Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মেজোমামার প্রতিশোধ || Lila Majumdar

মেজোমামার প্রতিশোধ || Lila Majumdar

আমার মেজোমামাকে নিশ্চয় তোমরা কেউ দেখনি। হাড় জিরজিরে রোগা বেঁটেমতন, সরু লিকলিকে হাত পা; সারা মুখময় খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ। কারণ মেজোমামা দু-সপ্তাহে একবার দাড়ি চাচেন, নাকি দাড়ি কামালেই মুখময় আঁচড়ে যায়; খাটো করে ধুতি পরা, আর প্রাণ ভরে নানা রকমের ভয়, চোরের ভয়, পুলিশের ভয়, বাঘের ভয়, গাড়ি চাপা পড়ার ভয়, রোগের ভয়, ডাক্তারের ভয়, ভূতের ভয়, আর সবচেয়ে বেশি ভয় নিজের শ্বশুরকে।

মেজোমামার শালার বিয়ে হবে। শ্বশুর লিখে পাঠালেন মেজোমামাকে নিজে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে শ্বশুরের ঠাকুরমার আমলের লাখ টাকার গয়না বের করে নিয়ে নৈহাটি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। খুব সাবধানে যাওয়া-আসা করতে হবে কারণ ও-জিনিস একবার গেলে আর হবে নাঃ আর দুষ্টলোকে খবর পেলে ওর জন্য মারপিট খুনজখম করতে পিছুপাও হবে না। শুনে তো মেজোমামার জিভতালু জড়িয়ে গেল, অথচ না গেলেও নয়, শ্বশুর তাহলে আর আস্ত রাখবেন না।

বঙ্কুদাদার গাড়িটা চেয়ে নিয়ে একেবারে স্টেশন যাবার পথে গয়নার বাক্স বের করে নিয়ে একটা আধময়লা বাজারের থলিতে পুরে, তার উপর কতকগুলো মুলোটুলো দিয়ে যত্ন করে ঢাকা চাপা দিয়ে তো স্টেশনে নামা গেল। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চির একটি কোনা দখল করতেও বেশি সময় লাগল না। এতক্ষণে মেজোমামা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। থলিটাকে বেঞ্চির কোণে গুঁজে তার উপর একরকম চেপে বসে ওফ করে এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ধুতির খুঁটটা দিয়ে কপালের গলার ঘামটাম মুছে নিলেন। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পাশে বসে পড়ল। উঃ, যেন সাক্ষাৎ করাক্ষস, ইয়া ছাতি, ইয়া হুঁড়ি আর ইয়া বড়ো বড়ো পান-খাওয়া বত্রিশপাটি দাঁত। তাকে দেখেই মেজোমামার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, কী অসৎ চেহারা লোকটার সে আর কী বলব। কানের লতি টানা, নাকের ফুটো বড়ো, চোখ ছোটো, জোড়া ভুরু, আঙুলের গিঁটে গিঁটে লোম।

মেজোমামা জড়সড় হয়ে বসলেন, ট্রেনটা লাগলে বাঁচা যায়। এমন সময় লোটা ঝুঁকে পড়ে কানে কানে বলল, দামোদরের দলের লোক না? মুখটা যেন চেনাচেনা লাগছে। মেজোমামা কথা বলবেন কী, জিভ শুকিয়ে শুকতলা। লোকটা একটু কাষ্ঠ হেসে আবার বলল, ঘাবড়াচ্ছ কেন? জান না কুকুরে কুকুরের মাংস খায় না। মেজোমামা অনেক কষ্টে সেঁক গিলে হঠাৎ সাহস করে উঠতে যাবেন, অমনি লোকটা কনুই ধরে টেনে আবার বসিয়ে দিয়ে বলল, আহা শোনোই-না। কথা আছে। মেজোমামা আবার বসে পড়লেন। পেটটা ব্যথা ব্যথা করতে লাগল। লোকটা বলল, মাথা না ঘুরিয়ে আড় চোখে চেয়ে দেখো আমাদের বাঁয়ে যে খাকি হাফপ্যান্ট-পরা লোকটা হলদে সুটকেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওই হল ব্যাঙ্কের বড়ো জমাদার, নৈহাটি যাচ্ছে। নকুলেশ্বরবাবুর ছেলের বিয়ের গয়না আছে, এই অবধি বলে সুরুৎ করে লোকটা জিভের জল টেনে নিয়ে আরও বললে, হ্যাঁ, আর বলতে হবে না, অমন ভালোমানুষও সাজতে হবে না। তুমিও আলুমুলো ব্যাগে করে ডেলি প্যাসেঞ্জার সেজে কেন বসে আছ সে আমি বেশ জানি। দেখো, মুখের ভাবখানা বদলাবে কোত্থেকে, ওতে যে ছাপ মারা রয়েছে। মেজোমামা একেবারে থ! লোকটা বলে কী?

ঠিক সেই সময়ে গাড়ি ইন করল, আর সক্কলে ধড়মড় করে উঠে পড়ল। তারই মধ্যে লোকটা মেজোমামার কানে কানে দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা গলায় বললে, দেখো দামোদরের চেলা, আজ আর কোনো চালাকি করতে এস না, তাহলে পিটে তোমাকে আলুভাতে বানিয়ে দেব, এই দেখো। বলে বিরাশি সিক্কা ওজনের এক ঘুসি পাকিয়ে মামার নাকের কাছে নেড়ে দিল। খবরদার আমাদের পাছু নেবে না। আমি ওই লোকটার সঙ্গে এক গাড়িতে যাব, নৈহাটি স্টেশনের আগে একটা পোস্টের ধারে বীরেশ্বর, জানই তো বীরেশ্বরকে, দাঁড়িয়ে আছে। যেই তার কাছে ট্রেন পৌঁছোবে, হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে লোকটার ঘাড়ে পড়ে, বাঁ-হাতে জানলা দিয়ে ব্যাগ মাটিতে ফেলতে নটবর শর্মার বেশি সময় লাগবে না। তুমি বরং ওই গাড়িতে ওঠো। বলে মেজোমামাকে একরকম কোলপাজা করে ধরে সামনের একটা থার্ড ক্লাসে তুলে দিয়ে নিজে সেই লোকটার সঙ্গে পাশের গাড়িতে চেপে বসল। মেজোমামা এতক্ষণ টু শব্দটি করেননি। সারা গা দিয়ে দরদর করে তার ঠান্ডা ঘাম ঝরছে। আর পা কাঁপুনি থামতে থামতে নৈহাটি এসে গেল। সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটটা মাটিতে ফেলে দিয়ে সুড়সুড় করে নেমে পড়ে ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে গেটের উলটো দিকে ছুটলেন। গাড়িতে খুব একটা শোরগোল হচ্ছে টের পেলেন।

লাইন পার হয়ে বাজারের থলি হাতে মেজোমামা পা চালিয়ে এগুতে লাগলেন। বেশ খানিকটা পথ, অন্ধকার হয়ে আসছে, এমনি সময় একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন একজন মোটা লোক হনহন করে পিছন পিছন আসছে। মেজোমামার গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল। সেই লোকটাই বটে। কোথাও জনমানুষ নেই, থলে নিয়ে মেজোমামা বাতাসের বেগে ছুটে চললেন। কিন্তু ল্যাগব্যাগে হাত-পা নিয়ে কত আর ছুটবেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোকটা অনেক এগিয়ে এল। ভয়ে তোত মেজোমামার চক্ষু চড়কগাছ; এখন কী করা যায়? লোকটাকে পিটলে কেমন হয়? সেও এক মুশকিল। যা জল্লাদের মতো বপুখানি, আর উরে বাপরে, কী খুনে প্যাটার্নের চেহারা! ছোটোবেলা থেকে মেজোমামার ঠাকুরমা ওঁকে দিনরাত বলে এসেছেন, ন্যাপলা, ফের শুয়োপোকা মাড়াচ্ছিস, দাঁড়া, তোকে আর জন্মে শুয়োপোকা হতে হবে। আঁ, মাকড়সা ঠ্যাঙাচ্ছিস নাকি? জানিস তুই আর জন্মে মাকড়সা হবি? ও কী রে, হাতে ঢিল কেন রে? ঢিল ছুঁড়লে ঢিল খেয়ে মরতে হয় তা জানিস? কাজে কাজেই কাউকে আর ঠ্যাঙানোই হত না। কিন্তু আজ তা বললে চলবে কেন? হাঁ, স্টেশনের সেই লোকটাই তো বটে। নিশ্চয় সুটকেশ খুলে তার মধ্যে জামা ইজের দেখে রেগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ছুটে আসছে। ছোটোবেলা থেকে কত লোক যে মিছিমিছি পা মাড়িয়ে দিয়েছে, কান মলেছে, ভেংচি কেটেছে, চুল ছিঁড়েছে, কালি দিয়ে পিঠে গাধা লিখেছে, বিয়ের সময় শালিরা নুন জল আর ন্যাকড়া দিয়ে সন্দেশ খাইয়েছে, অফিসে অন্য বাবুরা এপ্রিল ফুল বানিয়েছে তার উপর আজ এই। হঠাৎ মেজোমামার মাথায় খুন চেপে গেল। থলেটাকে রাস্তার ধারে নামিয়ে রেখে এক পাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলেন। যেই-না সেই লোকটা কাছে এসেছে ঝড়ের মতো ছুটে গিয়ে দিলেন তার নাকে প্যাঁচ করে এক ঘুসি, তারপর মুখের উপর ধাঁই করে আরেকটা। লোকটা এমনি অবাক হয়ে গেল যে, কিছু করতে পারল না। মেজোমামা তাকে বেদম পিটলেন। উঃ, সে কী পিটুনি, চড়-লাথি-ঘুসি কানমলা-চুলছেঁড়া, বিকট বিকট ভেংচি কাটা, নেহাত অন্ধকার ছিল বলে সে দেখতে পেল না, নইলে বাছাধনের পিলে চমকে যেত। তারপর সে যখন হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল মেজোমামা থলে তুলে নিয়ে হাওয়া।

শ্বশুরবাড়ি পৌঁছোলেন অনেক রাতে, ঘুরে ফিরে নার্ভাসনেসের চোটে ভুল রাস্তা দিয়ে চলে গিয়ে। বাড়ির লোকেরা তো ব্যস্তই হয়ে উঠেছিল। শ্বশুরমশাই ছুটে এসে গয়নার বাক্সটা হাতে নিয়ে বললেন, যাক বাবাজি, নিরাপদে যে এসেছ এই আমাদের ভাগ্যি। চারদিকে যা সব কাণ্ড হচ্ছে। এইমাত্র বটু খবর দিল বিকেলের ট্রেনে চুরি-ডাকাতি হয়েছে, আবার নলডাঙার মোড়ে হেডমাস্টার মশাইকে তিন-চারটে গুন্ডা বেদম ঠেঙিয়েছে। বেচারি ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। ওকী, এ-রকম মুখে হাত দিয়ে খুকখুক করছ যে? কাশি হয়েছে বুঝি? ওরে মেধো, জামাইবাবুর স্নানের জন্য শিগগির গরম জল দে, খাবার-টাবার তো রেডিই আছে।

মেজোমামা এতক্ষণে শ্বশুরমশাইকে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে বললেন, আমাকে কিন্তু কাল সকালের গাড়িতেই ফিরে যেতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *