Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৃত্যুক্ষুধা || Kazi Nazrul Islam » Page 13

মৃত্যুক্ষুধা || Kazi Nazrul Islam

মৃত্যুক্ষুধা – ১৩

সেজোবউয়ের খোকাকেও আর বাঁচানো গেল না।

মাতৃহারা নীড়-ত্যক্ত বিহগ-শিশু যেমন করে বিশুষ্ক চঞ্চু হাঁ করে ধুঁকতে থাকে, তেমনই করে ধুঁকে– মাতৃস্তন্যে চিরবঞ্চিত শিশু!

মেজোবউয়ের দুচোখে শ্রাবণ রাতের মেঘের মতো বর্ষাধারা নামে। বলে, “সেজোবউ, তুই যেখানেই থাক, নিয়ে যা তোর খোকাকে! আর এ-যন্ত্রণা দেখতে পারিনে!”

খোকা অস্ফুট দীর্ণ কণ্ঠে কেঁদে ওঠে, ‘মা’!

মেজোবউ চুমোয় চুমোয় খোকার মুখ অভিষিক্ত করে দিয়ে বলে, “এই যে জাদু, এই যে সোনা, এই যে আমি!”

বাড়ির মেয়েরা ভিড় করে এসে কাঁদে। শাবককে সাপে ধরলে বিহগ-মাতা ও তার স্বজাতীয় পাখির দল যেমন অসহায়ের মতো চিৎকার করে, তেমনই।

সাপের মুখের মুমূর্ষু বিহগ-শিশুর মতোই মেজোবউয়ের কোলে মৃত্যমুখী খোকা কাতরায়।

ভোর না হতেই সেজোবউয়ের খোকা সেজোবউয়ের কাছে চলে গেল। শবেবরাত রজনিতে গোরস্থানের মৃৎ-প্রদীপ যেমন ক্ষণেকের তরে ক্ষীণ আলো দিয়ে নিবে যায়, তেমনই।

দুপুর পর্যন্ত একজন-না একজন কেঁদে বাড়িটাকে উত্যক্ত করে তোলে, তারপর গভীর ঘুমে এলিয়ে পড়ে। শোকের বাড়ির ক্লান্ত প্রশান্তি, অতল গভীর।

ঘুমায় না শুধু মেজোবউ। তার ছেলেমেয়ে দুটিকে বুকে চেপে দূর আকাশে চেয়ে থাকে। গ্রীষ্মের তামাটে আকাশ, যেন কোন সর্বগ্রাসী রাক্ষসের প্রতপ্ত আঁখি!…বাঁশ গাছগুলো তন্দ্রাবেশে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। ডোবার ধারে গাছের ছায়ার পাতি-হাঁসগুলো ডানায় মুখ গুঁজে একপায়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে। একপাল মুরগি আতা-কাঁঠালের ঝোপে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে।

অদূর বাবুদের শখের বাড়ির বিলিতি তালগাছগুলো সারি সারি চাঁড়িয়ে। তারই সামনে দীর্ঘ দেবদারু গাছ – যেন ইমামের পেছনে অনেকগুলো লোক সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে – সামনের শুকানো বাগানটায় জানাজার নামাজ।

এমনই সময় উত্তরের আম বাগানের ছায়া-শীতল পথ দিয়ে খ্রিস্টান মিশনারির মিস জোন্স প্যাঁকালেদের ঘরে এসে হাজির হল। মিস জোন্স ওদের বিলিতি দেশে যুবতি, আমাদের দেশে ‘আধা-বয়েসি’পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের কাছাকাছি বয়েস। শ্বেতবসনা সুন্দরী। এই মেয়েটিই সেজোবউ আর তার খোকাকে ওষুধ-পথ্য দিয়ে যেত।

সেজোবউ আর তার ছেলেকে যে বাঁচানো যাবে না, তা সে আগেই জানত এবং তা মেজোবউকে আড়ালে ডেকে বলেওছিল। তবু তার যতটুকু সাধ্য, তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল।

সকালে এসে মেজোবউকে একবার সে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে। এই সময়টা বেশ নিরিবিলি বলেই হোক বা মেজোবউয়ের স্বাভাবিক আকর্ষণী শক্তি-গুণেই হোক, সে আবার এসে মেজোবউয়ের সঙ্গে গল্প শুরু করে দিলে।

এ কয়দিনে মেজোবউও আর তাকে ‘মেম সায়েব’বলে অতিরিক্ত স-সংকোচ শ্রদ্ধার ভাব দেখায় না। তাদের সম্বন্ধ বন্ধুত্বে পরিণত না হলেও অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে।

মিস জোন্স বাংলা ভালো বলতে পারলেও সায়েবি টানটা এখনও ভুলতে পারেনি। তবে তার কথা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয় না কারুর।

এ-কথা সে-কথার পর মিস জোন্স হঠাৎ বলে উঠল, “ডেখো, টোমার মটো বুডঢিমটি মেয়ে লেখাপড়া শিখলে অনেক কাজ করটে পারে। টোমাকে ডেকে এট লোভ হয় লেখাপড়া শেখবার।”

মেজোবউ হঠাৎ মেমের মুখের থেকে যেন কথা কেড়ে নিয়েই বলে উঠল, “সত্যি মিসি বাবা! আমারও এত সাধ যায় লেখাপড়া শিখতে! শেখাবে আমায়? আমার আর কিছু ভালো লাগে না ছাই এ বাড়িঘর!”

মিস জোন্স হেসে খুশিতে মেজোবউয়ের হাত চেপে ধরে বলে উঠল, “আজই রাজি। বড়ো ডুখ‍্‍খু পাচ্ছো টুমি, মনও খুব খারাব আছে টোমার এখন; এখন লেখাপড়া শিখলে টোমার মন এসব ভুলে ঠাকবে।”

মেজোবউ কী যেন ভাবলে খানিক। তারপর ম্লানস্বরে বলে উঠল, “আমার ছেলেমেয়েদের কী করব?”

মিস জোন্স হেসে বললে, “আরে, ওডেরেও সঙ্গে নিয়ে যাবে যাওয়ার সময়। ওখানে ওরাও পড়ালেখা করবে, ওডের আমি বিস্কুট ডেবে, খাবার ডেবে, ওরা খুশি হয়ে ঠাকবে।”

মেজোবউ আবার কী ভাবতে লাগল যেন। ভাবতে ভাবতে তার বেদনাম্লান চক্ষু অশ্রু-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। এই বাড়িতে যেন তার নাড়ি পোঁতা আছে। দুটো ছেলেমেয়ের বন্ধন, তারাও সাথে যাবে, আর সে চিরকালের জন্যও যাচ্ছে না–তবু কী এক অহেতুক আশঙ্কায় বেদনায় তার প্রাণ যেন টনটন করতে লাগল।

মিস জোন্স সুচতুরা ইংরেজ মেয়ে। সে বলে উঠল, “আমি টোমার মনের কঠা বুজেছে। টোমাকে একেবারে যেটে হবে না সেখানে। ক্রিশ্চানও হটে হবে না। টুমি শুধু রোজ সকালে একবার করে যাবে। আবার ডুপুরে চলে আসবে।”

মেজোবউ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে, “তা আমি যেতে পারব মিস-বাবা! পাড়ায় দুদিন একটা গোলমাল হবে হয়তো। তবে তা সয়েও যেতে পারে দু এক দিনে।”

মেজোবউয়ের ছেলেমেয়ে দুটি বিস্কুটের লোভে উসখুস করছিল এবং মনে মনে রাগছিলও এই ভেবে যে, কেন তাদের মা তখনই যাচ্ছে না মিস-বাবার সাথে! কিন্তু মায়ের শিক্ষাগুণে তারা মুখ ফুটে একটি কথাও বললে না। খোকাটি শুধু একবার তার ডাগর চোখ মেলে করুণ নয়নে মিস-বাবার দিকে চেয়েই চোখ নামিয়ে নিলে লজ্জায়।

মিস জোন্স খোকাকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে তার হাতব্যাগ থেকে চারটে পয়সা বের করে তাদের ভাইবোনের হাতে দুটো করে দিয়ে বললে, “যাও, বিস্কুট কিনে খাবে।”

মেয়েটি পয়সা হাতে করে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে যেন অনুমতি চাইলে। মেজোবউ হেসে বললে, “যা বিস্কুট কিনে খা গিয়ে।”

‍মিস জোন্স উঠে পড়ে বললে, “আজ টবে আসি! কাল ঠেকে তুমি সকালেই যাবে কিন্টু!”

মেজোবউ অন্যমনস্কভাবে শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

সমস্ত আকাশ তখন তার চোখে ঝাপসা ধোঁয়াটে হয়ে এসেছে।

পাশের আমগাছে দুটো কোকিল যেন আড়ি করে ডাকতে শুরু করেছে – কু-কু-কু! সে ডাকে সারা পল্লি বিরহ-বিধুরা বধূর মতো আলসে এলিয়ে পড়েছে।

মেজোবউ মাটিতে এলিয়ে পড়ল, নিরাশ্রয় নিরবলম্বন ছিন্ন স্বর্ণহার যেমন করে ধুলায় পড়ে যায়, তেমনই করে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *