সভায় সিদ্ধান্ত হল
সভায় সিদ্ধান্ত হল গাঁয়ের লোকেরা চার-পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে চারদিকে লোক দুটোকে খুঁজে বেড়াবে। সেইসঙ্গে সারা রাত গাঁ পাহারাও দেবে। এসব কাজে সত্যগোপাল সর্বদাই নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। কে কোন দলে থাকবে তাও সে ঠিক করে দিল। তাই নিয়ে অবশ্য খানিক গণ্ডগোল হল। যেমন ছকু দাসের সঙ্গে কালীপদর ঝগড়া, তাই কালীপদ ছকুর দলে যেতে নারাজ। মনোরঞ্জন কম্পাউন্ডারের গোরুকে বিশু পাল খোঁয়াড়ে দিয়েছিল বলে মনোরঞ্জন বিশু পালের দলে যেতে রাজি নয়। তার বাবার অসুখ হওয়ায় হারাধন প্রভঞ্জন ডাক্তারকে ডাকতে গিয়েছিল, কিন্তু প্রভঞ্জন তবু তাকে ইনজেকশন দিয়েছিল বলে হারাধনের রাগ এখনও যায়নি, তাই ডাক্তারবাবুর দলে সে গেল না। ইত্যাদি।
বিষ্ণুরাম বলল, “দেখুন, আমিই হলাম এখানে সরকারের প্রতিনিধি। আইন শৃঙ্খলার কর্তা, সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমিই ময়নাগড়ের সরকার। আমার ওপর বিরাট দায়িত্ব। আমি আক্রান্ত হওয়া মানে সরকার আক্রান্ত হওয়া। আমার পতনের মানে সরকারের পতন। আমার ধরাশায়ী হওয়া মানে সরকারের ধরাশায়ী হওয়া। সুতরাং আমাকে খাড়া থাকতে হবে। সুস্থ ও নিরাপদ থাকতে হবে। আমার ভাল থাকা মানে সরকারের ভাল থাকা। তাই আমি বাড়ি যাচ্ছি। কোনও বিপদ ঘটলে আপনারা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করবেন। জানবেন, আমি অর্থাৎ সরকার আপনাদের পিছনেই আছি।” ইত্যাদি।
হ্যাজাক, লণ্ঠন, টর্চ ইত্যাদি নিয়ে দলে দলে লোক বেরিয়ে পড়ল। কারও হাতে লাঠি, কারও বা দা, কারও হাতে কুড়ুল বা শাবল। যে যা অস্ত্র পেয়েছে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। পঞ্চাননের হাতে ঝটা দেখে গঙ্গারাম প্রশ্ন তোলায় পঞ্চানন বলল, “ঝাটাটাকে তুচ্ছ ভেবো না ভাই, আমার গিন্নির হাতে এই ঝাঁটার কেরামতি তো দ্যাখোনি। আমার বিশ্বাস ঝাঁটা দিয়ে সে বাঘও মারতে পারে।”
গঙ্গারাম রায়ের বাড়ির দাওয়ায় দুটো লোক মাদুর পেতে ঘুমোচ্ছিল। বিশু পালের দল তাদের দেখতে পেয়েই পা টিপে টিপে গিয়ে ঘিরে ফেলল। টর্চ ফোকাস করে দেখা গেল, তারা কেউ গাঁয়ের চেনা লোক নয়। সঙ্গে সঙ্গে বিশুর দল লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। লোক দুটো আচমকা হামলায় উঠে হাউরেমাউরে চিৎকার।
গঙ্গারাম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলল, “করো কী, কয়রা কী তোমরা! ওঁরা যে আমার পিসেমশাই আর মেলোমশাই! বুড়ো মানুষ ঘরে গরম হচ্ছিল বলে বারান্দায় শুয়েছেন।”
বিশু পাল অপ্রস্তুত হলেও মারমুখো ভাবটা বজায় রেখেই বলল, “পিসেমশাই আর মেসোমশাই বললেই তো হবে না। প্রমাণ কী?”
এই সময়ে গঙ্গারামের পিসি আর মাসি একজন হাতে রুটি বেলার বেলুন, আর একজন ঘাস কাটার হেঁসো নিয়ে বেরিয়ে এসে সপ্তমস্বরে চেঁচাতে লাগল, “প্রমাণ! দেখাচ্ছি তোমার প্রমাণ। হতভাগা, বোম্বেটে, গুণ্ডা, আজ তোদেরই একদিন কি আমারই একদিন…।”
অগত্যা বিশু পাল আর তার দলবলকে পিছু হটতে হল।
নয়নচাঁদের বারান্দায় একটা লোক বসে বসে গুনগুন করে রামপ্রসাদী ভাঁজছিল। রাখাল মোদকের দল গিয়ে যখন তাকে পেড়ে ফেলল তখন লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি যে নয়নবাবুর মেজোজামাই। গোবিন্দপুরে বিরিঞ্চি মহাজনের গদিতে বিষয়কর্মে আসা। ফিরতে রাত হয়ে গেল বলে শ্বশুরবাড়িতে রাতটা কাটাতে এসেছি। এসে দেখি ঘর তালাবন্ধ। বাড়িসুষ্ঠু তোক নাকি পাশের গাঁয়ে যাত্রা শুনতে গেছে। তাই বসে আছি মশাইরা, আমি চোর ডাকাত নই।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা, সবাই এই মারে, কি সেই মারে।
লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “গণ্ডগ্রামের কথা শুনেছি মশাই, কিন্তু গুণ্ডাগ্রামের কথা জানা ছিল না। এই নাক মলছি, কান মলছি, জীবনে আর কখনও শ্বশুরবাড়িমুখো হব না।”
গোলমাল শুনে পাশের বাড়ি থেকে পাঁচকড়ি নস্কর বেরিয়ে এসে বলল, “তোমাদের আক্কেলখানা কী হে, এই তো সেদিন নয়নচাঁদের মেজো মেয়ের বিয়েতে এসে তোমরা গাঁসুদু লোক গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে গেলে। ওই রাখাল বিশ্বাস বাইশখানা মাছ খেয়েছে, এই কালীপদ সেদিন একান্নটা রসগোল্লা সাঁটিয়েছিল, আর ওই যে সত্যগোপালের চেলা প্যাংলাচরণ এখন মুখ লুকোচ্ছে, এটি অন্তত সেরটাক খাসির মাংস গিলেছিল। যার বিয়ের ভোজে কাছা খুলে খেয়েছিলে আজ তাকে দেখেও চিনতে পারছ না, নেমকহারাম আর কাকে বলে!”
রাখাল মোদক আমতা আমতা করে বলল, “জানোই তো ভাই, আমি বোকাসোকা মানুষ। একটা ভুল হয়েছে, মাপ করে দাও।”
পাঁচকড়ি হেঁকে বলল, “যে গাঁয়ে জামাইয়ের হেনস্থা হয় সে গাঁয়ে আর কোনও জামাই আসতে চাইবে? এ যা করলে তোমরা, এরপরে এ গাঁয়ের মেয়ে বিয়ে করতেও আর কোনও জামাই বাবাজীবনের আগমন ঘটবে না। কী সর্বনাশটা হবে একবার ভেবে দেখো। ঘরে ঘরে আইবুড়ো মেয়েরা বসে বসে বুড়ি হয়ে যাবে।”
ভয় পেয়ে সবাই মিলে নয়নচাঁদের জামাইকে তাড়াতাড়ি খুব খাতিরটাতির করে রাখালের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভোজের আয়োজন করে ফেলল। নরম বিছানাটিছানা পেতে দিল।
ভজুরাম আর গজুরাম নয়াগঞ্জের মাড়োয়াড়ি মহাজনের পাইক। তিন গাঁ ঘুরে তাগাদা সেরে রাতের দিকে ময়নাগড়ের বাঁশবনের পাশ ঘেঁষেই দুই পালোয়ান ফিরছিল। এমন সময় রে রে করে ডাক্তার প্রভঞ্জনের দলবল তাদের ওপর গিয়ে চড়াও হল। ব্রজ কবরেজ চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই দুজনই তো! ঠিক চিনেছি।” হোমিও নগেনও দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “হুবহু সেই মুখ, সেই চোখ।”
সবাই মারমার করে যখন ঘিরে ফেলল তাদের তখন দু’জনে খানিক অবাক হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল। ভজুরাম বলল, “এ হো গজুয়া, ইন লোক ক্যা কহতানি রে?”
“মালুম নেহি ভাই। এক এক কো উঠাকে পটক দে।”
প্রভঞ্জন দুজনের রোখাভাব আর বিশাল চেহারা দেখে গম্ভীর গলায় বলল, “না, না, এরা নয়। তোমাদের ভুল হয়েছে।”
ব্রজ কোবরেজও সায় দিল, “না, এরা তো তেমন খারাপ লোক বলে মনে হচ্ছে না। হ্যারিকেনের আলোতে ভাল বোঝা যাচ্ছিল না বটে।”
নগেন মিনমিন করে বলল, “আমিও তো পইপই করে বলেছিলাম এরা হতেই পারে না। তারা ছিল অন্যরকম লোক।”
ভজুরাম আর গজুরাম হেলতে দুলতে চলে গেল।
.
কাঁঠালতলার ভূতটাকে দেখার পর থেকেই শ্রীনিবাস একটু গুম মেরে গেছে। ওস্তাদের মুখচোখের ভাব দেখে পরাণ তাকে বেশি ঘাঁটাচ্ছে না। ওস্তাদ মানুষেরা যখন চুপ মেরে থাকে তখন তাদের মাথায় নানা ভাল ভাল মতলবের খেলা চলতে থাকে। অনেকটা রান্নাবান্নার মতোই। গরম তেলে ফোড়ন পড়ল, মশলা পড়ল, তারপর ব্যাঞ্জন কি মাছ কি মাংস জারানো হতে লাগল। সব মিলে মিশে যে জিনিসটা বেরিয়ে এল সেটাই আসল।
ওস্তাদের সঙ্গে কয়েকদিন থেকে পরাণ নিজের খামতিগুলো আরও বেশি টের পাচ্ছে। এই যে ওস্তাদ কাঁঠালতলায় ভূতটাকে দেখতে পেল, কিন্তু সে পেল না। তার মানে পরাণের চোখ এখনও তৈরি হয়নি। তৃতীয় নয়ন না থাকলে হবেই বা কী করে? রাতবিরেতে সে তো আলায় বালায় ঘোরে, ভূতবাবাজিরা কি আর তখন হাঁটাহাঁটি করে না? কিন্তু ওই তিন নম্বর চোখটার অভাবে আজ অবধি তাদের কারও দেখাই পেল না সে। তার যা কাজ তাতে এক-আধজন ভূতপ্রেত হাতে থাকলে সুলুক সন্ধান পেতেও সুবিধে হয়।
নিজের অযোগ্যতার জন্য ভারী মনমরা হয়ে থাকতে হয় পরাণকে। নয়নতারার গঞ্জনায় জীবন আরও অতিষ্ঠ। তার কপালদোষে নয়নতারা আবার ষষ্ঠী গুণের মেয়ে। সেই ষষ্ঠী গুণ, ঝিকুড়গাছার আশপাশের দশটা গাঁয়ের চোর বাটপাড়েরা যার নাম শুনলে হাতজোড় করে কপালে ঠেকায়, গুণীর মেয়ে তো, তাই তাকে চোর বলেই গণ্য করে না। কথা উঠলে বলে, “তুমি তো এখনও চুরিতে হামাদেওয়া শিশু।”
ষষ্ঠী গুণের মেয়ের কাছে নিত্যি হেনস্তা হতে হচ্ছে বলে একদিন সে নিজের বাজারদরটা যাচাই করতে পুলিশের ইনফর্মার নবুদাদার কাছে গিয়েছিল। পরগনার সমস্ত চোরছ্যাঁচড়ার খবর নবুদাদার নখদর্পণে। গিয়ে পেন্নাম করে বলল, “নবুদাদা, পুলিশের খাতায় কি আমার নামে খারাপ কিছু লেখা আছে? মানে কেউ নালিশটালিশ কিছু করে রেখেছে কি না তাই জানতেই আসা।”
নবু ভারী অবাক হয়ে বলল, “কেন রে, তোর নামে নালিশ করবে কেন? কী করেছিস তুই?”
ঘাড়টাড় চুলকে ভারী লজ্জার সঙ্গে পরাণ বলল, “ওই রাতবিরেতে কাজকর্ম আর কী?”
নবু আরও অবাক হয়ে বলে, “চোর নাকি তুই!”
“যে আজ্ঞে।”
“নামটা বল তো, লিস্টিটা দেখি।”
“আজ্ঞে পরাণ দাস।” নবু একখানা লম্বা খাতা বের করে ভ্রু কুঁচকে বিড় বিড় করে বলতে লাগল, “বদন মণ্ডল, পাঁচু গড়াই, গেনু হালদার, খগেন দুলে… দাঁড়া প-এর পাতাটা দেখি। এই তো পবন সাঁতরা, পতিতপাবন কোঙার, পীতাম্বর দাস… নাঃ, পরাণ দাসের নাম তো নেই।”
ভারী হতাশ হয়ে পরাণ বলল, “নেই?”
“না। চুরি করিস অথচ আমার খাতায় নাম ওঠেনি এ আবার কেমন ব্যাপার! তা কী চুরি করিস বল তো! বড় কাজটাজ কিছু করেছিস?”
পরাণ ভারী লাজুক মুখে ঘাড় হেঁট করে বলল, “নিজের মুখে কী আর বলব। গত মাসে রায়বাড়ি থেকে কিছু বাসনপত্র সরিয়েছিলাম, সপ্তাহ দুয়েক আগে ঘোষবাড়িতে সিঁদ দিয়ে চারখানা শাড়ি, তিনটে ধুতি আর একটা পেতলের গামলা পাই। গেল হপ্তায় মদন ময়রার দোকানে ক্যাশবাক্স ভেঙে তিপ্পান্ন টাকা ষাট পয়সা আর দু’হাঁড়ি দই রোজগার হয়। দিন তিনেক আগে–”
নবু নাক সিঁটকে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তাই বল! তুই এখনও শিক্ষানবিশ! সেইজন্যই আমার লিস্টিতে নাম ওঠেনি। তার জন্য মন খারাপ করিসনি, মন দিয়ে কাজ কর। নিষ্ঠা থাকলে, পরিশ্রম করলে নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে থাকলে একদিন উন্নতি হবেই, দেখে নিস। চরিত্র চাই রে, চরিত্র চাই। মনটাকে শক্ত করে লেগে যা।”
নবুদাদার কাছে ও কথা শোনার পর মরমে মরে ছিল পরাণ। এখন শ্রীনিবাস চূড়ামণির দেখা পাওয়ার পর মেঘলা আকাশে যেন সূর্যের মুখ উকিঝুঁকি মারছে। আবার গগনে যেন সুধাংশু উদয় রে।
মিটিং ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ। গাঁয়ের লোকেরা সব লাঠিসোঁটা নিয়ে গ্রাম টহল দিতে বেরিয়ে পড়েছে। অন্ধকার মাঠের একটা কোণে তবু গুম হয়ে বসে আছে শ্রীনিবাস চূড়ামণি। পাশে বশংবদ পরাণ। বারকয়েক ডেকেও সাড়া না পাওয়ায় পরাণও এখন চুপ মেরে গেছে। মাঝে-মাঝে শুধু চটাস-পটাস করে মশা মারছে। সে বুঝতে পারছে চূড়ামণির এখন ধ্যানস্থ অবস্থা। এই ধ্যানটা অনেকটা ডিমে তা দেওয়ার মতো। তারপর একসময়ে ধ্যানের ডিমটা ফেটে ফন্দিফিকির পিল পিল করে বেরিয়ে আসবে।
বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকার পর শ্রীনিবাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “চল।”
“যে আজ্ঞে!” বলে উঠে পড়ল পরাণ, হ্যাঁ, এইবার ডিম ফেটেছে বলেই মনে হচ্ছে। সে সোৎসাহে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যেতে হবে ওস্তাদ?”
“কেন, তোর বাড়িতে! গরম ভাতে একটু কাঁচালঙ্কা ডলে লাউশোস্ত খেয়েছিস কখনও? ওরে, সে জিনিস মুখে দিলে মনে হবে অমরাবতীতে পৌঁছে গেছি।”
পরাণের মুখ শুকিয়ে গেল। সে একটা ঢোক গিলে বলল, “আপনি কি এতক্ষণ গুম হয়ে বসে লাউপোন্তর কথা ভাবছিলেন নাকি?”
“তা ছাড়া আর ভাববার আছেটা কী?”
“কিন্তু বাঁশিটা যে বদমাশদের হাতে গিয়ে পড়ল তার কী হবে? তারা যে পগার পার হয়ে গেল এতক্ষণ!”
“আহা, গুণ্ডা-বদমাশরা দূরে থাকলেই তো ভাল। তাদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করার দরকারটা কী আমাদের?”
পরাণ উত্তেজিত হয়ে বলল, “কিন্তু ওস্তাদ, বাঁশিটা হাতছাড়া হলে আমাদের আর রইলটা কী? বড় আশায় আশায় ছিলাম, বাঁশিটা পেলে সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে নিশ্চিন্তে কাজকারবার বাগিয়ে নেব। বেশি কিছু নয় ওস্তাদ, একখানা পাকা দোতলা বাড়ি, পনের-বিশ বিঘে ধানী জমি, দুটো দুধেল গাই, বউয়ের গায়ে দু চারখানা সোনার গয়না, আর ধরুন আমার একখানা আলপাকার কোট আর সাহেবি টুপির বড় শখ। দজ্জাল বউটার মুখের মতো একখানা জবাব দিতে পারতুম তা হলে। মুখনাড়া দিতে এলেই এক বান্ডিল নোট ছুঁড়ে দিতুম পায়ের কাছে, তা হলেই মুখে কুলুপ। তা সেই আশায় কি লাল সিগন্যাল পড়ে গেল ওস্তাদ? লেভেল ক্রসিং এর গেট কি বন্ধ হয়ে গেল?নটী বিনোদিনীর পার্ট করতে করতে কি হিরোইনের বাঁধানো দাঁত খসে পড়ে গেল? নাকি শ্রীরাধিকার অভিসারের পথে আয়ান ঘোষ গদা ঘোরাতে ঘোরাতে মুলোর মতো দাঁত বের করে বুক চিতিয়ে এসে দাঁড়াল?”
“বলি, বাঁশির জন্য বড় লাতন হয়ে পড়লি যে! বাঁশি গেছে যাক, সেজন্য অত ভাবনা নেই। কিন্তু এখন যে ওই বাঁশি বাজানোর জন্য একজন উপযুক্ত বেঁশোও দরকার, সে খেয়াল আছে তোর?”
একগাল হেসে পরাণ বলে, “বেঁশো মানে বাঁশিয়াল তো! সে মেলাই আছে।”
ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে শ্রীনিবাস বলে, “ও বাঁশি বাজানোর এলেম মাত্র একটি লোকেরই আছে। বুড়ো মানুষ রে। এখন তার খোঁজ হবে। আর বুড়ো বয়সের দোষ কী জানিস?”
“কী ওস্তাদ?”
“বুড়ো বয়সে মানুষের প্রাণের মায়া বাড়ে, ভয় বাড়ে, মনের জোর কমে যায়।”
“আজ্ঞে, তা আর জানি না! বুড়ো বয়সে বাতব্যাধি বাড়ে, খাই-খাই বাড়ে, বাইবাতিক বাড়ে, আক্কেল কমে যায়।”
“তাই তো বলছি রে, বাঁশি লোপাট হওয়ার মানে বুড়োটার বিপদ বাড়ল। এখন গুণ্ডা দুটো যদি তাকে খুঁজে বের করে চড়াও হয় তা হলে কি সে ঠেকাতে পারবে? ধর যদি গলায় ছোরা বাগিয়ে ধরে তবে হয়তো বাঁশি বাজানোর কায়দাকানুন শিখিয়েই দিল ভয় খেয়ে।”
পরাণ ফের উত্তেজিত হয়ে বলে, “তা হলে তো সাড়ে সর্বনাশ! ওস্তাদ, তাকে তো এখনই হুঁশিয়ার করা দরকার।”
মাথা নেড়ে শ্রীনিবাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “হুঁশিয়ার করেই বা লাভ কী বল! তার কি আর পালানোর জায়গা আছে!”
পরাণ শ্রীনিবাসের এই হালছাড়া ভাব দেখে মোটেই খুশি হল না। বলল, “কিন্তু একটা কিছু তো করা দরকার ওস্তাদ।”
“তাই তো করছি।”
“কী করছেন ওস্তাদ? মাথায় ফন্দি এল কিছু?”
“এল বইকী। ফন্দিটা এখন বঁড়শির টোপে ঠোকরাচ্ছে। একটু খেলিয়ে তুলতে হবে। সেইজন্যই তো গরম ভাত দিয়ে কাঁচা লঙ্কা টেসে লাউপোস্তটা খাওয়া দরকার। তা হলেই দেখবি ফন্দিটা কপ করে টোপ গিলে লেজ নাড়তে নাড়তে উঠে এসেছে।”
“কিন্তু বুড়োটা কে ওস্তাদ?”
“আছে রে আছে। ধারেকাছেই আছে। কিন্তু সবার আগে লাউপোস্ত।”
পরাণ কাহিল হয়ে হাল ছেড়ে বলল, “তবে লাউশোস্তই হোক।” কিন্তু খেতে বসেও ভারী আনমনা রইল শ্রীনিবাস। যেমনটা খাওয়ার কথা তেমনটা খেল না। পাতে খানিক ফেলে গম্ভীর মুখে উঠে পড়ল। মাদুরে শোওয়ার পর পরাণ তার গা-হাত খানিক দাবিয়ে দিয়ে নিজেও মাদুরের একধারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় খুট খুট শব্দ। চাপা গলায় কে যেন ডাকল, “শ্রীনিবাস! ও শ্রীনিবাস!”
অভ্যাসবশে পরাণ চট করে হামাগুড়ি দিয়ে মাচার নীচে ঢুকে যাচ্ছিল। শ্রীনিবাস তার কাছা টেনে ধরে একটা হাই তুলে বলল, “ভয় নেই। দরজাটা খুলে দে।”
আতঙ্কিত পরাণ বলে, “দেব? তারা নয়তো!”
“বুড়ো বয়সের দোষ কী জানিস?”
পরাণ রেগে গিয়ে বলে, “জানব না কেন? বুড়োরা কানে কম শোনে, চোখে কম দেখে, বুদ্ধি কমে যায়, মাঝরাতে হুট করে দরজা খুলে দেয়।”
এক গাল হেসে শ্রীনিবাস বলে, “তা ঠিক। তবে বুড়োদের পুরনো কথা মনে থাকে। যা দরজাটা খুলে দে। ও আমার পুরনো বন্ধু ইরফান গাজি।”
পরাণ দরজা খুলতেই ইরফান গাজি টুক করে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তার এক হাতে টর্চ অন্য হাতে লাঠি।
শ্রীনিবাস উদাত্ত গলায় বলল, “এসো ইরফান। কতকাল পরে দেখা।”
ইরফান গাজি এসে শ্রীনিবাসের হাত দুটো ধরে ফেলে বলল, “আমার চোখ দুটো এখনও ভাল আছে, বুঝলে? আবছা আলোতে মিটিং-এর এক কোণে তোমাকে বসে থাকতে দেখেই চিনেছি। মনে হল, ও বাঁশি চুরির ব্যাপারের সঙ্গে তোমার একটা যোগ আছে। তাই পাঁচজনের সামনে আর চেনা দিইনি।”
.
দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে একটু হেসে শ্রীনিবাস বলল, “ভালই করেছ। লোকজনের নজরে বেশি না পড়াই ভাল। কিন্তু আমার খোঁজ পেলে কী করে?”
“বদরুদ্দিন নামে আমার একটা চাকর আছে। আসলে সে চাকর সেজে থাকে। খুব সেবা টেবা করে। সে কিন্তু বড়লোকের ছেলে, চাকর সেজে আমার বাড়িতে ঢুকেছে চুরি করে বাঁশি শিখবে বলে। বড়লোকের ছেলের তো নানা খেয়াল হয়, তাই বদরুদ্দিন জীবনে অনেক কিছুই হতে চেয়েছিল। সাপুড়িয়া হবে বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, যাত্রার দলে ভিড়েছিল, চোর হওয়ার জন্য ষষ্ঠী গুণের কাছে তালিম নিয়েছিল।”
পরাণ হাতজোড় করে মাথায় ঠেকিয়ে বলল, “আমার পূজ্যপাদ শ্বশুরমশাই।”
ইরফান বলল, “সেই বদরুদ্দিনকে কাজে লাগাতেই খবর নিয়ে এল। তল্লাটের সব চোরকেই সে চেনে কিনা। তা তোমার ব্যাপারখানা কী বলল তো! বাঁশির সন্ধানে বেরিয়েছ নাকি?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীনিবাস গম্ভীর গলায় বলল, “সে এক লম্বা কাহিনী ভাই। মোহন রায়ের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ নবীন রায়ের কাছে তুমিও কিছুদিন তালিম নিয়েছিলে।”
“তা আর নিইনি! তারপর তো বেনারসের আমানুল্লা খাঁ সাহেবের সঙ্গে সঙ্গ করতে চলে যাই, নবীন বাবার কাছে আর শেখা হল না।”
“আমি কিছুদিন বেশি শিখেছিলুম। নবীন রায় একদিন আমাকে ডেকে বললেন, দেখ শ্রীনিবাস, মোহন রায়ের বাঁশি এক সর্বনেশে জিনিস। বংশপরম্পরায় আমরাই শুধু ও বাঁশি বাজাতে জানি, আর কেউ জানে না। আমার ছেলেপুলে নেই, সুতরাং আমি মরলে পরে ও বিদ্যে লোপ পাবে। কিন্তু মুশকিল কি জানিস, বিদ্যেটা কেবলমাত্র আমিই জানি বলে, আমার মনে হয়, মরার পরও আমার প্রাণটা ওই বাঁশিটার কাছে ঘোরাফেরা করবে, আমার আর মুক্তি হবে না।
মন্ত্রশক্তি জিনিসটা বড় ভয়ংকর। তাই ঠিক করেছি ও বিদ্যে আমি তোকেই শিখিয়ে যাব।”
ইরফান উত্তেজিত হয়ে বলে, “বলো কী হে!”
“আমিও ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ও বাবা, ও আমি শিখব না।’ নবীন রায় বললেন, ‘তোকে ভাল করে জানি বলেই বিশ্বাস করি তুই কোনও অকাজ করবি না। দেখ বাঁশির বিদ্যে কাউকে দিয়ে খালাস হতে না পারলে আমার মুক্তি হবে না। কাউকে শেখাতে পারলেই আমার ছুটি।”
“শিখলে নাকি?”
“হ্যাঁ, রাজবাড়ির মাটির নীচে একটা নিরেট ঘরের সব রন্ধ্র ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে সাতদিন ধরে নিশুত রাতে নবীন রায় আমাকে বাঁশিটা বাজাতে শিখিয়ে দিলেন। শেখানোর সময় আমার কানে তুলো এঁটে দিতেন, যাতে সুরটা কানে না শুনতে পাই। যে বাজায় তার ওপর বাঁশি কোনও ক্রিয়া করে না, কিন্তু যে শোনে তার ক্রিয়া হয়।”
“তারপর?”
“সাতদিন বাদে বাঁশি বাজাতে শিখে গেলাম।”
“তা কী দেখলে, সত্যিই ওসব হয় নাকি?”
“হয়। নবীন রায় প্রতিদিন একটা করে জীবজন্তু নিয়ে গর্ভগৃহে আসতেন। কখনও কুকুর বা বেড়াল, কখনও ছাগলছানা বা বেজি, কখনও বানর বা পোষা পাখি। প্রথম সুরটা শুনলেই ওরা আনন্দে যেন মাতালের মতো হয়ে যেত। দ্বিতীয় সুরে নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ত।”
“আর তৃতীয় সুরে?”
“সেটা বাজালেই ঘরটা যেন দুলে উঠত আর বাইরে থেকে একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ আসত। তিন নম্বর সুরটা অবশ্য খুব অল্প একটু বাজিয়েই বন্ধ করে দিতেন নবীন রায়। লোকে তেমন টের পেত না।”
“তারপর কী হল?”
“বিদ্যেটা শিখিয়ে দিয়ে নবীন রায় ভারী নিশ্চিন্ত হলেন। বেশিদিন বাঁচেননি তারপর। কেতুগড়ের লোক জানল, বিদ্যেটা নবীন রায়ের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে।”
“আহা, থামলে কেন? তারপর কী হল?”। “এই বলছি, একটা লাউপোস্তর ঢেকুর উঠল কিনা। ভাল কিছু খেলে তার ঢেকুরটাও বড় ভাল লাগে, এটা লক্ষ করেছ?”
একগাল হেসে ইরফান গাজি বলে, “তা আর করিনি! এই তো সেদিন ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক রান্না হয়েছিল, কী যে ভাল ভাল ঢেকুর উঠল ভাই, তা আর বলার নয়।”
পরাণ বিরক্ত হয়ে বলল, “একটা গুরুতর কথার মধ্যে কেন যে গুচ্ছের বাজে জিনিস ঢুকে পড়ছে কে জানে বাবা।”
শ্রীনিবাস মিটমিট করে তার দিকে চেয়ে বলল, “বুড়ো বয়সের ওটাও একটা দোষ, বুঝলি? এক কথায় আর এক কথা এসে পড়ে। ধৈর্য হারাসনি বাপ, বলছি নবীন রায় মারা যাওয়ার পর আমি কেতুগড় ছেড়ে কাজকর্মে বেরিয়ে পড়লাম। বাঁশির সঙ্গে আর সম্পর্ক রইল না।”
ইরফান গাজি গলা নামিয়ে বলল, “ভাই, কিছু মনে কোরো না। তোমার যা কাজ তাতে তো বাঁশিটা হলে তোমার খুব সুবিধে হয়ে যেত, তাই না!”
একটা ফুয়ের শব্দ করে শ্রীনিবাস বলল, “লোককে ঘুম পাড়িয়ে চুরি তো, ও তো লোভী আর আনাড়ি লোকের কাজ। যেমন এই পরাণ দাস। এখনও হাত পায়ের আড় ভাঙেনি, কিন্তু আশা ষোলো আনা। আমাকে কি এলেবেলে চোর পেলে নাকি?”
“আরে না না, ছিঃ ছিঃ!” বলে জিভ কেটে কানে হাত দিল ইরফান। তারপর বলল, “তোমাকে কি আজ থেকে চিনি হে? চুরি তুমি করতে বটে, তবে শিল্পকর্ম হিসেবে। ওটা ছিল তোমার মজা। পেটের ধান্দায় কখনও করোনি। যা রোজগার করেছ তার সবটাই গরিব দুঃখীকে বিলিয়ে দিয়েছ। সব জানি। তুমি একটা সাধারণ চোর হলে এই ইরফান গাজি কি রাত দুপুরে ছুটে আসত তোমার কাছে?”
ফের একটু হাসল শ্রীনিবাস। বলল, “বাঁশি আমি আর দুইনি। বিদ্যেটা শিখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু কাজে লাগানোর ইচ্ছেই কখনও হয়নি। তা ছাড়া রাজবাড়ির নুন খেয়েছি, তাদের জিনিস চুরি করে নিমকহারামি করতে পারব না।”
“অতি হক কথা। কিন্তু বাঁশিটা নিয়ে এতদিন বাদে বখেরা বাঁধল কেন?”
‘বাঁধারই কথা। মহানন্দকে তো চেনো?”
“তা চিনব না কেন? নায়েব হরনাথ চৌধুরীর অকালকুণ্ড ছেলেটা তো! খুব চিনি। মহা হারমাদ ছেলে।”
“আমি যখন রিটায়ার হয়ে কেতুগড়ের কাছেই ঘর তুলে বাস করতে লাগলুম তখন মহানন্দ লায়েক হয়েছে। যণ্ডামি গুণ্ডামি করে বেড়ায়। রাজবাড়ির বিস্তর দামি জিনিস চুরি করে বেচে দেয়। রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণ বুড়ো হয়েছেন। এখন নিরানব্বই বছর বয়স। একে নিঃসন্তান, তার ওপর রানিমাও গত হয়েছেন। একমাত্র বুড়ো চাকর হরেকেষ্টই যা দেখাশোনা করে। মহানন্দের দৌরাত্ম্য ঠেকানোর সাধ্য বুড়ো রাজার নেই। এমনিতে দিগিন্দ্রনারায়ণ মানুষ খুব ভাল। কিন্তু তাঁর একটা দোষ কী জানো?”
“রাজারাজড়াদের দোষের অভাব কী?”
“সে দোষের কথা বলছি না। তাঁর শুচিবায়ু আছে, ভূতের ভয় আছে, কিপটেমি আছে, কিন্তু সেসব ধরছি না। যে দোষটা সবচেয়ে গুরুতর, তা হল কোনও গোপন কথা পেটে রাখতে পারেন না। কেউ কোনও গোপন কথা বললেই তাঁর ভীষণ অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। যতক্ষণ না কাউকে বলে দিচ্ছেন, ততক্ষণ পেটে বায়ু জমে ঘন ঘন উষ্মার উঠতে থাকে, ক্ষুধামান্দ্য হয়, রাতে ঘুম হয় না, কেবল পায়চারি করেন আর ঘটি ঘটি জল খান আর বিড় বিড় করতে থাকেন। এই জন্য রানিমা পারতপক্ষে তাঁর কাছে কোনও কথা ভাঙতেন না। তা হয়েছে কী, একদিন ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে হরেকেষ্ট নবীন রায়ের ডায়েরির একখানা পাতা কুড়িয়ে পেয়ে সেটা এনে রাজামশাইকে দেয়। তাতে লেখা ছিল যে, নবীন রায় বাঁশির বিদ্যে আমাকে শিখিয়ে গেছেন। ব্যস, এই খবর জানার পর থেকেই বুড়ো মানুষটার অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। ঢেকুর, পায়চারি, জল, অনিদ্রা, অরুচি, হাই প্রেশার। কাউকে কথাটা না বললেই নয়। একদিন থাকতে না পেরে তাঁর পোষা কাকাতুয়াটাকেই বলে দিলেন, বাঁশির বিদ্যে শ্রীনিবাস জানে। আর হতভাগা কাকাতুয়াটা তারস্বরে সেটা সারাদিন বলতে থাকে। ধূর্ত মহানন্দ আঁচ পেয়ে গিয়ে দিগিন্দ্রনারায়ণের ওপর চড়াও হল। এমনকী তরোয়াল বের করে ভয় দেখাল। দিগিন্দ্রনারায়ণ তখন নবীন রায়ের ডায়েরির পাতাটা তাকে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।”
“এঃ হেঃ, তা হলে তো বিপদ হল হে!”
“বিপদ তো হলই। তবে রাজামশাইয়ের খুব আত্মগ্লানিও হল। মহানন্দ যখন দলবল নিয়ে গোটা এলাকায় আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন রাজামশাই গোপনে হরেকেষ্টকে দিয়ে আমাকে ডাকিয়ে আনিয়ে হাউমাউ করে আমার হাত ধরে বললেন, তোর কাছে বড় অপরাধ করে ফেলেছি রে। মহানন্দ তোর ওপর বড় অত্যাচার করবে, তারপর দেশ ছারখার করতে শুরু করবে। তা তুই আমার মুখ রক্ষে কর। মহানন্দ বাঁশি কড়া পাহারায় রেখেছে। ও বাঁশি তোকে চুরি করতে হবে। বাঁশি নিয়ে তুই দূরে কোথাও পালিয়ে যা।তা আমি বললুম, মহারাজ, আমি যে রিটায়ার হয়েছি। বয়সও হল। মহারাজ বললেন, বুড়ো হলে কী হয়, এ তোর বাঁ হাতের কাজ। আমি তোকে এ কাজের জন্য মজুরিও দেব। আমাকে বাঁচা, রাজি হয়ে যা।”
“রাজি হলে বুঝি?”
“হলুম। প্রস্তাবটা তো খারাপ নয়।”
“ও, তা হলে তুমিই রাজবাড়ির চুরি-যাওয়া জিনিস ময়নাগড়ের বাড়ি বাড়ি ফিরি করে বিক্রি করেছ! বদরুদ্দিন বলছিল বটে, একজন বুড়ো ফিরিওলা ময়নাগড়ে কোন রাজবাড়ির জিনিস খুব শস্তায় বিক্রি করে গেছে।”
“শস্তায় না দিলে গাঁয়ের মানুষ কিনবে কেন বলো!”
“তা তো বুঝলুম, কিন্তু চালে কি একটু ভুল হল না?”
“চালে ভুল! তো বুড়ো হয়েছি, ভুলভাল হতেই পারে। কী ভুল হল বলল তো!”।
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভুল নয়? বাঁশিটা হাতছাড়া হল যে।”
শ্রীনিবাস চিন্তিত মুখে বলল, “হাতছাড়া কি সহজে হতে চাইছিল বাঁশিটা? বটেশ্বর সেটা এমন লুকিয়ে রেখেছিল যে, মহানন্দ সারা জীবনেও খুঁজে বের করতে পারত না। তারপর বাঁশি বাজাতে যেত আবার ভুতুড়ে দীঘির ধারে, যেখানে জনমনিষ্যি যায় না। তাই বাঁশিটা যে বটেশ্বরের কাছে আছে সে খবরটা আমিই মহানন্দকে দিয়েছিলুম।”
“তুমি!” বলে হাঁ হয়ে গেল ইরফান।
মৃদু হেসে শ্রীনিবাস বলে, “তা ছাড়া উপায় কী বলল। বেচারা বাঁশির হদিশ পেতে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছিল যে। তাই একদিন হাটখোলার কাছে অন্ধকারে সাধু সেজে তার পথ আটকে বললুম, পাঁচটা টাকা দে। তা হলে যা খুঁজছিস তার হদিশ পেয়ে যাবি। একটু কিন্তু কিন্তু করছিল বটে, তবে দিয়েছিল। তখন বললুম সন্ধের পর ময়নাদিঘির ধারে যাস, পেয়ে যাবি।”
ইরফান গম্ভীর হয়ে বলল, “কাজটা ভাল করোনি শ্রীনিবাস। খবরটা দিয়েছিলে বলে যে বটেশ্বর মরতে বসেছিল! সময় মতো আমি গিয়ে পড়েছিলুম বলে রক্ষে। ঠ্যাঙার ঘা খেয়ে পালিয়েছিল, নইলে–”
শ্রীনিবাস দুলে দুলে একটু হেসে বলে, “বাপু, ঠ্যাঙার ঘা-টা তুমি জব্বর দিয়েছিলে বটে। নিজের চোখেই তো দেখলুম। তবে তোমার ঠ্যাঙার সঙ্গে আমার গুডুলও ছিল যে!”
“অ্যা। বলল কী!”
“বাবলা ঝোঁপের আড়াল থেকে এই এতবড় একখানা গুডুল গুলতিতে ভরে মারলুম যে! তোমার ঠ্যাঙার ঘাও পড়ল, আমার গুডুলও গিয়ে গুণ্ডাটার কপালে লাগল। তোমার ঠ্যাঙার জোর বেশি, না আমার গুড়ুলের জোর বেশি তা বলতে পারব না। তবে কাজ হয়েছিল।”
“বটে!”
.
বটতলার অন্ধকার রাস্তা দিয়ে জনাদশেক লোক ময়নাগড়ে ঢুকছিল। সকলের সামনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নরেন্দ্রনারায়ণ। তার এক হাতে টর্চ, অন্য হাতে ধুতির কোঁচাখানা মুঠো করে ধরা। পিছনে দু’জনের হাতে বন্দুক, দু’জনের হাতে খোলা তলোয়ার, দু’জনের হাতে সড়কি আর বাকিদের হাতে লম্বা লম্বা লাঠি। প্রত্যেকেরই বিরাট বিরাট শরীর। তারা ভারী ভারী পায়ের শব্দ তুলে বুক ফুলিয়েই ঢুকছে।
বটতলা পেরোতেই টর্চের আলো এসে পড়ল তাদের ওপর। প্রভঞ্জন ডাক্তার হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “কে রে? কারা তোরা?” বলে তেড়ে এসেই টর্চের আলোয় লোকগুলোর মূর্তি দেখে ভারী নরম হয়ে পড়ল প্রভঞ্জন। মোলায়েম গলায় বলল, “আসুন, আসুন। কাকে খুঁজছে বলুন তো! ও ব্রজ, দ্যাখো এঁরা কার বাড়ি যাবেন, বরং সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসো।”
নরেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর গলায় বলল, “তার প্রয়োজন হবেনা। বাড়ি আমরা চিনি।”
নগেন পাল বিগলিত হয়ে বলল, “তা চিনবেন বইকী, এ তো আপনারও গ্রাম। তা হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন বুঝি! খুব ভাল। যা গরমটা পড়েছে আজ!”
লোকগুলো প্রভঞ্জনের দলের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সদর্পে এগিয়ে গেল।
হাটখোলার কাছে হ্যাজাক জ্বেলে কালীপদর দলবল ওত পেতে ছিল। উটকো লোকজন দেখে সবাই ‘রে রে’ করে উঠল। কিন্তু দলটা কাছে আসতেই তাদের মূর্তি দেখে কালীপদ তটস্থ হয়ে বলে, “নরেন্দ্রনারায়ণবাবু যে! তা শরীর গতিক ভাল তো! বাড়ির সবাই ভাল আছে? খোকাখুকিদের খবর সব ভাল? আর গিন্নিমা! হেঃ হেঃ, আজকাল তো আর দেখাই পাই না আপনার! মাঝে মাঝে চলে আসবেন এরকম হুটপাট করে। আমরা তো আর পর নই।”
নরেন্দ্রনারায়ণ তার দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি হেনে গটগট করে এগিয়ে যেতে লাগল, পিছনে তার বাহিনী।
কে একজন যেন জিজ্ঞেস করল, “কারা এরা কালীপদদা?”
“চিনলি না? বিরাট লোক! বিরাট লোক।”
আর কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করল না।
তিন নম্বর দলটার সঙ্গে দেখা হল রথতলায়। নবু কালীবাড়ি থেকে বলির খাঁড়াটা ধার করে এনেছিল। সেটা বেজায় ভারী বলে খাঁড়াটা মাটিতে শুইয়ে তার ওপর বসে চারদিকে নজর রাখছিল। সামনে হঠাৎ লোকজন সাড়া পেয়ে খাঁড়া হাতে উঠে গর্জন করল, “খবর্দার! আর কাছে এলেই কিন্তু এসপার ওসপার হয়ে যাবে, এই বলে রাখলুম!”
কিন্তু দলটা কাছে আসতেই নবু খ্যাখ্যাল করে হেসে বলল, “আপনারা! তাই বলুন। আমি ভাবলাম কে না কে যেন! তা গোবিন্দপুরে কেনারাম বিষয়ীর মেয়ের বিয়েতে যাচ্ছেন তো! হ্যাঁ, এই রাস্তাই। সামনে এগোলে বাঁ হাতে রাস্তা পাবেন, মাইলটাক গেলেই গোবিন্দপুর। জব্বর খাইয়েছে মশাই, মাছের কালিয়াটা যা হয়েছে না…”
নরেন্দ্রনারায়ণ একটু কুটি করে তার দিকে চাইতেই নবু চুপসে গেল।
প্যাংলা ঠিকমতো ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়নি। একটা ষণ্ডা তাকে কনুইয়ের একটা রাম-গুতোয় ছিটকে ফেলে দিল। যন্ত্রণায় কোঁক করে উঠল সে। পরমুহূর্তেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে উদ্বেগের সঙ্গে বলে উঠল, “আপনার ব্যথা লাগেনি তো ভাই? আহা, আমার বুকে গুঁতো খেয়ে কচি হাতটা বোধহয় জখম হল ছেলেটার!”
এর মধ্যেই দুটো ছেলে দৌড়ে গিয়ে বিষ্ণুরামকে খবর দিল, “বড়বাবু, গাঁয়ে দশ বারোজন লোক ঢুকে পড়েছে।”
বিষ্ণুরাম রাতে বারোখানা পরোটা খায়, সঙ্গে মাংস, শেষপাতে ক্ষীর আর মর্তমান কলা। মাত্র পাঁচ নম্বর পোটাটি ছিঁড়ে মাংসের ঝোলে ডুবিয়েছে, এমন সময় উটকো ঝামেলা।
বিষ্ণুরাম উঠে জানালার পাল্লা সাবধানে ফাঁক করে বলল, “কী হয়েছে?”
ছেলেদুটো হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “ভীষণ বিপদ বড়বাবু, গাঁয়ে দশ বারোজন তোক ঢুকে পড়েছে যে!”
বিষ্ণুরাম বিজ্ঞের মতো হেসে বলল, “হ্যাঁ রে, পেনাল কোডে কোন ধারায় বলা আছে যে, গাঁয়ে তোক ঢোকা বারণ?”
“আজ্ঞে, তা তো জানি না।”
“ওইটেই তো তোদের মুশকিল। কিছু জানিস না, না জেনেই চেঁচামেচি করিস। ওরে বাপু, আমি হলুম আইনের রক্ষক। আইন ছাড়া আমি এক পাও চলতে পারি না। তোক যদি ঢুকে থাকে তো কী হয়েছে? ঢুকতে দে না। কত আর ঢুকবে?”
“কিন্তু বড়বাবু, তাদের হাতে বন্দুক আছে, তরোয়াল আর লাঠি আছে।”
ভ্রু কুঁচকে বিষ্ণুরাম বলল, “অস্ত্র থাকলেই তো হবে না। তাদের উদ্দেশ্য কী বুঝতে হবে। খুনজখম যদি নিতান্তই হয় তখন না হয় কাল সকালে দেখা যাবে। তোরা বরং পরিস্থিতির ওপর নজর রাখ। যা-ই ঘটুক, সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা কর। আমি তো তোদের পিছনেই আছি।”
ছেলে দুটো বিমর্ষ মুখে ফিরে গেল।
বিষ্ণুরাম ধীরে সুস্থে মাংস পরোটা আর ক্ষীর খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ওদিকে নরেন্দ্রনারায়ণ তার দলবল নিয়ে যখন পরাণ দাসের বাড়িতে হাজির হল তখন চারদিক সুনসান। বিভীষণের মতো চেহারার একটা লোকের এক ধাক্কাতেই দরজাটা মড়াত করে খুলে গেল। নরেন্দ্রনারায়ণ টর্চ ফেলে দেখল, মেঝেতে মাদুর পেতে অঘোরে ঘুমোচ্ছ শ্রীনিবাস।
গম্ভীর গলায় সে ডাকল, “শ্রীনিবাস!”
শ্রীনিবাস এক ডাকেই উঠে পড়ল। চোখ মিটমিট করে চেয়ে বলল, “মহানন্দবাবু যে! সঙ্গে এত লোকজন কেন বলুন তো! অস্ত্রশস্ত্রই বা কেন?”
“আমি তোমাকে ভয় দেখাতে আসিনি শ্রীনিবাস। বরং তোমার সঙ্গে একটা চুক্তি করতেই এসেছি।”
“কীসের চুক্তি?”
“আমার মনে আছে, অনেক দিন আগে আমি যখন ছোট ছিলুম তখন তুমি আমাকে আড়বাঁশি বাজাতে শিখিয়েছিলে। মনে পড়ে?”
“পড়ে।”
“আজ আবার তোমার কাছে বাঁশি শিখতে এসেছি। এই বাঁশিটা।” বলে নরেন্দ্রনারায়ণ ওরফে মহানন্দ মোহন রায়ের বাঁশিটা বের করে দেখাল।
শ্রীনিবাস নিরুত্তাপ চোখে বাঁশিটা দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। নরেন্দ্রনারায়ণ বলল, “বাঁশিটা চেনো?”
“চিনি মহানন্দবাবু।”
“চেনারই কথা। বাঁশিটা চুরি করে তুমি আমাকে অনেক দৌড়ঝাঁপ করিয়েছ।”
শ্রীনিবাস উদাস গলায় বলল, “ভালর জন্যই চুরি করেছিলাম।”
“কার ভালর জন্য শ্রীনিবাস? এ বাঁশির জোরে রাজা হওয়া যায়। কিন্তু তুমি তো তা হওনি৷ ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কী ভালটা হল তোমার?”
তেমনি উদাস গলায় শ্রীনিবাস বলে, “সবার ভাল কি একরকম?”
“তোমার ভালটা কীরকম তা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। একসময়ে তুমি নামকরা চোর ছিলে। শুনতে পাই, তুমি নাকি লাখো লাখো টাকা রোজগার করেছ। কিন্তু দান-খয়রাত করে সব উড়িয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে একখানা কুঁড়ে ঘরে মাথা গুঁজে পড়ে থাকো। উলোঝুলো পোশাক পররা, ভালমন্দ খাবার জোটে না, লোকে ১০৪
খাতির করে না, সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওনি, তা হলে ভালটা কী হয়েছে বলতে পারো? তুমি তো আর সাধু-সন্ন্যাসী নও।”
শ্রীনিবাস নিস্পৃহ গলায় বলল, “সাধু হওয়া কি সোজা?”
“শোনো শ্রীনিবাস, আমি জানি না তুমি পাগল,নাকি বোকা, নাকি বৈরাগী। তবে তুমি যে একটি অদ্ভুত লোক তাতে সন্দেহ নেই। এভাবে বেঁচে থাকতে কি তোমার ভাল লাগে? বুড়ো হয়েছে, এখন একটু ভোগসুখ করতে ইচ্ছে যায় না? ধরো যদি অসুখবিসুখ করে, বিছানায় পড়ে যাও তা হলেই বা কে তোমাকে দেখবে, ডাক্তার বদ্যিরই বা কী ব্যবস্থা হবে, এসব ভেবেছ? তোমার তো তিনকুলে কেউ নেই, একা মানুষ, হাতে টাকা পয়সা না থাকলে তোমার গতিটা কী হবে জানো?”
শ্রীনিবাস একটু হেসে বলল, “তা আর ভাবি না? খুব ভাবি। ভেবে ভয়ও হয় খুব। তুমিও যে আমার কথা এত ভাবো তা জেনে বড় ভাল লাগল।”
“ইয়ার্কি নয় শ্রীনিবাস, আমি ভাবের ঘোরে চলি না। আমি কাজের লোক। হাতে ক্ষমতা পেয়েও যদি কেউ সেই ক্ষমতা কাজে
লাগায় তা হলে সে আহাম্মক। এই যে অদ্ভুত বাঁশিটা দেড়শো বছর ধরে রাজবাড়িতে পড়ে আছে এটা কি ঠিক হচ্ছে? মোহন রায় অনেক মাথা খাঁটিয়ে, বিস্তর মেহনতে এটা তো ফেলে রাখার জন্য তৈরি করেননি! তাঁর অপোগণ্ড বংশধরেরাও বাঁশিটা কেউ কাজে লাগায়নি। এখন দুনিয়ার তুমিই একমাত্র লোক যে এই বাঁশির বিদ্যেটা জানো। তুমি মরে গেলে এই বাঁশি চিরকালের মতো বোবা হয়ে যাবে। এত বড় একটা সম্পদ নষ্ট হবে। ভেবে দ্যাখো শ্রীনিবাস। বিদ্যেটা দিয়ে যাও, বাঁশিটা সার্থক হোক।”
“বিদ্যেটা শিখে তুমি কী করবে মহানন্দবাবু?”
“তোমাকে মিথ্যে কথা বলব না। লোককে ঘুম পাড়িয়ে এলাকা লুট করার মতো ছোট নজর আমার নয়। কথা দিচ্ছি, সাধারণ মানুষের ধনসম্পত্তিতে আমি হাতও দেব না। আমি বন্দোবস্ত করব সরকার বাহাদুরের সঙ্গে।”
অবাক হয়ে শ্রীনিবাস বলল, “সেটা কী রকম?”
“আমি জানি, তিন নম্বর সুরে প্রলয় কাণ্ড হয়। ঘূর্ণিঝড় ওঠে, বান ডাকে, ভূমিকম্প হয়। ধরা যাক, আমি সরকার বাহাদুরকে খবর দিলাম, অমুক দিনের মধ্যে আমাকে একশো কোটি টাকা না দিলে অমুক দিন অতটার সময় অমুক জায়গায় প্রলয়ংকর কাণ্ড এবং ভূমিকম্প হবে। সরকার প্রথমে পাত্তা দেবে না। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে, ঠিক সময়ে সেই জায়গায় যদি তাই হয় তা হলে সরকার নড়েচড়ে বসবে। দু’বার বা তিনবার একই কাণ্ড ঘটলে তখন আর সরকার চুপ করে থাকতে পারবে না। ভয় পেয়ে আমার দাবি মিটিয়ে দেবে। তোমাকে কথা দিচ্ছি আমার রোজগারের চার আনা ভাগ তোমার। ভাল করে ভেবে দ্যাখো, এ কাজে খারাপ কিছু নেই। টাকাটা দেবে সরকার। আর সরকারের টাকার ওপর হক তো আমাদের আছেই। ঠিক কি না!”
হঠাৎ মুখটা উজ্জ্বল হল শ্রীনিবাসের। সে দুলে দুলে হেসে বলল, “খুব ঠিক। আমি ভাবছি, সরকার টাকাটা পাবে কোথায়। যতদূর শুনেছি, সরকারের টাকা আসলে দেশের মানুষেরই টাকা। তাই নাকি মহানন্দবাবু?”
মহানন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, “সরকারের কত টাকা নয়ছয় হয় তুমি জানো? কত লোক সরকারি তহবিলের টাকা লুটমার করে নিচ্ছে! তা হলে আমাদের দোষ হবে কেন? সরকারি টাকা আসলে বেওয়ারিশ জিনিস। ও নিলে দোষ হয় না।”
“আমাকে সিকিভাগ দিতে চাও?”
“চাইলে আধাআধি বখরাও হতে পারে।”
ভ্রু কুঁচকে মহানন্দের দিকে চেয়ে শ্রীনিবাস ঠাণ্ডা গলাতেই বলল, “আমাকে একটা কথা বুঝিয়ে দেবে মহানন্দবাবু?”
“কী কথা?”
“আমাকে তুমি বখরাই বা দেবে কেন? ধরো বাঁশির বিদ্যে যদি আমি তোমাকে শিখিয়েই দিই তা হলে আমাকে বাঁচিয়েই বা রাখবে কেন তুমি? বুদ্ধিমান মানুষ কি তা করে?”
“তুমি ভাবছ বিদ্যেটা শিখে নিয়ে আমি তোমাকে মেরে ফেলব?”
“যুক্তি তো তাই বলে। শত্রুর কি শেষ রাখতে আছে?”
“আমি কথা দিলেও তুমি বিশ্বাস করবে না?”
“বিশ্বাস করার কারণ নেই যে।” মহানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে ভাঙা যে সহজ হবে না তা আমি জানি তোমার মৃত্যুভয়ও নেই। তবে তোমার একটা দুর্বলতার খবর আমি রাখি শ্রীনিবাস।”
“তাই নাকি?”
“কেতুগড়ে তোমার পাশের বাড়িতে একটা ছোট পরিবার থাকে। নয়নচাঁদ আর তার বউ বিষাণী। তাদের একটা বছর পাঁচেকের ফুটফুটে ছেলে আছে, তার নাম গোপাল। তোমার এতদিন সংসারের কোনও মায়ার বন্ধন ছিল না। কিন্তু ওই গোপাল হওয়ার পর থেকে বিষাণী বাচ্চাটাকে তোমার কাছে রেখে ঘর-গেরস্থালির কাজ করত। আর তুমি গোপালকে কোলেপিঠে করে এত বড়টি করেছ। এখন সে তোমার নয়নের মণি, আর গোপালও দাদু ছাড়া কিছু বোঝে না। এখন ও তোমার হাতে খায়, তোমার কাছে ঘুমোয়।”
শ্রীনিবাসের মুখটা ধীরে-ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছিল। সে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ধরা গলায় বলল, “কী বলতে চাও মহানন্দবাবু?”।
“গোপালের ভাল-মন্দের জন্যই বলছি, আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়াই সকলের পক্ষে মঙ্গল। যদি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও আমি তোমাকে মারব না শ্রীনিবাস, কিন্তু গোপালকে তুলে নেব। তারপর যে কদিন তুমি বাঁচবে দগ্ধে দগ্ধে মরবে। এখনও ভেবে দ্যাখো।”
শ্রীনিবাস কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধরা গলায় বলল, “মহানন্দবাবু, আমি জানি বিদ্যেটা শেখার পর তুমি আমাকে মেরে ফেলবে। মরতে আমার ভয়ও নেই। শুধু বলি, শেষবারের মতো ভেবে দেখো, ওই সর্বনেশে বাঁশি কাজে লাগাবে কি না।”
“আমার ভাবা হয়ে গেছে শ্রীনিবাস। আমি তোমাদের মতো বোকা নই। সম্পদ কাজে না লাগানোও অন্যায়।”
শ্রীনিবাস হাত বাড়িয়ে বলল, “বাঁশিটা দাও। আর ঘর থেকে ওদের বেরিয়ে যেতে বলল।”
.
মাঝরাত্তিরে হঠাৎ কাতুকুতু খেয়ে গাঢ় ঘুম থেকে জেগে উঠল বিষ্ণুরাম, ভারী অবাক হয়ে বলল, “এ কী রে! কাতুকুতু দেয় কে? অ্যাঁ! আরে, আমার কাতুকুতু লাগছে কেন? কী মুশকিল!”
কে একটা চাপা গলায় ধমক দিল, “চোপ! উঠে পড়, সময় নেই।”
বিষ্ণুরাম ভয় খেয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, “কে রে তুই? চোর নাকি রে? অ্যাঁ! চোর? ওরে বাপু, দারোগার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকলে কী হয় জানিস? পেনাল কোডে লেখা আছে, দারোগার বাড়িতে চুরি করলে ফাঁসি হয়। বুঝলি!”
“বুঝেছি। কিন্তু আমার ফাঁসি হওয়ার উপায় নেই। উঠে পড়, নইলে আবার কাতুকুতু দেব।”
বিষ্ণুরাম ভয় পেয়ে উঠে পড়ল। অন্ধকারে খাটের পাশে একটা আবছা মতো মানুষকে দেখে সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “ওরে, গাঁয়ে তো আরও বাড়ি আছে, সেখানে যা না। যা বাবা, যত পারিস চুরি কর গে, কিচ্ছু বলব না। ওরে, আমি কি কখনও তোদের কাজে বাগড়া দিয়েছি, বল।”
“জানি, তুই হলি ষাঁড়ের গোবর। পোশাক পরে পিস্তলটা হাতে নে।”
“আমাকে হুকুম করছিস! সাহস তো কম নয়! তুই কে রে?”
“আমি মোহন রায়।”
“সেটা আবার কে?”
“বেশি কথার সময় নেই। বাঁশি শুনতে পাচ্ছিস?”
“বাঁশি!” বলে একটু অবাক হয়ে বিষ্ণুরাম চুপ করল। বাস্তবিক একটা ভারী অদ্ভুত সুরেলা শব্দ যেন বাতাসে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে।
শুনলে যেন রক্ত নেচে ওঠে।
বিষ্ণুরাম বলল, “বাঃ, বেশ বাজায় তো!”
“এটা এক নম্বর সুর।”
“তার মানে?”
“মানে বলার সময় নেই। দরজা খুলে বেরো, আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
“কিন্তু তোকে এত আবছা দেখছি কেন? স্বপ্ন নাকি?”
“না। স্বপ্ন নয়, আমাকে আবছাই দেখা যায়।”
“তা যেতে হবে কোথায়?”
“কাজ আছে। কথা না বলে বেরিয়ে পড়।”
বিষ্ণুরামের হঠাৎ মনে হল, এ লোকটা যে সে লোক নয়। ভারিক্কি গলা, বেশ দাপট আছে, কেউকেটা কেউ হবেও বা। সে একটু নরম হয়ে বলল, “তা না হয় যাচ্ছি, কিন্তু আপনার পরিচয়টা?”
“পরে হবে। ওই যে দু’নম্বর সুর বাজছে।”
বিষ্ণুরাম পথে বেরিয়ে সামনের আবছা লোকটার পিছু পিছু যেতে শুনতে পেল, বাঁশির সুরটা পালটে গেছে। ভারী নেশাড়ু একটা সুর চারদিকে যেন ঘুম-ঘুম ভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিষ্ণুরাম একটা হাই তুলতে গিয়ে দেখল, রাস্তায় ঘাটে, মাঠে, ময়দানে, এখানে সেখানে লোকজন শুয়ে ঘুমোচ্ছে। গরমে লোকে ঘরের বাইরে অনেকে ঘুমোয় বটে, কিন্তু পথেঘাটে এরকম পড়ে থাকে না তো!
বিষ্ণুরাম সভয়ে বলল, “মোহনবাবু, এরা কি মরেটরে গেছে, নাকি!”
“না। দু নম্বর সুর শুনলে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।”
“তা হলে আমি ঘুমোচ্ছি না কেন?”
“তোর ওপর সুরটা ক্রিয়া করছে না, আমি সঙ্গে আছি বলে।”
“ঘুমোতে দিচ্ছেন নাই বা কেন?”
“তুই না এলাকার শান্তিরক্ষক?”
“আহা, শান্তিরক্ষকদের কি ঘুমোতে নেই?”
“সারাক্ষণ তুই তো ঘুমিয়েই থাকিস। তোর চোখ ঘুমোয়, মন ঘুমোয়, বিবেক ঘুমোয়, বুদ্ধি ঘুমোয়। আজ তোর জেগে ওঠার পালা।”
“আপনার কথা শুনে ভয়-ভয় করছে যে!”
“আজ ভয় পেলে চলবে না। আয়।”
হঠাৎ বাঁশির সুরটা পালটে একটা ভয়ংকর ভয়াল সুর বেজে উঠল। যেন পেতনির কান্না। হঠাৎ যেন হাহাকারে ভরে গেল চারদিক। হঠাৎ প্রলয়ের শব্দ তুলে হুহুঙ্কারে ছুটে আসছিল ঘূর্ণি ঝড়ের শব্দ। সেই সঙ্গে বিপুল জলের কলরোল।
বিষ্ণুরাম চেঁচাল, “কী হচ্ছে বলুন তো মোহনবাবু!”
“তিন নম্বর সুর।”
হঠাৎ পায়ের তলার মাটি দুলতে লাগল দোলনার মতো। মড়মড় শব্দ উঠল গাছের ডালপালায়, পাখিরা তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, আকাশে ঝলকাতে লাগল বিদ্যুৎ।
তারপর আচমকাই সব শব্দ থেমে গেল। মাটির দোলন থেমে স্থির হল।
“তাড়াতাড়ি আয়। এবার বিপদ।”
“বিপদ! তা বিপদের মধ্যে আমাদের যাওয়া কি ভাল হচ্ছে?”
“পিস্তল বাগিয়ে আয়।”
লোকটা এত জোরে হাঁটছে যেন মনে হচ্ছে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। বিষ্ণুরাম প্রাণপণে হেঁটেও তাল রাখতে পারছে না। থেমে যে উলটোদিকে পালাবে তারও উপায় নেই। একটা চুম্বকের মতো টান যেন তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে।
সামনে থেকে মোহন রায় কেবল বলছে, “আয়, তাড়াতাড়ি আয়।”
বাঁশি থামতেই মহানন্দ শ্রীনিবাসের হাত থেকে বাঁশিটা কেড়ে নিয়ে হাসল। তারপর দুই কানের ভিতর থেকে দুটো তুলোর ঢিপলি বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, “আজ চোখ আর কানের বিবাদভঞ্জন হল হে শ্রীনিবাস। তোমারও কাজ শেষ হয়ে গেল।”
শ্রীনিবাস জ্বলজ্বল করে চেয়ে ছিল মহানন্দের দিকে। বলল, “বিদ্যে তো পেয়ে গেলেন। কিন্তু মনে রাখবেন ওই বাঁশি এক মহৎ শিল্পের কাজ, এক দারুণ কারিগরের। পৃথিবীতে এমনটা আর হয়নি, হবেও না। ওটা দিয়ে মোটা দাগের কাজ করলে পস্তাতে হবে।”
মহানন্দ একটু হেসে পাঞ্জাবির ঝুল পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে শ্রীনিবাসের দিকে চেয়ে বলল, “এই বিদ্যের ভাগীদার থাকা কি ভাল শ্রীনিবাস?”
শ্রীনিবাস একটু হেসে বলল, “আমার কাজ ফুরিয়েছে মহানন্দবাবু। গুলিটা চালিয়ে দিন।”
রিভলভারের শব্দ হল।
কিন্তু শ্রীনিবাস অবাক হয়ে দেখল, সে নয়, তার বদলে মহানন্দই উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝের ওপর। পিঠ থেকে রক্তের একটা ধারা নেমে আসছে মেঝেতে। আর দরজায় খোলা ধোঁয়ানো রিভলভার হাতে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিষ্ণুরাম দারোগা। তার চোখে ভারী অবাক দৃষ্টি।
পরদিন সকালে নয়নতারা বলল, “দিন তো বাবা, ওই অলক্ষুণে বাঁশিটা উনুনে গুঁজে দিই।”
মৃদু আপত্তি করে পরাণ বলল, “আহা, কটা দিন থাক না হাতে। বেশি কিছু তো নয়, একখানা দোতলা বাড়ি, পনেরো বিশ বিঘে ধানী জমি, দুটো দুধেল গাই…”
শ্রীনিবাস বাঁশিটার গায়ে আদরে হাত বুলিয়ে বলল, “এমন শিল্পকর্ম কি নষ্ট করতে আছে রে! যেখানকার জিনিস সেখানেই ফিরিয়ে দিয়ে আসব।”
পরাণ বলল, “ছোটখাটো দু’একটা কাজ কারবার করে নিলে হয় বাবা?”
শ্রীনিবাস ঝোলা খুলে কয়েকটা মোহর, সোনার রেকাবি, রুপোর বাসন বের করে দিয়ে বলল, “এগুলো বেচে যা পাবি তাই দিয়ে একটা দোকান দে। চুরির ধাত তোর নয়, ও তোর হবে না।”
জিনিসগুলো দেখে পরাণ ভারী আহ্লাদিত হয়ে বলল, “এ থেকে আপনাকে কত ভাগ দিতে হবে বাবা?”
শ্রীনিবাস মৃদু হেসে বলে, “ভাগ দিবি? ভাগ করলে সব জিনিসই তো ছোট হয়ে যায় রে। আমার কি অল্পে হয়? অল্পে আমার মন ভরে বলে ভগবান যে আমাকে গোটা বিশ্ব সংসারটাই দিয়ে রেখেছেন। ভাগ নিয়ে তোরা থাক।”