মৈত্রেয় জাতক (Maitreya Jatak) – মগধের রাজধানী
নিবেদন
‘মৈত্রেয় জাতক’ বুদ্ধর জীবন কথা নয়। ঐতিহাসিক রোম্যান্স তো নয়ই। এই জাতক একটি সময়কালের পুনর্নিমাণ, যে কাল আজকের সংকটমুহূর্তে নিঃসন্দেহে ফিরে দেখার যোগ্য। অবশ্যই কল্পনাশ্রয়ী এ নির্মাণ, কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্যসমূহকে অবমাননা করে নয়। ইতিহাসের গর্ভে যেখানে যেখানে অনিশ্চয়তা, পরস্পরবিরোধ ও নীরবতা, যুক্তিসিদ্ধ কল্পনা সেই ফাঁকগুলোতেই স্বেচ্ছাচারী হয়েছে। যেমন বিম্বিসারের বংশ নির্ণয়, অভয় বা জীবকের পরিচয়, আনন্দর বয়স, এবং সাধারণভাবে ছোট ছোট ঘটনার কালক্ৰম। ঘটনাবলীর পেছনের মোটিভ-নির্ণয়ও ছিল গবেষণার কেন্দ্র, যদি একে ন্যূনতম গবেষণার মান দেওয়া যায়। এই চিত্র পূর্ণ এমন দাবি করি না। বিশেষত জ্ঞাতৃকপুত্র বর্ধমান মহাবীরকে তেমন কোনও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায় দেখানো গেল না, এ দুঃখ রয়েই গেল। কিন্তু ইতিহাস, কথাকাহিনী এমন কি বিজ্ঞানের জগতেও কোন চিত্রই বা পূর্ণ? আসল কথা যথাসম্ভব খোলা মন ও মুক্ত দৃষ্টি নিয়ে কাজ করা গেছে কি না।
অশ্বঘোষ, ললিতবিস্তর, অবদানশতক এবং সাম্প্রতিককালে রবীন্দ্রনাথ সবার চোখেই বুদ্ধ করুণার অবতার। সবার আগে অবশ্যই তিনি অধ্যাত্মপুরুষ। কিন্তু আধ্যাত্মিক কৃতির মূল্যায়ন তো অনাধ্যাত্মিক মানুষের ক্ষমতার বাইরে! সুতরাং, আধ্যাত্মিকতাকে তাঁর ব্যক্তিত্বের পশ্চাৎপট বলে মেনে নিয়েই একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে তিনি এ-যুগের বিচারে এবং সে যুগের চোখে কীভাবে প্রতিভাত হন, অর্থাৎ বিগ্রহের ভেতরকার মানুষ অমিতাভ কেমন, কী তাঁর তাৎপর্য তা দেখার বিশেষ আগ্রহ ছিল, আরও আগ্রহের বিষয় সেই দেশ ও সেই কাল যা তাঁকে সম্ভব করেছিল, সেইসব মানুষ যাঁরা তাঁকে বন্ধুতা অথবা শত্রুতা দিয়েছিলেন, এবং সবার পেছনে সেই জীবনের পটভূমি যা সাধারণজনের যাপিত।
দেখা গেল সিদ্ধার্থ একজন অসাধারণ বুদ্ধিমান (চতুরও বটে), অসামান্য দৈহিক রূপ ও ব্যক্তিমায়া সম্পন্ন (পুরুষদেরও মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো), সময়ে সময়ে কৌতুকপ্রিয় (মোটেই সর্বদা ধ্যানগম্ভীর নন), দারুণ প্র্যাকটিক্যাল ও স্থিতধী (উপস্থিতবুদ্ধি তাঁকে বহুবার বাঁচিয়েছে) অথচ ট্র্যাজিক মানুষ। আজকের ভাষায় তাঁকে শোধনবাদী বললে বোধহয় ভুল হবে না। সমাজের পাশাপাশি বাস করতে করতে যে সঙঘ তিনি গড়েছিলেন তাতে সমাজ শক্তি ও রাজশক্তির সঙ্গে বহু আপস ও রফা ছিল। তাঁর প্রধান সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা হল—অতিকৃচ্ছ্র ও অতিভোগ এই উভয়বিধ বদভ্যাসের মাঝামাঝি এক মধ্যপন্থার সুপারিশ। তাঁর কালের বিচারে এ পদক্ষেপ যদি বৈপ্লবিক না-ও হয় অন্তত তা বিশেষ কাণ্ডজ্ঞান ও মনস্তত্ত্বজ্ঞানের পরিচয় দেয়। বৈজ্ঞানিক যুক্তি ব্যবহার করে তিনি উপকরণশুদ্ধি (স্নানে পাপ মোচন ইত্যাদি), অনর্থক অনুষ্ঠান (অগ্নিহোত্র ইত্যাদি) অগ্নিবরুণ সোমের দেবত্ব—ইত্যাদি খণ্ডন করলেন, কিন্তু আবার বললেন সুকর্মে স্বর্গ বা দেবযোনি, কুকর্মে নরক বা তির্যগ্ যোনি প্রাপ্তির কথা, কর্মফল জন্ম থেকে জন্মান্তরে প্রসারিত হবার কথা। ভেবে দেখলে এই পরস্পরবিরোধের একটা ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। এই মহামানব যিনি মানুষের কল্যাণের জন্য নিজের উদ্যোগে লোকগুরুর ভূমিকা নেন তাঁর লক্ষ্য ছিল সংযত, সজাগ, কর্তব্যপরায়ণ, সহনশীল, করুণাময়, নিরাসক্ত এক সমাজ-ব্যবস্থার পত্তন। ‘সম্মা আজীব’ অর্থাৎ সৎ-জীবিকার প্রতিও তিনি জোর দিয়েছিলেন। শ্ৰেষ্ঠীদের ধনোপার্জনও এই সৎ-জীবিকার মধ্যে পড়ে (ব্যবসা বাণিজ্যের কুটিলা গতির কথা তখনও যথেষ্ট জানা ছিল না)। জীবনযাপনে যাতে অসুবিধের সৃষ্টি হয় এমন সংস্কার দূর করতে তাঁর যতটা উদ্যোগ ছিল, সুকর্মে প্রবর্তনা ও আশা জাগ্রত রাখবে এমন সংস্কার রচনা করতেও তাই বোধ হয় ততোটাই উদ্যোগ দেখিয়েছিলেন।
বর্ণভেদ তিনি নিজে মানতেন না, তাঁর সঙঘও মানত না, কিন্তু সমাজশরীর থেকে বর্ণভেদ উঠিয়ে দেবার জন্যও তো কই উঠে পড়ে লাগেননি! অবশ্য জন্মের বদলে গুণকর্মের ওপর নির্ভরশীল বর্ণভেদের কথা বিশেষত ব্রাহ্মণত্বের কথা তিনি বহুবার বলেছেন। অর্থাৎ শ্রমভাগের একটা কাঠামো হিসেবে বর্ণভেদের ভূমিকা হয়তো তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করতেন না।
অপর দিকে আত্মা তিনি মানতেন না, ঈশ্বর সম্পর্কে ছিলেন নীরব। আবারও আত্মবিরোধ। কেননা আত্মা ও ঈশ্বরে বিশ্বাসের মতো আশাপ্রদ ও শুভসংস্কার আর কী-ই বা থাকতে পারে? তবে কি তিনি ধ্যানযোগে অনাদ্যন্ত শূন্যেরই মুখোমুখি হয়েছিলেন, এবং সে কথা সোজাসুজি সামান্য জনের কাছে প্রচার করা ভালো মনে করেননি? জীবনের বৃহত্তম দার্শনিক ‘চালাকি’টি তিনি করলেন এই ঈশ্বরসম্পর্কিত প্রশ্নে? ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে অনর্থক বাদানুবাদ সর্বাঙ্গসুন্দর ইহ জীবনের পরিপন্থী মনে করেই কি তিনি তাঁর আবিষ্কৃত শূন্যতত্ত্ব গোপন রাখলেন? তিনি কি পৃথিবীর প্রথম এগ্জিসটেনশ্যালিস্ট? এবং তাই-ই আনন্দকে তাঁর জীবনের শেষ নির্দেশ দিলেন ‘আত্মদীপো ভব?’ একি প্রকারান্তরে বলা নয় তোমাকে পথ দেখাবার কেউ নেই, জীবন এবং মরণের মুখোমুখি দাঁড়াও, নিজের জোরে, নিজের নির্বাচনের দায় স্বীকার করে!
গৌতম বুদ্ধর রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা আরও চমকপ্রদ ও বৈপ্লবিক। এখানে লক্ষণীয়, তাঁর বৈরাগ্য ছিল একটা ইতিবাচক মনোভাব থেকে উৎপন্ন। দারা-পুত্র-পরিবার আর ভালো লাগছে না—এমন নয়, দুঃখনিবৃত্তির একটা উপায় খুঁজে বার করবোই—এমনি। শাক্য ও কোলিয়দের মধ্যে রোহিণী নদীর জল নিয়ে বিবাদ (গঙ্গার জল নিয়ে পঃ বঙ্গ ও বাংলাদেশ, কাবেরীর জল নিয়ে তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক স্মরণীয়) ও অনবরত রক্তক্ষয় নাকি তাঁর বৈরাগ্যের অন্যতম কারণ (অত্তদণ্ড সুত্ত—জাতক অট্ঠকথা)। তা হলে যে নিরাময়ের সন্ধানে তিনি বেরিয়েছিলেন রাজনৈতিক নিরাময়ও তাঁর অন্তর্গত হওয়া অসম্ভব নয়! এবং জীবনের অনেকটা সময়ই যে তিনি কোশলপতি, মগধরাজ বা বৎসরাজের সংস্পর্শে কাটালেন সেটাও নেহাত কাকতালীয় নয়, বরং সচেতন ও সাভিপ্রায় হতে পারে। আসলে অভ্যন্তরীণ নীতিতে গণতান্ত্রিক ও বৈদেশিক নীতিতে পারস্পরিক মৈত্রীর একটি তত্ত্ব তিনি রাজপুরুষদের কাছে ক্রমাগত পেশ করে যাচ্ছিলেন। অর্থাৎ যে রাজনীতি জিনিসটা বরাবর ভেদনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত তাকে তিনি তার বিপরীত মৈত্রী নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করছিলেন। একজন প্রতিভাবান গণরাজকুমার হিসেবে ষোড়শ মহাজনপদের অফুরান বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে মৈত্রীতত্ত্বের উপযোগিতা অনুভব করা তাঁর পক্ষে খুবই সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি পারেননি। কেন? জিনিসটা যুগধর্মের বিরোধী এই বলে, এই ‘কেন’র একটা দায়সারা উত্তর দেওয়া যায়। কিন্তু আসল কথা, গৌতম যা বোঝেননি, তা হল রাজনীতির সামনে এসব ক্ষেত্রে এক দ্বিতীয় এবং সহজতর বিকল্প বরাবর থেকে যায়—তা হল সাম্রাজ্যগঠন। কেন্দ্রীয় সেনা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রি পরিষদ, কেন্দ্রীয় টাঁকশাল, এক মুদ্রা, এক মূল্যমান, এক আরক্ষা। বুদ্ধের কল্পনার ভারতবর্ষ কিছুটা সম্ভব হয়েছিল প্রায় দু’শ বছর পরে অশোকের রাজত্বকালে। কিন্তু তারপর? তা আবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এবং আজ সারা বিশ্বে গৌতম যদিচ ‘এশিয়ার আলো’ বলে স্বীকৃত, যদিচ অশোকস্তম্ভ আমাদের জাতীয় প্রতীক, এবং পঞ্চশীল নিয়ে যথেষ্ট বাগ্মিতা ও ভাস্কর্য সৃষ্টি হয়েছে, ভাগ্যের পরিহাস এমনই যে বুদ্ধর প্রচারিত তত্ত্বের মধ্যেকার নেতিবাচক দিকটি ছেঁকে নিয়ে আমরা পরমহংস হয়েছি, কিন্তু আত্মনির্ভর হওয়া, যে মতবাদের (ধর্মমত, রাজনৈতিক মতবাদ) প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাকে ভাঙা ভেলার মতো পরিত্যাগ করা, অষ্টাঙ্গিক মার্গের সবল সদর্থক দিকটি জীবনে গ্রহণ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে এক কিম্পূরুষোচিত অহিংসাতত্ত্ব বুদ্ধর ওপর আরোপ করে ভারতের নির্বীর্যকরণের জন্য আমরা তাঁকেই দায়ী করি। বিশ্বের মহত্তম ট্রাজেডিগুলি এমনই হয়। শুভ ভেবে যা করা হল তার ফল হল চূড়ান্ত অশুভ। তাই অমিতাভ বুদ্ধ যে ট্রাজেডির নায়ক তার কাল আড়াইহাজার বছর। এবং তার প্রেক্ষিত সমস্ত বিশ্ব।
সমগ্র বুদ্ধযুগটির চরিত্রই কি ট্র্যাজিক নয়? গ্রামজনেরা গ্রামকৃত্য করছে, অর্থাৎ নিয়মিত শ্রম দিয়ে গ্রাম পরিচ্ছন্ন রাখছে, নগরে নগরে কৌতূহলশালা, নতুন নতুন মতামতের আদানপ্রদান হচ্ছে, শুনছেন শুধু বিদ্বানরা নন, রাজ পুরুষরাও, সাধারণ মানুষরাও। এমন নাগরিকদের নিয়েই তো আথিনীয় রাষ্ট্র প্রধান পেরিক্লীস গৌরব করেছিলেন! আশি হাজার(?) গ্রামিক নিয়ে বৈঠক করেছেন এক সম্রাট, তাদের অভাব-অভিযোগ সরাসরি শুনবেন বলে, বিচারের পদ্ধতির আটটি স্তর, বিনিশ্চয়ামাত্য থেকে গণরাজ পর্যন্ত, অপরাধ অপ্রমাণ হলে এঁদের যে কেউ মুক্তি দিতে পারেন, কিন্তু গুরুতর অপরাধ হলে এতগুলো কোর্টে তা প্রমাণিত হতে হবে। একশো বছরের এদিক ওদিকে জন্মেছেন মহা বৈয়াকরণ পাণিনি, লোকোত্তর ও লোকায়তের মিলনের রূপকার যাজ্ঞবল্ক্য, বিদ্রোহী রৈক্ক মহাবীর, গৌতম, উপনিষদগুলি রচিত হচ্ছে, সঙ্কলিত হচ্ছে সূত্র-সাহিত্য। প্রব্রজ্যা-বাতিকে গৌতম গুরুমশাইকে নিয়ে রাজগৃহের লোক তামাশা করে ছড়া বাঁধল। কিন্তু এই বেদবিরোধী শ্রমণকেই দূর থেকে আসতে দেখেই আবার বেদপন্থী ব্রাহ্মণ শিষ্যসামন্তদের সাবধান করছেন—‘অত গোল করো না, শ্রমণ গৌতম গোলমাল ভালোবাসেন না।’ বুদ্ধের সময়ে আথেন্সে সোক্রাতিসকে বিষপানে বাধ্য করল তাঁর রাষ্ট্র, কিন্তু বুদ্ধযুগে তো একা বুদ্ধ নয়। ছটি (মোট তেষট্টিটি) শক্তিশালী বেদবিরোধী শ্ৰমণপন্থ ছিল, কই কোনও ধর্মোন্মাদ তো তাদের হত্যার পরোয়ানা বার করেনি? দেবদত্ত গৌতমকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা ব্যক্তিগত অসূয়াপ্রসূত, এবং শেষ পর্যন্ত জনসাধারণ তা সমর্থন করেনি। তবে? এই-ই কি সেই আধুনিক যুগ নয়, যা জিজ্ঞাসা করে, মীমাংসা চায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবার সাহস রাখে! আরও কত জিজ্ঞাসু সন্ধিৎসু কর্মবীর তা হলে সে যুগে থাকা সম্ভব যাঁরা নতুন চিন্তা করেছেন কিন্তু রয়ে গেছেন ইতিবৃত্তের আড়ালে! এবং হায় বুদ্ধযুগের নারীকুল। প্রায়শই উচ্চশিক্ষিত, ব্যক্তিত্বময়ী, পূর্ণবিকশিত কিন্তু সামনে কোনও পথ খোলা পাননি। প্রব্রজ্যাই একমাত্র বিদ্রোহ যা তাঁরা করতে পেরেছেন। ব্যর্থ এবং আবারও ট্র্যাজিক। এঁদের সবাইকে নিয়েই প্রধানত ‘মৈত্রেয় জাতক’-এর যাত্রা।
বুদ্ধোক্ত সেই মেসায়া যাঁর নাম মৈত্রেয়, তিনি আজও আসেননি। আরও আড়াই হাজার বছর নাকি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পরবর্তী যুগের চিন্তাবীররা যেমন রুসো-মার্কস-টলস্টয়-গান্ধী-রাসেল-রবীন্দ্রনাথ-শ্রীঅরবিন্দ এঁদের মধ্যে মৈত্রেয়র পদধ্বনি শোনা গেছে, কিন্তু আসেননি সেই মুক্তিবাদী যিনি পারবেন মানুষকে মৈত্রীবদ্ধ করতে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে, ব্যক্তিগত জীবনযাপনে, হৃদয়বৃত্তিতে ও মননে। হয়তো মৈত্রেয় কোনও মানুষ নয়, হয়তো তা যুগ যুগান্তরের নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার ফলে উদ্ভূত এক মানসিকতা যা সভ্যতা-সংস্কৃতির মধ্যে যা শ্রেষ্ঠ তার সঙ্গে মানুষের আদিম অপাপবিদ্ধ সরলতার মিলন না হলে জাত হবার নয়। কিংবা হয়তো তা জাত হবে তখনই, ভেদ-নির্ভর এই সভ্যতা যখন শেষ সর্বনাশকে মুখোমুখি প্রত্যক্ষ করবে। মৈত্রী ছাড়া যখন অন্য পন্থা থাকবে না।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
ডাঃ দেবার্চনা সরকার তাঁর ‘পালিসাহিত্যের ভূগোল’ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি পড়তে দিয়ে আমার অশেষ উপকার করেন!
শ্ৰীমতী গৌরী ধর্মপাল, ডঃ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও ডঃ রণবীর চক্রবর্তীর কাছে আমি বিশেষভাবে ঋণী।
গ্রন্থসংগ্রহে সহায়তা করে আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন—সর্বশ্রী বীরেশ্বর ঘোষ, শংকরলাল ভট্টাচার্য, অরুণ ঘোষ এবং অধ্যাপিকা—নিয়তি রায়, নমিতা মিত্র, অশোকা চট্টোপাধ্যায়, অলোকা মিত্র ও শিখা মজুমদার।
প্রথম পর্ব
“গড্ডলিকার সহবাসে উত্ত্যক্ত
তারা খুঁজেছিল সাযুজ্য সংরক্ত;
কল্পতরুর নতশাখে সংসক্ত
শুক্ল শশীরে ভেবেছিল করগত।”
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
.
মগধের রাজধানী রাজগৃহ-গিরিব্রজের বৈপুল্লগিরির ওপর থেকে এক ব্যক্তি নেমে আসছিলেন। সময় অপরাহ্ণ। সূর্যাস্তের দেরি আছে। কিন্তু সময়টা এমনই যে কখন সূর্যাস্ত হবে টের পাওয়া না-ও যেতে পারে। পাহাড়ের গা সুকঠিন শিলাময়। লেশমাত্র শ্যামলতা নেই। কিন্তু পর্বতের যে কোনও অংশে দাঁড়িয়ে চারদিকে দৃষ্টিপাত করলে নিবিড় ঘন শ্যামলিমার বিপুল আয়োজন দেখা যায়। ধানক্ষেতগুলিতে সবুজ সজীব ধানগাছগুলি হাওয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে। বনে-উপবনে নগরপথের দু-প্রান্তের বীথিকায় গৃহসংলগ্ন উদ্যানগুলিতে এবং সর্বোপরি নগরের প্রান্তিক অটবীতে সবুজ উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে। ভারে ভারে সবুজ। বহু বর্ণচ্ছায়ের। তাম্রাভ সবুজ, নতুন কদলীপত্রের সবুজ, বৈদুর্য মণির, মরকত মণির সবুজ, গাঢ় কৃষ্ণাভ সবুজ। থরে-বিথরে। গত কয়েক দিন দণ্ড কয়েকের বৃষ্টিপাতে প্রকৃতি সজীব, পরিচ্ছন্ন, সহর্ষ, প্রাণময় হয়ে উঠেছে। বর্ষা এসে যাচ্ছে শীঘ্রই। এসে গেছে। পূর্ব দিকপ্রান্ত থেকে অরণ্যের তরুসম্ভার দলিত মথিত করে বেগবান বারিগর্ভ হাওয়া বইতে থাকবে। প্রথমে যখন তখন ঝড়বৃষ্টি প্রচুর ধুলো উড়িয়ে। তারপর বৃষ্টি। শুধু বৃষ্টি। এখন থেকে থেকেই মাঝে মাঝে উড়ন্ত মৈনাকগিরির মতো বিপুলাকার ঘন নীলবর্ণ মেঘ দেখা যাচ্ছে। নগরের বাপী, তড়াগ, পুষ্করিণীর পরিষ্কার জলে মুকুরিত হয় এই মেঘরাজ। জলকেলিতে মত্ত নগরের মেয়েরা কৃত্রিম ভয়ে ভুরু দুটি ওপর দিকে তুলে পরস্পরকে দেখায় মেঘরাজের অবর্ণনীয় পুরুষশোভা। তারপর সাহসিকার মতো কলহাস্যে ঝাঁপ দেয় মেঘরাজের বক্ষপট লক্ষ্য করে। এটা তাদের খুব প্রিয় খেলা। উদ্যানের মধ্যে কোনও তড়াগের পাশে দাঁড়ালে তাদের লীলাচাপল্য শোনা যাবে। যেমন শ্রেষ্ঠী অহিপারকের অন্তঃপুরের দীর্ঘিকায়।
—এমন উদার বক্ষপট আর কোথায় পাবি বল, মাধবিকা, আলিঙ্গনে এমন সুখ…
—আর যেখানেই পাই তোর বা আমার গেহে কখনও নয়—
—সাহস তো তোদের বাড়ছে দেখছি দিন দিন! পতিনিন্দা করছিস! গহপতির কানে গেলে কী হবে ভেবে দেখেছিস?
—রাখ্, রাখ্, পুষ্পমালিকা, ভাবনাগুলো সব শুদ্ধান্তঃপুরে গহপতির ধর্মপত্নীর পেটিকায় বন্ধ করে এসেছি আমরা। তুই কি তোর পতিকে নীবিবন্ধে বেঁধে এনেছিস নাকি? এনে থাকিস তো বাঁধন খুলে নামিয়ে দে, একটু নাচাই।
পুষ্পমালিকার স্বামী খর্বাকার, কৃশকায়। মাধবিকার কথায় সে রাগ করে দীর্ঘিকার ঘাট থেকে উঠে পড়ে। তার মুখে অকালসন্ধ্যা।
মাধবিকা শৃঙ্গী মাছের মতো ওলোট-পালোট খেতে খেতে ঘাটের কাছে এসে জলসিক্ত মুখটি তুলে বলে, ‘রাগ করিস কেন পুষ্প, কেমন করে নাচাব জানিস? এই পুবে হাওয়া যেমন করে দীঘির জলকে নাচাচ্ছে! তেমন। ধর্মপত্নীর সইয়েদের তো এটুকু অধিকার থাকেই, থাকে না?
পুষ্পমালিকার চোখে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে। সে বোধ হয় অন্যদের মতো রসিকা নয়, কোথায় একটু বঞ্চনা, একটু ক্ষোভ, একটু অসন্তোষ তাকে অভিমানী করে তুলেছে। সে দীর্ঘাঙ্গী, কুরঙ্গনয়না রমণী। স্বামীর আকৃতি পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও প্রাণপণে মানিয়ে নিচ্ছে। স্বামী তার আঁচলে বাঁধা এইটুকুই যা সুখ। সে প্রতিবেশিনীদের রসিকতায় তার স্বামীর খর্বতা, স্ত্রৈণতা, সব কিছুর প্রতিই নিষ্ঠুর কটাক্ষ লক্ষ করেছে। হঠাৎ সে মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিল, ‘কথা ঢাকবার জন্য এত করছিস কেন মাধবিকা, দীঘির জল-টল বলে আমাকে ভোলাবারই বা প্রয়োজন কী? মর্কট, সোজাসুজি মর্কটই বল না তাকে! তবে আমি তো তোর মতো স্বয়ংবরা হইনি। তোর মুখে নিজের মনোনীত পতির নিন্দা মানায় না।’ পুস্পমালিকা তার বৈকালিক স্নান না সেরেই দ্রুত চলে গেল।
মাধবিকা টুপ করে ডুব দিল। ডুবসাঁতার দিয়ে বেশ কিছুদূর চলে গিয়ে সখী সুদত্তার পাশে ভেসে উঠল। তার কানে তীক্ষ্ণ স্বরে কু দিয়ে সমস্ত দীঘির জল তোলপাড় করতে করতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে বলতে লাগল, ‘এই দ্যাখ্ পতির বক্ষের অপ্রশস্ততা নিয়ে পরিহাস করেছি বলে অবীচি নরকে কেমন তপ্ত তৈলে ভাজা-ভাজা হচ্ছি।’ স্নানরত পুরকামিনীরা সবাই হেসে উঠতে রঙ্গরসিকতার স্রোত আবার বইতে থাকে। আকাশে গুড়গুড় ধ্বনি।
সুদত্তা মুখ তুলে বলে, ‘আরে আরে, স্বয়ং মেঘরাজ তোর রসিকতায় খুশি হয়েছেন। কেমন সমর্থন জানাচ্ছেন দ্যাখ্!’
সুদত্তার সতীন বারুণী বলল, ‘সমর্থন জানাচ্ছেন ভালো। আবার নিজেও রসিকতা আরম্ভ না করলেই বাঁচি। দীঘির ঘাটে আমার নতুন কুসুমবর্ণ নিচোলটি রেখেছি।
সুদত্তা বলল, ‘আমারটাও তো।’
‘আমারও, আমারও’ একটা রব উঠল।
মাধবিকা গাল ফুলিয়ে বিচিত্র উপায়ে মুখের জল ফোয়ারার মতো ওপর দিকে উচ্ছ্রিত করতে লাগল চিতসাঁতারে শুয়ে। জল ফুরিয়ে গেলে বলল, ‘আরে সই, যত গর্জে তো বর্ষে না, জানিস না?’
সকলে জল থেকে উঠে, দ্রুত বেশ-বাস বদলাতে লাগল। নিপুণ হাতে লোধ্ররেণু মাখল মুখে, কেশ যাদের সিক্ত ছিল সযত্নে আঁচড়ে মেলে দিল, যারা মাথা ডোবায়নি, তারা কবরী কিংবা বেণী রচনা করতে লাগল। ফুলের মালাগুলি কেশে, কণ্ঠে বিন্যস্ত করতে করতে সুদত্তা বলল, ‘পুষ্পমালা কিন্তু গর্জালোও যত, বর্ষালোও তত।’ কলহাসিতে লতায়িত হতে হতে পুরকামিনীদের দলটি উদ্যানপথে গৃহের দিকে চলতে লাগল।
হ্যাঁ, কী বলছিলাম! বৈপুল্ল পর্বতশিখর থেকে এক ব্যক্তি নেমে আসছিলেন। নামতে নামতে বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। দেখছিলেন আকাশের পশ্চিম পট মার্জিত নীল। পূর্ব কোণ থেকে মেঘপতি যেন এক গোপন একক বিজয়-অভিযানে বার হয়ে ধীরে ধীরে সমস্ত নভোমণ্ডল জয় করে নিতে চান। কতকগুলো দিন আসে যখন আকাশের স্বাভাবিক নীলিমা ধূম্রজালিকার মতো মেঘজালিকায় আচ্ছন্ন থাকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। মুক্তাফলের মতো এক অবর্ণ ছায়া-লাবণ্যে উদ্ভাসিত থাকে এই অপূর্ব নগরী, তার প্রান্তবর্তী গভীর অরণ্য এবং কর্মোপলক্ষে নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গতায়াতরত নাগরিকদের মুখচ্ছবি। বৃষ্টির চেয়ে কিছু কম মনোহর নয় সে দৃশ্যও।
মানুষটিকে দেখলে প্রৌঢ় জটিল সন্ন্যাসী বলে মনে হয়। সামান্য অধোবাস ছাড়া অঙ্গে আর কিছু নেই। জটাক্রান্ত কেশ। মুখে দৃঢ় কতকগুলি বলিরেখা। পা দুটি খালি। কিন্তু ব্যক্তি বয়সের তুলনায় খুবই ক্ষিপ্র, হস্তপদচালনায় রীতিমতো দক্ষ। মুখমণ্ডলে বলিরেখা থাকলেও দেহের অন্যান্য স্থানের ত্বক মসৃণ, দীর্ঘ দিনের অমার্জনা ও ভস্মাচ্ছাদন সত্ত্বেও গাত্রবর্ণ যে এক সময়ে রক্তাভ শ্বেত ছিল বোঝা যায়। চোখের দৃষ্টি একই সঙ্গে গভীর এবং তীক্ষ্ণ। তিনি যেন এক চোখে পথের খুঁটিনাটি দেখে নিচ্ছেন। আর এক চোখে দেখছেন আকাশ, অরণ্য, কোনও দূরবর্তী দেশ, দূরবর্তী সময়। এই আত্মমগ্নতা ও সতর্কতার সহবাস মানুষটিকে এই পরিবেশে অভিনব বলে চিনতে সাহায্য করে।
রাজপথে পৌঁছে ব্যক্তির চলার গতি মন্দ হয়ে এলো। তিনি মাথার পেছনে প্রলম্বিত জটাভারের এক অংশ সামনের দিকে টেনে আনলেন এবং নীরবে পথ অতিক্রম করতে লাগলেন। পদক্ষেপ অতি ক্ষিপ্র; তাঁর যেন খুবই তাড়া আছে। অন্য কোনও পথচারী সামনে পড়লে সে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিচ্ছিল। রাজধানীর পথে পথে সন্ন্যাসী, আজীবক, শ্ৰমণ, তীর্থিকদের স্বতই দেখা যায়। এরা বিভিন্ন স্থান থেকে আসেন। গ্রাম গ্রামান্তর তো বটেই, দেশ দেশান্তর থেকেও আসেন। ভিক্ষান্নই তাঁদের সম্বল। দৈহিক সুখ ও আরামের দিকে এঁরা দৃক্পাত পর্যন্ত করেন না। মাঝে মাঝেই বিতর্কসভা বসে, রাজগৃহে তো স্বয়ং রাজা বিম্বিসারই এমন অনেক কৌতূহলশালা নির্মাণ করে দিয়েছেন অতি সুন্দর সুন্দর উদ্যানের মধ্যে। ভ্রাম্যমাণ তীর্থিক আজীবকরা ইচ্ছামতো সেখানে অবস্থান করতে পারেন, বিতর্কে বা ধর্মসভায় যোগ দিতে পারেন। তখন জ্ঞানপিপাসু, ধর্মপিপাসু প্রজারা ছাড়াও রাজা, শ্ৰেষ্ঠী, অমাত্য, রাজন্যরা সেখানে আসেন, শ্রদ্ধাভরে শোনেন, প্রশ্ন করেন। রাজগৃহে সংসারত্যাগী এইসব নানান শ্রেণীর সন্ন্যাসীদের খুবই সমাদর। চূড়ান্ত ভোগ-বিলাস আর চূড়ান্ত কৃচ্ছ্র—দুই-ই এখানে পাশাপাশি দেখা যায়।
সন্ন্যাসী কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করে চলছিলেন। পথের দুধারে কিছুদূর অন্তর অন্তর নানান আপণ। বহুবিধ পণ্যভারে সুসজ্জিত। তবে এগুলি বেশির ভাগই বিলাসের দ্রব্য। মালা, গন্ধদ্রব্য, অবলেপ্য, বেলী, জাতী, চম্পা, কেতকী ইত্যাদি পুষ্প এবং চন্দন, অগুরু, কস্তুরী ইত্যাদি সুরভিসারের গন্ধে পথ আমোদিত। কয়েকটি শৌণ্ডিকালয়ও আছে। এই ধরনের একটি শৌণ্ডিকগৃহ থেকে সহসা এক ব্যক্তি উঠে এসে সন্ন্যাসীর গতি রোধ করল। ব্যক্তিটির গলায় জাতীপুষ্পের মালা, কস্তুরী সুবাসিত উত্তরীয়টি বর্ষার হাওয়ায় উড়ছে। সে মৃদুস্বরে বলল, ‘কী হে সন্ন্যাসী, এই যুবাবয়সে সন্ন্যাসগ্রহণ করে আত্মাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন? চলো দেখি, আমার সঙ্গে পানাগারে চলো, এক সন্ধ্যাতেই তোমার কপাল কেমন ভ্রূকুটিহীন করে দিই দ্যাখো।’
সন্ন্যাসী ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘দেখছ না আমি বৃদ্ধ সন্ন্যাসী! পথ ছাড় নাগরক, আমি তোমার পরিহাসের পাত্র নই।’
নিম্ন কণ্ঠে নাগরিক বলল, ‘বৃদ্ধ নয় ভণ্ড। জটিলক নয় কুটিলক এবং চতুরক। ভালো চাও তো আমাকে অনুসরণ করো, তারপর তুমি পরিহাসের পাত্র না অপাত্ৰ বোঝা যাবে।’
সন্ন্যাসী স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন, নাগরিক বলল, ‘লঠঠিবন চেনো? লঠ্ঠিবন? অবিলম্বে চলে এসো সেখানে নয় তো তোমার প্রাণসংশয়!’
নাগরিক পানাগারের পাশে একটি পিঙ্গলবর্ণ ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। সন্ন্যাসী ইতস্তত তাকালেন। সায়ংকালীন ক্রয়-বিক্রয় ও আমোদ-প্রমোদে মত্ত মানুষেরা কেউই বোধ হয় এই ছোট্ট নাটকটি লক্ষ করেনি। তিনি সাধারণত এক পথ দিয়ে নিত্য যাতায়াত করেন না। কিন্তু যেদিন পাহাড়ে ওঠেন সেদিন এ পথ দিয়ে তাঁকে যেতেই হয়। লঠ্ঠিবন নগরীর উপান্তে। অশ্বারোহণে যাওয়া সহজ হলেও এই আসন্ন সন্ধ্যায় এতখানি পথ পদব্রজে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। কিন্তু মাল্যধারী নাগরিকের সাবধানবাণী এখনও কানে বাজছে, তিনি বিলম্ব করলেন না। তাড়াতাড়ি পা চালালেন।
কিছু পথ চলবার পর তিনি লক্ষ করলেন—তাঁর প্রায় পাশাপাশি একটি চতুর্দোলা চলেছে। নিশ্চয় দোলাটি তাঁর অনেক পেছনে ছিল। চার জোড়া পায়ের ছোটার গতিতে এখন কাছে চলে এসেছে। যেন বড্ড কাছে। চতুর্দোলার আচ্ছাদন সরিয়ে একটি হাত ও একটি শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ বেরিয়ে আসছে দেখতে পেলেন সন্ন্যাসী।
—ভগবন্, আপনি কোথায় যাবেন?
ঈষৎ ভাবলেন সন্ন্যাসী, তারপর বললেন, ‘লঠ্ঠিবন।’
—সন্ধ্যার আর বিলম্ব নেই। একবার ছায়া পড়ে গেলে লঠ্ঠিবনে শতসহস্র জোনাকি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না। আসুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি। এ আবার কী? বিপদ? নতুন বিপদ?
‘আসুন’—অন্তরালবর্তীর কণ্ঠে অনুরোধের চেয়ে আদেশের সুরই যেন প্রবল। দ্বিরুক্তি না করে মাটিতে রক্ষিত চতুর্দোলায় প্রবেশ করলেন সন্ন্যাসী, আচ্ছাদন বন্ধ হয়ে গেল।
অভ্যন্তরের অন্ধকারে মনে হল ব্যক্তিটির পরনে শ্রেষ্ঠীবেশ। নবীন বলেই মনে হয়, অন্তত কণ্ঠস্বর থেকে। কিন্তু শিরোভূষণ, ঘন কৃষ্ণ শ্মশ্রু, গুম্ফ ও চতুর্দোলার ভেতরের অন্ধকার মিলিয়ে বিশেষ কিছুই বোঝা গেল না। বৃথা বাক্যব্যয়ও করলেন না ব্যক্তি। যেন এই উপকারটুকু করা ছাড়া সন্ন্যাসী, তাঁর গন্তব্য, ইত্যাদি সম্পর্কে কোনও কৌতূহলই নেই তাঁর। সন্ন্যাসী নিজেও সতর্ক হয়ে আছেন, কথা বলার ইচ্ছা নেই। সমীচীনও হবে না সেটা। তিনি সারাটা পথ চুপ করে রইলেন। লঠ্ঠিবনের প্রান্তে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে চতুর্দোলাটি দ্বিগুণ হুম্ হুম্ শব্দে চলে গেল। সন্ন্যাসী খানিকটা চলবার পর দেখলেন অদূরে একটি সুদীর্ঘ পিপ্পল বৃক্ষের নিচে অশ্বটিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পদচারণা করছে তাঁর পূর্ব পরিচিত নাগরিক।
—যাক, সন্ধ্যা গাঢ় হবার পূর্বেই পৌঁছে গেছ দেখছি। গৃহত্যাগ করলে কী হয়, প্রাণের ভয় ঠিকই আছে! নাগরিকের মুখে যেন কৌতুকের হাসি।
সন্ন্যাসী রুক্ষস্বরে বললেন, ‘ডেকেছ কেন? শীঘ্র বলো, সময় নেই।’
নাগরিক অতর্কিতে দু পা সামনে এগিয়ে এসে তাঁর গুরুভার জটায় এক টান দিল, জটাভার তার হাতে খুলে এলো, প্রকাশিত হল স্বর্ণাভ কৃষ্ণ কেশ। নাগরিক বলল, ‘ভণ্ড সন্ন্যাসী! অদূরে সরোবর রয়েছে। আমার সঙ্গে এসো। মুখেও অনেক আঁকিবুকি কেটেছ, সেগুলি ভালো করে ধোও, আমি তোমার আসল মুখ দেখতে চাই।’
—‘মুখ দেখার দরকার নেই।’ ব্যক্তি বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বর একেবারেই বিচলিত নয়। ‘স্বীকার করছি আমি ছদ্মবেশ ধারণ করেছি কিন্তু সব ছদ্মবেশই প্রতারণার জন্য নয়। আত্মরক্ষার জন্যও কখনও কখনও ছদ্মবেশের প্রয়োজন হয়। আপনি কী জানতে চান, বলুন। উত্তর পাবেন।’
—নাম বলো। তরোয়াল আস্ফালন করে নাগরিক বলল।
—কাত্যায়ন চণক, নিবাস তক্ষশিলা।
—এমনটাই অনুমান করেছিলাম। উত্তরদেশ। তবে আমি ভেবেছিলাম আরও উত্তর। কাশ্মীর। উদীচ্য ব্রাহ্মণ?
—আপাতত।
—অর্থাৎ?
—আপাতত ব্রাহ্মণবৃত্তিতেই নিযুক্ত। কিন্তু প্রকৃত দ্বিজ তার শিক্ষানুযায়ী যে কোনও বৃত্তি নেবে। পরিবর্তনও হতে পারে।
—বটে! সুদূর তক্ষশিলা থেকে রাজগৃহে ছদ্মবেশের কারণ?
—তার আগে তোমার পরিচয় দাও নাগরক।
—যদি না দিই।
—আর একটি বাক্যও বলব না।
—বিদেশি চরের শাস্তি জানা আছে?
—শূলদণ্ড? না আমকশ্মশানে গলা অবধি জীবন্ত সমাধি? তবে ধরতে পারলে দেশি চরের বোধ হয় কিছু পুরস্কারও প্রাপ্য হয়। তক্ষশিলায় তো পুরস্কারের মূল্য ছয় শত কার্ষাপণ। মগধে কত?
নাগরিকের মুখ ধীরে ধীরে হাসিতে ভরে গেল। সে বলল, ‘বুঝতে যখন পেরেছ, তখন নামে প্রয়োজন কী? তক্ষশিলায় চরের নাম থাকলেও মগধে চরেরা অনামক।’
সন্ন্যাসীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, তিনি বললেন, ‘গান্ধারবাসী প্রয়োজনে ছদ্মবেশ ধারণ করলেও, প্রয়োজনের বাইরে মিথ্যা কথা বলে না। আমি কাত্যায়ন গোত্রীয়। দেবরাত পুত্র চণক। নিবাস তক্ষশিলা। দেবরাত-পুত্র এই পরিচয়ের প্রকৃত গুরুত্ব তুমি বুঝতে না পারো মাগধ, তোমার প্রভু সম্যক বুঝতে পারবেন। আমি এদেশে ভাগ্যান্বেষণে এসেছি। তা ছাড়াও কিছু রাজকার্য আছে। দুটিকে একত্র করেছি। যথাসময়ে প্রকাশ পাবে। তোমার প্রভুর কাছে নিয়ে গেলে গান্ধাররাজের অঙ্গুরীয় দেখাব।’
—তুমি কি দূত?
—ধরো একপ্রকার তাই।
—তাহলে রাজসভায় গিয়ে রাজদর্শন প্রার্থনা না করে জটা মাথায় নিয়ে ছদ্মবেশে পাহাড়ে পাহাড়ে ভ্রমণ করছ কেন? বিস্ময়ের সঙ্গে শ্লেষ মিশিয়ে নাগরিক বলল।
—কারণ আছে। যথাসময়ে রাজদর্শন হবে।
—ভালো। কিন্তু সে পর্যন্ত তুমি আমার দৃষ্টিবন্দী রইলে, জেনো।
—‘থাকি। ক্ষতি কী?’ উদাসীন স্বরে বললেন চণক, ‘আমি তাহলে এখন যেতে পারি অনামক মাগধ?’
হালকা অন্ধকারে এবার যষ্টিবনে ইতস্তত জোনাকি জ্বলতে শুরু করেছে। একটু দূরের ঝোপ বা কুঞ্জগুলি কুণ্ডলীকৃত অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে। মাগধ তার অশ্বের গলায় হাত বোলাচ্ছে। মুখে মৃদু হাসি। সন্ন্যাসীবেশী চণক বেরিয়ে এলেন।
আয়তনে খুব বড় নয় নতুন রাজগৃহ নগর। পদব্রজেই এর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যেতে যে পারেন না চণক তা নয়। কিন্তু এখন সন্ধ্যা ঘনায়মান। প্রধান পথগুলির ধারে ধারে দীপদণ্ড পথ আলোকিত করে বটে, কিন্তু যষ্টিবন নগরীর উপান্তে। এই উপান্ত থেকে যথেষ্ট দূরে যেতে হবে তাঁকে। মহারণ্য ঘিরে আছে নগরীর দক্ষিণ পূর্ব দিক। সেই দিকেই যাবেন তিনি। এখনও বাতাস বইছে পুব দিক থেকে। হাওয়া নির্মল, যেন একটু জলকণাবাহী। গান্ধারদেশে এমন হাওয়া নেই। গ্রীষ্মে সেখানে তপ্ত কটাহের মতো আবহাওয়া হয়। শীত নিদারুণ। শুষ্ক শীত। তা হোক, পশুরোমবস্ত্র দিয়ে সে শীত উপভোগ করা যায়। কিন্তু, এই পুবদেশের মতো বৃষ্টি সেখানে হয়ই না বলতে গেলে। এই বৃষ্টি একটা বিস্ময়, একটা অবর্ণনীয় আনন্দের ব্যাপার। বৃষ্টি চণককে মুগ্ধ সম্মোহিত করেছে। তিনি শীতল বাতাসের স্রোতের মধ্য দিয়ে যেতে থাকেন ধীরে ধীরে। ভাবতে থাকেন পুব দিকে সূর্য ওঠে, এই বাতাস আসছে সেই সূর্য ওঠার দেশ থেকে। সে দেশ কেমন? আদৌ দেশ কী? না সাগর? না এমনই বন শুধু, না মহাবন। এই হাওয়ার উৎপত্তি হল কোথা থেকে? এত জলই বা কোথা থেকে নিয়ে আসে। যেন অফুরান জলের সঞ্চয়! নিশ্চয় অকূল বারিধি ওদিকে। চলতে চলতে চণকের মনে হল দুটি পায়ের বদলে যদি তাঁর দুটি ডানা থাকত! ধৃতরাষ্ট্র হংসের মতো সোনার বরণ বিশাল দুটি ডানা! তাহলে তিনি এই মুহূর্তে এই নগরীর কোনও প্রাসাদচূড়ায় গিয়ে বসতেন। তারপর গৃধ্রকূট শিখরে। একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিতেন চারপাশ। তারপর ঝাঁপ দিয়ে পড়তেন এই বাতাসের স্রোতের উলটো দিকে। পূর্বাচল। নগরী, গ্রাম, নদনদী, মহারণ্য পার হয়ে চলে যেতেন পুবালি হাওয়ার দেশে।
নগরের দক্ষিণ প্রান্তের অরণ্যে চণকের বাস। যে আটবিকেরা তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে নিজেদের আবাসের কিছু দূরে, তিনি তাদের নিয়মিত প্রদীপের তেল ও ধান্যজাত নানা দ্রব্য সরবরাহ করেন। এইসব বস্তু ওই আটবিকেরা চায়নি। কিন্তু পেলে ভারি প্রসন্ন হয়। ওরা নির্জনতাপ্রিয়, নিজেদের গোষ্ঠীর বাইরে কাউকে, বিশেষত শ্বেতকায়দের একেবারে সহ্য করতে পারে না। বনের ফল, মধু, আপনাআপনি গজিয়ে ওঠা নীবার ধান এবং মৃগয়ালব্ধ পশুমাংস—এই তাদের খাদ্য। অভাববোধ বলে কিছু নেই। কিন্তু অত্যন্ত স্বাধীনতাপ্রিয়। স্বভাবে হিংস্র। তবে কিছুদিন বাস করতে করতে চণক বুঝেছেন এ হিংসা এসেছে সংশয় থেকে, নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকে। স্বভাবে না বলে আচরণে হিংস্র বলাই ভালো। চণক তাঁর অর্ধমলিন সন্ন্যাসী বেশ দিয়ে এদের ভুলিয়েছেন। তেল, শর্করা, লবণ দিয়ে এদের মন জয় করেছেন। অপরাহ্ণ চার ঘটিকার মধ্যেই অরণ্যে অন্ধকার নেমে আসে। দেখতে দেখতে নিবিড়, নিচ্ছিদ্র হয়ে যায় সেই অন্ধকার। সেই তমিস্রায় ছোট ছোট মাটির কুটিরে প্রদীপ জ্বালিয়ে আটবিকেরা পরম বিস্ময়ে ও উল্লাসে চেয়ে থাকে দীপশিখার দিকে। নাচ গান আমোদে মাতে। ডিম, ডিম, ডিমাডিম, অনেক রাত পর্যন্ত শুনতে পান চণক। কৃতজ্ঞতাবশে তারা চণকের কুটির প্রতিদিন পরিচ্ছন্ন রাখে, তিনি ভালোবাসেন বলে বহু প্রকারের কুসুম চয়ন করে মাটির পাত্রে জলে ভিজিয়ে রেখে দেয়। স্থূল, এবড়ো-খেবড়ো মাটির পাত্র। স্থূলদের কুম্ভকারের চক্র নেই। তাঁর কুটিরটিও তারাই রচনা করে দিয়েছে। নিয়মিত মধু, ফলমূল, কখনও কখনও ঝলসানো মৃগ কি বরাহমাংসও তাঁর জন্য রেখে যায় ওরা। এবং একটি দীপ জ্বেলে রাখে।
অরণ্যে প্রবেশ করার সময়ে পেছনে ঘাড় না ফিরিয়েও চণক সতর্ক হলেন। মগধের চরেরা তাঁর প্রতি লক্ষ রাখছে এ তো সকালের আলোর মতো স্পষ্ট। কিন্তু এখনও কি কেউ পেছনে আছে? আটবিকরা মাগধদের ভয় পায়, ঘৃণা করে। ঘৃণা উভয়ত। ভয়ও তাই। নগরে অনেক সময়েই চণক শুনেছেন কোনও শিশু হয়ত বিপণির সামনে বায়না ধরেছে, খেলনার জন্য, হয়ত খেলনাটি মহার্ঘ, তার পিতা তাকে ভয় দেখাচ্ছেন ‘বনে রাক্ষস আছে, লম্বা লম্বা কালো কালো হাত পা, ছোট ছেলেদের মুণ্ডু কাঁচা চিবিয়ে খায়, বিশেষ করে কাঁদুনে ছেলেদের!’ এইভাবে এদের নিয়ে কত কথা, কত কাহিনী তৈরি হয়, ভয় আর ঘৃণার মিশ্রণ দিয়ে।
যদিও তাদের আবাস কিছুটা দূরে, তবু চণকের সঙ্গে আটবিকদের যোগাযোগ আবিষ্কৃত হলে মাগধরা যদি আটবিকদের ওপর কোনও অত্যাচার করে? তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না চণক। আরও একটি সমস্যা আছে। তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করে আছেন। ছদ্মবেশ আজ মগধের গূঢ় পুরুষের কাছে প্রকাশিত হয়েছে। এখন যে কোনদিন ছদ্মবেশ তাঁকে ত্যাগ করতে হতে পারে। তখন! তখন তাঁর আশ্রয়দাতা আরণ্যকরা তাঁকে কীভাবে নেবে? স্বেচ্ছালালিত মলিনতার তলায় তাঁর রক্তপদ্মসন্নিভ গাত্রবর্ণ দেখলে যদি তারা বিদ্বেষ বোধ করে! তাঁকে ছদ্মবেশী জানলে তারা তাঁকেও ঘৃণা করবে এটাই স্বাভাবিক। কোনও রকম কপটতা, শঠতা, খলতা তারা সহ্য করতে পারে না, কাপট্যের জন্যই তারা নাগরিকদের আরও ঘৃণা করে। এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে চণক তাঁর কুটিরের দীপালোক দেখতে পেলেন। গলিত কালিমার মধ্যে এক বিন্দু স্বর্ণখণ্ডের মতো জ্বলছে। দেখতে দেখতে কেমন হৃষ্ট হয়ে উঠলেন চণক।
কুটিরের চারপাশ খানিকটা পরিষ্কৃত। ঝোপঝাড় কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে কিছু বন্য কুসুমের গাছ। কোনও কোনও নিশীথ পুষ্পের গন্ধে আকুলিত হয়ে আছে কুটিরের চারদিকের বাতাস। এই গন্ধে সাপ চলে আসে চণক জানেন, তিনি সাবধানে পা ফেলতে লাগলেন। কিছু দূর থেকেই আরম্ভ হয়েছে দীর্ঘ সব বনস্পতির রাজ্য। সেদিকে তাকালে আর দৃষ্টি চলে না। এই অরণ্যে তেমন কোনও হিংস্র শ্বাপদ নেই। আটবিকরা এবং মগধের ক্ষত্রিয় কুমাররা মৃগয়া করে করে তাদের সব যম-সদনে পাঠিয়ে দিয়েছে। আছে এখন শৃগাল, নানা ধরনের মৃগ, শশক, বন্যবরাহ এবং বহু রকমের পাখি। এখনও। কুটিরের প্রবেশপথে একটি দীর্ঘ ছায়া দেখলেন চণক। প্রদীপ জ্বালিয়ে অদূরে বসে আছে অটবীকুমারী রগ্গা। মাথা অনেকটা নিচু করে। নিচু দ্বারপথে তিনি প্রবেশ করতে রগ্গা উঠে দাঁড়াল। নাতিদীর্ঘ কিন্তু ভারি সুগঠিত ঘোর কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটি। তার বক্ষোদেশ অনাবৃত। এই বনের অজস্র কচি কাঁচা বিল্বফলের মতো বক্ষ দুটি তার। নিম্নাঙ্গে একটি পিটিয়ে নরম করা বল্কল। তার মাথার অজস্র ধুলোমাখা কালো চুল তার বুক এবং পিঠ প্রায় ঢেকে রেখেছে। চুলগুলির দিকে তাকিয়ে মনে মনে জিহ্বা দংশন করলেন চণক।
রগ্গা আবদারের সুরে বলল, ‘যতি, এনেছিস আমার কাঁকই?’
চণক বললেন, ‘আজ নগরে কিছু বিপদে পড়েছিলাম রগ্গা, আনতে পারিনি।’
রগ্গা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘রোজই তো তোর কিছু না-কিছু হয়। আনতে ভুলে যাস। অথচ খুড়োর জন্যে তেল, চাল এসব আনতে তো তোর ভুল হয় না!’ বলতে বলতে সে তার রুক্ষ কেশভার পুরোপুরি সামনে এনে তার মধ্য দিয়ে আঙুল চালাতে লাগল।
চণক বললেন, ‘আমি তো অনেকদিনই তোমায় বলেছি রগ্গা। আমি সন্ন্যাসী, কঙ্কতিকা কিনতে গেলে লোকে কী ভাববে?’
—তাহলে তাই-ই বল, বলিস না বিপদে পড়েছিলাম। আর যদি তাই-ই হয়, কাঁকই কিনতে যদি তোর অসুবিধেই হয় তো আমায় কথা দিয়েছিলি কেন? আসলে তোরা অজ্জরা সন্ন্যাসীই হোস আর যাই-ই হোস, বড্ড শঠ।
চমকে উঠলেন চণক। কী নিখুঁত চরিত্ৰজ্ঞান অরণ্যবালিকার! সত্যিই তিনি কঙ্কতিকার কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। রোজই ভুলে যান। রোজই মিথ্যা আশ্বাস দেন। শঠতা তো একেই বলে! আবার একে সভ্যতাও বলে। ভুলে গিয়েছিলেন একথা বললে মনে ওর কষ্ট দেওয়া হবে তাই অন্যভাবে বলা, আবার নিজের দোষ ঢাকবার জন্যও বলা। এই মিথ্যাচার তো সভ্যতার অঙ্গ। তিনি নম্র সুরে বললেন, ‘রগ্গা, আমি শাস্তিগ্রহণ করছি। তুমি আজ যা-যা আমার জন্য এনেছ সব নিয়ে যাও। যতদিন না তোমার কাঁকই এনে দিতে পারছি, তোমার কাছ থেকেও আমি কিছু গ্রহণ করব না।’
রগ্গা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর গা ঘেঁষে চিবুক ছুঁয়ে বলল, ‘তুই রাগ করলি?’
তিনি যে সন্ন্যাসী, নারীসান্নিধ্য পরিহার করে চলেন একথা রগ্গা জানে। কিন্তু মানে না। সে কিছুই মানতে চায় না। সে কাছে আসতেই একটা উগ্র বুনো গন্ধ পেলেন চণক। যেন অরণ্যের গায়ের গন্ধ। একটু সরে গিয়ে বললেন, ‘না, রাগ নয়। অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছি।’
প্রায়শ্চিত্ত কথাটা ভালো বুঝতে পারল না রগ্গা, দু একবার জিভে উচ্চারণ করল, ‘পারশ্চিত্ত? পারশ্চিত্ত?’ তারপর যেন মোটামুটি বুঝে নিল, সরল বিস্ময়ে বলল, ‘পারশ্চিত্ত করলে খাবি কী?’
—নিজে যা সংগ্রহ করতে পারি!
কিশোরীর চোখে ব্যথার ছায়া নামল। সে বলল, ‘তুই পাহাড়ে গিয়ে ধ্যান করবি? না আমাদের মতো ফলমূল কুড়োবি? চাই না আমার কাঁকই যতি, তুই হাত-পা ধুয়ে খেতে বোস, আমি যাই।’
সে আড়াল ছেড়ে সরে দাঁড়াতে চণক দেখলেন বড় বড় শালপত্র জোড়া দিয়ে তাঁর জন্য অগ্নিপক্ক মৃগমাংস এনে রেখেছে রগ্গা। সঙ্গে কিছু ফলমূল। তিনি নিকটবর্তী সরোবরে গিয়ে হাত-পা ধুয়ে এলে রগ্গা বলল, ‘আমি যাই রে যতি, বড্ড দেরি হয়ে গেছে, উদ্দক খুঁজবে।’ তার মুখে এখন রাগ অভিমানের চিহ্নমাত্র নেই। চণক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাবার আগেই সে বাতমৃগীর মতো চঞ্চল ছন্দে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। এই ঘন অন্ধকারেও কোথায় কোন গাছ, কোন ঝোপ, কিসের শাখা সরাতে হবে সে পরিষ্কার দিবালোকের মতো দেখতে পায়। পথ তার চেনা, আপন করতলের মতো মুখস্থ। বিশেষত সে এখন উদ্দকের কাছে যাচ্ছে। উদ্দক রগ্গার প্রণয়ী। এখনও উভয়ের বিবাহ হয়নি। অর্থাৎ রগ্গার খুড়ো মদ্যমাংসের ভোজটা দেননি। উদ্দকেরও হয়ত খুড়োকে কিছু দেওয়ার আছে। তবে উদ্দক ও রগ্গা প্রায়ই একসঙ্গে বাস করে।
এই আটবিকদের ভালো বোঝেন না চণক। পশ্চিম দেশ থেকে পুবে এসে প্রথম এদের দেখে ঘৃণায় শিহরিত হয়েছিলেন। এই অরণ্যে বাস করতে এসে তাঁর প্রথম ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হল এদের হাতে বন্দী হওয়া। সেদিনের কথা স্মরণ করলে আজও তাঁর রোমাঞ্চ হয়। একটি শিংশপা বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তিনি কুটির বাঁধবার উপযুক্ত স্থান অন্বেষণ করছিলেন। কাছাকাছি খুব বড় বড় গাছ থাকবে না, ঝোপগুলি সহজে কেটে ফেলা যাবে। অল্প দূরেই থাকবে কোনও জলের উৎস, অরণ্যের খুব গভীরেও নয়। আবার খুব প্রান্ত ঘেঁষেও নয় এমন একটি স্থান। সহসা পায়ের কাছে শনশন করে দুটি তীর এসে পড়ল। চমকে চোখ তুলে তাকাতেই গাছের আড়ালে আড়ালে কালো কালো ছায়া দেখলেন। লিকলিকে রোগা। কোমরে কৌপীন বস্ত্র। খালি গা। মাথায় তাম্রাভ রুক্ষ কেশ, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। হাতে ধনুক নিয়ে অতি ক্ষিপ্র গতিতে তারা তাঁকে গোল হয়ে ঘিরে ফেলল। তিনি বদ্ধাঞ্জলি নতজানু হয়ে বসলেন। কালো মানুষগুলি পরস্পরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল, তারপর একজন রূঢ় স্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কে?’
—দেখছ না আমি জটাধারী সন্ন্যাসী!
—আমাদের বনে এসেছিস কেন?
—সন্ন্যাসীরা হয় বনে, নয় গিরিগুহায়, নিভৃত স্থানে বাস করতে চায়। জানো না?
—তুই কি এখানে তপস্যা করবি? তোদের দেবতা ইন দ্রর আসন টলাবি?
—না ইন্দ্রের আসনের ওপর আমার লোভ নেই। নির্জনে ধ্যান করতে ভালোবাসি।
—কীরকমের তপস্বী তুই? মাথা নিচু করে ঝুলিস? না এক হাত ওপরে তুলে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকিস?
—কোনটাই করি না।
—গাছের খসে পড়া পাতা খেয়ে থাকিস? না পাতা পেড়ে খাস?
—কোনটাই না।
—তবে?
—ধ্যান করি। দিনান্তে একবার আহার করি। ফলমূল অন্ন মাংস যা জোটে!
এরপর আটবিকরা এসে তাঁকে পরীক্ষা করে। অস্ত্রশস্ত্র আছে কি না। চণকের অধোবাস বিশেষভাবে প্রস্তুত। দু তিনটি স্তর আছে তাতে। ভেতরে প্রকোষ্ঠে স্বর্ণমুদ্রা, শিকড়বাকড়, পর্ণ, কার্ষাপণ সেলাই করে বাঁধা। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, কিন্তু সন্ন্যাসীর প্রতি সম্ভ্রমবশতই বোধ হয় ওরা তাঁকে ভালো করে অনুসন্ধান করেনি।
এই মানুষগুলিই তাঁকে তাঁর রুচি ও প্রয়োজনমতো স্থান খুঁজে দিল। সরোবরতীরে বসিয়ে রেখে নিজেরাই কুটির বেঁধে দিল। যতই দেখছেন ততই এদের প্রতি তাঁর এক ধরনের শ্রদ্ধা ও মমতা বেড়ে যাচ্ছে। কালো মানুষরাও যে উন্নতনাসা স্বর্ণাভ গাত্রবর্ণের মানুষের মতোই মানুষ, অনেক বিষয়ে তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ সম্পর্কে তাঁর প্রত্যয় ক্রমশই দৃঢ় হচ্ছে। এদের বৃক্ষপূজা, লিঙ্গপূজা, নগ্নতা, নারী পুরুষের ইচ্ছামতো যৌনাচার, আমমাংস খাওয়া তিনি আগে অতি অরুচিকর বিকৃতি বলে মনে করতেন। এখন বলেন, নিজেকেই বলেন, বোঝেন না। ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা তার ক্রমশই লোপ পাচ্ছে। এদের যে চারিত্রিক গুণ যেমন অকপটতা, সহ্যশক্তি, বিনয়, সদা-সতর্কতা, সহজাত বুদ্ধি, বনের যাবতীয় পশুপাখি বৃক্ষ লতাদির গুণাগুণ সম্পর্কে জ্ঞান, বিশ্বস্ততা এইগুলির সঙ্গে যদি সভ্য মানুষের শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভা, বেশবাস, বাসস্থানের সৌকর্য ইত্যাদি যোগ হয় তাহলে কি আদর্শ মানুষ প্রস্তুত হবে? দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চণক ভাবেন—না, এগুলির সহাবস্থান বোধ হয় সম্ভব নয়। যে মুহূর্তে দেহ ঢাকবে সেই মুহূর্তেই মানুষ মনও ঢাকবে, উদ্দেশ্য ঢাকবে, চাতুর্য ব্যবহার করবে। সৌকর্য সুষমা ইত্যাদি থেকে আসবে ঘৃণা, লোভ, প্রতিভা থেকে আসবে ক্ষমতালিপ্সা।
আহার শেষ করে তিনি উচ্ছিষ্ট শালপাতাগুলি ঝোপের মধ্যে ফেলে দিলেন। সরোবর থেকে মুখ-হাত ধুয়ে কুটিরের মেঝে পরিষ্কার করলেন, তারপর শীতল মাটির মেঝেয় শুয়ে পড়লেন। রাত্রি আরও একটু গভীর হলে তবেই তিনি জটাটি খুলে রেখে একটু স্বস্তি পাবার চেষ্টা করবেন। এখনও সে সাহস করছেন না। অনেক সময়ে আটবিক পল্লী থেকে উদ্দক, রগ্গা কিংবা অন্য কেউ হঠাৎ এসে পড়ে। হয়ত সামান্য কোনও সমস্যা হয়েছে। এই সরল মানুষগুলিকে নাগরিক শিষ্টতা শেখানো সম্ভব নয়। তারা জানে, সন্ন্যাসী বহু রাত্রি অবধি ধ্যান-ধারণা করেন। নিজেদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সমস্যার কথা নিয়ে এই উচ্চ শ্রেণীর জ্ঞানীগুণী বন্ধু সন্ন্যাসীর কাছে রাতে আসা এমন কিছু একটা বিধিবহির্ভূত কাজ নয়। কয়েকদিন আগেই তো এসেছিল রগ্গার প্রণয়ী উদ্দক। তার সমস্যা অতি বিচিত্র। মৃগয়া করতে করতে সে অরণ্যের মধ্যে বহুদূর চলে গিয়েছিল একটি বরাহর পেছন পেছন। বরাহটিকে মারবার পর গোষ্ঠীর নিয়মমতো সে বরাহটিকে বয়ে নিয়ে আসেনি। একটি স্রোতস্বিনীর ধারে অরণিকাষ্ঠের সাহায্যে আগুন জ্বালিয়ে বরাহমাংস ঝলসিয়ে সে দুদিন ধরে অল্পে অল্পে খায়। তারপর যেটুকু বাকি ছিল নদীতীরে ফেলে গোষ্ঠীতে ফিরে আসে। উদ্দক তার এই অপরাধ সবার সামনে স্বীকার করতে সম্মত। খালি রগ্গাকে ভয় পায়। রগ্গা যদি তার সম্পর্কে বীতস্পৃহ হয়? উদ্দককে চণক মিথ্যাচারের পরামর্শ দিতে পারেননি কিছুতেই। রগ্গাকে তিনি বুঝিয়ে বলবেন এই আশ্বাস নিয়ে উদ্দক চলে যায়।
আজ সারা দিন অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশি পরিশ্রম হয়েছে। তবু উৎকণ্ঠায় ঘুম আসছে না চণকের। মগধের চর সহসা তাঁর ছদ্মবেশ ভেদ করায় কি তাঁর আত্মপ্রত্যয়ের ভিত শিথিল হয়ে গেছে? বোধ হয় তাঁর গণনা মতো কাজ হচ্ছে না। অজানা অচেনা এই মধ্যদেশ। পুব ঘেঁষে। এখানে বন ও নদনদী ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। তিনি জানতেন গঙ্গা-সিন্ধু-যমুনা বিধৌত এক জনবসতিপূর্ণ উত্তর পশ্চিমাঞ্চলকে। অচিরবতী, সরযূ বা মহীরও নাম শোনা ছিল কিন্তু পথে আসতে আসতে দেখেছেন ক্রমশই নদীর সংখ্যা বাড়ছে। উপনদী শাখানদী প্রসারিত দশ আঙুলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। কোনটিতে রুপোলি জলস্রোত, কোথাও জলের বর্ণ নীলাভ, কোথাও গৈরিক। উত্তর পশ্চিমদেশে এক যোজন অতিক্রম করতে যে সময় লাগে এখানে তার দশগুণ লাগাও বিচিত্র নয়। পথচলতি সব শ্রমণ পরিব্রাজকের কথায় নির্ভর করে পরিকল্পনা করা ঠিক হয়নি। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। এবারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আত্মপ্রকাশেরও সময় হয়েছে।
হঠাৎ কুটিরের দ্বারে মৃদু শব্দ হল। অরণ্যে প্রায় দু’মাস থাকার পর প্রহর সম্পর্কে খানিকটা ধারণা চণকের হয়েছে। এখন মনে হয় রাত্রি দ্বিপ্রহর। আটবিক পল্লীর নাচ-গানের আওয়াজ অনেকক্ষণ থেমে গেছে। এত রাত্রে আবার কার কী কাজ পড়ল? ধীরে ধীরে অর্গল খুলে, দ্বারের অন্তরালে সরে দাঁড়ালেন চণক। আবার দরজায় আঘাত। এবার দ্বার খুলে গেল, মুক্ত দ্বারপথে একটি নগ্ন তরবারি প্রবেশ করল।
চণক চাপা স্বরে বললেন, ‘কৃপাণ কোষবদ্ধ করো ভীরু, সন্ন্যাসী নিরস্ত্র।’
উত্তরে একটি ধীর গম্ভীর স্বর বলল, ‘দীপ জ্বালো।’
২
রাজগৃহের উত্তর-পশ্চিমে নিত্যপ্রবাহিনী সরযূ নদীর তীরে অনন্যা সুন্দরী তন্বী সাকেত। কোশল রাজ্যের তিন গরবিনী নগরী—শ্রাবস্তী, অযোধ্যা, সাকেত। শ্রাবস্তী যদি হয় চাকচিক্যময় রত্নহার, অযোধ্যা যদি হয় বহু-ব্যবহৃত স্বর্ণসূত্র, সাকেত তবে একগাছি মুক্তার মালা। বিশ্বভুবনে এমন নগরী আর কোথায় আছে? প্রয়োজনের খামখেয়ালে গড়ে উঠেছে শ্রাবস্তী। স্বয়ং কোশলরাজের বসবাস, বহু ধনী শ্রেষ্ঠীরাও স্বভাবতই জড়ো হয়েছে সেখানে। তাই জাঁকজমকে চোখ ধাঁধায়। সব পাওয়া যায়। সব্বম অত্থি ইতি সাবত্থি। অযোধ্যা প্রাচীন নগরী। তার পথঘাট, প্রাসাদ, বিপণি সবেতেই একটা ব্যবহারের মালিন্য। কিন্তু সাকেত কল্পনার ধন। ভেবেচিন্তে ধীরে ধীরে অতি সুমিত, পরিচ্ছন্ন শিল্পরুচিতে সাজানো হয়েছে তাকে।
প্রধান পথগুলি সবই নদীমুখী। পথের দু-ধারে ছায়াতরু। এই প্রশস্ত পথগুলিকে সমকোণে কেটে চলে গেছে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত আরও পথ। নগরীর কেন্দ্রে রাজন্য উগ্রসেনের প্রাসাদ, চারিদিকে তার উদ্যান। শুধু রাজন্যগৃহ কেন নগরীর প্রায় সবগুলি গৃহেই কানন রয়েছে। রয়েছে সুস্বাদু পানীয় জলের কূপ। তা ছাড়াও বাপী। রাজগৃহ থেকে পাটলি গ্রামের কাছে গঙ্গা পার হয়ে বৈশালী অতিক্রম করে নিচের দিকে নামলে পড়বে প্রথমে অচিরবতী নদীর তীরে শ্রাবস্তী। কিন্তু বারাণসীর কাছে গঙ্গা পার হয়ে কোশলের দিকে অগ্রসর হলে প্রথমেই পড়বে অযোধ্যার উপকণ্ঠে সাকেত। আর সাকেতে প্রবেশ করে প্রথম যে দৃষ্টিগ্রাহী মনোরম প্রাসাদটি চোখে পড়বে সেটাই সাকেতের ধনীশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর আবাস।
সাকেতকে মধুভাণ্ডের মতো তিন দিকে ঘিরে একের পর এক বিস্তৃত রয়েছে শস্যক্ষেত্র। ধান্য, যব, ইক্ষু। প্রধানত ধান্য। উৎকৃষ্ট জাতের ধান্য উৎপাদন করে সাকেতের সমীপবর্তী গ্রামগুলি। এইসব শস্যক্ষেত্রের মধ্যে অনেকগুলিই সাকেতের নাগরিকদের। তাঁদের নিযুক্ত কৰ্ষকরা গ্রামগুলিতে বসবাস করে। ক্ষেতগুলি কর্ষণ করে।
আজ হলকর্ষণোৎসব। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবশেষে মাটি ভিজিয়ে দিয়ে গেছে মেঘ। সেই প্রথম বর্ষণের পর ধরিত্রীর মাতৃগন্ধে গৃহপতিরা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজের নিজের ক্ষেত্রে হলকর্ষণ করবেন। কুসুম মাল্যে চন্দনে সজ্জিত হয়েছে হলযন্ত্র ও বলদ। গৃহস্বামিনী বরণ করবেন। শঙ্খ বাজাবে, আনন্দধ্বনি করবে পুরনারীরা। পুরোহিত ক্ষেত্রপূজা, হলপূজা করবেন ঠিকমতো। এই সময়ে সম্পন্ন গৃহপতিরা পশুযাগ করে থাকেন। একটি ছাগশিশু বলি দেওয়ার প্রথা আছে। ইদানীং কিন্তু তা আর হচ্ছে না। পুরোহিতরা অনেকেই এতে ক্ষুব্ধ। কে এক ক্ষত্রিয়বংশীয় শ্ৰমণ শ্রাবস্তীতে প্রচার করে বেড়াচ্ছে দেবপূজার নামে জীববলি দেওয়া নাকি হত্যা। দেবতা কখনও এ বলি গ্রহণ করেন না।
কিন্তু হলকর্ষণোৎসবের চেয়েও আকর্ষক উৎসব আজ আছে। সরযূর তীরে তাই তরুণ যুবকদের যেন মেলা বসে গেছে। প্রত্যেকেরই পরনে উত্তম বেশ। বক্ষে চন্দনলেপ। গলায় হার। পুষ্পমালা। কানে কুণ্ডল। বাহুতে অঙ্গদ। কপালে তিলক। সাকেতের কুলনারীরা, অতি সম্ভ্রান্ত বংশীয়া কন্যারাও আজ উৎসবে যোগ দিতে নদীতীরে আসবে। নদীর ধার পর্যন্ত চূতবীথিকার প্রধান পথটিতে বহু অস্থায়ী বিপণি শ্রেণিবদ্ধভাবে বসে গেছে। বহুধরনের ফুল। ফুলের মালায় ও অলঙ্কারে কে কত বৈচিত্র্য আনতে পারে তার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কেউ গেঁথেছে স্থূল বেলকুঁড়ি দিয়ে পাঁচ লহর, সাত লহর মুক্তাহারের মতো মালা। মল্লিকার মালায় রূপদক্ষ কেউ হয়তো মালার মাঝখানে ঝুলিয়ে দিয়েছে প্রস্ফুটিত দু-তিনটি কেতকীর মধ্যমণি। কর্ণিকারের কর্ণাভরণ। পত্রের ওপর কুঁড়ি দিয়ে গাঁথা কবরীসজ্জা। কণ্ঠী, কেয়ুর, মেখলা। সব ফুলের। সুগন্ধে আকুল হয়ে রয়েছে পথগুলি।
তরুণদের হৃদয়ে আশা ও উল্লাস। কুমারীরা নদীতীরে আসবে। যাদের সহসা দেখতে পাওয়া যায় না, তারাও। তরুণরা যাকে ইচ্ছে মালা দিয়ে বরণ করবে। অবশ্য এ নির্বাচন একেবারে প্রাথমিক। উৎসবের দিনে কোনও কুমারীর গলায় জোর করে মালা পরিয়ে দিলেই যে তাকে ঘরে আনতে পারা যাবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। সেই কন্যা যদি নিজ কণ্ঠের মালাটি বিনিময়ে দেয় তবেই মোটামুটি গান্ধর্ববিবাহের প্রথম পর্ব সিদ্ধ হল বলে মনে করা হয়। এর পর কন্যার পিতার কাছে নিজের কুল, শীল, উপার্জন ইত্যাদি সমস্ত সংবাদ ও মাঙ্গলিক উপঢৌকন দিয়ে দূত পাঠাতে হবে। কন্যার পিতা যদি পাত্রকে উপযুক্ত মনে করেন একমাত্র তবেই এই প্রাথমিক নির্বাচন বিবাহে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। কিন্তু, নিশ্চয়তা থাক বা না থাক, এ এক মধুর খেলা। এ দিনটিতে নব্য যুবকদের সংযত করা এক দুরূহ ব্যাপার।
ঋতু-উৎসবের দিনগুলিতে বিশাখা যেন মুক্ত পাখি। ঝরা বকুলে আকীর্ণ হয়ে রয়েছে পথ। ঘন সবুজ পত্রজালের মধ্যে থেকে কোকিল যুবা ক্ষণে ক্ষণে উৎকণ্ঠ ডাক ডেকে উঠছে। কে বলে পিক শুধু বসন্তেই ডাকে! সাকেতে সর্ব ঋতুতে সর্ব সময়ে পিক কুহরে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিশাখা। দেখতে পায় না। বিচিত্র কর্কশ স্বরে ডেকে উঠে সহসা ঝরঝর শব্দে পেখম ছড়িয়ে নাচতে শুরু করে দেয় একটা ময়ূর গ্রীষ্মের আকাশ একটু ছায়াময় হলেই। বিশাখা থাকে সাকেতের পূর্বস্থলীতে। পিতার সপ্ততল প্রাসাদ। তাকে ঘিরে চতুর্দিকে বিছিয়ে রয়েছে অশ্বশালা, হস্তিশালা, রথাগার, মহানস, সংরক্ষণাগার, শ্রীগৃহ। মাঝে মাঝেই উদ্যান। উদ্যানের মধ্যে তড়াগ যেমন পদ্মে-কলহারে শোভাময়, তড়াগের চারপাশের ভূমিও তেমনই বহুবিধ বৃক্ষ, কুসুমকুঞ্জ ইত্যাদিতে শ্রীময়। এরই মধ্যে বিশাখার দিন কেটে যায় নানা বিষয় শিক্ষা করতে। আচারিয় মহাকল্পক আসেন শাস্ত্র শিক্ষা দিতে। মা দেবী সুমনা স্বয়ং তাকে চিত্র লিখতে শিখিয়েছেন; শিখিয়েছেন কীভাবে শাখা-প্রশাখায় প্রলম্বিত বিশাল সংসার ধারণ করে রাখতে হয়। পিতা শেখান অর্থের গণনাকৌশল, প্রয়োগ, বাণিজ্য-মন্ত্র। নয়নের মণি সন্তান। তাকে তাঁর পিতৃধন সর্বৈব অর্পণ করতে চান তিনি। বিশাখা নিপুণভাবে শিখে নিচ্ছে সব। এই পনেরো বছর বয়সেই সে নানা বিষয়ে বাবা ও মাকে পরামর্শ দিয়ে থাকে।
সাকেত সুন্দর। সুন্দর সাকেতের সপ্ততালিক প্রাসাদ। কিন্তু সাত বছর এখানে কেটে গেলেও আজও বিশাখার সাকেতকে বিদেশ বলে মনে হয়। বড় ঘনিষ্ঠ, অন্তরঙ্গ, আপন ছিল তাদের আদি নিবাস ভদ্দিয়। অঙ্গরাজ্যের এই ছোট প্রান্তিক নগরে দীর্ঘদিন ধরে পিতামহ মেণ্ডক গড়ে তুলেছিলেন তাঁর অতুল ধনসম্পদ। বামে শ্রাবস্তী। রাজগৃহ, বারাণসী, দক্ষিণে চম্পা। ভদ্দিয় ছোট জনপদ হলেও তার অবস্থান ছিল শ্ৰেষ্ঠীর কাজকর্মের পক্ষে সুবিধাজনক। অঙ্গ ও মগধের মাঝখানে। তা ছাড়াও মেণ্ডক শ্রেষ্ঠীর মূল ভদ্দিয়তে, তিনি তাকে ত্যাগ করেননি। ধনী কন্যা বলে আলাদা একটা অস্মিতা তখন সেই বয়সে গড়ে ওঠেনি বিশাখার। ছিলেন স্নেহময়ী পিতামহীরা, ছিল পিতৃব্য পুত্র-কন্যারা, জীবন ছিল সারা দিনমান প্রলম্বিত একটি ছুটির দিনের মতো। যার প্রতি প্রহরে নতুন নতুন আবিষ্কারের রোমাঞ্চ। বিশেষত, পিতামহ আবার ছিলেন ঐন্দ্রজালিক। শ্ৰেষ্ঠী বলে যত খ্যাতি জাদুকর বলে খ্যাতি বুঝি তার দ্বিগুণ। পরিবারের অনেকেই ইন্দ্রজাল জানত। শিশুকাল থেকেই বিশাখার মনোগত ইচ্ছা ছিল সে হবে জাদুকরী। তাঁর জাদুদণ্ডের এক ছোঁয়ায় বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হবে, গাছ বড় হয়ে উঠবে, তাতে ফল ধরবে, পাকবে, তারপর সেই সুগন্ধ আম্রফল সে দর্শকদের মধ্যে বিতরণ করবে। পিতামহ খুব ব্যস্ত মানুষ ছিলেন, তবু যখন তাঁকে কাছে পেত নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা তাঁকে অকপটে জানাত বিশাখা।
মৃদু মৃদু হাসতেন পিতামহ, ‘তুই বিবাহ করবি না বিসাখা!’
—না, পিতামহ, আমি দেশে দেশে জাদু দেখিয়ে বেড়াব।
—কিন্তু তার জন্য তো দলবল চাই। সে সব পাবি কোথা থেকে?
পিতৃব্য পুত্র-কন্যাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে সে নিশ্চিন্তে বলত, ‘কেন ভদ্দা রয়েছে, রোহিণী রয়েছে, মধুস্সরা রয়েছে, ছন্ন, বলভদ্দ, ছেটকও রয়েছে। ওরাও শিখবে। ওরা আমার সহকারী হবে।’
ভদ্দা, রোহিণী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠত, ‘না, না, আমরা বিসাখার সঙ্গে দেশে দেশে ওভাবে ঘুরতে পারব না, আমরা ভদ্দিয়তেই থাকব।’
—তোরা বিবাহ করবি না? পিতামহের প্রশ্ন।
—হ্যাঁ। পিতামহ, আমরা বিবাহ করব।
—কেমন বর চাই রে ভদ্দা, রোহিণী?
—তোমার মতো! তোমার মতো।
পিতামহ অট্টহাস্য করে উঠতেন, নিজের শ্বেতকৃষ্ণ মিশ্র শ্মশ্রুতে হাত বুলোতে বুলাতে বলতেন, ‘দেখলি তো বিসাখা, তোর দলবল কেমন?’
মধুস্সরা তখন বিশাখার হাত ধরে জোর গলায় বলত, ‘আমি তো আছি ভগ্নী বিসাখার সঙ্গে, কি রে বলভদ্দ, ছেটক, ছন্ন, তোরাও কি ভদ্দিয় ছেড়ে দেশে দেশে জাদু দেখাতে চাস না?’
বিশাখা যোগ দিত, ‘তোদের কারও মধ্যেই কি কোনও বীরতা নেই?’
ছেলে তিনটি গৃহের সবচেয়ে ছোট। কচি-কচি গলায় জবাব দিত, ‘হ্যাঁ, আমরা জাদুকর হব, জেটঠা বিসাখার সহকারী হব, পিতামহ, আমাদের শিখিয়ে দাও।’
তখন মেণ্ডক শ্ৰেষ্ঠী পরম স্নেহ এবং গর্বভরে বিশাখার দিকে তাকাতেন, বলতেন, ‘তা, তোমার অক্ষিতারকার যেরকম ক্ষণে নিশ্চলতা ক্ষণে চঞ্চলতা দেখছি, যেমন গ্রীবাভঙ্গি দেখছি, তুমি পারবে, তুমি জাদুকরী হয়েই জন্মেছ বিসাখে। তবে তোমার সঙ্গে যদি একটি উপযুক্ত জাদুকরের বিবাহ দিই তবে আপত্তি নেই তো!’
একটু ভেবে বিশাখা বলেছিল, ‘না, তা নেই। তবে তাকেও সত্য করতে হবে আমরা এক স্থানে থাকব না। সার্থবাহরা যেমন অরণ্য, কান্তার, বারিধি কিছু মানে না। খালি চলে চলে আর চলে, আমরাও তেমনি শকটে আমাদের পেটিকাগুলি নিয়ে খালি চলব, চলব আর চলব।’
শ্রেষ্ঠী বললেন, ‘অরণ্য? কান্তার? বারিধি? দিদি, অরণ্যে-কান্তারে কাকে জাদু দেখাবে? ব্যাঘ্র-ভল্লুককে? না নরখাদক যক্ষদের?’
বিশাখা একটু কি অপ্রতিভ? শিশুকাল থেকে বাণিজ্যযাত্রার কাহিনী শুনে আসছে, তার স্বপ্ন সেই সব কথা-কাহিনী-কল্পনার উপকরণ দিয়ে গড়া। সে ঢোঁক গিলে বলল, ‘কেন পিতামহ! ধরুন ভদ্দিয় থেকে চম্পা যেতে, কি রাজগৃহ যেতে, মাঝে ছোট ছোট গ্রামগুলিতে যেতে অরণ্য, নদী, প্রান্তর তো পড়বেই! বল মধুস্সরা, বল ছন্ন কী অপূর্ব, রোমাঞ্চকর হবে আমাদের জীবন?’
শ্রেষ্ঠী হেসে আশ্বাস দিলেন, ‘ঠিক আছে দিদি, আর একটু বড় হয়ে ওঠো, কেশ আরেকটু দীর্ঘ হোক, ওষ্ঠাধরে আরও রঙ্ লাগুক, আঁখিপক্ষ্মগুলি আরও নিবিড় হয়ে উঠুক, তুমি অবশ্যই জাদুকরী-শ্ৰেষ্ঠা হবে।’
এখন বিশাখার পনেরো বছর পার হয়ে গেছে। পঞ্চদশী, পৌর্ণমাসী। সঙ্গে সব সময়েই ঘোরে জগৎ ব্যাপারে অভিজ্ঞ সুচতুরা সখী ও দাসীর দল। সে এখন পিতামহের সেই শেষ আশ্বাসবাণীর রহস্য ভেদ করতে পারে। হাসি পায়, কিন্তু ক্রোধও হয়। এখন হয়ত ভ্রাম্যমাণ জাদুকরী হবার সেই শৈশব সাধ আর নেই। কিন্তু জাদু, জাদুর প্রতি তার আকর্ষণ কমেনি মোটেই। কদিন আগে তাদের উদ্যানপালের সদ্যোজাত পুত্রটি অকালে মারা গেল। তার সব পুত্র-কন্যাগুলিই এভাবে মারা যায়। অকস্মাৎ নীলবর্ণ হয়ে যায়। তারপর একটা ক্ষীণ স্বর বেরোয় মুখ দিয়ে। তার পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বিশাখার মনে হয় সে যদি জাদু জানত, জাদুদণ্ড দিয়ে স্পর্শ করত একবার, উদ্যানপালের নয়নের মণিটি বেঁচে উঠত! জীবনে সংকল্প যদি-বা থাকে, সাধ্য কেন থাকে না? জীবন এমন একই ছকে বাঁধাই বা হবে কেন? ঠিক যেভাবে তার প্রপিতামহী, পিতামহী প্রমাতামহী, মাতামহী জীবন কাটিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই? যেভাবে তার মায়ের জীবন….। এইখানে এসে বিশাখার চিন্তা থেমে যায়। না, মা সুমনা একেবারে স্বতন্ত্র। তিনি ওই ছকের মধ্যে আছেন ঠিকই, তবু তাকে ইচ্ছামতো অতিক্রমও করেন। তবে, তবে কেন বিশাখা গতানুগতিতে গা ভাসাবে?
এখন সে চূতবীথিকার পথ ধরে পায়ের তলায় নবীন ঘাসফুলগুলি সযত্নে এড়িয়ে সরযূতীরের দিকে চলেছে। বহু সখী এবং অন্যান্য পরিবার থেকে আগত নবীনা সুরূপা কিশোরীদের মধ্যে থেকেও তাকে চিনে নেওয়া যাচ্ছে অনেক কাচখণ্ডের মধ্যে একটি মাত্র দৃঢ়জ্যোতি হীরকখণ্ডের মতো। নীলাভ শ্বেত দুকূলের একটি অধোবাস পরেছে সে, উপরার্ধে ঘন নীল রঙের স্তনপট্ট। দুই কাঁধ থেকে নেমে এসেছে শ্বেত উত্তরীয়। তাতে রক্ত ও নীলবর্ণ বুটিকা। ঈষৎ কুঞ্চিত তার নীলকৃষ্ণ কেশ ঠিক ময়ূরপুচ্ছের মতো তার পিঠ বেড়ে রয়েছে। কেশাগ্রভাগ বাইরের দিকে সমানভাবে বক্র হয়ে অপূর্ব শোভা ধারণ করেছে। বিশাখার গায়ের রঙ রক্তাভ গৌর। সুবক্র ঠোঁটদুটি দেখলে মনে হয় তাতে রঞ্জনী দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বিশাখা কোনও রঞ্জকদ্রব্য ব্যবহার করেনি। তার কান, নাক, কপাল, বিশাল দুই পক্ষ্মাচ্ছাদিত চক্ষু, চিবুক থেকে আরম্ভ করে বাহুযুগল, আঙুলগুলি, সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন অশেষ যত্নে গড়া। সর্বোপরি এই পনেরো বছর বয়সেই তার মধ্যে এমন একটা শান্ত বুদ্ধির দীপ্তি যে, তাকে দেখলে সম্ভ্রম হয়।
কুমারীর দল এগোতেই যুবকদের মধ্যে চঞ্চলতা দেখা গেল। অনেকেই মালিনীর কাছ থেকে তার সবচেয়ে মনোমত মালাটি সংগ্রহ করে রেখেছে। গত বসন্তোৎসবে যে কিশোরী বা বালিকা মনোহরণ করেছে, তারই কণ্ঠ লক্ষ্য করে মালাগুলি সব নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। কুমারীদের দলে হিল্লোল, হাসি। এরই মধ্যে একটি যুবক বোধ হয় অনেকক্ষণ ধরে সাহস সঞ্চয় করছিল। সে একটি অতি সুন্দর কুন্দ ফুলের মালা হাতে একটু ইতস্তত করে বিশাখার দিকে এগিয়ে গেল। তার বন্ধুরা একটু দূর থেকে বিপুল ঔৎসুক্যের সঙ্গে তাকে লক্ষ করছে।
যুবক ক্ষত্রিয়কুমার। স্থানীয় রাজন্যর ছেলে। এই বয়সেই শস্ত্রবিদ্যায় নিপুণ হয়ে উঠেছে এমন শোনা যায়। সে খুব সাহসে ভর করে, হৃৎপিণ্ডের প্রবল আলোড়ন সংযত করে বিশাখার মুখোমুখি হল। বিশাখার রাজহংসীসদৃশ চলার গতি মন্থর হয়ে এসেছে। আশেপাশে তার সখীদের মুখে কৌতুকের হাসি। চোখে কৌতূহল নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে গেছে। কুমার যথেষ্ট দীর্ঘাকৃতি। সে মালাটি হাতে নিয়ে বিশাখার গলায় পরাতে যাবে, বিশাখা দু পা পিছিয়ে গিয়ে তার স্বর্ণঘণ্টার মতো কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তিট্ঠ, তিট্ঠ তিস্স। এ কী করছ!’
ক্ষত্রিয়কুমার তিষ্য হকচকিয়ে থেমে গেল।
তার আজকের আচরণের পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। না, না। এই বছরের, কি তার আগেকার বছরের কোনও প্রগলভ ঋতু-উৎসবের উদ্দীপন নয়। আছে আরও কয়েক বছর আগেকার একটি পারিবারিক উৎসবের দিন ও দিনান্তের স্মৃতি। সে তক্ষশিলার গুরুগৃহ থেকে ফিরে আসবার পর তার পিতা উগ্রসেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সপরিবারে নিজগৃহে দ্বিপ্রাহরিক ভোজে আপ্যায়ন করেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে প্রধান ছিলেন শ্রেষ্ঠী ধনঞ্জয়। শ্রেষ্ঠীকন্যা বিশাখাকে দেখে, তার সঙ্গে আলাপ করে তিষ্য চমৎকৃত হয়ে যায়। সে আজ তিন চার বছর আগেকার কথা। তক্ষশিলার শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত করবার পর পিতা তাকে পাঠান আরও বিশদভাবে অস্ত্র প্রয়োগ শিখতে শ্রাবস্তীর সেনাপতি মল্লবংশীয় বন্ধুলের কাছে। ইতিমধ্যে সে ভূর্জপত্রে কুঙ্কুমরাগ দিয়ে পত্র লিখে অতি বিশ্বাসী জ্ঞাতিভগ্নীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে বিশাখার কাছে। তিন বছরে তিনটি। কোনবারই কোনও উত্তর পায়নি সে। কিন্তু মৌনতাই তো সম্মতি? মৌনতাই তো মুগ্ধতা? একে সে রাজন্যবংশীয় কুমার, দ্বিতীয়ত সে অতি বীরপুরুষোচিত অবয়বের অধিকারী। তার সুচারু কেশ, সযত্নপুষ্ট ক্ষীণ গুম্ফরেখা, পরিষ্কৃত লালিত শ্মশ্রু সবেতেই একটু ক্ষীণ স্বর্ণাভা আছে। তিষ্যর পিতা উগ্রসেন গর্ব করেন তিনি পাঞ্চাল রাজবংশের সন্তান। বিশুদ্ধ রাজরক্ত তাঁর ধমনীতে। কোনদিন পরিবারে কোনও মিশ্রণ হতে দেননি তাঁর পূর্বপুরুষ। খুব সম্ভব শিক্ষাশেষে সে হয় মগধ, নয় কোশলের সেনাবাহিনীতে অতি উচ্চপদে যোগ দেবে। না দিলেও সাকেতের সীমার মধ্যে তো সে রাজকুমার, পরে রাজাই হতে যাচ্ছে। তক্ষশিলা থেকে আসবার পর যখন বালিকা বিশাখার সঙ্গে আলাপ হয় সে নিজে ছিল সদ্য-স্নাতক অহঙ্কারী যুবক, তাকে লক্ষ্য করে তরুণী কুমারীদের লাস্য উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। সে কিন্তু কাউকেই প্রশ্রয় দিতে চাইত না। শুধু বিশাখার বুদ্ধিদীপ্ত, সপ্রতিভ আলাপচারিতায় সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কয়েক দণ্ডের মধ্যেই দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব জমেছিল। বারো বছরের বালিকার পক্ষে অবশ্য বিশাখা তখনই একটু অতিরিক্ত গম্ভীর, যেন একটু অকালপক্কও কিন্তু সে পক্কতা অন্যান্য বালিকার মতো নয়, সে কথায় কথায় শ্লোক উদ্ধৃত করত, গুরুগম্ভীর মন্তব্য করত রাজকর্তব্য, বাণিজ্যপথ ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু তিষ্যর মনে হয়েছিল বালিকা আসলে সরল। একেবারেই পূতচিত্ত। অভিজাত ঘরের শিক্ষাদীক্ষায় তার ওপর একটা গাম্ভীর্যের, পক্কতার আচ্ছাদন তৈরি হয়েছে। বালিকার লীলাচাপল্য ওরই মধ্যে যখন তখন প্রকাশ পেত।
—তিস্স, তিস্স, তোমার হাতের রেখা দেখি! এখনও তিষ্য বালিকার অদ্ভুত মিষ্ট অথচ জোরালো কণ্ঠ শুনতে পায়।
—ভদ্র তিষ্য বলো বিসাখে, আপনার বলো, তোমার বলো না, আমি তক্ষশিলার স্নাতক, জানো না? সমগ্র সাকেতে আপাতত এই একটিই!
ভদ্র বা আপনি শোনবার কোনও বাসনা ছিল না তিষ্যর। তবু দুষ্টুমি করে ভর্ৎসনা করেছিল সে বিশাখাকে।
বিশাখা তার কৌতুক সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছিল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, হে তক্ষশীলিত তিষ্য ভদ্র, আপনার অসামান্যম্ একম্ অদ্বিতীয়ং দক্ষিণহস্তম্ দেখি।’
—তুমি কি জ্যোতিষ জানো? হস্তরেখা পড়তে পারো? অঙ্গবিদ্যাটিদ্যাও জানো নাকি?
—ভদ্রে বলুন তিষ্যকুমার, আমি ধনঞ্জয়পুত্রী, মেণ্ডকপৌত্রী জাদুকরী বিসাখা। রেখা পড়তে না পারলে আপনার ওই কর্কশ, ভারী হাতটি ধারণ করে আমি কী এমন স্বর্গলাভ করব? তবে জ্যোতিষশাস্ত্রও তক্ষশিলায় শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। যদিও তাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারে খুব কম জনই।
তিষ্য হেসে বলেছিল, ‘বেশ, বেশ, ভদ্রে বিসাখে আপনি আমার হস্তরেখা বিচার করুন।’
ভালো করে তার দক্ষিণ হস্তের রেখাগুলির ওপর নিজের পুষ্পবৃন্তের মতো কোমল আঙুলগুলি চালনা করে তিষ্যর সারা শরীরে বিপুল রোমহর্ষ জাগিয়ে দিল বিশাখা। তারপর হঠাৎ বলে উঠেছিল, ‘অহো কী দুঃখ! ভদ্র আপনি তো দেখছি গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হবেন!’
—ঘাতক না ঘাতিকা ঠিক করে বলো তো? রহস্যচ্ছলে জিজ্ঞাসা করেছিল তিষ্য।
তার কথার গূঢ়ার্থ বোঝেনি বিশাখা। শুধু তার নীলাভ কৃষ্ণকেশ সমেত অপরূপ মাথাটি দুলিয়ে বলেছিল ‘তা জানি না, ঘাতকের লিঙ্গ বলতে পারব না, যাও তিস্স, আর তোমার অশুভ হাত দেখব না। শেষে বলবে বিসাখা অপ্রিয়বাদিনী। অকল্যাণকামী।’
তিন বছর আগেকার প্রতিটি শব্দ ফিরে ফিরে এসে আঘাত করল তিষ্যকে। সে ব্যথাম্লান মুখে বলল, ‘মাল্য প্রত্যাখ্যান করছ ভদ্রে বিসাখে?’
—অবশ্যই। তুমি কি ভেবেছিলে সাধারণীদের মতো ধনঞ্জয়পুত্রীও সরযূমুখী চূতবীথিকায় প্রণয়গুঞ্জন করে? বিশাখার সুন্দর চোখে ক্রোধ ঝলসে উঠেছে। মুখে অপমানের লালিমা। তার কণ্ঠস্বর যতই সুন্দর হোক এই মুহূর্তে কর্কশ লাগল।
একটি কথাও বলতে পারল না তিষ্য। পায়ে পায়ে পিছিয়ে এলো। তার চোখের সামনে অন্ধকার। আশেপাশে বন্ধুকল্পরা ব্যঙ্গের হাসি হাসছে। তার বিশেষ বন্ধু সুমিত্র এবং আত্রেয় তাকে বহুবার নিষেধ করেছিল, এ কথা মানতেই হবে। বিশাখা সাকেতের ধনীশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয়ের নয়নের মণি, তারপর অপরূপা রূপসী। তার জন্য ববেরু থেকেও পাণিপ্রার্থী এলে বিস্ময়ের কিছু নেই। তা ছাড়া আজকাল জনসমাজে শ্রেষ্ঠীরাই শ্রেষ্ঠ। রাজাদের তারা মুখেই সম্মান দেখায়, ভালো করেই জানে রাজার ভালোমন্দ এক রকম তাদের অর্থঋণে বাঁধা। তিষ্যদের পুরোহিত সক্ষোভে বলে থাকেন, ‘এখন আসছে এক বৈশ্য যুগ, যার যত অধিক স্বর্ণ, তার তত উচ্চ বর্ণ’। স্বয়ং কাশীকোশলের নৃপতি প্রসেনজিৎ যখন মগধরাজ বিম্বিসারের কাছে একটি শ্রেষ্ঠী তাঁর রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, তখন মগধরাজ্যের পঞ্চশ্রেষ্ঠী যোতীয়, জটিল, মেণ্ডক, পুণ্যক, কাকবলীয় কেউই কি আসতে চেয়েছিল? রাজাদেশ অগ্রাহ্য করতে তাদের কারোরই কোনও অসুবিধে হয়নি। দুই রাজার মান বাঁচাতে অবশেষে মেণ্ডক তাঁর পুত্র ধনঞ্জয়কে কোনক্রমে রাজি করিয়েছিলেন। সে-ও ধনঞ্জয় বাপের সুপুত্র বলেই। ধনঞ্জয় আসার পর থেকেই সাকেত নগরী ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সরযূর জলে পণ্যতরী এসে ভিড় করছে। সরযূ বেয়ে গঙ্গায় গিয়ে পড়ে তরীগুলি তারপর পুবমুখে পাল তুলে চলে যায়, আসে। সার্থবাহরা আর পথের বিপদ গ্রাহ্য করছে না, দলে দলে বণিক মধ্যবর্তী চৌরকান্তার, ব্যালকান্তার কিছুই না মেনে সাকেতকে কেন্দ্র করে সারা উত্তরাপথ ঘুরে ঘুরে বাণিজ্য করছে। অনেক পরদেশী বণিক তো বলে সায়ংকালে প্রসেনজিৎ ধনঞ্জয়কে নিয়ে এই স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন, সায়ংকালে এই নগরের পত্তন হয়। ধনঞ্জয় নাকি বলেছিলেন, ‘সায়ংকৃত’। তার থেকেই সাকেত। এই নতুন সাকেত-জন্মকথা বণিকদের মুখে মুখে চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অযোধ্যার উপকণ্ঠে যে সাকেত নগরী সত্যই ছিল, অযোধ্যা এবং সাকেত উভয় নগরীর রাজাই যে তিষ্যর পিতা উগ্রসেন, বংশপরম্পরায়, এসব কথা এই নব্য বণিকরা জানে না। বিশ্বাসও করতে চায় না। আসলে ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীই এই নগরীর যশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন সাকেত শ্রাবস্তী, রাজগৃহ, বৈশালী, বারাণসী, চম্পার সঙ্গে তুলিত হয়। সেই ধনঞ্জয়ের কন্যা যে ধনগর্বী, রূপগর্বী হবে তাতে আর আশ্চর্যের কী! সবাই বুঝেছিল, খালি তিষ্যই বোঝেনি, মানতে চায়নি।
পায়ে পায়ে পিছিয়ে এসে তিষ্য তরুণদের ভিড় থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র করে নিল। তাদের ঈষৎ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কারও কারও দুঃখপ্রকাশ কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। একটা অভিমান, একটা হতাশা ও ক্ষোভের আবরণের মধ্যে সে এখন সম্পূর্ণ একা। সে ফিরে চলেছে। অবশ্যই গৃহ অভিমুখে নয়। অন্য কোথাও। নির্জনে। সুমিত্র এবং আত্রেয় কিছুক্ষণ পেছন পেছন এসেছিল। কিন্তু তারা সাকেতের বাল্যবন্ধু। বেড়ে ওঠার সময়ে, তক্ষশিলা এবং শ্রাবস্তীতে থাকায় দীর্ঘকাল অদর্শনে তাদের বন্ধুত্বে আর সে রকম গাঢ়তা অনুভব করে না তিষ্য। বাঁধন যেন শিথিল হয়ে গেছে। উপরন্তু আজ উৎসবের দিনে অনেক প্রমোদ!—‘তিস্স্ আমরা নদীতীর থেকে একটু ঘুরে আসছি’—এই বলে তারা চলে গেল। তিষ্য ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে সরযূর বিপরীত দিকে তার ছোট বেলাকার অঙ্কধাত্রীর বাড়ি এসে পৌঁছল। ডাকল, ‘ধাই মা।’
প্রৌঢ়া বেরিয়ে এসে তিষ্যকে দেখে বড় প্রীত হল। রাজপরিবারের শিশুরা বহু প্রকার ধাত্রীর কোলে কোলে মানুষ হয়। তিষ্যর ছিল তিনজন ধাইমা। তার এই অঙ্কধাত্রী-ই ছিলেন তার দুধ-মা। আর ছিল একজন মণ্ডনধাত্রী, সে খুব সম্ভবত একটি মধ্যবয়স্কা বারবিলাসিনী। এবং একজন ক্রীড়াপনিক ধাত্রী। কিন্তু দুধ-মাকে সে বড় ভালোবাসত। ইনি ছিলেন নাতি কৃষ্ণা, নাতি গৌরী। বক্ষের দুগ্ধধারা কবোষ্ণ। তার মুখগহ্বর মিষ্ট জীবনরসে ভরে যেত। ধাইমার স্তন দুটিও ছিল দৃঢ়, অতি উচ্চ নয়। স্তন ঝুলে পড়ে তার নাক চেপ্টে যাচ্ছিল বলে একটি ধাত্রীকে আগেই বিদায় দেওয়া হয়েছিল। এই ধাইমার সুকোমল, সুপৃথুল কোলে শুয়ে সে মধুভাণ্ডের মতো এঁর সুবর্তুল স্থূল বোঁটাযুক্ত স্তনটি ধরত। কত আদর করে ধাই-মা তাকে কোলে বসিয়ে পা দুটি দুদিকে ঝুলিয়ে দিয়ে, তার হাত পা ধীরে ধীরে তৈলমর্দন করে সুগঠন, বলশালী করবার চেষ্টা করতেন। সেই দৃঢ় কোমল স্পর্শ এখনও সে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে অনুভব করে। মণ্ডনধাত্রীটি তাকে খুব করে সাজাত। গ্রীষ্মকালে কার্পাসিক, অল্প শীতে ক্ষৌম এবং অধিক শীত পড়লে পশমী বস্ত্র পরাত। রেশমের খুব সুন্দর সুন্দর পরিচ্ছদ তৈরি করে দিত ধাইটি। মুক্তা স্বহস্তে গেঁথে তার গলার মালা প্রস্তুত করত। কিন্তু কেন যেন এই ধাইটিকে তার ভালো লাগত না। এই ধাইটি তিষ্যর শিশু বয়সেই তার সুকুমার পুরুষাঙ্গটি নিয়ে নানান কৌতুক করত, পুরললনারা হেসে অস্থির হয়ে যেত।
—দ্যাখো, দ্যাখো ঠিক অশ্বের মতো দীর্ঘ লিঙ্গটি হয়েছে খোকার। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে যা হবে না!
এখনও মনে আছে তিষ্যর। ধাত্রীটি তার জননাঙ্গ নিয়ে খেলা করতেও ছাড়ত না। ক্রীড়াপনিক ধাত্রীটি কিন্তু ছিল শান্তস্বভাব। শিশুর সঙ্গে খেলা করবার জন্য যে দৈহিক শক্তি ও উৎসাহ প্রয়োজন তা যেন তার কিছু অল্প ছিল। মাঝে মাঝেই উন্মনা হয়ে যেত। কন্দুক দিয়ে তাকে প্রহার করত তিষ্য। ক্ষুব্ধ হয়ে সে বলত, ‘অরে অরে, দরিদ্র বলে কি এমন করে প্রহার করতে হয়? বালক হলে হয় কি! ধনী ঘরের বড় ছোটো সবাই দেখি সমান!’ তারপর সে কাঁদতে আরম্ভ করত।
তিষ্য ক্রুদ্ধ হয়ে বলত, ‘তা, তুই আমার সঙ্গে খেলা করছিস না কেন?’
শ্যামা নামে সেই মেয়েটি বলত, ‘মাতার মৃত্যুর পর পিতা আমাকে তোমাদের বাড়িতে বিক্রি করে দিয়ে দূরদেশে চলে গেলেন। আমার কি তোমার সঙ্গে কন্দুক খেলতে মন লাগে! কোথায় গেল আমার সুপন্ন। সে কথা দিয়েছিল আমাকে বিবাহ করবে। বচ্চ, আমি খালি এইসব কথাই ভাবি।’
—সুপন্ন কে?
—সে একটি অতি মনোহর যুবক। আমার মনপ্রাণ হরণ করেছিল।
—আমার চেয়েও মনোহর? এমনি পীত দুকূলের বস্ত্র তার আছে? এমনি ময়ূর পালক দেওয়া শিরোভূষণ?
বিষন্ন হাসি হাসত শ্যামা, ‘না বচ্চ, পীত রেশমও তার ছিল না, মুকুটও তার ছিল না, তোমার মতো এমন শ্বেতপদ্মের মতো গাত্রবর্ণই বা সে কোথায় পাবে! কিন্তু আমার কাছে সে ছিল সবার থেকে মনোহর।’
তিষ্য বর্তমানে ফিরে এলো। ধাইমা ডাকছে। হাতে মৃৎপাত্রে কী সব ভোজ্য। তিষ্য বলল, ‘ধাইমা, সূতককে একটু বলবে মন্দ্রাকে এখুনি নিয়ে আসবে!’
এই সূতক তিষ্যর সমবয়সী। ধাইমার বৎস। এরই প্রাপ্য দুগ্ধধনে ভাগ বসিয়ে বড় হয়েছে তিষ্য। সে তাদের অশ্বরক্ষক, তিষ্যর প্রিয় অশ্বী মন্দ্রা সূতকের তত্ত্বাবধানেই থাকে।
—নিশ্চয়ই বচ্চ, এই যে বলি।
কুটিরের নিচু ছাদ এক হাতে ধরে বেরিয়ে এলো সূতক। সে উৎসবের নতুন পোশাকে সজ্জিত। নববধূর সঙ্গে নদীতীরে যাবার আয়োজন করছিল। প্রভুপুত্রের ডাকে সে বেরিয়ে এসে তিষ্যদের অশ্বশালার দিকে দৌড়ল।
তিষ্য কুটিরসংলগ্ন মৃৎবেদীর ওপর বসে পড়ল। ধাইমা তার পাশে পাত্রটি নামিয়ে রেখেছে, হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা ধাইমা, সেই শ্যামাকে মনে আছে? আমাকে খেলা দিত?’
ধাইমা বলল, ‘সামা? হ্যাঁ, হ্যাঁ, সামাকে মনে আছে বই কি!’
—তার সংবাদ কী?
ভ্রূ কুঁচকে ধাই-মা কিছুক্ষণ মনে করবার চেষ্টা করে বলল, ‘সামা তো তোমার পিতার কাছ থেকে মুক্তি ক্রয় করে সাকেত ছেড়ে চলে যায়।’
তিষ্য উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তবে কি সে সুপন্নর দেখা পেয়েছিল?’
—সুপন্ন? কে সুপন্ন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ধাইমা।
নিশ্বাস ফেলে তিষ্য উঠে দাঁড়াল। অশ্বক্ষুরধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মন্দ্রা আসছে। মন্দ্রা। তার নাসা স্ফুরিত হচ্ছে, পিঙ্গল ও সাদা রোমগুলি খাড়া হয়ে উঠেছে। সে বুঝতে পেরেছে তিষ্য, তিষ্য তাকে ডাকছে। সে দ্রুত কুটিরাঙ্গন পার হয়ে গেল, ধাইমা জল আনতে ভেতরে গিয়েছিল। তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘তিট্ঠ কুমার তিট্ঠ। তোমার জন্য ক্ষীরমণ্ড পাকিয়ে এনেছি। উৎসবের দিনে একটু মুখে করো।’
‘তিটঠ’টুকু শুধু শুনেছিল তিষ্য। অল্প সময়ের ব্যবধানে আজ দুবার তাকে কথাটা শুনতে হল। কিন্তু সে থামবে না। সে মন্দ্রার পিঠে লাফিয়ে চড়ল। তার পেটের ওপর দুদিক থেকে সামান্য পায়ের আঘাত হানল, মন্দ্রা হাওয়ার বেগে ছুটে চলল।
সরযূতীর ছাড়িয়ে সে চলে এসেছে অনেক দূর। ছোট একটি টিলা। আশেপাশে বট, অশথ, শিংশপা কতকগুলি। বিস্তীর্ণ সব ক্ষেত। টিলায় পিঠ দিয়ে, অর্থাৎ সরযূর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বসল তিষ্য। জ্বালাময় ক্রোধ নয় আর, কেমন একটা গভীর বিষাদ তার হৃদয়ে। কর্ষণোন্মুখ এই বিশাল সবুজ শস্যক্ষেত্র এই উদার আকাশ তার চোখ ছুঁয়ে যাচ্ছে, সে অনুভব করছে না। মুখে তিক্ত স্বাদ। সে টিলায় হেলান দিয়ে দূরের দিকে চোখ প্রসারিত করে দিল। কিছুক্ষণ পর চোখ বুজিয়ে ফেলল। স্বপ্ন নেই, আশা নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই, এক ধরনের নির্বেদ।
—বৎস, বৎস—প্রৌঢ় গলার উৎকণ্ঠ ডাকে চোখ মেলল তিষ্য। সামনে দুই ব্রাহ্মণ। একজনের মাথা শুভ্র। আর একজনের শুক্ল কেশের সঙ্গে কিছু কৃষ্ণেরও মিশ্রণ আছে।
—বৎস, তুমি কি সাকেতবাসী?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল তিষ্য।
—আজ কি সেখানে হলকর্ষণোৎসব?
—হ্যাঁ।
—জানো কি নদীতীরে কুমারী-সমাবেশ হয় কি না?
—হয়। তিক্ত স্বরে বলল তিষ্য।
—পৌঁছতে পারবো সময় মতো?
—আপনাদের ভাগ্য! বিরস মুখে চোখ বুজিয়ে ফেলল তিষ্য।
ব্রাহ্মণদ্বয় বুঝলেন এ যুবকের কাছ থেকে আর বিশেষ কিছু জানা যাবে না। তাঁরা ফিরতে উদ্যত হলেন।
হঠাৎ তিষ্যর চোখ দুটি খুলে গেল, ‘আপনাদের কি অত্যন্ত বেশি প্রয়োজন?’
—হ্যাঁ বৎস, অতিশয়।
—ঘোড়ায় চড়তে পারেন? তিষ্যর মুখে সামান্য হাসি।
দুজনের মধ্যে যিনি অল্পবয়স্ক, তিনি বললেন, ‘যৌবনে চড়েছি। চেষ্টা করলে পারি বোধ হয়।’
—এই অশ্বী অতি সুশীলা, এর পিঠে চড়ে সোজা ওইদিকে চলে যান। সে দিক নির্দেশ করল।
—অশ্বটি কী করবো?
—ছেড়ে দেবেন কার্যশেষে। ও ঠিক ওর মন্দুরায় ফিরে যাবে।
ব্রাহ্মণেরা দু হাত তুলে স্বস্তিবাচন করলেন। অল্পবয়স্ক ব্রাহ্মণ সহজেই মন্দ্রার পিঠে উঠে গেলেন। দ্বিতীয় জনকে উঠতে সাহায্য করল তিষ্য। অদূরে একটি শিবিকা। সেটিকে সরযূতীরে আসবার নির্দেশ দিলেন ব্রাহ্মণরা, তারপর মন্দ্রা তাঁদের নিয়ে ছুটে চলে গেল। তিষ্য আবার চোখ বুজল।
তিষ্য সাকেতের জ্যেষ্ঠ রাজকুমার। তার পিতা উগ্রসেনের দুই রানি। জ্যেষ্ঠা শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় উগ্রসেন দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। তার দুই জ্যেষ্ঠার মধ্যে একজনের বিবাহ হয়েছে শ্রাবস্তীতে। এক রাজপরিবারে। আর একজনের বৈশালী থেকে কিছু দূরে ভোগনগরে। সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে। বড়রানির দুটি মেয়ে এবং তার নিজের মা ছোটরানির একটি ছেলে শিশুকালেই মারা গেছে। তিষ্যর বাকি দুটি ভাই তার থেকে ছোট। কেউই তার মতো গুণবান নয়, বলেন পিতা। তাঁর ইচ্ছা সে এখন থেকে সাকেতে থেকেই রাজৈশ্বর্য ভোগ করুক। শিখে নিক জনপদ শাসনের খুঁটিনাটি। মাণ্ডলিক রাজা হিসেবে একশটি গ্রামের শাসনকার্য দেখতে হয় উগ্রসেনকে। গ্রামিকরা বছরে তিনবার তাঁর সভায় সমবেত হন। তা ছাড়াও, কোনও সমস্যা উপস্থিত হলে পিতাকে তার সমাধান করতে হয়। কিন্তু এই রাজস্ব আদায়, বছরে তিনবার শস্যের ষষ্ঠ ভাগ এবং বণিকদের পণ্যের দশম ভাগ রাজভাণ্ডারে পাঠানো, চৌর এবং দস্যুদমন, এই ধরনের বাঁধা কাজে মন লাগে না তিষ্যর, এটুকু কাজ কি আর তার মধ্যম বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা করতে পারবে না? সে সাকেতের এই গণ্ডি থেকে, এমন কি শ্রাবস্তীর গণ্ডি থেকেও মুক্ত হতে চায়। তক্ষশিলা থেকে যাওয়াআসার পথে সে দেখেছে কত জনপদ, কত নগরী—মিথিলা, মধুরা, ইন্দ্রপ্রস্থ, মদ্রদেশ, যতই উত্তরে যাও ভাষা আরও সুছন্দ, সুচারু। মানুষগুলির দৈর্ঘ্য উচ্চ, নাক মুখ চোখ অতি স্পষ্ট, নীলাভ কৃষ্ণ চোখের মণি, অনেক সময়ে নীলাভ কেশ, স্বর্ণাভ কেশ। কিন্তু তাদের পূজা, যজ্ঞ, নিয়মপালনবিধি অতি বিশদ এবং দুরূহও বটে। বিশেষ রকমে শিক্ষাপ্রাপ্ত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সাহায্য ছাড়া তারা ধর্মাচরণ করতেই পারে না। তিষ্যর আকৃতিতে খানিকটা পশ্চিমদেশের ছাপ আছে। নইলে ওরা মধ্যদেশ ও প্রাচীর মানুষদের ব্রাত্য বলে অবজ্ঞার চোখে দেখে। দক্ষিণে মধুরার পর থেকেই আরম্ভ হয়েছে, নিবিড় অরণ্য। তার ওপারে বিন্ধ্য পর্বতমালা। ওই পর্বতের ওপারে কী? গুরুগৃহে শুনেছে হিংস্র শ্বাপদে পূর্ণ অরণ্য এবং পর্বত যদি-বা পার হওয়া যায়, অসভ্য বর্বর জাতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন, আছে যক্ষ, রক্ষ নাগ, বানর প্রভৃতি বহু জাতি। উপরন্তু দক্ষিণদেশের মাটি শিলাময় ও মরুভূমিসদৃশ। সেখানে সহজে শস্য জন্মায় না।
কেন কে জানে তিষ্যকে টানে এইসব অজানা দেশ, অদেখা জাতি। তার মনে হয় কিছু অনুরূপ সঙ্গী পেলে সে বিন্ধ্য পার হয়ে দক্ষিণদেশে চলে যেত, বাহুবলে জয় করে নিত যক্ষ-রক্ষদের। রাজা হত তাদের, এমন মাণ্ডলিক রাজা বা রাজন্য নয়। সত্যিকারের রাজা। কেমন করে সুশাসন করতে হয় দেখিয়ে দিত। এই উত্তরাখণ্ডে বড় বেশি সন্ন্যাসীর উপদ্রব। যখন তখন, যে সে হয় আজীবক, নয় তীর্থিক—একটা কিছু হয়ে যাচ্ছে। বেশ সম্পন্ন গৃহস্থঘরের পুরুষ, এমন কি রাজবংশীয় ক্ষত্রিয়রাও। উত্তরাখণ্ডের শেষ লক্ষ্য যেন অরণ্যবাস। সন্ন্যাস। যে তা করতে পারে সে বন্দনীয়। বাকিরা পারল না বলে যেন কোথায় একটা হীনম্মন্যতা বোধ করে। আজীবক, তীর্থিকদের সেবা করে নিজেদের হীনতা স্খালন করতে চায়। দক্ষিণে গিয়ে সে রাজ্য স্থাপন করবে। আদর্শ নগর, সম্পন্ন গ্রাম, তক্ষশিলার মতো শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করবে বহু। এবং এ সমস্ত করতেই তার সাহায্য লাগবে একজন বুদ্ধিমতী, সাহসী, প্রেরণাদায়িনী রানির।
এই পর্যন্ত চিন্তা করে তিষ্যর মন অবসাদে ভরে গেল। রমণীর মন আজ পর্যন্ত কে-ই বা বুঝতে পেরেছে! পাওয়া তো দূরের কথা। সে কি এই তিন বছর বিশাখা সম্পর্কে একবারে নিশ্চিন্ত ছিল না? সমগ্র সাকেত নগরীতে আর কে আছে তার মতো সুপুরুষ, উপায়কুশল? তিন বেদ, শিক্ষা, কল্প, দর্শন, দণ্ডনীতি, ধনুর্বেদ, আঠারোটি শিক্ষণীয় বিষয়ের অনেকগুলিই তো আয়ত্ত করেছে সে। উপরন্তু এমন অমিশ্র আর্যবংশ, বন্ধুল মল্লর কাছে শস্ত্র শিক্ষা। ধনঞ্জয়-কন্যা যদি তার পাশে থাকত তাহলে দক্ষিণদেশে বর্বরদের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে চক্রবর্তী রাজা হওয়া তার পক্ষে খুব কঠিন হত না বোধ হয়। শ্বশুর একজন মহাধনবান শ্ৰেষ্ঠী, তাঁর অর্থবল হত তার পৃষ্ঠবল। কিন্তু এ সবই বাহ্য। আসল হল বিশাখা। বিশাখার প্রণয়। কাশ্মীরে, গান্ধারে, মদ্রদেশে বহু সুন্দরী দেখেছে সে। পারস্য দেশের কিছু কিছু রাজকুমার কাশ্মীরে বসবাস করেন, তাঁদের বংশের সুন্দরীরা দেবকন্যার মতো। কিন্তু বিশাখা অন্য রকম। তার সৌন্দর্যের সঙ্গে লাবণ্য, গাম্ভীর্যের সঙ্গে চাপল্য, বুদ্ধির সঙ্গে সারল্য, আভিজাত্যের সঙ্গে করুণা এমন আশ্চর্যভাবে মিশেছে! যে বিশাখা বালিকাবয়স থেকে গাভী, রোগগ্রস্ত কুকুর বিড়াল ও অশ্বদের পরিচর্যা নিয়ে দিনের এক চতুর্থাংশ সময় কাটায়, গুরুজনদের অভিবাদন করে রাজকুমারীর মতো, সমবয়স্কদের পরামর্শ দেয় মন্ত্রীর মতো, ভিক্ষুক আর শিশুদের প্রতি যার স্নেহ সারা সাকেতে সুবিদিত, সে তার প্রণয়প্রার্থী, উচ্চবংশীয় উচ্চশিক্ষিত ক্ষত্রিয়কুমারকে এইভাবে অপমানিত করল? এ কাজ কি বিশাখার যোগ্য হল?
কিন্তু কোন বিশাখা? বিশাখা নামে একটি অলৌকিক মানসপ্রতিমা গড়ে তার পূজা করছে না কি তিষ্য? দৈহিক রূপ মানুষকে বড় প্রতারিত করে, দেবশ্রীসম্পন্ন হলেই কি মানুষ দেবস্বভাব হয়? তক্ষশিলায় কত দেশ থেকে কত যুবক আসে। বেশির ভাগই অতি সুপুরুষ। কিন্তু তাদের কীর্তি স্মরণ করে এখনও শিউরে ওঠে তিষ্য। বারাণসী থেকে এক ব্রাহ্মণকুমার গিয়েছিল গুরু কাশ্যপের কাছে। অতি অল্প সময়েই দেখা গেল সে তার সতীর্থদের সব বিষয়ে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাতে কাশ্যপের শিষ্যরা এমন ঈর্ষাকাতর হল যে, ষড়যন্ত্র করে গুরুর মনে ধারণা জন্মিয়ে দিল যে, ওই ব্রাহ্মণকুমার কনিষ্ঠ গুরুপত্নীর প্রতি আসক্ত এবং উভয়ে ব্যভিচারে মত্ত। কাশ্যপ এতদিনের প্রিয় প্রতিভাবান ছাত্রটির সম্পর্কে একটু অনুসন্ধান করাও প্রয়োজন বোধ করলেন না। একটুও অনুকম্পা দেখালেন না। সোজা তাড়িয়ে দিলেন। অথচ ওই ব্রাহ্মণকুমার দিবাভাগে গুরুসেবা করে রাত্রে বিদ্যাশিক্ষা করত। পুণ্য শিষ্য ছিল তো! গুরুদক্ষিণার সহস্ৰ কার্ষাপণ দিতে পারেনি। তার পরিবর্তে সেবা দিত। তার সৎ চরিত্র, দীনতা, বিনয় লক্ষ্য করবার মতো। বিশাখা কেমন? কাশ্যপের অভিজাতবংশীয় ধনগর্বী সুপুরুষ শিষ্যগুলির মতো নিষ্ঠুর? বোধশূন্য? সহানুভূতিশূন্য? রূপ, খ্যাতি আর তিন বছর আগেকার বুদ্ধিমন্ত কথার্বাতার স্মৃতি দিয়েই কি তাকে বিচার করা চলে?
হঠাৎ তিষ্যর একটা কথা মনে হল। ব্রাহ্মণেরা কুমারী সমাবেশের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন কেন? উভয়েই বিবাহের বয়স পার হয়েছেন, পুরুষের অবশ্য বিবাহ যে-কোনও বয়সেই চলে, কিন্তু এই বয়সে ভার্যা গ্রহণের ইচ্ছা হলে, সে প্রথম বারই হোক, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বারই হোক সাকেতের কুমারী সমাবেশের জন্য এত ব্যাকুলতা কেন? ব্রাহ্মণগুলির আকৃতিও তো বেশ সৌম্য। কুমারীলোলুপ বটুদের মতো যেন ঠিক নয়। আরে! তিষ্য আবার নিজেকে তিরস্কার করল। আকৃতিতে কী এসে যায়! প্রকৃতি কেমন? বাইরের রূপ দেখে তা বোঝা অসম্ভব। কিন্তু ব্রাহ্মণরা তিনজন। শিবিকায় এসেছেন। ত্বরা আছে। কিছু ক্লান্ত ও উৎকণ্ঠিতও মনে হল। তিষ্যর মনে কৌতূহলের সঞ্চার হচ্ছে। কিন্তু একখণ্ড বিরাট মেঘ ভেসে আসছে। সহসা তীব্র ধারায় বৃষ্টি আরম্ভ হল।
৩
দীপে অগ্নিসংযোগ করলেন চণক। অন্ধকার এত গাঢ় যে, কুটিরের কোণগুলিও আলোকিত হল না। তৈলও সম্ভবত অল্প হয়ে এসেছে। চণকের চোখে ধন্ধ। দীর্ঘকায় আগন্তুক তাঁরই মতো মাথা নিচু করে কুটিরে ঢুকছেন। মাথায় উষ্ণীষ। দীর্ঘ অঙ্গচ্ছদ। সম্পূর্ণ শব্দহীন পাদুকা। আগন্তুককে চিনতে পারছেন না চণক। তাঁর কটিবস্ত্রে একটি ক্ষুদ্র ছুরিকা লুকানো আছে। ছুরির বাঁটে হাত রেখে চণক নম্র সুরে বললেন, ‘মাটির পীঠিকা ছাড়া এই কুটিরে ভদ্রকে বসতে দেবার মতো তো কিছু নেই! দয়া করে বসুন। রাত্রি গভীর, মধ্যযাম উত্তীর্ণ হয়ে গেছে সম্ভবত। এই নিশীথে, অরণ্যে, একাকী সন্ন্যাসী আপনার কী কাজে লাগতে পারে ভদ্র?’
‘একাকী সন্ন্যাসী?’ মৃদু, প্রায় নারীসুলভ সরু গলায় আগন্তুক বলল। তার কণ্ঠস্বরে শ্লেষ গোপন নেই, ‘সন্ন্যাসীই বটে! তোমার ছদ্মবেশ ভেদ করতে মগধের গূঢ়পুরুষের প্রয়োজন হয় না, যে কোনও বুদ্ধিমান নাগরিক তোমার জটাটি এইভাবে উল্টে দিতে পারে’, তরোয়ালের প্রান্ত দিয়ে আগন্তুক চণকের জটাটি ফেলে দিল। আজকে এই দ্বিতীয়বার। তার পরে বলল, ‘সুভদ্র, অনঘ আর সম্পাতি কোথায় গেল? দৌত্য কর্ম করতে এসে হীন চরের মতো ব্যবহার করছ কেন? ওদের তিনজনকে কি হত্যা করেছ?’ শেষের শব্দগুলি বলবার সময়ে আগন্তুকের কণ্ঠস্বর সহসা বদলে গিয়ে কর্কশ, কঙ্করময় বোধ হল।
চণক সসম্ভ্রমে প্রণিপাত করলেন। সমগ্র তক্ষশিলায় এই একটি মাত্রই রাজপুরুষ, একটি মাত্রই ব্যক্তি আছেন, যিনি কণ্ঠস্বর ইচ্ছামতো বদলাতে পারেন। তিনি হেসে বললেন, ‘স্বয়ং মহাচরাধিচর হয়ে চরবৃত্তিকে হীন বলছেন মহামাত্র দর্ভসেন?’
—বলছি। যে চর নিজের কার্য উদ্ধার করার প্রাথমিক উপায়গুলি সম্পর্কে এমন অসাবধান, যার ছদ্মবেশ এত অসম্পূর্ণ, উপরন্তু যাকে চর নিযুক্ত করা হয়নি, সেই স্ব-নিযুক্ত চরকে হীন বলব না তো কী! জানো কি, তোমার পৃষ্ঠদেশে স্বাভাবিক গাত্রবর্ণ স্পষ্ট বোঝা যায়! বয়স্ক মুখের সঙ্গে যুবাপুরুষের হাত-পা নিয়ে তুমি একটি অতি হাস্যকর মর্কটের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছ। তুমি সেই শশকের মতো যে দেহের সম্মুখভাগ বিবরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে মনে করে সে বুঝি নিজেকে অদৃশ্য করতে পেরেছে এবং শৃগাল বা তরক্ষু যার পশ্চাদ্ভাগ কামড়ে ধরে অনায়াসেই তার সায়মাশটি সমাধা করতে পারে। উপরন্তু তুমি অপরের ছদ্মবেশ ভেদ করতে পার না।
চণক মুখ তুলে বললেন, ‘ও আপনিই! মাগধ গূঢ়পুরুষ তবে আপনিই সেজেছিলেন?
—মূর্খ! শুধু মূর্খ নয়, হস্তিমূর্খ! মাগধ চর মগধেরই চর। তুমি যে ধরা পড়েছ তাতে কোনও সংশয়ই নেই। বহু কষ্টে সেই জন্যেই এই মধ্যরাত্রিতে অরণ্য ভেদ করে এই হস্তিমূর্খের সন্দর্শনে আসতে হয়েছে আমাকে। বলি, কোনও ব্যক্তি কি তোমাকে নগরীর উপান্তে যষ্টিবনে পৌঁছে দেয়নি?
—ওহ, সেই সম্ভ্রান্ত পুরুষই তবে আপনি? আমি ভেবেছিলাম সেও আর একটি মাগধ চর। সময়মতো উপস্থিত হতে পারব না বলে প্রথম চরের নির্দেশে এসেছে।
—মগধের শাসনযন্ত্রের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা তো আকাশ চুম্বন করছে দেখছি। তোমাকে সময়মতো পৌঁছে দিতে মাগধের কী দায়!
—আমার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া তো তার প্রয়োজন…।
অসহিষ্ণু হয়ে দর্ভসেন বললেন, ‘পূর্ণ পরিচয়ই বটে! মাগধ চেয়েছিল তুমি সন্ধ্যা পার করে ওই উদ্যানে প্রবেশ কর। তাহলে হত্যাটা সহজ হত।’
—হত্যা?
—হ্যাঁ নির্বোধ, হত্যা। শিবিকায় আমি সত্বর পৌঁছে না দিলে, ঘনপত্র বৃক্ষের অন্তরালে সঙ্গীদের নিয়ে সশস্ত্রভাবে ঘোরাফেরা না করলে, তোমাকে নিহত হতে হত।
মগধের চর কিভাবে তাকে সরোবরে মুখ ধুতে জোর করছিল মনে পড়ে একটু হাসলেন চণক, বললেন, ‘আমাকে নিহত করা অত সহজ নয়। যাই হোক, হত্যা করে লাভ?’
—লাভের কথা তো তুমিই ব্রাত্যটার সঙ্গে আলোচনা করছিলে। পুরস্কার! নিহত ব্যক্তিকে পরিষ্কৃত করলেই তাকে বিদেশি বলে স্পষ্ট চেনা যেত। ছদ্মবেশী বিদেশি, চর ছাড়া কী? ওই মাগধ বহু কার্ষাপণ পুরস্কার পেত। কিন্তু এ সব কথা থাক। এখন আসল কথায় এসো। সুভদ্র, সম্পাতি, অনঘকে কীভাবে হত্যা করলে? কেনই বা?
চণকের চোখ দুটি হঠাৎ জ্বলে উঠল, তিনি প্রাণপণে নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘আর্য দর্ভসেন, আপনি অনেকক্ষণ থেকেই আমাকে মূর্খ, হস্তিমূর্খ, মর্কট অনেক কিছু বলে যাচ্ছেন। সবই সহ্য করেছি। কিন্তু বিনা প্রমাণে, বিনা কারণে সহসা আমাকে হত্যাকারী বলে ধরে নেওয়াটা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমার আচার-আচরণে কি আমাকে হন্তা, এমন কি কোন রূপেই কোনও অপরাধী বলে মনে হয়?’
দর্ভসেনের মুখে হাসি খেলে গেল, বললেন, ‘তোমার জেনে রাখা ভাল চণক, কাউকে উত্তেজিত করে দিলে তার মুখ থেকে সত্য কথাটা শীঘ্র বেরিয়ে আসে। অপেক্ষা করছি। তোমার কী বলবার আছে বল।’
—সম্পাতিকে পাঠিয়েছি বৈশালী। সুভদ্র ও অনঘকে শ্রাবস্তীতে। প্রতি দিনই তাদের আগমন প্রত্যাশা করছি।
বিস্মিত দর্ভসেন বললেন, ‘কেন?’
—পথে আসতে আসতে ছদ্মবেশ ধারণ করবার নির্দেশ স্বয়ং মহারাজ পুষ্করদেবই দিয়েছিলেন, আপনি জানেন না কেন বুঝতে পারছি না। জনপদ থেকে জনপদান্তর যেতে যেতে আমরা বহু প্রকার কথা শুনেছি। চার জনে অবশেষে পরামর্শ করি গ্রীষ্ম পার হবে, তার পরেও বর্ষার তিন-চার মাস সময় আছে। ইতিমধ্যে এই মধ্যদেশ সম্পর্কে যথাসাধ্য জেনে নেওয়া ভালো। আপনি কি জানেন, মগধরাজের রাজবৈদ্য তরুণ জীবক এখন উজ্জয়িনীতে! প্রদ্যোত মহাসেনের কামলা রোগ হয়েছে। নিরাময়ের জন্য জীবক মহোদয়ের ডাক পড়েছে। এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যেখানে সেখানে কি আপনি আশা করেন মগধরাজ তাঁর মিত্র অবন্তীরাজের বিরুদ্ধে গান্ধারকে সাহায্য করবেন?
দর্ভসেন চিন্তিত মুখে চুপ করে ছিলেন, বললেন, ‘সমস্যা বটে! কিন্তু তোমার কাজ ছিল মগধরাজের কাছে আমাদের গান্ধারের দৌত্য নিয়ে যাওয়া, তারপর তিনি যা করবেন, আমাদের সেটাই মেনে নিতে হবে।’
চণক বললেন, ‘এ ছাড়াও আমাদের মনে রাখতে হবে রাজা বিম্বিসারের অগ্রমহিষী তো মদ্রদেশীয়! সাগলের সঙ্গে আমাদের তেমন কোনও বিবাদ নেই ঠিকই। কিন্তু তার পাশাপাশি পাণ্ডবরা এখন মহারাজ পুষ্করদেবের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখছে না। …আর এইসব কারণেই আমি সব দিক বিবেচনা করে শ্রাবস্তী ও বৈশালীতে আমার সহকর্মিদের পাঠিয়েছি। সেখানে বাতাবরণ কী, সাহায্য পাওয়া যাবে কি না, তারা পর্যবেক্ষণ করে আসুক। তারপর ফলাফল যাই হোক, আমরা দৌত্য করব।’
এই সময়ে অরণ্যে ঝিল্লির ঝংকার এমন সশব্দ হয়ে উঠল যেন খুব কাছেই কোথাও শত শত নর্তকী নূপুর বাজিয়ে নাচছে। দর্ভসেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ তিনি যেন আত্মগতভাবে বললেন, ‘কি জানি চণক, কাজটা হয়ত তুমি ভালই করেছ। তোমার শিক্ষার উপযুক্ত। সত্যিই, তুমি তো শুধু একজন যে- কোনও রাজপুরুষ নও, যে রাজার সন্দেশটুকু মাত্র বয়ে নিয়ে আসবে। তুমি দণ্ডনীতির পাঠ নিয়েছ বড় বড় পণ্ডিতের কাছে …সাধারণ রাজদূত শুধু সুদর্শন, শিষ্টাচারী, সুস্মিত, অক্রোধী এবং বাগ্মী হলেই চলে। এরূপ রাজপুরুষ অনেক পাওয়া যাবে গান্ধারে। কিন্তু তুমি… তোমাকে… আচ্ছা… চণক তুমি কি মগধরাজের ছিদ্র অন্বেষণ করছ? কিছু পেয়েছ বা শীঘ্র পাবে? সুন্দরী ললনা চাই? রাজার কি মণিমুক্তার প্রতি দুর্বলতা আছে? সুবর্ণ উপহার দিয়ে কিছু করা যাবে? এই বিম্বিসার যদি গান্ধাররাজকে, সাহায্য না করেন তাহলে অবন্তীর ওই চণ্ড মহাসেন যে অচিরে গান্ধার ছারখার করে দেবে!’
এ কথার সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে চণক বললেন, ‘ভাল কথা মহামাত্র, আপনি কীভাবে এখানে এসে পৌঁছলেন জানতে পারি কী? আমার ধারণা ছিল এই দৌত্যকর্মের দায়িত্ব মহারাজ শুধু আমার হাতেই দিয়েছেন। সুভদ্র, সম্পাতি এবং অনঘ যদিও আমার সতীর্থ, তবু আমার অধীনেই। আমিই ওদের চেয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু…মহারাজ যে আপনাকে সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করেছেন, এ ধারণা তো আমার ছিল না!’
দর্ভসেন রহস্যময় মৃদু হাস্য করে বললেন, ‘চণক, রাজকার্যের জটিলতার মধ্যে তুমি সবে মাত্রই প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছ সত্য, কিন্তু রাষ্ট্রনীতির গূঢ় নিয়মগুলি যে তুমি একেবারে জানো না, তা তো নয়!’
চণক মাটিতে কতকগুলি অক্ষর আঁকছিলেন একটি শলাকার অগ্রভাগ দিয়ে, কতকগুলি অক্ষর, কিছু অবয়ব। তিনি প্রায় স্বগতোক্তি করলেন, ‘তাহলে মহারাজ পুষ্করদেব আমাকে বিশ্বাস করেন না? আমার পর্যবেক্ষণশক্তিতে বা দৌত্য বিষয়ে যোগ্যতায় তাঁর আস্থা নেই!’
দর্ভসেন তাড়াতাড়ি বললেন, ‘এমন কথা বলো না চণক। এ তো রাজকার্যের গতানুগতিক নীতিই! বিশেষ, তুমি বয়সে ও অভিজ্ঞতায় নবীন, যদিও বুদ্ধি ও শিক্ষায় অবশ্যই প্রাজ্ঞ!’
চণক হঠাৎ মুখ তুলে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, ‘আর্য কি এখানেই শয়ন করবেন? আমি তাহলে কিলিঞ্জক বিছিয়ে দিই!’
—এত রাত্রে আর কোথায় যাব? তুমি অনর্থক এত কৃচ্ছ্রসাধন করছ চণক!
মহামাত্রের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়ে দীপটি নিবিয়ে দিলেন চণক। মহামাত্র শয়নমাত্র গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়েছেন। মৃদুস্বরে তাঁর নাক ডাকছে। চণক জানেন এই নিদ্রা অতি সতর্ক নিদ্রা। সামান্যতম শব্দে টুটে যাবে। মহামাত্রের মুঠি সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে পাশে রাখা তরোয়ালের দিকে। কুশলী! অতি কুশলী! যা শিখে এসেছেন, এতকাল ধরে যা যা চলে আসছে, সবই নিপুণভাবে প্রয়োগ করতে পারেন এঁরা। তার থেকে এতটুকু সরলে, এতটুকু কল্পনাশক্তির ব্যবহার করলে এঁরা বিচলিত হয়ে পড়েন। বুঝি সব গেল, শাস্ত্র, রাজ্য, সংসার, দেশ, সব ভেঙেচুরে গেল। চণক ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, না এঁদের সঙ্গে তাঁর মিলবে না। তিনি পরিকল্পনায় বিশ্বাসী। প্রকল্পনা। প্রকৃষ্ট কল্পনা। তিনি স্বপ্ন দেখেন। কোনও স্বপ্নকেই অগ্রাহ্য করেন না। কবে কোনকালে রাজা জনক, কি ইক্ষ্বাকু, কি যযাতি কী করেছিলেন, অবশ্যই সেগুলি শ্রোতব্য, বিচার্য, কিন্তু সে সবই ভিত, সেই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে বহু দূর দেখতে হবে। সু-উচ্চ অট্টালক স্থাপন করতে হবে। না হলে সকলই বৃথা।
তিনি কুটিরের বাইরে চলে এলেন ধীর পদক্ষেপে। এই মধ্যদেশে যাকে নাসিকা কুঞ্চিত করে গান্ধাররা বলে ও-স্থানও তো প্রাচীই, পাপভূমি, কীকট দেশ, এখানে অপেক্ষাকৃত আগেই সূর্যোদয় হয়। যতই পূর্বে যাওয়া যাবে, ততই শীঘ্র সূর্য উঠবে। একটি সূক্ষ্ম গণনা আছে। চণক জানেন আজ সূর্যোদয়ের সময় পাঁচ প্রহরের কিছু আগে। আকাশ আজ পরিষ্কার। সূর্যোদয়ের বহু পূর্বেই পদ্মের অভ্যন্তরের মতো একটি মৃদু লাল আভা পূর্বাচল থেকে ধীরে ধীরে গগনমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। বালার্কর চেয়ে এই আভা তাঁকে আকৃষ্ট করে বেশি। তাঁর হৃদয়মণ্ডলেও যেন ছড়িয়ে যায় এই আভা। তিনি এখন কুটির দুয়ারে বসে এই সূর্যোদয়ের পূর্ব লগ্ন দেখবেন অবিকল যেমন ঋষি কুৎস আঙ্গিরস দেখেছিলেনঃ
ইদং শ্রেষ্ঠং জ্যোতিষাং জ্যোতিরাগাত
চিত্রঃ প্রকেতো অজনিষ্ট বিভ্বা।
তিমির বিদীর্ণ করে, সকল জ্যোতির জ্যোতি উষা আসছেন। কুৎস উষা ও রাত্রিকে দুই ভগ্নী রূপে কল্পনা করেছেন। উষা শ্বেতা, রুশতী, আর রাত্রি কৃষ্ণা। উষা অজীগর্ ভুবনানি বিশ্বা…! উষা জাগালেন। জাগাচ্ছেন। জাগিয়ে থাকেন এই বিশ্বভুবন। এই সময়ে কিছু ভাবতে ইচ্ছা করে না। খুব বেশি দুশ্চিন্তা করার মানুষও এমনিতে তিনি নন। এখন তিনি ডুবে আছেন রুশতী উষার আবির্ভাবরসে। নীরন্ধ্রা কৃষ্ণা রাত্রির রূপও তিনি দেখেছেন এই দু মাসে। অরণ্যের মধ্যে রাত্রি যে কী নিবিড়, কী নিকষ, তা লোকালয় থেকে কল্পনা করা যায় না। লোকালয়ে মাথার ওপর চন্দ্রাতপ বিছিয়ে থাকে আকাশ। লক্ষ দীপশিখার মতো। কিংবা হরিদ্রাভ, নীলাভ সব হীরের মতো জ্বলে তারকারাজি। অন্ধকার তরল হয়ে যায়। এই অটবীতে যেন রাত্রি সত্যিই উষার অপরা ভগ্নী। একেবারে বিপরীত। সে শব্দময়ী। ঝিল্লিঝঙ্কারে, নিশাচর পাখির ডাকে, মাংসলুব্ধ, তৃষ্ণার্ত পশুদের বিচিত্র দূরাগত আওয়াজে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। জোনাকি জ্বলে। কিন্তু সে শুধুই টিপ টিপ জ্বলা, তাতে কোনও আভা নেই। দেখা যায় না কিছু। কিন্তু সম্পাতি, সুভদ্র, অনঘ সত্যিই ভাবালে! পাটলি গ্রামের কাছে বন্ধুদের নিয়ে গঙ্গা থেকে মধ্যদেশের ভূমিতে অবতরণ করেছিলেন তিনি। নৌকায় সমানে গূঢ় পরামর্শ চলেছে। জীবক কোমারভচ্চর উজ্জয়িনী যাবার জনশ্রুতি গঙ্গাপথেই শোনা গিয়েছিল। কত পণ্য বোঝাই তরী যে পশ্চিম থেকে পূর্বে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে ভেসে যাচ্ছে, আসছে। তাদের অনেকের সঙ্গেই রয়েছে জলনিয়ামক। নদীর স্রোতের সমস্ত গূঢ় কথা জানে। জানে কোথায় কোন গ্রামে, কী জনপদে কেমন আহার্য পাওয়া যাবে, নামা নিরাপদ কিনা, নদীদস্যুদের দৌরাত্ম্য কোন কোন অঞ্চলে। এইসব নৌ-বণিকদের অধিকাংশই ছ মাস সাত মাস কি তারও বেশি গৃহছাড়া, আপনজনের মুখ দেখে না। সেই ক্ষতি হয়ত পূরণ করছে দেশ-দেশান্তরের অভিজ্ঞতা। চোখে দেখা, কানে শোনা। কখনও কৌতুকময়, কখনও কৌতূহলপ্রদ, কখনও ভয়ঙ্করের ধার ঘেঁষেও যায় সেসব কাহিনী। …
—কারে পার করো ভাই, ও পাটনী।
—দেশ জিজ্ঞাসা করি নাই। কথায়বার্তায় মনে হয় তক্ষশিলার স্নাতক। মগধ যায়।
—তুমি কারে নিয়া যাও?
—আর কইও না। বহু লক্ষ পণের বারাণসী লইয়া যায়। চম্পার পথে যমের সদৃশ কুম্ভীর বণিকের নৌকা উল্টায়। পণ্য সব জলে গেছে। বণিক বয়সে তরুণ, মায়ের জমা কাহন-কড়ি নিয়া বার দিয়াছিল। সবার সব থাকে, দুঃখী মানুষটারই সব যায় ভাই, কারে দোষ দিব, কও। মাথার যেন দোষ হচ্ছে, মনে লয়। আপন মনে বিড় বিড়ায়, মাঝি, উহারে ঘরে লইয়া যাই।
—আহা! আহা! যাও ভাই। ভাগ্যে থাকে আবার সকলই হবে।
কেউ কেউ বলল জীবক কোমারভচ্চ আহূত হননি। শ্ৰেণীক বিম্বিসার নিজেই উদ্যোগ করে পাঠিয়েছেন তরুণ বৈদ্যকে। অতি অল্পসময়ের মধ্যে কোমারভচ্চর খ্যাতি নাকি ছড়িয়ে পড়েছে চার দিকে। রাজা বিম্বিসার এই সুযোগে চণ্ড মহাসেনের চণ্ডতা প্রশমের আশায় আছেন। অর্থাৎ, মগধরাজ নিজেও ওই চণ্ডরাজকে ভয় করেন, তার সখ্য চান যেন তেন প্রকারেণ। একটি ক্ষত্রিয়বংশীয় যোদ্ধাবেশী যাত্রী সকৌতুকে বলছিল, ‘কেন, অবন্তীরাজের কি বাসবদত্তা ছাড়া আর সুন্দরী কন্যা নেই? আর মহারাজ বিম্বিসারেরও কি বীণা কি বংশীবাদন আসে না! না হলে কৌশাম্বীরাজ উদয়নের মতো তিনিও চণ্ডরাজাটার জামাতা হতে পারতেন! সব দিক রক্ষা হত!’
এইসব কথা শুনে চার বন্ধু পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় করত নীরবে। এইসব রটনা যদি সত্য হয়, তাহলে তো গান্ধার থেকে এত দূর আসা একপ্রকার বৃথাই হল! অবশেষে পাটলি গ্রামে এক সম্পন্ন গৃহস্থের অতিথিশালায় দু রাত পরামর্শের পর স্থির হল শ্রাবস্তী ও বৈশালী ঘুরে আসা প্রয়োজন। শ্রাবস্তী ও বৈশালী মগধের মিত্ররাজ্য। সেখান থেকে চণ্ড মহাসেনের বিরুদ্ধে সাহায্যের আশা থাকলে হয়ত মগধরাজ গান্ধারের প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখতে পারেন। বস্তুত চণ্ডরাজাটি কাউকেই জ্বালাতে ছাড়েন না। নিজের জামাতার সঙ্গেও প্রণয় নেই। এ তো সাধারণ দৌত্যকর্ম নয়! মহামাত্র দর্ভসেন যাই বলুন না কেন! দেব পুষ্করসারী কূটকক্ষে তাঁকে স্বতন্ত্রভাবে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, যেভাবে হোক অবন্তীরাজ প্রদ্যোত মহাসেনকে নিরুদ্যম করার ব্যবস্থা করতে হবে, মগধরাজের বন্ধুত্ব চাই-ই চাই। কাজেই চণক প্রচলিত পথ থেকে সরে গিয়ে রাজাজ্ঞার বিরোধী তো কিছু করেননি! তবু কেন দর্ভসেনের আবির্ভাব হল? মস্তিষ্কের মধ্যে প্রশ্নগুলি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, গণনার উত্তর মিলছে না। চণক তাই বড় বিভ্রান্ত বোধ করছেন। রাজগৃহের যে অতিথিশালায় তাঁর সঙ্গী তিন জনের আসবার কথা, সেখানে তিনি নিত্যই খোঁজ নিয়ে থাকেন। কিন্তু না। কোনও চিহ্ন নেই! অথচ বোঝা যাচ্ছে, তাঁর অজ্ঞাতবাসের দিন ফুরোল। প্রথম কারণ, মগধের চর। দ্বিতীয় কারণ, দর্ভসেন। আটবিকদের জেগে ওঠবার আগেই, এদিকে তারা আসবার আগেই, তাঁকে এ স্থান ত্যাগ করতে হবে। আটবিকরা থাকে অরণ্যের নিবিড়তর অঞ্চলে। সেখানে বড় বড় বনস্পতি বহুক্ষণ দিনের আলো ঠেকিয়ে রাখে। তারা রাত্রে বহুক্ষণ জেগে জেগে নৃত্যগীত, আমোদ-প্রমোদ করে, নিশাচর প্রাণী সব। সকালে তাদের ঘুম ভাঙতে আর একটু বিলম্ব হবে। এই সুযোগে চলে যেতে হবে। সংকল্প স্থির করে তিনি নিকটবর্তী বন্য সরোবর থেকে ভালো করে স্নান করে এলেন, কুটিরে এসে ক্ষুদ্র পেটিকা থেকে পীতবর্ণের অধোবাস বার করে পরলেন। পায়ে গান্ধারদেশীয় পাদুকা। গায়ে শ্বেত উত্তরীয়। কটি থেকে তুলে নিয়ে শুভ্র উপবীত বক্ষে স্থাপন করলেন যথাযথ। তার পর সুবর্ণমণ্ডিত কঙ্কতিকা দিয়ে তাঁর স্বর্ণাভ কৃষ্ণ কেশ আঁচড়ালেন। দর্ভসেন ততক্ষণে উঠে বসেছেন। বললেন, ‘ভালো, তুমি তবে প্রস্তুত?’
চণক বললেন, ‘হ্যাঁ। এবার যত শীঘ্র পারি এ স্থান ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে। আটবিকরা যে-কোনও সময়ে এখানে এসে পড়তে পারে। এসে আমাদের দেখলে প্রীত হবে না।’
দর্ভসেন মুখে একটা অবজ্ঞাসূচক শব্দ করে বললেন, ‘কেন? তুমি কি আটবিকদের মুখোমুখি হতে ভয় পাও নাকি?’
চণক গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ওদের তীরে তীক্ষ্ণ বিষ মিশ্রিত থাকে আর্য, দূতকার্য সমাধা না করেই যমসদনে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। আপনি ওই সরোবরে চলে যান। ওই যে শিংশপা বৃক্ষ দুটির মাঝখানটায় দেখুন, চকচক করছে! আমি অপেক্ষা করছি।’
কিছুক্ষণ পরেই দর্ভসেন মুখমণ্ডলের জল উত্তরীয় প্রান্ত দিয়ে মুছতে মুছতে ফিরে এলেন। বললেন, ‘চলো। বিষের তীরকে দর্ভসেন ভয় পায় না। কিন্তু কার্যসিদ্ধির পূর্বে অনর্থক গোলমাল, রক্তপাত এসব অশুভ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়াটা ঠিক নয়।’
দুজনে অবিলম্বে বনানীর উত্তর প্রান্তের দিকে চলতে লাগলেন। ক্ষুদ্র মাটির কুটিরের মধ্যে একটি কিলিঞ্জক বিছানো রইল। এক প্রান্তে একটি নির্বাপিত মাটির প্রদীপ। একটি মাটির পাত্রে জলে ভেজানো কিছু সুগন্ধ বন্যকুসুম। এবং কিলিঞ্জকের ঠিক মাঝখানে একটি সুবর্ণমণ্ডিত কঙ্কতিকা। কুটিরের দুয়ার বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে আসবার সময়ে দর্ভসেন বললেন, ‘কিছু যেন ফেলে এলে?’
—কিছু নয়, বলতে বলতে চণক নিমেষে বনভূমির অনেকটা পার হয়ে গেলেন। দর্ভসেন বললেন, ‘সহসাই যেন তোমার আচরণে একটা অস্বাভাবিক দ্রুতি এসে গেছে। এতদিন তো এখানেই বাস করছিলে! বসেই ছিলে।’
চণকের চোখ ঝলসে উঠল, দর্ভসেন দেখতে পেলেন না। আত্মসংবরণ করে চণক বললেন, ‘ছিলাম সন্ন্যাসী বেশে। দুজন সম্ভ্রান্ত আর্যপুরুষকে তাদের বাসস্থানের ত্রিসীমায় দেখতে পেলে আটবিকরা অবশ্যই লক্ষ্যভেদ করবে। শীঘ্র চলে আসুন।’
বন পার হয়ে নগরপ্রান্তে পৌঁছবামাত্র গান্ধারের রক্ষীবাহিনী তাঁদের ঘিরে ধরল। মহামাত্র দর্ভসেনের অশ্ব এবং আরও একটি অশ্ব চণকের জন্য নিয়ে তারা সারারাত অপেক্ষা করছিল। এক লাফে নিজের ঘোড়াটির ওপর চড়ে খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন চণক। রক্ষীদের মধ্যে কারও কারও মুখ চেনা। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হল। সসম্ভ্রমে প্রশ্নের উত্তর দিল তারা। তাদের অনর্থক শরীর কঠিন এবং মুখের পেশীগুলি স্থির রাখার চেষ্টা দেখতে দেখতে চণকের মনে হচ্ছিল, তিনি কি এই দু মাসে একটু বুনো হয়ে গেছেন! নিজেকে যেন আর দর্ভসেনের কর্তৃত্বাধীন ওই রক্ষীবাহিনী, যা গান্ধারের প্রতীক, যা উচ্চবর্ণ সভ্যতার ও রাজকীয় আচারআচরণেরও প্রতীক, তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। স্বাচ্ছন্দ্য এবং অস্বস্তি এই দুই বিপরীত অনুভূতির মাঝখানে পড়ে তিনি যেন একটু হতবুদ্ধিও।
দর্ভসেন বললেন, ‘নগরদ্বারে গিয়ে গান্ধারের দূতবাহিনীর আগমন ঘোষণা করো রক্ষীজ্যেষ্ঠক।’
চণককে বললেন, ‘আমরা নগরের বাইরে এক পান্থশালায় ছিলাম এতদিন। তোমাদের কারও দেখা পাই না! না পেলে তো প্রথানুযায়ী কিছু করতেও পারি না। ভালো সমস্যাতেই ফেলেছিলে, যা হোক।’
চণক উত্তর দিলেন না। দর্ভসেনের পাশাপাশি চলছিল তাঁর ঘোড়াটি। রাশ টেনে একটু পিছিয়ে নিলেন। তারপর চিন্তিত মুখ অল্প নিচু করে মন্দগতিতে চলতে লাগলেন।
রোদ ক্রমশ প্রখর হয়ে উঠছে। নগরদ্বার পেরিয়ে গেল। নগরদ্বারের অতি স্থূল কঠিন ইন্দ্রকীলকের পাশেই দৌবারিকদের পীঠাগার, একজন অশ্বারোহী তীরবেগে রাজপুরী অভিমুখে ছুটে গেল গান্ধার দূতদের আগমনবার্তা নিয়ে। আর একজন সমাদরে নিয়ে যাচ্ছে তাঁদের পথ দেখিয়ে। ক্রমশই পথগুলি আরও প্রশস্ত পরিষ্কার, একটি দুটি করে সৌধ দেখা দিচ্ছে। সুসজ্জিত নগরবাসীরা বেরিয়ে পড়েছে। মুছে যাচ্ছে তমসাবৃত, তরুচ্ছায়াশীতল অরণ্য, পাতার কুটির। দূরে ডিম ডিম শব্দ। কালো কালো মানুষগুলির হাতে অব্যর্থ-লক্ষ্য তীর ধনুক। মুছে যাচ্ছে নীরন্ধ্র অন্ধকারে একটি মাত্র দীপের আলো, উদ্দক, রগ্গা। চণক ভাবলেন একটি অধ্যায় শেষ হল তাহলে! যখন তক্ষশিলা থেকে বেরিয়েছিলেন, তখন কি ভাবতে পেরেছিলেন এইসব অভিজ্ঞতার কথা! হয়ত এর পরেও যা ঘটবে তার মধ্যেও থাকবে কল্পনার অতীত কিছু। যতই পরিকল্পনা করুন, জীবনযাপন ও কর্তব্যকর্মের মধ্যে যদি অভাবনীয়র প্রবেশ মাঝে মাঝে না ঘটে, তো জীবনের স্বাদ যেন লবণহীন ব্যঞ্জনের মতো মনে হয়। সুতরাং বিপদ থাক। থাক-যা কিছু আকস্মিক, রোমাঞ্চক। মহামাত্র দর্ভসেনের মতো বাঁধানো রাজমাৰ্গ দিয়ে চলা সব সময়ে তাঁর পোষাবে না।
৪
নদীতীরে পাষাণময় গৃহ। শ্রেষ্ঠী নদীতীর বহুদূর পর্যন্ত বাঁধিয়ে দিয়েছেন। এই গৃহও দ্বিতল। উপরিতলে জলবণিকরা ইচ্ছামতো বিশ্রাম নিতে পারে। রয়েছে বিশ্রামাগার। বিশ্রামাগারে সুখশয্যা, কাষ্ঠফলক, ব্যবস্থাপক, দাসদাসী, জলপূর্ণ কুম্ভ। নিচতলায় নারী পুরুষের স্বতন্ত্র বেশাগার। বহুজনের বসবার জন্য কাষ্ঠাসন, পাষাণবেদী। এই গৃহের উন্মুক্ত প্রশস্ত অলিন্দপথে দাঁড়িয়েই উৎসবমত্ত নগরবাসীদের দেখছিলেন তিন ব্রাহ্মণ। সহসা বৃষ্টি আসতে তাঁরা একটি ভারি সুন্দর দৃশ্য দেখলেন। মৌচাকে ঢিল মারলে যেমন মৌমাছিরা সবেগে বেরিয়ে এসে এক দিকে ধাবিত হয়, বৃষ্টির বিন্দুগুলি তীরের ফলার মতো আকাশ থেকে নেমে আসবার সঙ্গে সঙ্গে তেমনি বহু তরুণী, যারা এতক্ষণ বিপণিগুলিতে কেনা-কাটায় ব্যস্ত ছিল, ব্যস্ত ছিল পরস্পরের সঙ্গে মধুরালাপে, তারা মাথা নিচু করে এলোমেলো ভাবে কিন্তু সবেগে ছুটে আসছে বেশাগারে আশ্রয় নেবার জন্য। তরুণরাও আছে। আছে বালকবালিকার দল। কিন্তু তরুণীগুলি সযত্নে প্রসাধন করেছে। তাদের মাথার কবরীশোভন কুসুমালঙ্কার থেকে পায়ের আলতা পর্যন্ত নিখুঁত সজ্জা। কণ্ঠের মালা দুলছে, কাঞ্চীগুলি ঝাপটা মারছে নিতম্বে, ওই কার পা থেকে নূপুর খসে পড়ে গেল, নিচু হয়ে তুলতে যেতেই খসে পড়ে গেল কণ্ঠহারের কেন্দ্রমণি পুষ্পগুচ্ছটি। কেউ হয়ত দু হাতে মাথার ওপরটা ঢাকছে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
হঠাৎ কনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বলে উঠলেন, ‘দেখুন দেখুন। ওইদিকে দেখুন!’
তিন জনে তাকিয়ে দেখলেন সবাই ছুটছে। খালি একটি মেয়ে আসছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। চলার ধরনটি ভারি সুন্দর। অতি মন্থরও নয়, অতি দ্রুতও নয়। রাজহাঁস যেমন অবলীলায় জলে ভেসে যায়, তেমনি। মেয়েটির গাত্রবর্ণ পদ্মের কচি পাপড়ির মতো কোমল, অরুণাভ, মসৃণ। বৃষ্টির জলে তার কোনও প্রসাধনই ধুয়ে যায়নি। অর্থাৎ সে প্রসাধনবিনাই এমন। অপরিমিত কালো কেশের মধ্যে মুখটি ফুটে আছে কহ্লার কুসুমের মতো। আকৃতি, গঠন, অঙ্গসৌষ্ঠব ও অবয়বসংস্থানে এত সুষমা যে, ব্রাহ্মণদের দৃষ্টি যেন এক শীতল শান্তি অনুভব করল। সবচেয়ে আশ্চর্য মেয়েটির কেশ। ঠিক ময়ূরপুচ্ছের মতো তার মাথার চারদিকে চালচিত্র রচনা করেছে। আর কেশাগ্র সব সাপের ফণার মতো বাঁকানো।
কনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বিস্ফারিত লোচনে চেয়ে চেয়ে বললেন, ‘একেই বলে যথার্থ কেশকল্যাণী। এমনটি আর দেখিনি।’
জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘এ যে কেশকল্যাণী, মাংসকল্যাণী ও ছবিকল্যাণী তাতে সন্দেহ নেই। ত্বক দেখুন জ্বলজ্বল করছে। গঠন দেখুন সুকুমার, নির্দোষ। কিন্তু বড় অলস।’
মধ্যম বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন আর্য, স্বামীর কপালে দগ্ধোদন।’
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘সুন্দরী পত্নীও হবে আবার সুসিদ্ধ অন্নব্যঞ্জনও সময়মতো পাওয়া যাবে, এত ভাগ্য করে কজন পুরুষ আর আসে বলো! ও দুটি বস্তু আজকাল আর একত্র পাওয়া যাচ্ছে না।’
কিশোরী ততক্ষণে বেশাগারের অলিন্দে ব্রাহ্মণদের পাশেই প্রায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার দুগ্ধধবল উত্তরীয়টি এবং নীলাভ শ্বেত অধোবাসটি দেহের সঙ্গে একেবারে জড়িয়ে গেছে। ফুটে আছে পুস্পমালার দুধারে উন্মুখ শঙ্খের মতো বক্ষযুগল। এমন নিখুঁত নাতিস্থূল, মনোহর শ্রোণিদেশ, এমন সুচারু জঙ্ঘা, প্রস্ফুটিত কমলপত্রের মতো চরণ ব্রাহ্মণরা আর দেখেননি।
সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণদের দিকে তাকিয়ে কিশোরী বলল, ‘আপনারা কি আমায় কিছু বলছেন?’
মেয়েটির কণ্ঠস্বরে চমৎকৃত হলেন তিন ব্রাহ্মণ। কনিষ্ঠ বললেন, ‘কণ্ঠকল্যাণী, না স্বরকল্যাণী, কী বলবে একে? যদিও আমাদের অনুসন্ধানের মধ্যে এটি পড়ে না।’
জ্যেষ্ঠ বললেন, ‘অস্থিকল্যাণীও বটে, দন্তপঙ্ক্তি যেন ঘনবদ্ধ হীরকের সারি।’
—কিছু বললেন? আবার জিজ্ঞেস করলো কিশোরী।
—না। বলছিলাম মা, তোমার সখীরা কেমন বৃষ্টি আসতেই দৌড়ে এসে এই গৃহে আশ্রয় নিল, রক্ষা পেয়ে গেল। তুমি ভিজে গেলে।
মেয়েটি হাসল। বহুদর্শী অভিজ্ঞ মানুষ যেমন অল্পদর্শী, অল্পবুদ্ধি মানুষের কথা শুনে হাসে, তেমনি অনুকম্পামিশ্রিত ক্ষমার হাসি।
জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘মা, কিছু বলবে?’
মেয়েটি বলল, ‘একটা প্রশ্ন হঠাৎ মনে এলো, আপনারা তো বিদ্বান, বহুদর্শীও বটে, অনুমতি দেন তো জিজ্ঞাসা করি।’
—নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করবে। এর আবার অনুমতি কি মা!
মেয়েটি বলল, ‘বহু অলঙ্কার আর মূল্যবান মণিমুক্তাখচিত পরিচ্ছদে ভূষিত অভিষিক্ত রাজা, ধরুন মাথায় মুকুট, হাতে দণ্ড—হঠাৎ বেগে দৌড়তে আরম্ভ করলেন…যথাযথ হবে কি?’
জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হেসে বললেন, ‘একেবারেই না। অভিষিক্ত রাজা হবেন শার্দুলগতি, তাঁর মহিমা যতটা না আকৃতিতে, তার চেয়েও অধিক তাঁর গতিভঙ্গিতে থাকে মা।’
মেয়েটি বলল, ‘তবে রাজহস্তী? পিঠে সুদৃশ্য বস্ত্রাচ্ছাদন, সুখাসন, তার ওপর শ্বেতচ্ছত্র, মস্তকে ও শুণ্ডে পত্রলেখা। এই হস্তী যদি দৌড়ায়?’
‘ভারি কুদৃশ্য হবে মা’ মধ্যম ব্রাহ্মণ বললেন, ‘অতি ভয়াবহও বটে! প্রথমেই লোকে ভাববে হস্তীটি পাগল হয়ে গেছে। মদবারি ঝরছে কিনা লক্ষ করবে। কারণ ওই সময়ে হাতি সাময়িকভাবে ক্ষিপ্ত হয়। যখন দেখবে তা-ও নয়, তখন এই হস্তী সম্পর্কে তাদের আর কোনও দয়াই থাকবে না। শত শত বাণ বর্ষণ করে হয়ত মেরেই ফেলবে। রাজহস্তী হল গজেন্দ্র, চলবে গজেন্দ্রগমনে।’
মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, ‘আচ্ছা, তবে সন্ন্যাসী? মুণ্ডিতমস্তক, সৌম্যদর্শন সন্ন্যাসী? হাতে ধরুন ভিক্ষাপাত্র। হঠাৎ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে আরম্ভ করলেন।’
তিন ব্রাহ্মণই হেসে উঠলেন, ‘ছিঃ, মানাবে না মা। সন্ন্যাসীকে কি অধৈর্য মানায়! তিনি তো সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণভয়ও বিসর্জন দিয়েছেন। তিনি হবেন ক্ষান্তিবাদী। হাত পা নাক কান কেটে ফেললেও তিনি ধৈর্যশীল থাকেন। তিনি অকস্মাৎ ধাবিত হলে, ইতরজন কী শিখবে?’
—উৎসবসাজে সজ্জিত সদ্বংশজাত নারীকেও ছুটলে মানায় না আর্য।
চমকে উঠলেন তিন জন। জ্যেষ্ঠের চোখে কৌতুক ঝিলিক দিল। কিশোরী নিজেকে অনায়াসে নারীর দলে ফেলে দিল। একেই সে সর্বাঙ্গসুন্দরী, তার ওপর তার অঙ্গবিক্ষেপ এত মনোহর যে, এই মুহূর্তে সত্যি কথা বলতে কি তাঁর ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটির দৌড়নোর দৃশ্য দেখতে। তবে এটা সত্যি অল্পবয়স্কা হলেও মেয়েটি হরিণী প্রকৃতির নয়, বরং যেন একটি হংসবালিকা। মানস সরোবরে রাজহংসী।
মেয়েটি এই সময়ে হংসের মতোই কটাক্ষ হেনে বলল, ‘বৃষ্টিপাতে অধোবাস অঙ্গের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে আর্য, আপনারা কি চান আমি দৌড়তে গিয়ে পড়ে হাত-পা ভাঙি?’
—কখনও না মা, কখনও না। তিন জনে সমস্বরে বলে উঠলেন। তাঁদের মনোগত ইচ্ছে কি মেয়েটি পড়তে পেরেছে?
—হাত-পা ভাঙলে আর কারও কিছু না, কিন্তু আমার পিতামাতা যে আশা করে আছেন, এত যত্নে লালিতা কন্যাকে সুপাত্রে অর্পণ করবেন, তা কি পারবেন? বিবাহযোগ্য যুবারা বরং দগ্ধোদন খেতে রাজি, কিন্তু ভগ্নহস্ত, ভগ্নপদ কন্যা কদাপি বরণ করবেন বলে তো মনে হয় না।
—ঠিকই বলেছ মা। একেবারে ঠিক। হাসি চেপে জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বললেন। মেয়েটি খুবই সপ্রতিভ। কিছুটা প্রগলভও বটে। তাঁদের কথাবার্তা বোধ হয় কিছু কিছু শুনতে পেয়েছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত উত্তর দিয়েছে। অকালপক্ক, কিন্তু স্বীকার করতেই হবে ভারি মনোহর।
মধ্যম ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নামটি কী মা?’
—বিসাখা।
—কার কন্যা?
—পিতা ধনঞ্জয় সেট্ঠি, মাতা দেবী সুমনা।
—কোন্ ধনঞ্জয়? ভদ্দিয় নগরের মেণ্ডক শ্রেষ্ঠীর পুত্র না কি?
—তিনিই। বিশাখার কণ্ঠে শান্ত গৌরব।
—তুমি ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা? সবিস্ময়ে বললেন জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, তবে তো পুষ্পরাগ খুঁজতে খুঁজতে আমরা আসল হীরকমণিই পেয়ে গেছি। বলতে বলতে তিনি চকিতে একটি দীর্ঘ সুবর্ণহার বিশাখার গলায় পরিয়ে দিলেন। তার বহুমূল্য রত্নখচিত কেন্দ্রমণিগুলি তার বক্ষের নিচে দুলতে লাগল। ব্রাহ্মণ বললেন—শ্রাবস্তীবাসী মিগার শ্রেষ্ঠীর পক্ষ থেকে এই সুবর্ণহার দিয়ে তোমায় আশীর্বাদ করতে অনুমতি দাও মা। তাঁর সুপুত্রের জন্য আমরা কন্যা নির্বাচন করতে বেরিয়েছি।
আশেপাশে সখীরা হাততালি দিয়ে কলকল করে উঠল, ‘বিসাখা বৃত হয়ে গেল, বিসাখা বৃত হয়ে গেল।’
বিশাখা সপ্রতিভ কণ্ঠে জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী যেন নাম বললেন সেট্ঠির?’
—মিগার, মৃগার। কোশল রাজধানী শ্রাবস্তীতে বাস।
—আর তাঁর পুত্র?
—তরুণ পূর্ণবর্ধন।
বিশাখা গম্ভীর মুখে সখীদের ডেকে বলল, ‘সই, শীঘ্র যাও, পিতাকে খবর দাও, রথ পাঠিয়ে দিতে বল, এখন তো আর পায়ে হেঁটে যেতে পারব না!’
বৃষ্টির বেগ এতক্ষণে প্রশমিত। যারা বেশাগারে অলিন্দে আশ্রয় নিয়েছিল, সেইসব সাকেতবাসীরা কৌতূহলের দৃষ্টিতে বিশাখা এবং তিন ব্রাহ্মণের দিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ি ফিরে চলল। অনেকে এখনও অপেক্ষা করছে। শ্রেষ্ঠীর গৃহ থেকে রথ আসবে, শ্রাবস্তীর তিন বটুকে নিতে ধনঞ্জয় নিজে আসেন কি না, এসব অনেক কৌতূহলের বিষয় এখনও রয়েছে। কয়েকজন রথের কথা বলতে চলে গেলেও অধিকাংশ সহচরীই এখনও বিশাখার চারপাশে তাকে প্রায় বৃত্তাকারে ঘিরে রয়েছে। আছে সাকেতের আরও অনেক বড় ঘরের মেয়েরাও। তাদের কলকণ্ঠ বৃষ্টির শব্দকে বহুগুণ ছাপিয়ে যাচ্ছে। আজ উৎসবের দিনে, মধ্যাহ্নবেলায় সরযূতীরে সাকেতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কৌতূহলপ্রদ ঘটনাটি ঘটে গেল। বিবাহ জীবনের একটা আবশ্যিক ঘটনা, শিক্ষা সমাপন করে গৃহে ফিরলেই পুত্রদের বিবাহ দেন সব গৃহস্থরাই। দু-চারজন যারা বিবাহ করতে চায় না, ঋষি প্রব্রজ্যা নিতে চায়, তাদের কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু আর সবার ক্ষেত্রেই বিবাহ তো ঘটছেই। কোনও কোনও পুরুষের দু-বার, তিন বার। ক্কচিৎ কখনও কোনও রমণীরও দ্বিতীয়বার বিবাহ ঘটে। কিন্তু তবু বিবাহ একটা মহা উত্তেজনার বিষয়। এখনই আরম্ভ হবে সারা সাকেতে নানান জল্পনা-কল্পনা। যারা সাক্ষী রইল ঘটনাটির, তারা বাড়ি গিয়ে পরিজনদের বলবে, তারা আবার বলবে তাদের পরিচিতদের। বাড়ির দাস-দাসীরা যেতে আসতে সংবাদ বিনিময় করবে। এইভাবে ঘটনাটি পল্লবিত হয়ে সাকেত এবং তার আশপাশের গ্রামগুলিতেও ছড়িয়ে পড়বে। কারণ ধনঞ্জয় যেমনি প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী তাঁর কন্যা তেমনি রূপসী ও গুণবতী। এবং উভয়েই লোকপ্রিয়।