মৃগয়া : ৫
প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে প্রভাতকাকা ঘরের ভেতর থেকে বললেন—ছোড়দি দরজা খুলুন। আমরা তখন পড়তে বসে গেছি। মাঝখানে হ্যারিকেন, একপাশে আমি আর একপাশে গদাইদা। পড়া মুখস্থর গুনগুনুনি থেমে গেল। দৌড়ে পালাতে হবে নাকি। বাবু গোল করে গুটোনো বিছানার ওপর উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে অঘোরে। পিসিমা দরজাটা খুলে দিলেন। আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। প্রভাতকাকা দরজার দুটো পাল্লাই হাট করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। ঘর অন্ধকার। প্রদীপ নিভে গেছে। সলতে পোড়া মৃদু একটা গন্ধ এ—ঘরে ভেসে এল। এ—ঘর থেকে একটু আলো ও—ঘরে পড়েছে। প্রভাতকাকা ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন। বুকটা সামনে চিতানো। চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।
আমরা উঁকি মেরে দেখলুম, ঘরের মাঝখানে মেঝেতে মাদুর। মাদুরের ওপর জ্যাঠাইমা ধ্যানস্থ। সাদা কাপড়। মাথায় অল্প ঘোমটা। মীরাবাঈয়ের মতো দেখাচ্ছে। পাশে একটা দণ্ড কমণ্ডুল থাকলে দৃশ্যটা সম্পূর্ণ হত। আমরা অবাক হয়ে প্রভাতকাকার দিকে তাকিয়ে রইলুম। তিনি যেন সিংহীকে শান্ত করে খাঁচা থেকে বেরিয়ে এলেন। পিসিমা জিজ্ঞেস করলেন, দরজা খোলা থাকবে প্রভাত?—হ্যাঁ খোলাই থাকবে ছোড়দি। আর কোনো ভয় নেই। এবার উনি ইচ্ছে করলে বাথরুমে যেতে পারেন। জিজ্ঞেস করে দেখুন। কিছু হবে না তো প্রভাত। —কিচ্ছু হবে না।
পিসিমা ভয়ে ভয়ে দরজার বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলেন—মেজোবউদি, ও মেজোবউদি, তুমি বাইরে যাবে নাকি? আমরা আবার বসে পড়েছি। প্রভাতকাকা আমাদের কাছে এসে বসেছেন। পিসিমা বারেবারে ডাকছেন—মেজোবউদি, ও মেজোবউদি। জ্যাঠাইমা উঠে দাঁড়ালেন। টলছেন, যেন নেশা করেছেন। আমরা প্রভাতকাকাকে জিজ্ঞেস করছি— মেসমেরিজম? প্রভাতকাকা মাথা নাড়লেন। নামটা পালটে দিয়েছেন। সেই যেমন বিনয়কাকার নামটা করে দিয়েছিলেন সিঙ্গার। —না নাম পালটায়নি। একজন সাধিকাকে বসিয়ে দিয়েছি ভেতরে। দেখি কতক্ষণ তিনি থাকেন।
জ্যাঠাইমা দেওয়াল ধরে ধরে টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন। কোনোদিকে দৃষ্টি নেই। প্রভাতকাকা আদেশের স্বরে বললেন—যা করার করে নিন। এখন আমার ঘুমোবার সময়।
বাবাকে কখনো এত ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখিনি। হাতের সাদা ঝোলাটা, ছাতাটা লটরপটর করছে। সারামুখে ক্লান্তির ছাপ কালো হয়ে আছে।—কেমন আছিস? আঙুলের কথা ভুলে বললাম—ভালো আছি। আপনি কেমন?—ওই একরকম। জুতো খুলতে খুলতে পড়ে যাবার মতো হচ্ছিল, দেওয়াল ধরে সামলে নিলেন। ঘরে ঢোকার আগে একটু থমকে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন—খবর কী? —না খারাপ নয় ভালোই। প্রভাতকাকা হিপনোটাইজ করে রেখেছেন। —বলিস কী! সত্যি সত্যি হিপনোটাইজ করা যায়! বিশ্বাস হয় না। কোন ঘরে রেখেছে?
—অন্ধকার ঘরেই আছেন। ওই তো মশারির মধ্যে, শুয়ে আছেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন—দরজা খোলা! সে কী রে! অন্যদিন উত্তরের ওই অন্ধকার ঘরে ঢুকে বাবা জামাকাপড় ছাড়েন। আজ দক্ষিণের বড়ো ঘরে আলনা। জামা, কোট, কাপড় আজ সব ওইখানেই ঝুলল। একটা মুগুর একটু কাত হয়ে ছিল। সোজা করে রাখলেন। একটা পেয়ারা ডাল টিনের চালের ভেতর আটকে ছিল, সেটাকে মুক্ত করে দিয়ে বললেন—যাও হাওয়া খাও। শিশির মাখো।
চেয়ারে উবু হয়ে বসে চা খেতে খেতে বললেন—যাও আজ তোমাদের পড়ার ছুটি। ইস্কুল খুলছে কবে? খবর নিয়েছ? —এখনও গোলমাল মেটেনি। স্কুল কমিটি প্রাণধনবাবুকে হেডমাস্টার করেছে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে শুধরে দিলেন—ছিঃ হেডমাস্টারমশাই বলো। তাহলে তো মিটেই গেছে। —না মেটেনি। ছাত্র কমিটি হর্ষবর্ধন বাবুকে করেছে। প্রাণধনবাবু হেডমাস্টরমশাইয়ের চেয়ারে বসলেই ছেলেরা হর্ষবাবুকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রাণধনবাবুর কোলে বসিয়ে দিয়ে চিৎকার করছে, চলবে না চলবে না। প্রাণধনবাবু রোগা, মোটা হর্ষবাবুর চাপে যেই চেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন, হর্ষবাবু জাঁকিয়ে বসে বলছেন, আমি হেড। আজ শুনলুম বোম মেরেছে ছেলেরা।
—সে কী! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটা কী ধরনের অসভ্যতা।
—আজকে স্কুলের মাঠে পুলিশ বসে গেছে।
বুঝেছি ওই দাঙ্গার পর থেকেই বোম আর ছুরিটা খুব চালু হয়ে গেছে। তা না—হলে কেউ ভাবতে পারে বিকেলবেলা, প্রকাশ্য দিবালোকে মোহিতবাবুর ছোটোছেলেকে ছুরি মেরে খুন করে দিলে। ওই নামকাওয়াস্তে স্কুলটা থাক, পড়াশুনা বাড়িতেই চেপে করে যাও।
চাঁদের আলোয় দুটো সাদা প্যাঁচা ইলেকট্রিক তারে এসে পাশাপাশি বসেছে। তারের লম্বা ছায়া পড়েছে রাস্তার ওপর। কাদের বাড়ির রেডিয়োতে ভারি সুন্দর সেতার বাজছে। সামনের বাড়ির ভাঙা ছাদে লম্বা ঘাসের জঙ্গল হয়েছে। হাওয়া যখন জোরে বইছে শনশন করে একটা শব্দ উঠছে।
এতক্ষণে প্রভাতকাকা এলেন। রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন, রাতের খাওয়ার আয়োজন নিয়ে। বাবা বললেন—বসো। টেলিগ্রামটা পেল কিনা বুঝতে পারছি না হে। ভেবেছিলুম আজই এসে পড়বেন। ঠিকানাটা ঠিক আছে তো? —ঠিকানায় কোনো ভুল নেই। পোস্টাপিস তো আর আগের মতন নেই। হয়তো সন্ধেবেলা পেয়েছে। আসতে আসতে কাল সকাল!
—তুমি কীভাবে ঠান্ডা করলে? হিপনোটাইজ? বিশ্বাস হয় না বাপু। তোমার যদি এত শক্তিই থাকত তুমি এইভাবে পড়ে পড়ে মার খেতে না। প্রভাতকাকা মাথাটা সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বাবার কানে কানে ফিসফিস করে কী বললেন, ঠিক শুনতে পেলুম না। বাবা আতঙ্ক মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করলেন—বেশি দাওনি তো! দেখ মাত্রা না ঠিক থাকলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। দুজনেই পড়ে যাব খুনের দায়ে।
প্রভাতকাকা চেয়ারে শরীরটা এগিয়ে দিয়ে হাতের দুটো আঙুল নস্যির টিপ ধরার মতো করে বললেন—ছোট্ট মটরের দানার মতো এতটুকু। আমি দু—ভরি হজম করে ফেললুম, কী যে ভয় পান আপনি। —তোমার কথা বাদ দাও প্রভাত, তুমি স্বয়ং নীলকণ্ঠ।
প্রভাতকাকা বললেন—আমি কাল থেকেই মাজন কোম্পানি শুরু করতে চাই। কাল দিন ভালো। নাম ঠিক হয়েছে দি টুথ পাউডার। এদের সব চাকরি দিয়ে দিয়েছি—সপ্তাহে চার টাকা। আমি ক্যানভাসার। তুমি ক্যানভাস করতে পারবে না প্রভাত। শক্ত কাজ। প্রথম প্রথম ট্রেনে ঘুরতে হবে। —কী ভাবেন ছোড়দা আমাকে। এমন কোনো কাজ নেই যা আমি করিনি। ঘটকালি, জ্যোতিষী, কয়লার দোকান, সাইকেলের দোকান, চোরাই মালের কারবারি। বলে দিলে রাজাবাজার ট্রামডিপোর উলটোদিকের ফুটপাথে গিয়ে দেখবেন একটা লোক একটি হাতের তালুতে সিগারেট ঠুকছে, তাকে এই কালো প্যাকেটটা দেবেন। লোকটি মানে কারবারের মালিক একদিন খুন হয়ে গেল আর চাকরিটা চলে গেল।
বাবা চুক করে মুখে একটা শব্দ করলেন—আমি কি বলেছি তুমি কাজকে ভয় পাও? পরিশ্রমকে ভয় পাও? ক্যানভাসিং একটা আলাদা লাইন,আলাদা আর্ট। সে ছিলেন বিল্টুর ছোড়দাদু। সাহেবদের মতো দেখতে ছিল। বিলিতি পোশাক পরে বাঁকা করে টুপি লাগিয়ে মুখে পাইপ দিয়ে যে—কোনো জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেই কাজ হাসিল। ইংরিজি কী? সায়েব বাচ্চা হার মেনে যেত। তোমার একটা অসুবিধা কী জানো, তোমার ওই সামনের দাঁত দুটো। ওই ঢকঢকে দাঁত নিয়ে তুমি কী করে বলবে, এই মাজনে দাঁত মাজলে, দাঁত ভালো হয়।
প্রভাতকাকা চেয়ারটাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন—কী বলছেন ছোড়দা। তবে দেখুন। প্রথমে জিভ দিয়ে সামনের এই দুটো দাঁতকে ঢকঢক করে নাড়ব। মনে করুন আপনি প্যাসেঞ্জার। আমি ক্যানভাসার।
প্রভাতকাকা সামনের গজাল দাঁত দুটোতে কিছুক্ষণ নাড়িয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন—সর্বনাশ, সর্বনাশ। বাবা চমকে উঠেছিলেন।—সর্বনাশ হয়ে গেছে দাদা। দাঁত থাকতে বুঝিনি দাঁতের মর্যাদা। তাই তো আমার এই অবস্থা। ঈশ্বর দিয়েছিলেন হাতির মতো দাঁত, পারিনি তাই রাখতে, সবক—টা হয়ে গেছে কাত। আমি সেই জ্ঞানপাপী, এসেছি যিশুর মতো বিলোতে প্রেম। জেনে রাখুন—দাঁত যদি করে উৎপাত, দীতুথ লাগান, দাঁত সেরে যাবে চটপট। দাঁতের ব্যথায় কেন করেন ছটফট, এনেছি বিদেশি দীতুথ পাউডার।
বাবা বললেন—দেখো কী হয়। মন্দ হয়নি, তবে তোমার ওই দাঁত দুটো দূর থেকে সকলে কি দেখতে পাবে প্রভাত?
—খুব পাবে ছোড়দা, এর সাইজ কি কম ভাবেন। প্রায় হাতির দাঁতের কাছাকাছি যায়। প্রভাত তো দাঁতের জন্যেই বিখ্যাত, এইবার বিখ্যাত হবে মাজনের জন্যে। দাঁত যদি বাজারে না—নেয় তুলে ফেলব। কতক্ষণ লাগবে, এক সেকেন্ডের ব্যাপার।
—না, না দাঁত তোলার অনেক ঝামেলা, সে আবার ডেন্টিস্ট লাগবে, অনেক টাকার ধাক্কা।
—ডেন্টিস্ট। প্রভাতকাকা হাসলেন—ডেন্টিস্ট তো আমি নিজেই। এই পাশের দাঁত দুটো তো আমি নিজে তুলেছি। বলুন না আপনার সব দাঁত আমি এক্ষুনি তুলে দিচ্ছি। এক—একটা এক সেকেন্ডে।
—কীভাবে তুলবে? ঘুসি মেরে! —না না, সিল্কের শক্ত সুতো দিয়ে দরজার শিকলে একটা দিক বাঁধব, আর একটা দিক ফাঁস লাগিয়ে দাঁতে। তারপর ঝট করে পেছন দিয়ে শুয়ে পড়ব, গোড়াসুদ্ধ দাঁত উঠে চলে আসবে।
—বলো কী, অতই সোজা! —বিশ্বাস করছেন না, দেখিয়ে দেব! সুতোতে কীনা হয় ছোড়দা, জীবন বেরিয়ে আসে, দাঁত বেরুবে না। বসুন আমি একটা তুলে দেখিয়ে দিচ্ছি! বাবা একটু আতঙ্কিত হয়ে বললেন—কার দাঁত তুলবে! তোমার নিজের! —না আমারটা তুলতে চাইছি না। গজদন্ত সৌভাগ্যের লক্ষণ! —আর সৌভাগ্য দেখিয়ো না প্রভাত। প্রভাতকাকা মোটেই হতাশ না হয়ে বললেন—গজদন্তে, গজ লাভ হয়। তা হয়, যেমন তোমার হয়েছে। এই সংসারটা গজের বাবা। বাবা চেয়ারটা শব্দ না—করে সরিয়ে উঠে পড়লেন।
খাওয়াদাওয়া শেষ। প্রভাতকাকা বালিশ বগলে ছাদে চলেছেন শুতে। মাদুর একটা পাতাই আছে। সারাদিন রোদ খাবার পর এখন চাঁদের আলো মাখামাখি। বাবা ডাকলেন—প্রভাত। খুব ঘুম পেয়েছে? প্রভাতকাকা ঘুরে দাঁড়ালেন—না ছোড়দা! —একটু কাজ ছিল? খুব সিক্রেট। ওরা সব ঘুমিয়েছে। হ্যাঁ সব ফ্ল্যাট। —তুমি তাহলে বারান্দার দিকের দরজা দুটো দিয়ে দাও।
বাবা বিছানায় বসে বসে নির্দেশ দিচ্ছেন। মশারিটা গুটিয়ে পাকিয়ে ওপরে তোলো। আমি ঘুমোবার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। আঙুলটা কট কট ঝনঝন করছে। ভয়ে বলতে পারছি না। বললেই, বিনা অনুমতিতে গঙ্গায় চান ধরা পড়ে যাবে। সবচেয়ে খারাপ লাগে, বাবা যখন পয়সার কথা তোলেন—নাও আবার একগাদা খরচা। খিদেটা চাপা যায় না, তাই খাই খাই করি। দাঁত চেপে যন্ত্রণা চাপা যায়। চোখের সামনে দিয়ে সেই লোকটি যেন চলে যাচ্ছেন, যাঁর একটা পা কাঠের।
বাবা বলছেন—বালিশটা বগল থেকে নামাও। বগলটা আলগা করতেই প্রভাতকাকা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেইখানেই পায়ের কাছে শব্দ করে বালিশটা পড়ল। নিজের মাথার বালিশের তলা হাতড়ে বাবা একগোছা চাবি বের করলেন।
ঘরের পূর্ব কোণে পর পর তিনটে স্টিল ট্র্যাঙ্ক। ওপরের দুটো একাই নামিয়ে ফেললেন। নীচেরটা ওরই মধ্যে নতুন। অরিজিন্যাল রং লতাপাতা ডিজাইন অস্পষ্ট হয়ে এলেও বোঝা যায়।—হ্যারিকেনটা আনো তো প্রভাত। প্রভাতকাকা হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। বাক্সটার সামনে বসে বাবা একের পর এক চাবি লাগাচ্ছেন। শেষ চাবিটায় খুলে গেল। ডালাটা ওঠালেন। ক্যাঁচ করে চমকে যাবার মতো একটা শব্দ হল। সারাঘরটা ভরে গেল পুরোনো কালের একটা অদ্ভুত গন্ধে। ছাদের আলসেতে কর্কশ গলায় একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। বহু দূরে গোটাকতক কুকুর খুব শোরগোল করে উঠল। —মাদুরটা পাত তো প্রভাত।
একে একে সব জিনিস বেরুচ্ছে। নীল একটা বেনারসি, সোনার সুতো দিয়ে নকশা তোলা। বড়ো হাতা নীল ব্লাউজ। রেশমি রঙের চকচকে একটা শায়া। কোমরে লাগানো সাদা দড়ির একটা দিক এঁকেবেঁকে মেঝের ওপর পড়েছে। পুরোনো দিনের সমস্ত স্মৃতি বেরিয়ে আসছে। ওই বেনারসি ওইরকম পাট করাই থাকবে। কেউ পরবে না। ওই নীল সোয়েটারে মা—র গোল ফর্সা হাত আর কোনোদিন আকৃতি দিতে ঢুকবে না। মা—র সেই লম্বা লম্বা হাতের আঙুল! অনামিকায় পোখরাজের জ্বলজ্বলে আংটি। ওই সিল্কের পাঞ্জাবি—বোধহয় বাবার বিয়ের পাঞ্জাবি। সবশেষে বেরিয়ে এল বর্মার তৈরি ঝকঝকে কালো সেই গোল বাঁশের বাক্সটা যার সারা গায়ে লতাপাতার কাজ। রেঙ্গুন থেকে জ্যাঠাইমা এনেছিলেন। বেতের তৈরি সুটকেসটা এখন এই জ্যাঠাইমার দখলে।
সমস্ত জিনিস হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে গোল বাক্সটা বাবা ঘরের মাঝখানে সাবধানে রাখলেন। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। যেন পবিত্র একটা আধার। গলার স্বর শুনে মনে হল যেন বহু দূর থেকে বলছেন—প্রভাত একটা পেনসিল আর কাগজ নিয়ে বসো তো। আমার মনে হয় কাল সকালেই ওর বড়োভাই এসে পড়বেন। কারোর সম্পত্তি মেরে দিয়েছি, এই অপবাদ আমি শুনতে রাজি নই।
খাতা আর পেনসিল হাতে গম্ভীর মুখে প্রভাতকাকা বসলেন। বাক্সর ডালাটা খুলতে খুলতে বাবা বললেন—এর মধ্যে রেঙ্গুনের মেজোবউদির সমস্ত গয়না আছে। যক্ষের মতো আমি আগলে রেখেছি। এত দুর্দিনেও একটার গায়ে হাত পড়েনি। মেজদার কাছে থাকলে সব শেষ হয়ে যেত। খেয়ে আর খাইয়ে উড়িয়ে দিত। তুমি তো জানোই, কী মেজাজের মানুষ ছিল।
একটা লকলকে সরু হার ধীরে ধীরে হাতের আকর্ষণে ওপরদিকে উঠেছে, আলো পড়ে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। বাবা বলছেন—এসব পুণ্য স্মৃতি, মনুমেন্ট, বুঝলে প্রভাত! এ কি বেচে খাবার জিনিস, না বাঁধা দেবার জিনিস। আমি চোখের সামনে তাদের দেখতে পাচ্ছি। বাবার গলাটা ভীষণ ভারী শোনাল। নাও লেখো, আইটেম নাম্বার ওয়ান মপচেন উইথ লকেট। হারটা বাক্সের ডালার ওপর রাখলেন। —আইটেম টু প্রজাপতি হার, ফিটেড উইথ রুবি, তিন একজোড়া সাপবালা, চার ব্রেসলেট, পাঁচ টায়রা ফিটেড উইথ ডায়মন্ড, ছয় চুড়ি বারো গাছা, সাত নবরত্ন আংটি।
তালিকায় গহনার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে এদিকে রাতও বাড়ছে। শেষ জিনিস, হিরে বসানো একটি নাকছাবি। নাকছাবি হাতে নিয়ে দু—আঙুলে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন, তারপর টুপ করে বাক্সের মধ্যে ফেলে দিলেন।
—দাও লিস্টটা দাও। তোমার সামনে মিলিয়ে সই করে রাখলুম, তুমিও একটা সই করে দাও, উইটনেস, সাক্ষী। কী ভেবেছিলুম জানো প্রভাত, মেজদার ছেলেটার জন্যে এসব আগলে রাখব। বলা যায় না, আমি আজ আছি আমি কাল নেই। এসব সোনা তুমি পাবে কোথায়। পিয়োর গিনি গোল্ড। সেযুগের কাজ। পান নেই বললেই চলে। আমাকে সব ভুল বোঝে জানো। বলে, স্বার্থপর কঞ্জুস, চামার—আমি নাকি সব মেরে দেবার তালে আছি। সবই তো কানে আসে হে। আরে আমার সংসারই নেই, কার জন্যে মারব। হিসেব, হিসেব সে তো তোদেরই ভবিষ্যতের জন্যে রে। যাও তোমাদের জিনিস তোমরা বোঝ। মেজদার ছেলেটার এডুকেশনের কী হবে কে জানে!
একে একে সব জিনিস উঠছে। বেনারসির ভাঁজ থেকে একটা গোল ন্যাপথলিন গড়িয়ে গেল। নীল সোয়েটারটা হাতে নিয়ে বাবা বললেন—মনে পড়ে প্রভাত, সেই জামতাড়ায় যাবার আগে, তুমি আর আমি বিল্টুর মার—র জন্যে কিনেছিলুম। এখনও নতুনের মতো আছে। যত্নে রাখলে কতদিন থাকে দেখেছ।
প্রভাতকাকা সোয়েটারের ঝুলে থাকা হাতটা স্পর্শ করে বললেন—এর সঙ্গে সেই হ্যান্ড গ্লাভস কেনা হয়েছিল, সে দুটো কোথায় ছোড়দা? —আছে, আছে, সব আছে। চৌকো একটা কাগজের বাক্স খুলে মা—র দস্তানা দুটো বের করলেন। —একটা, দুটো জায়গায় একটু ফুটো করে দিয়েছে হে। উলের জিনিস রাখা বড়ো শক্ত।
মা—র হাত দুটো নেই, দস্তানা দুটো আছে, মা—র শরীরটা নেই, মা—র শাড়ি রয়েছে। জামতাড়া জায়গাটা আছে, প্রতি বছরই শীত আসে, মা—র সোয়েটার আছে, সেই পাহাড়ের পাশে মাঠটাও আছে যে—মাঠে ভোরবেলা বেড়াতে গিয়ে মা—র পায়ের উপর দিয়ে কুচকুচে কালো একটা সাপ চলে গিয়েছিল, কেবল সেই দিনটাই আর আসবে না ফিরে।
বাবা বলছেন—সোয়েটারের উলটা দেখছ প্রভাত, যেমন নরম তেমনি গরম। এসব উল আর পাবে কোথায়!
মেঘলা, মেঘলা সকাল। কোনোরকমে একবার একফাঁকে একটু রোদ বেরিয়েছিল। তারপর সেই যে মুখ লুকিয়েছে আর দেখা নেই। সারা আকাশে কোদালে মেঘ। উত্তরের বারান্দায় দাঁড়ালে বেশ বোঝা যায় শীত এসে গেল। একটা দুটো শিউলি ফুল ফুটতে শুরু করেছে। কখন যে ফোটে, কখন যে ঝরে পড়ে হলুদ মুখটি মাটিতে গুঁজে। কেন জানি না কেবলই মনে হচ্ছে, দূরে কোথাও সানাই বাজছে ভোরের করুণ সুরে—বাবুল মেরা নইহার ছুট জায়ে। হয়তো বাজছে না, কিংবা বাজছে।
চা খেতে খেতে বাবা বললেন—কই এখনও তো ওঁরা এলেন না। আকাশের যা অবস্থা এখুনি হয়তো বৃষ্টি এসে যাবে।
মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় সামনের ভাঙা ছাদের বড়ো বড়ো জঙ্গলে খসখস শব্দ উঠছে, ভাঙা ইটের ফাঁক থেকে ধুলো উড়ছে। আকাশের চাপা আলোয় নীচের রাস্তাটা ভীষণ সাদা দেখাচ্ছে। দূরে ঠুং, ঠুং করে একটা রিকশা আসছে। আর একটু কাছে আসতেই আরোহীদের চিনতে পারলুম। জ্যাঠাইমার বড়োভাই, আমার বড়োমামা আর মাসিমা আসছেন। জানালার কাছ থেকে চাপা গলায় বললুম—ওঁরা আসছেন। বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন—তোমার প্রভাতকাকাকে ও—ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে বলো।
আনন্দ হচ্ছে—মাসিমা আসছেন। বাড়িটা বেশ জমজমাট হবে। জ্যাঠাইমার ছোটো—বোন। রঙে একটু ময়লা বলেই বোধহয় জ্যাঠাইমার মতো অহংকারী নন। এর আগে একবার একমাস এ—বাড়িতে ছিলেন। বাবাকে তেমন ভয় পান না—মাসিমার সামনে বাবার রাশভারী মেজাজটাও একটু হালকা হয়ে যায়। জ্যাঠাইমা কথায় কথায় বলতেন, সীতার কাছে ঠাকুরপো জব্দ। ওইরকম লোকের এইরকম বউ হওয়া উচিত। কালোয় কালোয় মানাবেও ভালো। মাসিমা বলতেন—জব্দ শুধু। ঠাকুরপো কেন, জব্দ তুমিও হবে।
মাসিমা রান্নাঘরের কাছে এসে বললেন—খেতে এলুম। প্রভাতকাকা বললেন মেনুটা দেখে অর্ডার দাও। এ—ঘরটার নাম প্রভাত হোটেল। মাসিমা, পিসিমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন—ছোড়দি বুঝি! বিল্টু তুই একটু বড়ো হয়েছিস রে। মনে আছে তোর শেষ দাঁতটা আমিই ফেলে দিয়ে গিয়েছিলুম। এর মধ্যে তোর গোঁফ বেরিয়ে গেল রে, কী কাণ্ড! সময় কীভাবে চলে যায়।
মাসিমা এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন—দিদির কী হয়েছে? সত্যি মাথা খারাপ, না অভিনয়। দিদির স্টকে অনেকরকম জিনিস থাকে। জামাইবাবুর সঙ্গে বিয়ের সেই প্রথম শুভদৃষ্টির সময় থেকেই ও কিন্তু ছোড়দার ওপর খেপে গেছে। ওর ধারণা ছোড়দা জেনেশুনে ওকে ঠকিয়েছে।
পিসিমা বললেন—সে আর জানি না। নতুন বউ বাড়িতে পা দিয়েই সেই যে গুম হয়ে বসল, দু—দিন আর জলস্পর্শ করল না। মেজদার সঙ্গে কম দুর্ব্যবহার করেছে।
বাবা ডাকলেন—প্রভাত। —হাজির, বলে প্রভাতকাকা ছুটলেন।
মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন—প্রভাতদা কি রাঁধছিলেন নাকি? কেন? মেয়েছেলে থাকতে বেটাছেলে রাঁধবে কেন?
পিসিমা বললেন—ওই খাওয়া নিয়েই তো মেজোবউদির মাথা খারাপ হয়ে গেল। কেবলই ভাবত আমি সব চুরি করে ছেলেমেয়েদের খাইয়ে দিচ্ছি। মাসিমা অবাক হয়ে বললেন—ছি ছি, দিদির মনটা চিরকালই অপরিষ্কার রয়ে গেল। চল বিল্টু তোর জ্যাঠাইমাকে একবার দেখে আসি।
দক্ষিণের টেবিলে বড়োমামা বিব্রত মুখে বসে আছেন। একদিকে বাবা, একদিকে প্রভাতকাকা, মাঝখানে সেই গোল গহনার বাক্সটা। বাবা বলছেন, বিমল, রেঙ্গুনের বউদির সমস্ত গহনা আমি লিস্ট করে এর মধ্যে রেখে দিয়েছি। তুমি একে একে মিলিয়ে নাও। বড়োমামা বলছেন—গহনা কী হবে ছোড়দা! এর মধ্যে গয়নার কথা আসছে কেন? দিদিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে আমি ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব।
বাবা বললে—না না গয়নার কথা আসছে বই কী। ভীষণভাবে আসছে। তোমার দিদিকে তুমি চেনো না। তুমি আত্মভোলা মানুষ, আমি তো হাড়ে হাড়ে চিনি। সাংঘাতিকভাবে চিনি। এই গয়নাগুলো ওর মাথা খারাপের আর একটা কারণ। ওর হাতে আমি দিতে পারিনি, তোমার হাতে তুলে দিলুম। কেবল একটা প্রার্থনা, তোমার কাছে আমার একটা ভিক্ষেই বলতে পারো।
বড়োমামা অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাবা ভস করে বাক্সের ঢাকনাটা খুললেন। সামনে ঝুঁকে পড়ে হিরে বসানো সেই ছোট্ট নাকছাবিটা তুলে নিলেন। বাবার হাতে ওটার কোনো শোভা নেই। শোভা ছিল মায়ের টিকোলো নাকে। মুখটা নীচু থেকে উঁচু দিকে যখন তুলতেন বিন্দুর মতো হিরেটা চুমকির মতো ঝলসে উঠত।— এইটা বুঝলে বিমল, এইটা রেঙ্গুনের বউদিরই ছিল সেই হিসেবে তোমার দিদিরই প্রাপ্য, কিন্তু বউদি এটা বিল্টুর মাকে দিয়েছিল, মৃত্যুর ঠিক দশমিনিট আগে এটা তাঁর নাক থেকে খুলে নেওয়া হয়। আমার কাছে এই সামান্য জিনিসটার মূল্য তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ। এইটা আমি তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি। যা দাম লাগে আমি দেব। প্রয়োজন হলে বেশিও দেব। জিনিসটা হাতে নিয়ে উদাস মুখে বাবা তাকিয়ে আছেন। বড়োমামার মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ভীষণ আমুদে মানুষ। সর্বক্ষণই হইহই ভালোবাসেন। ঘোরপ্যাঁচ বোঝেন না। ঘন ঘন নস্যি নেন। বেশ বুঝতে পারছি একটু নস্যির জন্যে ছটফট করছেন। এদিকে বাবা যেভাবে চেপে ধরেছেন সহজে মুক্তি পাবেন সে—আশা নেই। কথায় কথা বাড়তেই থাকবে। আজকে একেবারে চুলচেরা হিসাবের দিন।
বড়োমামা হঠাৎ বাবার হাত দুটো ধরে অনুরোধ করার মতো গলায় বললেন—ছোড়দা, দিদির কথায় আপনি অপমানিত হয়েছেন, আমি দিদির হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। গয়না—টয়না সব আপনার কাছেই থাক। আপনার কাছে থাকা আর ব্যাঙ্কে থাকা একই কথা।
—না বিমল, গয়নার দায়িত্ব আর আমি নিতে চাই না। আমার কী এমন দায় পড়েছে, চিরকাল পরের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে! এসব বিষয়—বিষ তুমি হাটাও। লিস্ট আছে মিলিয়ে নাও। ওর বাইরে আমার কাছে আর কিছু নেই।
বাবা উঠতে যাচ্ছিলেন, মাসিমা এলেন। এতক্ষণ জ্যাঠাইমার ঘরে ছিলেন। বাবার চেয়ারের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে বাবার মাথায় একটা উশকো চুল একটু টেনে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু দুষ্টুমির হাসি হাসলেন। বাবা এতই উত্তেজিত কিছু বুঝতেই পারলেন না। তবে এতটুকু বুঝেছেন, পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। বড়োমামা, প্রভাতকাকা কেউই এই তুচ্ছ ঘটনাকে লক্ষ করার অবস্থায় নেই। মাসিমা বললেন—ছোড়দার আজ অফিস নেই? কথাটা শুনেই বাবা স্প্রিঙের মতো লাফিয়ে উঠলেন—নিশ্চয় আছে। ক—টা বাজল?
বড়োমামাও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। মুখে অনুনয়—এগুলো তুলে রাখুন ছোড়দা। ছোড়দা তুলে রাখুন।
গোল বাক্সটা হাতে নিয়ে মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন—কী রে দাদা? বড়োমামা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। বাবা ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন। এখনও অনেক কাজ বাকি। মাসিমা বলছেন—বাক্সটা বেশ, এত ভারী কেন রে? বাক্সটা খুলেই লাফিয়ে উঠলেন—একী রে! গয়না! মাসিমার মুখ দেখে মনে হল হঠাৎ গুপ্তধনের বাক্স খুলে ফেলেছেন। গয়না কী হবে রে! বড়োমামা ফিসফিস করে বললেন—দিদিটার জন্য শালা কী যে বে—ইজ্জত হতে হয়! মাসিমা আরও ফিসফিস করে বললেন—তোর শালাটা সামলা দাদা। মনে রাখিস কোথায় কার সামনে বসে আছিস।
—ভাগ শালা। এতক্ষণ চেপে চেপে বসে আছি। আমার কি এসব পোষায় নাকি! মিলে কুলি খাটানোর চাকরি করি, খাইদাই না—খাই, না—দাই বগল বাজাই। কোত্থেকে শালা এক পাগলি এসে জুটল। তুই বল সীতা, এ তোর সর্দি কাশি, পেট খারাপ নয় যে মেরে দেব এক ট্যাবলেট! জিনিসটা কোথায়?
—কোন জিনিসটা? মাসিমা বুঝতে পারেননি। —আরে সেই পাগলিটা! নিয়ে যে যাব, কামড়ে দেবে না তো। বস্তায় ভরে নিয়ে যেতে হবে নাকি রে? মাসিমা বললেন—যাঃ, ইয়ার্কি করিসনি। গুম মেরে ঘরের অন্ধকার কোণে বসে আছে। একটাও কথা বলছে না। চোখদুটো দেখলে তোর মনে হবে, মরে গেছে। মাইরি বলছি তুই দেখে আয়।
প্রভাতকাকা আগেই উঠে চলে গেছেন। বড়োমামা আমাকে কাছে ডেকেই ইশারায় ঘরের দরজাটা দেখিয়ে বললেন—ভাগনে গার্ড। বুঝতেই পারছ। আমি দরজা পাহারা দিতে গেলুম, বড়োমামা ঝট করে টেবিল থেকে বাবার নস্যির ডিবেটা তুলে নিলেন।
মাসিমা গয়নার বাক্সটা নিয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাবা তখন পেরেকে ঝোলানো দড়ির ফাঁস থেকে দাড়ি কামাবার বুরুশটা খুলছেন। আমার জ্ঞান হওয়াতক বুরুশটা দেখছি। সরু হতে হতে ছবি আঁকার তুলির মতো চেহারা হয়েছে। —ছোড়দা পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়! নিন তুলে রাখুন। কোথায় ছিল? আমি তুলে রাখছি। বাবা বললেন—না সীতা, এ তো একটা হিসেব চুকল, এখনও আর গোটাকতক গোলমেলে হিসেব আছে। মেজদার অসুখের সময় খরচের হিসেবটা আমাকে কমপ্লিট করতে হবে।
—কমপ্লিট করে কী করবেন? —ওর নাকের ডগায় ছুড়ে ফেলে দেব। —কার নাকের ডগায়? —বুঝতে পারছ না, তোমার দিদির নাকের ডগায়? —তার মাথায় কিছু আছে? সে আমি জানি না। আমার কাজ আমি করে যাব। —হ্যাঁ কাজের মতো কাজ অবশ্যই আপনি করবেন, অকাজ আপনাকে কেউ করতে বলেনি।
কথা বলতে বলতে মাসিমার নজর ঠিক তলার ট্রাঙ্কটার দিকে চলে গেছে। চাবির গোছাটা ঝুলছে। ওপরের ট্রাঙ্ক দুটো নামিয়ে তলার ট্রাঙ্কের ডালাটা মাসিমা খুলে ফেললেন। গয়নার বাক্সটা রাখতে গিয়ে পুরো ট্রাঙ্কটাই প্রায় গোছানো হয়ে গেল। মাসিমা চাবিটা আঁচলে বেঁধে রাখলেন। বাবা বেশ জব্দ হয়েছেন। মাসিমা সেই ধাতের মানুষ, বাবার ভুরু কোঁচকানো দেখলে থমকে যান না। বাবার বিরক্তি, হাসি দিয়ে ভাসিয়ে দেন। মাসিমা বাড়িতে পা দেওয়ামাত্রই পাথরচাপা থমথমে আবহাওয়াটা ভাঙতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রভাতকাকাকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলেন—মেয়েমহলে পুরুষের স্থান নেই প্রভাতদা। ছোড়দার মহলে চলে যান। বাবা ঢুকেছেন জ্যাঠাইমার ছেড়ে দেওয়া ঘরে। দুটো মুগুর ঢুকেছে, ডাম্বেল ঢুকেছে। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত কোনোকিছুর পরোয়া করেন না। নিয়ম, নিয়ম। বেরিয়ে আসেন ঘেমে নেয়ে। এইজন্যেই কি বাবাকে সকলে স্বার্থপর বলেন।
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা বাবার গঙ্গায় চান কেউ বন্ধ করতে পারবে না। মাঝে মাঝে গর্ব করে বলেন, আমার লোহার শরীর। বাবা স্নানে যেতেই বড়োমামা বললেন—ভাগনে এইবার একটু ম্যানেজ করে দাও। বড়োমামার নস্যির ডিবে আর বাবার ডিবে দুটোই ভরে ফেললুম। বাবার ছোটো ডিবেতে বড়ো কৌটো থেকে নস্যি ভরে দেওয়া আমার রোজের কাজ। বড়োমামা বললেন—থ্যাঙ্ক ইউ! ধরা পড়ে যাবে না তো?
বড়োমামা রাস্তার দিকের জানালার ধারে সরে গিয়ে বেশ শব্দ করে এক টিপ নস্যি নিয়ে লাল চেখে ফিরে তাকালেন—এতক্ষণে ঠিক হল বুঝলে বিল্টু। ঝড়ের মতো শব্দ করে নস্যি না—নিলে ঠিক জমে না। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? ছোড়দার বকুনি? খুব হচ্ছে? বড়োমামা জানালার ধার থেকে সরে এলেন—ছোড়দা আসছেন। রোজ গঙ্গার চান।
—রোজ—সেই তেলটা আছে, ভৃঙ্গরাজ!—হ্যাঁ একটু আছে। —দিদির ব্রহ্মতালুতে একটু অ্যাপ্লাই করে দেব? বড়োমামা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন—আরে দুটোর সময় আমার ডিউটি। আমি এখুনি চলে যাব রে। দিদিকে বেঁধে—টেধে রেডি করে দে। ঝুলিয়ে নিয়ে যাব, না, কাঁধে করে নিয়ে যাব। চল চল আর দেরি করিসনি।
মাসিমা বললেন—চল চল কীরে। আমি আজ যাব না। —যাবি না মানে, তোকে রোববার দেখতে আসবে সেই রাজপুত্তুর।—সে কি এই রোববার নাকি। পরের রোববার তো।—যাঃ শালা, আমি একলা যাব নাকি? বড়োমামা দুটো কান ধরে বললেন—আর বলব না। দ্যাখ আর একবারও শালা বলব না।
—তোর অভ্যেস দাদা। তুই বাবার সামনে শালা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কান ধরে বসে থাকতিস।
——শালা কারা বলে জানিস, মহা মহা সাধকরা, বামাখ্যাপা, রামকৃষ্ণ, তৈলঙ্গস্বামী বিমল মুখার্জি।
উত্তরের বারান্দায় বাবার নাক ঝাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। বড়োমামা ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে বুঝিয়ে দিলেন সব চুপ।
বাবা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কোঁচা পাট করছেন, পাটে পাটে টেনে টেনে। গেঞ্জির ওপর দিয়ে বুকের কাছে পইতেটা অল্প বেরিয়ে আছে, ফাঁসের মতো। পইতেটা খুবই হলদে। অল্প দূরেই মেঝেতে খাবার ঠাঁই হয়েছে। মাসিমা জল ছিটিয়ে হাত দিয়ে মেঝে মুছছেন। বাবা এটা খুব পছন্দ করেন। বলে শাস্ত্রসম্মত মার্জনা। মেয়েদের এসব শেখা উচিত, জানা উচিত। পাতের ডানদিকে থাকবে নুন। থাকবে গেলাস। ঝকঝকে কাঁসার গেলাস। গায়ে এতটুকু জলের দাগ লেগে থাকবে না। ভাতটাকে বেশ গুছিয়ে ঠাস ফুলকপির মতো করে দিতে হবে।
বাবা সোজা হয়েই দেখলেন সামনে বড়োমামা দাঁড়িয়ে। —আমি তাহলে আসছি। বাবা অবাক হয়ে বললেন—সে কী? এখুনি যাবে কী? খাওয়াদাওয়া করে দুপুরের দিকে যাবে। —না ছোড়দা, দুটোর মধ্যে মিলে পৌঁছোতে হবেই। চা, জলখাবার খেয়েছি। আমি আসি। বড়োমামা নীচু হয়ে প্রণাম করলেন।
—কীভাবে যাবে। বাবা একটু উদবিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন। —প্রভাতকে দোব তোমার সঙ্গে? বড়োমামা বললেন—না দরকার হবে না। দিদি তো কীরকম ঝিম মেরে আছে। চালালেই চলবে। টানা রিকশায় করে সোজা দমদম স্টেশনে চলে যাই, সেখান থেকে ট্রেন।
—ধর হঠাৎ যদি গোলমাল শুরু করে। বড়োমামা ফস করে বললেন—ফেলে রেখে পালাব। মাসিমার কানে গেছে—কী যে বলিস দাদা, ফেলে পালাবি কী করে! ছোড়দা ও ঠিক নিয়ে যাবে, কোনো গোলমাল হবে না।
—তাহলে একটা রিকশা ডাকার ব্যবস্থা হোক। বাবা বাইরের বারান্দার দিকে এগোতে লাগলেন। যাবার পথে জাঠাইমা যে—ঘরে রয়েছেন সেই ঘরের দিকে তাকালেন।
দরজার পাশটিতে জ্যাঠাইমা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন অন্ধকারে। ফর্সা একটা ধুতি পরেছেন। মাথায় ঘোমটা। মুখটা মোমের মতো সাদা। চোখের দৃষ্টি এত উদাস বলে না—দিলে সাধিকার চোখ বলে ভুল হবে। মাথার কালো কোঁকড়া চুল কপালের সামনে অল্প ঝুলে আছে। বগলে সেই বর্মা বেতের সুটকেস। ভেতরে আছে, জপের মালা, গৌরাঙ্গের ছবি, একখণ্ড গীতগোবিন্দ, জ্যাঠামশাইয়ের লেখা একগোছা পুরোনো চিঠি, নিকেলের সাবানদানিতে কয়েকটা আংটি, একটা সরু হার ছিঁড়ে টুকরো টুকরো, কয়েক গাছা চুড়ি। টুকিটাকি নানা জিনিস আছে ওই বেতের বাক্সে।
বড়োমামা ডাকলেন—চল দিদি, চল। জ্যাঠাইমা কলের পুতুলের মতো উঁচু চৌকাঠ ডিঙিয়ে বড়ো ঘরে এসে উদাস মুখে উত্তরের বারান্দার দিকে তাকালেন—আকাশ, নিমগাছ, রান্নাঘরের দিকের বারান্দার থামে একটা কাক, শিউলি গাছ ভাঙা পাঁচিলের গায়ে ফার্ন, তেলাকুচো, পেয়ারাগাছের একটা ঝুঁকে—পড়া ডাল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। পাতকোয় কেউ বালতি নামাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাতকোর গায়ে বালতি ঠুকে যাবার শব্দ হচ্ছে।
জ্যাঠাইমা এইবার অবাক হয়ে রেঙ্গুনের জ্যাঠাইমার বড়ো ছবিটার দিকে তাকালেন। চোখের পলক পড়ছে না। তাকিয়ে আছেন, তাকিয়ে আছেন। ছবিটার তলাতেই ক্যালেন্ডারের ছবি—গোরুর গলা জড়িয়ে বাঁশি হাতে শ্রীকৃষ্ণ। কী দেখছেন জ্যাঠাইমা? হেরে গেছেন। রেঙ্গুনের জ্যাঠাইমার আসনে বসতে পারলেন না।
বড়োমামা ডাকলেন—দিদি চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় রিকশা এসেছে। ঠুং ঠুং করে শব্দ করছে।
মাসিমা এসে জ্যাঠাইমার হাত ধরলেন— চলো। জ্যাঠাইমা ফ্যালফ্যাল মুখে অন্ধকার ঘরের দিকে তাকালেন। মাসিমা ধরে ধরে নিয়ে আসছিলেন। জ্যাঠাইমা কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলেন। যে—মুখে কোনো ভাব ছিল না সেই মুখই হঠাৎ বিরক্ত হয়ে উঠল।
বারান্দায় বেরিয়ে এসে উলটোদিকের বাড়ির ভাঙা ছাদের বড়ো বড়ো ঘাস গাছগুলোর দিকে তাকালেন। চেয়ারটাকে সিঁড়ির দিকে ঘুরিয়ে বাবা বসে আছেন। জাঠাইমা বাবার সামনে এসে দাঁড়ালেন। অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টি ঠান্ডা, মুখটা পাথরের মতো! খুব আস্তে বললেন—আমি আসছি।
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বাবা ভাবতেও পারেননি জ্যাঠাইমা এত ভদ্র, এত সুন্দর গলায় শুধু বিদায় চাইবেন। বাবা নিজের দুটো হাত এক করে শান্ত গলায় বললেন—যাও, ভালো হয়ে এসো, সেরে এসো। বাবু আমার কাছে রইল। জ্যাঠাইমা আর একটাও কথা বললেন না। ক্ষয়া ক্ষয়া চটিটা পরে, বেতের বাক্স বগলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শেষবারের মতো চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চি, মা দুর্গার ছবি, নিজের ঘর, বন্ধ কালো দরজার দিকে তাকালেন।
বাবু একটা ঝলঝলে ইজের, শরীরের তুলনায় বড়ো গেঞ্জি পরে জ্যাঠাইমার পেছনে পেছনে নামছে। জ্যাঠামশাইয়ের ছেলে তো! স্বভাবটাও ঠিক তাঁর মতো। সাতচড়ে রা করে না। চোখে জল টলটল করছে, তবু হাত—পা ছড়িয়ে বায়না ধরেনি—মা—র সঙ্গে যাবই। সিঁড়ির বাঁকটা ঘোরার সময় আমাকে একবার খালি বললে—আমাকে যেতে দাও না দাদাভাই। আমি যেন বাবার প্রতিনিধি! আমি ওকে ভোলাবার জন্যে বললুম—ধুস তুই কেন যাবি! বিমান দাদুর শ্রাদ্ধে কাল আমাদের নেমন্তন্ন, ভুলে গেছিস বুঝি? বড়ো বড়ো লুচি, ছোলার ডাল, লেডিকেনি। বাবু চুপ করে গেল। জ্যাঠাইমা নীচের গলিতে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বাড়িটা ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। অন্ধকার অন্ধকার, বন্ধ ঘরগুলোর দিকে বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে রইলেন। আমার দিকে বারকয়েক তাকালেন, কিছু যেন বলতে চান। হঠাৎ আমার কাছে সরে এসে বললেন—তোর মা আসছে রে! বড়োমামা রাস্তায় রিকশার কাছ থেকে বিরক্তিভরা গলায় বললেন—মহা মুশকিল হল তো, সীতা দিদিকে নিয়ে আয় না। জ্যাঠাইমা আর একটু কাছে সরে এসে বললেন—নুন একদম খাবি না, নুন খেলে মানুষ মরে যায়।
জ্যাঠাইমা ধীরে ধীরে রিকশার কাছে এগিয়ে গেলেন। মুখ তুলে বাড়িটাকে একবার ভালো করে দেখে নিলেন। বড়োমামা তাড়াতাড়ি বেতের বাক্সটা ধরে নিলেন। রিকশাওয়ালা সামনের পর্দাটা ফেলতে যাচ্ছিল, বড়োমামা বারণ করলেন। রিকশাটা ঠুং ঠুং করে এগিয়ে চলেছে। গালের ওপর দিয়ে কী—একটা গড়িয়ে গেল। আঙুল দিয়ে দেখলুম। এ কী আমিও কাঁদছি! রাস্তা থেকে দোতলার দিকে জানালার দিকে একবার তাকালুম। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন মূর্তির মতো। চোখ ফিরিয়ে নিলুম। সন্তোষদা একটু কুঁজো হয়ে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে দোকান থেকে নেমে আসছেন।
বাবার একগাদা জামাকাপড় গেঞ্জি লুঙ্গি নিয়ে মাসিমা পাতকো—তলায় বেশ ছড়িয়ে বসেছেন। ধুমধাম করে কাচা চলছে। বাড়িটা এখন কত শান্ত! বড়ো ঘরে দরজার সামনে প্রভাতকাকা একগাদা জ্যোতিষীর বই নিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে বসেছেন। নিজের কোষ্ঠী নিজেই বিচার করছেন। একটু আগে বাবুকে কথা দিয়েছেন বিকেলে সাইকেলের রডে বসিয়ে বহু দূরে বেড়াতে নিয়ে যাবেন।
দু—দিন পরে জ্যাঠাইমার ঘরে ঢুকেছি। মেঝেতে তেলা। ঠিক লাল নয় একটু সাদাটে। চুল ফাটা হয়ে গেছে। জ্যাঠাইমার জীবনসঙ্গী মাদুরটা গোল করে গুটিয়ে এক কোণে দাঁড় করানো। হাতপাখাটা আর এক কোণে। ইজিচেয়ারটা দু—ভাঁজ করে দেওয়ালে দাঁড় করানো। জ্যাঠামশাইয়ের কাচভাঙা ছবিটা দেওয়ালের একপাশে কাত হয়ে ঝুলছে। নখের আঁচড়ে জায়গায় জায়গায় সাদা হয়ে গেছে। আলমারির একটা কাচ ভেঙে গেছে। তালাটা লাগানো আছে। ভাঙা জায়গাটা দিয়ে গোটাকতক বড়ো বোতল ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে আছে। গৌরাঙ্গের ছবিটা যে জায়গায় ঝুলত, সে—জায়গাটা খালি, ঝুলের ফ্রেমে খানিকটা সাদা শূন্যতা অনেকদিনের একজনের চলে যাবার কথা ঘোষণা করছে।
বড়ো বড়ো দুটো জানালায় সোজা সোজা গরাদ। বাইরে মেঘলা আকাশ। মেঘের কোলে মেঘ, যেন সারি সারি পাহাড় আকাশের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাঠাইমার তেলচিটে বালিশটা একপাশে অনাদরে পড়ে আছে। জানালার গরাদে মাথা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম। দুপুরের রাস্তা প্রায় জনশূন্য। পাশের বাড়ির রেডিয়োতে রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে। আর দাঁড়ানো যায় না, বসে পড়লুম। মেঝেতে পাতলা ধুলো জমেছে। জানালার তলায় জল বেরোবার ফুটোর কাছে লাল পিঁপড়ে মাটি তুলেছে। সাদা সাদা ডিম—মুখে সারি বেয়ে কোথায় চলেছে। বোধহয় বাসা বদল করছে। কিংবা বৃষ্টি আসবে।
মেঝের সেই জায়গাটায় চোখ চলে গেল। গোটাকতক পেরেক পোঁতা রয়েছে। এ—ঘরটা মৃত্যুর ঘর। এই ঘরে মা, জ্যাঠাইমা, তার আগে হয়তো আরও অনেকে মারা গেছেন। শ্মশান থেকে ফিরে এসে একটি করে পেরেক মেঝেতে ঠোকা হয়েছে। এই নাকি নিয়ম। সাতটা পেরেক মেঝের সঙ্গে মিশে আছে। একটা মাথা ওরই মধ্যে একটু উজ্জ্বল। টাটকা মৃত্যু। ওইটাই বোধহয় জ্যাঠামশাইয়ের। এটা কার? এটা বোধহয় মায়ের জন্যে। পেরেকের মাথা যদি মানুষের মাথার মতো কথা বলতে পারত।
একটা ভিজে ভিজে গন্ধ নাকে এল। পাশের ঘরে দরজায় খিল দেবার শব্দ হল। ভিজে কাপড় দু—পাট করে সাধুদের মতো পরে মাসিমা এসেছেন। এক হাতে শুকনো শাড়ি, ব্লাউজ, শায়া। মাসিমা বোধহয় আমাকে দেখতে পাননি। গুন গুন করে কী—একটা গান গাইছেন। মেয়েদের কাপড় ছাড়া দেখতে নেই। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকি। কী বোকাই ছিলুম আমি। বছর দুয়েক আগে কী করে বীরের মতো বলেছিলুম—কিছু ভাববেন না জ্যাঠাইমা, মাসিমাকে কেউ বিয়ে না—করলে, আমি বিয়ে করব। সেই নিয়ে কত হাসাহাসি। এখনও মাঝে মাঝে মেয়েমহলে প্রসঙ্গটা ওঠে, আর আমি লজ্জা পাই। কেন বলেছিলুম কে জানে। মাসিমাকে সমবয়সি ভাবতুম বলে? নাকি আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন বলে। শ্যামনগরে গেলেই আমার হাতে ধরে বাগানে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরতেন, কখনো কুল, কখনো পেয়ারা পেড়ে দিতেন, কখনো কাঁদি থেকে ছিঁড়ে দিতেন পাকা কলা।
—কী রে বিল্টু? মাসিমা দেখতে পেয়েছেন। দুটো ঘরের মাঝের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। শায়ার দড়িতে ফাঁস লাগাচ্ছেন। শাড়িটা মেঝেতে পড়ে আছে। দড়ি বাঁধতে বাঁধতেই মাসিমা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পায়ের চেটোয় বিন্দু বিন্দু জল। পায়ের গোছের অনেকটা বেরিয়ে আছে। হালকা লোম জলে ভিজে জুড়ে আছে। একটা ঠান্ডা ভাপ মুখে এসে লাগছে। নাকে লাগছে সোডা সাবানের গন্ধ।
—এভাবে বসে আছিস কেন এখানে? মাসিমা হাঁটুগেড়ে আমার সামনে বসে পড়লেন। —মন খারাপ হয়েছে বুঝি! হাত দিয়ে মাথাটা বুকে টেনে নিলেন। বুক আর কোলের গরম নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। দু—হাত দিয়ে আমার মুখটা তাঁর নরম বুকে চেপে ধরতে ধরতে বলছেন—বল, আমাকে মা বল, বল, আমাকে মা বল। বুক আর কোলের মাঝখানে অদ্ভুত অজানা উষ্ণতা থেকে আমার মুখ মা উচ্চারণ করল। আর সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠল আমার মায়ের ফর্সা পানের মুখ টিকোলো নাক হিরের নাকছাবি। মাসিমা পাগলের মতো আমাকে চুমু খাচ্ছেন। আমার চোখের জলে ব্লাউজের সামনের দিকটা ভিজে গেছে।
দুপুরেই জ্বর এল, বাড়তে বাড়তে সন্ধের দিকে বেশ হাঁসফাঁস অবস্থা। পা—টা ফুলে ঢোল। আর চেপে রাখা গেল না। মাসিমা বললেন—তোর মতো বোকা আর ভীতু ছেলে পৃথিবীতে দুটো নেই। তুই বকুনির ভয়ে পায়ের কথা চেপে গেছিস। তবু আমি অনুরোধ করলুম—বাবাকে বলবেন না, উনি আসার একটু আগে আমি কোনোরকমে উঠে পড়তে বসে যাব।
—যাওয়াচ্ছি বাছাধন। গরম জল করে আনি, তারপর বরিক পাউডার দিয়ে কম্প্রেস। পেকে পুঁজ হয়ে গেছে রে। ছোড়দা আসার অপেক্ষায় বসে থাকলে তো চলবে না দেখছি। এখুনি একজন ডাক্তার দরকার। তখন তো ডাক্তারখানাও সব বন্ধ হয়ে যাবে। প্রভাতদারও পাত্তা নেই। মাসিমা ঘরবার করছেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
এদিকে বড়ো ঘরে আমাদের বিছানা হয়েছে। মশারিও পড়েছে। সন্ধ্যায় সাংঘাতিক মশা। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছি। কানে সব কিছুই আসছে। কেবল নিজের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। মালাদি একবার এসে অনেকক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে। গদাইদা গল্প শুনিয়ে গেছে। পিসিমা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে জ্যাঠাইমাকে গালাগাল দিয়ে গেছেন—জানো না সীতা মন্তর শক্তি ভীষণ শক্তি। মাসিমা পিসিমাকে এককথায় চুপ করিয়ে দিয়েছেন—দিদি নেই দিদির কথাও আর হবে না। এখন অন্য কথা।
মাসিমা আমার পাশে এসে কাত হয়ে শুয়ে আছে। একটা হাত আমার মাথায়। —কী করি বল তো বিল্টু। গরম জল করলুম কিন্তু বরিক আর তুলো খুঁজে পেলুম না রে। এতগুলো চাবির একটা চাবিতেও ও—ঘরের আলমারিটা খোলা গেল না। এ—চাবিগুলো কীসের বল তো। সেই সকালের আঁচলে বাঁধা চাবিগুলো নিয়ে মাসিমার আক্ষেপ। আমিই এখন মাসিমাকে ভোলাবার চেষ্টা করি—কিচ্ছু হবে না মাসিমা, কাল সকালেই সেরে যাবে। আমি পা—টা বরং বালিশের ওপর উঁচু করে রাখি। সরসর করে পুঁজটা নীচের দিকে নেমে যাবে। বাবা তো আমাকে বলেছেন—তুই মা মরা ছেলে, জীবনে তোকে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে।
মাসিমা কপালে হাত বুলোচ্ছিলেন। হাতটা থেমে গেল—দুপুরের কথা তুই বুঝি ভুলে গেছিস। আমাকে কী বলে ডেকেছিস! আমার কানটা তখন অন্যদিকে চলে গেছে—ঝোপঝাড়ে ঘেরা উত্তরের দিকের বস্তিবাড়ির সেই মহিলা সুর করে রামায়ণ পড়ছেন দাওয়ায় বসে, রোজ যেমন পড়েন—মৃগয়া করিতে রাজা করেন গমন। হস্তী ঘোড়া রাজার চলিল শতে শতে। মৃগ অন্বেষিয়া রাজা বেড়ান বনেতে।… অন্ধকের তপোবনে গেলেন তখন।… দিব্য সরোবরে দেখিলেন সেই স্থলে। অন্ধক মুনির পুত্র সিন্ধু নাম ধরে। কলসিতে ভরে জল সেই সরোবরে। কলসির মুখ করে বুকবুক ধ্বনি। রাজা ভাবে জলপান করিছে হরিণী।
মাসিমার হাতটা আমার কপালে খেলা করছে। মাসিমার নাকটা নামতে নামতে আমার কপালে এসে ঠেকেছে। আরও দূরে বোষ্টম বাড়িতে খোল করতাল বাজছে। এইবার সিন্ধু মরবে… শব্দভেদী বাণ শব্দ মাত্র হানে। পুত্রপরে বাণ পড়ে সেইক্ষণে। দশরথের কী অবস্থা। …মৃগের উদ্দেশে রাজা যান দৌড়াদৌড়ি। মৃগ নহে মুনি পুত্র যায় গড়াগড়ি। কে সিন্ধু। না আমি বাবু!— তোর জ্বরটা খুব বেড়েছে বিল্টু। দেখি কী করা যায়। দশরথ সিন্ধুর প্রাণহীন দেহ কাঁধে নিয়ে অন্ধক মুনির আশ্রমের দিকে চলেছেন। জয়মিত্রের কালী বাড়িতে সন্ধ্যারতির জগঝম্প বাজছে। অনেক অনেক বছর আগে, মা আর আমি আর আমার রেঙ্গুনের জ্যাঠাইমা শীতকালে এক সন্ধ্যায় আরতি দেখতে গিয়েছিলুম। দুজনেরই গায়ে একইরকম নীল সোয়েটার, পায়ে একইরকম ডোরাকাটা জুতো। এক বৃদ্ধা বলছেন—দেখ দেখ দু—বোনের একই বাড়িতে বিয়ে হয়েছে।
—টর্চটা ফ্যালো প্রভাত, হ্যাঁ হ্যাঁ আঙুলের ওপরে ফ্যালো। বাবার গলা না! ইস এতো সেপটিক হয়ে গেছে, মিস্টার চ্যাটার্জি! —এ কার গলা? ডক্টর জয়ন্ত সেন? সেই টুকটুকে সাহেব? মাকে দেখেছেন, জ্যাঠাইমাকে দেখেছেন। —টেম্পারেচার কত?—দেখা হয়নি! মাসিমার গলা, না মা—র গলা। —কী করেন? আপনারা সব এডুকেটেড লোক এরকম ইললিটারেটের মতো কাজ করেন কেন? ছেলেপুলের বাড়িতে একটা থার্মোমিটার অবশ্যই রাখবেন। দেখি টর্চটা আমার হাতে দিন।
বেশ আরাম লাগছে। আঙুলের মাথায় গরম সেঁক। জল গড়াচ্ছে বুড়ো আঙুলের পাশ দিয়ে। আমি একবার বৃষ্টির পরের দিন, পাশের ঘাসে—ঢাকা মাঠে জমে—থাকা জলের ওপর দিয়ে হেঁটেছিলুম। তখন আমার এইরকম লেগেছিল। পেটা ঘড়িতে ক—টা বাজছে… এক, দুই, তিন … বারোটা।—নার্ভাস হবার কিছু নেই সীতা, ডোন্ট গেট নার্ভাস। ওরকম একটু—আধটু হবেই। শরীর থাকলেই তার খাজনা দিতে হবে। এসেছে যখন ভবে থাকার মাসুল দিতে হবে। একটু ঘুম, একটু তন্দ্রা, যন্ত্রণা কখনো কম, কখনো বেশি। কোথাও তো আলো নেই। কোনো শব্দ নেই। আমি কি ঠিক শুনছি, বাবার গলাই তো—অনেক রাত হল, অনেক সেবা করেছ, ঘুমুচ্ছে, তুমি এইখানেই এবার শুয়ে পড়ো সীতা!—বালিশ? মাসিমারই তো গলা।—এই তো আমার হাতে মাথা রাখ। —ওরা? ওরা কোথায়! সবাই তো ঘুমাচ্ছে। কে হাসছে! কার হাসি। আর তো আমার জেগে থাকা উচিত নয়।
দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির ন্যাড়া ছাদে। খুব রাত। কাচের মতো ঝকঝকে নীল আকাশ কত নীচে নেমে এসেছে। ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে অসংখ্য তারা। খুব শীত করছে যেন। সামনের বাড়ির ছাদে প্রাণধনবাবু। এক মাথা সাদা চুল। হাতে ম্যাপ পয়েন্ট আউট করার সেই সরু লাঠিটা। ইউ বিল্টু। লুক হিয়ার। তাকাও ওপরে। এটা কী কনস্টিলেশন? দাঁড়াও ঘড়িটা দেখি। রাত আড়াইটে। এটা হল কালপুরুষ। মৃগয়ায় বেরিয়েছে। এই দ্যাখো মাথা। একটা তারার গায়ে সরু লাঠিটা ঠেকালেন, লাঠির মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠল। এই দ্যাখো কোমরের বেল্ট। এই দ্যাখো ধনুক। প্রত্যেকটা তারার গায়ে সরু লাঠিটা ঠেকাচ্ছেন আর প্রতিবারই লাঠির মাথাটা জ্বলে জ্বলে উঠছে। অ্যান্ড দিস ওয়ান ইজ লুব্ধক। শিকারি কালপুরুষের ফেথফুল ডগ। এইবার লাঠিটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আর সেই আলোতে দেখলুম ছাদের আর এক কোণ থেকে হর্ষবাবু বাঘের মতো এগিয়ে আসছেন—হু আর ইউ, আপনি দেখাবার কে! আমি হেডমাস্টার, আমি দেখাব। হোয়্যার ইজ দি স্টিক? স্কুলের লাঠি আপনি পুড়িয়েছেন। আপনাকে আমি নিল—ডাউন করে রাখব। লুক হিয়ার বিল্টু। আমি হাত দিয়েই দেখাচ্ছি। এই হল শিকারি কালপুরুষ, মৃগয়ায় বেরিয়েছে। দেখি ক—টা বাজল! আড়াইটে। এই হল মাথা। হাতটা তুলতেই আকাশটা সরতে আরম্ভ করল। হর্ষবাবু ভীষণ চেষ্টা করছেন আকাশ ছোঁবার কিন্তু ক্রমশই ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। হর্ষবাবু চেষ্টা করছেন আকাশ ছোঁবার। এরিয়ালের বাঁশটা খুলে নিয়ে লেংচে লেংচে আকাশের গায়ে ঠেকাবার চেষ্টা করছেন——লুক হিয়ার বিল্টু লুক হিয়ার। হর্ষবাবুর রকম দেখে প্রাণধনবাবু খুব হাসছেন, মাথার সাদা চুল কপালের চারপাশে ঝুলছে।
উঠতে উঠতে আকাশটা আকাশের চেয়েও দূরে চলে গেল। প্রাণধনবাবু আর হর্ষবাবু হাত—পা নাড়া পুতুল—নাচের পুতুলের মতো ছাদের আলসেতে ঝুলে পড়লেন। দৃশ্যটা হারিয়ে গেল। এ আমি কোথায়! রাজবাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। একেবারে নদীর ধারে। বিশাল ছাদ। দূরে আলসের ধারে নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে কে! —মা তুমি! —ওই দ্যাখ বিল্টু পালতোলা নৌকা করে আমার রাজা চলে যাচ্ছে মৃগয়ায়! হাঁসের মতো সাদা পাল তুলে ময়ূরপঙ্খী ভেসে চলেছে নীল জলে। —তুমি আমার মা। তাই তো। তাহলে মাসিমা কী করে মা হয়। —দুর পাগল, ছানা ছাড়া রসগোল্লা হয়? তুইও যেমন। দাঁড়া বলে দিই, তা না—হলে আবার ভুল করবে। মা চিৎকার করে বলছেন—হরিণ ভেবে অন্ধক মুনির ছেলেকে যেন মেরো না, তাহলে রামকে বনবাসে যেতে হবে।
হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাবার গলাই যেন শুনলুম—তা নাহলে তুমি পুত্রবতী হবে কী করে।
মা যেন থতোমতো খেয়ে গেলেন। আমার দিকে তাকালেন। মুখে হঠাৎ হাসি খেলে গেল—সেই অসাধারণ গালে টোল খাওয়ানো হাসি। একটা হাত এগিয়ে এসে আমার মাথা স্পর্শ করল। অনামিকায় সেই পোখরাজের আংটি। আর একটা হাত মুখের পাশে রেখে খুব জোর গলায় বললেন—আমি তো পুত্রবতী। এই তো আমার পুত্র, তুমি ফিরে এসো।
বহু দূর থেকে বাবার গলা ভেসে এল, বড়ো করুণ গলা—আমি যে বেরিয়ে পড়েছি তুলসী।