেন, যদি না আমি তাকে মূর্তিটা দিয়ে দিই।
কথাটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে ডরোথির দিকে তাকাল অর্জুন। মেয়েটার মুখে একটুও অন্য ছাপ ফুটল না। সে জিজ্ঞেস করল, কিসের মূর্তি?
তারিণী বললেন, তোমায় গোরাসাহেব বলেননি মূর্তির কথা?
আমার সঙ্গে দাদুর কোনও কথা হয়নি। আমি তাঁর লেখা ডায়েরিতে যে তিনজনের নাম পেয়েছি তাঁদের মধ্যে আপনি আছেন। তাই এখানে এসেছি।
অ। তা হবে। মুর্তিটা পেয়েছিলাম তিব্বতিদের কাছ থেকে। ওটার ওপর গোরাসাহেবের খুব লোভ ছিল। একটা হাত কাটার পর বলেছিল মূর্তি দিলে দ্বিতীয়টা কাটবে না। তাও যখন রাজি হলাম না, তখন এটাও কাটল। ডান হাত দেখালেন বৃদ্ধ, জানে মারল না। মারলে তো মূর্তি কোনওদিনই পাওয়া যাবে না।
ডরোথি জিজ্ঞেস করল, মূর্তিটা কি খুব দামি?
নাঃ। কেউ কিনতে চায়নি। ময়নাগুড়ির মাড়োয়ারি দোকানদার আট আনা দাম দিয়েছিল।
আমার দাদু আপনাকে টাকা দিতে চাননি?
হ্যাঁ। একশো টাকা। চোখ বড় করলেন তারিণী সেন। পঞ্চাশ বছর আগে একশো টাকার দাম ছিল কয়েক হাজার টাকার সমান।
দিলেন না কেন?
দিলেই তো আমাকে খতম করে দিত গোরাসাহেব। মূর্তিটার লোভে আমাকে জেল থেকে বাঁচিয়েছে। আমাকে মেরে ফেলতে পারেনি। তারিণী সেন ফিকফিক করে হাসতে লাগলেন। মূর্তিটার শেষপর্যন্ত কী হল?
কালোর মধ্যে লাল আর লালের মধ্যে কালো/ভক্তিভরে তারে নো করাই ভাল।
এর মানে কী?
তারিণী সেন এর জবাব দিলেন না। একই ভাবে হাসতে লাগলেন।
কত টাকা দিলে মূর্তিটা আপনি দিতে পারবেন?
কেন? মূর্তিটা তুমি কেন চাইছ?
আমার দাদুর ইচ্ছে ছিল, ওটা নিজের কাছে রাখার। সেই ইচ্ছে পূর্ণ করতে চাই।
তারিণী সেন হাসলেন, তা লে ক্ষমা চাইতে নয়, মূর্তির জন্যে এসেছ আমার কাছে?
এই গোপন সত্যটা মুখের ওপর বলে দিলেন বৃদ্ধ। অনুবাদ করতে করতে নিজেকে ঠিক রাখা বেশ মুশকিল হচ্ছিল অর্জুনের। ডরোথি হঠাৎ গলার স্বর পালটাল, কত টাকা পেলে মূর্তিটা দিতে পারবেন? দশ হাজার টাকা?
তারিণী সেন অঙ্কটা শুনে যেন অবাক হয়ে গেলেন! কোনও কথা বলতে পারলেন না।
ডরোথি আবার প্রশ্ন করল, ঠিক আছে, আপনাকে কুড়ি হাজার টাকা দেব আমি।
এবার দ্বিতীয়া বৃদ্ধা চিৎকার করে উঠলেন, কথা বলছেন না কেন? কুড়ি হাজার টাকা। ওমা, আর ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না।
তারিণী সেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর দিকে তাকালেন। টাকার অঙ্কটাকে বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ভদ্রলোক। অর্জুনের ভয় হচ্ছিল, উনি রাজি হয়ে যাবেন। সে চটপট বলে উঠল, ডরোথি, তুমি ভুল করছ। ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়া এ-দেশ থেকে কোনও মূর্তি তুমি নিয়ে যেতে পারবে না। আর মূর্তির যদি পুরাতাত্ত্বিক মূল্য থাকে, তা হলে কখনওই সেই অনুমতি পেতে পারো না।
ডরোথি শক্ত গলায় জবাব দিল, কীভাবে নিয়ে যাব সেটা আমার চিন্তা। ওঁকে তুমি জিজ্ঞেস করো মূর্তিটা ওই টাকায় দেবেন কি না!
অর্জুন এবার মিথ্যাচার করল, আপনি যেটা ওর দাদুকে দেননি তা কি এখন মাত্র কুড়ি হাজার টাকায় দিয়ে দেবেন?
মাত্র? কুড়ি হাজার মাত্র নাকি? মাড়োয়ারি দোকানদার আট আনাও দাম দেয়নি।
অর্জুন কথাগুলো অনুবাদ করল না। সে বলল, ডরোথি, উনি বলছেন সে সময় ওই মূর্তির দাম ছিল তোমাদের টাকায় এক হাজার পাউন্ড।
একথা উনি জানলেন কী করে?
অর্জুন তারিণী সেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তখন একশো টাকার লোভ ছেড়েছিলেন প্রাণের ভয়ে। এখন তো সেই ভয় নেই!
তারিণী সেন এবার নীরবে মাথা নাড়লেন। সেটা দেখিয়ে অর্জুন বলল, উনি রাজি হচ্ছেন না। সেই সময় হাজার পাউন্ড দাম উঠলে এখন তো কোটি টাকা হবে ডরোথি। তুমি মাত্র কুড়ি হাজার টাকায় সেটা পাওয়ার আশা করতে পারো না।
এটা ওঁর কথা, না তুমি আমাকে বলছ?
আমিই বলছি।
দ্যাখো অর্জুন, আমি আশা করছি তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে। ওই মূর্তির জন্যে আমি অনেক খরচ করেছি। তুমি ভেবো না আমি তোমাকে বঞ্চিত করব। তুমি তোমার কমিশন পাবে। এখন ওঁকে বলো পঁচিশ হাজার টাকা আমি দেব। এরকম ভিখিরির মতো অবস্থায় পঁচিশ হাজার পেলে এরা বর্তে যাবেন।
দ্বিতীয়া জিজ্ঞেস করলেন, কী বলছে?
অর্জুন জবাব দিল, পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে পারে।
দ্বিতীয়া স্বামীকে বললেন, অনেক কষ্ট করেছি। আর না। কোথায় রেখেছেন ওই মূর্তিটাকে? আপনি আমাকে কখনও বলেননি, দিদিকে বলেছেন?
পেছনে দাঁড়ানো প্রথমা মাথা নেড়ে না বললেন নীরবে।
দ্বিতীয়া এখন রুখে দাঁড়িয়েছেন, তা হলে দেখুন কী রকম মানুষ আপনি। এই বয়সেও গতর খাটিয়ে খাচ্ছি আর আপনি গুপ্তধন মাটিতে পুঁতে বসে আছেন। ফট করে মরে গেলে আমরা জানতেই পারব না ওটার কথা। আমাদের একটু ভাল থাকতে আপনি দেবেন না?
বৃদ্ধ মাথা নিচু করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কালোর মধ্যে লাল আর লালের মধ্যে কালো/ভক্তিভরে তারে নমো করাই ভাল। চিতায় পা দিয়ে বসে আছি, এখন টাকা নিয়ে কী করব? অ্যাাঁ?
অর্জুন কথাটা অনুবাদ করে ডরোথিকে শোনাতেই ডরোথি ব্যাগ খুলে কয়েকটা একশো টাকার নোট বের করে দ্বিতীয়া বৃদ্ধার কাছে এগিয়ে গেল, প্লিজ, ওকে রাজি করাও।
দ্বিতীয় বৃদ্ধা ইংরেজি বুঝতে না পারলেও বেশ অনুমান করলেন ডরোথি কী বলতে চাইছে। কাঁপা হাতে টাকাগুলো নিয়ে তিনি স্বামীর কাছে ছুটে গেলেন, এই দ্যাখো টাকা, আগাম দিয়েছে। বলো, কোথায় রেখেছ মূর্তিটাকে?
তারিণী সেন মাথা নাড়তে-নাড়তে বললেন, ভুলে গেছি।
মিথ্যে কথা! তুমি ভুলে যাওয়ার লোক নও। ওই হেঁয়ালিটা প্রায়ই শোনাও। তোমাকে বলতেই হবে কোথায় রেখেছ।
বললাম তো, ভুলে গেছি।
আবার মিথ্যে কথা! রাজ্যের গল্প তোমার মনে আছে আর এটা ভুলে গেছ?
অর্জুন উঠল। সে দেখল ইতিমধ্যে উঠোনে ভিড় জমে গেছে। গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। তারিণী সেনের কাছে একটা মূর্তি আছে যার দাম অনেক। পঁচিশ হাজার দাম দিচ্ছে মেমসাহেব। এত টাকা পাওয়া যেতে পারে, এই গ্রামের মানুষ ভাবতেই পারে না! তারিণী সেনের সৌভাগ্যে তাদের মনে ঈর্ষা বাড়ছে। অর্জুন বলল, আপনি চিন্তা করে দেখুন। আমরা নাহয় কাল আসব।
তারিণী সেন মাথা নাড়লেন ৷ ঃশব্দে। অর্জুনের মনে হচ্ছিল, বৃদ্ধ পুরো ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছেন। কিন্তু ওঁর ওপর যে অর্থনৈতিক চাপ, তাতে এখন মূর্তির হদিশ বলে না দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। ওরা মন্দিরের সামনে ফিরে এল। ইতিমধ্যে জনতার আকার বেড়ে গেছে। একজন এগিয়ে এসে বলল, আমার কাছে ছোট-ছোট কিছু মূর্তি আছে। কিনবেন?
ডরোথি জানতে চাইলে অর্জুন অনুবাদ করে শুনিয়ে দিল।
কী ধরনের মূর্তি?
পাথরের। আসুন না।
অর্জুন তাকে বোঝাল, না ভাই। উনি বিশেষ একটা মূর্তির জন্যে এসেছেন, যে-কোনও মূর্তি কেনার বাসনা ওঁর নেই। কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। মূর্তি সে দেখাবেই। অর্জুনরা যাচ্ছে না দেখে সে একজনকে দিয়ে বাড়ি থেকে আনিয়ে নিল মূর্তিটা। অর্জুন দেখল চার ইঞ্চিটাক একটি মানুষের অবয়ব পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। ডরোথি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে বলল, এর জন্যে আমি বড়জোর পঞ্চাশ টাকা দিতে পারি।
লোকটি ছোঁ মেরে ফিরিয়ে নিল, মামার বাড়ি! না দেখা মূর্তির জন্যে পঁচিশ হাজার, আর আমার জিনিস দেখে মাত্র পঞ্চাশ?
ডরোথি কিনবে না, আর লোকটি বিক্রি করবেই। এই সময় ডাক্তারবাবু এসে উদ্ধার করলেন ওদের। একটু ফাঁকায় সরিয়ে নিয়ে বললেন, কী শুনছি মশাই! পঁচিশ হাজার…।
ঠিকই শুনেছেন। তারিণীবাবুর মাথা এখনও ঠিক কী করে আছে জানি না!
দিয়ে দিক। বাকি কটা দিন খেয়ে-পরে বাঁচবে তা হলে!
আপনি একথা বলছেন?
দেখুন, আমরা বাধা দিলে ওঁর তো কোনও উপকার হবে না। মূর্তি উদ্ধার হলে সরকার নিয়ে নেবে। হয়তো একটা নামমাত্র মূল্য দিতে পারে। তাও সেই টাকা উনি জীবিত অবস্থায় পাবেন কি না সন্দেহ। তার চেয়ে দিয়েই দিক।
কিন্তু আমাদের দেশের কোনও অমূল্য সম্পদ বিদেশে চলে যাবে?
এখন যে ওটা দেশে আছে তা আপনি কি জানেন? এতকাল যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেখানেই তো চিরকাল থেকে যেতে পারত, ওই মেমসাহেব না এলে?
অর্জুন মন্দিরটার দিকে তাকাল। ডাক্তারবাবু যা বলছেন তাতে নিশ্চয়ই যুক্তি আছে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা লুকোচুরি আছে। এইটে কিছুতেই মেনে নেওয়া যেতে পারে না। অর্জুন অন্যমনস্ক হয়ে মন্দিরটাকে দেখছিল। ডাক্তারবাবু এখন ডরোথির সঙ্গে কথা বলছেন। বিকেল ঘন হয়ে এসেছে। পদ্মদিঘির পানায় এখন ঘন ছায়া। চোখ তুলতেই লাল মন্দিরটা নজরে এল। ছোটখাটো মন্দির। সে ধীরে ধীরে মন্দিরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেই গাইড হতে-চাওয়া লোকটি এসে বলল, এখন এই লাল মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ আছে। বেশিদিনের পুরনো না।
মন্দিরটার রং লাল কেন?
জানি না বাবু। এটার কথা কেউ ভাবে না। আমাদের বড় মন্দিরই আসল মন্দির।
অর্জুন উঁকি মেরে শিবলিঙ্গ দেখতে পেল। কালো পাথরের গায়ে কেউ সাদা দাগ এঁকে রেখেছে মাহাত্ম্য বাড়াতে। সে জিজ্ঞেস করল, এখানে পুজো হয় না?
জল-বেলপাতা পড়ে। তবে শিবরাত্রির দিন ঘটা করে হয়।
সন্ধে হয়ে আসছিল। অর্জুন ডরোথিকে নিয়ে বাইকে উঠল। মিনিট কুড়ির মধ্যে ওরা তিস্তা ব্রিজে পৌঁছে গেল। চমৎকার সূর্যাস্ত হয়ে চলেছে তিস্তার বুকে। বাইক থামিয়ে ওরা রেলিঙের ধারে চলে এল। তিস্তায় এখন শীর্ণ জলের ধারা। আকাশে নানা রঙের মাখামাখি চলছে।
হঠাৎ ডরোথি বলল, আমি খুব দুঃখিত, কিন্তু তোমার কাছে মিথ্যে না বলে উপায় ছিল না!
অর্জুন হাসল, কিন্তু কিছু বলল না।
ডরোথি বলল, আমি মূর্তি নিয়ে যাওয়ার জন্যে এসেছি এটা তোমাদের সরকার মেনে নেবে না তা এর আগের বার দিল্লিতে এসে জেনেছিলাম। অতএব এই কথাটা আমি প্রকাশ্যে বলতে পারব না। তোমাকেও বলিনি।
মূর্তিটার কথা তোমার দাদু ডায়েরিতে লিখেছিলেন?
হ্যাঁ। তারিণী সেন ছাড়া ওই দুজন বিপ্লবীর নামও ছিল ডায়েরিতে। দাদুর ধারণা ছিল তারিণী সেনের সঙ্গে কমলাকান্ত রায়ের যোগাযোগ আছে। মূর্তিটা কমলাকান্ত রায়কে লোকটা দিয়ে দিতে পারে। পরে বুঝেছিলাম, ভাবনাটা ভুল।
ভুল কেন?
ওঁর কাছে খবর এসেছিল কমলকান্ত রায় মূর্তিটার কথা জানেনই না।
বেশ। এ-দেশে একটি মূর্তির কথা তোমার দাদু জেনেছিলেন। মূর্তিটা তাঁরও নয়। তবু এত বছর পরে সেটা পাওয়ার জন্যে তুমি মরিয়া হলে কেন?
আমি বাধ্য হয়েছি।
তার মানে?
আট মাস আগে আমার বাড়িতে হামলা হয়েছিল। আমরা তখন বাড়িতে ছিলাম না। ফিরে এসে দেখি সমস্ত জিনিসপত্র তছনছ করে কিছু খোঁজা হয়েছে। পুলিশকে জানিয়েছিল। তারাও কোনও হদিশ করতে পারল না। এরপর ফোন পেলাম। তখনই জানলাম মূর্তিটার কথা। তার আগে আমি কখনও দাদুর ডায়েরি পড়িনি, ইচ্ছেও হয়নি।
কার ফোন পেয়েছিলে?
লোকটা তিব্বতি। যে তিব্বতিদের ওপর তারিণী সেন ডাকাতি করেছিল, ও তাদের বংশধর। শুধু ও না, তিব্বতীদের একটা সংগঠন ওই মূর্তি ফেরত চায়। ওদের ধারণা, আমার দাদু ওটা ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছেন। আমি ব্যাপারটা জানি না বললে ওরা বিশ্বাস করেনি। আমার ওপর সমানে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের কাছে গেলে ওরা আরও মারাত্মক হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ওরা আমার বাড়িতে আসা-যাওয়া আরম্ভ করল। আমি ওদের দাদুর লেখা ডায়েরি দেখালাম। ওরা সেই সময়ের একটা খবরের কাগজ এনে আমাকে দেখাল, যাতে দাদুর ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে। দাদু বলেছেন এক হাজার পাউন্ড পেলে মূর্তিটা তিনি বিক্রি করতে রাজি আছেন। কাগজটি অবাক হয়ে লিখেছিল, মিস্টার রিচার্ড ম্যাকডোনান্ড কী এমন জিনিসের মালিক হয়েছেন জানা নেই, তবে এক হাজার পাউন্ড মূল্য জিনিসটিকে আরও মূল্যবান করে দিয়েছে। তিব্বতিরা বলল, ওই কাগজের ইন্টারভিউ প্রমাণ করছে দাদু মূর্তিটা পেয়ে গিয়েছিলেন। আমি ফাঁপরে পড়ি। আমার পূর্বপুরুষের দায় মেটানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। গত বার দিল্লিতে এসে খোঁজখবর নিলাম। ওদের একজন লোক আমাকে সাহায্য করল। ওরা চাইছে আমি সব করি, কারণ মূর্তিটা যে আমার কাছে নেই, সেটা আমাকেই প্রমাণ করতে হবে।
তার মানে তারিণী সেন মুর্তিটা দিয়ে দিলে তুমি তিব্বতিদের সেটা ফিরিয়ে দেবে?
হ্যাঁ। ঠিক তাই।
গতরাত্রে তুমি যাদের সঙ্গে গ্রামে যেতে চেয়েছিলে, তারা কে?
ডরোথি একটু অবাক হল! কিন্তু সেটা সহজেই কাটিয়ে উঠে বলল, ওদের একজনের বাবা তিব্বতি মা ব্রিটিশ। আর-একজন বাঙালি। বাঙালি লোকটি শিলিগুড়িতে থাকে, আর প্রথমজন আমার সঙ্গে এসেছে। এয়ারপোর্টে তুমি বুঝতে পারোনি।
অমল সোমের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছিল?
হ্যাঁ। ওই তিব্বতিরাই আলাপ করিয়ে দেয়। একজন বিদেশির পক্ষে এত বছর পরে তারিণী সেনকে খুঁজে বের করা মুশকিল। আমরা পুলিশকেও জানাতে চাইনি। এই শহরে তুমি প্রাইভেট গোয়েন্দাগিরি করো। তোমাকে মিস্টার সোম অনুরোধ করলে তুমি কিছুতেই না বলবে না, এটা ওরা জেনেছিল।
অর্থাৎ আমার সব কিছুই তুমি জানো?
কিছুটা। তাই তোমার সঙ্গে অভিনয় করতে হচ্ছে।
এখন তো তারিণী সেনকে পেয়ে গেছ। তিব্বতিদের বলছ না কেন ওর কাছে গিয়ে মূর্তিটা নিয়ে নিতে। তারিণী সেন তো স্বীকার করেছে ওর কাছেই আছে।
ওরা তাই করবে। কিন্তু আমি চাইনি, ওরা তারিণী সেনের ওপর অত্যাচার করুক। মানুষটি কী গরিব! আমার দাদু ওর ওপর যে অত্যাচার করেছেন, তা নিজের চোখেই দেখেছি। আমার মনে হয়েছে অন্তত পঁচিশ হাজার টাকা দিলে ও যদি ভালভাবে থাকে তাহলে দাদুর পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি।
মুর্তিটার জন্যে তিব্বতীরা এত বছর পরে সক্রিয় হল কেন?
ওরা নাকি দীর্ঘদিন ধরে সন্ধান চালিয়েছে। ওই মূর্তি ওদের সৌভাগ্যের প্রতীক। শেষ পর্যন্ত ওরা আমার দাদুর দেওয়া ইন্টারভিউ পড়ে আমার কাছে আসে।
অর্জুন চুপচাপ শুনল। ডরোথির কথা বিশ্বাস করবে কিনা সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। সে চুপচাপ বাইক চালিয়ে ডরোথিকে তিস্তা ভবনে পৌঁছে দিল। বাইক থেকে নেমে ডরোথি জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু বললে না?
না। আমার মনে হয় তুমি আগামীকাল বন্ধুদের সঙ্গে ফিরে যেতে পারো। সেক্ষেত্রে আমার সাহায্য আর দরকার হবে না। আজ রাত্রেই তো তোমার বন্ধুরা জেনে যাবে, তারিণী সেনের কাছে মুর্তিটা আছে। কিন্তু লোকটার যদি কোনও ক্ষতি হয়, তা হলে আমি চুপ করে বসে থাকব না। ডরোথি কোনও জবাব দিল না। অর্জুন ওকে চুপচাপ দাঁড় করিয়ে রেখে বাইকে স্পিড তুলল।
থানায় পৌঁছে দেখল অবনীবাবু জিপে উঠতে যাচ্ছেন। ওকে দেখে বললেন, ফিরে এলেন? ঠিক বিকেলবেলায় মিনিস্টার এসে হাজির। ইচ্ছে থাকলেও বেরোতে পারলাম না!
মিনিস্টার আছেন না গেছেন?
আছেন। সার্কিট হাউসে। কিন্তু এখন আমি ফ্রি।
আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
ভেতরে ঢুকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল অর্জুন। ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, অসম্ভব। জিনিসটা যে তিব্বতিদের, তা ওদের প্রমাণ দিতে হবে। দেশের আইন মেনে ওদের আবেদন করতে হবে, যদি ওটা ধর্মীয় মূর্তি হয়। এভাবে নিয়ে যেতে পারে না এবং দেব না।
দেবেন না ঠিক, কিন্তু আপনার কাছে থাকলে তো ওই প্রশ্ন উঠছে।
তারিণী সেন তা পঁচিশ হাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে?
এখনও রাজি হয়নি।
তা হলে ওঁকে গিয়ে বলা যাক মূর্তিটার হদিশ দিতে।
যে-মানুষ টাকার বিনিময়ে এ র দেয়নি, সে পুলিশের ধমকে দেবে—এটা বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
আশ্চর্য! আরে, হাজার হোক জিনিসটা তো ডাকাতি করে পাওয়া। ডাকাতির জিনিস তো ইললিগ্যাল জিনিস। সেটা লুকিয়ে রাখা তো অবৈধ ব্যাপার। এটা বুঝিয়ে বলব।
পঞ্চাশ বছর লুকিয়ে রাখলে সেটা আর অবৈধ কতখানি থাকে তা জানি না। এদেশ থেকে কয়েক শো বছর আগে হিরে-মানিক ডাকাতি করে বিদেশিরা নিয়ে গিয়েছিল। তার একটাও ফেরত পেয়েছি কি আমরা? ওভাবে হবে না। আমার খুব ভয় হচ্ছে তারিণী সেন রাজি না হলে ওরা ওঁর ওপর অত্যাচার করবেই। এত দূরে যারা এত বছর পরে আসতে পারে, তারা কিছুতেই হার মানবে না। ওঁকে প্রোটেক্ট করা উচিত।
ঠিক আছে, আমি ময়নাগুড়ি থানাকে অনুরোধ করছি যাতে ওঁর বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা দেয়। এস.পি সাহেবের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। অবনীবাবু ফোন তুললেন।